Quantcast
Channel: বিজ্ঞান – Bigyan
Viewing all articles
Browse latest Browse all 305

খেলাচ্ছলে প্রোগ্রামিং –২

$
0
0

 

sayaminduMIT মিডিয়া ল্যাব-এর সায়মিন্দু দাশগুপ্তর সাথে আমরা এক আলোচনায় বসলাম। সেই আলোচনায় উঠে এলো তাদের একটা বিশেষ প্রজেক্টের কথা: কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখাকে কিভাবে মজাদার করা যায়। আগের পর্বে আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম প্রোগ্রামিং শেখা থেকে কেন অনেক শিশুই বিরত থাকতে চায়। দেখা গেল, দুর্বোধ্য ভাষা, ভাষার প্রয়োগে ব্যক্তিগত ইচ্ছার অনুপস্থিতি আর ইস্কুলের বাঁধাধরা নিয়মে শেখানো, এই তিনে মিলে প্রোগ্রামিং শেখাকে তেতো ওষুধ গেলার মত করে দিয়েছে। এই সমস্যার সমাধান করতে এমন এক ভাষার খোঁজ করা হলো যেটা শেখা যাবে চটপট, একবার শিখলে যা-ইচ্ছে-তাই করা যাবে আর যার যেভাবে শিখতে ইচ্ছে, সে সেইভাবে শিখতে পারবে। তৈরী হলো একটা নতুন প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা – স্ক্র্যাচ। সেই ভাষার কিছু ঝলক আমরা দেখেছিলাম আগের পর্বে। কিভাবে এই নতুন ভাষা সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করলো, সেটা দেখব এই পর্বে। লিখেছে অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়

 

তুন ভাষাটার সাফল্য এখানেই যে সেটা এই তিনটে জিনিসই মাথায় রাখতে পেরেছে। বিশেষ করে তৃতীয়টা — ভিন্ন শিক্ষার্থীর ভিন্ন শেখার স্টাইলকে জায়গা দিতে পেরেছে। সায়মিন্দুর কথায় — “যার ছবি আঁকতে ঝোঁক, সে ছবি আঁকতে আঁকতে কিছু প্রোগ্রামিং শিখে নিল। যার প্রোগ্রামিংয়ের শখ, সে একটু ছবি এঁকে নিল।” দুজনেই কিন্তু ভবিষ্যতের আই.টি. সেক্টরের কর্ণধার হওয়ার কথা ভাবছে না। নিজের মধ্যে সুপ্ত একটা খুদে স্রষ্টা কি শিল্পীকে বাইরে টেনে আনছে মাত্র। তাদের যেটা ভালো লাগে, এমন কাজের মাধ্যমে শিখছে তারা — তা সে গেম বানানোই হোক কি গল্প বলাই হোক। কোন দুঃখে একটা হ-জ-ব-র-ল ভাষা শেখার চেষ্টা করছি, সেই প্রশ্ন তাদের মাথাতেও আসছে না।

ব্যাপারটা সহজ ভাবে বোঝাতে কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক:

  • একবার একটা ১৩ বছরের ছেলে একটা গেম বানিয়েছিলো, কিন্তু কিভাবে স্কোর রাখবে সেটা বুঝতে পারছিল না। ‘স্ক্র্যাচ’ টীম-এর এক প্রফেসর তাকে শেখালো ‘স্ক্র্যাচ’-এ ভেরিয়েবিল কি করে বানাতে হয়। ছেলেটা তো মহা খুশি, প্রফেসরকে ধন্যবাদের বন্যায় ভাসিয়ে দিল। পরে প্রফেসর ভাবছিলেন, এরকম কস্মিনকালেও হয়েছে কি যে বীজগণিত ক্লাসে ভেরিয়েবিল শিখে ছাত্র এতটা খুশি হয়ে গেছে!

  • jamini_roy_projectকিম্বা ধরা যাক, যামিনী রায় স্টাইলে পেইন্টিং নিয়ে এই প্রজেক্টটা। দেখা যাচ্ছে, স্রষ্টার আঁকার দিকে ঝোঁক বেশি (এবং আঁকার হাতটাও দিব্যি)। ‘স্ক্র্যাচ’-এর নির্মাতারা বলে, হোক না, তাতে ক্ষতি কি? যে যেভাবে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, সেইদিক থেকেই আসুক না! এমন আঁকার হাত যার, তাকে ক্লাসে জায়গা দেওয়া হবে না, এ কেমন কথা?

