Quantcast
Channel: বিজ্ঞান – Bigyan
Viewing all 305 articles
Browse latest View live

যাত্রা শুরু ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র !

$
0
0

 সম্পাদকমন্ডলী, ‘বিজ্ঞান’

বাংলায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের পত্রিকা ‘বিজ্ঞান’ তার পথচলার প্রথম দেড় বছর পূর্ণ করল। মাত্র আঠারো মাস হয়তো কোন পত্রিকার সাবালক হওয়ার পক্ষ্যে যথেষ্ঠ নয়। কিন্তু তাও একটু একটু করে আমরা এগিয়েছি বেশ অনেকটাই। সে কাজ সম্ভব হত না এত উৎসাহী গবেষক-লেখক, স্বেচ্ছাসেবী এবং সর্বোপরি পাঠকদের সাথে না পেলে।

সমাজের উন্নতিতে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রয়োজন বিতর্কের অতীত। তার জন্য দরকার সেই সমাজের নিজের ভাষায় বিজ্ঞান আলোচনার পরিবেশ। বিজ্ঞান প্রকৃতির ভাষা বোঝার চেষ্টা করে। সুবিধের খাতিরে গবেষণার কাজ আমরা ইংরাজী ভাষায় প্রকাশ করি, কারণ আন্তর্জাতিক স্তরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখতে এর বিকল্প এখনো নেই।  কিন্তু সেই গবেষণার কথা আমরা কোন স্কুলে পড়া ছাত্রছাত্রীকে তার মাতৃভাষায় বোঝাতে পারব না কেন? আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রা আর সমস্যার কথা না জানলে ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তকের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আর ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের আনন্দযজ্ঞের শরীক না হলে সেই সমাজ ভবিষ্যতে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ হিসেবে গড়ে উঠবে এমন আশা না করাই ভাল। এই উদ্দেশ্যে অনেক বিজ্ঞানী মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের জনপ্রিয়করণের কাজ করে যান। ‘বিজ্ঞান’ সেই প্রচেষ্টাকে আরো অনেক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম।

কোন বিষয়কে সহজ করে অথচ নির্ভুলভাবে বোঝাতে পারা খুব শক্ত। তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সেই বিষয় সম্বন্ধে নিজের পরিচিতি, অনেক ভাবনাচিন্তা। ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত বেশিরভাগ লেখাই লিখেছেন এমন লেখক যারা সরাসরি গবেষণার সাথে যুক্ত, বা সেই বিষয় নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছেন। লেখাগুলি প্রকাশিত হওয়ার আগে সেই বিষয়ের গবেষকদের মতামত নেওয়া হয়েছে, যাতে যথাসম্ভব সঠিকভাবে এবং সহজভাবে বিষয়গুলির অবতারণা করা যায়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা এত বাঙালী গবেষকদের এক মঞ্চে এনে এমন আড্ডার নিদর্শন খুব বেশী নেই। BIGYAN PATRIKA 01_cover

‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত লেখাগুলির মধ্যে থেকেই বাছাই করা কিছু লেখার সংকলন নিয়ে হাজির ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’। আপাতত তিনমাসে একবার করে এটি প্রকাশিত হবে ‘বিজ্ঞান’-এর ওয়েবসাইটেই। আমাদের আশা পাঠকেরা এই পিডিএফ পত্রিকাটি ভাগ করে নেবেন অনেকের সাথে। বিশেষত স্কুলের মাষ্টারমশাইরা যদি ছাত্রছাত্রীদের জন্য রীডিং-বোর্ডে এই পত্রিকাটির প্রিন্ট আউট প্রদর্শন করেন তাহলে আমাদের প্রচেষ্টা অনেকাংশে সার্থক হবে। পত্রিকাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পেতে bigyan.org.in@gmail.com -এ ইমেইল করুন। আর যারা ‘বিজ্ঞান’-এর লেখাগুলির নিয়মিত পাঠক তারা আরেকবার পড়ে নিন লেখাগুলো! ইমেইলে মতামত জানাতে ভুলবেন না।

ভারতের শিক্ষক দিবসে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যায় রইল কিছু অত্যাশ্চর্য বিষয়ের কথা – যেমন মোমাছির অবিশ্বাস্য নাচ, বৃষ্টিভেজা মনকেমন করা সোঁদা গন্ধের বৈজ্ঞানিক কারণ, আলো দিয়ে পদার্থকে ঠান্ডা করার রহস্য, গাছেদের জগতে হিংসে-মারামারির কাহিনী ইত্যাদি। সেই সাথে থাকছে কিছু ইতিহাস, বিজ্ঞানের খবর, ধাঁধা ইত্যাদি।

আসুন, ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র সাথে আরেকবার বিজ্ঞানের মজা উপভোগ করি, মাতৃভাষা বাংলায়!

 

‘বিজ্ঞান পত্রিকা’ ডাউনলোড করুন

 

 

প্রচ্ছদের কোলাজ ও ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র নকশা – সূর্যকান্ত শাসমল

 


পেখম রহস্য

$
0
0

অনিন্দিতা ভদ্র
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চ, কলকাতা

বর্ষার গান মানেই মেঘের গুরু গুরু, অন্ধকার আকাশ, ভিজে মাটির গন্ধ, আর ময়ূরের অপরূপ পেখম নৃত্য। আমাদের জাতীয় পাখির সাজসজ্জায় মুগ্ধ হয় না এমন মানুষের সংখ্যা বিরল।

ছোটবেলায় আর সব বাচ্চাদের মতো আমিও ভাবতাম বুঝি সব ময়ূরই সুন্দর, সবার পেখম আছে, সবাই নাচে। কিন্তু যখন প্রথমবার একটা চিড়িয়াখানায় ময়ূর-ময়ূরী দেখলাম, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি যে দুটোই একই পাখি আসলে। আরো অবাক হয়েছিলাম এটা শুনে যে সুন্দর লেজওয়ালা পাখিগুলো ছেলে (পুরুষ) পাখি, আর খারাপ দেখতে পাখিগুলো মেয়ে!

পশুপাখীদের মধ্যে বেশীর ভাগ প্রজাতিতেই পুরুষরাই বেশী আকর্ষণীয়। প্রশ্ন হল, কেন এমন হয় ?

আরো বড়ো হলাম যখন, জানলাম যে অধিকাংশ পাখিদের মধ্যে পুরুষ পাখিরাই বেশী সুন্দর। যে সব পাখি গান গায়, তাদের মধ্যেও পুরুষরাই  সুরেলা। একটু চোখ মেলে চারিদিকে তাকালেই দেখা যাবে, পশুপাখীদের মধ্যে বেশীর ভাগ প্রজাতিতেই পুরুষরাই বেশী আকর্ষণীয়। ঝিঁঝিঁর ডাক থেকে শুরু করে কোকিলের গান, ময়ূরের পেখম থেকে হরিণের লম্বা, বাঁকানো শিং, সবই পুরুষজাতির অলংকার। এই সব প্রজাতিতে মহিলাদের সাজগোজের প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন এমন হয়?

১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন যখন তাঁর বিবর্তন তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন, তাঁর ঐতিহাসিক রচনা, ‘দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’-এ তিনি লিখেছিলেন যে তাঁর তত্ত্ব খাটে না শুধু দুটি ক্ষেত্রে।

এক হলো মৌমাছি, পিঁপড়ে, বোলতা এই জাতীয় প্রাণী। এদের নিয়ে তিনি বিব্রত, কারণ জগতের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি প্রাণী প্রজনন করে তার নিজের বংশ বৃদ্ধি করে, কিন্তু মৌমাছিরা তা করে না। হাজার হাজার মৌমাছি মিলে শুধু একজন রাণীর জন্য বেগার খাটে কোনো অজানা কারণে। কেন মৌমাছি, পিঁপড়ে, বোলতা বা উইপোকাদের এরকম অদ্ভুত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করেছিলেন উইলিয়াম হ্যামিল্টন, ১৯৬৪-এ। কিন্তু এখন বলব অন্য গল্প, ডারউইন সাহেব যা শুরু করেছিলেন দেড়’শ বছর আগে। সেই গল্পের নায়ক হলো আমাদের জাতীয় পাখি, ময়ূর।

ডারউইন সাহেব তাঁর এইচ. এম. এস. বিগলের সফরে অনেক রঙবেরঙের পাখি দেখেছিলেন। পুরুষ পাখিদের সাজ, যা অনেক সময় একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশী হয়ে ওঠে, ডারউইনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। রঙবেরঙের পালক দেখতে অপূর্ব তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই রঙ তৈরী করতে খরচা আছে, আর তার রসদ আসে পাখির নিজের শরীর থেকেই। শুধু তো রঙ নয়, ময়ূরের পেখম অস্বাভাবিকরকম লম্বাও। আর তাই উড়তে পারে না ময়ূর, নেকড়ের তাড়া খেলে নিজেকে বাঁচাতেও পারে না। অথচ ময়ূরীকে দেখ, কোনো সাজ নেই, বাহার নেই, মাপেও ছোটখাটো। দিব্যি তো বেঁচে বর্তে রয়েছে তারাও।

এই ধরণের উদাহরণ অসংখ্য, বিশেষ করে পাখিদের মধ্যে। ডারউইন সাহেব এদের জন্য তৈরী করেছিলেন আরো একটি তত্ত্ব – থিওরি অফ সেক্সুয়াল সিলেকশন। তিনি বলেছিলেন, এই পাখিদের সাজ শুধুই প্রমিলাদের মুগ্ধ করতে, অর্থাৎ এর মূলেও রয়েছে সেই বংশ বিস্তারের প্রাকৃতিক তাড়না। শুধু তো নিজে সাজলেই চলবে না, দেখতে হবে যাতে সেই সাজ অন্য সবার সাজকে ছাপিয়ে যায়। তাই আরো, আরো উজ্জ্বল রঙ চাই, আরো লম্বা লেজ চাই, বা আরো সুরেলা, কঠিন গান চাই। এইভাবেই, নিজেদের মধ্যে সবসময় প্রতিযোগিতা চালিয়ে যায় পুরুষরা, আর সবথেকে সুন্দর পুরুষদের ভাগ্যে জোটে সবচেয়ে ভালো সঙ্গিনী – ভালো সঙ্গিনী মানে, যার প্রজনন ক্ষমতা বেশী। সুতরাং যে পুরুষ যত বেশী সুন্দর, তার বংশ বৃদ্ধিও হয় তত বেশী। অতএব, আবার সেই ন্যাচারাল সিলেকশন-এর খেলায় ময়ূরের পেখমের বাহার ছড়ায়। এই যুক্তির রেশ টেনে ডারউইন সাহেব বলেছিলেন, যে সব প্রজাতির স্ত্রীরা তাদের পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করবে, সেই সমস্ত প্রজাতির পুরুষদের মধ্যেই দেখা যাবে মনোহরণের আড়ম্বর।

ময়ূরের পেখম অস্বাভাবিকরকম লম্বা। আপাতদৃষ্টিতে শরীরের যে গঠনকে দেখে আমাদের মনে হয় প্রতিবন্ধকতা, তা আসলে ময়ূরের স্বাস্থ্য আর ক্ষমতার পরিচয়। (ছবির উৎস)

 

ডারউইনের এই দ্বিতীয় তত্ত্বটিকে অনেকেই উপেক্ষা করেছেন। কেউ কেউ খোলাখুলি এর বিরুদ্ধে যুক্তিও দিয়েছেন। ডারউইনের সেক্সুয়াল সিলেকশন তত্ত্বের সাথে ১৯৭৫ সাল থেকে জুড়ে গেছে আরো এক তর্কের সূত্র – জাহাভির হ্যান্ডিক্যাপ প্রিন্সিপল (প্রতিবন্ধকতা নীতি)। আমোত্স্ জাহাভি (Amotz Zahavi) একজন ইজরায়েলী বৈজ্ঞানিক। ময়ূরের পেখমকে ঘিরে যে প্রবল মতবিরোধ চলে আসছিল বহু বছর ধরে, জাহাভি তাতে যোগ করেন আর একটি দিক। তিনি বলেন যে ময়ূরের পেখম নেকড়ের হাত থেকে বাঁচার পথে প্রতিকূল বলে তা প্রতিবন্ধকতা ঠিকই, কিন্তু যে পাখি সেই প্রতিবন্ধকতা নিয়েও বেঁচে থাকতে সক্ষম, সে অবশ্যই ময়ূরীদের কাছে সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে শরীরের যে গঠনকে দেখে আমাদের মনে হয় প্রতিবন্ধকতা, তা আসলে ময়ূরের অনেস্ট সিগনাল, যা তার স্বাস্থ্য আর ক্ষমতার পরিচয়। ময়ূরের পেখমের বাহার স্বয়ম্বরা ময়ূরীদের কাছে পাত্র হিসেবে তার যোগ্যতার অকপট সংকেত পৌঁছে দেয়। সুতরাং, এই প্রতিবন্ধকতাকে ন্যাচারাল সিলেকশন জিইয়ে রাখে, আরো মেজে ঘসে সুডৌল করে তোলে। জাহাভির প্রতিবন্ধকতা নীতি বৈজ্ঞানিক মহলে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বলাই বাহুল্য যে এরকম একটা সুন্দর গোল গল্প অনেকেই মেনে নিতে রাজী হননি। কিন্তু পশুজগতে এই নীতি আদৌ সত্যি কিনা, তা কেউ যাচাই করে দেখেননি দুই দশক ধরে।

পেখমের মধ্যে শুধু ময়ূরীরা রঙের বাহারই খোঁজে না, তার সাথে খোঁজে সমতা।

১৯৭৫-এ যে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল জাহাভির জার্নাল অফ থিওরেটিকাল বায়োলজিতে ছাপানো বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ দিয়ে, ১৯৯১ সালে এনিম্যাল বিহেভিয়ার-কে পাঠানো মারিয়ন পেট্রির একটি কাজ তার মিমাংসার পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বৈজ্ঞানিক মহলে প্রকাশ পেল। লন্ডনে বসে একদল ময়ূর-ময়ূরীর ওপর গবেষণা চালাচ্ছিলেন পেট্রি ও তাঁর সহকর্মীরা। ১৯৯১ থেকে শুরু করে ১৯৯৬ পর্যন্ত পর পর কয়েকটি পেপার ছাপা হয় এই গবেষক দলটির। তাঁরা প্রমাণ করেন যে সবচেয়ে লম্বা আর বাহারে পেখম যে ময়ূরদের, তাদেরকেই পছন্দ করে ময়ূরীরা। আরো জানা যায় যে পেখমের মধ্যে শুধু ময়ূরীরা রঙের বাহারই খোঁজে না, তার সাথে খোঁজে সমতা বা সিমেট্রি। অতএব, পেখম মেলে ধরে যখন ময়ূর নাচে, তখন ময়ূরী দেখে নেয় পেখমের মধ্যে চোখগুলো কিভাবে ছড়ানো রয়েছে বা দুপাশের চোখের সারিগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কিনা। এখানেই শেষ নয়, পেট্রিরা আরো দেখালেন যে সব ময়ূর পেখমের সাজে ময়ূরীদের মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়, তাদের পেখম ছেঁটে দিলে বা তাতে নতুন পালক জুড়ে তার সমতা কমিয়ে দিলে সেই একই ময়ূর আর প্রমিলা মহলে পাত্তা পায় না বিশেষ। এমনকি এও জানা গেল যে বেশী লম্বা পেখম যাদের, সেই ময়ূরদের প্রজনন ক্ষমতাও বেশী। শুধু তাই নয়, লম্বা পেখমওয়ালা ময়ূরদের সন্তানরা জন্মের সময় থেকেই মাপে কিছুটা বড় হয়, আর তাদের জীবনী শক্তিও হয় বেশী। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল যে, ইংল্যান্ডের হুইপস্নেড পার্কে রাখা দলটির ওপরে একবার নেকড়েদের হামলা হয়, আর তাতে যে ময়ূররা মারা পড়ে, তাদের পেখম বাকিদের তুলনায় কম বাহারী ছিলো। পেট্রিদের কাজ থেকে প্রথমবার প্রমাণ হল যে ময়ূরীরা পেখমের বাহার দেখেই সঙ্গী নির্বাচন করে এবং সেই নির্বাচিত ময়ূররা বাকিদের তুলনায় বেশী সুস্থ ও প্রজননে বেশী সক্ষম।

ডারউইনের সেক্সুয়াল সিলেকশন-এর তত্ত্ব তৈরী হয়েছিল তাঁর পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে। তিনি বলেছিলেন যে সব প্রজাতির মধ্যে প্রজনন নির্ভর করে নারীদের নির্বাচন স্বাধীনতার ওপর, সেই সব প্রজাতিতে বাহারী পুরুষ দেখতে পাওয়া যুক্তিযুক্ত। কেন বেঁচে থাকার পথে যা প্রতিবন্ধক, এমন গঠনকেও টিকিয়ে রাখে ন্যাচারাল সিলেকশন, তার সপক্ষে জাহাভি দাঁড় করিয়েছিলেন তাঁর হ্যান্ডিক্যাপ প্রিন্সিপল-কে। কিন্তু এসবই তত্ত্ব, আর যে কোনো তত্ত্বই প্রমাণ সাপেক্ষ। সেই প্রমাণ এসেছে পেট্রিদের কাজের মাধ্যমে। পেট্রি অবশ্য এখানেই ময়ূর নিয়ে গবেষণা থামিয়ে দেন নি। আরো নানারকম পরীক্ষা চালিয়ে গেছেন জীবজগতের নানান রহস্য উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টায়।

আমার কথাটি ফুরিয়েও ফুরোয়নি এখনও। একটা দুঃখের কথা এখানে না বলে পারছি না। আমাদের জাতীয় পাখিটি বহু বছর ধরেই বৈজ্ঞানিক বিতর্কের বিষয় ছিল। গত তিন দশকে ময়ূর হ্যান্ডিক্যাপ প্রিন্সিপল-এর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিষয়ে কোনো বই এমন হয় না যাতে ময়ূরের ছবি নেই। কিন্তু ময়ূরকে নিয়ে গবেষণা তো দূরের কথা, আমাদের দেশের কোনো বৈজ্ঞানিক কোনদিন ভাবেন নি যে এই পাখিটিকে দিয়ে খুব সহজেই হ্যান্ডিক্যাপ প্রিন্সিপলকে যাচাই করা যায়। সেই কাজ হল অবশেষে ইংল্যান্ডে, ভারতীয় ময়ূরকে নিয়েই। ময়ূর নিয়ে বিতর্কের শেষ হয়নি মারিয়ন পেট্রি-র কাজ দিয়ে, বরং তৈরী হয়েছে আরো নতুন গবেষণার সুযোগ। ২০০৮-এ এনিম্যাল বিহেভিয়ার জার্নালে জাপানের এক বৈজ্ঞানিক দলের কাজ প্রকাশ হয়, যাতে তাঁরা জানান যে জাপানে রাখা ভারতীয় ময়ূরীরা মোটেও ইংল্যান্ড বাসিনীদের মতো নয়। বাহারী পেখম দিয়ে তাদের মুগ্ধ করা যায় না। বলাই বাহুল্য, এর উত্তর দিতে হয় পেট্রি-কে। তাঁর কাজে কি তাহলে কোনো ভুল ছিল? পেট্রি-র তরফ থেকে জবরদস্ত উত্তর পায় এনিম্যাল বিহেভিয়ার, তাকাহাশিদের কাজ প্রকাশিত হওয়ার চার মাসের মধ্যে, আর তার তিন মাস পরে প্রকাশিত হয় সেই জবাব। ময়ূরীরা ভুল করেনি, ভুল করেছেন তাকাহাশিরাই, গবেষণার পদ্ধতিতেই রয়েছে অনেক গলদ। ২০১১-তে দুই পক্ষের সওয়াল-জবাবকে কেন্দ্র করে আরো একটি কাজ প্রকাশিত হয় সেই এনিম্যাল বিহেভিয়ারে, এবারের গবেষণার কেন্দ্র কানাডার এন.আর.আই. ময়ূর- ময়ূরীরা। এই নিয়ে আরো বিতর্ক চলবে, কিন্তু ১৯৯১-এর পরে ভারতের জীববিজ্ঞান সমাজের হেঁট হয়ে যাওয়া মাথাটা আরো নীচুই হবে শুধু।

 

অনিন্দিতা ভদ্র আই. আই. এস. ই. আর., কলকাতায় বায়োলজি বিভাগে অধ্যাপিকা। পশুপাখির স্বভাবচরিত্র ও বিবর্তন নিয়ে তার গবেষণা। কুকুরের উপর তাঁর বিশেষ উৎসাহ, একেই মডেল সিস্টেম হিসেবে স্টাডি করেন। অন্যান্য জিনিসের মধ্যে, তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন তারা মানুষের সাথে একসাথে সহবাস করতে শিখলো কি করে। গবেষণার বাইরে তিনি পড়াতে খুব ভালোবাসেন। এছাড়াও INYAS বলে একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন উনি। আমাদের দেশের যুবা বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় এবং বিজ্ঞান প্রচারে সাহায্য করতে এই বছরই সংগঠনটি তৈরী হয়েছে। এর সম্বন্ধে আরও জানতে এখানে দেখুন।

(প্রচ্ছদের ছবির উৎস)

[১] প্রথম মুদ্রণে বইটির নাম ছিল বেশ লম্বা: The origin of species by means of Natural Selection, or The Preservation of favoured races in the struggle for life.

[২] মৌমাছিদের গল্প আরো জানতে এখানে পড়ুন – ধাঁধার থেকেও জটিল প্রাণী: ডারউইনের সমস্যা

[৩] জাপানি গবেষকদের পেপার। তাদের বক্তব্য, বেশি বাহারি পেখম মানেই ময়ূরীরা সেই ময়ূরদের পছন্দ করবে, তার কোনো প্রমাণ নেই।

[৪] জাপানি গবেষকদের কাছে পেট্রির জবাব

[৫] কানাডায় ময়ূরদের নিয়ে গবেষণা

 

সংশোধন: আগের একটি সংস্করণে বলা হয়েছিলো যে জাপানি গবেষক দলের ময়ূর সংক্রান্ত পেপার বেরোতে চলেছে। সেটা একটু পুরোনো খবর। পেপারটি বেরিয়ে গেছে এবং তার জবাব-ও এসে গেছে। এটা উপরে সংশোধন করা হয়েছে।

প্রকাশিত হল ‘বিজ্ঞান’-এর বাছাই সংকলন ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’

প্রথম সংখ্যা (সেপ্টেম্বর ২০১৫)

ডাউনলোড করুন (PDF, 9.1 MB)

ধাঁধা : বিনি পয়সার ভোজ

$
0
0

শাওন সিকদার

ডিপার্টমেন্ট অফ সিএসই, ঢাকা ইউনিভার্সিটি

দশজন তরুণ তাদের মাধ্যমিক স্কুল থেকে পাশ করে বেরুনো উপলক্ষে, একটা  রেস্তোঁরায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করার প্লান করল। একসাথে জড়ো হবার পর প্রথম পদটি যখন পরিবেশন করা হলো তখন তারা কে কোন চেয়ারে বসবে তাই নিয়ে তর্ক শুরু করে দিলো। কেউ প্রস্তাব করলো নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী বসা হোক, কেউ আবার বলল বয়স অনুসারে, কেউ বলল উচ্চতা অনুসারে। তর্ক চলছে তো চলছেই।

খাবার জুড়িয়ে যাচ্ছে তবু কেউ বসতে রাজি না তখন ওয়েটার এসে সমস্যা সমাধান করে দিলো। “শুনুন তরুণ বন্ধুরা!” বলল সে, “যে যেখানে আছেন বসুন দেখি। আমি যা বলি শুনুন।” তরুণরা তার কথা মেনে নিলো। ওয়েটার তখন বলল “আপনাদের কেউ একজন এখন আপনারা যে ক্রমানুযায়ী বসেছেন সেটা লিখে রাখুন। কাল আবার এসে ভিন্ন কোন ক্রমানুযায়ী বসবেন। এবং যত দিন না বসবার এ সমস্ত রকম এর বিন্যাস শেষ হয়ে যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এভাবে চলুক। তার পর আপনারা এখন যে ক্রমানুসারে বসেছেন আবার ঠিক এভাবে বসার পালা যেদিন আসবে সেদিন আপনাদের ইচ্ছে মতো যে কোন সুখাদ্য আমি আপনাদের বিনামূল্যে পরিশেবন করবো বলে আমি প্রতিজ্ঞা করছি।”

প্রস্তাব টা লোভনীয় এবং প্রতিদিন সবাই এ রেস্তোরা তে এসে টেবিল কে ঘিরে সমস্ত সম্ভাব্য উপায় যাচাই করতে লাগলো। এখন প্রশ্ন হলো ঠিক কত দিন পর তারা সেই দিন ফিরে পাবে? চিন্তা করতে থাকুন আর উত্তরটা লিখুন নিচের কমেন্ট বক্সে। তারপর উত্তরটা দেখতে চাইলে দেখুন এখানে

ইগ নোবেল : প্রথমে হাসুন, তারপর ভাবুন!

$
0
0

গত শনিবার এম আই টি-তে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ২০১৫ সালের ইগ নোবেল বিজেতাদের বক্তৃতা অনুষ্ঠান। সেখানে উপস্থিত ছিল ‘বিজ্ঞান’-এর সুমন্ত্র, শাওন, আর রাজীবুল। তাদের কলমে ইগ নোবেল পুরস্কার সম্বন্ধে এই সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন।

 

“প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকে পড়েছে যে। কি সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি সার রে হতভাগা –  পইপই করে বললাম এত জল খাসনে। ভাগ্যিস পাবলিক টয়লেট খানা ছিল!”

নিজের কি সহযাত্রীর – এই অভিজ্ঞতা নেই এমন লোক বোধ হয় খুব কম আছে! এসব মহাসংকটের মুহূর্তে মনে হয় যদি আমাদের ব্লাডারটা ইঁদুরের মত পুচকে বা হাতির মত বড় হত – কী ভালই না হত। পুচকে ব্লাডার খালি করতে সময় কম লাগত, আর বড় ব্লাডার হলে অনেকক্ষণ মূত্র ধরে রাখা যেত – ‘মধ্যম পন্থা সর্বোত্তম’ কে যে বলে!

তাই? ভেবে দেখেছেন কি প্রাণীজগতে কার ‘মূত্র বিসর্জন’ করতে কত সময় লাগে? ভাবছেন, বিজ্ঞানের পত্রিকায় এসব কী লিখছি ? আচ্ছা তাহলে অন্য প্রশ্নে যাই বরং। মুরগীর লেজের কাছ থেকে একখানা বড় মাপের বোঝা চাপিয়ে দিলে কি তাদের হাঁটা-চলা ডাইনোসরের মত হবে? অথবা, শরীরের কোন জায়গায় মৌমাছি কামড়ালে বেশী জ্বালা করে? ঠোঁটে না মুখে না মাথায় না কি  শরীরের যে সব জায়গায় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারছেন না মৌমাছির কামড় খেতে হতে পারে !!

কেন প্রায় সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যে মূত্রত্যাগ করে ফেলে?

না, মাথা খারাপ হয়ে যায়নি আমাদের। সত্যি সত্যিই বিজ্ঞানীরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করেছেন। আর সেই সব গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ কিছু বিজ্ঞানী পেয়েছেন ইগ নোবেল পুরস্কার। ‘অ্যানালস অফ ইমপ্রোবাবল রিসার্চ’ নামে এক গবেষণা পত্রিকা দেয় এই পুরস্কার। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যান্ডার্স প্রেক্ষাগৃহে প্রতিবছর বিজেতারা পুরস্কার পান – উপস্থিত থাকেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরাও। এই অনুষ্ঠানের কয়েকদিন পরে এম আই টি -তে এক অনুষ্ঠানে বিজয়ীরা তাদের বক্তব্য রাখেন। প্রতি বিজয়ী বা বিজয়ী দল সময় পান পাঁচ মিনিট। একদম ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট। তার বেশী হলেই কিন্তু মহা বিপত্তি। কেমন? এই লেখার শেষে একটা ভিডিও লিঙ্ক দেওয়া আছে – নিজেরাই দেখে নিন!

এই বছর (২০১৫) পদার্থবিদ্যায় ইগ নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা হলেন প্যাট্রিশিয়া ইয়াং, ডেভিড হু, জোনাথন ফাম, এবং জেরোম চু । এরা সকলেই জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির সাথে যুক্ত। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওনারা দেখিয়েছেন যে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মূত্রত্যাগ করতে মোটামুটি কুড়ি সেকেন্ড সময় লাগে এবং এই সময়টা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আকার ও আয়তনের উপর নির্ভর করে না। এই কুড়ি সেকেন্ড হল গড় সময়, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে এর একটু এদিক ওদিক হতেই পারে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল, চেহারায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকলেও এই সংখ্যাটা সাত থেকে তেত্রিশ (কুড়ি প্লাস মাইনাস তেরো) সেকেন্ডের মধ্যেই থাকে। মানে একটা ইঁদুরের মূত্রত্যাগ করতে যতক্ষণ সময় লাগে, একটা হাতিরও মোটামুটি একই সময় লাগে!

byang

আন্দ্রে গাইম ২০০০ সালে পদার্থবিদ্যায় ইগ নোবেল পুরস্কার পান একটা ব্যাঙকে চুম্বকের সাহায্যে হাওয়ায় ভাসানোর জন্য। ২০১০ সালে তিনি  নোবেল পুরস্কার পান। (ছবি – উইকিমিডিয়া)

শুনে হাসি পেলেও কাজটি খুবই আগ্রহজনক।  মূত্রত্যাগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুব গভীর নয়। বিশেষতঃ, মূত্রনালী বা ইউরেথ্রার  ভূমিকার সম্পর্কে আমরা বিশেষ জানি না। এতদিন আমাদের ধারণা ছিল যে মূত্রনালী কেবল মূত্রথলি ও মূত্রদ্বারের সংযোগকারী একটি নালী ছাড়া আর কিছুই নয় । তার যে মূত্রত্যাগের সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারনাই ছিল না। পূর্বোল্লেখিত গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, মূত্রনালীর  কাজ হল, মূত্রত্যাগের সময়টাকে মোটামুটি কুড়ি-একুশ সেকেন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, তাই যে প্রাণী যত বড় হয়, তার মূত্রনালীর আকার ও আয়তনও  তত বড় হয়। শুধু তাইই নয়, মূত্রনালী যদি খুব ছোটো আর সরু হয়, তাহলে সান্দ্র্য (viscous) ও ক্যাপিলারি বল মোটামুটি অভিকর্ষ বলের মতই শক্তিশালী হয়। এই কারণে, খুব ছোট প্রাণী, যেমন ইঁদুরের ক্ষেত্রে মূত্র আমাদের মত ধারার (jet) আকারে পড়ে না, বরং ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে।

কিন্তু কেন এমন হয়? প্রায় সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী কেন কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যে মূত্রত্যাগ করে ফেলে? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এমনটা বিবর্তনের (Evolution)  কারণে হয়ে থাকে। আমরা যখন প্রস্রাব করি, তখন যদি কেউ পিছন থেকে ধাক্কা মারে তাহলে কিন্তু আমরা সেটা আটকাতে পারি না। বরং, অনেক সময় প্রস্রাব আটকে গিয়ে খুবই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে অবশ্য পিছন থেকে ধাক্কা মারার মত কেউ নেই, তবে শিকারীরা তো এরকম অবস্থার জন্য সবসময় তক্কে তক্কেই থাকে, তাই মূত্রত্যাগের সময়টাকে যতটা কম করা যায় ততই ভালো। তাই সম্ভবত বহু বহু বছরের অভিযোজনের ফলেই আমরা কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যে কম্পিটিশন লাগিয়ে প্রস্রাব করে ফেলি।

নোবেলের মতই ইগ নোবেল অনেক বিষয়ে দেওয়া হয় – যেমন অর্থনীতি। এবারের বিজেতা থাইল্যান্ডের ব্যাংকক মেট্রোপলিটান পুলিশ। তারা দেখিয়েছে ঘুষ বন্ধ করার একটা ভালো উপায় হতে পারে যে সব পুলিশেরা ঘুষের সুযোগ পেয়েও নেয়নি তাদের অতিরিক্ত আর্থিক পুরস্কার দেওয়া।  

শরীরের কোন জায়গায় মৌমাছি কামড়ালে বেশী জ্বালা করে?

চিলে এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিজ্ঞানী দল পেয়েছেন জীববিজ্ঞানের ইগ নোবেল। তারা দেখিয়েছে মুরগীর পিছনে একটা ভারী কাঠি ঝুলিয়ে দিলে তারা ডাইনোসরের মত হাঁটতে থাকে। অর্থাৎ হাঁটার সময় মুরগীরা যেমন হাঁটুর উপর ভার ফেলে চলে, এই অতিরিক্ত বোঝার চাপে তা যায় পালটে – ভরকেন্দ্র উরুর কাছে চলে যায়। ডাইনোসররা তাদের বিশাল লেজ নিয়ে ঠিক যে ভাবে হাঁটত বলে ভাবা হয়।  

শরীরবিজ্ঞান (ফিজিওলজি) ও পতঙ্গবিজ্ঞান (এনটমোলজি)-এ পুরস্কৃত হয়েছেন জাস্টিন স্মিট আর মাইকেল স্মিথ। প্রথমজন তৈরী করেছেন বিভিন্ন পতঙ্গের কামড় কত যন্ত্রনা দেয় তার তুলনা করার জন্য একটা স্কেল (‘স্মিট স্টিং পেইন ইন্ডেক্স’)। দ্বিতীয়জন নিজের সারা শরীরে মৌমাছির কামড় খেয়ে দেখেছেন কোথায় কত যন্ত্রনা পেতে হয়, এবং স্মিট ইন্ডেক্সে তাদের মান কত। তার অভিজ্ঞতায় সবথেকে বেশী কষ্ট হয় নাকের ফুটোয়, উপরের ঠোঁটে আর যৌনাঙ্গে কামড় খেলে!

