Quantcast
Channel: বিজ্ঞান – Bigyan
Viewing all 308 articles
Browse latest View live

প্রাণের নকশা (পর্ব ৪- কিভাবে কোষেরা নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালায়)

$
0
0

নিচের পোস্ট-টা মলিকুলার জেনেটিক্স গবেষক বেনি শিলো-র লেখা ‘Life’s Blueprint’ বইটার চতুর্থ অধ্যায়ের অনুবাদ। বইটা সম্বন্ধে আরো জানতে ভূমিকাটি দেখুন।


আগের অধ্যায়ে আমরা স্পিমান আর মানগোল্ড-এর ১৯২৪-এর পরীক্ষাটার তাৎপর্যের কথা বলেছিলাম। এই অব্দি বুঝেছিলাম যে কোষের ভাগ্য আগাগোড়া পূর্বনির্ধারিত নয়। “বড় হয়ে কি হবে”, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কোষেরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে এবং প্রভাবিত হয়। অন্যভাবে বললে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ভুলে একটা কোষ একটা পূর্বলিখিত ভাগ্যের দিকে ধেয়ে চলে না। বরং সেই পরিবেশের কাছ থেকে পাওয়া নির্দেশের ওপরই সে ভরসা করে থাকে। এই ব্যাপারটা বুঝতে আমরা আমাদের পুরোনো সমাজের সাথে আধুনিক সমাজের তুলনা করতে পারি। এককালে সমাজে শ্রেণীবিভাগ ছিল। কে কোন পথে যাবে, তার পেশা কি হবে, সব জন্ম থেকে ঠিক করে দেওয়া হতো। আজকের সমাজে আমাদের যোগ্যতা এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে আদানপ্রদানই বেশিরভাগ সময় ঠিক করে দেয় একজন ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছতে পারবে।

এই ধারণাটা ভ্রূণবৃদ্ধির রহস্যোদ্ধারে আমাদের যে কতটা এগিয়ে দিয়েছিল, সেটা বলে বোঝানো মুশকিল। ভ্রূণবৃদ্ধি বুঝতে এখন প্রয়োজন হয়ে উঠলো সেইসব নির্দেশগুলোর হদিশ পাওয়া, যেগুলো কোষেরা অনবরত একে অপরকে পাঠিয়ে চলেছে। কোষেদের এই ভাষা বুঝতে পারা জরুরি হয়ে পড়লো কারণ ডিএনএ-র তথ্য শুধুমাত্র কোষেদের এই আদানপ্রদানগুলোকে কিছু নিয়মকানুনে বেঁধে দিয়ে ভ্রূণর শেষের অবস্থাটাকে নির্ণয় করে। এর বাইরের আর কোনো খুঁটিনাটিতে সে হস্তক্ষেপ করে না।

যদি প্রত্যেকটা কোষের একেবারে পূর্বলিখিত নিয়তি থাকতো, তাহলে একটা কোষ হারালেই শেষের নকশাটা ভয়ানকভাবে ঘেঁটে যেত। অপরদিকে, যদি কোষেদের অনেকগুলো পথে যাওয়ার সুযোগ থাকে, একটা কোষ হারালে অন্যেরা তার জায়গা নিতে পারে।

এই যে কোষেদের ছেড়ে দেওয়া হয় নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে, এতে কিন্তু লাভই হয়। ক্রমবৃদ্ধির জটিল পদ্ধতিটা খুচরো ভুলচুকের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকে। যদি প্রত্যেকটা কোষের একেবারে পূর্বলিখিত নিয়তি থাকতো, তাহলে একটা কোষ হারালেই শেষের নকশাটা ভয়ানকভাবে ঘেঁটে যেত। অপরদিকে, যদি কোষেদের অনেকগুলো পথে যাওয়ার সুযোগ থাকে, একটা কোষ হারালে অন্যেরা তার জায়গা নিতে পারে। সেই যে বলে, এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে চলে গেলে অন্য কেউ তার জায়গায় আসতে পারবে না, এটা খানিকটা সেইরকম।

স্পিমান আর মানগোল্ড-এর পরীক্ষাগুলো যতই নাটকীয় হয়ে থাকুক না কেন (গোসাপ-এর ধড়ে দুটো মাথা গজানোর থেকে নাটকীয় কিছু হতে পারে কি?), তার থেকে পাওয়া সিদ্ধান্তগুলো ঝুলে রইলো পাঁচ দশক ধরে। এই বিরতির কারণ হলো, কোষেদের যোগাযোগব্যবস্থা ও একে অপরকে নির্দেশ দেওয়ার ব্যাপারটা জানা থাকলেও, কারা সেই আদানপ্রদান চালায়, সেটা জানা ছিল না। অর্থাৎ, আণবিক স্তরে এই যোগাযোগব্যবস্থার উপাদানগুলোকে জৈবরাসায়নিকভাবে আলাদা করা যাচ্ছিলো না। আসলে, এই উপাদানগুলো যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, তারা কিন্তু থাকতে পারে খুব স্বল্প পরিমাণে। যেভাবে তাদের সনাক্ত করা যায়, সেই পদ্ধতিগুলো  (biological assay) মোটেই সহজ নয়। অন্যভাবে বললে, তারা কিরকম হতে পারে, সে ব্যাপারে আর কোনো ধারণা না থাকলে, কোষের গুচ্ছের উপাদানের মিশ্রণে কোষীয় যোগাযোগব্যবস্থার কান্ডারীদের খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এটাকে তুলনায় করা যায় একটা সেলফোনকে গুঁড়ো গুঁড়ো করার সাথে। আগে থেকে কিছু না জানা থাকলে শেষের ঘ্যাঁট-টার মধ্যে কোনটা ফোনের মাস্টার চিপ ছিল, সেটা বলতে পারবে কি?

বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত জিনগত পদ্ধতিতে বার করলেন কোন পথে (pathway) কোষেরা নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালায়। একটা জীবের জিনগত গঠনকে বলে জেনোটাইপ (genotype) আর সেটা নির্ণয় করে জীবের শেষের চেহারাটা কেমন হবে, যাকে বলে ফেনোটাইপ (phenotype)।

বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত জিনগত পদ্ধতিতে বার করলেন কোন পথে (pathway) কোষেরা নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালায়। একটা জীবের জিনগত গঠনকে বলে জেনোটাইপ (genotype) আর সেটা নির্ণয় করে জীবের শেষের চেহারাটা কেমন হবে, যাকে বলে ফেনোটাইপ (phenotype)। জিনগত বিশ্লেষণ করতে গেলে জিন-এ পরিবর্তন (mutation) আনতে পারা চাই এবং তারপর সেই পরিবর্তন কিভাবে প্রকাশ পায়, সেইটে ঠাওর করতে পারা চাই। যেহেতু জিন-এর ক্রমবিন্যাস নির্ণয় করে শেষের প্রোটিন কিরকম হবে, এই ক্রমবিন্যাসে সামান্য রদবদল হলে সেটা প্রোটিন-এ ধরা পড়বে। পরিবর্তনটা কোথায় হচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে শেষের প্রোটিনে উনিশ বিশ তফাৎ হতে পারে (একটা গোটা বাক্যে একটা অক্ষর পাল্টালে যেরকম হয়), আবার গোটা প্রোটিন-টার কাজে গোলযোগ বাধতে পারে। যদি একটা মোক্ষম প্রোটিন-এ হাত পড়ে, জীবের চেহারায় কি কার্যক্ষমতায় একটা পরিবর্তন আসার প্রবল সম্ভাবনা থাকে (অন্যভাবে বললে, একটা নতুন ফেনোটাইপ-এর সৃষ্টি হয়)। এর দারুণ উদাহরণ হলো ১৯১০ সালে  টমাস এইচ. মরগ্যান-এর প্রথম জিনগত পরিবর্তনের (mutation) আবিষ্কার যেখানে ফলের মাছি, Drosophila-তে, একটিমাত্র জিন পাল্টাতে চোখের রং লাল থেকে সাদা হয়ে গেছিলো। এই জিনগত পরিবর্তনটা, যাকে শেষের ফেনোটাইপ-এর নামে “সাদা” (white) বলে ডাকা হয়, এটাকে  আলাদা করাই জৈবিক প্রক্রিয়ার জিনগত ভিত্তি সন্ধানের একটা উদাহরণ। বিপুল সংখ্যক মাছির কিছুর মধ্যে এই পরিবর্তনটার আবির্ভাব হঠাৎ করেই হয়েছিল। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে এই পরিবর্তিত জিন-এর উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল, স্রেফ ওই সাদা চোখের রং-এর কারণে। আজ পর্যন্ত শয়ে শয়ে গবেষকদল এই বিশেষ পরিবর্তনটাকে তাদের গবেষণায় ব্যবহার করেছেন। তাহলে দাঁড়ালো এইরকম: যে জিন-টার পরিবর্তনের ফলে ওই ফেনোটাইপটা দেখা গেল, সেটার নিশ্চই গুরুতর ভূমিকা আছে চোখের রং তৈরীর পিছনে। কারণ ওই জিনটা না থাকলে চোখে কোনো রং দেখা যায় না। পরে ওই “সাদা” জিন-টার উপর আরো কাটাছেঁড়া করে দেখা গেছিলো যে আণবিক স্তরে সত্যিই সেখানে রং সৃষ্টি এবং বহনের ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যভাবে বললে, একটা জিন-এর অনুপস্থিতিতে যে ফেনোটাইপ-এর জন্ম হয়, সেটাই জিন-টাকে একটা প্রক্রিয়ার আড়ালে নাটের গুরু হিসেবে চিনিয়ে দেয় (নিচের ছবিটা দেখো)।