  • center_of_earth_projectএই প্রজেক্টটা বানিয়েছে বেঙ্গালুরুর একটা ছেলে। ভূগোল ক্লাসে সে শিখেছিল পৃথিবীর নিচে অনেকগুলো স্তর আছে, যারা একে অপরের সাপেক্ষে নড়াচড়া করে। এটা শুনে তার মনে কি ভাব জেগে উঠলো, সেটা সে মহা উৎসাহের সাথে সবাইকে বললো এই অ্যানিমেশনটার মাধ্যমে। মিউজিক, নেপথ্য-কন্ঠ, আরো নানান খুঁটিনাটি দিয়ে ভরাট এই অ্যানিমেশনটা একটা বারো বছরের ছেলে বানিয়েছে, এটা ভাবলেই অবাক লাগে!

  • এখানে দেখতে পাবেন, নানারকম উৎসবের একটা সংকলন। বাচ্চারা দেদার আনন্দে বছরের প্রিয় সময়গুলোর কথা বয়ান করেছে এখানে।

festivals project

অতএব দেখতেই পাচ্ছেন, কম্পিউটার ল্যাবে সপ্তাহে এক কি দু ঘন্টার পিরিয়ডে যা শেখা যায়, তার থেকে অনেক জটিল জিনিস শিখছে এই শিশুরা! শিখতে পারছে, কারণ তারা এমন কিছু একটা তৈরী করছে, যার একটা গভীর অর্থ আছে তাদের কাছে!


এছাড়া, ভাষাটাও যত কম খটমট করা যায়, তার চেষ্টা করা হয়েছে। যাকে বলে সিনট্যাক্স এরর বা ব্যাকরণের গলদ, সেগুলো করা খুব কঠিন। ব্লকগুলো খাপে খাপে না বসলেই আপনি বুঝে যাবেন, কোথাও গোলমাল করছেন। যেমন, যেসব ব্লক নির্ধারণ করে কাজগুলো কখন বা কতবার হবে, তারা হাঁ করে থাকে, যাতে তাদের হাঁ করে থাকা মুখে সেই কাজের ব্লকগুলোকে গুঁজে দেওয়া যায়।

code_blocks

আরেকটা জিনিস নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন। এইসব ব্লকে একটা ষড়ভুজ আকারের খোপ আছে। সেখানে বসবে যাকে বলে কন্ডিশন বা শর্ত। যে শর্ত পূরণ হলে ওই হাঁ করে থাকা ব্লকের ভিতরের কাজগুলো শুরু বা শেষ হবে। এবার ওই ষড়ভুজ আকারের খোপে আরেকটা ষড়ভুজ আকারের ব্লককেই বসানো যায়, যাকে তাকে বসানো যায়না। আমরা যারা প্রোগ্রামিং করেছি, তারা জানি শর্তটা একটা হ্যাঁ-না প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে আসবে। যাকে বলে বুলিয়ান ভ্যালু। হ্যাঁ-না প্রশ্নের ব্লকগুলো করা হয়েছে ষড়ভুজ আকারের, যাতে খাপে খাপে বসে যায় ওই লুপ ব্লকের ষড়ভুজ খুপড়িতে।

conditional_blocks

দেখতেই পাচ্ছেন, সিনট্যাক্স এরর করা, অর্থাৎ ভাষার নিয়ম ভাঙ্গার জো-টি নেই। জমিটা কতটা নিচু দেখতে পাচ্ছেন তো নিশ্চয়ই।

তাছাড়া, ইংরিজি হরফ পড়তে পারে না অথচ প্রোগ্রামিং শিখতে বসেছে, এমন কাউকে দেখেছেন কি? ‘স্ক্র্যাচ’ যেহেতু ছবির উপর কিছু নির্দেশ মাত্র, নির্দেশগুলোকে অনুবাদ করলেই অন্য যেকোনো ভাষায় ‘স্ক্র্যাচ’ শেখা যায়! এবং অনুবাদ হয়েওছে অনেক ভাষায়। ইংরাজি না জানাটা প্রোগ্রামিং শিখতে আর কোনো বাধাই নয়!

এসবের পরেও আটকে গেলে উদ্ধার করার জন্য বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ খুদে শিক্ষক রয়েছে। আবার অপরদিকে ফাটাফাটি কিছু নামিয়ে দিলে তারিফ করার লোকেরও অভাব নেই। যেহেতু পুরো খেলাটাই, থুড়ি কোডিংটাই অনলাইন করা হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ার সব হাতিয়ারই মজুত রয়েছে। শেয়ার, কমেন্ট, রি-শেয়ার এবং প্রত্যেকটা প্রজেক্টই যেহেতু ওপেন-সোর্স, তাতে নিজের মত রিমিক্স করা — সবই চলে ‘স্ক্র্যাচ’-সমাজে। এবং শেয়ার করাকে রীতিমত উৎসাহ দেওয়া হয়। যেসব প্রজেক্টকে সবথেকে বেশি লোকে আপন করে রি-শেয়ার করে, তাদের হোমপেজে ফীচার করা হয়। ইন্টেলেকচুয়াল সম্পত্তি মিছিমিছি আগলে রাখার প্রবণতা যাতে না গড়ে ওঠে, সেদিকে সজাগ থেকেছেন ‘স্ক্র্যাচ’-এর স্রষ্টারা।