চুম্বনের শারীরিক সুফল নিয়ে গবেষণার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছেন একাধিক বিজ্ঞানী। তারা দেখিয়েছেন অ্যালার্জী প্রশমনেও রয়েছে চুম্বনের ভূমিকা!

এইসব অদ্ভূত গবেষণাকেই স্বীকৃতি দেয় ইগ নোবেল। শুধু গভীর কাজ করে ইগনোবেল পাওয়া অসম্ভব। ইগনোবেল পেতে গেলে এমন কাজ করতে হবে যেটার ব্যাপারে শুনে প্রথমে হয় হাসি পাবে, নয়তো মনে হবে, “ধুস! এরকম কাজ করার জন্যও লোকেরা টাকা পায়! ” কিন্তু পরে যখন কাজটার ব্যাপারে ভেবে দেখবেন, বুঝবেন কাজটা সত্যিই খুব সুন্দর আর গভীর। আন্দ্রে গাইম, যিনি  ২০১০ সালে নোবেল পুরস্কার পান গ্রাফিনের উপর কাজ করার জন্য, ২০০০ সালে পদার্থবিদ্যায় ইগনোবেল পুরস্কার পান একটা ব্যাঙকে চুম্বকের সাহায্যে হাওয়ায় ভাসানোর জন্য।

এ বছরের পুরস্কার প্রাপকদের বক্তব্য শুনতে শুনতে হাসিতে ফেটে পড়ছিল দর্শক। তবে অনুষ্ঠান শেষ হয় একটু দুঃখ মিশ্রিত অনুভূতির সাথে। হুইল চেয়ারে বসে উপস্থিত ছিলেন জাপানী বিজ্ঞানী ইয়োশিরো নাকামাৎস, যিনি ২০০৫ সালে পেয়েছিলেন ইগ নোবেল। আজ তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত, আয়ু হয়ত আর কয়েক মাস। কিন্তু তাও মুখে দুঃখের ছাপ নেই প্রায় চার হাজার আবিষ্কারের পেটেন্ট পাওয়া সাতাশি বছরের এই বিজ্ঞানীর। নিজে লিখে এক মিউজিক কোম্পানীর সাহায্যে রেকর্ড করে ফেলেছেন একটা গান – “Even cancer face very bad”। ওনার সাথে সাথেই গাইল উপস্থিত দর্শকেরা (নিচে অডিও শুনুন)। সেই গানে বারবার ফিরে এল জীবনের জয়গান, “I don’t afraid never give up! ”

 

আরো পড়ুন/জানুন

১। ইগ নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট বলার সুযোগ পান বক্তারা। তার বেশী হলে তাদের থামানোর জন্য নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন এই ভিডিও-তে মিস স্যুইটি পু-র কার্যকলাপ দেখুন। এ বছর অবশ্য মিস পু ছিল না – তার বদলে এক ব্যান্ড ছিল। সময় পেরিয়ে গেলে তাদের বাজনা উপেক্ষা করা বক্তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

২। ইগ নোবেল বিজয়ীদের তালিকা

(প্রচ্ছদের ছবির উৎস)

ছদ্মবেশী

$
0
0

অনিন্দিতা ভদ্র
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চ, কলকাতা

বসন্তকাল সমাগত। পুরুষ মৌমাছিরা উড়ে বেড়াচ্ছে এদিকে-ওদিকে। মহিলাদের এখনো পাত্তা নেই – হয়ত সাজগোজ সারা হয়নি তাদের মিলনঋতুর জন্য। এমন সময় কোনো পুরুষ মৌমাছির শুঁড়ে একটা গন্ধ এসে লাগে – এই গন্ধ তার চেনা নয়, কিন্তু তার জন্মগত কোনো এক আদিম প্রবৃত্তি তাকে বলে দেয় যে এই গন্ধের উৎস কোনো স্ত্রী মৌমাছি। গন্ধের দিকে উড়তে থাকে পুরুষ মৌমাছি, দেখতে পায় তার লক্ষ্যকে। প্রবৃত্তি-তাড়িত পুরুষটি সোজা গিয়ে বসে তার সম্ভাব্য সঙ্গিনীর ওপরে, উদ্দেশ্য – তাকে নিজের শুক্রাণু (sperm) দিয়ে বোঝাই করা। কিন্তু এখানে বাধ সাধে প্রকৃতি। পুরুষ মৌমাছির অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাকে ঠকিয়েছে আরেকটি প্রাণী – হয়ত শুনতে সবার অবাক লাগবে, এই প্রাণীটি আসলে একটি উদ্ভিদ।

পুরুষ মৌমাছির অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাকে ঠকিয়েছে আরেকটি প্রাণী – একটি উদ্ভিদ।

নানা প্রজাতির অর্কিড ছড়িয়ে রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। এদের মধ্যে একটি প্রজাতির নাম অফ্রিস (Ophrys)। এদের দেখা যায় প্রধানত ইউরোপে। এই প্রজাতির বিশেষত্ব এদের ফুলের আকারে আর গন্ধে। যেমন ধরা যাক মিরর অর্কিডের কথা। মাটি থেকে এক ফুট মত ওপরে একটা ডাঁটির মাথায় কয়েকটা ফুল, যাদের দেখে ফুল বলে ভাবতে একটু কষ্ট হয়। একটা বেশ বড়সড় ডিম্বাকৃতি চকচকে নীলচে-বেগুনি পাপড়ি, তার ধার দিয়ে রয়েছে লাল রোঁয়াওয়ালা একটা হলুদ দাগ। দুপাশে দুটো ছোট পাপড়ি, অনেকটাই ডানার মত। ফুলগুলোকে দেখতে অবিকল ওই অঞ্চলের কিছু মৌমাছি আর বোলতার মত। কিন্তু কেন এই বিচিত্র সাজ? এর পেছনে রয়েছে প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম – পৃথিবীর যে কোনো প্রাণীর সাফল্যের মাপকাঠি তার প্রজনন ক্ষমতায়। যে যত উত্তরসূরি রেখে যেতে পারবে, তার জন্ম তত বেশি সার্থক।

গাছেদের যৌন অঙ্গের আধার ফুলেরা। নানা রং আর গন্ধের সাহায্যে ফুলেরা ছোট-বড় কীট-পতঙ্গ, এমনকি পাখিদেরও আকর্ষণ করে। এরা আসে ফুলের মধুর লোভে, আর ফুলেরা তাদের ব্যবহার করে অন্য ফুলেদের কাছে নিজের রেণু পৌছে দিতে। এই ‘রেণুবাহক’ (pollinator)-দের ছাড়া অনেক ফুলেরই প্রজনন অসম্ভব। কিন্তু এদের সবার প্রয়োজন এক নয়, তাই তাদের পছন্দও আলাদা, আর সেই সব পছন্দের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে কাজ হাসিল করতে হয় ফুলেদের, তাই চারিদিকে এত রকমারি ফুলের বাহার। বেশিরভাগ ফুলই তাদের রেণুবাহকদের মধু দিয়ে, বা কখনো ডিম পাড়ার অনুকূল জায়গা দিয়ে, এমনকি রেণু দিয়েও পুরষ্কৃত করে। কিন্তু বিবর্তনের খেলায় এমন কিছু ফুল তৈরী হয়েছে যারা তাদের রেণুবাহকদের বিনা পারিশ্রমিকে ব্যবহার করে। ওফ্রিস অর্কিডরা এই সুবিধেবাদী দলের এক বড়সড় অংশ।

মিরর অর্কিড – মৌমাছির মনে হয় যে তার সঙ্গিনী ফুলের উপর ঝুলে রয়েছে ওপরের দিকে মুখ করে (ছবির উৎস)

যে মিরর অর্কিডের কথা বলেছিলাম, তারা শুধু যে তাদের রেণুবাহকদের মত দেখতে তাই নয়, এই অর্কিডরা নকল করে তাদের গন্ধও। পুরুষ মৌমাছি (বা বোলতা) দূর থেকে দেখে এই অর্কিডকে নিজের প্রজাতির স্ত্রী-মৌমাছি ভাবে, কারণ এদের গন্ধ প্রায় অবিকল তাদের সেক্স ফেরোমোন (sex pheromone) বা যৌন আকর্ষণের মত। এই বর্ণ-গন্ধের আকর্ষণে পুরুষ মৌমাছি গিয়ে বসে অর্কিডের ওপরে, আপ্রাণ চেষ্টা করে তার সাথে মিলিত হতে, কিছুটা চেষ্টার পর হতাশ হয়ে উড়ে যায় সঙ্গিনীর খোঁজে। কিন্তু এই ফাঁকে অর্কিড তার কাজ সেরে নিয়েছে – একগাদা রেণু মাখিয়ে দিয়েছে মৌমাছির মাথায়। কি করে? মিরর অর্কিডের রোঁয়া নিচের দিকে ঝুলে থাকে, তাতে মৌমাছির মনে হয় যে তার এই ভুয়ো সঙ্গিনী ফুলের উপর ঝুলে রয়েছে ওপরের দিকে মুখ করে। সে এসে ফুলের বড় পাপড়ির ওপরে বসে নিচের রোঁয়াগুলোর ভেতরে নিজের যৌনাঙ্গ গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই চাপে ফুলের ওপরের দিক থেকে শুঁড়ের মত যৌনাঙ্গ নেমে এসে মৌমাছির মাথায় একজোড়া পলিনিয়া (pollinia) বা রেণুর থলি সেঁটে দেয়। এই মৌমাছি যখন পরের মিরর অর্কিডে গিয়ে বসে, তখন এই পলিনিয়া চলে যায় সেই ফুলের স্ত্রী-অঙ্গে, আর নতুন একজোড়া পলিনিয়া আবার এসে জুটে যায় বেচারা মৌমাছির মাথায়। বেশ কয়েকবার  এইভাবে ঠকতে হয় পুরুষ-মৌমাছিদের, আর সেই সুযোগে নিজেদের কাজ হাসিল করে নেয় অর্কিডরা।

মৌমাছির কপালে কি জুটবে শুধুই অর্কিডের প্রতারণা? না, সে অত বোকা নয়।

কিন্তু মৌমাছি যদি এক অর্কিড থেকে উড়ে তার স্বজাতি অর্কিডে গিয়ে না বসে, তাহলে? তার ব্যবস্থাও করেছে প্রকৃতি। কিছু অর্কিড হলো বিশেষজ্ঞ বা স্পেশালিস্ট। কখনো দেখা যায় যে একটি প্রজাতির অর্কিড বিশেষ একটি প্রজাতির স্ত্রী-মৌমাছিকে নকল করে, তাই শুধু সেই প্রজাতির মৌমাছিরাই আকৃষ্ট হয় এই অর্কিডদের দেখে। আবার কখনো একই অঞ্চলে যেসব অর্কিড পাওয়া যায়, তাদের গর্ভকেশর (stigma) আর পুঙ্গকেশর (anther) এমনভাবে সাজানো যে মৌমাছির গায়ের আলাদা আলাদা অংশকে তারা ব্যবহার করতে পারে নিজেদের কাজে। যেমন মিরর অর্কিড কাজে লাগায় মৌমাছির মাথাকে, আর সেই একই মৌমাছির শরীরের পেছনের অংশকে কাজে লাগাতে পারে অন্য কোনো অর্কিড – একজন রেণুবাহককে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে দুই প্রজাতি। তাহলেই আর কোনো সমস্যা রইলো না। আবার কোনো ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিডদের ফুল ফোটার সময় হয় আলাদা, যাতে মৌমাছিরা ভুল করেও এক প্রজাতির রেণু অন্য প্রজাতির গায়ে না চাপাতে পারে। সুন্দর ব্যবস্থা নয় কি?

ফিরে আসি আমাদের প্রথম দেখা সেই মৌমাছির কাছে। সে বেচারার ভাগ্য কি এতই খারাপ যে তার কপালে জুটবে শুধুই অর্কিডের প্রতারণা? না, সে অত বোকা নয়। প্রথম প্রথম একটু আনাড়ি ছিল বলে তাকে সহজেই বোকা বানাতে পেরেছিল অর্কিডরা। কিন্তু নেড়া বেলতলায় যেমন একবারই যায়, তেমন মৌমাছিরাও বারবার ভুল করে না। আর স্ত্রী মৌমাছিরাও এবারে দেখা দিতে শুরু করে। তাদের সাথে টেক্কা দিতে পারেনা অর্কিডরা। অল্প একটু সময়ের ফাঁকে প্রকৃতি মৌমাছি আর অর্কিডদের নিয়ে একটা সুন্দর লুকোচুরির খেলা খেলে নেয়, আর সেই খেলার ঘুঁটি অর্কিডদের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হই আমরা।

অনিন্দিতা ভদ্র আই. আই. এস. ই. আর., কলকাতায় বায়োলজি বিভাগে অধ্যাপিকা। পশুপাখির স্বভাবচরিত্র ও বিবর্তন নিয়ে তার গবেষণা। কুকুরের উপর তাঁর বিশেষ উৎসাহ, একেই মডেল সিস্টেম হিসেবে স্টাডি করেন। অন্যান্য জিনিসের মধ্যে, তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন তারা মানুষের সাথে একসাথে সহবাস করতে শিখলো কি করে। গবেষণার বাইরে তিনি পড়াতে খুব ভালোবাসেন। এছাড়াও INYAS বলে একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন উনি। আমাদের দেশের যুবা বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় এবং বিজ্ঞান প্রচারে সাহায্য করতে এই বছরই সংগঠনটি তৈরী হয়েছে। এর সম্বন্ধে আরও জানতে এখানে দেখুন।

(প্রচ্ছদের ছবির উৎস)

 

লেখার উৎস ও অন্যান্য টুকিটাকি:

[১]: ফেরোমোন হলো কোনো প্রাণীর শরীরে তৈরী হওয়া রাসায়নিক ‘গন্ধ’, যা হাওয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে সেই প্রাণী তার স্বগোত্রীয়দের সাথে ‘কথা বলতে’ পারে সাংকেতিক ভাষায়।

[২]: Schiestl FP (2005) On the success of a swindle: Pollination by deception in orchids. Naturwissenschaften 92:255–264

[৩]: Kullenberg B (1961) Studies in Ophrys Pollination (Almquist & Wiksells Boktryckeri, Uppsala, Sweden)

[৪]: Schiestl FP, et al. (1999) Orchid pollination by sexual swindle. Nature 399:421–422

[৫]: Mant JG, et al. (2005) Cuticular hydrocarbons as sex pheromone of the bee Colletes cunicularius and the key to its mimicry by the sexually deceptive orchid Ophrys exaltata. J Chem Ecol 31:1765–1787

[৬]: Schiestl FP, Peakall R, Mant J, Ibarra F, Schulz C, Francke S, Francke W: The chemistry of sexual deception in an orchid wasp pollination system. Science 2003, 302:437-438

জীবাণুদের যত কথা –৬

$
0
0

দেবনাথ ঘোষাল, ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি

(পূর্ব প্রকাশিতের পর )

মানুষ আর ব্যাকটেরিয়ার লড়াই: সুপার-বাগ বনাম অ্যান্টিবায়োটিকস

নেক দিন পরে ফিরে এলাম জীবাণুদের যত কথার ষষ্ঠ পর্ব নিয়ে। আগের পাঁচটি পর্বে আমরা জীবাণুদের বাসস্থান, তাদের নানা প্রকারভেদ, বৈচিত্র্যময় গঠন ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আকারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলেও গঠনগত দিক দিয়ে তারা যে অনেক জটিল এবং তাদের কোষের বাহ্যিক প্রতিরক্ষা বলয় যে অনেক বেশী সুসংগঠিত সে বিষয়েও আমরা অনেক কিছু জেনেছি। উন্নত ইউক্যারিওটদের থেকে ব্যাকটেরিয়া কোষের বাহ্যিক আবরণের প্রধান পার্থক্যটি হল, ব্যাকটেরিয়া কোষের বাইরে কোষ-পর্দা ছাড়াও কোষ-প্রাচীরের দৃঢ় আচ্ছাদন থাকে। আর এই কোষ-প্রাচীরের উপস্থিতির জন্যই প্রতিকূল পরিবেশেও ব্যাকটেরিয়া অভিস্রবণ জনিত চাপ (Turgor pressure) থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারে। কোনো কারণে যদি ব্যাকটেরিয়া কোষের এই প্রতিরক্ষা বলয় নষ্ট হয়ে যায় তাহলে ব্যাকটেরিয়া কোষটি অভিস্রবণ জনিত চাপ সহ্য করতে না পেরে মারা যায়। আর এই কারণেই দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকস গুলির বেশীর ভাগের-ই  নিশানা হল ব্যাকটেরিয়া কোষের কোষ-প্রাচীর। এই পর্বে আমরা অ্যান্টিবায়োটিকস কীভাবে কোষ-প্রাচীরের গঠন নষ্ট করে এবং কিছু ‘সুপার’ ব্যাকটেরিয়া তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে সেই বিষয়ে আলোচনা করব।

ঠান্ডালাগা, কোথাও ছড়ে যাওয়ার মত সাধারণ সমস্যা বা প্লেগ, হুপিং কাশির মত মহামারী সবের-ই এক সমাধান – অ্যান্টিবায়োটিকস!

আমাদের যখন শরীর খারাপ হয় তখন ডাক্তারের কাছে গেলে প্রায়শই তাঁরা আমাদের অ্যান্টিবায়োটিকস খেতে বলেন। ঠান্ডালাগা, কোথাও ছড়ে যাওয়ার মত সাধারণ সমস্যা বা প্লেগ, হুপিং কাশির মত মহামারী সবের-ই এক সমাধান – অ্যান্টিবায়োটিকস! তোমাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করে এই অ্যান্টিবায়োটিকস-এ কী এমন ম্যাজিক থাকে যে ভয়ংকর সব ব্যাকটেরিয়া পালাবার পথ খুঁজে পায় না?

এই বিষয়ে জানার আগে চট করে আমরা একটু আগের পর্বের বিষয়টা ঝালিয়ে নেব। আগের পর্বে (পর্ব-৫) আমরা আলোচনা করেছিলাম যে NAG ও NAM এই দুই অদ্ভুত শর্করার সমন্বয়ে তৈরী হয় পেপ্টাইডোগ্লাইকান পলিমার। অসংখ্য পেপ্টাইডোগ্লাইকান পলিমার একসঙ্গে মিলে ব্যাকটেরিয়ার পেরিপ্লাসমে ত্রিমাত্রিক জালের ন্যায় কোষ-প্রাচীর তৈরী করে। NAG ও NAM এই দুই শর্করার অণুকে পরপর সাজিয়ে পলিমার তৈরী ও এই পলিমার গুলিকে জুড়ে ত্রিমাত্রিক সজ্জায় সাজানোর কাজ করে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একদল প্রোটিন বা উৎসেচক। এদের পেনিসিলিন-বাইন্ডিং-প্রোটিন (Penicillin-binding proteins) বা PBPs বলা হয়।

তোমরা কি আন্দাজ করতে পারো কেন এদের পেনিসিলিন-বাইন্ডিং-প্রোটিন বলা হয়? কারণটা খুব-ই সহজ! পেনিসিলিন বা পেনিসিলিন গোত্রের যে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকস আসলে এই শ্রেণীর উৎসেচক গুলির সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওদের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। তাই এই প্রোটিন বা উৎসেচক গুলিকে পেনিসিলিন-বাইন্ডিং-প্রোটিন বলে। এই প্রক্রিয়ার ফলে ব্যাকটেরিয়া কোষের কোষ-প্রাচীর তৈরী হয় না এবং কোষটিও নষ্ট হয়ে যায়। 

PBP-দের ভূমিকা ব্যাকটেরিয়া কোষের বেঁচে থাকার জন্যে অপরিহার্য। পেনিসিলিন বা পেনিসিলিন গোত্রের যে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক এই PBP-দের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওদের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। ক্লিক করুন ভাল রেসোল্যুশনে দেখতে। (উৎস- উইকিপিডিয়া)

PBP-র উপস্থিতি প্রায় সব ব্যাকটেরিয়াতেই দেখা যায় এবং ওদের ভূমিকা ব্যাকটেরিয়া কোষের বেঁচে থাকার জন্যে অপরিহার্য। তাই পেনিসিলিন গোত্রের বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকস গুলি (Amoxicillin, Cephamycins, Carbapenems, Flucloxacillin ইত্যাদি) ডাক্তারবাবুরা আমাদের ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত রোগ সরানোর জন্যে প্রায়শই দিয়ে থাকেন।

তোমরা ভাবছ, ব্যাস তাহলে তো ল্যাঠা চুকে গেল! ব্যাকটেরিয়াকে বেশ জব্দ করা গিয়েছে। ওই পুঁচকিগুলো কিনা এসেছিল আমাদের সঙ্গে লড়াই করতে! আসলে সবাই তেমনটাই ভেবেছিল। ১৯২৯ সালে স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেক্জান্ডার ফ্লেমিং জার্নাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল প্যাথলজি তে সর্বপ্রথম আন্টিবায়োটিকস-এর ধারণা প্রকাশ করেন। তার পর থেকে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ সারানোর জন্যে পেনিসিলিনের বহুল ব্যবহার শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈন্যদের সংক্রমণ সারাতে পেনিসিলিন ব্যবহারের অনেক উল্লেখ আছে।

সমস্যা দেখা দিল ১৯৬৭ সালে। পাপুয়া নিউগিনির (তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ায়) এক গ্রামে এক রোগীর স্ট্রেপটোকক্কাস নামে এক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ (Streptococcus pneumoniae) সারাতে গিয়ে দেখা গেল পেনিসিলিন আর কাজ করছে না। এই সময় গুয়াতেমালাতেও সিগেলা (Shigella spp.) নামে আর এক ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেল। সাত বছর পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায় আমেরিকাতে – নিসেরিয়া (Neisseria gonorrhoeae) নামে অন্য আর প্রকার ব্যাকটেরিয়াতে। নব্বই-এর দশকে দেখা গেল বিভিন্ন দেশে অনেক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ-ই আর প্রচলিত পেনিসিলিন শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিকস দিয়ে সারানো যাচ্ছে না। এই ব্যাকটেরিয়াদের তাই অ্যান্টিবায়োটিকস প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া (Antibiotic-Resistant Bacteria) বা সুপার-বাগ (Super-Bug) নাম দেওয়া হয়েছে!

সুপার-বাগগুলি বিটা-ল্যাকটামেস নামে উৎসেচক তৈরী করে। এই উৎসেচক হাইড্রোলাইসিস বিক্রিয়ার মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকসের বিটা-ল্যাকটাম রিং ভেঙ্গে দেয়। (উৎস –  উইকিপিডিয়া)

তোমরা নিশ্চই ভাবছ, এই সব ব্যাকটেরিয়াদের তো PBPs আছে। আবার ওদের কোষ-প্রাচীরেরও একান্ত প্রয়োজন। তাহলে পেনিসিলিন কাজ করছে না কেন? আসলে আমরা যত সহজে ওদের জব্দ করব ভেবেছিলাম ব্যাপারটা অত সহজ না। ব্যাকটেরিয়া যেহেতু খুবই প্রতিকূল পরিবেশে পৃথিবীতে প্রায় ৩৬০ কোটি বছর ধরে টিকে আছে তাই ওদের অভিযোজন ক্ষমতা বড্ড বেশী। এক্ষেত্রে ওরা পেনিসিলিনের জন্য একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।

ব্যাকটেরিয়া খুবই প্রতিকূল পরিবেশে পৃথিবীতে বহু কোটি বছর ধরে টিকে আছে তাই ওদের অভিযোজন ক্ষমতা বড্ড বেশী

কি সেই ব্যবস্থা?

সুপার-বাগগুলি এক বিশেষ ধরনের উৎসেচক তৈরী করে ফেলেছে, যার নাম বিটা-ল্যাকটামেস (β-lactamase)। এই উৎসেচক হাইড্রোলাইসিস বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকস-এর প্রধান গঠনগত একক বিটা-ল্যাকটাম রিং (β-lactam ring, উপরের ছবিতে লাল রঙের) ভেঙ্গে দেয়! বিটা-ল্যাকটাম রিং নষ্ট হয়ে যাওয়ায় PBP বা পেনিসিলিন-বাইন্ডিং-প্রোটিনদের সাথে পেনিসিলিন আর বিক্রিয়া করতে পারে না। ফলে অ্যান্টিবায়োটিকসের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায় এবং ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীরের স্বাভাবিক গঠন প্রক্রিয়ার কোনো ক্ষতি হয় না। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ চলতেই থাকে!

এই সুপার-বাগদের থেকে রক্ষা পাবার উপায় কি? ওদের সাথে লড়াই করার জন্যে বিজ্ঞানীরা কি ব্যবস্থা নিলেন? সেসব জানার জন্যে পরের পর্বে নজর রাখো।

                                                                                                                                                                                       -চলবে

দেবনাথ ঘোষাল বর্তমানে ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পোস্টডক্টরাল ফেলো। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি। গবেষণার বিষয় ব্যাকটেরিয়ার আণুবীক্ষণিক গঠন ও সংক্রমণ প্রক্রিয়া।

 

 

[১] বিটা-ল্যাকটাম রিং থাকার জন্য পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকস গুলিকে বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকস-ও বলা হয়ে থাকে।

খেলাচ্ছলে প্রোগ্রামিং

$
0
0

 

sayaminduগবেষণায় অবাধ স্বাধীনতা যে কোনো গবেষকের কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মত। কিছু গবেষণাগার আছে যেখানে এই স্বপ্নের খুব কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। MIT মিডিয়া ল্যাব তার মধ্যে অন্যতম। নিজের আইডিয়ার পিছনে বিনা বাধায় লেগে থাকতে পারলে কোথায় পৌঁছনো যায়, এই মিডিয়া ল্যাব তারই নিদর্শন। প্রস্থেটিক পা থেকে শুরু আকার পরিবর্তনক্ষম টেবিল, রোবোটিক অপেরা থেকে থালাবাটির কীবোর্ড — এখানে কিছুক্ষণ কাটালে কল্পবিজ্ঞান আর বাস্তবের মধ্যে তফাৎ করা কঠিন হয়ে যায়। এই মিডিয়া ল্যাবের সায়মিন্দু দাশগুপ্তর সাথে আমরা এক আলোচনায় বসলাম। সেই আলোচনায় কিছু ইতিহাস উঠে এলো, জানলাম মিডিয়া ল্যাবের কিছু বর্তমান প্রজেক্টের কথা। আজকের গল্প একটা বিশেষ প্রজেক্টকে নিয়ে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে ধারণা আমূল পাল্টে দেবে। লিখেছে অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়

 

টা নিঃসন্দেহে সত্যি যে জেনারেশন ওয়াই কম্পিউটার নিয়ে নাড়াচাড়া করাতে তার আগের প্রজন্মের থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে এবং পরবর্তী প্রজন্ম আরো অল্প বয়েসে তুখোড় হয়ে উঠবে নিশ্চিতরূপে। কিন্তু তুখোড় হওয়া মানে কি? তারা পটাপট ইন্টারনেট ঘেঁটে যেকোনো তথ্য বার করে দিতে পারবে, রকমারি অ্যাপ ব্যবহার করে অনেক নিত্যনৈমিত্তিক ঝঞ্ঝাট থেকে নিষ্কৃতি পাবে। কিন্তু তার বাইরে, যদি রেডিমেড সমাধান না খুঁজে নিজে থেকে একটা প্রোগ্রাম অথবা অ্যাপ বানাতে বলা হয় তাহলে ক’জন বলতে পারবেন — কুছ পরোয়া নেহি, নামিয়ে দিচ্ছি? কই, হাত তুলুন তো দেখি!

প্রোগ্রামিংয়ের জুজুর সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। একে তো অপরিচিত কিম্ভূত-নিয়মে-ভরা ভাষা, তায় ভাষার প্রয়োগে একচুল এদিক ওদিক হলে প্রোগ্রাম আর কাজ করবে না। কেন কাজ করছে না, তা জানানো হবে ঠিকই, কিন্তু যা জানানো হবে, তার থেকে গলদটা খুঁজে বার করতেই জান কয়লা হয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই, স্কুলের পাঠ্যক্রমে ঘাড় ধরে না শেখালে নিজে থেকে শেখার উৎসাহ পাওয়া কঠিন। MIT মিডিয়া ল্যাব এই কঠিন কাজটাকে সহজ এবং মজাদার করার এক অভিনব উপায় ভেবেছে, যার নাম স্ক্র্যাচ

চট করে দেখলে, “স্ক্র্যাচ”-কে প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা বলে মনেই হবে না। ধরা যাক, আপনি একটা নতুন প্রোগ্রাম লিখতে শুরু করলেন। প্রথমেই পর্দায় দেখবেন একটা বেড়াল। আপনার প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য হলো, বেড়ালটাকে দিয়ে যা খুশি তাই করানো।

scratch_cat

কেমনভাবে করানো হবে? আসলে সেখানেই মজা। হাতে মজুত কয়েকটা বিশেষ আকারের ব্লক, যেগুলো একটার গায়ে আরেকটা চাপানো যায়। যেমন, একটা ব্লক নির্দেশ দিচ্ছে, একশো পা এগোন।

move_100_steps

আরেকটা ব্লক বলছে, ৩ সেকেন্ড অপেক্ষা করুন।

wait_3_seconds

আরেকটা বলছে, ৯০ ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়ান।

turn_90_degreess

এবার এদের একটার ঘাড়ে আরেকটাকে চাপিয়ে তাদের উপর ক্লিক করলেই বেড়ালবাবাজি একশো পা হেঁটে তিন সেকেন্ড পর রাইট টার্ন নেবে।

move_wait_turn

এবার এই তিনটে ব্লকের সমষ্টিকে আর একটা চতুর্থ হাঁ করে থাকা ব্লকের মধ্যে গুঁজে দেওয়া যায়। এই ব্লকটা বলছে, কাজটা দশবার করুন।

repeat_10_times

জিনিসটা দাঁড়াবে এইরকম। লক্ষ্য করুন, আরেকটা অপেক্ষা করার ব্লক গুঁজে দেওয়া হলো যাতে সবকটা ব্লকের প্রভাব আলাদা আলাদা করে বোঝা যায়।

repeat_move_wait_turn_wait

এবার ক্লিক করুন এতে। বেচারা বেড়াল একটা অদৃশ্য চতুষ্কোণের চারিদিকে ঘুরপাক খাবে আড়াই পাক।

বেড়ালবাবাজিকে কলুর বলদ বানিয়ে নিজের অজান্তেই কিন্তু আপনি শিখে গেছেন প্রোগ্রামারদের চেনাপরিচিত একটা কনসেপ্ট বা ধারণা — যাকে বলে “লুপ”। যার অর্থ দাঁড়ায় একই কাজের বারংবার পুনরাবৃত্তি। এক্ষেত্রে আপনি শুধু শিখছেনই না, চোখের সামনে জলজ্যান্ত দেখছেন। এবার বেড়ালের বদলে বসিয়ে দিন পছন্দসই চরিত্র (যাকে স্ক্র্যাচ টীম নাম দিয়েছে “স্প্রাইট”), তাকে ইচ্ছেমত নাচনকোঁদন করান, চান তো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা সিনারি জুড়ে দিন তাতে — একটা ছোটখাটো অ্যানিমেশন কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরী।

এইবার বলুন, একজন ইস্কুলের ছাত্র এইভাবে প্রোগ্রামিং শিখতে চাইবে, না দশগন্ডা মৌলিক সংখ্যা কি ফিবোনাচি সেকুএন্সের যোগফল বার করে শিখতে চাইবে?

এই ধরণের একটা উপলব্ধি থেকেই ‘স্ক্র্যাচ’-এর জন্ম। আশির দশকে যখন পার্সোনাল কম্পিউটার বা পি.সি. এলো, তখন ভাবা হয়েছিল শিক্ষার জগতে একটা বিপ্লব আসবে। বিপ্লব হয়তো এসেছে, কিন্তু শিক্ষার জগতে নয়। আজও ভাবা হয়, প্রোগ্রামিং শেখার একটা বড় উদ্দেশ্য আখেরে সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি। প্রোগ্রামিংয়ের দ্বারা নিজেকে প্রকাশ করার সাবলীলতা বা স্বাচ্ছন্দ্য এখনো অনেকেরই হাতের বাইরে।

এর কারণ খুঁজতে গিয়ে, কয়েকটা জিনিস লক্ষ্য করা গেল।

১) প্রোগ্রামিংয়ের ভাষায় দুর্বোধ্য নিয়মের কড়াকড়ি। কোথায় সেমিকোলন পড়বে, আর কোথায় নয়, সেটা বুঝতে বুঝতেই শেখার ইচ্ছেটা মরে যায়।

২) ভাষার প্রয়োগে কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছের জায়গা নেই। কিছু আপাত রসহীন সমস্যার সমাধান করাই যেন প্রোগ্রামিংয়ের লক্ষ্য, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই তার।

৩) যেভাবে প্রোগ্রামিং, ইস্কুলের বাঁধাধরা কারিকুলাম মেনে শেখানো হয়, সেখানে খুটখাট করে এক্সপেরিমেন্ট করার জায়গা নেই। এক ঘণ্টার পিরিয়ডে চারটে প্রোগ্রাম নামাতে হবে!