জিনগত পরিবর্তন থেকেই জিন-এর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জানা যায়।
একটা জিন-কে সরিয়ে দিলে দেহে যে খুঁত তৈরী হয়, তার থেকেই বোঝা যায় জিন-টার কি ভূমিকা ছিল। যেরকম ভিজে সিমেন্ট-এর ওপর একটা পাতা এসে পড়লে, সেটা পরে সরিয়ে নিলে তার অনুপস্থিতিটা পাকাপাকিভাবে ধরাশায়ী হয়ে থাকে (B. Shilo, Hampi, India)।

এটা অনেকটা সেই ছোটবেলার খেলাটার মতো যেখানে কোনো একজন একটা বিশেষ অঙ্গভঙ্গি করে আর ঘরের মধ্যে বাকিরা তাকে অনুকরণ করে। সেই ঘরে ঢুকলে তোমার বোঝার উপায় নেই কাকে অনুকরণ করা হচ্ছে। তুমি হয়তো আন্দাজে একজনকে ঘর থেকে বার করে দিলে। বাকিরা যদি তাদের কীর্তি চালিয়ে যায়, তাহলে বোঝা যাবে যে নাটের গুরু এখনো ঘরেই আছে। তুমি তখন আরেকজনকে বার করলে। এইভাবে করতে করতে যখন আসল লোকটাকে ঘরছাড়া করবে, ডামাডোল থামবে এবং অমনি তুমি বুঝে যাবে তার ভূমিকা কি ছিল।

শুরু থেকেই পরিবর্তনগুলো জিন ধরে করা হয়না। প্রথমে ঠিক করা হয়, অমুক ফেনোটাইপ-এর ওপর মনঃসংযোগ করা হবে। এরপর জিন সরিয়ে নেওয়া হয় বা তাতে খুঁত সৃষ্টি করা হয় যতক্ষণ না সেই ফেনোটাইপ-টা দেখা যাচ্ছে। যেই সেটা দেখা যায়, স্পষ্ট হয়ে যায় একটা প্রক্রিয়ার পেছনে জিনগত সার্কিট-টা কিরকম ছিল।

কিন্তু আগে থেকে যদি নাই জানি যে কোন জিন আর প্রোটিনগুলো একটা জৈবিক প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী, তাহলে সেই জিন-এ পরিবর্তন আনবো কি করে? এর উত্তর হলো, শুরু থেকেই পরিবর্তনগুলো জিন ধরে করা হয়না। প্রথমে ঠিক করা হয়, অমুক ফেনোটাইপ-এর ওপর মনঃসংযোগ করা হবে। এরপর জিন সরিয়ে নেওয়া হয় বা তাতে খুঁত সৃষ্টি করা হয় যতক্ষণ না সেই ফেনোটাইপ-টা দেখা যাচ্ছে। যেই সেটা দেখা যায়, স্পষ্ট হয়ে যায় একটা প্রক্রিয়ার পেছনে জিনগত সার্কিট-টা কিরকম ছিল। তাই, ফলের মাছির চোখের রং না তার ডানার গড়ন, আগে ফেনোটাইপ-টা ঠিক করলে আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায় কোন জিনগুলো নিয়ে আরো গভীরে গবেষণা করা  হবে। একেকটা করে জিন-কে নিষ্ক্রিয় করে জীবের কোনো নির্দিষ্ট  কলা (tissue) বা দশায় (stage) লক্ষ্য রাখা হয়। দেখা হয় সেখানে কোনো ফেনোটাইপ-এর পরিবর্তন  হচ্ছে কিনা। এলোমেলো ভাবে জিনের মধ্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে, ফেনোটাইপ দেখে দেখে জিন ছেঁকে নেওয়াকে বলে জেনেটিক স্ক্রিন, বাংলা করা যেতে পারে  “জিনগত ছাঁকনি” (genetic screen)।

কিভাবে এই জেনেটিক স্ক্রিন  করা হয়? একটা জীবের জিনোম বা জিনগত উপাদানে আয়নিকরণক্ষম (ioninizing) তেজস্ক্রিয় রশ্মি কিংবা রাসায়নিক পদ্ধতির সাহায্যে কিছু এলোপাথাড়ি পরিবর্তনের সৃষ্টি করা হয়। ডিএনএ প্রতিলিপিকরণে যেভাবে হুবহু প্রতিলিপি তৈরী হওয়ার কথা, সেইটা আর হয়না, একটু রকমফের দেখা যায়। জিনোম-এর এই “কলঙ্ক” চালান হয় শুক্রাণু আর ডিম্বাণুতে থাকা ডিএনএ-র মধ্যেও। যেহেতু এই শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর থেকে সন্তানের জন্ম শুরু, পরিবর্তিত জীবগুলোর সন্তানদের মধ্যে প্রত্যেকটা কোষের ডিএনএ-তেই ওই পরিবর্তনটাকে দেখা যায়। এইভাবে একটা পরিবর্তনকে পাকাপাকিভাবে ধরে রাখা যায় কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম পরিবর্তনটা এবার নিশ্চিতভাবে চালান হতে থাকবে।

মনে করে দেখো, বহুকোষী জীবের জিনোম-এ কিন্তু একেকটা ক্রোমোসোম-এর দুটো কপি আছে, একটা আসে শুক্রাণুর থেকে আর অন্যটা আসে ডিম্বাণুর থেকে। অতএব, যদি একটা অতীব প্রয়োজনীয় জিন-এর পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে বিকল করেও দেওয়া হয়, জোড়ার অন্য জিন-টা কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সজাগ থাকে এবং সেই জিনগত কাজের  “শূন্যস্থান” পরিপূরণ করে। অন্যভাবে বললে, একটা কোষ কিংবা জীব নিজের জিন-এ ক্ষতিকারক পরিবর্তন নিয়েও বহালতবিয়তে থাকতে পারে।

যথেষ্ট সংখ্যক পরস্পর-স্বাধীন পরিবর্তন সৃষ্টি করে তার ফলাফল খতিয়ে দেখার পর বলা যেতে পারে যে একটা জেনেটিক স্ক্রিন-এ একটা প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী বেশিরভাগ জিন-কেই চিহ্নিত করা গেছে।  স্ক্রিন-টাকে তখন সম্পূর্ণ বা স্যাচুরেটেড (saturated) বলা হয়। আগের উদাহরণটাই ধরা যাক যেখানে ঘরের মধ্যে কে ডামাডোল শুরু করেছিল, তাকে চিহ্নিত করতে হবে। যদি ঘরে বিশজন থাকে আর তুমি এক দুজনকে বার করে দাও, তোমার নাটের গুরুকে ধরতে পারার সম্ভাবনা কম। কিন্তু যদি বিশজনকেই বার করে দাও এক এক করে, তাহলে তাকে একটা না একটা সময় ধরতে পারবেই। তখন তোমার স্ক্রিন-টা সম্পূর্ণ কারণ যতগুলো সম্ভাবনা ছিল, সব তোমার পরীক্ষা করে  দেখা হয়ে গেছে।