শিশুদের জগতে এমন বাস্তবজীবনের প্রস্তুতি সাধারণ স্কুলের বাঁধাধরা কারিকুলামের মধ্যে সম্ভবই নয়।

এর একটা অপ্রত্যাশিত প্রভাব দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কোলাবরেশন বা যৌথ উদ্যোগ, শিক্ষার জগতে যেটা প্রায় নেই বললেই চলে। সায়মিন্দুর কথায়, “আমাদের শিক্ষাটা আসে উপর থেকে — বয়স্ক, অভিজ্ঞ শিক্ষকদের থেকে। সমবয়েসীদের কাছে যে শেখার সুযোগ আছে, আমরা সেটা ভেবেই দেখিনা। অথচ, বড় হলে তখন কোলাবরেশনের জয়জয়কার।” এই কোলাবরেশনের কিছু অভাবনীয় দৃষ্টান্ত দেখা গেছে ‘স্ক্র্যাচ’-সমাজে। যেমন, ইংল্যান্ড-এর একটা পনের বছরের মেয়ে কিছু মজাদার অ্যানিমেশন বানালো। তাই দেখে ইংল্যান্ডেই একটা দশ বছরের মেয়ে তাকে অনুরোধ জানালো, আমার প্রজেক্টের জন্য একটা ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরী করে দাও প্লিজ। দুজনে মিলে একটা “কোম্পানি” খুলে বসলো, যাদের দাবি তারা উচ্চ মানের ভিডিও গেম বানিয়ে দিতে পারে। তাতে যোগ দিল, আমেরিকার নিউ জার্সিতে থাকা চোদ্দ বছরের একটা ছেলে। তার প্রোগ্রামিংয়ের ক্ষমতা দিয়ে সে জায়গা করে নিল কোম্পানিতে। শিশুদের জগতে এমন বাস্তবজীবনের প্রস্তুতি সাধারণ স্কুলের বাঁধাধরা কারিকুলামের মধ্যে সম্ভবই নয়।

কম্পিউটার যে একদিন বাঁধাধরা কারিকুলামকে ছিন্নভিন্ন করে শিক্ষার জগতে নতুন পথের নির্দেশ করবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন MIT মিডিয়া ল্যাবেরই কিছু পথিকৃত। সিমোর প্যাপার্ট তার মধ্যে অন্যতম। ‘স্ক্র্যাচ’ হয়ত সাম্প্রতিক একটা ঘটনা, কিন্তু তার গোড়াপত্তন করে গেছিলেন প্যাপার্ট। প্যাপার্টের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা থেকেই আজকের এই নতুন শিক্ষাপ্রদানের মাধ্যমে আসা গেছে। তবে তার কথা আরেকদিন বলবো। আপাতত স্ক্র্যাচ-এর দুনিয়ায় ছেড়ে দিলাম আপনাদের। দেখুন তো, যে গল্পটা এদ্দিন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেটাকে স্ক্র্যাচের সাহায্যে বলতে পারেন কিনা।

তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:

[১] সায়মিন্দুর সাথে আলোচনা ছাড়াও এখান থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রচ্ছদের ছবিটিও এখান থেকে গৃহীত।

[২] স্ক্র্যাচে একটা নতুন প্রজেক্ট খুলে কোনো নির্দেশ ছাড়াই খুটখাট করতে করতে ভাষাটা শিখে যেতে পারেন। কিন্তু যদি নিতান্তই শুরু করিয়ে দিতে একটু নির্দেশের প্রয়োজন হয়, এখান থেকে শুরু করতে পারেন।

[৩] যদি বাবা-মা হিসেবে আপনার সন্তানের জন্য স্ক্র্যাচের কথা ভাবেন আর মনে কিছু প্রশ্ন থাকে, এখানে দেখুন।

[৪] যদি শিক্ষক হিসেবে আপনার ছাত্রদের জন্য স্ক্র্যাচের কথা ভাবেন আর মনে প্রশ্ন আসে যে একা পড়ে যাবেন কিনা, এখানে দেখুন। বিশ্বজুড়ে শিক্ষকেরা কিভাবে স্ক্র্যাচকে ব্যবহার করছেন, তার গল্প জানতে পারবেন। যদি আপনার কোনো ছাত্র স্ক্র্যাচের সাহায্যে দারুণ কিছু বানিয়ে ফেলে, আমাদের ইমেল করে জানাবেন (ইমেইল: bigyan.org.in@gmail.com)।


Viewing all articles
Browse latest Browse all 305

Trending Articles



<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>