তাবড় তাবড় প্রোগ্রামারদেরও প্রথম সংস্করণটা নির্ভুল হয়না।

সায়মিন্দু আমাদের দুটো ছোটবেলার অভিজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দিলো। তার মধ্যে একটা হলো, কাগজে কলমে প্রোগ্রাম লেখা। “এটা যে কি অস্বাভাবিক জিনিস, বলে বোঝানো মুস্কিল। তাবড় তাবড় প্রোগ্রামারদেরও প্রথম সংস্করণটা নির্ভুল হয়না। প্রোগ্রাম চালিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ডিবাগ করে তবে সেটা দাঁড়ায়। অথচ, ইস্কুলে আশা এই যে কাগজে কলমে প্রথম চেষ্টাতেই নিখুঁত প্রোগ্রাম বেরিয়ে আসবে।” আরেকটা সমস্যা, ইস্কুলে যথেষ্ট সংখ্যক কম্পিউটার থাকে না। একটা কম্পিউটারে চার পাঁচজনকে বসিয়ে দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই একজন কোড করে, বাকিরা চেয়ে চেয়ে দেখে। চেয়ে চেয়ে দেখে কতটা শেখা যায়, সেটা না বলাই ভালো।

শিক্ষাপ্রদানের পন্থা বদলানো একটা ভিন্ন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু, প্রোগ্রামিং ভাষা শেখার যে প্রতিবন্ধকতা ভাষার মধ্যেই আছে, তাকে অনেকটা দূর করেছে ‘স্ক্র্যাচ’। চেষ্টা ছিল এমন একটা ভাষা তৈরী করা, যার জমি থাকবে অনেক নিচে, ছাত অনেক উপরে আর নড়াচড়া করার অনেকটা জায়গা থাকবে। অর্থাৎ, শেখা যাবে চটপট, একবার শিখলে প্যাঁচালো থেকে প্যাঁচালোতর কাজে লাগানো যাবে, আর সামনের বেঞ্চের প্রথমেশ থেকে পিছনের বেঞ্চের লাল্টুবিল্টু — সকলেই নিজের মত শেখার রাস্তা খুঁজে নিতে পারবে।

পরের সপ্তাহে আমরা দেখবো, ‘স্ক্র্যাচ’ কিভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করল।

ছবি: MIT News

খেলাচ্ছলে প্রোগ্রামিং – ২

খেলাচ্ছলে প্রোগ্রামিং –২

$
0
0

 

sayaminduMIT মিডিয়া ল্যাব-এর সায়মিন্দু দাশগুপ্তর সাথে আমরা এক আলোচনায় বসলাম। সেই আলোচনায় উঠে এলো তাদের একটা বিশেষ প্রজেক্টের কথা: কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখাকে কিভাবে মজাদার করা যায়। আগের পর্বে আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম প্রোগ্রামিং শেখা থেকে কেন অনেক শিশুই বিরত থাকতে চায়। দেখা গেল, দুর্বোধ্য ভাষা, ভাষার প্রয়োগে ব্যক্তিগত ইচ্ছার অনুপস্থিতি আর ইস্কুলের বাঁধাধরা নিয়মে শেখানো, এই তিনে মিলে প্রোগ্রামিং শেখাকে তেতো ওষুধ গেলার মত করে দিয়েছে। এই সমস্যার সমাধান করতে এমন এক ভাষার খোঁজ করা হলো যেটা শেখা যাবে চটপট, একবার শিখলে যা-ইচ্ছে-তাই করা যাবে আর যার যেভাবে শিখতে ইচ্ছে, সে সেইভাবে শিখতে পারবে। তৈরী হলো একটা নতুন প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা – স্ক্র্যাচ। সেই ভাষার কিছু ঝলক আমরা দেখেছিলাম আগের পর্বে। কিভাবে এই নতুন ভাষা সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করলো, সেটা দেখব এই পর্বে। লিখেছে অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়

 

তুন ভাষাটার সাফল্য এখানেই যে সেটা এই তিনটে জিনিসই মাথায় রাখতে পেরেছে। বিশেষ করে তৃতীয়টা — ভিন্ন শিক্ষার্থীর ভিন্ন শেখার স্টাইলকে জায়গা দিতে পেরেছে। সায়মিন্দুর কথায় — “যার ছবি আঁকতে ঝোঁক, সে ছবি আঁকতে আঁকতে কিছু প্রোগ্রামিং শিখে নিল। যার প্রোগ্রামিংয়ের শখ, সে একটু ছবি এঁকে নিল।” দুজনেই কিন্তু ভবিষ্যতের আই.টি. সেক্টরের কর্ণধার হওয়ার কথা ভাবছে না। নিজের মধ্যে সুপ্ত একটা খুদে স্রষ্টা কি শিল্পীকে বাইরে টেনে আনছে মাত্র। তাদের যেটা ভালো লাগে, এমন কাজের মাধ্যমে শিখছে তারা — তা সে গেম বানানোই হোক কি গল্প বলাই হোক। কোন দুঃখে একটা হ-জ-ব-র-ল ভাষা শেখার চেষ্টা করছি, সেই প্রশ্ন তাদের মাথাতেও আসছে না।

ব্যাপারটা সহজ ভাবে বোঝাতে কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক:

  • একবার একটা ১৩ বছরের ছেলে একটা গেম বানিয়েছিলো, কিন্তু কিভাবে স্কোর রাখবে সেটা বুঝতে পারছিল না। ‘স্ক্র্যাচ’ টীম-এর এক প্রফেসর তাকে শেখালো ‘স্ক্র্যাচ’-এ ভেরিয়েবিল কি করে বানাতে হয়। ছেলেটা তো মহা খুশি, প্রফেসরকে ধন্যবাদের বন্যায় ভাসিয়ে দিল। পরে প্রফেসর ভাবছিলেন, এরকম কস্মিনকালেও হয়েছে কি যে বীজগণিত ক্লাসে ভেরিয়েবিল শিখে ছাত্র এতটা খুশি হয়ে গেছে!

  • jamini_roy_projectকিম্বা ধরা যাক, যামিনী রায় স্টাইলে পেইন্টিং নিয়ে এই প্রজেক্টটা। দেখা যাচ্ছে, স্রষ্টার আঁকার দিকে ঝোঁক বেশি (এবং আঁকার হাতটাও দিব্যি)। ‘স্ক্র্যাচ’-এর নির্মাতারা বলে, হোক না, তাতে ক্ষতি কি? যে যেভাবে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, সেইদিক থেকেই আসুক না! এমন আঁকার হাত যার, তাকে ক্লাসে জায়গা দেওয়া হবে না, এ কেমন কথা?

  • center_of_earth_projectএই প্রজেক্টটা বানিয়েছে বেঙ্গালুরুর একটা ছেলে। ভূগোল ক্লাসে সে শিখেছিল পৃথিবীর নিচে অনেকগুলো স্তর আছে, যারা একে অপরের সাপেক্ষে নড়াচড়া করে। এটা শুনে তার মনে কি ভাব জেগে উঠলো, সেটা সে মহা উৎসাহের সাথে সবাইকে বললো এই অ্যানিমেশনটার মাধ্যমে। মিউজিক, নেপথ্য-কন্ঠ, আরো নানান খুঁটিনাটি দিয়ে ভরাট এই অ্যানিমেশনটা একটা বারো বছরের ছেলে বানিয়েছে, এটা ভাবলেই অবাক লাগে!

  • এখানে দেখতে পাবেন, নানারকম উৎসবের একটা সংকলন। বাচ্চারা দেদার আনন্দে বছরের প্রিয় সময়গুলোর কথা বয়ান করেছে এখানে।

festivals project

অতএব দেখতেই পাচ্ছেন, কম্পিউটার ল্যাবে সপ্তাহে এক কি দু ঘন্টার পিরিয়ডে যা শেখা যায়, তার থেকে অনেক জটিল জিনিস শিখছে এই শিশুরা! শিখতে পারছে, কারণ তারা এমন কিছু একটা তৈরী করছে, যার একটা গভীর অর্থ আছে তাদের কাছে!


এছাড়া, ভাষাটাও যত কম খটমট করা যায়, তার চেষ্টা করা হয়েছে। যাকে বলে সিনট্যাক্স এরর বা ব্যাকরণের গলদ, সেগুলো করা খুব কঠিন। ব্লকগুলো খাপে খাপে না বসলেই আপনি বুঝে যাবেন, কোথাও গোলমাল করছেন। যেমন, যেসব ব্লক নির্ধারণ করে কাজগুলো কখন বা কতবার হবে, তারা হাঁ করে থাকে, যাতে তাদের হাঁ করে থাকা মুখে সেই কাজের ব্লকগুলোকে গুঁজে দেওয়া যায়।

code_blocks

আরেকটা জিনিস নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন। এইসব ব্লকে একটা ষড়ভুজ আকারের খোপ আছে। সেখানে বসবে যাকে বলে কন্ডিশন বা শর্ত। যে শর্ত পূরণ হলে ওই হাঁ করে থাকা ব্লকের ভিতরের কাজগুলো শুরু বা শেষ হবে। এবার ওই ষড়ভুজ আকারের খোপে আরেকটা ষড়ভুজ আকারের ব্লককেই বসানো যায়, যাকে তাকে বসানো যায়না। আমরা যারা প্রোগ্রামিং করেছি, তারা জানি শর্তটা একটা হ্যাঁ-না প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে আসবে। যাকে বলে বুলিয়ান ভ্যালু। হ্যাঁ-না প্রশ্নের ব্লকগুলো করা হয়েছে ষড়ভুজ আকারের, যাতে খাপে খাপে বসে যায় ওই লুপ ব্লকের ষড়ভুজ খুপড়িতে।

conditional_blocks

দেখতেই পাচ্ছেন, সিনট্যাক্স এরর করা, অর্থাৎ ভাষার নিয়ম ভাঙ্গার জো-টি নেই। জমিটা কতটা নিচু দেখতে পাচ্ছেন তো নিশ্চয়ই।

তাছাড়া, ইংরিজি হরফ পড়তে পারে না অথচ প্রোগ্রামিং শিখতে বসেছে, এমন কাউকে দেখেছেন কি? ‘স্ক্র্যাচ’ যেহেতু ছবির উপর কিছু নির্দেশ মাত্র, নির্দেশগুলোকে অনুবাদ করলেই অন্য যেকোনো ভাষায় ‘স্ক্র্যাচ’ শেখা যায়! এবং অনুবাদ হয়েওছে অনেক ভাষায়। ইংরাজি না জানাটা প্রোগ্রামিং শিখতে আর কোনো বাধাই নয়!

এসবের পরেও আটকে গেলে উদ্ধার করার জন্য বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ খুদে শিক্ষক রয়েছে। আবার অপরদিকে ফাটাফাটি কিছু নামিয়ে দিলে তারিফ করার লোকেরও অভাব নেই। যেহেতু পুরো খেলাটাই, থুড়ি কোডিংটাই অনলাইন করা হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ার সব হাতিয়ারই মজুত রয়েছে। শেয়ার, কমেন্ট, রি-শেয়ার এবং প্রত্যেকটা প্রজেক্টই যেহেতু ওপেন-সোর্স, তাতে নিজের মত রিমিক্স করা — সবই চলে ‘স্ক্র্যাচ’-সমাজে। এবং শেয়ার করাকে রীতিমত উৎসাহ দেওয়া হয়। যেসব প্রজেক্টকে সবথেকে বেশি লোকে আপন করে রি-শেয়ার করে, তাদের হোমপেজে ফীচার করা হয়। ইন্টেলেকচুয়াল সম্পত্তি মিছিমিছি আগলে রাখার প্রবণতা যাতে না গড়ে ওঠে, সেদিকে সজাগ থেকেছেন ‘স্ক্র্যাচ’-এর স্রষ্টারা।

শিশুদের জগতে এমন বাস্তবজীবনের প্রস্তুতি সাধারণ স্কুলের বাঁধাধরা কারিকুলামের মধ্যে সম্ভবই নয়।

এর একটা অপ্রত্যাশিত প্রভাব দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কোলাবরেশন বা যৌথ উদ্যোগ, শিক্ষার জগতে যেটা প্রায় নেই বললেই চলে। সায়মিন্দুর কথায়, “আমাদের শিক্ষাটা আসে উপর থেকে — বয়স্ক, অভিজ্ঞ শিক্ষকদের থেকে। সমবয়েসীদের কাছে যে শেখার সুযোগ আছে, আমরা সেটা ভেবেই দেখিনা। অথচ, বড় হলে তখন কোলাবরেশনের জয়জয়কার।” এই কোলাবরেশনের কিছু অভাবনীয় দৃষ্টান্ত দেখা গেছে ‘স্ক্র্যাচ’-সমাজে। যেমন, ইংল্যান্ড-এর একটা পনের বছরের মেয়ে কিছু মজাদার অ্যানিমেশন বানালো। তাই দেখে ইংল্যান্ডেই একটা দশ বছরের মেয়ে তাকে অনুরোধ জানালো, আমার প্রজেক্টের জন্য একটা ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরী করে দাও প্লিজ। দুজনে মিলে একটা “কোম্পানি” খুলে বসলো, যাদের দাবি তারা উচ্চ মানের ভিডিও গেম বানিয়ে দিতে পারে। তাতে যোগ দিল, আমেরিকার নিউ জার্সিতে থাকা চোদ্দ বছরের একটা ছেলে। তার প্রোগ্রামিংয়ের ক্ষমতা দিয়ে সে জায়গা করে নিল কোম্পানিতে। শিশুদের জগতে এমন বাস্তবজীবনের প্রস্তুতি সাধারণ স্কুলের বাঁধাধরা কারিকুলামের মধ্যে সম্ভবই নয়।

কম্পিউটার যে একদিন বাঁধাধরা কারিকুলামকে ছিন্নভিন্ন করে শিক্ষার জগতে নতুন পথের নির্দেশ করবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন MIT মিডিয়া ল্যাবেরই কিছু পথিকৃত। সিমোর প্যাপার্ট তার মধ্যে অন্যতম। ‘স্ক্র্যাচ’ হয়ত সাম্প্রতিক একটা ঘটনা, কিন্তু তার গোড়াপত্তন করে গেছিলেন প্যাপার্ট। প্যাপার্টের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা থেকেই আজকের এই নতুন শিক্ষাপ্রদানের মাধ্যমে আসা গেছে। তবে তার কথা আরেকদিন বলবো। আপাতত স্ক্র্যাচ-এর দুনিয়ায় ছেড়ে দিলাম আপনাদের। দেখুন তো, যে গল্পটা এদ্দিন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেটাকে স্ক্র্যাচের সাহায্যে বলতে পারেন কিনা।

তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:

[১] সায়মিন্দুর সাথে আলোচনা ছাড়াও এখান থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রচ্ছদের ছবিটিও এখান থেকে গৃহীত।

[২] স্ক্র্যাচে একটা নতুন প্রজেক্ট খুলে কোনো নির্দেশ ছাড়াই খুটখাট করতে করতে ভাষাটা শিখে যেতে পারেন। কিন্তু যদি নিতান্তই শুরু করিয়ে দিতে একটু নির্দেশের প্রয়োজন হয়, এখান থেকে শুরু করতে পারেন।

[৩] যদি বাবা-মা হিসেবে আপনার সন্তানের জন্য স্ক্র্যাচের কথা ভাবেন আর মনে কিছু প্রশ্ন থাকে, এখানে দেখুন।

[৪] যদি শিক্ষক হিসেবে আপনার ছাত্রদের জন্য স্ক্র্যাচের কথা ভাবেন আর মনে প্রশ্ন আসে যে একা পড়ে যাবেন কিনা, এখানে দেখুন। বিশ্বজুড়ে শিক্ষকেরা কিভাবে স্ক্র্যাচকে ব্যবহার করছেন, তার গল্প জানতে পারবেন। যদি আপনার কোনো ছাত্র স্ক্র্যাচের সাহায্যে দারুণ কিছু বানিয়ে ফেলে, আমাদের ইমেল করে জানাবেন (ইমেইল: bigyan.org.in@gmail.com)।


পাখিপ্রাণ সালিম আলি (১৮৯৬-১৯৮৭)

$
0
0

মানস প্রতিম দাস

আকাশবাণী কলকাতা

৯৫০ সাল। সুইডেনের উপসালাতে বসেছে পক্ষীবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। প্রথম অধিবেশন শুরু হতে তেমন দেরি নেই, পৌঁছে গিয়েছেন প্রায় সবাই। একজন ভারতীয় অবশ্য তখনও পৌঁছন নি। কী হবে? কোথাও আটকে গেলেন নাকি? অনুপস্থিত থাকবেন? এমন ভাবনা যখন ঘুরছে আয়োজকদের মনে তখন হঠাৎ মোটরসাইকেলের গর্জন। একটা সানবীম মডেল ব্রেক কষে দাঁড়াল সভাঘরের বাইরে। নামলেন সেই ভারতীয়। মুহূর্তের মধ্যে খবর চাউর হয়ে গেল যে ভারত থেকে সোজা বাইকে করে উপসালা পৌঁছেছেন এক ভারতীয় পক্ষীবিদ! যার কথা হচ্ছে তিনি সালিম আলি। চুয়ান্ন বছর বয়সে ফিল্মি হিরোর মত বাইকে করে আবির্ভূত হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই যাঁর। এতটাই আকর্ষণ মোটরবাইকের প্রতি যে একটা মডেল নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন না তিনি, শুধু হার্লে-ডেভিডসনেরই তিন রকম মডেল ছিল তাঁর কাছে। এছাড়াও একটা করে ডগলাস, স্কট, নিউ হাডসন এবং জেনিথ মোটরবাইক চালিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। অবশ্য সানবীমের গল্পটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ভারত থেকে গোটা পথ ঐ বাইকে পাড়ি দেন নি তিনি। বম্বে থেকে জাহাজে করে ইউরোপে আনান বাইকটা, উদ্দেশ্য ছিল সম্মেলনের আগে সেটাতে করে ইউরোপ চক্কর দেওয়া। এই কাজ করতে গিয়ে ফ্রান্সে ছোটখাটো দুর্ঘটনায় পড়লেন, জার্মানীর মসৃন, বাঁধানো রাস্তায় আছাড়ও খেলেন বেশ কয়েকবার। তাতে কী? ভালবাসার জন্য কতকিছু করা যায়, হাত-পায়ে চোট তো সামান্য ব্যাপার। প্রবন্ধের শুরুতে ঝাঁকুনি খেয়ে পাঠক হয়ত প্রশ্ন তুলে ফেলেছেন, সালিম আলি কোনটা বেশী ভালবাসতেন, পাখি না মোটর বাইক? জানা নেই উত্তরটা, তবে বাকি প্রবন্ধ তাঁর পক্ষীপ্রেমের আলোচনায় নিবেদিত।

সালিম আলির পক্ষী-পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর ও জাহাঙ্গীরের মত – দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠা বজায় রাখা।

যে কোনো শাখার একনিষ্ঠ গবেষক সেই শাখার গভীরতা বুঝতে তার ইতিহাস পাঠ করেন নিবিড়ভাবে। নিজের উপলব্ধি পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষের কাছে । প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কাজটা করেছিলেন ‘আ হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’-র  মাধ্যমে। সালিম আলি ব্যবহার করেছেন তাঁর লেখনী ও বিভিন্ন বক্তৃতার মঞ্চ। ষোড়শ আজাদ মেমোরিয়াল লেকচারে সালিম আলি তুলে আনলেন ভারতবর্ষের পক্ষীচর্চার ইতিহাস। মুঘল আমলের আগে পাখিদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা হলেও সেগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চেষ্টা শুরু হয় বাবরকে দিয়ে। সালিম আলির মন্তব্য, চালু ধারনাকে আশ্রয় করে পাখির বর্ণনা তৈরি করতেন না সম্রাট বাবর। একটা উদাহরণ – শীতকালে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মোনাল ফিজ্যান্ট (monal pheasant) নেমে আসে পাহাড়ের পাদদেশে। ওড়ার পথে ফিজ্যান্টের দল যদি কোনো আঙুরক্ষেতের উপর দিয়ে যায়, তখন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে যায় সেখানেই। বাবর লিখছেন, ‘এইসব কথার সত্যতা ঈশ্বরই জানেন। আমি বুঝি যে এর মাংস বেশ সুস্বাদু।’  ইতিউতি কথায় যে বাবরের আস্থা নেই এবং পক্ষীকুলের বর্ণনায় যে সেগুলোকে কোনো স্থান দেননি তিনি, এটা তার দৃষ্টান্ত।

বাঁধানো রাস্তায় আছাড় খাওয়া এবং হাত-পায়ে চোট পাওয়া সত্তেও সালিম আলি দেশ বিদেশে মোটরবাইক সফরে বেরিয়ে পড়তেন। (ছবির উৎস)

তবে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যিনি পাখি সম্পর্কিত জ্ঞানের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন নিবিড়ভাবে, তিনি জাহাঙ্গীর। তার সম্পর্কে বলা হয়, সম্রাট না হয়ে তিনি যদি কোনো ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রধান হতেন তবে হয়ত অনেক বেশি সুখী হতেন। এমনই ছিল তার পক্ষীপ্রেম। রাজসভায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর ওস্তাদ মনসুর-কে। তাঁর কাজ ছিল নতুন পাখির ছবি আঁকা। জাহাঙ্গীরের আগ্রহ জানতেন তাঁর সাম্রাজ্যের সবাই, এমনকি বিদেশীরাও। তাই নজরানা হিসাবে তারা নিয়ে আসতেন তাদের এলাকার বিশেষ প্রজাতির পাখি। সেগুলো সম্রাটের হাতে পৌঁছনো মাত্রই তিনি মনসুরকে নির্দেশ দিতেন পাখির নিখুঁত ছবি আঁকতে। সৌভাগ্যক্রমে, এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি আজও সংরক্ষিত রয়েছে। কলকাতার ভারতীয় যাদুঘরেও সম্ভবতঃ রয়েছে তার নমুনা। ছবির পাশাপাশি পাখির চেহারা, বাসস্থান এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করতেন জাহাঙ্গীর।  সেইসব বর্ণনা ধরা রয়েছে তাঁর স্মৃতিকথায়। ১৬২৪ পর্যন্ত চলে জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথা রচনা। এই সময়ের মধ্যে কত যে পাখির বৈজ্ঞানিক বর্ণনা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। সালিম আলি জানিয়েছেন যে তাঁর দরবারে ডোডো পাখিও পৌঁছেছিল। তবে সেটা ১৬২৪ সালের পরে। ফলে সেটার ছবি থাকলেও স্মৃতিকথায় কোনো উল্লেখ নেই।

জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্য বা আরো পরে মুঘল সাম্রাজ্য ছারখার হওয়ার পরে সম্রাটের সংগৃহীত বহু নমুনা বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে। স্রেফ লুটের খেলা চলছিল তখন। যিনি পাখির নমুনা চুরি করছেন, তিনি হয়ত জানেনও না তার গুরুত্ব। লুটেরাদের দলে অবশ্যই ছিল ব্রিটিশরা। কিন্তু তাঁদের অপরাধের পাশাপাশি গুনপনাও কিছু কম ছিল না। ব্রিটিশ রাজপুরুষদের অনেকেরই আগ্রহ ছিল পাখিদের সম্পর্কে তথ্যভান্ডার গড়ে তোলায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভারতে প্রথম পাখি সম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক সংকলন তৈরী করেছিলেন ব্রিটিশ সাহেব জার্ডন। ১৮৬২ এবং ১৮৬৪ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘বার্ডস অফ ইন্ডিয়া’-র দুটো খন্ড। এর পরে যে খামতি ছিল তা পূরণ করেন দুজন ভারতীয় — সালিম আলি এবং সিডনি ডিলো রিপলে। দশ খন্ডে তাঁরা প্রকাশ করেন ‘হ্যান্ডবুক অফ দ্য বার্ডস অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’। প্রকাশকাল ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩। এতগুলো খন্ড প্রকাশের পরও, যে বিষয়টা সালিম আলিকে চির-অতৃপ্ত রেখেছিল তা হলো পাখিদের স্থানীয় নামের নির্ভরযোগ্য তালিকা সম্পূর্ণ করতে না পারা। এর অভাবে জনপ্রিয় বই যে তৈরী করা মুশকিল তা বিলক্ষণ জানতেন তিনি।

জনপ্রিয়করণের এই আগ্রহ যে সারা জীবন তাঁর মধ্যে ছিল, তার বহু প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। পরিণত বয়েসে একবার তিনি প্রতিষ্ঠিত পক্ষীবিদ রিপলেকে বেশ রাগ করেই লেখেন যে পক্ষীচর্চার সবটাই যদি কাঠ-কঠিন নামকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তিনি ছেড়েই দেবেন বিষয়টা। অরণ্যে পাখিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অধ্যয়ন ছেড়ে তিনি এমন ট্যাক্সোনমির যুদ্ধ করতে আগ্রহী নন। মজার কথা, প্রাণীবিজ্ঞানে সালিম আলির প্রশিক্ষণ মাত্র এক বছরের। ১৯১৭ সালে দুটো কলেজে একসাথে ভর্তি হন তিনি। একটাতে পড়াশোনার বিষয় ছিল আইন ও হিসাবশাস্ত্র। অন্যটাতে প্রাণীবিজ্ঞান। Salim_Ali_The_Fall_of_a_sparrowদুটোই সম্পূর্ণ করেন তিনি। অবশ্য শুধু সময়ের ‘দৈর্ঘ্য’ দিয়ে এই সময়টাকে মাপলে চলবে না। এই সময়েই তিনি যুক্ত হতে শুরু করেন বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সঙ্গে। তার কেরিয়ার গঠিত হতে শুরু করে এই জায়গা থেকে। তবে ওই সোসাইটির সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় যে নিতান্ত শৈশবে, তা তো পাঠক মাত্রেই জানেন। ঘটনাটা এইরকম। একটা চড়ুই পাখি মেরেছিল ছোট্ট সালিম, তাঁর খেলনা এয়ারগান দিয়ে। সোসাইটির সম্পাদক মিলার্ড সাহেব সেই পাখি দেখে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। পাখির শরীরে ব্যতিক্রমী রঙের বিস্তার দেখে মনোযোগী হলেন তিনি।  চিহ্নিত করলেন পীত্কন্ঠ চড়ুই হিসাবে।  এরপরে, বলা যায় পুরস্কার হিসাবে, সোসাইটির stuff  করা পাখির সংগ্রহ দেখালেন।  এই বিশেষ চড়ুইয়ের কথা সালিম আলি লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অফ আ স্প্যারো’ তে।  মৃত চড়ুই তাঁকে পাখির জগতের দরজা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রির সঙ্গে তাঁর যোগ যে কতটা নিবিড় ছিল তা বোঝাতে ১৯৮৩ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখের নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করব। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বায়োলজি আন্ডার দ্য রাজ’। সোসাইটির শতবর্ষ পূর্তিতে এর ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে এক জায়গায় লেখা হয়েছে (অনুবাদ) :

“১৯৩০ থেকে বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির কাহিনী নির্ধারিত হয়েছে সালিম আলি নামে এক ক্ষীনদেহীর দ্বারা। কোনো ডিগ্রী নেই, জীববিজ্ঞানের প্রশিক্ষণও দূর অস্ত, তিনি বার্মায় কাঠ ব্যবসায়ীর পেশা ছেড়ে নিজের জীবন নিয়োজিত করেন পক্ষীচর্চায়। আজ ৮৭ বছর বয়সেও তিনি সমান সক্রিয় এবং দেশে বিদেশে সোসাইটির সঙ্গে তাঁর নাম সমার্থক। তাঁর ভূমিকার তাৎপর্য দুরকম: প্রকৃতিবিদ হিসাবে এবং প্রশাসক রূপে। যদিও প্রানীদের সমীক্ষার সাথে মূলত যুক্ত ছিলেন তিনি, প্রান্তরে-অরন্যে গিয়ে প্রাণীর আচরণ ও বাস্তুতন্ত্রের সংস্কারমুক্ত, সরল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ইতিহাস চর্চার প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তোলেন।  বিশেষ করে বাবুই পাখির সামাজিক জীবন সম্পর্কে তাঁর গবেষণা, মুক্ত ভাবনা এবং স্পষ্টতার দিক দিয়ে কিছু বছর আগে great crested grebes এর উপর জুলিয়ান হাক্সলির করা গবেষণার সঙ্গে তুলনীয়।”

প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সালিম আলি ভরতপুরকে চাষের ক্ষেতে পরিবর্তিত হওয়া থেকে বাঁচান। 

তবে সোসাইটির পুরোভাগে থাকাকালীন কিছু বিতর্কেও জড়িয়ে পরেন তিনি। স্বাধীনতার পরে যখন রাজস্থানের ভরতপুরে মহারাজার অধীনে থাকা কেওলাদেও ঘানা বার্ড স্যাংচুয়ারি ভেঙেচুরে চাষের ক্ষেত বানানোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন শুরু করে, তখন তিনিই প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাঁচান ভরতপুরকে। অবশ্য মহারাজার শিকারের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। প্রজননের ঋতুতে শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা পড়ে। পাখির জন্য এলাকার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করেন নি তিনি। অবশ্য নেহাৎ আবেগের বশে একাজে লিপ্ত হননি সালিম আলি। তিনি দেখান যে ভরতপুর পার্শ্ববর্তী এলাকাকে দেয় অনেক কিছু – গবাদি পশুর খাবার, জ্বালানি কাঠ, ফল এবং বাড়ির ছাউনির জন্য খড় ইত্যাদি। চাষের ক্ষেত তৈরি হলে এর থেকে বেশি উপকৃত যে নাগরিকরা হবেন না, তা বোঝে সরকার। পাশ হয় ভরতপুরের অরণ্য ও জলাভূমি অটুট রাখার সিদ্ধান্ত।

এই ভরতপুরকেই ন্যাশনাল পার্ক করার আগ্রহ দেখান সালিম আলি। এই আগ্রহের সঙ্গে যুক্ত হয় দাবি – গবাদি পশুকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না এই এলাকায়। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে সোসাইটির করা এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে গবাদি পশু না ঢুকলে এক বিশেষ ধরেণের আগাছা বাড়ছে হু হু করে।  এরা জলের মধ্যে মাছের জীবনকেও সীমিত করে দিচ্ছে। ফলে মাছের সংখ্যা কমছে এবং সঙ্গে-সঙ্গে কমে যাচ্ছে জলের পাখি। এই সমীক্ষায় সহযোগী হয় ইউনাইটেড স্টেট্স ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিস। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী সচিব ডেভিড চালিনর ১৯৮০ সালে আসেন এই সমীক্ষায় অংশ নিতে। হতবাক হয়ে তিনি চিঠি লেখেন রিপলেকে।  রিপলে বিষয়টা নিয়ে লেখেন সালিম আলিকে। প্রায় এক দশক চলার পর ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় সোসাইটির প্রতিবেদন, সালিম আলির মৃত্যুর (১৯৮৭) পর। গবাদি পশুর অভাবে ভরতপুরে পাখির দৈন্যদশা পরিষ্কার হয়। 

সালিম আলি সারা জীবন নিজেকে দেখেছেন একজন শখের বা অ্যামেচার পক্ষীবিদ হিসাবে। অথচ তিনিই  তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন পেশাদারিত্বের সুউচ্চ মান। বিজ্ঞানী মাধব গ্যাডগিল-এর মতে তাঁর পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর ও জাহাঙ্গীরের মত – দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠা বজায় রাখা। হয়ত আবেগের বশে কোথাও-কোথাও তিনি কিঞ্চিৎ সরে গিয়েছেন যুক্তির নিগড় থেকে। তবে তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে সবসময় ছিল পাখিদের সংরক্ষণ। কেবল সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি নয়, নিখাদ অর্থনৈতিক মূল্যে পাখি যে কত দামী তা বুঝতেন তিনি, বুঝিয়ে গিয়েছেন আমাদের।

ম্যান্ডারিন এবং ঊড হাসের ছবিটি তুলেছে অনিন্দিতা সরকার।

(প্রচ্ছদের ছবির উৎস)

লেখার উৎস ও অন্যান্য টুকিটাকি:

[১] স্যাংচুয়ারি ও ন্যাশনাল পার্কে গবাদি পশুদের ঢুকতে দেওয়া উচিত কিনা, এবং এই তর্কে কেওলাদেও ঘানা বার্ড স্যাংচুয়ারির   ভূমিকার কথা জানতে পড়ুন এখানে।   

[২] পাখী সংক্রান্ত কয়েকটি সুন্দর ওয়েবসাইট – Bird Count India, eBird, eBird India, Cornell Lab of Ornithology, Audubon Society

 

Manas Pratim Dasডঃ মানস প্রতিম দাস, অনুষ্ঠান কার্যনির্বাহক, আকাশবাণী কলকাতা, আকাশবাণী ভবন। 

মানস প্রতিম দাস যেমন আকাশবাণীর মাধ্যমে বিজ্ঞানের জনপ্রিয়করণে একজন সফল মানুষ তেমনই তাঁর নানান লেখা এবং তথ্যমূলক প্রযোজনার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন রাজ্য এবং জাতীয় স্তরে! 

email:i2manas@gmail.com

মানস প্রতিম দাসের আরও কিছু লেখা 

‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত লেখার বাছাই সংকলন ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’ ডাউনলোড করুন। 

পাঠকের দরবার বিভাগের জন্য আপনাদের প্রশ্ন পাঠান।

‘ক’-এ কোয়ান্টাম!

$
0
0

রাজীবুল ইসলাম, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি

প্রথম পর্ব-  সব্যসাচী

“জাগলো সাড়া নিদ্ মহলে, অ-থই নিথর পাথার-জলে

আলপনা দ্যায় আল্ তো বাতাস, ভোরাই সুরে মন ভোলা !” 

(‘ভোরাই’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

য়নার মত স্থির নদী আর তার উপর আলতো করে বাতাসের আঁকিবুকি কাটা নিয়ে কবি-সাহিত্যিকেরা অনেক লিখেছেন। বাতাসের দোলায় জলের উপর যে রকমারি নকশা তৈরী হয়, তা সত্যিই দৃষ্টিনন্দন!

কিন্তু, ভেবে দেখেছ কি কেন হয় এই নকশা?