এই ধরণের জেনেটিক স্ক্রিন-এ কি বেরোবে সেব্যাপারে গবেষকের কিন্তু আগে থেকে কোনো ধারণাই থাকে না। বিশেষ করে যখন কোনো একটা জটিল প্রক্রিয়ার উপর গবেষণা হচ্ছে, তখন একদম খোলা মনে কাজ শুরু করতে হয়। এই প্রক্রিয়াগুলো এতটাই জটিল যে বাস্তবে কি ঘটছে, সেই ধারণা আগে থেকে তৈরী করা প্রায় অসম্ভব। তাই যারা  এই কাজটা করছেন, তাদের মধ্যে কোনো বিশেষ প্রক্রিয়ার প্রতি পক্ষপাত থাকলে চলবে না। স্ক্রিন-এ যেসব পরিবর্তনকে চিহ্নিত করা যায়, সেগুলোই খোলসা করে দেয় একটা প্রক্রিয়া কিভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।

সত্তরের দশকের শেষের দিকে, ক্রিস্টিয়ানা নিউসলেন-ভোলহার্ড আর এরিক উইসআস এরকমই একটা জেনেটিক স্ক্রিন করেছিলেন ফলের মাছির উপর। আঠারো হাজার জাতের(strain) মাছির সৃষ্টি করলেন তারা, প্রত্যেকটার জিনোম-এ এক বা একাধিক পরিবর্তন রয়েছে। আজ আমরা জানি যে এই প্রজাতির মাছিতে তেরো হাজার মতো জিন রয়েছে। তাই ওনারা যে সংগ্রহটা বানিয়েছিলেন, তাতে খুব সম্ভবত বেশিরভাগ জিন-এই হাত দেওয়া গেছিলো। এই নিয়ে ওরা জেনেটিক স্ক্রিন করলেন। ওনাদের লক্ষ্য ছিল আকাশছোঁয়া, একেবারে ভ্রূণর নকশা তৈরীর পিছনে থাকা জিন-গুলোকে চিহ্নিত করা। হ্যাঁ, ফলের মাছি একটা সরলতর মডেল অর্গানিজম (model organism), তাদের ভ্রূণের বিকাশ সম্পূর্ণ হতে লাগে মাত্র চব্বিশ ঘন্টা। কিন্তু সম্পূর্ণ হওয়ার পর সেই ভ্রূণর মধ্যে পঞ্চাশ হাজার কোষ থাকে, বিশেষীকৃত কলার সবটাই তাতে ধরা পড়ে, তাই প্রক্রিয়াটা মোটেই হ্যালাফেলা করার মতো নয়। এই যুগান্তকারী কাজের জন্য ১৯৯৫ সালে তাঁদের  নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়।

বিজ্ঞানীদের জিন-এর সংগ্রহে প্রত্যেকটা স্ট্রেন-এ একটা জিন ছিল স্বাভাবিক আর তার জুড়িদার-টা  পরিবর্তিত (যে কোনো একটা জিন-এ পরিবর্তন-টা হতে পারে)। কিন্তু যখন একই ধারার স্ত্রী-পুরুষের মিলনে সন্তান তৈরী হয়, কিছু সন্তানের দু-কপি জিন-ই ডিফেক্টিভ বা পরিবর্তিত হতে পারে। জিন-টা যদি একটা জরুরি জিন হয়, তাহলে এরকম ক্ষেত্রে পরবর্তী জীবিত প্রজন্ম তৈরীই হবে না। একটা জিন জরুরি হতে পারে কারণ সে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াতে মধ্যস্থতা করে, যেমন বিপাক বা মেটাবলিজম (metabolism) কিংবা কোষের ভিতর গঠনমূলক কার্যে। কিন্তু গবেষকদের জেনেটিক স্ক্রিন-এর মূল লক্ষ্যবস্তু সেইসব জিন ছিল না। তারা খুঁজছিলেন সেইসব জিন যা ভ্রূণর নকশাকে প্রভাবিত করে।

কিরকম নকশা? ফলের মাছির স্বাভাবিক ভ্রূণবিকাশের সময়, ভ্রূণর বাইরের খোসার কোষগুলো  এমনভাবে সাজানো থাকে যে ভ্রূণর ভিতর আলাদা আলাদা ভাগ বা খুপরি তৈরী হয়ে যায়। একেকটা ভাগ কোথায় অবস্থিত, মাথার না ল্যাজের দিকে, পেটের না পিঠের দিকে, সেই অনুযায়ী তারা একেকটা আকৃতি ধারণ করে। খোসার  কোষগুলো থেকে নিঃসৃত হয় একটা শক্ত সুরক্ষাপ্রদানকারী স্তর, যাকে কিউটিকল (cuticle) বলা হয়। এটাকে ভ্রূণের বাইরের দিকের  কাঠামো হিসেবে ভাবতে পারো। এই স্তরটার প্রধান রসদ হলো একটা জড় পদার্থ, কাইটিন (chitin), এর ফলে স্তরটা মজবুত আর টেকসই হয়। এই স্তরটার গঠন কিরকম হবে, সেটা নির্ভর করে ভিতরের খোসার কোষগুলোর উপর। এই কিউটিকল নামক “খোলস”-ই শেষপর্যন্ত ভ্রূণ বিকাশের ধাঁধাটার একটা সমাধান খুঁজে পেতে সাহায্য করলো (নিচের ছবি দেখ)। ভ্রূণ মরে যাওয়া কিংবা মিলিয়ে যাওয়ার পরও তাদের বাইরের খোলস-টা কিন্তু দিব্যি মজবুত আর টেকসই থাকে। তাই গবেষকরা সেই খোলসটাকে নিয়ে দেখতে পারেন জিন পরিবর্তনের ফলে কোথায় গোলমাল দেখা দিলো, ল্যাজের অভাবে হলো নাকি একজোড়া মাথা গজালো।

ফলের মাছির জেনেটিক্স-এর মধ্যে দিয়ে কোষের ভাষা উদ্ধার করা গেল।
ফলের মাছির ভ্রূণর বাইরের স্তরে একটা শক্ত আবরণ বা “খোলস” নিঃসৃত হয়। খোলসটা কিরকম হবে, সেটা ভিতরের কোষগুলোর কি দশা, তার উপর নির্ভর করে। আঠারো হাজার মাছির স্ট্রেন-এ আনাড়িভাবে জিন-এ পরিবর্তন ঢুকিয়ে ভ্রূণের নকশায় খুঁত সন্ধানের চেষ্টা করা হলো। এইভাবে জেনেটিক স্ক্রিন করে গবেষকরা কিছু জিনগত পরিবর্তন (mutation) খুঁজে পেলেন যেগুলো এই ধরণের খুঁতের জন্ম দেয়। এর থেকে তারা যেসব জিনগুলোকে চিহ্নিত করলেন, তারা কোষীয় যোগাযোগব্যবস্থার মধ্যমণি কিছু প্রোটিনের জন্ম দেয়। যদিও বাইরের খোলসটা আসল ভ্রূণর একটা “ছায়া” মাত্র, তবু তার থেকেই ভ্রূণ সৃষ্টির বেশিরভাগ উপাদানের সুলুকসন্ধান পাওয়া গেল।
উপরের ছবি: ফলের মাছির ভ্রূণর বাইরের “খোলস” (B. Schweitzer and B. Shilo, Weizmann Institute)। নিচের ছবি: ছায়ার থেকেও কিন্তু গভীরে থাকা আসল সম্পর্কটা বোঝা যায় (B. Shilo, Israel Museum, Jerusalem)।