তরঙ্গ জগত

ভালো করে দেখলে খেয়াল করবে, জলের একটা তরঙ্গ আরেকটার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে এই আলপনা সৃষ্টি করছে। বাতাসের ধাক্কায় জলে তৈরী হয় তরঙ্গ বা ঢেউ। জলে ঢিল ফেললে যেমন হয়, সেইরকম। এই তরঙ্গ উৎস থেকে দূরে ছড়িয়ে পড়ে। আর তার চলার পথে কেঁপে ওঠে জল — উঁচু থেকে নীচু, আবার উঁচু, এমনি ভাবে।

এবার ভাব, সেই তরঙ্গের উপর আরেকটা তরঙ্গ — যে অন্য জায়গা থেকে উঁচু-নীচু-উঁচু-নীচু খেলতে খেলতে ছুটে আসছিল — হুমড়ি খেয়ে পড়লে কি হবে?

quantum1_waterwaveinterfere1200

জলের তরঙ্গ একে অপরের উপর ইন্টারফেয়ার করে সুন্দর নকশা তৈরি করে। উৎস – উইকিমিডিয়া

বাড়ীর সামনে পুকুর থাকলে দুটো ঢিল ফেলে একবার ভাল করে দেখে আস, এই প্রশ্নের উত্তর পাবে। আমি ঘরে বসেই একটা পরীক্ষা করলাম। একটা বড় চ্যাপ্টা কাঁচের পাত্রে নিলাম কিছু জল। সেই পাত্রকে রাখলাম একটা উঁচু জায়গায়, যাতে তার উপর আলো ফেললে মেঝেতে সুন্দর ছায়া পড়ে। সেই জলকে আবার ফুড-কালারিং দিয়ে রাঙিয়ে দিলাম, যাতে মেঝেতে সুন্দর ছায়া-ছবি দেখা যায়! এবার সেই পাত্রের দুদিকে আমার দুই আঙ্গুলের ধাক্কায় তৈরি করলাম দুটো তরঙ্গ। আর তাদের খেল দেখতে লাগলাম!

দেখলাম, যেখানে প্রথম তরঙ্গের উঁচু অংশ দ্বিতীয় তরঙ্গের উঁচুর সাথে মিশলো, সেখানকার জলকে দুটো ঢেউ মিলে  সহযোগিতা করে আরো উঁচুতে তুলে দিল। যেখানে প্রথম তরঙ্গের নীচু অংশ এসে পড়ল দ্বিতীয় তরঙ্গের নীচুর উপর, সেখানেও তারা সহযোগিতা করে জলকে নামিয়ে দিল আরো নীচে।

সবথেকে মজার জায়গাটা হল, যেখানে প্রথম তরঙ্গের উঁচু অংশ গিয়ে পড়ল দ্বিতীয় তরঙ্গের নীচু অংশের উপর। ভাবতে পার, সেখানে কি হল?

ব্যাপারটা সহজ করে বলা যেতে পারে এভাবে — প্রথম তরঙ্গ সেই জায়গার জলকে বলল ‘উপরে ওঠ’, আর দ্বিতীয় তরঙ্গ বলল ‘নীচে নাম’! তাহলে তরঙ্গদুটোর যুগ্ম প্রভাব কি হবে? দুটো ঢেউয়ের শক্তি সমান হলে সেই জায়গায় তারা দু’জন দু’জনকে ‘ক্যানসেল’ করে দেবে। দড়ি টানাটানিতে দু’-পক্ষই সমান শক্তিশালী হলে যেমন দড়ি এদিকেও সরে না, ওদিকেও সরে না, তেমন-ই!

তাহলে দেখলাম জলের বিভিন্ন জায়গায় দুই ঢেউ নিজেদের মধ্যে কখনো সহযোগিতা আর কখনো মারামারি করে চলেছে। আর তৈরী হচ্ছে সুন্দর নকশা।

এই যে দুটো তরঙ্গের মধ্যে সহযোগিতা আর মারামারির গল্প বললাম, বিজ্ঞানে এর একটা সুন্দর নাম আছে। এই ঘটনাকে বলে ইন্টারফেয়ারেন্স বা ব্যতিচার। ইংরাজীতে ‘ইন্টারফেয়ার’ শব্দের মানে ‘নাক গলানো’ – যেমন এখানে এক তরঙ্গ আরেক তরঙ্গের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে!

quantum1_butterfly_structural_color_195px-Morpho_didius_Male_Dos_MHNT

মরফো প্রজাপতির ডানার রঙ আসে আলোর ইন্টারফেরেন্সের ফলে। ছবির উৎস

ইন্টারফেয়ারেন্স হল তরঙ্গের ধর্ম। প্রকৃতিতে ইন্টারফেয়ারেন্সের উদাহরণ ছড়িয়ে আছে অনেক। রাস্তার উপর তেল পড়ে থাকলে সেখান থেকে যে বাহারী রঙ বেরোয় তা দেখেছো নিশ্চয়ই। এটা হয় তেলের পাতলা ঝিল্লি বা ফিল্ম থেকে প্রতিফলিত আলোক তরঙ্গগুলোর ইন্টারফেয়ারেন্সের ফলে। আরও অবাক করার মত তথ্য হল যে অনেক রঙবাহারী পাখী আর প্রজাপতি আছে, যাদের ডানাতে কোন রঞ্জক পদার্থ বা পিগমেন্ট নেই! তাহলে রঙ আসে কোথা থেকে? তারও মূলে এই আলোক তরঙ্গের ইন্টারফেয়ারেন্স। ডানার সূক্ষ্ম কারুকার্য থেকে সূর্যের আলোর কিছু নির্দিষ্ট রঙই ইন্টারফেয়ারেন্সের ফলে মুগ্ধ দর্শকের চোখে ফিরে আসে। বাকি রঙের তরঙ্গগুলোর যে অংশ ডানার সূক্ষ্ম কারুকার্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিফলিত হয়ে দর্শকের চোখের দিকে আসতে পারত, তারা নিজেদের মধ্যে ইন্টারফেয়ার করে একে অপরকে ‘ক্যানসেল’ করে দেয়। তাই তারা দর্শকের চোখে না ফিরে ডানায় শোষিত হয়ে যায়। ময়ূরের পেখমের রঙের রহস্যও একই!

     

কণা জগত

এতো গেলো তরঙ্গের কথা। প্রকৃতিতে তরঙ্গ ছাড়াও আছে কণা বা পার্টিকেল – এই যেমন ধরো মার্বেলের গুটি, নুড়ি-পাথর, ক্রিকেটের বল ইত্যাদি। তারা তরঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ে না। একটা মার্বেল গুলতি থেকে ছুড়ে মারলে সে দূরে কোন এক জায়গায় গিয়েই পড়ে। জলের তরঙ্গ যেমন একই সাথে অনেক জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তেমনটা হয় না।

এবার কণা দিয়ে একটা পরীক্ষার কথা ভাবি। একটা গুলতি বা বন্দুকে মার্বেল ভরে সেটাকে এলোপাথাড়ি ছুড়ছি দূরে একটা পর্দার দিকে। গুলতি আর পর্দার মাঝে রয়েছে একটা পাত, সেখানে আছে একটি আয়তকার ছিদ্র যাকে ইংরাজীতে ‘স্লিট’ বলে। মার্বেলগুলো স্লিট দিয়ে ঢুকে পর্দায় ধাক্কা মেরে দাগ তৈরি করছে। তাহলে সবশেষে পর্দায় কি দেখব? অনেকটা নিচের ছবির মত চেহারা হবে তার।

quantum1_particle_one_slit

এবার এই পাতে আরও একটা স্লিট কেটে দিলাম। তাহলে এবার মার্বেলগুলো দুটো স্লিটের যেকোন একটা দিয়ে যেতে পারে। পর্দায় যখন অনেকগুলো মার্বেল ধাক্কা মেরে দাগ তৈরি করেছে, তখন তা দেখতে অনেকটা এমন হবে।

quantum1_particle_both_slits

এখানে কালো রঙ্গের দাগগুলো হল সেই মার্বেলগুলোর কীর্তি যারা উপরের ছিদ্র দিয়ে গিয়ে পর্দায় ধাক্কা মেরেছে। লাল রঙ্গের দাগগুলো তৈরী করেছে নিচের ছিদ্র দিয়ে যাওয়া মার্বেলগুলো। লক্ষ্য কর, ছিদ্রদুটো যদি আরো চওড়া করি, তাহলে এই রঙিন ব্যান্ডগুলোও আরো চওড়া হবে।

 ভাবছ, এখানে আশ্চর্যের কি আছে? না, আশ্চর্যের তেমন কিছু নেই এই মার্বেলের পরীক্ষায়। খালি তরঙ্গ ও কণার মধ্যে পার্থক্য করার জন্য এই পরীক্ষাটার কথা বললাম। মার্বেলের গুলতির বদলে যদি জলের তরঙ্গ তৈরি করতাম, তাহলে কি হবে ভাবতে পারছ কি? ওই তরঙ্গ উপরের আর নিচের স্লিটে ধাক্কা খেয়ে দুটো আলাদা তরঙ্গ তৈরি করবে। সেই দুটো তরঙ্গ একে অপরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে, পর্দার উপর তৈরি হবে ইন্টারফেয়ারেন্স প্যাটার্ন (নিচের অ্যানিমেশন, সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)। ঠিক এই গল্পের শুরুতে যেমনটি বলেছিলাম।


 তাহলে তরঙ্গের ইন্টারফেয়ারেন্স দেখা যায়, কণার দেখা যায় না।

 

 কোয়ান্টাম জগত

এবার আমরা পাঠককে নিয়ে যাব এক আশ্চর্য জগতে। বর্ণনা করব এক আশ্চর্য পরীক্ষা।

বর্ণনা করব এক আশ্চর্য পরীক্ষা – মার্বেলের বদলে বন্দুক থেকে ছুড়ব ইলেক্ট্রন।

জোড়া স্লিটের যে পরীক্ষাটার কথা একটু আগে বললাম, সেখানে মার্বেলের বদলে বন্দুক থেকে ইলেক্ট্রন ছুড়ব। হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই পরমাণুর মধ্যে নিউক্লিয়াসের চারধারে যে ইলেকট্রন গোলক ধাঁধায় ঘোরে, সেই ইলেক্ট্রন। ভাবছ, ইলেক্ট্রনকে নিয়ে এমন খেলা আবার করা যায় নাকি? উত্তর হল, ঠিক এভাবে না হলেও এই পরীক্ষাটি কিন্তু সত্যিই নানাভাবে ল্যাবরেটরীতে করা হয়েছে।

আর একটা কথা, এই পরীক্ষাটা করব একদম অন্ধকারে। ইলেক্ট্রন এত ছোট যে পাছে আলো এসে তাকে ধাক্কা মেরে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে না দেয় তার জন্য। অর্থাৎ, মার্বেলের মত আমরা দেখতে পাচ্ছি না সে ঠিক কিভাবে গিয়ে পর্দায় আছড়ে পড়ছে। কিন্তু পর্দায় এক বিশেষ কেমিক্যাল মাখানো আছে যার সাথে  ইলেক্ট্রন বিক্রিয়া করে দাগ সৃষ্টি করবে — ঠিক মার্বেলের মত।

তো, আমরা ইলেক্ট্রন ছুড়ে চলেছি একে একে। প্রথমে দেখি একখানা স্লিট-ওয়ালা বাধা থাকলে কি দেখব। একে একে ইলেক্ট্রন উৎস থেকে পর্দার উপরে পড়ে দাগ তৈরি করছে। অনেক ইলেক্ট্রন পর্দায় ধাক্কা খাওয়ার পর ছবিটা এরকম হবে।

quantum1_wave_one_slit

এবার দেখি আগের মতো দুটো স্লিট থাকলে কি হয়। ইলেক্ট্রনগুলো আবার একে একে পড়ছে পর্দার উপর। বিস্ময়ের ব্যাপার, পর্দার কোন কোন জায়গায় একদমই আর কোন ইলেক্ট্রন পড়ছে না। সেই সব জায়গায় কিন্তু যখন দুটোর বদলে একটা মাত্র স্লিট খোলা ছিল, তখন পড়েছিল। ধীরে ধীরে ইলেক্ট্রনগুলো পর্দার উপর এক প্যাটার্ন তৈরি করল, নিচের ছবির মত।

quantum1_wave_both_slits

চিনতে পারছ? ঠিক, এ তো এক ইন্টারফেয়ারেন্সের প্যাটার্ন। ইলেক্ট্রন যেন এক তরঙ্গ!

কিন্তু, কিসের সাথে কিসের ইন্টারফেয়ারেন্স তৈরি হচ্ছে? আমরা তো একে একে ছুঁড়েছি ইলেক্ট্রনগুলোকে, যাতে কোনভাবে দুটো ইলেক্ট্রন একসাথে না থাকতে পারে, তাহলে? আর পর্দার উপরে তো ইলেক্ট্রনগুলো মার্বেলের মত কণা হয়েই তো আছড়ে পড়ল?

ইলেক্ট্রন তাহলে কণা না তরঙ্গ? সে মার্বেল গুটির মত পর্দার এক জায়গাতেই আছড়ে পড়ছে, তরঙ্গের মত সব জায়গায় ছড়িয়ে নেই। কিন্তু যেখানে আছড়ে পড়ছে সেই জায়গাগুলো একটা ইন্টারফেয়ারেন্স প্যাটার্ণ তৈরী করছে, যা কিনা তরঙ্গের ধর্ম!

খুব মুশকিলে পড়া গেল, তাই না?

ইলেক্ট্রন তরঙ্গ না কণা, না দুটোই ? ভূতুড়ে কোয়ান্টাম জগতে তোমাদের স্বাগত জানাই।

তাহলে আরেকবার ভাবা যাক, এই জোড়া স্লিটের পরীক্ষা মার্বেল আর জলের তরঙ্গ দিয়ে করলে তাদের মধ্যে কি তফাৎ। জলের একটাই  তরঙ্গ দুটো স্লিটে ধাক্কা খেয়ে দুটো তরঙ্গ তৈরি করল, আর তারা দুজনে পর্দার উপর একসাথে পড়ে ইন্টারফেয়ারেন্স করল। অর্থাৎ তরঙ্গ একসাথে দুই স্লিট দিয়ে গিয়েছিল বলে ইন্টারফেয়ারেন্স দেখাল। কিন্তু একটা মার্বেল হয় এই স্লিট নয় ওই স্লিট দিয়ে গিয়েছিল, একসাথে দুটো দিয়ে যাওয়া তো তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাই নিজের সাথে ইন্টারফেয়ারেন্স করাও সম্ভব নয়।

এবার আমরা একটু চালাকি করার চেষ্টা করি। চুপিসারে স্লিটদুটির কাছে একটা সূক্ষ্ম যন্ত্র বসিয়ে দিই, যা কিনা দেখতে পাবে ইলেক্ট্রন কোন স্লিট দিয়ে গিয়েছে। তাহলে খুব মজা হবে, তরঙ্গের মত ইন্টারফেয়ারেন্স প্যাটার্নও দেখব, আবার কণার মত বুঝেও যাব কোন স্লিট দিয়ে গিয়েছে ইলেক্ট্রন!

আবার ইলেক্ট্রন ছোড়া হচ্ছে একে একে। এবার আমাদের যন্ত্র বলে দিচ্ছে ‘এ ব্যাটা এই স্লিট দিয়ে, পরেরটা ঐ স্লিট দিয়ে … ’। আর পর্দায় একে একে সেই ইলেক্ট্রনগুলো মার্বেলের মত ধাক্কা মারছে।

এখানেও বিস্ময়! ধীরে ধীরে দেখা গেল আর কোন ইন্টারফেয়ারেন্স প্যাটার্ণ নেই !! মানে যখনই আমরা জেনে যাচ্ছি ইলেক্ট্রন কোন পথ দিয়ে গিয়েছে, তখনই সেই ইন্টারফেয়ারেন্স প্যাটার্ণ পুরো ভ্যানিশ!

quantum1_wave_both_slits_observed

কি অদ্ভুত, তাই না?

দেখতে গেলাম ইলেক্ট্রন তরঙ্গ না কণা – কিন্তু প্রকৃতি বললো “সে রহস্যময়। কোন পথ দিয়ে গিয়েছে না জানলে সে তরঙ্গ হয়ে সব পথ দিয়েই যাবে একসাথে। এক একটা ইলেক্ট্রন এক একটা তরঙ্গ। সে এখানেও আছে, আবার সেখানেও আছে একসাথে। তাই সে নিজের সাথে নিজেই ইন্টারফেয়ার করছে। কিন্তু কোন পথ দিয়ে যাচ্ছে জানতে পারলেই নষ্ট হয়ে যাবে তার তরঙ্গ ধর্ম। তখন সে হয় এখানে, নয় সেখানে। কিন্তু, দুটো জায়গায় একসাথে নয়। সে তখন কণা। সাধারণ মার্বেলের মত। ইন্টারফেয়ারেন্সের ধার ধারে না!”

ভূতুড়ে লাগছে? কোয়ান্টাম জগতে তোমাদের স্বাগত জানাই।

(চলবে)

অন্যান্য টুকিটাকি:

[পাখী বা প্রজাপতির শরীরে এই যে সূক্ষ্ম কারুকার্যের কথা বললাম, সেগুলোকে কিন্তু খুবই সূক্ষ্ম  –  কয়েকশ’ ন্যানোমিটারের মত। এক ন্যানোমিটার এক মিলিমিটারের দশ লক্ষ ভাগের একভাগ। এই সূক্ষ্ম কারুকার্য আমাদের চুল যতটা চওড়া তার প্রায় একশো ভাগের একভাগ, বা আরো কম! এত ছোট নকশা বলেই কিন্তু আলোর ইন্টারফেয়ারেন্স হচ্ছে সেখান থেকে। কারণ, আলোক তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব ছোট। তরঙ্গদৈর্ঘ্য হল যতটা দূরত্বের মধ্যে একটা তরঙ্গ পুরো একবার উঁচু থেকে নীচু হয়ে আবার উঁচু হয়। জলের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কয়েক সেন্টিমিটার, আলোর ক্ষেত্রে তা কয়েকশ’ ন্যানোমিটার। আলোর ইন্টারফেয়ারেন্সের উদাহরণ খুব সুন্দর ভাবে দেখা যাবে একটা কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা CD-র উপর । বাজারে সস্তায় যে লাল বা সবুজ লেজার পয়েন্টার পাওয়া যায় তার থেকে আলো CD এর উপর ফেল। দেখো তো, সেই আলো CD-র অতি সূক্ষ্ম খাঁজ থেকে প্রতিফলিত হয়ে দূরে দেওয়ালে ইন্টারফেয়ারেন্স প্যাটার্ন তৈরি করে কিনা! লেজার না থাকলেও সমস্যা নেই, CD-র উপর সূর্যের আলো বা টর্চের আলো ফেলেই দেখো কি হয়।

[২] প্রচ্ছদের ছবির বিবরণ: কোয়ান্টাম কোরাল – আই বি এম রিসার্চের বিজ্ঞানীদের পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে এই ভাস্কর্যটি বানিয়েছেন Julian Voss-Andreae। এখানে দূর্গের প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে আছে কিছু লোহার পরমাণু। এই পরমাণুদের থেকে প্রতিফলিত হয়ে তরঙ্গের ঢেউ-এর মত ধরা দিচ্ছে তামার ইলেক্ট্রন। (প্রচ্ছদের ছবির উৎস)

 

  • Rajibul_Harvardলেখক পরিচিতি : ডঃ কাজী রাজীবুল ইসলাম এম.আই.টি-হার্ভার্ড সেন্টার ফর আল্ট্রাকোল্ড অ্যাটমস-এর পোস্ট-ডকটরাল গবেষক। গবেষণার বিষয় – পরমশূন্য তামপাত্রার কাছে পদার্থের অবস্থা এবং কোয়ান্টাম ইনফরমেশন। এর আগে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ এবং মেরীল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজীবুল http://bigyan.org.in (‘বিজ্ঞান’) এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা।

 

রাজীবুল ইসলামের আরও লেখা পড়ুন এখানে।

‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত লেখার বাছাই সংকলন ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’ ডাউনলোড করুন। 

পাঠকের দরবার বিভাগের জন্য আপনাদের প্রশ্ন পাঠান।

অটিজম-এর কি একটাই দাওয়াই?

$
0
0

অলকানন্দা রুদ্র, বেন-গুরিয়েন বিশ্ববিদ্যালয় 

টিজম এমন একটা মনের অসুখ যেখানে মানুষ সবরকম সামাজিক সংস্পর্শ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়।  রোগটা এমনই যে সারা জীবন থেকে যায়। শুধু তাই নয়, পরবর্তী প্রজন্মও উত্তরাধিকার সূত্রে এই রোগটা পেতে পারে।। ২০১৪ সালের একটা গণনা অনুযায়ী, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক ৬৮ জন শিশুর একজনের মধ্যে অটিজমের লক্ষণ পাওয়া গেছে।

অটিজম শব্দটা এসেছে একটা গ্রিক শব্দ থেকে: “অটোস” অর্থাৎ অহং।  শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন অয়গেন ব্লয়লার (Eugen Blueler) নামে একজন সুইস মনোবিজ্ঞানী। ১৯১১ নাগাদ উনি ‘অটিজম’ শব্দটা ব্যবহার করেন স্কিজোফ্রেনিয়ার কিছু বিশেষ উপসর্গকে বোঝাতে। তারপর, ১৯৪০-এর দশকে ব্রিটেনের গবেষকরা কথাটা বাজারে আনলেন সামাজিক বা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের বোঝাতে। জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লিও ক্যানার বেশ কিছু শিশুর অসামাজিক আচরণের কারণ বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তিনিও এই শব্দটাই বেছে নিলেন। এদিকে একই সময়ে হান্স অ্যাস্পার্গার নামে এক জার্মান বিজ্ঞানী খুবই কাছাকাছি কিছু উপসর্গ লক্ষ্য করলেন। সেগুলোকে এখন অ্যাসপার্গার্স সিনড্রোম বলা হয়।

সংক্ষেপে বললে, অটিজম-এর তিনটে প্রধান বিশেষত্ব রয়েছে:

      ১। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা

      ২। ভাষা বা অন্য উপায়ে নিজেকে প্রকাশ করতে অক্ষমতা

      ৩। কিছু বিশেষ ক্রিয়াকলাপে এতটাই মশগুল থাকা যে দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে

অটিজম ধরা পড়ে কিভাবে

অটিজমের রোগনির্ণয় বা ডায়াগনোসিস করার কোনো ডাক্তারী পরীক্ষা এখনো অব্দি বেরোয়নি। তার বদলে চিকিৎসক বা মনোবিজ্ঞানীরা অটিজম নির্ণয় করতে আচরণ-সংক্রান্ত কিছু সর্বস্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। রোগের উপসর্গের উপর ভিত্তি করে একটা নিয়মাবলী মেনে রোগীকে একটা স্কোর দেওয়া হয়। স্কোর একটা সীমা ছাড়িয়ে গেলে তখন রোগী সন্দেহের আওতায় পড়ে। তারপর পাকাপাকিভাবে অটিজম সাব্যস্ত করতে একটা পাঁচমেশালী বিশেষজ্ঞ দলের প্রয়োজন হয়। তাতে থাকে শিশুরোগের বিশেষজ্ঞ বা পিডিয়াট্রিসিয়ান, মনোবিজ্ঞানী, স্পিচ-ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট-এর মত হরেক বদ্যি।

বিজ্ঞানীদের কাছেও অটিজম একটা পুরনো ধাঁধা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও যার কোনো সুরাহা হয়নি। আর সব মস্তিষ্কের ব্যারামের থেকে অটিজম বেশ আলাদা। একে তো, উপসর্গের বৈচিত্র্য দেখে রোগটা কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ বোঝা যায় না। তায় আবার বিভিন্ন রোগীর মধ্যে অটিজমের প্রকাশ হয় বিভিন্ন মাত্রায়। তাদের বাহ্যিক চালচলন আলাদা, তাদের স্বাধীন ভাবনাচিন্তার ক্ষমতাও আলাদা। এই বিপুল বৈচিত্র্যকে বোঝাতে অটিজমকে একটা বড়সড় দলে ফেলা হয় — অটিজম স্পেকট্রাম কন্ডিশনস বা এ.এস.সি.।

উপসর্গের ফুলঝুড়ি

প্রথমে, উপসর্গের বৈচিত্র্যকেই ধরা যাক। অটিজমের সবচেয়ে স্পষ্ট ছাপ পড়ে সামাজিক আদানপ্রদানের মধ্যে। কিন্তু, সেখানেও নানারকম সম্ভাবনা দেখা যায়। কেউ কেউ লোকসমাজে কথাই বলতে পারেনা, কেউবা কথা বললেও নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেনা। আরেকটা লক্ষণ হলো, সামাজিক আদবকায়দায় চূড়ান্ত আনাড়িপনা। যেমন, লোকসমাজে কি বলতে আছে, কি নেই, বুঝি না। কার সাথে কিরকম ভাবে ব্যবহার করতে হয়, সে জ্ঞান নেই। বন্ধু পাতানো, কি সামান্য বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা, স্বভাবের মধ্যেই নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি।

Autism-stacking-cans_2nd_edit

বিশেষ কয়েকটা বাঁধাধরা কাজে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা, অস্বাভাবিক মনোযোগ সহকারে ঘুরেফিরে একই জিনিস বারবার করে চলা – এরকমটা অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে প্রায়শই দেখা যায়। (ছবির উৎস

শুধুমাত্র সামাজিক আচরণের মাধ্যমেই যে অটিজম প্রকাশিত হয়, তাও নয়। বন্ধ দরজার আড়ালেও তাকে দেখা যায়। যেমন, বিশেষ কয়েকটা বাঁধাধরা কাজে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা। অস্বাভাবিক মনোযোগ সহকারে ঘুরেফিরে একই জিনিস বারবার করে চলেছে, এরকমটা অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে প্রায়শই দেখা যায়। যেমন, সারবেঁধে পুতুল সাজাচ্ছে কিম্বা একনাগাড়ে খেলনা-গাড়ির চাকা ঘুরিয়ে চলেছে।

কিন্তু অনেক সময় তাদের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি সজাগ হয়। আপনি-আমি যেসব ঘটনাকে লক্ষ্যই করব না, যেমন গাছের পাতা নড়া বা দেওয়ালে আলোর খেলা, সেগুলো তাদের কাছে চলচ্চিত্রের মত আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এর খারাপ দিকটা হলো, আপনি-আমি যেসব অসুবিধেকে পাত্তাই দেবো না, সেগুলোকে তারা উপেক্ষা করতে পারে না। অনেক সময় তো সেসব তাদের কাছে বিভীষিকার আকার ধারণ করে। যেমন, কোনো বিশেষ ফ্যাব্রিকের ছোঁয়া, কিম্বা বিশেষ কম্পাঙ্কের শব্দ, বা হয়ত কোনো অপছন্দের রং বা খাবারে হালকা বিস্বাদ। লেখিকা ডোনা উইলিয়ামসে কথায়: “তীব্র আলো, রঙের বাহার আর হাজারো নক্সা, এই সব মিলিয়ে ইন্দ্রিয়ের উপর অস্বাভাবিক চাপ পড়ে। তাতে দেহ এমনভাবে সাড়া দেয় যেন ক্রমাগত আক্রমণ চলছে তার উপর। একে একে আসে মাথা ধরা, উৎকন্ঠা, থেকে থেকে দুশ্চিন্তা কিম্বা পাল্টা আক্রমণের প্রবৃত্তি।”

প্যাটার্ন বা নক্সা খুঁজে পাওয়ার দক্ষতায় সাধারণ লোকে অটিস্টিক লোকজনের ধারেকাছেও আসে না।

Autism_1

এই ছবিতে যে একটা ত্রিভুজ রয়েছে, সেটা একজন অটিস্টিক ব্যক্তির সাধারণ লোকের থেকে অনেক আগে চোখে পড়বে।

যেমন, পাশের ছবিতে যে একটা ত্রিভুজ রয়েছে, সেটা একজন অটিস্টিক ব্যক্তির সাধারণ লোকের থেকে অনেক আগেই চোখে পড়বে।

সবাই একরকম হয়না

এবার দ্বিতীয় বিষয়টাতে আসা যাক। সব অটিস্টিক রোগী একরকম হয়না। একদিকে আছে আদি-অকৃত্রিম অটিজম, যেখানে কথা বলাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে রয়েছে অ্যাসপার্গার্স সিনড্রোম, যেখানে কথা বলতে কোনো সমস্যা নেই। আই. কিউ. স্বাভাবিক বা স্বাভাবিকের উপরে। কিন্তু দুই ধরনের অটিস্টিক রোগীর ক্ষেত্রেই অন্যান্য সামাজিক সমস্যাগুলো একই বা সাধারণ আগ্রহের জায়গাটা একইরকম সীমিত, যা সাধারণভাবে স্বাভাবিক মানুষের সাথে মেলে না। এদিকে, অ্যাসপার্গার্স-ওয়ালাদের চমকে দেওয়ার মত কিছু ক্ষমতা থাকে। কেউ হয়তো অসাধারণ শিল্পী, কেউ সংখ্যা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, কেউ আবার অঙ্ক বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মত  খুঁটিনাটি বিষয়ে চ্যাম্পিয়ন।

এখানেই বৈচিত্র্যের শেষ নয়। সাধারণ মানুষের, অর্থাৎ যারা অটিস্টিক প্রমাণিত হয়নি তাদের মধ্যেও এইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটু আধটু দেখা যায়। প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট সাইমন ব্যারন-কোহেন দেখিয়েছিলেন, সমাজে গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ বা ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে অটিজম-সম বৈশিষ্ট্য স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি লক্ষ্য করা যায়।২,৩ সেই কারণেই, অটিজমকে একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের শ্রেণীর মধ্যেও ফেলা হয়। নামটা আগেই বলেছি, অটিজম স্পেকট্রাম কন্ডিশনস বা এ.এস.সি.।

সমাজে গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ বা ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে অটিজম-সম বৈশিষ্ট্য স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি লক্ষ্য করা যায়।

অটিজম নিয়ে গবেষণা

এত যে হরেকরকম উপসর্গ, তার পিছনে কি কোন একটা মাত্র কারণকেই দায়ী করা যায়? ক্লাসিক অটিজম থেকে অ্যাসপার্গার্স সিনড্রোম — সবরকম রোগীকেই কি বলা সম্ভব, “হ্যা, অমুক জায়গা থেকেই রোগটা আসছে”? এর উত্তর পেতে হলে, অটিজম নিয়ে কিভাবে গবেষণা হয়, সেটা একটু ভালো করে দেখতে হবে।

মূলত, তিনটে দৃষ্টিভঙ্গী থেকে গবেষণাটা চলে। 

১। জেনেটিক গবেষণা – ক্রোমোসোমে খুঁত ধরা, সম্পূর্ণ জিনোমের সিকোএন্সিং করা বা অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে জিনের উপর কারিকুরি করা — সব এই ধরণের গবেষণার আওতায় পড়ে।

২। স্নায়বিক গবেষণা – সাধারণত, এই গবেষণায় ম্যাগনেটিক রেসনান্স ইমেজিং (এম.আর.আই.) বা ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফির (ই.ই.জি.) মাধ্যমে অটিস্টিক রোগীর মস্তিষ্কের ছবি তুলে তার সাথে সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের ছবির তুলনা করা হয়।

৩। রোগীর হাবভাবের উপর নজর রাখা। বেশ কিছু পরীক্ষা হয় যার দ্বারা চটজলদি সাধারণের থেকে অটিস্টিক লোকজনকে আলাদা করা যায়। একটা পরীক্ষার কথা আগেই বলেছি — লুকোনো আকৃতি খুঁজে বার করা। একে বলে, এমবেডেড ফিগারস টেস্ট

অটিজম কি একটাই রোগ?

‘অটিজম আসলে একটাই রোগ’, এই ধারণাটার বিপক্ষে সবথেকে বেশি প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রথম ধরণের গবেষণার ফল থেকে। এখনো অব্দি কেউ সবকটা উপসর্গের পিছনে কোনো একটা বিশেষ জিনকে দায়ী করতে সক্ষম হয়নি। তার জায়গায় বেশ কয়েকটা জেনেটিক প্যাটার্ন বা সজ্জা পাওয়া গেছে, যাদের অটিজমের সাথে সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। তাও মানা যেত, কিন্তু সেই প্যাটার্নগুলো অন্য কিছু মানসিক রোগের সাথেও যুক্ত। আচরণ-সংক্রান্ত পরীক্ষানিরীক্ষা থেকেও একটা ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

স্নায়বিক লাইনে একটু আশা দেখা গেছিল। নিউরোইমেজিংয়ের দ্বারা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের গঠন এবং কাজকর্ম সম্বন্ধে জানা যায়। প্রথম দিকে দেখা যাচ্ছিল যে অটিস্টিক ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ মস্তিষ্কের আয়তন এবং বিশেষ কিছু জায়গা, যেমন অ্যামিগডালা ও সেরিবেলাম, এদের আয়তন একটু বেশি। উপসর্গগুলো কতটা বাড়াবাড়ি রকমের, তার সাথে মস্তিষ্কের গঠনের একটা সম্পর্কও পাওয়া গেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরও পাকাপোক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হলে, এই সম্পর্কগুলোর সপক্ষে সেরকম জোরালো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার কারণ হতে পারে, প্রথমদিকের গবেষণাগুলো মাত্র গুটিকয়েক লোকের উপরই করা হয়েছিল। আবার অন্য আরেকটা কারণ এটাও হতে পারে, বিভিন্ন গবেষণায় যে বয়েসের গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা হচ্ছিল, তাদের মধ্যে অনেক ফারাক।

অটিজমের যে হরেকরকম উপসর্গ, তার পিছনে কি কোন একটা মাত্র কারণকেই দায়ী করা যায়?

মস্তিষ্কের গঠন তো গেল একটা দিক। এটা ছাড়াও ফাংশানাল ইমেজিংয়ের সাহায্যে দেখা হয়েছে, কিছু বিশেষ কাজের সময় মস্তিষ্কের কোনো একটা অংশের ক্রিয়াকলাপে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে কিনা। কাজগুলো এমন যাতে অটিস্টিক রোগীরা হোঁচট খায়, যেমন মুখ চেনা বা ভাষার সুক্ষ্ম তারতম্য বোঝার চেষ্টা করা। তাতে কিছু অস্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ ধরাও পড়েছিল। কিন্তু এই গবেষণার ফলাফল বয়েস নির্বিশেষে প্রযোজ্য কিনা, সেই নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে বিতর্ক রয়েছে। এবং এই পদ্ধতিগুলো এক একটা উপসর্গের পিছনে ঠিক কি হচ্ছে, সেই প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। তাই এখনি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে নিউরোইমেজিংয়ের মাধ্যমেই একটা সম্পূর্ণ তত্ত্ব বেরিয়ে আসবে।

অন্যভাবে ভাবা যাক

এসব দেখে কিছু নামী বিশেষজ্ঞ বলেছেন, অটিজমের একমেবাদ্বিতীয়ম ব্যাখ্যার পেছনে ধাওয়া করার দিন শেষ। তার পরিবর্তে, সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিভিন্ন উপসর্গগুলোকে আলাদা আলাদা করে দেখতে হবে। যেমন, রোগীর অবস্থা কতটা খারাপ, তার একটাই রেটিং দেওয়ার মানে হয়না। তার থেকে সামাজিক উপসর্গের উপর একটা রেটিং, কাজকর্মের উপসর্গে আরেকটা রেটিং, ইন্দ্রিয়ের প্রখরতায় একটা তৃতীয় রেটিং — এরকম দেওয়া গেলে ছবিটা অনেক স্পষ্ট হয়। আর মলিকুলার জেনেটিক্সের ক্ষেত্রেও একটাই ‘অটিজম জিন’ খোঁজার চেষ্টা ছাড়া উচিত। তার থেকে বিভিন্ন উপসর্গের পেছনে কি জেনেটিক প্যাটার্নের অবদান রয়েছে, সেই খোঁজেই জোর দেওয়া উচিত। কারণ, এটা তো মোটামুটি স্পষ্ট যে বেশিরভাগ জিনই একা অনেকগুলো উপসর্গের জন্যে দায়ী নয়।

কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়। একটা যদি ব্যাখ্যা না পাওয়া গেল তো এই বিভিন্ন উপসর্গগুলো একসাথে হানা দেয় কেন? কাকতালীয় তো হতে পারেনা। জেনেটিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয়। যদিও বেশিরভাগ জিন একটাই  উপসর্গের সাথে জড়িত, কিছু জিন আছে যারা একাধিক উপসর্গের জন্ম দেয়। সেখানেই কি তবে রহস্যের চাবিকাঠি? অথবা, আচরণ-সংক্রান্ত গবেষণার দিক থেকে দেখলে, এটা কি হতে পারে যে এক ধরণের অক্ষমতার সাথে আরেকটার সম্পর্ক রয়েছে? হয়তো, একটা অক্ষমতা এলে আরেকটা আসবেই আসবে?

একমেবাদ্বিতীয়ম ব্যাখ্যার সন্ধান ছাড়লে অটিজমের ‘একটিই’ চিকিৎসার সন্ধানও ছাড়তে হয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যেসব পরিবার তাদের শিশুদের কি হয়েছে বোঝবার চেষ্টা করছে, যে মনোরোগ-বিশেষজ্ঞগণ রোগীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথ বাতলাচ্ছে, যেসব অটিস্টিক ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে নিজেদের ক্ষমতা ও অক্ষমতার সাথে পরিচিত হচ্ছে, কিম্বা যেসব গবেষক নতুন ওষুধ-বিহীন চিকিৎসা পদ্ধতি খুঁজছে, তাদের কাছে এটা একটা নতুন ভাবনার খোরাক। তবে যদ্দিন না রহস্যের সমাধান হচ্ছে, উপসর্গগুলোকে বোঝা এবং কাবু করা ছাড়া উপায় নেই।

 

লেখার উৎস:

[১] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  আটলান্টা শহরের সেন্টার ফর ডিসিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-এর অটিজম এন্ড ডেভেলপমেন্টাল ডিসেবিলিটিস মনিটরিং নেটওয়ার্ক বিভাগটি, ২০১৪-তে এই গণনাটা করেছিল।

[২] Baron-Cohen, Simon, et al. “Autism occurs more often in families of physicists, engineers, and mathematicians.” Autism 2.3 (1998): 296-301

[৩] Baron-Cohen, Simon, et al. “The autism-spectrum quotient (AQ): Evidence from asperger syndrome/high-functioning autism, males and females, scientists and mathematicians.” Journal of autism and developmental disorders 31.1 (2001): 5-17

[৪] Amaral, David G., Cynthia Mills Schumann, and Christine Wu Nordahl. “Neuroanatomy of autism.” Trends in neurosciences 31.3 (2008): 137-145

[৫] Brambilla, Paolo, et al. “Brain anatomy and development in autism: review of structural MRI studies.” Brain research bulletin 61.6 (2003): 557-569

[৬] Jemel, Boutheina, Laurent Mottron, and Michelle Dawson. “Impaired face processing in autism: fact or artifact?.” Journal of autism and developmental disorders 36.1 (2006): 91-106

 

 

Alokaলেখক পরিচিতি: ডঃ অলকানন্দা রুদ্র ইজরায়েলের বেন-গুরিয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট-ডক্টরেড গবেষক। সে অটিজম সহ বিভিন্ন স্নায়বিক রোগের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ে গবেষণা করে। অলকানন্দার পিএইচ.ডি. গবেষণার বিষয় ছিল ভারতবর্ষে অটিজম রোগের সাইকোমেট্রিক ধর্মাবলীর পরিমাপ। ভারতে অটিজমের ব্যপকতা নিয়ে একটি প্রাথমিক সমীক্ষার সাথেও সে যুক্ত ছিল।

(লেখাটি ইংরাজী থেকে অনুবাদ করেছে অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়।)

 

পাঠকের দরবার –মহাকর্ষ সূত্রে বিন্দু ভর

$
0
0

 

sumantra‘পাঠকের দরবার’ বিভাগে থাকছে কিছু বাছাই করা প্রশ্নের উত্তর। এই বিভাগের প্রথম পর্বে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির পদার্থবিজ্ঞানের পোস্ট-ডকটরাল গবেষক ডঃ সুমন্ত্র সরকার উত্তর দিচ্ছে আবু নঈম শিকদারের করা প্রশ্নের। মূল প্রশ্নটি হল- “মহাকর্ষ সূত্রে বিন্দু ভরের ধারণা কেন ব্যবহার করা হয়?” 

 

প্রথমেই বলে দি যে বিন্দু ভর বা চার্জের ধারণা আসলে একটা গাণিতিক ধারণা, যা বাস্তব জগতে কখনো মোটামুটিভাবে, ইংরেজীতে যাকে বলে approximately, খেটে যায়। যেহেতু এটা একটা approximation, তাই আমরা সবসময় এই ধারণা ব্যবহার করতে পারি না এবং এই ব্যাপারটা আমাদেরকে স্কুলে বলাও হয় না। তাই তোমার প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক।

বিশদে উত্তর দেওয়ার আগে একটা উদাহরণ দিই। ধর, তোমার কাছে একটা সাদা রঙের ফুটবল আছে। ফুটবলটাকে একটা চেয়ারে রাখো। এবার ফুটবলটার একদম কাছে, এই ধর এক হাত দূরত্বে গিয়ে বলটাকে দেখার চেষ্টা কর। দেখবে বলটা বেশ গোলগোল দেখতে লাগছে, আর তুমি বুঝতে পারছ ওটা একটা বল। তুমি দেখতে পাচ্ছ বলটা সাদা রঙের ষড়ভুজাকার  আর পঞ্চভুজাকার  অংশ দিয়ে বানানো, আর ওই অংশগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আবার সেলাই করা আছে, মানে তুমি বলের পুরো আকারটা দেখতে পাচ্ছ। এবার ধর তুমি প্রায় ১০ মিটার দুরে চলে গেলে। দেখবে তুমি ওই ষড়ভুজাকার আর পঞ্চভুজাকার অংশগুলো দেখতে পাচ্ছ, কিন্তু তুমি আর সেলাইগুলো ভাল করে দেখতে পাচ্ছ না। এবার আরও দুরে চলে যাও। ধর তুমি একটা গোলপোস্টে বলটাকে রেখে অন্য গোলপোস্টে গিয়ে বলটাকে দেখছ। কি দেখবে? যে ওই ষড়ভুজাকার আর পঞ্চভুজাকার অংশগুলো আর তুমি দেখতে পাচ্ছ না, খালি বলটা যে সাদা সেটা বুঝতে পারছ। আর বলটাও কিরকম সাইজে ছোট মনে হচ্ছে। এবার সম্ভব হলে তুমি আরও দূরে চলে যাও। দেখবে বলটাকে আর বল বলে মনে হচ্ছে না, একটা সাদা বিন্দুর মত লাগছে। অর্থাৎ, তুমি যত দূরে চলে যাচ্ছ, বলটার আকারের বৈশিষ্ট্যগুলো তত মুছে যাচ্ছে আর শেষমেষ ওটাকে কেবল একটা বিন্দু বলে মনে হচ্ছে।

ঠিক একইরকম ব্যাপার হয় মহাকর্ষ বলের ক্ষেত্রে। যখন তুমি পৃথিবী বা অন্য কোনো গোলাকার বস্তুর খুব কাছে থাক, তখন পৃথিবীর এই গোলাকার ব্যাপারটা বোঝা যায়। শুধু তাই নয়, পৃথিবী যে ঠিক গোলাকার নয়, বরং এবরো-খেবড়ো সেটাও স্যাটেলাইট দিয়ে মহাকর্ষ বল মেপে বোঝা যায়। কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাতে বা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে রকেট পাঠাতে পৃথিবীর পুরো আকারটা জানা জরুরী। কিন্তু যখন তুমি পৃথিবী আর সূর্যের ভিতর মহাকর্ষ বল মাপতে যাবে, পৃথিবী আর সূর্য একে অপরের থেকে এতটাই দূরে যে দুজনকেই ফুটবলটার মত বৈশিষ্ট্যহীন একটা গোল বস্তু হিসেবে ভাবতে পারো। এবার তুমি একটা ছোট্ট গণনা করে দেখাতে পারো যে, যদি একটা গোলকের সব জায়গায় সমান ঘনত্ব থাকে তাহলে গোলকটার বাইরে যেকোনো বিন্দুতে মহাকর্ষ বলের মান এমন হয়, যেন গোলকটার সমস্ত ভর ওর কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে। মানে তুমি যদি গোলকটাকে দেখতে না পাও, তাহলে গোলকটার বাইরে মহাকর্ষ বল মেপে বুঝতে পারবে না যে ওটা গোলক না একটা বিন্দু ভর। সেই কারণে, আমরা জ্যোতির্বিদ্যায় বেশিরভাগ সময়ই বিন্দু ভরের ধারণা ব্যবহার করতে পারি।

Geoids_sm

খুব কাছ থেকে দেখলে পৃথিবী যে ঠিক গোলাকার নয়, বরং এবরো-খেবড়ো, সেটা স্যাটেলাইট দিয়ে মহাকর্ষ বল মেপে বোঝা যায়। ছবির উৎস

কিন্তু কত দূরে যেতে হবে বিন্দু ভরের ধারণা ব্যবহার করার জন্য? জিনিসটা অঙ্ক কষে বের করা যায়। বিন্দুভরের ধারণার সাথে আরেকটি ধারণা যুক্ত করে আমরা বাস্তব জগতের এবড়োখেবড়ো বস্তুর জন্য মহাকর্ষ বা কুলম্বের বল হিসেব করতে পারি। এই যে নতুন ধারণাটির কথা বলছি তার নাম হল সুপারপোজিশান, যাকে বাংলায় উপরিপাত নাম দেওয়া যেতে পারে।  অর্থাৎ দুটি এলোমেলো আকারের বস্তু ‘ক’ আর ‘খ’-এর মধ্যে বলের হিসেব করতে হলে তাদের অনেকগুলো ছোট ছোট ভাগে ভাগ কর, যেগুলোকে মোটামুটি বিন্দু হিসেবে ধরা যায়। তারপর, ‘ক’-এর সব কটা বিন্দু আর ‘খ’-এর সব কটা বিন্দুর মধ্যে কি বল কাজ করছে তা মহাকর্ষ বা কুলম্বের সূত্র লাগিয়ে জোড়ায় জোড়ায় বের কর। এবার এই সব বলকে যোগ কর।বুঝতেই পারছ কাজটা খুব একটা সহজ না-ই হতে পারে। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ক্যালকুলাস বা কলনবিদ্যা লাগিয়ে অঙ্কটা কষে ফেলা যায়, কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কম্প্যুটারের সাহায্য নিতে হবে।

বিন্দুভরের ধারণার সাথে সুপারপোজিশানের ধারণা যুক্ত করে আমরা বাস্তব জগতের এবড়োখেবড়ো বস্তুর জন্য মহাকর্ষ বা কুলম্বের বল হিসেব করতে পারি।

তবে তুলনামূলক সহজ উপায়ে এই অঙ্কটা অনেক সময় কষা হয় multipole expansion বলে একটা পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে তুমি যেকোনো আকৃতির একটা বস্তুকে বিন্দু ভর (monopole), একটা dipole, quadrupole, এইসব নানা আকারের সমষ্টি হিসেবে ভাবতে পার। এইসব আকারগুলোর জন্য মহাকর্ষ বল মাপা সোজা। আর যেহেতু মহাকর্ষ বল সুপারপোজিশানের নীতি মেনে চলে, তাই আমরা এই বিভিন্ন আকারের মাধ্যমে মাপা মহাকর্ষ বলগুলোকে ভেক্টর পদ্ধতিতে জুড়ে দিয়ে বস্তুটার মোট মহাকর্ষ বল মাপতে পারি। গণনা করে দেখানো যায় যে monopole মানে বিন্দু ভরের জন্য বস্তুটি যে বল প্রয়োগ করে তার মান দূরত্বের সাথে সাথে সবথেকে ধীরে ধীরে কমে। এরপর আসে dipole এর পালা, তারপর আসে quadrupole-এর পালা, তারপর octopole … এরকম ভাবেই যত pole-এর পরিমান বাড়তে থাকে বলের মান দূরত্বের সাথে তত তাড়াতাড়ি কমতে থাকে। এবার এই বিভিন্ন আকারগুলো থেকে বলগুলো কষে তুমি দেখাতে পারো যে কোনো প্রায় গোলাকার বস্তুর কেন্দ্র থেকে যদি তুমি মোটামুটি এক ব্যাস পরিমান দূরে চলে যাও, তাহলে শুধু বিন্দু ভর ব্যবহার করেই তুমি প্রায় সমস্ত গণনা করতে পারবে।

 

বিশদে জানতেঃ

Multipole expansion কিভাবে ব্যবহার করা হয় তা জানতে উইকিপিডিয়ার এই লেখাটি দেখতে পার।

 

‘পাঠকের দরবার’ বিভাগের জন্য আপনার প্রশ্ন পাঠান।

সুমন্ত্র সরকারের আরো লেখা পডুন।

জলের দামে মাইক্রোস্কোপ

$
0
0
foldscope_chhana_ghauস্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মানু প্রকাশের (উপরের ছবি) ল্যাবরেটরী তৈরী করেছে এক অভিনব মাইক্রোস্কোপ, যা বানাতে খরচ হয় মাত্র পঞ্চাশ-ষাট টাকা (এক ডলার)। এর নাম ফোল্ডস্কোপ, কোন বস্তুকে প্রায় ২০০০ গুণ পর্যন্ত বড় করে দেখাতে পারে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা শোনাচ্ছে অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়অনির্বাণ ঘোষ
 
কটা লম্বা টেস্টের ফর্দ লিখে দিলেন ডাক্তারবাবু। সব টেস্ট এ চত্বরে হয়না, শহরে যেতে হবে। এই নিয়ে তিনবার ভিজিট হয়ে গেল ডাক্তারবাবুর চেম্বারে। প্রথম দুবার শুধু ওষুধ দিয়েছিলেন। তাতে কাজ হলো না দেখে টেস্টের ফিরিস্তি। মাঝে খোকা একটু ভালো ছিল বলে ইস্কুলে পাঠানো হলো, কিন্তু হাফ-টাইমে আবার পড়লো জ্বরে। ইস্কুল থেকে কড়া ফোন এলো: ওকে পাঠাবেন না, প্লিজ। ও আসার পর আরো তিন-চারজনের জ্বর হয়েছে। টেস্টগুলোর মধ্যে একটা ছিল ম্যালেরিয়ার। ম্যালেরিয়া হয়নি তো?
 
খোকাকে নিয়ে খোকার মা গেল শহরে। সেখানে তার রক্তের স্যাম্পেল নেওয়া হবে। সেই রক্ত স্লাইডে বুলিয়ে তাকে রিএজেন্ট দিয়ে রঙ করা হবে। তারপর মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলে দেখা হবে তাতে ম্যালেরিয়ার জীবাণু কিলবিল করছে কিনা। এটা করতে এত ঝক্কি কেন? ডাক্তারবাবু টেস্টের ফর্দ চাপানোর আগে কিছু ঢিল ছুঁড়ে দেখলেন কেন? উনি নিজেই ম্যালেরিয়া কিনা, টুক করে ধরতে পারতেন না কি?
উপসর্গ দেখে আন্দাজ করতে পারতেন, কিন্তু যাদের দেখলে শতকরা একশ’ ভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়, সেই জীবাণুরা তার নাগালের বাইরে। আমরা খালি চোখে যা দেখতে পাই, তারা তার চেয়ে প্রায় কয়েকশো গুন ছোটো। আর ছোটোকে খালি চোখের আওতায় আনতে দরকার মাইক্রোস্কোপ বা অনুবীক্ষণ যন্ত্র, যা আমাদের অদেখা জগতকে নিয়ে আসে দেখার মাঝে। কিন্তু মাইক্রোস্কোপের গঠন বেশ জটিল আর এর সঠিক কার্যকারিতার জন্য দরকার আলোর পথের উপর সুক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ। এগুলো কিন্তু মোটেই সস্তায় আসে না।
 
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মানু প্রকাশের ল্যাবে এই সমস্যাটার সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলছিলো। ‘সস্তায় বিজ্ঞান’ বা ‘ফ্রুগাল সাইন্স’ এই ল্যাবের একটা মন্ত্র। তাই তাঁরা তৈরী করতে পেরেছেন এক অভিনব মাইক্রোস্কোপ, যা বানাতে খরচ হয় ডাক্তারবাবুর ভিজিটের থেকেও কম – মাত্র পঞ্চাশ-ষাট টাকা (এক ডলার)। এত সস্তা হওয়ার কারণ আর কিছুই না — মূল একটা আলোর উৎস আর লেন্সটা ছাড়া বাকি মাইক্রোস্কোপটা কাগজের তৈরী! আর ছোট সাইজের লেন্সও সম্প্রতি সস্তায় বানানো সম্ভব হয়েছে – সেলফোনে ক্যামেরার বাহার তো দেখছেনই!
 
কিন্তু কাগজের তৈরী কেমন করে হলো? কাগজ ভাঁজ করে এটাসেটা তো আমরা কতই বানিয়েছি — হাঁস কি নৌকা বানিয়ে জলে ভাসিয়েছি, গোলাপ বানিয়ে সারপ্রাইজ দিয়েছি। এখানেও সেই একই নীতি — অরিগ্যামি।
 
কাগজ ভাঁজ করে তাঁরা এমন এক মাইক্রোস্কোপ তৈরী করেছেন যাতে স্লাইডে পড়া আলো লেন্স দিয়ে আমাদের চোখে আসবে এবং সেই আলোর পথের উপর আমাদের সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
 
CrossSection

লেন্সটা যে স্ট্রাকচারে আটকে আছে, তাকে দুটো বুড়ো আঙ্গুল চেপে বা ছেড়ে দিয়ে লেন্সটাকে আগুপিছু করে ফোকাস করতে হবে। স্লাইডটাকে না সরিয়ে, আঙ্গুলের সাহায্যে লেন্স আর আলোর উৎসটাকে একসাথে সরিয়ে ‘প্যানিং’-ও করা যাবে । (ছবির উৎস)

ব্যবহার করার সময় মাইক্রোস্কোপটা আমরা চোখের সামনে ধরবো — ঠিক  যেমন সূর্যগ্রহণের সময় চোখের সামনে ফিল্টার ওয়ালা কাগজ ধরা হয়। লেন্সটা যে স্ট্রাকচারে আটকে আছে, তাকে দুটো বুড়ো আঙ্গুল চেপে বা ছেড়ে দিয়ে লেন্সটাকে আগুপিছু করে ফোকাস করতে হবে। সাধারণ কম্পাউন্ড মাইক্রোস্কোপ ফোকাস করছি যখন, লেন্সের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব বাড়াচ্ছি বা কমাচ্ছি। এখানে একখানি লেন্স, তার সাপোর্টিং স্ট্রাকচারের বক্রতা বাড়িয়ে কমিয়ে ফোকাস করবো আমরা।

আরেকটা জিনিস: লম্বা স্লাইডকে খুদে বলমার্কা লেন্স পুরোটা একসাথে ধরতে পারেনা। কিন্তু আমরা আঙ্গুলের সাহায্যে লেন্স আর আলোর উৎসটাকে একসাথে সরাতে পারি, স্লাইডটাকে না সরিয়ে, যাকে বলে প্যানিং। ব্যাস, এই কাগজের মাইক্রোস্কোপ নিয়ে আমরা যত ইচ্ছে প্যান আর ফোকাস করতে পারি — আর জগতের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর খুঁটিনাটি আমাদের নখদর্পণে! আমাদের ফোনের ক্যামেরা দিয়ে পছন্দমত জিনিসের ছবি তুলে বন্ধুদের ক্যুইজ-ও করা যেতে পারে! শুধু তাই নয়, ঘর অন্ধকার করে তার দেওয়ালে সোজাসুজি মাইক্রোস্কোপের ছবি প্রোজেক্ট করা যেতে পারে। সত্যজিত রায়ের ‘গণশত্রু’ ছবি মনে আছে? ডাঃ গুপ্তর (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) কাছে ফোল্ডস্কোপ থাকলে তিনি মন্দিরের জলের ভিতরে জীবানুরা যে কিলবিল করছে, তা একঘর ভর্তি মানুষের সামনে সিনেমার মত সরাসরি দেখাতে পারতেন।
 
তবে এই আপাত সহজ ধারনা থেকে একটা সত্যিকার ব্যবহারযোগ্য যন্ত্র বানাতে প্রযুক্তিবিদদের অনেক চিন্তা করতে হয়েছে। যেমন ধরা যাক, কিভাবে কাগজ ভাঁজ করে করে এই মাইক্রোস্কোপের স্ট্রাকচারটা তৈরী করা হবে। কম্পিউটার সফটওয়্যারে তার জ্যামিতিক ছবি বা প্ল্যান নাহয় বানানো গেলো। কিন্তু আসল কাগজ তো আর নির্ভেজাল জ্যামিতিক সমতল নয়, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছাড়াও তার একটা ছোট্ট বেধ আছে। তার জন্য কাগজের ভাঁজগুলো প্ল্যানের জ্যামিতিক সরলরেখার থেকে একটু এদিক-ওদিক হয়ে যেতেই পারে। সেটা হলে লেন্স আর আলোর উৎসের এলাইনমেন্ট বা বিন্যাস বিগড়ে যেতে পারে! হিসেব করে দেখা যায় যে কাগজের বেধ যদি h হয় তাহলে এই এলাইনমেন্টের গড়বড়ের পরিমাণ-ও মোটামুটি h হওয়ার কথা। ওইটুকু গন্ডগোলই এই খুদে মাইক্রোস্কোপের কাজে ব্যাগড়া দিতে পারে। তাহলে উপায়?

ফোল্ডস্কোপের ডিজাইন এমনই মজবুত যে হাত থেকে ফেললে কি পায়ে চাপলে, আবার কুড়িয়ে নিয়ে তাকে আগের মতই ব্যবহার করা যায়।

 
এই ধরনের সমস্যার মোকাবিলা ইঞ্জিনিয়াররা আগে করেছেন সূক্ষ্ম মেশিন ডিজাইন করতে গিয়ে। এর উপায় বার করতে  মানু প্রকাশ আর তাঁর দলবল সেই মেশিন ডিজাইনের গাণিতিক তত্ত্ব অনুযায়ী ফোল্ডস্কোপের প্ল্যানে এমন কিছু ভাঁজের কম্বিনেশন ঢোকালেন যা ওই এলাইনমেন্ট এর গড়বড়ে বাধা দেয়। এইসব ইঞ্জিনিয়ারিং মারপ্যাঁচ সত্যি সত্যি কাজ করছে কিনা দেখতে একটা পরীক্ষা করা হলো। তাঁরা 350 মাইক্রোমিটার পুরু কাগজের কুড়িটা ফোল্ডস্কোপ বানিয়ে প্রতিটাকে কুড়িবার খুললেন আর ভাঁজ করলেন।  দেখা গেল প্রতিবার এলাইনমেন্ট হচ্ছে নিঁখুত ভাবে – গরবড়ের পরিমান কাগজের বেধের থেকে অনেক কম।
 
এরকম নানা ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধি লাগিয়ে শেষমেষ যেটা দাঁড়ালো সেটা মোটের ওপর মন্দ কাজ করে না। এই ফোল্ডস্কোপে সহজেই এক মাইক্রোমিটার পর্যন্ত দূরত্বের দুটো বিন্দুকে আলাদা করে চেনা যায়। এছাড়া ফোল্ডস্কোপের আরেকটা বিশেষত্ব হলো এর মূল ডিজাইনে একটু অদল বদল করে একে নানারকম বিশেষ বিশেষ কাজের উপযোগী করে তোলা যায়। আর বেশ কম খরচেই। এর ডিজাইনটাও এতই সরল যে আধুনিক নির্মাণ-প্রযুক্তিতে বছরে এক হাজার কোটি ফোল্ডস্কোপ বানানো সম্ভব। এবং গঠন এমনই মজবুত যে হাত থেকে ফেললে কি পায়ে চাপলে, আবার কুড়িয়ে নিয়ে তাকে আগের মতই ব্যবহার করা যায়। ঠুঁটো  জগন্নাথের মত তাকে ল্যাবের এক কোনায় বসিয়ে রাখার দরকার নেই।
students_with_foldscope

মানু প্রকাশের স্বপ্ন প্রত্যেক শিশুর পকেটে থাকবে একটা করে “ফোল্ডস্কোপ”। (ছবির উৎস)

 মানু প্রকাশের সেটাই স্বপ্ন। প্রত্যেক শিশুর পকেটে থাকবে একটা করে “ফোল্ডস্কোপ”। মনে যে প্রশ্নই জাগুক না কেন, ক্ষুদ্র  জগত সম্পর্কিত বলে সেটা আর অধরা থাকবে না। মৌমাছির ডানার নক্সা কি ফুলের রেণু, সবেরই ক্লোসআপ পেয়ে যাবে তারা। মনে শুধু প্রশ্ন আসতে হবে। তাঁর কথায়, বিজ্ঞানকে শুধু ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে হাতিয়ার দিতে হবে জানার সীমাকে লঙ্ঘন করার, তবেই বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরী করা যাবে।

বিজ্ঞানের এই গণতান্ত্রিকরণে উঠেপড়ে লেগেছেন মানু প্রকাশ। একটা প্রজেক্ট চালু করেছিলেন তিনি — বিনামূল্যে ফোল্ডস্কোপ বিতরণ করবেন। শর্ত একটাই, সেটা কিভাবে ব্যবহার করা হলো এবং কি প্রশ্নের সুলুকসন্ধান পাওয়া গেল, সেটা ওনাদের জানাতে হবে। প্রজেক্টটা চলেছিল এক বছর। এই প্রজেক্টের দরুণ তিনি ফোল্ডস্কোপের এমন ব্যবহার দেখেছেন, যা কল্পনাও করতে পারেননি।
 
আর চিকিৎসাশাস্ত্রে এর উপকারিতা অনস্বীকার্য। খোকার ডাক্তার তাঁর চেম্বারে বসে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে এই ফোল্ডস্কোপের তলায় দেখে চট করে বলে দিতে পারবেন ম্যালেরিয়া হয়েছে কিনা। রোগ নিয়ে ইস্কুলেও যেতে হবে না, সঠিক চিকিৎসা হবে প্রথম দিন থেকেই। আর বিশেষ সংক্রামক কোনও রোগ হলে পরীক্ষার পর স্লাইডসুদ্ধু গোটা মাইক্রোস্কোপটাকেই পুড়িয়ে ফেলা যাবে।
 
onion

আমাদের তোলা ফোল্ডস্কোপ দিয়ে পেয়াজের ছবি। দেখা যাচ্ছে কোষ প্রাচীর এবং কিছু অন্যান্য cell-organelle।

এখনো বাজারে ছাড়ার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ভারতে ফোল্ডস্কোপ আনার চেষ্টা করছে ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি। তাদের স্টার কলেজ স্কিমের দরুণ যেসব কলেজকে তারা চিহ্নিত করেছে, সেখানে তারা ফোল্ডস্কোপ আনার চেষ্টা করছে। ‘বিজ্ঞান’-এর পক্ষ থেকে মানু প্রকাশের সাথে যোগাযোগ করা হলে উনি সানন্দে আমাদের ফোল্ডস্কোপের কয়েকটি নমুনা পাঠিয়ে দেন। ফোল্ডস্কোপ হাতে পেয়েই আমরা পেঁয়াজের খোসা, টমেটোর ছাল, বিড়ালের লোম, কিচেন সিঙ্কের জল, পানীয় জল, শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ, ও আরো অনেক কিছু কেমন হয় দেখে ফেললাম। তার কয়েকটি ছবি আপনাদের জন্য রইল নিচে। আমাদের কাছে আরও কিছু ফোল্ডস্কোপ রয়েছে যেগুলো আমরা বিভিন্ন স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। মানু প্রকাশের ইচ্ছে যে এই ফোল্ডস্কোপগুলো আমরা সেই সব জায়গায় পাঠাই যেখানকার ছাত্রছাত্রীরা মাইক্রোস্কোপ নিয়ে নাড়াচাড়া করার সুযোগ পায় না তেমন। ‘বিজ্ঞান’-এর পাঠকদের মধ্যে মাষ্টারমশাই বা ছাত্রছাত্রীরা ফোল্ডস্কোপ পেতে চাইলে আমাদের ই-মেইলে (bigyan.org.in@gmail.com) জানান। ফোল্ডস্কোপ ব্যবহার করার একটি-ই শর্তঃ কিভাবে এই ফোল্ডস্কোপটি আপনারা ব্যবহার করবেন আর কি কি ছবি তুললেন সেটা ফোল্ডস্কোপের ওয়েবসাইটে লিপিবদ্ধ করতে হবে। মানু প্রকাশের ইচ্ছে যে সেটা যে যার মাতৃভাষাতেই করবে।

 
তবে একটা ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এটা যদি বাজারে আসে, চিকিৎসা এবং শিক্ষা জগতে একটা গুরুতর পরিবর্তন হতে চলেছে।
foldscope

আমাদের বানানো একটি ফোল্ডস্কোপ
foldscope_biraler_lom

বিড়ালের লোম
foldscope_tomato

টমেটোর খোসা। কোষের মধ্যে লাল রঞ্জক পদার্থ দেখা যাচ্ছে – এর জন্য টমেটো লাল হয়।
লেখার উৎস ও অন্যান্য টুকিটাকি:
 
[১] ফোল্ডস্কোপ তৈরি করার বিস্তারিত গল্প জানতে পড়ুন এখানে
[২] এই মাপটাকে বলা হয় মাইক্রোস্কোপ এর রেজোলিউশন। যেমন, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো আলোক মাইক্রোস্কোপের রেজোলিউশন ০.২ মাইক্রোমিটার এর কাছাকাছি।
[৩] বিস্তারিত সংবাদ এখানে দেখুন।
[৪]  ফোল্ডস্কোপ নিয়ে মানু প্রকাশের দেওয়া ‘TED-talk
[৫] ফোল্ডস্কোপ হোমপেজ
লেখক পরিচিতিঃ অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় ম্যাথওয়ার্কস-এ (ম্যাসাচুসেটস) কর্মরত। খড়গপুর আই আই টি থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও মেরীল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি। অনির্বাণ ‘বিজ্ঞান’ (www.bigyan.org.in) -এর এক অন্যতম উদ্যোক্তা এবং সম্পাদক।
অনির্বাণ ঘোষ জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার পি এইচ ডি গবেষক। পড়াশুনো করেছে খড়গপুর আই আই টি থেকে। 

কণা পদার্থবিদ্যার জগত: বিজ্ঞানীরা যখন ডিটেকটিভ

$
0
0
ArkaSantraবছর কয়েক আগে, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের বর্ডারের কাছে এক জায়গায়, বিশ্বের বহু দেশের প্রচেষ্টায় এবং CERN নামক সংস্থার উদ্যোগে সম্পন্ন হলো পৃথিবীর বৃহত্তম এক্সপেরিমেন্টের প্রথম ভাগ। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার বা সংক্ষেপে এল.এইচ.সি কণা যা পদার্থবিদদের আশ্বস্ত করলো যে তাঁরা ভুল পথে যাচ্ছিলেন না। দু বছর পর আবার চালু হয়েছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। অনেক আশা ভরসা টিকে রয়েছে এই পরীক্ষার উপর। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, কি এই কণা পদার্থবিদ্যা? কোন প্রশ্নের পিছনে ছুটছেন এই বিজ্ঞানীর দল? কেমনভাবে কাজ করেন তারা? খোদ CERN থেকে আমাদের জানাচ্ছে ফ্লোরিডা রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অর্ক সাঁতরা

 

খনো ভেবে দেখেছ, আমাদের আশেপাশের সব বস্তু ঠিক কি দিয়ে তৈরি?

আমরা যদি কোনো বস্তু নিয়ে ভাঙতে শুরু করি, আর লাগাতার ভাঙতেই থাকি, তাহলে কি পাব? অবশ্যই প্রশ্নটা আজকের নয়। প্রাচীন দার্শনিকদের সময় থেকে, যেমন ভারতীয় দার্শনিক কণাদের সময়ে, প্রশ্নটা নিয়ে ভাবা শুরু হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই প্রশ্নটার প্রথম উত্তর আসে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। ব্রিটিশ পদার্থবিদ ডালটন বললেন, প্রত্যেকটা পদার্থ, তা চোখে দেখতে যেমনই লাগুক, আদপে অসংখ্য পরমাণু দিয়ে গঠিত। তারপর এক সময়ে মানুষ জানতে পারল, পরমাণুর গঠন কেমন। জানতে পারল যে পরমাণুর কেন্দ্রভাগে থাকে একটা ভারি ধনাত্মক নিউক্লিয়াস, আর তাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে ঋণাত্মক ইলেকট্রন।

কিন্তু মানুষের কৌতূহল এখানেই শেষ হল না। সে ঢুকতে চাইল নিউক্লিয়াসেরও ভেতরে। পাওয়া গেল নিউট্রন, প্রোটন। শুরু হল নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যা। তবে, প্রশ্নটা সেখানেই শেষ নয়। প্রোটন, নিউট্রন — এরাই মৌলিক কণা বা ফান্ডামেন্টাল পার্টিকেল? এদের কি আর ভাঙাই যায় না?