শুরুতে জানা ছিল না মাছির জিনোম-এ তেরো হাজার জিন-এর মধ্যে কতগুলো ভ্রূণের সূক্ষ্ম নকশা তৈরীর কাজে নিয়োজিত। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে মাত্র দুশোর কাছাকাছি জিন ছিল যাদের পরিবর্তন করতে নকশায় খুঁত দেখা গেল। যেহেতু বেশিরভাগ জিন-এই  হাত পড়েছিল এই স্ক্রিন-এ, স্বাভাবিকভাবেই এই সিদ্ধান্তে আসা গেল যে ভ্রূণর জটিল গঠন এবং আকৃতির পিছনে ওই অল্পসংখ্যক জিন-ই রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার আলাদা আলাদা জিন-এর পরিবর্তন সত্ত্বেও একইরকম খুঁত দেখা গেল। এর মানে, জিনগুলো একই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। অন্যভাবে বললে, জিনগুলো একের পর এক ক্রমানুসারে কাজ করে একটাই প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করতে।

কমলালেবু চাষের কথা ভাবো। কল্পনা করে দেখো ঠিক কি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাষের ক্ষেত থেকে শুরু করে একদম শেষে  একটা কমলালেবুকে বাজারের তাকে পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ার কোথাও একটা যদি ব্যাগড়বাই হয়, জলের অভাব কিংবা অনুপযুক্ত বাতাবরণ থেকে শুরু করে লেবু-চালানকারী ট্রাকে যান্ত্রিক গোলযোগ, সবেতেই ফল কিন্তু একই হবে: বাজারের তাক লেবুশূন্য! অর্থাৎ প্রত্যেকটা ধাপই গোটা প্রক্রিয়াটার জন্য মহামূল্যবান। যেসব জিন-এর অনুপস্থিতিতে একই ধরণের খুঁত তৈরী হয়, তাদের সকলকে একই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপের প্রতিনিধি বলা যায়। এবার, এই জিনগুলোকে আলাদা করার পর সহজেই বার করা যায় এরা কিরকম প্রোটিন বানায়। সেইসব প্রোটিনের গঠন দেখলে একটা আন্দাজ পাওয়া যায় কোষের কোথায় এদের অবস্থান এবং আণবিক স্তরে কিভাবে এরা কাজ করতে পারে। দেখা গেলো যে এইসব প্রোটিনের মাধ্যমেই কোষেরা নিজেদের মধ্যে কথোপকথন করে। স্পিমান যে সম্ভাব্য যোগাযোগপদ্ধতির কথা একদিন বলেছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল, নাড়িভুড়ি বার করে দেখাও গেল।  কোষের কথপোকথনের “ভাষা” চলে এলো নাগালের মধ্যে।

কোষেদের এই যোগাযোগব্যবস্থাকে আণবিক স্তরে কিভাবে দেখবো? সব কোষের বাইরেই একটা মেমব্রেন (membrane) বা কোষপর্দা রয়েছে। এই মেমব্রেন বহু ফ্যাট-যুক্ত অ্যাসিড (fatty acid) দিয়ে গড়া, একেকটা অ্যাসিড যেখানে ইয়ালম্বা একটা কার্বন পরমাণুর শৃঙ্খল। বাইরের এই fatty acid আর কোষের ভিতরের জলীয় পরিবেশ, এই দুই পরিবেশের মধ্যে একটা স্পষ্ট বিভেদ রয়েছে। ফলে মেমব্রেন-টাকে কোষ আর তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্যে একটা গণ্ডি বলা যেতে পারে। এই মেমব্রেন-এর সৌজন্যেই কোষ নিজের ভিতরের স্বতন্ত্র পরিবেশকে অক্ষুন্ন রাখতে পারে। কিছু জিনিসকে সে বেছেবুছে ভিতরে কব্জা করে রাখতে পারে আর বাকি অনভিপ্রেত জিনিসকে বহিষ্কার করে দিতে পারে।

এই মেমব্রেন-এ আছে বিশেষ কিছু প্রোটিন যারা বিবিধ রকমের কাজ করে। আমাদের আলোচনার জন্য যে শ্রেণীর প্রোটিন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তাদেরকে বলে রিসেপ্টর (receptor) বা গ্রাহক। এরাই কোষীয় মেমব্রেন-এর বাইরে থেকে ভিতরে সংকেত পাচার করে। এই রিসেপ্টর-গুলো মেমব্রেন-এ গেঁথে আছে তবে এদের কিছুটা বাইরে বেরিয়ে থাকে। এই বেরিয়ে থাকা অংশটার সাথে অন্যান্য কোষ থেকে নিঃসৃত হরমোন জাতীয় কিছু প্রোটিন-এর মুলাকাত ঘটে। একবার রিসেপ্টর আর প্রোটিন-এর যোগাযোগ ঘটলে রিসেপ্টর-এর গঠন পাল্টে যায়। শুধু হরমোন-এর সাথে সংযুক্ত বেরিয়ে থাকা অংশটার গঠন নয়, কোষের ভিতর গেঁথে থাকা বাকি অংশটাতেও পরিবর্তন আসে।

এই পরিবর্তনটা কোষের কেন্দ্রে নিউক্লিয়াস অব্দি পৌঁছয় কিভাবে? কোষের ভিতরের প্রোটিনগুলো তখন অবস্থান, স্থায়িত্ত্ব কিংবা গঠন পাল্টে একে অপরের সাথে জুড়ে যেতে পারে। এরকমভাবে জুড়ে বার্তা বহনের একটা পথ (signalling pathway) তৈরী করে ফেলতে পারে। একদম “রিলে রেস”-এর মতো,  পরস্পর-সংযুক্ত প্রোটিন-এর শৃঙ্খল নিউক্লিয়াস-এর কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয় যে একটা রিসেপ্টর সক্রিয় হয়েছে। প্রত্যেকটা বার্তাবহ পথ আলাদা আলাদা ধরণের প্রোটিন ব্যবহার করে, বার্তা বহনের “কৌশল”-ও আলাদা, যদিও তাদের অন্তিম লক্ষ্য একই। এই বার্তাবহন পদ্ধতিতে নানা রকমের নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসবৃদ্ধির ব্যবস্থা আছে। কোষে চালান হওয়ার সময় একটা সিগনাল স্তিমিত হয়ে যেতে পারে। আবার তার ক্ষমতা বেড়েও যেতে পারে যদি একটা প্রোটিন একসাথে অনেকগুলোকে সক্রিয় করে। এই চালানের সময় বাড়াকমাটাকে বোঝার একটা মজার উপায় নরমান রকওয়েল-এর যাত্রাপালা The Gossips-এ পাওয়া যায়। রকওয়েল এখানে দেখাচ্ছে কিভাবে একটা গুজব কানাঘুষোয় একজনের থেকে আরেকজনে ছড়ায়। যখন গুজবটা শুরুর ব্যক্তির কাছে ফিরে এলো, সেটা মাঝপথে এতটাই পাল্টে গেছে যে সে ব্যক্তি আর সেটাকে চিনতেই পারছেনা।

কোষে কোষে যোগাযোগের পদ্ধতি।
একটা কোষ প্রতিবেশী কোষের থেকে বার্তা পায় তার বাইরের জগতের মধ্যে দিয়ে। একটা লম্বা প্রোটিন-শৃঙ্খল এই বার্তাকে বাইরের কোষীয় মেমব্রেন থেকে কেন্দ্রের নিউক্লিয়াস-এ পৌঁছে দেয়, যাতে সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিন-এর প্রকাশ ঘটতে পারে। এই প্রোটিন শৃঙ্খল অনেকটা একটা “বালতিবাহক বাহিনী”-র (bucket brigade) মতো কাজ করে। এখানে, একটা ইম্প্রভ নাটকগোষ্ঠী (Playback theatre) এইরকম একটা বাহিনীকে দেখাচ্ছে। অভিনেতারা একটা কাল্পনিক বস্তুকে নিয়ে একে অপরের মধ্যে চালান করছে, কিন্তু চালানকালে সেই বস্তুটাকে কিছুটা পাল্টেও ফেলছে (B. Shilo, Cambridge, Massachussetts)।