পার্টিকেল ফিজিক্সের যাত্রা শুরু

এখানেই যাত্রা শুরু হল উচ্চ শক্তি পদার্থবিদ্যা অথবা কণা পদার্থবিদ্যার।

প্রথমেই যে প্রশ্নটা মাথায় আসে, তা হলো উচ্চ শক্তির প্রয়োজন কেন? যদি আমাদের কাছে ভীষণ উচ্চ ক্ষমতার মাইক্রোস্কোপ থাকত, যা দিয়ে নিউক্লিয়াসের ভেতরে উঁকি মারতে পারতাম, তাহলেই তো ল্যাটা চুকে যেত। নিঃসন্দেহে সকলেই এই যন্ত্রের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এরকম কোনও যন্ত্র তৈরি সম্ভব না। কারণ, মাইক্রোস্কোপটাকে কাজ করতে হলে, যা দেখতে চাই, তার সাথে আলোককণা বা ফোটনের একটা সংঘর্ষ হতে হবে, আর তারপর সেই কণাগুলোকে আমাদের চোখে আসতে হবে। কিন্তু যে সংঘর্ষের কথা এখানে ভাবছি আমরা, তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আলোককণার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। আমাদের চোখে আসেনা।

তাহলে কি উপায়?

আমরা ছোটবেলায় অনেকেই কোন না কোন খেলনা ভেঙ্গে জানার চেষ্টা করেছি, ওর মধ্যে ঠিক কি আছে। বিজ্ঞানীরা এই পথটাই নিলেন। তাঁরা করলেন কি, বিভিন্ন কণার স্রোতকে মুখোমুখি ধাক্কা লাগিয়ে দিলেন। তারপর, সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে জানতে চাইলেন কণাদের আচরণ, ভর ও অন্যান্য ধর্ম। এ যেন দুটো গাড়িকে মুখোমুখি সংঘর্ষ করে জানতে চাওয়া, গাড়ির ইঞ্জিনটা কোন কোম্পানির।

এই কারণেই পদার্থবিদ্যার এই বিভাগের সাথে উচ্চ শক্তি জড়িয়ে আছে। এই ভেঙ্গে-দেখো পদ্ধতিতে একে একে কোয়ার্ক, গ্লুওন, W/Z বোসন কণা, মিয়ন, টাও পার্টিকেল ইত্যাদি মৌলিক কণার সন্ধান পাওয়া গেল। জানা গেল যে প্রোটন আর নিউট্রন মৌলিক কণা নয়। ওরা কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত, আর একাধিক কোয়ার্ক কণা গ্লুওন কণা বিনিময়ের মাধ্যমে নিউক্লিয়াসের ভেতর একসাথে থাকে । কণার তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হিগস বোসন কণা । সেটা কিছুতেই গবেষণাগারের পরীক্ষায় ধরা দিচ্ছিল না। শেষে ২০১২-য় সুইজারল্যান্ডের CERN গবেষণাগারে ঘোষণা করা হলো যে এই কণাটাকে হয়তো দেখা গেছে।

নতুন কণার হদিশ পাওয়া সোজা নয়

প্রকৃতি বড়ই রহস্যময়ী। যেসব পদার্থবিদরা গবেষনাগারে নতুন কণা খোঁজেন, তাঁদের কাজটা মোটেই সহজ নয়। যদি গাড়ির সংঘর্ষের তুলনাটা ব্যবহার করি, সমস্যা হল এই যে সংঘর্ষের ফলে যে স্বাভাবিক  গাড়ির টুকরোই দেখা যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। কখনো কখনো ট্রাকও বেরিয়ে আসতে পারে!

ভাবছ গাঁজাখুরি গল্প দিচ্ছি? তোমরা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের কথা শুনেছ নিশ্চয়ই। আমি  সেই E=mc2 সমীকরণটার কথা বলছি, যার দ্বারা ভর (m) আর শক্তির (E) মধ্যে রূপান্তর হয়। সমীকরণটাতে c হলো  আলোর গতিবেগ, একটা খুব বড় সংখ্যা। অতএব, সমীকরণটা দেখেই বুঝতে পারছো, সামান্য ভর সৃষ্টি করতে পর্বতপ্রমাণ শক্তি লাগে।

ছোটবেলায় যেমন আমরা খেলনা ভেঙ্গে জানার চেষ্টা করেছি ওটা কি দিয়ে তৈরি, তেমনই কণার স্রোতকে মুখোমুখি ধাক্কা লাগিয়ে জানতে পারা যায় কণাদের আচরণ, ভর ও অন্যান্য ধর্ম। জানার চেষ্টা করা যায় মহাবিশ্ব কি দিয়ে তৈরি।  

আগেই বললাম, নতুন কণা দেখতে হাতে মজুত কণাদের প্রচণ্ড শক্তির সাথে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। সে শক্তি এতই বেশি যে তার থেকে কিছু শক্তি ভরে রুপান্তরিত হতে পারে এবং সেই শক্তিই অন্য কণাদের জন্মের জন্য দায়ী। তাই দুটো প্রোটন কণার সম্মিলিত ভর ২ GeV-র কাছাকাছি হলেও তাদের সংঘর্ষে আমরা ১৭৩ GeV ভরের টপ কোয়ার্ক পর্যন্ত পেতে পারি। এই অতিরিক্ত ভর আসছে প্রোটন কণাদুটোর গতিশক্তি থেকে।

সব গুলিয়ে যাছে মনে হচ্ছে কি? তাহলে কোন কণা কখন তৈরি হবে কি করে জানা যাবে? সেটাও বিজ্ঞানীরা শেষ অবধি বার করে ফেললেন। বহুদিনের চেষ্টায় ( প্রায় ৫০ বছর ) তত্ত্ব আর পরীক্ষার মেলবন্ধনে তৈরি হল স্ট্যান্ডার্ড মডেল। বর্তমানে আমরা যেসব কণার কথা জানতে পেরেছি, তারা এই মডেল অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে (নিউট্রিনো নামের এক ভূতুড়ে কণা কিছুটা আলাদা )। কোন কোন কণা থেকে কি কি তৈরি হতে পারে, একইরকমের কণা থেকে বিভিন্ন কণা সৃষ্টি হলে কোনটার কতটা সম্ভাবনা, সেসব জানা যায় এই তত্ত্ব থেকে। এবং আজ অবদি যত গবেষণা হয়েছে কণা বিদ্যায়, তাতে এই স্ট্যান্ডার্ড মডেলকে ভুল মনে করার কোনো কারণ পাওয়া যায়নি।

particle1

স্ট্যান্ডার্ড মডেল মেনে চলা কণাদের লিস্ট, আর বাক্সের মধ্যের অক্ষর গুলো কণাদের চিহ্ন। বেগুনীতে কোয়ার্ক, আর সবুজে লেপটন। এদের আমরা বলি ম্যাটার পার্টিকেল, কেননা এরাই (বিশেষত আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক আর ইলেকট্রন ) আমাদের চারপাশের বস্তু সৃষ্টি করে। লালে গেজ বোসন, এদের আদান-প্রদানের মাধ্যমে বল (ফোর্স), অর্থাৎ আকর্ষণ বা বিকর্ষণ, তৈরী হয়। আর সবশেষে হলুদ বাক্সে হিগস বোসন, যার কাজ পদার্থকে ভর দেওয়া। (ছবির উৎস)

 

কণা পদার্থবিদ না ডিটেকটিভ

দুটো উচ্চ শক্তির কণার স্রোতকে ধাক্কা তো মারলাম, কোন কোন কণা তৈরি হবে, সেগুলোও জানতে পারছি। কিন্তু মুস্কিল হলো, তৈরি হওয়া কণাগুলোকে আমরা ধরব কি করে? এখানে বিজ্ঞানীদের গোয়েন্দাগিরিতে নামতে হয়।

প্রত্যেক কণাই তৈরি হবার পর প্রবল শক্তি নিয়ে ছুটে চলে। আমরা যদি কোনভাবে ওই কণাগুলোকে খাঁচায় বন্দি করতে পারি তাহলেই কেল্লাফতে! কিন্তু কণাগুলো খুবই উচ্চ শক্তির, তাই যে সে খাঁচা হলে চলবে না। আর তাই তৈরি হল বড় বড় ডিটেক্টর। এগুলোর কাজ আসলে খুবই সাধারণ, যেসব কণাগুলো এদের গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে তাদের শক্তি কতটা সেটা হিসেব করে বলা।

একটু আগেই ডিটেকটিভের কথা বললাম, ভাবছ এই বিজ্ঞানের মাঝে আবার গোয়েন্দা কি জন্য লাগবে? বলি তাহলে। কোন একটা সংঘর্ষ হবার পর আমরা দেখি, সেই সংঘর্ষ থেকে কি কি কণা বেরল। কিন্তু শুধু কি কি কণা বেরল সেটা জানলেই হবে না, কারণ বিভিন্ন সংঘর্ষ থেকেই একইরকম কণা বেরোতে পারে। তাই ঠিক কি ঘটেছিল, জানবার জন্য চেষ্টা করতে হয় সেই সংঘর্ষটাকে পুনর্গঠন করতে। ঠিক যেমন গোয়েন্দা কোনও অপরাধের অকুস্থল থেকে ক্লু জোগাড় করে অপরাধটা কিভাবে হল বোঝার চেষ্টা করেন। সেইরকম, এখানেও চেষ্টা করা হয় সব কণার শক্তি ঠিকঠাক পরিমাপ করতে, তারপর দেখা হয় সেগুলো ঠিক কোন কোন কণার সংঘর্ষে তৈরি হয়েছে, আর তাদের সাথে আরও কি কি কণা তৈরি হয়েছে। এগুলো ঠিকঠাক করতে পারলে তবেই ‘শাবাশ তপশে! ‘

particle2

এখানে CERN এর CMS ডিটেক্টরে ধরা পড়া একটা সংঘর্ষের পুনর্গঠিত ছবি দেখান হল। এই ছবিতে একটি হিগস বোসন দুটো ফোটন কণায় ভেঙ্গে গেছে। ফোটন কণাগুলোকে দেখান হয়েছে দুটি লম্বা সবুজ সরলরেখা দিয়ে। ফোটন কণা আধানহীন, তাই চুম্বকক্ষেত্র এদের বাঁকাতে পারে না। হলুদ রঙে দেখানো হয়েছে সংঘর্ষে তৈরি হওয়া আরও নানান কণাদের। একটু লক্ষ্য করলে দেখবে, এদের বেশ কিছুরই গতিপথ বাঁকা। এদের আধান আছে, তাই চুম্বক এদের বাঁকাতে পেরেছে। ছবি দেখে বলতে পারবে, ঠিক কোথায় ধাক্কাটা লেগেছিল? (ছবির উৎস)

 

কণা পদার্থবিদ্যায় এখনো কি বাকি আছে

এবার নিশ্চয় ভাবছ: স্ট্যান্ডার্ড মডেল আমাদের কণার ধর্ম সম্বন্ধে বলে দিচ্ছে, আমরা ডিটেক্টরের সাহায্যে কণা গুলোকে ধরতেও পারছি, তাহলে বিজ্ঞানীরা এখনো এত এত কণার সংঘর্ষ ঘটিয়ে ঠিক কি করতে চাইছেন? মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, এমনকি সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র, এরা যেসব জিনিস দিয়ে তৈরি, সেগুলো মহাবিশ্বের মোট ভর-শক্তির মাত্র ৫%! এগুলো ছাড়া আরও ২৭% হলো যাকে বলে ডার্ক ম্যাটার, আর ৬৮% ডার্ক এনার্জি। এদের নামের মধ্যে ডার্ক বা অন্ধকার আছে কারণ এরা মহাকর্ষ বল ছাড়া আর কোনভাবে এদের উপস্থিতি সম্বন্ধে জানান দেয় না। বিজ্ঞানীরা CERN এর গবেষণাগারে ডার্ক ম্যাটার সৃষ্টি করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদি সফল হন, সেটা মানব সভ্যতার মুকুটে আরও একটা পালক যোগ করবে।

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, এইমাত্র বললে যে ডার্ক ম্যাটার কিম্বা ডার্ক এনার্জি, এদের মহাকর্ষ ছাড়া আর কোনভাবে জানাই যায় না, আর CERN এর বিজ্ঞানীরা সেটা তাঁদের ডিটেক্টরে ধরে ফেলবেন? সেটা কি করে সম্ভব?’ দুর্দান্ত প্রশ্ন! ঠিকই, এই ডার্ক ম্যাটার যদি CERN-এ তৈরিও হয়, এদের সরাসরি সনাক্ত করা অসম্ভব। কিন্তু ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই, আমরা জানি শক্তি-ভরের নিত্যতা সূত্রের কথা। মানে সংঘর্ষ লাগার আগে কণাগুলোর যে শক্তি ও ভর ছিল, সংঘর্ষ ঘটার পরেও নতুন কণাগুলোর মোট ভর আর শক্তি তার সমান হওয়ার কথা। যদি আমাদের সংঘর্ষে ডার্ক ম্যাটার তৈরি হয়, তাহলে তারা ডিটেক্টর থেকে বেড়িয়ে যাবে, তাদের শক্তি ধরা পরবে না কোনমতেই। কিন্তু তখনি আমরা শক্তি-ভরের নিত্যতা সূত্র কাজে লাগিয়ে ধরে ফেলব যে ঠিক কতখানি শক্তি আমাদের হিসেবের বাইরে গেছে।

যতটা সহজে এখানে বলা হলো, কাজটা অতটা সহজ কিন্তু নয়। একটু আগেই ভূতুড়ে নিউট্রিনো কণার কথা বললাম। এদেরও ধরতে পারা ভীষণই শক্ত। প্রতি মুহূর্তেই আমাদের শরীরের মধ্য দিয়ে লক্ষ-লক্ষ নিউট্রিনো কণা ছুটে বেড়িয়ে যাচ্ছে, আমরা টেরটিও পাচ্ছি না। CERN এও এরা তৈরি হয়, আর এদের জন্য হামেশাই শক্তি-ভরের হিসেব মেলে না। তাছাড়া ডিটেক্টরও একশ শতাংশ ঠিকঠাক কাজ করে না। তারা মাঝে-সাঝে হিসেবে একটু ভুলও করে  ফেলে। তাই কণা-পদার্থবিদদের একটু সাবধানী হতে হয়, বুঝে নিতে হয় কি কি ভাবে নিউট্রিনো বেরতে পারে, অথবা কি কি ভাবে ডিটেক্টর হিসাবে ভুল করতে পারে। সেইসব বুঝে শুনে বিজ্ঞানীদের সন্তর্পণে পা ফেলতে হয়।

বর্তমানে বিজ্ঞানীদের মতে স্ট্যান্ডার্ড মডেলই শেষ কথা নয়। কোথাও না কোথাও আরও নতুন কিছু অবশ্যই লুকিয়ে আছে যা আমাদের আজো অজানা। বহু বিজ্ঞানী বহু তত্ব দিয়েছেন, কিন্তু সেগুলোকে পরীক্ষায় পাস করতে হবে, নইলে জানা যাবে কি করে প্রকৃতি কি নিয়মে নিজেকে চালিত করে। CERN এর বিজ্ঞানীরা এখন ঠিক এই কাজেই মত্ত।   

(প্রচ্ছদের ছবির উৎস)

অন্যান্য টুকিটাকি:

[১] কণার মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ বা বিকর্ষণ কিছু মধ্যবর্তী কণার বিনিময়ের মাধ্যমে হয়। তড়িচ্চুম্বকীয় বল ফোটন কণার বিনিময়ের মাধ্যমে, স্ট্রং ফোর্স গ্লুওন কণার মাধ্যমে, উইক ফোর্স W/Z বোসন কণার মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়। মহাকর্ষ গ্র্যাভিটন কণার মাধ্যমে সঞ্চারিত হয় বলে কল্পনা করা হয়। তবে, এখনো গ্র্যাভিটন কণা পরীক্ষাগারে ধরা পড়ে নি।

[২] হিগস বোসন কণাকে গড পার্টিকেল বা ঈশ্বরকণা নাম দেওয়া হয়েছে, যদিও এর সাথে ভগবানের কোন সম্পর্ক নেই। পদার্থবিদ লিওন লেডারম্যান কথাটা চালু করেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রথমে গডড্যাম পার্টিকেল বলে আখ্যা দিতে চেয়েছিলেন একে, পাবলিশাররা রাজি হয়নি। সেই থেকে ঈশ্বরকণা নামটা টিকে গেছে। তবে CERN এর বিজ্ঞানীদের ভগবান খোঁজার কোন বাসনা নেই।

[৩] GeV মানে ১০ eV, যেখানে ১ eV = ১.৬*১০-১৯ জুল। এটি আদতে শক্তির একক, কিন্তু যেহেতু ভর আর শক্তি একে অন্যে রূপান্তরিত হতে পারে, তাই এক্ষেত্রে ভরের এককের বদলে শক্তির এককেই ভর মাপা হয়।

[৪] ভূতুড়ে কারণ এরা হুবহু স্ট্যান্ডার্ড মডেল মেনে চলে না, যেমন স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে নিউট্রিনো ভর-হীন, কিন্তু পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে নিউট্রিনোর খুব সামান্য ভর আছে ( ১ eV এর থেকেও কম)।

[৫] কিছু বিজ্ঞানী ডার্ক ম্যাটার এর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্বে পরিবর্তন করলে ডার্ক ম্যাটার ছাড়াই মহাবিশ্বের ব্যাখ্যা সম্ভব।

 

লেখক পরিচিতিঃ

অর্ক সাঁতরা বর্তমানে ফ্লোরিডা রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কণা পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। গবেষণার বিষয় সুপারসিমেট্রি। গবেষণার প্রয়োজনে Fermilab CERN এ যাতায়াত। পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ও IIT কানপুরে। ক্রিকেট, ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি নানা বিষয় নিয়ে পড়া আর গাড়ি নিয়ে নানা জায়গায় ঘোরার ফাঁকে ফাঁকে গবেষণা করার চেষ্টা করে। সংখ্যা ভালবাসা অর্ক পদক্ষেপস্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কোষাধ্যক্ষ।

আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা

$
0
0

arnab_rudra

সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানসচেতনতা দরকার কেন? বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ‘আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা’ গল্পটির সাহায্যে এই চিন্তা উদ্দীপক প্রশ্ন করছে অর্ণব রুদ্র (পদক্ষেপ স্বেচ্ছাসেবী)।

 

 

গত সপ্তাহে স্থানীয় বাণী সিনেমা গৃহে সুপ্রসিদ্ধ চিত্রতারকা ইন্দুবালা দেবী শুভাগমন করেন। নৃত্যকলা-নৈপুণ্যে ও কিন্নরকন্ঠের সঙ্গীতে তিনি সকলের মনোহরণ করিয়াছেন। বিশেষত “কালো বাদুড় নৃত্যে” তিনি যে উচ্চাঙ্গের শিল্প-সঙ্গীত প্রদর্শন করিয়াছেন, রানাঘাটবাসিগণ তাহা কোনদিন ভুলিবে না। এই উপলক্ষে উক্ত সিনেমা গৃহে অভূতপূর্ব জনসমাগম হইয়াছিল-সেও একটি দেখিবার মত জিনিস হইয়াছিল বটে। লোকজনের ভিড়ে মেয়েদের ব্যালকনির নিচে বর্গা দুম্ড়াইয়া গিয়াছিল। ঠিক সময়ে ধরা পড়াতে একটি দুর্ঘটনার হাত হইতে সকলে বাঁচিয়া গিয়াছেন।

বিখ্যাত জার্মান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন গতকল্য দার্জিলিং যাইবার পথে এখানে মিউনিসিপাল হলে বক্তৃতা দিতে নামিয়াছিলেন। তাঁহাকেও সেদিন বাণী সিনেমা গৃহে ইন্দুবালার নৃত্যের সময় উপস্থিত থাকিতে দেখা গিয়াছিল!

 

পরের খবরটি পড়ে ভাবছেন এ আবার কবে হলো? ঘাবড়াবেন না, এই ঘটনা আদৌ ঘটেনি। পুরোটাই বিভূতিভূষণের কল্পনা। কদিন আগেই ওঁর লেখা ‘আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা’ গল্পটি পড়লাম। সেখানেই এমন কল্পনাজাল বিছিয়েছেন বিভূতিভূষণ। এমন গল্প যে লিখেছিলেন সেটাই আমার অজানা ছিল। তবে গল্পটি থেকে কিছু কথা মনে হলো। সেসব নিয়েই আজকের লেখা। তবে তার আগে গল্পটাও আপনাদের সংক্ষেপে বলছি।

রানাঘাটে আইনস্টাইন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর আগেকার কথা। জার্মানি থেকে আমেরিকায় আসার পর আইনস্টাইন অর্থাভাবের মুখে পড়েন। তাই নানা দেশে বক্তৃতা দিয়ে কিছু অর্থোপার্জন করা স্থির করলেন। সেই সূত্রেই ভারতে আসা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে আইনস্টাইনের বক্তৃতা শুনতে গেলেন কৃষ্ণনগর কলেজের গণিতের অধ্যাপক রায়বাহাদুর নীলাম্বর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ইচ্ছে হলো কলেজে যদি এমন মানুষকে আনা যায় তাহলে ছাত্রছাত্রীরা অনুপ্রাণিত হবে।

কিন্তু কলেজের অধ্যক্ষ বাধ সাধলেন। ব্রিটিশ প্রভুরা যেহেতু জার্মানদের পছন্দ করেন না তাই আইনস্টাইনকে আনা ঠিক হবে না, এই যুক্তিতে রায়বাহাদুরের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। রায়বাহাদুর হাল ছাড়ার পাত্র নন। আইনস্টাইন হিমালয় দেখতে যাবেন শুনে রায়বাহাদুর ভাবলেন, রানাঘাট যেহেতু রাস্তাতেই পড়বে, এই সুযোগে তাঁকে দিয়ে সেখানে বক্তৃতা দেওয়ানো যায় কিনা।

শেষপর্যন্ত আইনস্টাইনের রানাঘাটে আসা ঠিক হল রায়বাহাদুরের চেষ্টায়। যেদিন আইনস্টাইনের আসার কথা সেদিন রায়বাহাদুর তাঁর কিছু ছাত্রদের নিয়ে রানাঘাট স্টেশনে আগে থেকে এসে পড়লেন সব ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা একবার দেখে নেওয়ার জন্য। ট্রেন থেকে নেমে দেখলেন দেয়ালে পোস্টার পড়েছে ইন্দুবালা দেবী রানাঘাটে আসছেন সেইদিনই। ইন্দুবালা দেবী তখনকার দিনের এক নামজাদা অভিনেত্রী। মানুষের মনে তখনও তাঁর “মিলন” সিনেমার স্মৃতি তাজা। সাবান থেকে শাড়ি সবকিছুর বিজ্ঞাপনেই তাঁর ছবি। রায়বাহাদুর দেখলেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তাতেও সর্বত্র ইন্দুবালার পোস্টার।

ইন্দুবালাও যে সেই ট্রেনেই এসেছেন আর তাঁকে দেখতেই সবাই যে এসেছে সেটা আইনস্টাইনের জানার কথা নয়।

শেষপর্যন্ত যখন বিকেলবেলা দার্জিলিং মেল রানাঘাট স্টেশনে এলো, লোকজন বেশ জমে উঠেছে। আইনস্টাইন রানাঘাটে নেমে ভাবলেন তাঁকে দেখতেই এত লোক। ইন্দুবালাও যে সেই ট্রেনেই এসেছেন আর তাঁকে দেখতেই সবাই যে এসেছে সেটা আইনস্টাইনের জানার কথা নয়। রায়বাহাদুর ও তাঁর সঙ্গীরা প্রমাদ গুনলেন। আইনস্টাইনের বক্তৃতা যেখানে দেওয়া ঠিক হয়েছিল সেই রানাঘাটের মিউনিসিপাল হলে যখন পৌঁছলেন সবাই, হলঘর তখন শুনশান। এরপর বেশ কিছুক্ষণ পরেও রানাঘাটের কেউ যখন ওমুখো হলো না, রায়বাহাদুর আর আইনস্টাইন দুজনেই যে কত অপদস্ত হলেন সেটা পাঠক নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন। রায়বাহাদুর এরপর আর কিই বা করেন, হাল ছেড়ে দিয়ে আইনস্টাইনকে নিয়ে পৌঁছলেন বাণী সিনেমা হলে। পরের দিন খবরের কাগজে কি বেরিয়েছিল সেটাই একদম শুরুতে উদ্ধৃত করেছি।

Bibhuti

 

গল্পটা কেন এখনো একইরকম প্রাসঙ্গিক

গল্পটি পড়তে গিয়ে দেখেছি, প্রতিপদে বিভূতিভূষণের বিজ্ঞানের প্রতি ঔৎসুক্য ধরা পড়েছে। এক জায়গায় তো তিনি লিন্ডন বোল্টনের আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে তৎকালীন বহুলপ্রচারিত বইটির উল্লেখও করেছেন। বিভূতিভূষণ যে তখনকার বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে পড়াশোনা করতেন, খোঁজখবর রাখতেন, তা বেশ বোঝা যায়। যাই হোক, এ তো গেল বিভূতিভূষণের কথা।

বাংলার সাধারণ মানুষ যে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে অথবা বিজ্ঞানীদের ব্যাপারে কতখানি উদাসীন সেকথা বেশ ব্যঙ্গাত্মকভাবে লিখেছেন বিভূতিভূষণ। বাঙালির “অলিক কুনাট্যরঙ্গে” মেতে ওঠার ঐতিহ্যের সঙ্গে আইনস্টাইনের বক্তৃতা একেবারেই মানায় না, আর তাই তাঁর কথা শুনতেও কেউ যায়নি। এই বিষয়টা হয়ত এখনো একইরকম ভাবে সত্যি। আজও বাংলার সাধারণ মানুষ বর্তমান বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে যে খুব উৎসাহী তা নয়।

এর মাঝেও আশার আলো রয়েছে। বহু বাঙালি ছাত্রছাত্রী অতি উচ্চমানের গবেষণায় মেতে রয়েছেন দেশে ও বিদেশে এবং তাদের শিক্ষা দিয়ে চলেছেন কিছু অসামান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা। এই জমানার নানা প্রযুক্তিগত উন্নতির পিছনেও রয়েছে বহু বাঙালি ছাত্রছাত্রীর নাম। বহু বাঙালি ডাক্তার তাদের গবেষনার মধ্যে দিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে নতুন নতুন দিশা দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানসচেতনতা সময়ের সঙ্গে সমান্তরালভাবে বাড়েনি।

বিজ্ঞানের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে না থেকেও বিজ্ঞানসচেতন হওয়া যায় এবং হওয়াও দরকার। একটা সমাজ সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানসচেতন না হলে কিভাবে আমাদের উন্নয়ন হবে? আমাদের ভবিষ্যৎ গভীরভাবে আমাদের বিজ্ঞানবোধের ওপর নির্ভর করছে। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে আপনাদের এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে অনুরোধ করব। পরিবেশদূষণ কিভাবে দ্রুত পৃথিবীকে অবাসযোগ্য করে তুলছে, জিনগত পরিবর্তন খাদ্যে অথবা চিকিৎসায় কিভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, অথবা মঙ্গলগ্রহে যান পাঠানো দরকার কিনা ইত্যাদি ঠিকমত বুঝতে হলে বিজ্ঞানের কিছু প্রাথমিক ধারণা এবং তার সঙ্গে সমকালীন বিশ্বে বিজ্ঞান গবেষণা সম্পর্কে ধারণা থাকা খুবই জরুরি। এইসব বিষয়গুলো আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িত। তাই এই বিষয়ে সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন আমাদের জানা দরকার যে সরকারের সেই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে, ভালো অথবা খারাপ যেভাবেই হোক না কেন। আর আমাদের বহু সমস্যার সমাধান যে বিজ্ঞানের দ্বারাই হবে সেকথা তো আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন রাখে না। প্রকৃত গণতন্ত্র শিক্ষিত ও সচেতন জনতার দ্বারাই গড়ে ওঠে। কিন্তু তার জন্য তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করাও জরুরি এবং সে কাজ করতে হবে সাধারণ মানুষকেই।

আপনাদের কি মনে হয়? নিচে কমেন্ট করুন।

 

অন্যান্য টুকিটাকি:

[১] স্কুলের ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীদের করা ‘আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা’ নাটক দেখুন এখানে।

[২] পলাশ বরণ পালের ইংরাজি অনুবাদ ‘Einstein and Indubala’ পড়ুন এখানে

 

লেখক পরিচিতি: অর্ণব রুদ্র ইউঠা (Utah) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিজ্ঞানে পি.এইচ.ডি. করেছে এবং পরবর্তীকালে জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেছে। বর্তমানে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (MIT) গবেষণারত। গবেষণার বাইরে অর্ণব ‘পদক্ষেপ‘ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে জড়িত। ‘পদক্ষেপ’ পশ্চিমবঙ্গের দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করে। অর্ণব ‘বিজ্ঞান’ সম্পাদকমন্ডলীর একজন অন্যতম সদস্য।


বিজ্ঞান পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা

$
0
0

 সম্পাদকমন্ডলী, ‘বিজ্ঞান’

বিজ্ঞান পত্রিকা’-র দ্বিতীয় সংখ্যা বার করতে গিয়ে মনে হলো: কেন এই যাত্রাটা শুরু করেছিলাম আমরা, সেটা আরেকবার হয়তো ঝালিয়ে নেওয়া উচিত। আমাদের অসংখ্য বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকদের কাছে হয়তো সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের জগৎ থেকে বঞ্চিত থাকা মানে জেনেশুনে একটা অন্য যুগে পড়ে থাকা। আর বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা হয়, এমন মাধ্যম তো হাতে গোনা কয়েকটি! তাই, ‘বিজ্ঞান’-এর প্রয়োজন কেন, সেই নিয়ে হয়ত প্রশ্ন নেই।

কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যায়: ইন্টারনেট যুগে প্রিন্ট পত্রিকা কেন? তাও আবার এমন প্রিন্ট পত্রিকা যা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে প্রিন্ট করতে হয়? অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মধ্যে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যের কথা বলি।

বিজ্ঞান পড়বো কি পড়বো না, এই সিদ্ধান্তটা খুব কাঁচা বয়েসেই আমাদের নিয়ে ফেলতে হয়। সাধারণত, সেটা হয় দশম শ্রেণীর পর, যখন সাইন্স, আর্টস বা কমার্সের মধ্যে কোনো একটা বেছে নিতে হয়। একবার বিজ্ঞান বেছে নিলে, তারপর কলেজে ভর্তির সময় আরেকবার আসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। খুব মোটাদাগে বললে, এবার বিকল্পগুলো হলো ফলিত বিজ্ঞান (applied science)/ ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিশুদ্ধ বিজ্ঞান (pure science)। এই মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে কিসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তগুলো নেব, আমাদের অনেকের কাছেই তার স্পষ্ট জবাব থাকে না। ফলস্বরূপ, বিজ্ঞান বেছে নেওয়ার বা না নেওয়ার কারণগুলোর সাথে অনেক সময় বিজ্ঞানের সরাসরি সম্পর্ক থাকেনা। যেমন, পরীক্ষার হলে অঙ্ক নামাতে না পেরে অঙ্ক তথা সমগ্র বিজ্ঞানের ভীতি কিম্বা কিছু বিশেষ ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে মোটা মাইনের চাকরির আকর্ষণ। এই কারণগুলো আমাদের সমাজ বা শিক্ষাব্যবস্থার দিকে আঙ্গুল তুলতে পারে, কিন্তু এইসব কারণে কেউ যদি বিজ্ঞান বেছে নেয় বা ছেড়ে দেয়, সেটা আক্ষেপের বিষয়।

অপরদিকে, বিজ্ঞান গবেষকদের যদি জিজ্ঞাসা করেন, কখন তারা প্রথম বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকেছিলেন, উত্তরে কিন্তু তাদের অনেকেই চলে যাবেন তাদের কৈশোরে। কোনো একটা বই, কোনো একটা লেখা, কোনো একজন তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল:  “বাহ্, এইটা করা যেতে পারে তো!” সেটা হতে পারে কোনো এক বিজ্ঞানের পত্রিকায় বা খবরের কাগজের  কোনো লেখা, রেডিও-র কোনো অনুষ্ঠান অথবা কোনো পপুলার সাইন্সের বই। অনেক ক্ষেত্রেই, কোনো অসাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষক কিম্বা শিক্ষিকা সেই ভূমিকা নেয়। কিন্তু, এমন একটা কিছুর সান্নিধ্যে যে সবাই আসবে, তার নিশ্চয়তা নেই। বিশেষ করে, ইংরাজিতে স্বচ্ছন্দ না হলে সেই সুযোগ আরো অনেকটা কমে যায়।

সেই অভাবের কথা মাথায় রেখেই ‘বিজ্ঞান’ ওয়েবসাইট এবং বিশেষ করে, ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’। শুধু নিজে পড়া নয়, আপনার চেনাপরিচিত ছাত্রছাত্রীদের যাতে পড়াতে পারেন, তার একটা সুযোগ করে দিতে চাই আমরা। আপনি যদি স্কুলের শিক্ষক কি শিক্ষিকা হন বা সন্তানের অভিভাবক হন, তাহলে এই প্রিন্ট-ফ্রেন্ডলি ফরম্যাটের পত্রিকা প্রিন্ট করে স্কুলের বুলেটিন বোর্ডে লাগাতে পারেন। বা অন্য কোনভাবেও ছাত্রদের কাছে পৌছে দিতে পারেন। পাঠ্যক্রমের বাইরে বৃহত্তর বিজ্ঞানের জগতের সাথে ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। তবেই না তারা বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, বিজ্ঞানের রাস্তায় নামবে কিনা। আর ভালোবেসে কোনো কিছু বেছে নেওয়ার চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে?