জেনেটিক স্ক্রিন-এ এই বার্তাবহ পথগুলো আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীদের জন্য আরো দুটো চমক অপেক্ষা করে ছিল। প্রথমত, তারা দেখলেন যে ভ্রূণ বৃদ্ধির সময় কোষেদের মধ্যে যোগাযোগ গুটিকয়েক বার্তাবহ পথেই সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে পাঁচটা পথ প্রধান এবং বারেবারে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে তাদের ব্যবহার হয়, আরও তিনটে আছে যারা তুলনায় কম ব্যবহৃত। প্রত্যেকটা পথের উপাদান আলাদা, আণবিক স্তরে কর্মপদ্ধতি আলাদা। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই মেমব্রেন পেরিয়ে নিউক্লিয়াস-এ তথ্য পৌঁছে দেয় যাতে জিন-এর প্রকাশের (gene expression) ধরণকে বদলানো যায়।

দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানীরা দেখলেন যে এই পথগুলো বিবর্তনের মাঝে পড়েও একই রয়ে গেছে (highly conserved in evolution)। সরল জটিল সব রকম জীবেই এদের দেখা যায়। এর মানে হলো, সব বহুকোষী প্রাণীর মধ্যেই কোষগুলো একই ভাষা ব্যবহার করে কথপোকথন করতে। এই ভাষা গোটা বিবর্তন ধরে তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও একই ছিল। এই বার্তাবহ পথগুলো সবেতেই সমান, সে নেমাটোড কৃমি  হোক কি মাছি, কি মানুষ।  এই আবিষ্কারটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধরণধারণ পাল্টে দিল। আগে ছোট ছোট বিজ্ঞানীর গোষ্ঠী আলাদা আলাদা জীব নিয়ে নাড়াচাড়া করতো, একে অপরের কাজের  মধ্যে কোনো  সম্পর্ক ছিল না। হঠাৎ দেখা গেল যে ওমা, সবাই আসলে একই আণবিক যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে! ফলের মাছির চোখের ক্রমবিকাশ আর মানুষের দেহে ক্যান্সার, এরকম সম্পূর্ণ আলাদা কিছু প্রক্রিয়া একদম একই যন্ত্রের ব্যবহার করছে। এই যে বার্তাবহনের সার্বজনীন চরিত্র, এটা জীববিজ্ঞানের জগতে একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনলো। বিশেষ কোনো একটা জীবের জগতে সংকীর্ণ না থেকে বিজ্ঞানীরা অনেক ব্যাপক একটা পন্থা অবলম্বন করতে পারলেন।


(‘Life’s blueprint’ বইটা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর  অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং  কুণাল চক্রবর্তী।)

The post প্রাণের নকশা (পর্ব ৪- কিভাবে কোষেরা নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালায়) appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).


প্রতিক্রিয়া আর টান-এর ব্যাখ্যা

$
0
0

ওজনদার বস্তুর উপর জমির প্রতিক্রিয়া বা normal reaction কিংবা ঝুলন্ত বস্তুর জন্য দড়িতে টান বা tension, এগুলোর উৎস কি?


ওজনদার বস্তুর উপর জমির “প্রতিক্রিয়া”

টেবিল-এর ওপর একটা বই রাখো। যদি জিজ্ঞেস করি বইটার ওপর কোন কোন বল কাজ করছে, চট করে বলে দেবে, বইয়ের ওজন-টাকে সামাল দিচ্ছে টেবিলের প্রতিক্রিয়া। যেটাকে প্রতিক্রিয়া বললে, সেটা নিশ্চয় ওজনের প্রতিক্রিয়া না। কারণ নিউটনের তৃতীয় সূত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তো আলাদা বস্তুর ওপর কাজ করে, এখানে দুটোই কাজ করছে ওই বইটার ওপর। তাহলে টেবিলের “প্রতিক্রিয়া” আবার কি?

আসলে একটা উপরিতল-কে (surface) যতই মসৃণ লাগুক, মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখলে আর মসৃণ থাকে না। যেটাকে মসৃণ মনে হচ্ছিলো, সেটাই একগুচ্ছ পাহাড় আর মাঝের উপত্যকায় পরিণত হয়। অতএব, যখন বইটা টেবিলের ওপর রাখা হয়, বইয়ের কিছু অণুর সাথে টেবিলের কিছু অণুর ঘষাঘষি লাগে (চিত্র ১ দেখো)।

অণুগুলোর ধর্ম হলো এইরকম: তাদের পারস্পরিক দূরত্ব equilibrium বা সাম্যাবস্থার দূরত্বের থেকে কমে গেলে তারা একে অপরকে ঠেলতে থাকে আর দূরত্ব বেড়ে গেলে টানে। অর্থাৎ, তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরৎ যেতে চায়। বইয়ের অণুগুলো মাধ্যাকর্ষণের টানে নিচে যাওয়ার চেষ্টা করে, তারা টেবিলের অণুর সংস্পর্শে থাকার ফলে তাদেরও নিচের দিকে ঠেলে। টেবিলের অণুগুলোও ফিরে আসার চেষ্টা করে তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় এবং জন্ম হয় নতুন এক প্রতিক্রিয়ার। সবকটা অণুর প্রতিক্রিয়া জুড়লে (resultant) বইয়ের উপর যে বলটা তৈরী হয়, সেটা স্বাভাবিকভাবেই সরাসরি উপরের দিকে। এটাকেই গোদা ভাষায় “টেবিলের প্রতিক্রিয়া” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্বাভাবিক অবস্থায়, যখন কেউ নড়ছে-চড়ছে না, তখন এই টেবিলের প্রতিক্রিয়া (ধরা যাক, R) বইয়ের ওজনের (ধরা যাক, W) সমান হয়:

R = W

এতক্ষণ বইটার কথা ভাবছিলাম। বইটা ছেড়ে যদি এবার টেবিলটাকে দেখি, সেও তো নড়ছে না। তার ওজন যদি হয় W_1, সেই ওজনটা আর টেবিলের ওপর যাবতীয় নিম্নমুখী বলকে সামাল দিচ্ছে জমির প্রতিক্রিয়া (ধরা যাক, R_1)। জমির প্রতিক্রিয়া কোত্থেকে এলো? উপরের ব্যাখ্যাটা থেকেই আসে। সব কিছুই নট নড়নচরন হতে গেলে, এই সমীকরণটা সত্যি হতে হবে:

R_1 = W_1 + R …. (১)

আর  যেহেতু বইয়ের ওজনের সমান, তাই:

R_1 = W_1 + W …. (২)

বই আর টেবিলটাকে মিলে যদি একটা বস্তু ভাবি, তাহলে উপরের সমীকরণটা সেই বস্তুটার জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ, বই এবং টেবিলের মিলিত ওজন জমির প্রতিক্রিয়ার সমান। আরেকবার বলি, এই “জমির প্রতিক্রিয়া”-কে ব্যাখ্যা করতে হলে আণবিক স্তরে যেতে হবে। যেভাবে একটু আগে “টেবিলের প্রতিক্রিয়া”-কে বোঝালাম।

ঝুলন্ত বস্তু যে টান অনুভব করে

ধরা যাক, সিলিং থেকে সুতো দিয়ে ঝুলছে একটা বস্তু। বস্তুর ওজন W। বস্তুটা স্থির অবস্থায় রয়েছে।

তখন তুমি বলবে যে সিলিং-এর “প্রতিক্রিয়া” R সামাল দিচ্ছে ওজন W-কে। এই “প্রতিক্রিয়া”-কেও একইভাবে আণবিক স্তরে ব্যাখ্যা করা যায়। আগের মতোই, সুতোর কিছু অণু সিলিং-এর অণুর সংস্পর্শে রয়েছে, আবার কিছু অণু বস্তুর সংস্পর্শে রয়েছে। বস্তুকে মাধ্যাকর্ষণ নিচের দিকে টানে, তখন তার অণুর সাথে সুতোর অণুর দূরত্বে বাড়ে, সেই দূরত্ব কমাতে সুতোর অণুগুলো নিচের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন আবার সিলিং-এর অণুর সাথে সুতোর অণুর দূরত্ব বেড়ে যায় এবং তার ফলে সুতোর অণুগুলোর মধ্যে  উপরের দিকে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। অর্থাৎ, তারা ঊর্ধ্বমুখী একটা বল অনুভব করে। এই সুতোর অণুগুলোর ওপর যত ঊর্ধ্বমুখী বল রয়েছে, সেগুলোকে জুড়লে (resultant) যে নিট ঊর্ধ্বমুখী বল পাওয়া যায়, তাকেই আমরা গোদা ভাষায় “সিলিং-এর প্রতিক্রিয়া” বলি।

এবার AB বরাবর সুতোর একটা প্রস্থচ্ছেদ (cross-section) কল্পনা করো। যেহেতু সিলিং-সুতো-ঝুলন্তবস্তু  মিলিয়ে গোটা সিস্টেম-টা সাম্যাবস্থায় রয়েছে (equilibrium), একেকটা অংশও তাই। অর্থাৎ এই প্রস্থচ্ছেদের উপরের আর নিচের অংশটাও আলাদা করে সাম্যাবস্থায় রয়েছে। এই অংশবিশেষের সাম্যাবস্থাকে কিভাবে বোঝানো যায়? গোটা বস্তুটা সাম্যাবস্থায় রয়েছে মানে তার ওপর নিচের দিকে আর উপরের দিকের বল সমান। এবার তাতে যদি একজোড়া নতুন বল জুড়ে দি, যেগুলো সমান এবং বিপরীতমুখী, কিছু যায় আসবে না। তখনো নিম্নমুখী আর ঊর্ধ্বমুখী বল সমান থাকবে।

উপরের ছবিতে তাই করা হলো। ধরা যাক ওই প্রস্থচ্ছেদের নিচের অংশটাকে একটা বল টানছে আর উপরের অংশটাকে একই পরিমাণ বল ঠেলছে, এবং উভয় বলের মান T। এবং ধরা যাক, T ওজন W-এর সমান। তাহলে, যখন নিচের অংশের সাম্যাবস্থাকে বোঝানোর চেষ্টা করবো, বলবো বস্তুর ওজন W-কে সামাল দিচ্ছে সুতোয় ঊর্ধ্বমুখী টান (tension), T। আর উপরের অংশটাকে বোঝাতে গেলে বলবো, সিলিং-এর প্রতিক্রিয়া R-কে সামলাচ্ছে সুতোয় নিম্নমুখী টান, তার মানও T। অর্থাৎ টান-এর ধারণা তখনই আসে যখন আমরা একটা অংশবিশেষের সাম্যাবস্থাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। ভাগাভাগিটা বাস্তবে না থাকলেও চলবে, অংশটাকে কল্পনা করে নিয়ে তার সমীকরণ লিখতে গেলেই টান-এর প্রয়োজন হবে। টান-এর দিশা সবক্ষেত্রেই ওই অংশটার থেকে বহির্মুখী হয়, অর্থাৎ অংশটাকে “টানে”, ঠেলে না।

যদিও ‘টান’ নামক বলটা অংশবিশেষের সাম্যাবস্থা বোঝাতে আমদানি করলাম, এই টান-এর ধারণাটা আকাশ থেকে পড়েনি, এর উৎসও আণবিক স্তরে। আগেই বলেছি যে বস্তুর মধ্যের অণুগুলো পরস্পরের থেকে দূরে সরে গেলে, তারা সেই দূরত্বকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ সুতোর উপরের অংশের আর নিচের অংশের অণুগুলো পরস্পরকে টানে। এই আণবিক বলগুলোকে জুড়লে দেখা যায় যে সুতোর উপরের অংশের ওপর নিট বল কাজ করছে নিচের দিকে, আর নিচের অংশের ওপর বলটা উপরের দিকে। এটাই টান।

টান কতটা, সেটা কি সুতোর সর্বত্রই সমান? যদি সুতোর কোনো ওজন না ধরি, তাহলে সেই ওজনের বল নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে না। সুতোর যেখানেই প্রস্থচ্ছেদ কাটি না কেন, প্রস্থচ্ছেদ-এর নিচের অংশটাকে ধরলে টান খালি নিচের বস্তুর ওজনটাকে সামাল দেয়, সুতোর কোনো ওজন নেই। অর্থাৎ, সর্বত্রই লেখা যায় W = T

কিন্তু সুতোর যদি একটা ওজন থাকে, তখন কিন্তু আর সুতোর সর্বত্র একই টান থাকবে না? কোনো একটা জায়গায় টান কতটা, সেটা কিভাবে বার করা হবে তখন? সেই গল্প পরের পর্বে।


(লেখাটা মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়।)

প্রচ্ছদের ছবি: বনানী মণ্ডলঅন্যান্য ছবি: ধীরঞ্জন রায় / বনানী মণ্ডল

The post প্রতিক্রিয়া আর টান-এর ব্যাখ্যা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

পৃথিবীর গভীর কথা

$
0
0

মহাকাশ্চারীদের মতো ভূবিজ্ঞানীদের কোনো উপায় নেই যাতে করে পৃথিবীর নীচ থেকে ঘুরে আসতে পারে। তাহলে পৃথিবীর নীচের বিভিন্ন স্তরগুলো নিয়ে কিভাবে জানা গেল?


মানুষের গভীরতম পদক্ষেপ 

পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দূরত্ব প্রায় ৬৩৭০ কিলোমিটার। এই দূরত্ব এতটাই গভীর যে  মানুষের পক্ষে এই গভীরতায় প্রবেশ করা সম্ভব নয়।  বলতে গেলে এই গভীরতার ০.১%ও মানুষ অতিক্রম করতে পারেনি। মানুষ মাটির নিচে প্রবেশ করতে চায় মূলত দুটি কারণে। প্রথমত মাটির নীচে থেকে খনিজ সম্পদ সংগ্রহ করার জন্য। এই মুহূর্তে পৃথিবীর গভীরতম খনি রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়, এমপোনেং (Mponeng) স্বর্ণখনি যা মাটির নিচে প্রায় ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ভবিষ্যতে আরও গভীরতা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। এটাই এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর গভীরতম স্থান যেখানে মানুষের পা পড়েছে।  খনি ব্যতীত, অনেক সময় বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের জন্য মাটির মধ্যে গর্ত করা হয়, যা থেকে পাথর সংগ্রহ করা হয় এবং সেই পাথর থেকে মাটির নিচের তাপমাত্রা এবং চাপ পরিমাপ করা যায় ।  এই জাতীয় গর্তকে ভূবিজ্ঞানের ভাষায় বলে বোরহোল (Borehole)। এখানে মানুষ সরাসরি পৌঁছায় না, কিন্তু যন্ত্র পৌঁছে যায় এবং পাথর তুলে আনে। পৃথিবীর গভীরতম বোরহোল প্রায় ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত গেছে।  রাশিয়ার পেচাংস্কি জেলায় রয়েছে এই বোরহোল যার নাম কোলা সুপারডিপ বোরহোল [১]।  

মানুষের প্রচেষ্টা মাত্র ১২ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, আমরা পৃথিবীর  কেন্দ্র থেকে একদম ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের বর্ণনা, তাদের বৈশিষ্ট সম্পর্কে জানতে পারি, শিলামন্ডল (lithosphere), গুরুমন্ডল (mantle), কেন্দ্রমন্ডল (core), তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিযুক্তিরেখা (discontinuity), যেমন, মোহোরভিসিক বিযুক্তি (Mohorovičić discontinuity), গুটেনবার্গ বিযুক্তি (Gutenberg discontinuity) ইত্যাদি সম্পর্কে সমস্ত বিবরণ স্কুলের পাঠ্য বইতে পাওয়া যায়।   কিন্তু বৈজ্ঞানিকরা কি করে সংগ্রহ করে এই সব অজানা তথ্য?