Bigyan 2 Cover‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র দ্বিতীয় সংখ্যায় আমরা ছাত্রছাত্রীদের কথা মাথায় রেখেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় থেকে একটা কি দুটো বাছাই লেখা তুলে ধরেছি। আশা করি বিজ্ঞানচর্চা কতটা মজাদার হতে পারে, তার এক ঝলক পাওয়া যাবে এখানে। যেমন, রসায়ন মানে শুধু সমীকরণ ব্যালান্স নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তা কতটা জড়িয়ে আছে, তা ‘লঙ্কাকাণ্ড’ পড়লে বোঝা যাবে। কেন জল খেলে লঙ্কার ঝাল জিভ থেকে যায়না, সেটাও কিন্তু রসায়ন। জীবন বিজ্ঞান মানে শুধুই হাজারটা নাম মুখস্থ নয়, ‘পেখম রহস্য’ সেটাই দেখায়। ময়ুরের বাহারি পেখম তো নেকড়ের জন্য আদর্শ, শিকার খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধেই নেই, অথচ বিবর্তনের ফলে পেখম হারিয়ে যায়নি কেন, সেটাও কিন্তু জীবন বিজ্ঞানের প্রশ্ন। পদার্থবিদ্যা শুধু বইয়ের পিছনে দেখে অঙ্কের উত্তর মেলানো নয়, তার সাহায্যে মানুষ যে আজ অজানার কোন সুদূর  প্রান্তরে পাড়ি দিয়েছে, তার কিছুটা পরিচয় দিচ্ছে ‘পরমশূন্য তাপমাত্রার কাছে’ বা ‘মহাবিশ্বের প্রথম আলো’। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখতে যে হাজারটা ব্যাকরণ বা সিনট্যাক্স মনে রাখতে হয়না, তা দেখাচ্ছে ‘খেলাচ্ছলে প্রোগ্রামিং’। এর সাথে থাকছে কিছু ইতিহাস, বিজ্ঞানের খবর, ইত্যাদি। বিজ্ঞানের ওয়েবসাইটে আগে এই লেখাগুলো যারা পড়েছিলেন তারা এই সুযোগে আবার একবার পড়ে নিতে পারেন।

আর সারপ্রাইজ প্যাকেজ হিসেবে আছে ‘জলের দামে মাইক্রোস্কোপ’। প্রায় জলের দামে একটা মাইক্রোস্কোপ বানিয়ে সকলের কাছে পৌছে দেওয়ার এই প্রয়াসকে আমরা সেলাম জানাই। এটা কত উপযোগী আর সেই সাথে এটা বানাতে  আবিষ্কারকদের কতটা সৃজনশীল হতে হয়েছে সেটাও আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা।

লেখাগুলো আমাদের খুবই পছন্দের। আশা করি, আপনাদেরও ভালো লাগবে।

 

‘বিজ্ঞান পত্রিকা’ ডাউনলোড করুন

রামধনুর নানা বিস্ময় –২

$
0
0

Deep Sarkar

হাই স্কুলে শেখা ফিজিক্স আর জ্যামিতি দিয়েই রামধনুর কিছু রহস্য ব্যাখ্যা করা যায়।
দীপ সরকার, টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ


 

ই ধারাবাহিকের আগের পর্বে আমরা দেখেছিলাম যে রামধনু তৈরি করতে শুধুমাত্র একটি জলকণাই যথেষ্ট। প্রতিসরণ ও প্রতিফলনের সূত্র মেনে রামধনু তৈরি হয় এবং তারা একাধিক প্রকারের হয়। কিন্তু সাথেসাথে যে অতিরিক্ত ধনুর আবির্ভাব হয়, তার ব্যাখা এভাবে পাওয়া যায় না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক রামধনুর মাঝের আকাশই বা সবসময় বেশি গাঢ় দেখায় কেন? এর ব্যাখা কি আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণের মাধ্যমে সম্ভব?

প্রতিফলন ও প্রতিসরণের সূত্রের সাথে তো তোমরা সকলেই কমবেশী পরিচিত, তাও একবার নিচের ছবিগুলির মাধ্যমে তোমাদের একটু মনে করিয়ে দিই।

rbow1

প্রতিফলনে আপতন আর প্রতিফলন কোণের মান সমান হয় (ছবিতে i)। অন্যদিকে প্রতিসরণে স্নেলের সূত্র খাটে। মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক (ছবিতে n) জানলে প্রতিসরণ কোনের মান (ছবিতে r) খুব সহজেই বের করা যায় এই নিয়ম কাজে লাগিয়ে।

রামধনুর প্রাথমিক বিশ্লেষণ এই দুই নীতির উপর ভিত্তি করেই শুরু হয়েছিল। এখন বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য ধরে নেওয়া যাক যে আকাশে ভাসমান জলবিন্দুরা গোলাকৃতি। কি সুবিধা তাতে? সুবিধা এই যে গোলকের প্রতিসাম্যর (symmetry) দরুন আপতিত আলোকরশ্মির দিশা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই। কারণ গোলকের কাছে সমস্ত দিকই সমান। শুধু যেটা বিবেচ্য সেটা হল গোলকের কেন্দ্রবিন্দু থেকে আলোকরশ্মির লম্ব দুরত্ব।

এই দুরত্বকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার (impact parameter)। যদি আলোকরশ্মি সরাসরি গোলকের কেন্দ্রবিন্দু ভেদ করে, তাহলে তার ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার শূন্য। আর যদি তা গোলকটিকে স্পর্শ করে বেরিয়ে যায় তাহলে তার ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার-এর মান গোলকের ব্যাসার্ধের সমান (এটি ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার-এর সর্বোচ্চ মানও বটে)। নিচের ছবিটি দেখ, ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার-এর ধারণা আরো পরিষ্কার হবে।

rbow2 

ভেবে দেখলে, রামধনুর ব্যাপারটা অবাক করার মতই। যে সূর্যরশ্মি জলকণার উপর এসে পড়ছে, তাদের ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার-এর মান শূন্য থেকে জলকণার ব্যাসার্ধের মাঝে যা খুশি হওয়া সম্ভব। আর তাহলে, বিক্ষিপ্ত রশ্মিদের বিক্ষেপ কোণও শূন্য ও ১৮০° র মাঝে যে কোন মান  নিতে পারে, তাই নয় কি? তাহলে আকাশের একটা বিশেষ কোণেই শুধু রামধনু দেখতে পাওয়া যাবে কেন? থিওডোরিক এটা ভেবে দেখেননি। এই প্রশ্নের উত্তর প্রথম মেলে ডেকার্টের কাছে।

একটু ভাল করে এই প্রশ্নটা ভেবে দেখা যাক। উপরের ছবিটি দেখ – খুব সহজ জ্যামিতি লাগিয়ে আমরা বিক্ষেপ কোণ বা স্ক্যাটারিং অ্যাঙ্গেল (scattering angle), δ-র মান বের করার একটা সমীকরণ লিখেছি। এই সমীকরণ অনুযায়ী আপতন আর প্রতিসরণ কোণের মান জানলেই বিক্ষেপ কোণের মান জানা যাবে।

উপরের ছবি অনুযায়ী ইমপ্যাক্ট প্যারামিটারের মান পাল্টালে, অর্থাৎ আলোক রশ্মি জলকণার বিভিন্ন জায়গায় এসে ধাক্কা মারলে, আপতন কোণ বা i-এর মান বদলাব‍ে (সমীকরণ ছবিতে দেওয়া হয়েছে)। এবং পরিণামে প্রতিসরণ কোণ বা r-এর মানেরও পরিবর্তন হবে। অর্থাৎ ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার বদলালে বিক্ষেপ কোণ বদলাবে, তাই না? যেমন, আপতিত আলোকরশ্মির ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার শূন্য হলে বিক্ষেপ কোণের মান হবে ১৮০°, অর্থাৎ বিক্ষিপ্ত আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সোজা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ফিরে যাবে।

এবার ধরো, ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার-এর মান যদি ক্রমাগত বাড়ানো যায়, তাহলে বিক্ষেপ কোণের মানের পরিবর্তনটা ঠিক কিরকম হবে? ডেকার্ট এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছিলেন।

আকাশের একটা বিশেষ কোণেই শুধু রামধনু দেখতে পাওয়া যাবে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর প্রথম মেলে ডেকার্টের কাছে।

প্রাথমিক রামধনু রশ্মির ক্ষেত্রে দেখা গেল যে ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার বাড়ানোর সাথে সাথে বিক্ষেপ কোণের মান প্রথমে কমতে থাকে, কিন্তু একটা সময় পর সেটা আবার বাড়তে শুরু করে! অর্থাৎ বিক্ষেপ কোণের একটি সর্বনিম্ন মান রয়েছে; হিসেব করে দেখা গেল যে এই সর্বনিম্ন মানটি হল ১৩৮°। ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার জলবিন্দুর ব্যাসার্ধের ৭/৮ ভাগ হলে বিক্ষেপ কোণের মান এই দাঁড়ায়।

এখানে তোমরা হয়ত প্রতিবাদ করে বসবে! বলবে – “বিক্ষেপ কোণের মান হিসেব করতে আলোর প্রতিসরাঙ্কের মান জানতে হয়। আর এই যে সেদিন স্কুলে মাষ্টার মশাই দেখালেন, প্রিজমের মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো সাত রঙে ভেঙ্গে যায়। বিভিন্ন রঙের আলোর জন্য মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক আলাদা – তাই না আলো সাত রঙে ভেঙ্গে গেল? তাহলে বিক্ষেপ কোণের মানও তো পালটাবে আলোর রঙ পাল্টালে?” সাবাশ তোপসে! ডিটেক্টিভের মত একদম ঠিক ধরেছ! এই বিক্ষেপ কোণের মান বিভিন্ন রঙের জন্য সত্যিই আলাদা। আর সেখানেই তো রামধনুর সৃষ্টি-রহস্য! বুঝতে যাতে আর একটু সুবিধা হয় তার জন্য নিচে একটি টেবিলে আপতন কোণ i-এর বিভিন্ন মানের জন্য বিক্ষেপ কোণের মান দেখিয়ে দেওয়া হল, শুধু বেগুনি রঙের আলোর জন্য। জলের জন্য বেগুনি রঙের প্রতিসরাঙ্ক 1.340।

TableRbow

ছবিটিতে দেখ, i = 60°-র জন্য δ-র মান সর্বনিম্ন। কোন ম্যাজিক নেই, শুধু যোগ-বিয়োগের খেলা! δ-র সমীকরণটি পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আরেকবার লিখে দেওয়া হল।

লাল রঙের জন্য বিক্ষেপ কোণ δ-র সর্বনিম্ন মান বেগুনির তুলনায় সামান্য কম, কারণ লাল রঙের জন্য জলের প্রতিসরাঙ্ক বেগুনির তুলনায় কম (1.331)। অর্থাৎ বেগুনির প্রতিসরণ লালের তুলনায় বেশি। নিচের ছবিটি দেখ; ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার বুঝতে পারবে।

rbow3a

মাধ্যমিক রামধনুর ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা হয় ঠিক উল্টো! ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার বাড়ার সাথে-সাথে বিক্ষেপ কোণ প্রথমে বাড়ে এবং ১৩০° অতিক্রম করার পর কমতে শুরু করে। এক্ষেত্রে ১৩০° হল বিক্ষেপ কোণের সর্বোচ্চ মান।

rbow3b

এই যে বিক্ষেপ কোণের একটা সর্বনিম্ন মান আছে, ডেকার্টের এই পর্যবেক্ষণের গুরুত্বটা কতখানি সেটা বোঝার জন্য একটু কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করা যাক। ধরো, আকাশের জলবিন্দুগুলি এমনভাবে আলোকরশ্মিদের বিক্ষেপণ ঘটাচ্ছে যাতে করে আকাশের সর্বত্রই ঔজ্জল্য একইরকম। তাহলে কি আদৌ রামধনু বলে কিছু থাকত? থাকত না! আবার বিক্ষেপ কোণের মান যদি ক্রমাগত কমতেই থাকত ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার বাড়ার সাথে-সাথে, তাহলেও লাভের লাভ কিছু হত না। ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার-এর অসংখ্য মানের জন্য অসংখ্য বিক্ষেপ কোণের মাঝে আমাদের রামধনু কোণ হারিয়ে যেত! বিক্ষেপ কোণের একটা সর্বনিম্ন মান থাকার ফলেই বিক্ষিপ্ত আলোকরশ্মিদের একটা বড় অংশ ওই বিশেষ কোণের আশেপাশে জড়ো হয়। কেন? নিচের ছবিটাতে আমি ইমপ্যাক্ট প্যারামিটারের সাথে বিক্ষেপ কোণের বিভিন্ন মানের একটা লেখচিত্র দিলাম।

rbow4

ভাল করে খেয়াল কর – এই সর্বনিম্ন বিক্ষেপ কোণের কাছে ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার পালটালেও বিক্ষেপ কোণ তেমন ভাবে পালটাচ্ছে না! অর্থাৎ, ইমপ্যাক্ট প্যারামিটার-এর সঙ্গে বিক্ষেপ কোণের পরিবর্তনের হার সব চাইতে কম বিক্ষেপ কোণের এই সর্বনিম্ন মানের জন্য। অতএব, জলকণার উপর বিভিন্ন আপতন কোণে পতিত অনেক রশ্মি ওই একই বিক্ষেপ কোণে ফিরে গিয়ে দর্শকের চোখে ধরা দেবে! তাই ১৩৭.৬° বিক্ষেপ কোণে লাল রঙের আলোর জটলা হবে, ১৩৮.৮° বিক্ষেপ কোণে হবে বেগুনির জটলা। ভিন্ন রঙের আলোর ভিন্ন বিক্ষেপ কোণে এই জটলাটাই হচ্ছে আমাদের রামধনু!

যেহেতু জলকণা থেকে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসা আলো রামধনু তৈরি করছে, তাহলে এবার বুঝলে তো, কেন রামধনু সূর্যের বিপরীত দিকে দেখা যায়? উপরের ছবিগুলির দিকে আরেকবার ভাল করে তাকালে বুঝবে যে সূর্যের আলোর দিকের সাথে মোটামুটি ৪২ ডিগ্রী কোণে প্রাথমিক রামধনু দেখা যায় – লাল থাকে উপরে, বেগুনি নিচে। মাধ্যমিক রামধনুর ক্ষেত্রে কিন্তু উলটো – বেগুনি উপরে, লাল নিচে!

উপরের লেখচিত্রের দিকে আবার তাকাও – ১৩০‍‍‍° ও ১৩৮°-র মাঝে কোন রামধনু (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) রশ্মির বিক্ষেপ কোণ নেই! অর্থাৎ, ওই কোণটুকুর মধ্যকার আকাশে কোনো বিক্ষিপ্ত আলো এসে পৌঁছবে না। এটাই আলেকজান্ডারের ডার্ক ব্যান্ড!

তাহলে তোমরা বুঝলে তো, যে রামধনুর রহস্য বেশ সহজ অঙ্ক কষেই বের করা যায়! আর একটা লক্ষ্য করার মত বিষয় হল, জলবিন্দুর আয়তনের উপর রামধনু কোণের মান নির্ভর করে না। থিওডোর যেমনটি দেখিয়েছিলেন – বিক্ষেপনের জ্যামিতি জলকণাদের জন্যও যা, জলভর্তি কাঁচের গোলকের জন্যও তাই! একটি জলকণা নিয়ে পরীক্ষা করা শক্ত, কিন্তু একটা কাঁচের গোলকের উপর উজ্জ্বল সাদা আলো ফেলে নিজেরাই রামধনু তৈরি করে দেখবে নাকি?

আবার যখন রামধনু উঠবে আকাশে, নতুন চোখে দেখবে! রামধনু সুন্দর, কিন্তু তার সৃষ্টি-রহস্য যে জানে তার চোখে সে আরো সুন্দরভাবে ধরা দেয়! আমাদের কথা কিন্তু এখনো ফুরোয়নি! আলোক রশ্মির জ্যামিতিক হিসেব কানুন দিয়ে রামধনুর অনেক সূক্ষ্ম কারুকার্য, যেমন অতিরিক্ত ধনু (supernumerary arcs, যার কথা তোমাদের আগের পর্বে বলেছিলাম) ব্যাখ্যা করা যায় না। এর ব্যাখা খুঁজতে হলে আমাদের আলোর তরঙ্গধর্ম নিয়ে আলোচনায় ঢুকতে হবে। সেই গল্প নিয়ে হাজির হব পরের পর্বে।

(প্রচ্ছদের ছবিটির উৎস)

তথ্যসূত্র

উপরের লেখাটির অনুপ্রেরণা ও আংশিকভাবে উৎস (আগ্রহী পাঠকদের জন্য) এখানে দেখুন।

লেখক পরিচিতি

লেখক  বৰ্তমানে  টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এ (মুম্বই শাখা) ফিজিক্সে গবেষনারত এক ছাএ। লেখক অতীতে স্কটিশ চাৰ্চ কলেজ থেকে ফিজিক্সে B.Sc.(Hons) ও আইআইটি দিল্লী থেকে ফিজিক্সে M.Sc. করেছে।   

 

ম্যালেরিয়া : নোবেল পুরস্কার এবং মানুষের ভবিষ্যৎ

$
0
0

 


deyম্যালেরিয়া রোগের নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করার জন্য ২০১৫ সালে নোবেল পুরষ্কার পেলেন চীনা বিজ্ঞানী, ইয়উয়উ টু।
সুমন্ত দে, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি


 

ই বছর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দিয়ে যাদের সম্মানিত করা হল, তারা সকলেই পরজীবী বা প্যারাসাইট (parasite) জনিত রোগের মোকাবিলায় নজির স্থাপন করেছেন। এদের দ্বারা প্রবর্তিত চিকিৎসা পদ্ধতি যে কত মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে, তার হিসেব মেলা ভার! আজকের লেখার বিষয় তাদেরই একজনকে নিয়ে: চীনের মহিলা বিজ্ঞানী, ইয়উয়উ টু। চীনের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যবহারিক জ্ঞান কাজে লাগিয়ে, ষাট-সত্তরের দশকে, ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসায় তিনি এক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন।

youyou

১৯৫০-এর দশকে তোলা ছবি — ইয়উয়উ টু (ডান দিকে) এবং লাও জিচেন গবেষণায় ব্যস্ত। (ছবির উৎস)

প্রথমেই প্রশ্ন আসে: ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা তো সাড়ে তিনশো বছর ধরে চলে আসছে, প্রোফেসর টু নতুন কি করলেন? এমন তো নয় যে ষাট-সত্তরের দশকের আগে ম্যালেরিয়া হওয়া মানেই নির্ঘাত মৃত্যু ছিল! সেই গল্প জানতে হলে, আগে ম্যালেরিয়া রোগ  আর তা নিরাময়ের জন্যে ব্যবহৃত নানা রকমের ওষুধের জৈবরাসায়নিক ক্রিয়া পদ্ধতির কথা জানা দরকার।

 

 

ম্যালেরিয়ার আদি শত্রু: কুইনিন

কিছু বিশেষ মশার কামড়ে য়ে ম্যালেরিয়া হয়, তা আমরা সকলেই জানি। রোগের উপসর্গ সর্বাঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, আর অনেক ক্ষেত্রেই পরিনতি মারাত্মক! বহুকাল আগে থেকেই পেরু এবং বলিভিয়ার মত দেশে, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলেই সিনকোনা গাছের ছালের রস খাইয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচানো হত। লক্ষণীয় বিষয়, ঠিক একই সময়ে চীনদেশেও সেই জ্বরের চিকিৎসা করা হত সুইট ওয়ার্মউড গাছের পাতার রস দিয়ে।

১৮২০ সালে ফরাসি বিজ্ঞানীরা দেখান যে সিনকোনা গাছের ছালে কুইনিন নামে একটা পদার্থ ম্যালেরিয়া রোগ সারায়।

Cinchona_officinalis_001

সিনকোনা গাছের ছাল, যা থেকে তৈরি করা হয় কুইনিন। ছবির উৎস

গাছের নির্যাস খাইয়ে চিকিৎসা করা গেলেও সেই গাছ পৃথিবীর সব দেশে পাওয়া যেত না। গাছের ছালের আমদানি করেও চাহিদা মেটানো সহজ ছিল না। ১৮২০ সালে ফরাসি বিজ্ঞানীরা বের করেন যে সিনকোনা গাছের ছালের রসে কুইনিন নামে একটা  জৈবরাসায়নিক পদার্থ আছে। গাছের ছালের মধ্যে থাকা এই কুইনিনই আসলে ম্যালেরিয়া রোগ সারায়। এই তথ্যটা  জানার পরেই কুইনিনের মত রাসায়নিক পদার্থ বানানো শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন গবেষণাগারে। তার ফলে আবিষ্কার হল অনেকগুলো ওষুধ, যাদের মধ্যে সব থেকে বেশি সাফল্য পেল ক্লোরোকুইন। ১৯৩৪ সালে ক্লোরোকুইনের আবিষ্কারের পর থেকে সমস্ত দেশে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হল।

কিন্তু, ১৯৫০ সালের পর থেকেই দেখা গেল যে এই ওষুধ বেশ কিছু ক্ষেত্রে কাজ করছে না। কারণ: অতিরিক্ত মাত্রায় ক্লোরোকুইনের ব্যবহার। দুই-তিন দশকের মধ্যেই, পৃথিবীর সমস্ত ম্যালেরিয়া-প্রবণ দেশে দেখা গেল ক্লোরোকুইন তার কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে ম্যালেরিয়া-জনিত রোগে মৃত্যুর হার  বেড়ে গেল দুই-তিন গুণ।

ম্যালেরিয়া সারাতে যুদ্ধকালীন তৎপরতা

এরই মাঝে ১৯৫৫ সালে শুরু হয়ে গেল ভিয়েতনাম যুদ্ধ। উত্তর ভিয়েতনাম লড়ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে। মানুষের পরিকল্পিত যুদ্ধের মাঝে, সামরিক বাহিনীর মধ্যে ভীষণ আতঙ্ক হয়ে দাড়ালো ম্যালেরিয়া। দরকার হয়ে পড়ল দ্রুত রোগ নিরাময়ের।  নিরূপায় উত্তর ভিয়েতনামের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল  চীন। ২৩ মে, ১৯৬৩ সালে চীন শুরু করলো এক গোপন প্রকল্প – “প্রজেক্ট ৫২৩”।

সেই “প্রজেক্ট ৫২৩”-তেই যোগ দেন ইয়উয়উ টু এবং আরও অনেক বিজ্ঞানী। ১৯৭০ সালে সুইট ওয়ার্মউড গাছড়ার নির্যাসে পাওয়া গেল আরটেমিসিনিন (Artemisinin) নামের একটি পদার্থ। চীনা ভাষায় এর নাম চিংহাউসু (qinghaosu)। আরটেমিসিনিন ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু পদার্থটা ব্যবাহারযোগ্য অবস্থায় এই গাছড়া থেকে উদ্ধার করাটা মোটেই সহজ কাজ ছিল না।

সমস্যা ছিল তখনকার প্রচলিত রাসায়নিক নিষ্কাশন পদ্ধতি। যে তাপমাত্রায় রাসায়নিক পৃথকীকরণ করা হচ্ছিল, সেই তাপমাত্রায় আরটেমিসিনিনের কার্যক্ষমতা যাচ্ছিল অনেক কমে। ইয়উয়উ টু এবং তাঁর সহকর্মীরা জয়লাভ করলেন সেখানেই। তাঁরা এক নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করলেন, যার দ্বারা রাসায়নিক ভাবে আরটেমিসিনিনের নানান সক্রিয় যৌগ নিষ্কাশন করা সম্ভব হলো1

ব্যবহার করো কিন্তু সামলে

নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে, ক্লোরোকুইন কাজ না করলে প্রয়োগ করা হত আরটেমিসিনিন যৌগগুলোর একটা পাঁচ-মেশালী বা আরটেমিসিনিন বেসড কম্বিনেশন থেরাপি (ACT)। ACT-র মধ্যে থাকতো:

(১) যে কোনও একটা আরটেমিসিনিনের যৌগ, এবং 

(২) অন্য কোনও ক্লাসের অ্যান্টি-ম্যালেরিয়াল ওষুধ যেমন লুমেফ্যানট্রিন, মেফ্লোকুইন, অ্যামোডায়াকুইন, ইত্যাদি।

ACT-এর মধ্যে আরটেমিসিনিন যৌগের কাজ হচ্ছে প্রথম তিন দিনের মধ্যেই রক্তের মধ্যে থাকা বেশীর ভাগ পরজীবীর সংখ্যা কমানো। অপর ওষুধটি বাকি বেঁচে থাকা পরজীবীদের মেরে ফেলে।

এই থেরাপির সুবিধে এটাই যে এতে আরটেমিসিনিন যৌগ প্রয়োগের মাত্রাটা কম রাখা সম্ভব। চিকিৎসা পদ্ধতিতে এর বেশ একটা লাভজনক দিকও রয়েছে। ওষুধের পার্শ্ব পতিক্রিয়া  তো কম থাকেই। তাছাড়া আরটেমিসিনিন কম পরিমাণে ব্যবহার করলে তার কার্যক্ষমতা অনেক বেশি দিন থাকে।  কারণ আর কিছুই না, আরটেমিসিনিন-প্রতিরোধী পরজীবীদের ছড়াতে অনেক বেশি সময় লাগে। অন্তত এমনটাই বিজ্ঞানীদের অনুমান।  

সুইট ওয়ার্মউড গাছড়ার নির্যাসে ইয়উয়উ টু এবং তাঁর সহকর্মীরা পেলেন ‘আরটেমিসিনিন’, যা ক্লোরোকুইন প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম।

বর্তমানে ৭৯টি দেশে ACT-কে প্রথম সারির চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে ব্যাবহার করা হয়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গ্যানাইজেশন (WHO)-এর রিপোর্ট 2 অনুযায়ী ACT-র ব্যবহারের ফলে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর হার তিরিশ শতাংশ কমেছে। তাহলে বুঝতেই পারছ যে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় আরটেমিসিনিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।

ম্যালেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্র

কুইনিন কোথায় ব্যর্থ হলো আর আরটেমিসিনিন কেন সফল, সেটা বুঝতে হলে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ পদ্ধতি সম্বন্ধে একটু গভীরে ঢুকতে হবে।

মানুষের মধ্যে ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী প্লাসমোডিয়া গোত্র বা ‘জেনাস’-এর পরজীবী। প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম আর প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স – এই দুটো পরজীবী ম্যালেরিয়া-জনিত মৃত্যুর প্রধান কারণ। পরজীবীর প্রবেশ থেকে শুরু করে তার প্রজনন, পুরো চক্রটা খানিকটা এইরকম হয়।

১। লিভার দশা (liver stage): স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা পরজীবীকে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যেই সে যকৃত বা লিভার-এর কোষের ভিতরে গা ঢাকা দেয়। এই দশায় থাকাকালীন পরজীবীরা আমাদের কোনও জানান দেয় না।

২। রক্ত দশা (blood stage): এরপর পাঁচ-ছ’দিনের মধ্যেই পরজীবীরা যকৃত থেকে লোহিত রক্ত কণিকায় নিজেদের জায়গা বানিয়ে ফেলে। এই দশাতেই শারীরিক জটিলতা শুরু হয়। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসাটা এই সময়েই হয়ে থাকে। পরজীবীরা রক্ত কণিকার ভিতরে থাকা হিমোগ্লোবিন ভেঙে গ্লোবিন প্রোটিনকে নিজেদের বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করতে শুরু করে। এইভাবে তাদের  জীবনচক্র এগোতে থাকে। আর এই কারণেই এরা পরজীবী: শত হলেও, মানব দেহে হিমোগ্লোবিন তো আর এদের পুষ্টির জন্য তৈরী হয়নি!

হিমোগ্লোবিন ভাঙার এই ঘটনা ঘটে পরজীবীর ভিতরে থাকা খাদ্য থলির মধ্যে। হিমোগ্লোবিন ভাঙার পরে গ্লোবিন ব্যবহার হলেও, খাদ্য থলির ভিতরে অবশিষ্ট থাকে হিম (Heme)। এই হিম অণু পরজীবীদের কাছে খুব ক্ষতিকারক (নিচে, টীকা ১ দেখো)। পরজীবীরা তাই চটপট এই হিমকে হিমোজইন নামক পদার্থে পরিবর্তন করে ক্ষতিকারক হিমের হাত থেকে রক্ষা পায়।

৩। গ্যামেটোসাইট দশা (gametocyte stage): শুধু খেয়েদেয়েই শান্তি নেই, এবার ম্যালেরিয়ার পরজীবীরা বংশবিস্তার করতে শুরু করে। গ্যামেটোসাইট মানে হল জননকোষ। পুরুষ এবং স্ত্রী গ্যামেটোসাইট, উভয়েই ম্যালেরিয়া রোগীর রক্তে তৈরি হয়। ম্যালেরিয়া রোগী নতুন করে মশার কামড় খেলে রক্তে থাকা এই গ্যামেটোসাইট আবার মশার মধ্যে প্রবেশ করে। মশার দেহের মধ্যে পরজীবীর যৌন জনন (sexual stage) শেষ হলে উৎপন্ন হয় নবজাতক, যা আবার সেই মশার কামড়ে অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।

malaria1

ম্যালেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্র । (ছবির উৎস)

কুইনিন  যৌগ কোথায় বাধ সাধে

তাহলে দাড়ালো এই যে, ম্যালারিয়ার পরজীবীকে আটকাতে হলে এই দশাগুলির কোনো একটাকে সফল হওয়া থেকে আটকাতে হবে। এখনও পর্যন্ত সব থেকে সফল অ্যান্টি-ম্যালেরিয়াল ওষুধগুলি, যেমন ক্লোরোকুইন, মেফ্লোকুইন, ইত্যাদি পরজীবীদের রক্ত দশাকেই আক্রমণ করেছে। ক্লোরোকুইন পরজীবীর খাদ্য থলিতে প্রবেশ করে হিম থেকে হিমোজোইন তৈরীর রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়। পরজীবীদের ভিতরে হিম-এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, আর এই হিম-এর বিষক্রিয়ায় তাদের মরতে হয়।

আর এইখানেই যত বিপত্তি। কিছু পরজীবীর এমন পরিবর্তন ঘটেছে যে তারা ক্লোরোকুইনকে নিজেদের খাদ্যথলির ভিতর জমতেই দেয় না। ফলে তারা দিব্বি বেঁচে-বর্তে থাকে (নিচে, টীকা ২ দেখো)। শুধু ক্লোরোকুইন নয়, আরও  কিছু অ্যান্টিম্যালেরিয়াল ওষুধকেও একই সাথে প্রতিরোধ করতে পারছে ওই সব মাল্টিড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট (MDR) পরজীবী।

আর এখানেই আরটেমিসিনিনের এর গুরুত্ব, কারণ আরটেমিসিনিন এইসব প্রতিরোধী পরজীবীদের অনায়াসেই মারতে পারে। ঠিক কিভাবে আরটেমিসিনিন কাজ করে?

মুশকিল আসানকারী আরটেমিসিনিন

রাসায়নিকভাবে আরটেমিসিনিন হল সেসকিটার্পিন ল্যাকটোন (sesquiterpene lactone) নামের একটি যৌগ। কেমিকাল ফর্মুলা  C15H22O5। এর কাঠামো লক্ষ্য করলে দেখবে, ভিতরে থাকে যাকে বলে একটা এন্ডোপারক্সাইড ব্রিmalaria2জ (endoperoxide bridge)। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন আরটেমিসিনিন এর ম্যালেরিয়া-বিনাশক ক্ষমতার জন্যে আসলে এই এন্ডোপেরক্সাইড ব্রিজ-ই দায়ী।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে আরটেমিসিনিন একটা প্রোড্রাগ (prodrug) যা একবার রক্ত কণিকায় থাকা পরজীবীর ভিতরে প্রবেশ করলে, তবেই সে একটা সক্রিয় পদার্থে পরিবর্তিত হয় এবং সেইটিই আসলে পরজীবী মারার কাজ করে।

অর্থাৎ, আরটেমিসিনিন দুটো ধাপে কাজ করে। প্রথম ধাপ হলো সক্রিয়করণ বা এক্টিভেশন (activation)। সাধারনভাবে মনে করা হয় যে, পরজীবীর ভিতর প্রবেশ করার পরে আরটেমিসিনি আয়রন (Fe2+) অথবা ফেরাস হিম-এর সাথে বিক্রিয়া করে। তৈরী হয় একটা মাঝামাঝি সক্রিয় অবস্থা।  দ্বিতীয় ধাপে, এই মাঝামাঝি অবস্থার পদার্থটি পরজীবীর কিছু প্রোটিনের অ্যালকাইলেশন (alkylation) করে প্রোটিনগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।

malaria3

পরজীবীর শরীরে নানান রাসায়নিক প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করার জন্য এইসব প্রোটিনের খুবই প্রয়োজন। এদের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার ফলেই পরজীবীর মৃত্যু হয়। তবে আরটেমিসিনিন কিভাবে কাজ করে, সেই নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে এখনও নানা রকম তত্ত্ব উঠে আসছে। কোনটা কতটা ঠিক, তা এখনই জোর দিয়ে বলা মুশকিল।  

আরটেমিসিনিন-এর দিন কি ফুরিয়ে এলো ?