ভূপদার্থ বিজ্ঞানের গোড়ার কথা 

যে সব বৈজ্ঞানিকরা পৃথিবীর গভীরের তথ্য সংগ্রহ করেন, তাদের বলা হয় ভূপদার্থ বিজ্ঞানী (Geophysicist)।  ভূপদার্থ বিজ্ঞান বা জিওফিজিক্স-এর (Geophysics) মধ্যে বিষয়ভিত্তিক আরো অনেক ভাগ হয়।  প্রত্যেকটি বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে গবেষণা করে।  যেমন জিওডিনামিক্স (Geodynamics) বা  ভূগতিবিদ্যায় বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীর গভীরে যেসব বলের কারণে আগ্নেয়গিরি কিংবা হিমালয়ের মতো পাহাড় তৈরী হয়, সেই বলগুলো নিয়ে হিসেব কষা।  আবার ভূমিকম্পবিদ্যা বা সেইসমোলোজি (Seismology) নিয়ে যারা গবেষণা করে, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ভূমিকম্পের কারণ নির্ধারণ করা, কত তীব্রতায় ভূমিকম্প হলো তার পরিমাপ করা।  আমরা অনেকেই জানি হিমালয়তে ভূমিকম্প হলে তার ফলস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গেও আমরা কম্পন অনুভব করি।  তাই ভূমিকম্প যেখানে শুরু হয়, সেই উপকেন্দ্র থেকে অনেক দূর পর্যন্ত কম্পন ছড়িয়ে পরে। সেইসমোলোজিস্ট বা ভূমিকম্পবিদের একটি প্রধান কাজ হলো এই কম্পন কি করে তরঙ্গাকারে উপকেন্দ্র থেকে চারিদিকে প্রবাহিত হয় তার গাণিতিক হিসাব নির্ণয় করা।  

দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র থেকে একাধিক তরঙ্গ নির্গত হয়।  এদেরকে দুইভাবে ভাগ করা যায়।  একটি দেহ তরঙ্গ এবং একটি পৃষ্ঠ তরঙ্গ।  পৃষ্ঠ তরঙ্গগুলি কেবলমাত্র পৃথিবী পৃষ্ঠের ওপেরই প্রবাহিত হয়, ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না।  কিন্তু দেহ তরঙ্গ ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে নির্গত হয়ে পৃথিবীর গভীরে প্রবেশ করে।  এই দেহ তরঙ্গের গতিবেগ এবং গতিবিধি নির্ণয় করেই ভূপদার্থবিদরা পৃথিবীর গভীরের সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেন।  ঠিক কি ভাবে হয় এই তথ্য সংগ্রহ?

ভূমিকম্পের ভাষা

যেকোনো তরঙ্গ প্রবাহের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট আছে। তরঙ্গ এক মাধ্যম থেকে ভিন্ন মাধ্যমে গেলে তরঙ্গের কিছু অংশ প্রতিফলিত হয়ে প্রথম মাধ্যমে ফিরে আসে (reflection) এবং কিছু অংশ প্রতিসরিত হয়ে দ্বিতীয় মাধ্যমে প্রবেশ করে (refraction)। ঠিক আমরা আলোর ক্ষেত্রে যেমনটি দেখতে পাই। সূর্যের আলো এক বালতি জলের ওপর পড়লে সূর্যের প্রতিফলন সেই বালতির জলে দেখতে পাই। আবার সেই বালতিতে একটি শক্ত লোহার রড জাতীয় পদার্থ রেখে দিলে জলের মধ্যে  রডটির দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন দেখি।  দৈর্ঘ্যের এই আপাত পরিবর্তন সম্ভব হয় বায়ু এবং জলের মধ্যে প্রতিসরাঙ্কের (refractive index) পরিবর্তনের জন্য।  প্রতিটি মাধ্যমের নির্দিষ্ট প্রতিসরাঙ্ক থাকে।  একটি মাধ্যমে তরঙ্গ কত গতিবেগে প্রবাহিত হতে পারে, তা মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্কের উপর নির্ভরশীল। প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তন হলে তরঙ্গ বেগ পরিবর্তিত হয়। 

চিত্র ১: ভূমিকম্পের উৎস (source) থেকে বিভিন্ন দেহ তরঙ্গ প্রবাহিত হয়। এক মাধ্যম থেকে দ্বিতীয় মাধ্যমে প্রবেশ করলে তরঙ্গ প্রতিফলিত (নীল বিচ্ছিন্ন রেখা) এবং প্রতিসরিত (কালো নিরবচ্ছিন্ন রেখা) হয়। এই প্রতিফলিত এবং প্রতিসরিত তরঙ্গ ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত সিস্মোগ্রাফ (seismograph) যন্ত্রে নথিভুক্ত হয়।

তরঙ্গ প্রতিফলিত এবং প্রতিসরিত হবার পর উৎসস্থল থেকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় প্রবাহিত হয়। তরঙ্গের এই গতিবিধিকে পরিমাপ করার জন্য থাকে গ্রাহক যন্ত্র। যদি তরঙ্গের উৎস থেকে গ্রাহক যন্ত্রের দূরত্ব জানা থাকে এবং উৎস থেকে ঠিক কত সময় পরে প্রতিফলিত এবং প্রতিসরিত তরঙ্গ গ্রাহক যন্ত্রে এসে পৌঁছায় তার হিসাব থাকে, তাহলে তরঙ্গ বেগ নির্ণয় করা সম্ভব। ভূমিকম্প তরঙ্গকে নথিভুক্ত করার জন্য যে গ্রাহক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাকে বলে সিস্মোগ্রাফ (Seismograph)। ভূমিকম্প তরঙ্গ নথিভুক্ত করার নির্দিষ্ট ভাষা আছে। সিস্মোগ্রাফ  যন্ত্রে এই ভাষা বা ভূকম্পলিপি (seismogram) ধরা পরে।  এই ভাষা পড়ে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারে প্রতিফলিত বা প্রতিসরিত তরঙ্গ ঠিক কোন পথে চলে গ্রাহক যন্ত্রে ধরা পড়েছে।  পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে এই সিস্মোগ্রাফ স্টেশন। যেকোনো ভূমিকম্প হলেই তার থেকে প্রতিফলিত এবং প্রতিসরিত তরঙ্গ পৃথিবীব্যাপী সমস্ত সিস্মোগ্রাফ যন্ত্রে ধরা পরে (চিত্র ১)।  ভূমিকম্পবিদরা জটিল গাণিতিক পদ্ধতিতে ভূকম্পলিপির অর্থ পাঠোদ্ধার করে  তরঙ্গের গতিবেগ কিভাবে পৃথিবীর গভীরতার সাথে পরিবর্তিত হয় তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নির্ণয় করে।  তরঙ্গ বেগ যে গভীরতায় আকস্মিক ভাবে পরিবর্তিত হয়, সেই অংশকে সিসমিক ডিসকন্টিনুটি (Seismic discontinuity) বা ভূকম্পিয় বিযুক্তি রেখা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। দুটি বিযুক্তি রেখার মধ্যবর্তি অংশকে এক একটি স্তর হিসাবে অবহিত করা হয়।   

পৃথিবীর স্তর বিন্যাস

মহাদেশীয় ভূপৃষ্ঠের নিচে প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত তরঙ্গের গতিবেগ নির্দিষ্ট অনুপাতে বৃদ্ধি পায় (চিত্র ২)। ঠিক এই দূরত্ব অতিক্রম করলেই দেহ তরঙ্গের গতিবেগ নির্দিষ্ট অনুপাতের থেকে অনেক বেশি হারে বৃদ্ধি পায়।  যদিও সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে এই বৃদ্ধি মাত্র ৫-৭ কিলোমিটারের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। 