আরটেমিসিনিন কতদিন সফল থাকবে বলে তোমাদের ধারণা ? আরও দশ-কুড়ি বছর? আমাদের জানা নেই। তবে তোমরা শুনলে চমকে উঠবে, বর্তমানে পাঁচটি দেশে (কাম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম) আরটেমিসিনিন প্রতিরোধে সক্ষম পরজীবীর খোঁজ পাওয়া গেছে। দুঃখের কথা, আমাদের হাতে মজুদ থাকা অস্ত্র  দিয়ে এদের মারা যাচ্ছে না 3

ঠিক এই কারণেই আরটেমিসিনিন বেসড কম্বিনেশন থেরাপির ব্যাবহার করা হচ্ছে। আরটেমিসিনিন কম পরিমাণে ব্যবহার করলে তার কার্যক্ষমতা অনেক বেশি দিন বজায় থাকবে। আর ওই আরটেমিসিনিন প্রতিরোধে সক্ষম পরজীবীদের ছড়াতে অনেক সময় লাগবে। এমনটাই বিজ্ঞানীদের অনুমান 4। (নিচে, টীকা ৩ দেখো)

ভবিষ্যতে কোন ওষুধ ম্যালেরিয়া থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীদের তৎপরতায় কিছু নতুন অণুর খোঁজ পাওয়া গেছে, যা ভবিষ্যতে সফল ম্যালেরিয়ার ওষুধের জায়গা নিতেই পারে। কিন্তু এই ওষুধগুলোকে অনেক বছর কার্যকর রাখাটাই বিজ্ঞানীদের কাছে অনেক বেশী চ্যালেঞ্জিং। ম্যালেরিয়ার টীকা আবিষ্কার হওয়াটা খুবই প্রয়োজন। আর যতদিন তা না হচ্ছে, ম্যালেরিয়া-বিনাশকারী ওষুধই আমাদের ভরসা।

(প্রচ্ছদের ছবির উৎস)

 

টীকা :

১) কেন রক্তের হিমোগ্লোবিন ভেঙ্গে অবশিষ্ট হিম পরজীবীদের কাছে ক্ষতিকারক:

হিমোগ্লোবিন থেকে বেরিয়ে আসা ফ্রি হিম লিপোফিলিক (Lipophilic)। তাই খুব সহজেই খাদ্যথলি  থেকে বেরিয়ে এসে কোষ পর্দায় ছিদ্র করে কোষ পর্দাকে ভেঙে দিতে পারে। এছারা ফ্রি হিম হাইড্রোজেন পারক্সাইডের(H2O2) সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রক্সিল মূলক (OH)-এর মত সক্রিয় জারক তৈরি করতে পারে। এই সক্রিয় জারক পরজীবীদের  DNA-র ক্ষতি করতে পারে এবং নানা রকম প্রয়োজনীয় লিপিড ও প্রোটিনকে জারিত (oxidize) করে তাদের মেরে ফেলতে পারে। প্রচুর জারণক্ষম রাসায়নিক (free oxidants) তৈরি হয়ে কোষের মধ্যে যে ক্ষতিকারক পরিস্হিতির সৃষ্টি হয় তাকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস (oxidative stress) বলা হয়। তাই হিম-এর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পরজীবী হিম অণুগুলোকে জোড়া লাগিয়ে বা পলিমারাইজ (polymerize) করে হিমোজোইন (Hemozoin) এ পরিনত করে, যে হিমোজোইন (Hemozoin) তাদের আর কোনও ক্ষতি করতে পারে না।

২) কেন কিছু পরজীবী ক্লোরোকুইনকে পাত্তা দেয় না:

ক্লোরোকুইন একটি দুর্বল ক্ষার যা খাদ্য থলির ভিতরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে। এই ক্লোরোকুইন একবার অ্যাসিডিক খাদ্যথলিতে প্রবেশ করলে তার প্রোটনেশন (protonation) হয়। এর ফলে ক্লোরোকুইন খাদ্য থলিতে  আটকা পরে।  কিন্তু ক্লোরোকুইন প্রতিরোধে সক্ষম পরজীবীদের মধ্যে এমনই পরিবর্তন ঘটেছে  যে খাদ্য থলির ভিতর ক্লোরোকুইন সঠিক পরিমাণে জমতে পারে না। এই পরিবর্তনের কারণ PfCRT (প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপ্যারাম ক্লোরোকুইন রেসিস্ট্যান্ট ট্রান্সপোর্টার) জিন-এ মিউটেশন। কিন্তু ঠিক কিভাবে এই মিউটেশন পরজীবীদের ক্লোরোকুইন প্রতিরোধ সক্ষম করে তুলছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। PfCRT প্রোটিনটি খাদ্য থলির পর্দার ওপরে থাকে আর কোনও এক অজ্ঞাত পদ্ধতিতে ক্লোরোকুইনকে খাদ্য থলির বাইরে বার করে দেয়।

৩) কেন আরটেমিসিনিন অল্পমাত্রায় ব্যবহার করলে অনেকদিন চলার সম্ভাবনা আছে:

সাধারণভাবে পরজীবীদের জিনে পরিবর্তন হওয়ার প্রবণতা বেশ কম। একটা পরিক্ষায় দেখা গেছে যে DHFR নামক জিনে পরিবর্তনের হার হল 10-9 mutations/DHFR gene/replication। পরিবর্তনের হার বেশি হলে যেমন প্রতিরোধী হওয়ার সম্ভবনাও বারে, আবার খারাপ পরিবর্তনের ফলে পরজীবীদের ক্ষতি হওয়ার এবং মারা যাওয়ার সম্ভবনাও আরও বেশি হয়। তাই খুব বেশি পরিবর্তনের হার কখনই কাম্য নয়। পরিবর্তনের হার  কম হওয়া সত্ত্বেও সিলেকশন প্রেসারের ফলে পরিবর্তিত পরজীবী তৈরি হয়। ইনফেকশন-এর পর চিকিৎসার সময় যে পরিমাণ ওষুধের প্রয়োজন হয়, রক্তে থাকা সমস্ত পরজীবীদের মারতে সেই পরিমাণ ওষুধে এই পরিবর্তিত পরজীবীরা বেঁচে যায়। এই পরজীবীগুলির গ্যামেটোসাইট দশায় রুপান্তরিত হলেই আবার মশার মধ্যে প্রবেশ করে এবং এইভাবে পরিবর্তিত প্রতিরোধী পরজীবীরা ছড়িয়ে পরে। নির্বিচারে ওষুধের ব্যবহার, ওষুধের ভুল পরিমাণ বা ডোস, নকল ওষুধের ব্যবহার, ইত্যাদি নানা রকম কারণে এই সিলেকশন প্রেসারের পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে পরজীবীদের প্রতিরোধী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। তাই যথেচ্ছভাবে ওষুধের ব্যবহার না করা এবং ডোস-এর পরিবর্তন না করাই বাঞ্ছনীয় 5

 

লেখার উৎস:

  1. The discovery of artemisinin (qinghaosu) and gifts from Chinese medicine. Nature Medicine 17, 1217–1220 (2011)
  2. WHO Malaria Report 2014
  3. WHO Malaria Report (updated February 2015 ) http://who.int/malaria/media/artemisinin_resistance_qa/en/)
  4. Artemisinin-based combination therapies: a vital tool in efforts to eliminate malaria. Nature Reviews Microbiology 7, 864-874 (December 2009)
  5. Drug-resistant malaria: molecular mechanisms and implications for public health. FEBS Lett. 2011 Jun 6;585(11):1551-62.

 

লেখক পরিচিতি: সুমন্ত দে বর্তমানে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পোস্টডক্টরাল অ্যাসোসিয়েট। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল বায়োলজি থেকে পিএইচডি। গবেষণার বিষয় নতুন জেনেটিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মালারিয়া পরজীবীদের মধ্যে জরুরী জিনের খোঁজ।

‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ : জ্যোতির্বিদ্যার জগতে ভারতের অনন্য ​অবদান

$
0
0
image_print

 dahia‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর হাত ধরে ভারত প্রবেশ করল উচ্চ প্রযুক্তির জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে।
মৈয়াঙ্ক ভাহিয়া, টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ


 

হাকাশে ভারত পাঠালো তার নিজের তৈরী প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ, অ্যাস্ট্রোস্যাট (ASTROSAT)। তারিখ — সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫।

উপগ্রহটি প্রায় পুরোটাই ভারতে পরিকল্পিত ও নির্মিত। সামান্য কিছু জরুরী বিদেশী সাহায্য নেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তির দিক থেকে উপগ্রহটি অত্যন্ত উন্নত মানের এবং আশা করা হচ্ছে, এটি ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণাকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।

অ্যাস্ট্রোস্যাট উপগ্রহটি অধ্যাপক পি.সি.আগরওয়ালের মস্তিষ্কপ্রসূত। তৎকালীন ‘ইসরো’-র (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন, ISRO) চেয়ারম্যান ড: কস্তুরীরঙ্গন ওনাকে প্রচুর উৎসাহ দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে। সে প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। সদ্য একটা ছোট এক্স-রে টেলিস্কোপ বানিয়েছেন অধ্যাপক আগরওয়াল, অন্য একটি কৃত্রিম উপগ্রহের জন্য। এইসময় তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল: উন্নত দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় না নেমে, তারা যেদিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে না, সেইদিকটা দেখা যাক না, কি হয়!

জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণার নানান সমস্যা

জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণাতে কিছু বিশেষ সমস্যা আছে, যে ধরণের সমস্যা নিয়ে আর কোনো বিষয়ের গবেষণায় মাথা ঘামাতে হয়না। এরমধ্যে প্রথম সমস্যা হলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের আচ্ছাদন, যা শুধুমাত্র বিশেষ কিছু তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকেই ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়। তাই, শুধুমাত্র পৃথিবীতে বসে থেকে গবেষণা সম্পূর্ণ করা মুশকিল। অন্য সব বিষয়ের মত যেমন খুশি এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করা যায় না,বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্য একত্র করতে হয়।

শুধু তাই নয়, একটা আলোর সূত্রকে চারিদিকে প্রদক্ষিণ করে সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে যে দেখা হবে, অনেক সময় সেটাও সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা। আবার, মহাকাশের বাসিন্দারা আয়তনে হয় বিপুল, হাজারের পর হাজার মাইল ধরে তাদের ব্যাপ্তি। তার উপর, অবিকল একই মহাজাগতিক বস্তু একটার বেশি পাওয়া মুশকিল। তাই দুটো বস্তু মোটামুটি একরকম পেলে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অন্য সব গবেষণাতে, একই বস্তুর অনেকগুলো অবিকল প্রতিরূপ বা ‘কপি’-র উপর একটা পরীক্ষা করে পরীক্ষার ফলের উপর ভরসা করা যায়। কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণায় অবিকল একই জিনিষ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার।

শেষ সমস্যাটা হলো, বিপুল আয়তনের এই মহাজাগতিক বস্তুগুলি নিজেরাই সর্বত্র সমসত্ত্ব হয়না। আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে যেকোনো বস্তুকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাদের কিছু জায়গার তাপমাত্রা কোটির ঘরে চলে গেছে, আবার কিছু জায়গার তাপমাত্রা কয়েক কেলভিন মাত্র ( -২৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে)। কিছু জায়গা এতই ঘন যে সে ঘনত্ব মাপার উপায় আমাদের কাছে নেই। আবার কিছু জায়গা এতই পাতলা যে একটা মিটার সাইজের পাত্র নিয়ে সেই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে কয়েক লক্ষ বছর ধরে চললে সেই পাত্রে এক গ্রামেরও কম হাইড্রোজেন জমা পড়বে।

মহাজাগতিক বস্তুগুলি থেকে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো নিঃসৃত হয়, রেডিও তরঙ্গ থেকে শুরু করে গামা তরঙ্গ অব্দি।

এই তাপমাত্রা আর ঘনত্বের বিস্তৃতির ফলে মহাজাগতিক বস্তুগুলি থেকে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো নিঃসৃত হয়, রেডিও তরঙ্গ থেকে শুরু করে এক্কেবারে গামা তরঙ্গ অব্দি। রেডিও তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে অনেক বড়, তাই তাকে ধরতে অনেক বড় ব্যাসের অ্যানটেনার প্রয়োজন হয়। অপরদিকে গামা তরঙ্গ এতই ছোট যে তাদের দৈর্ঘ্য একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধের থেকেও কম। এই তরঙ্গরশ্মিগুলো ধরতে বিশেষ কিছু পদার্থের ক্রিস্টাল বা স্ফটিক ব্যবহার করা হয়।

নাসার দাপট

নাসা-র হাবল টেলিস্কোপ, যা দিয়ে দৃশ্যমান এবং আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি সনাক্ত করা যায়। (ছবির উৎস)

বিগত অর্ধশতাব্দীতে, আমেরিকা, রাশিয়া-সহ বহু দেশ মহাকাশে টেলিস্কোপ বসিয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকার নাসা-র (NASA) অবদান সবথেকে বেশি। নাসার টেলিস্কোপগুলি খুবই হাই-রিসোলিউশন, অর্থাৎ সূক্ষ থেকে সূক্ষতর খুঁটিনাটির তফাৎ করতে পারে। দৃশ্যমান আলো, গামা, অবলোহিত (ইনফ্রারেড) কিম্বা এক্স-রে রশ্মি, সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জন্যেই তাদের আলাদা আলাদা টেলিস্কোপ আছে। টেলিস্কোপগুলো খুবই ক্ষমতাশালী এবং খুব সামান্য আলো থেকেই কষে ফেলতে পারে আলোককণার শক্তি।

নাসা এ ব্যাপারে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কয়েক টন ওজনের যন্ত্র মহাকাশে পাঠানো, কি দূর থেকে সেগুলোকে সূক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, এসবে তাদের পারদর্শিতার ধারেকাছেও আসা মুশকিল। আজকের দিনে অন্য কোনো দেশ কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যেই নাসাকে হয়তো টেক্কা দিতে পারবে না।

এরকম একটা কঠিন পরিস্থিতিতে ভারতের মহাকাশবিজ্ঞানীরা মাঠে নামলেন। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন, একদিন জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণায় ভারত স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। ’মঙ্গলযান’ কিম্বা ‘চন্দ্রযান’ এর মতো স্বাভাবিক পদক্ষেপ ছিল সেই দিশায়। কিন্তু এর মানে এটা কোনভাবেই নয় যে কাজগুলো সহজ ছিলো, ‘ইসরো’ খুবই দক্ষতার সাথে এগুলো সম্পন্ন করেছে। তবে, ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ এর গুরুত্ব অপরিসীম, এটা পাঠিয়ে ভারত সারা বিশ্বের জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণায় এক্কেবারে একটা নতুন অধ্যায় খুলে ফেলেছে।

Chandra

মহাবিশ্বের নানান কোণে উত্পত্তি হয় এক্স-রে রশ্মি, যা নাসা-র ‘চন্দ্র’ টেলিস্কোপ দিয়ে ধরা যায়। (ছবির উৎস)

স্পেস মিশন যখন অন্ধ লোকের হাতি বর্ণনার সামিল

আমরা আগেই জেনেছি মহাজাগতিক বস্তুগুলি খুবই জটিল এবং সবরকম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো নির্গত হয় তাদের থেকে। এযাবৎ সমস্ত স্পেস মিশনই কোনো একটা বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শ্রেণীর মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছে এবং মহাকাশের সর্বত্র তাকিয়ে দেখেছে সেই বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর জন্য।  

কিন্তু, জ্যোতির্বিদ্যার সমস্যা এটাই যে একটা বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর মধ্যে সীমিত থাকলে একটা বস্তুকে সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায়না। ব্যাপারটাকে চারটে অন্ধ লোকের হাতি বর্ণনার কাহিনীর মতো বর্ণনা করা যেতে পারে। সেখানে প্রত্যেকজন হাতির যেখানটা স্পর্শ করেছে তার বর্ণনা দিয়েছে, কিন্তু তাই দিয়ে কি একটা হাতির ছবি পাওয়া যায়? সেরকমই কোনো বস্তুর একটা সম্পূর্ণ ছবি পেতে তার থেকে নিঃসৃত সমস্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকেই ধরতে হবে।

Freq

আলোর নানান তরঙ্গদৈর্ঘ্য। ভারতের অ্যাস্ট্রোস্যাট দৃশ্যমান আলো থেকে আলট্রাভায়োলেট এবং এক্স-রে রশ্মি, সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকেই একসাথে ধরতে পারবে। (ছবির উৎস)

এর একটা সমতুল্য ব্যাপার আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও দেখা যায়। ধরুন, এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির কথা। প্রথমে সিকিউরিটির লোকজন আমাদের দিকে চেয়ে দেখবে। তারপর এক্স-রের সাহায্যে দেখবে সঙ্গে কোনো বিপজ্জনক বস্তু লুকিয়ে রেখেছি কিনা। কয়েক জায়গাতে, থার্মাল বা ইনফ্রারেড তরঙ্গেও ছবি তোলা হয়, লুকোনো জিনিস খুঁজতে। এই তিন ধরণের তরঙ্গ — অপটিক্যাল, এক্স-রে এবং ইনফ্রারেড — এই তিনে মিলে তবে বোঝা যায় আপনি কেমন যাত্রী হবেন। জ্যোতির্বিদ্যাতেও একই দশা।

ভারত তৈরী করল এমন একটা বহু-তরঙ্গ শনাক্তকারী কৃত্রিম উপগ্রহ যা দৃশ্যমান আলো থেকে আলট্রাভায়োলেট এবং এক্স-রে রশ্মি, সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকেই একসাথে ধরতে পারবে।

ভারতের কিস্তিমাত

এখানেই অধ্যাপক আগরওয়াল এবং অ্যাস্ট্রোস্যাট দলের অন্যান্য সদস্যদের দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁরা চিন্তা করলেন আরেকটা ছোট হাবল টেলিস্কোপ পাঠিয়ে নতুন কিছু তো করা হচ্ছে না, নাসা সেদিকে অনেকদূর এগিয়ে গেছে, তার চেয়ে অনেক কাজের হবে যদি অনেকগুলো তরঙ্গদৈর্ঘ্য একসাথে ধরা যায়। তাতে হয়তো একটা বস্তু বা মহাকাশের একটা কোণের মধ্যে সীমিত থাকতে হবে, কিন্তু সেই বস্তুর অনেক সম্পূর্ণ একটা ছবি পাওয়া যাবে। একটা বিশেষ শ্রেণীর তরঙ্গের জন্য গোটা মহাকাশ চষে বেড়ানোর দরকার নেই। তার জন্য অনেক ক্ষমতাশালী টেলিস্কোপ মহাকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে।

তৈরী হলো এমন একটা বহু-তরঙ্গ শনাক্তকারী (মাল্টি-ওয়েভলেংথ) কৃত্রিম উপগ্রহ যা দৃশ্যমান আলো থেকে আলট্রাভায়োলেট এবং এক্স-রে রশ্মি, সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকেই একসাথে ধরতে পারবে। এর জন্য আলোর সূত্রটাকে একটু বেশি উজ্জ্বল হতে হবে, কিন্তু তা যদি হয়, তাহলে আমাদের অ্যাস্ট্রোস্যাট তার একটা সম্পূর্ণ ছবি দিয়ে দিতে পারবে। সেই আলোকতরঙ্গের খবর থেকে পৃথিবীতে বসা বিজ্ঞানীরা আলোর সূত্রটার নানা খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করতে পারবেন।

অ্যাস্ট্রোস্যাট-এর বিভিন্ন ডিটেক্টর। (ছবি- ইসরো)

অ্যাস্ট্রোস্যাট-এর বিভিন্ন ডিটেক্টর। (ছবি- ইসরো)

আইডিয়াটা সহজ অথচ এত সুন্দর যে বিশ্বজুড়ে সবাই নড়েচড়ে বসেছে। বিশেষ করে এমন একটা সময়ে এটা এসেছে, যখন নাসা ভবিষ্যৎ মিশনের ব্যাপারে সংযম আনার চেষ্টা করছে। তিন দশক ধরে যন্ত্রপাতি নিয়ে গবেষণার পেছনে অর্থব্যয় করে নাসার বাজেটে একটু টান পড়েছে এবং যথেচ্ছ মিশন প্ল্যান করার স্বাধীনতা কমে গেছে। এইরকম সময়ে, আশা করা যায় অ্যাস্ট্রোস্যাটের এই সহজ পদ্ধতিটা অনেকেরই মনে ধরবে। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উপর মনঃসংযোগ না করে মহাকাশে অবস্থিত বস্তুর উপর মনঃসংযোগ করা — এই নতুন ধরণের চিন্তা হয়তো পাল্টে দেবে, ভবিষ্যতে কিভাবে স্পেস মিশনের পরিকল্পনা নেওয়া হবে।

এই অভাবনীয় প্রজেক্ট নেওয়ার জন্য অধ্যাপক আগরওয়াল এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের একটা কুর্ণিশ অবশ্যই প্রাপ্য। যেসব বিজ্ঞানীরা অ্যাস্ট্রোস্যাটের জন্য যন্ত্রপাতি বানিয়েছেন, তারা নিম্নোক্ত গবেষণাগারগুলির সাথে যুক্ত:  টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (মুম্বাই), ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (পুনে) এবং রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বেঙ্গালুরু)। এছাড়া দুটো যন্ত্রের ডিটেক্টর এসেছিল কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সী এবং ইউনিভার্সিটি অফ লেস্টার (Leicester) থেকে।

উপগ্রহের উপর যন্ত্রপাতিগুলো এবার আস্তে আস্তে চালু করা হবে। এর ফলে আশা করা যায়, আমরা চারিপাশের মহাকাশকে একটা নতুন চোখে দেখতে পাব।

TIFR-এর ডিরেক্টরের অফিসে রয়েছে অ্যাস্ট্রোস্যাট-এর এই  রেপ্লিকাটি। ইসরো-র উপহার।

TIFR-এর ডিরেক্টরের অফিসে রয়েছে ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’-এর এই রেপ্লিকাটি। ‘ইসরো’-র উপহার।

 

(প্রচ্ছদের ছবি: ISRO, উৎস)

লেখার উৎস: লেখাটি DNA সংবাদ-পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। ইংরাজী থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশ করার অনুমতি দেওয়ার জন্য DNA এবং প্রফেসর ভাহিয়া-র কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

 

উৎসাহী পাঠকের জন্যঃ 

অ্যাস্ট্রোস্যাট সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে ইসরো-র ওয়েবসাইট দেখুন।

image_print

জীবাণুদের যত কথা –৭

$
0
0
image_print

pic

যে সুপার-বাগ অ্যান্টিবায়োটিকে কাবু হয় না, তার মারণ অস্ত্র বিজ্ঞানীরা পেল আরেক ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে!
দেবনাথ ঘোষাল, ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি


(পূর্ব প্রকাশিতের পর … )

অ্যান্টিবায়োটিকসের খুঁটিনাটি: সুপার-বাগ প্রতিরোধের উপায়

র আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম কিভাবে কিছু বিশেষ ব্যাকটেরিয়া বিটা-ল্যাকটামেস (β-lactamase) নামে এক শ্রেণীর উৎসেচক তৈরী করে আমাদের প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এই ব্যাকটেরিয়াদের তাই অ্যান্টিবায়োটিকস প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া (Antibiotic-Resistant Bacteria) বা সুপার-বাগ (Super-Bug) বলা হয়। সুপার-বাগ-রা হাইড্রোলাইসিস বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকস-এর কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। ফলে প্রচলিত বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকস (পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকস) দিয়ে আর ওই সব ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ নিরাময় সম্ভব হয় না।

সম্প্রতি, আমেরিকার স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ দপ্তর (Centers for Disease Control and Prevention) থেকে প্রকাশিত তথ্য মারফত জানা গিয়েছে যে, স্ট্রেপটোকক্কাস (Streptococcus pneumoniae), মাইকোব্যাকটেরিয়াম (Mycobacterium tuberculosis),স্টাফাইলোকক্কাস (Staphylococcus aureus), এন্টারোকক্কাস (Enterococcus), ক্লসট্রিডিয়াম (Clostridium botulinum), লিস্টেরিয়া (Listeria monocytogenes) ইত্যাদি একদল মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া এখন সুপার-বাগ এর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

এখন প্রশ্ন হল এই সব সুপার-বাগদের থেকে মুক্তির উপায় কি?

বিটা-ল্যাকটামেস-এর সন্ধান পাবার পর থেকেই বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করে দিয়েছিলেন কিভাবে এই অ্যান্টিবায়োটিকস ধ্বংসকারী উৎসেচকটিকে রুখে দেওয়া যায় তার উপায় বের করতে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্ট্রেপটোমাইসেস ক্লাভুলিজেরাস (Streptomyces clavuligerus) নামে এক ব্যাকটেরিয়ার থেকেই মিললো সুপার-বাগ সমস্যার সমাধান সূত্র।

bacteria

স্ট্রেপটোমাইসেস ক্লাভুলিজেরাস ব্যাকটেরিয়া, যার থেকে মিললো সুপার-বাগ সমস্যার সমাধান সূত্র। (ছবির উৎস)

এই Gram-positive (Gram রঞ্জক পদার্থে সহজেই রঞ্জিত হয়) ব্যাকটেরিয়া তাদের বিপাক প্রক্রিয়ার  বিভিন্ন ধাপে এমন কিছু রাসায়নিক যৌগ তৈরী করে যেগুলির সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকসের গঠনগত মিল রয়েছে। স্ট্রেপটোমাইসেস ক্লাভুলিজেরাস থেকে বিজ্ঞানীরা এই রকম প্রায় ২০ টি যৌগের সন্ধান পেয়েছেন, ক্লাভুলানিক অ্যাসিড (Clavulanic acid) তাদের মধ্যে অন্যতম। বিজ্ঞানীদের নানাবিধ গবেষণার ফলে দেখা গেল এই ক্লাভুলানিক অ্যাসিড-এর উপস্থিতিতে বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচকটি আর কাজ করে না। তাই বিটা-ল্যাকটাম বা পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকসের সঙ্গে ক্লাভুলানিক অ্যাসিড মিশিয়ে দিলে সুপার-বাগদের মেরে ফেলা সম্ভব।  

অনেক সময় ডাক্তারবাবুদের দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিকসে কাজ না হলে তাঁরা আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম বা second generation অ্যান্টিবায়োটিকস দিয়ে থাকেন। কখনো একটু খেয়াল করে দেখো প্রথমে হয়ত তিনি আমাদের Amoxicillin দিয়েছিলেন। ধরা যাক এতে ভালো কাজ হলো না, পরের বার  প্রেস্ক্রিপশন-এ তিনি co-amoxiclav  বা Augmentin দিয়ে থাকেন। Co-amoxiclav বা Augmentin হলো এই দ্বিতীয় প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিকস, যাতে বিটা-ল্যাকটাম বা পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকসের সঙ্গে ক্লাভুলানিক অ্যাসিড মেশানো থাকে। আর তাতেই মোক্ষম কাজ হয় সুপার-বাগদের বিরুদ্ধে

স্ট্রেপটোমাইসেস ক্লাভুলিজেরাস নামে এক ব্যাকটেরিয়ার থেকেই মিললো সুপার-বাগ সমস্যার সমাধান সূত্র।

কি করে কাজ করে এই ক্লাভুলানিক অ্যাসিড?

ক্লাভুলানিক অ্যাসিড দেখতে অনেকটা পেনিসিলিনের মতই। তবে, এতে বিটা-ল্যাকটাম রিং থাকলেও পেনিসিলিন-বাইন্ডিং-প্রোটিনের সঙ্গে সরাসরি বিক্রিয়া করে না। তাই ক্লাভুলানিক অ্যাসিড অ্যান্টিবায়োটিকস নয়।  

মজার ব্যাপার হলো, ব্যাকটেরিয়ার বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচকটি কিন্তু এই গঠনগত মিল থাকার জন্যে পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকসের সঙ্গে ক্লাভুলানিক অ্যাসিডের পার্থক্য করতে পারে না (মনে পড়ে মলিকিউলার মিমিক্রি?)। আর তাই যখন পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকসের সঙ্গে ক্লাভুলানিক অ্যাসিড মিশিয়ে দেওয়া হয় তখন ব্যাকটেরিয়ার বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচক, বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকস ও ক্লাভুলানিক অ্যাসিড দুইটি যৌগের সঙ্গেই রাসায়নিক বিক্রিয়া করে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে ক্লাভুলানিক অ্যাসিডের সঙ্গে বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচকের বিক্রিয়া করার প্রবণতা অনেক বেশি। এর কারণ ক্লাভুলানিক অ্যাসিড ও বিটা-ল্যাকটামেস সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রাসায়নিক ভাবে খুবই স্থিতিশীল একটি যৌগ তৈরী করে। ফলে বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচকটি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে

pic1

Augmentin হলো দ্বিতীয় প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিকস, যাতে বিটা-ল্যাকটাম বা পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকসের সঙ্গে ক্লাভুলানিক অ্যাসিড মেশানো থাকে। (ছবি সৌজন্যে: Wikipedia)

যখন কোনো রাসায়নিক অণু কোনো উৎসেচকের সঙ্গে বিক্রিয়া করে উৎসেচকটির কার্যকারিতা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দেয় তখন সেই সব রাসায়নিক অণুকে “সুইসাইড ইনহিবিটর” (suicide inhibitor) বলা হয় আর এইরকম রাসায়নিক বিক্রিয়াকে “সুইসাইড ইনএকটিভেশন” (suicide inactivation) বলা হয়। ক্লাভুলানিক অ্যাসিডের উপস্থিতিতে তাই বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকস আবার আগের মতই কার্যকরী হয়ে ওঠে।

একটা প্রশ্ন মনে আসতেই পারে, স্ট্রেপটোমাইসেস ক্লাভুলিজেরাস তো একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া, তাহলে অ্যান্টিবায়োটিকস এর গঠনের সঙ্গে মিল আছে এমন সব রাসায়নিক যৌগ ( যেমন ক্লাভুলানিক অ্যাসিড) ওদের কোষে কি করে পাওয়া সম্ভব?

ব্যাকটেরিয়ারা এই পৃথিবীতে এসেছে প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে। ইউক্যারিওটদের আবির্ভাব হয়েছে তার অনেক অনেক পরে। তাই বিবর্তনের  ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, বেঁচে থাকার জন্যে ব্যাকটেরিয়াদের নিজেদের মধ্যেই লড়াই শুরু হয়েছিল সবার প্রথমে। আর এই কারণেই অনেক ব্যাকটেরিয়া এমন কিছু রাসায়নিক যৌগ তৈরী করে যেগুলো অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলে। পরবর্তী কালে ছত্রাক, প্রোটোজোয়া ও অন্যান্য ইউক্যারিওটদের আবির্ভাব হয়েছে এবং এদের মধ্যেও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী নানারকম রাসায়নিক যৌগের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এইরকমই এক ছত্রাক পেনিসিলিয়াম (Penicillium) থেকে স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেক্জান্ডার ফ্লেমিং (Alexander Fleming) ১৯২৯ সালে প্রথম পেনিসিলিন আন্টিবায়োটিকের সন্ধান পেয়েছিলেন।

pic2

সত্যি কথা বলতে কি, বিজ্ঞানীরা এখন উপলব্ধি করছেন ব্যাকটেরিয়াদের মোকাবিলা করার জন্যে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ও প্রোটোজোয়াদের থেকে নানাবিধ ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী রাসায়নিক যৌগ গুলিকে খুঁজে বার করা। সম্প্রতি বিজ্ঞানের নেচার পত্রিকায় এই বিষয়ে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে যেখানে মাটির সাথে মিশে থাকা বিভিন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য এককোষী বা বহুকোষীদের দেহ থেকে বিজ্ঞানীরা এমন সব রাসায়নিক যৌগ খুঁজে পেয়েছেন (যেমন: Teixobactin) যাদের ব্যবহার করে অদূর ভবিষ্যতে আমরা হয়ত ব্যাকটেরিয়াদের বিরুদ্ধে আরো কঠিন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব।

এখনও পর্যন্ত আমরা প্রধানত বিটা-ল্যাকটাম শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিকস ও তাদের কার্যকারিতা নিয়েই আলোচনা করেছি। বলে রাখা ভালো এই শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিকসগুলি কিন্তু Gram-positive ব্যাকটেরিয়াদের বিরুদ্ধেই সফল ভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। কারণ Gram-negative ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীরের বাইরে বাহ্যিক কোষ-পর্দার একটি আস্তরণ থাকে। বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকসের পক্ষে এই আস্তরণ ভেদ করে পেনিসিলিন বাইন্ডিং প্রোটিনদের (PBPs) সঙ্গে বিক্রিয়া করার সম্ভবনা খুব-ই কম। এছাড়া, Gram-positive ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীরের আস্তরণ অনেক দৃঢ় এবং পুরু তাই কোষের সুরক্ষার জন্যে এর ভূমিকা অপরিসীম। Gram-negative ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীর সে তুলনায় অনেক শিথিল এবং তাদের সুরক্ষার জন্যে  কোষ-প্রাচীরের বাইরে এই বাহ্যিক কোষ-পর্দা থাকে। তাই বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকসগুলি Gram-positive ব্যাকটেরিয়ার জন্য অনেক বেশি কার্যকরী। তাহলে অ্যাসিনেটোব্যাকটর (Acinetobacter), সিউডোমোনাস (Pseudomonas aeruginosa), ক্লেবসিয়েলা (Klebsiella pneumoniae), নিসেরিয়া (Neisseria gonorrhoeae) এই সব মারাত্মক Gram-negative ব্যাকটেরিয়াদের থেকে রক্ষা পাবার উপায় কি? ওদের বিরুদ্ধে আমরা কি কি অ্যান্টিবায়োটিকস ব্যবহার করি? Gram-negative ব্যাকটেরিয়া-ও কি সুপার-বাগ হয়?

এই বিষয়ে আরো জানার জন্যে পরের পর্বে নজর রাখো।

-চলবে

লেখার উৎস:

[১] http://www.nature.com/nature/journal/v517/n7535/full/nature14098.html

 

লেখক পরিচিতি: দেবনাথ ঘোষাল বর্তমানে ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পোস্টডক্টরাল ফেলো। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি। গবেষণার বিষয় ব্যাকটেরিয়ার আণুবীক্ষণিক গঠন ও সংক্রমণ প্রক্রিয়া।

image_print
Viewing all 305 articles
Browse latest View live


<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>