চিত্র ২: ভূপৃষ্ঠ থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কিভাবে ভূমিকম্প তরঙ্গের গতিবেগ পরিবর্তিত হয় তা দেখানো হয়েছে। ছবির নিচের অংশে সমগ্র পৃথিবীকে একটি গোলাকার চাকতির ন্যায় দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি নমুনা অংশকে বিস্ফোরিত করে স্তরায়ন তলের বিন্যাস তুলে ধরা হয়েছে। বিস্ফোরিত নমুনা অংশের মধ্যে একটি সাদা নিরবচ্ছিন্ন রেখা তরঙ্গ গতিবেগের মাপকাঠি হিসাবে দেখানো হয়েছে। রেখাপথ ডান দিকে অগ্রসর হলে তরঙ্গ গতিবেগ বৃদ্ধি হয় এবং বাম দিকে অগ্রসর হলে গতিবেগ হ্রাস পায়। যে যে গভীরতায় গতিবেগ পরিবর্তিত হয় সেগুলি ছবির বামপাশে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিযুক্তি রেখাগুলি ডানপাশে লেখা হয়েছে। প্রতিটি উল্লেখযোগ্য স্তরের নাম ছবির মধ্যবর্তী অংশে দেখা যাচ্ছে।

পৃথিবীর ভিতর দেহ তরঙ্গের এটিই প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ গতিবেগ পরিবর্তন। ভুপৃষ্ঠতল থেকে এই গভীরতা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ত্বক বা ক্রাস্ট (crust) এবং তরঙ্গ গতিবেগ এর প্রথম পরিবর্তনকে বলা হয় মোহোরভিসিক বা মোহো বিযুক্তি (Moho discontinuity) রেখা।  এর পরে আবার প্রায় ১০০ কিলোমিটার গভীরতায় দেহ তরঙ্গের গতিবেগ হঠাৎ হ্রাস পায়।  পৃথিবীর ত্বক সহ এই ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু স্তরকে বলা হয় শিলামন্ডল (Lithosphere)। ভূবিজ্ঞানীদের ধারণা শিলামন্ডলের নিচে যে স্তর আছে তা অপেক্ষাকৃত নরম যে কারণে তরঙ্গের গতিবেগ কমে যায়।  এই স্তরের নাম নমনীয়স্তর বা আস্থেনোস্ফিয়ার (Asthenosphere)। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত পাত-সঞ্চরণ তত্ত্ব বা প্লেট টেক্টোনিক্স তত্ত্বের (Plate tectonics theory) পিছনে আস্থেনোস্ফিয়ার-এর গুরুত্ব অপরিসীম। আস্থেনোস্ফিয়ার প্রায় ২০০ কিলোমিটার পুরু। ভূপৃষ্ঠের নিচে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার গভীরতার পর আবার ভূমিকম্পের দেহ তরঙ্গের গতিবেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।  প্রায় ২৮৯১ কিলোমিটার নিচে তরঙ্গের গতিবেগ মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। এইখানে ভূবিজ্ঞানীরা আরো একটি বিযুক্তি রেখা কল্পনা করে, যার নাম গুটেনবার্গ বিযুক্তি রেখা।  মোহো বিযুক্তি থেকে গুটেনবার্গ বিযুক্তি পর্যন্ত প্রায় ২৮০০ কিলোমিটার পুরু স্তরের নাম গুরুমণ্ডল বা ম্যান্টেল (Mantle)।  হিমালয়ের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে দাক্ষিণাত্য মালভূমির অব্দি পৃথিবীর যেকোনো দুর্বিসহ আগ্নেয়গিরি সৃষ্টির পিছনে সমস্ত অবদান এই স্তরের। ম্যান্টলের মধ্যে প্রায় ৬৭০ কিলোমিটার গভীরতায় তরঙ্গ বেগের সামান্য বৃদ্ধি পায়। একারণে ম্যান্টলের প্রথম ৬৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত উর্দ্ধ গুরুমণ্ডল বা আপার ম্যান্টেল (Upper mantle) এবং পরবর্তী ২৮৯১ কিলোমিটার পর্যন্ত অংশকে নিম্ন গুরুমণ্ডল বা লোয়ার ম্যান্টেল (Lower mantle) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। 

গুটেনবার্গ বিযুক্তিরেখার নিচে থেকে শুরু হয় কেন্দ্রমণ্ডল বা কোর (core) যার বিস্তার ২৮৯১ কিলোমিটার থেকে একদম কেন্দ্র পর্যন্ত, অর্থাৎ ৬৩৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত।  কেন্দ্রমণ্ডল আবার দুই ভাগে বিভক্ত।  ২৮৯১ থেকে ৫১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীরতায় দেহ তরঙ্গের বেগ ভীষণ ভাবে হ্রাস পায়।  প্রসঙ্গত, দেহ তরঙ্গের মধ্যেও দুই প্রকার তরঙ্গ হয়।  একটি পি তরঙ্গ (P wave) এবং একটি এস তরঙ্গ (S wave) । এস তরঙ্গের বৈশিষ্ট হলো তা তরল মাধ্যমের মধ্যে প্রবাহিত হতে পারে না, অর্থাৎ যে কোনো তরল মাধ্যমে (যেমন জল) এর গতিবেগ শূন্য। আশ্চর্য ভাবে ২৮৯১ থেকে ৫১৫০ কিলোমিটার এর মধ্যে এস তরঙ্গের নির্ধারিত গতিবেগ হয় শূন্য।  বিজ্ঞানীদের মতে, এই গভীরতায় অত্যাধিক চাপ এবং তাপের ফলে লোহা এবং নিকেলের মতো ধাতু গলিত তরল অবস্থায় থাকে। এই স্তরের নাম বহির কেন্দ্রমণ্ডল বা আউটার কোর (Outer core)।  এটিই পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র তরল স্তর, বাকি সমস্ত কঠিন। বলা বাহুল্য, তরল হলেও আগ্নেয়গিরি লাভার সাথে এই স্তরের বিন্দু মাত্র যোগাযোগ নেই। কিন্তু, পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরির কারণ হিসাবে রয়েছে এই স্তরের তরল লোহার তোলপাড়।  ৫১৫০ কিলোমিটার থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত আবার তরঙ্গ বেগ বৃদ্ধি পায়।  এস তরঙ্গ আবার ফিরে আসে, অর্থাৎ পৃথিবীর  তরল স্তর রূপান্তরিত হয় কঠিন স্তরে। ৫১৫০ কিলোমিটারের এই বিযুক্তি রেখার নাম লেম্যান বিযুক্তিরেখা*। পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থান করছে একটি প্রায় ১২০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের শক্ত লোহার গোলক।  লেম্যান বিযুক্তিরেখা থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত এই অংশের নাম অন্তরকেন্দ্র বা ইনার কোর (Inner core)।  

আরো রহস্যের খোঁজে 

বিগত এক শতাব্দী ধরে পদার্থ বিজ্ঞানী এবং ভূবিজ্ঞানীদের মিলিত চেষ্টায় পৃথিবীর গভীরতম রহস্যের কিয়দংশ উদ্ঘাটিত হয়েছে। বিগত দুই দশকে আবিষ্কৃত হয়েছে আরো অসংখ্য বিযুক্তি এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্তর। এখনো বহু রহস্য লুকিয়ে আছে আনাচে কানাচে। যেমন, পৃথিবীর গভীরে কি করে তাপমাত্রা এবং চাপ পরিবর্তন হচ্ছে, কেন পৃথিবীর উপরিভাগের পাত গুলি (Plate) চলাচল করে, কি করে হয় এই পাত সঞ্চরণ (Plate tectonics), কবে শুরু হয়েছিল এই সঞ্চরণ, কেন পৃথিবী বাদে অন্য কোনো গ্রহে পাত  সঞ্চরণ হয় না, প্রাণের উৎস এবং বিবর্তন কি কি ভাবে পাত সঞ্চরণের ওপর নির্ভর করে, গুরুমণ্ডলের পরিচলন স্রোতের (Mantle convection current) উৎস কোথায়, পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের উৎস কোথায়, কেনই বা কয়েক হাজার বছর অন্তর চৌম্বক ক্ষেত্র মেরু পরিবর্তন (magnetic polarity reversal) করে: এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখনো বাকি।  এই সমস্ত রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে পৃথিবীর গভীরে। মহাকাশ্চারীদের মতো ভূবিজ্ঞানীদের কোনো উপায় নেই যাতে করে পৃথিবীর নীচ থেকে ঘুরে আসতে পারে।  তবে গাণিতিক শক্তি আর বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে ভূবিজ্ঞানীরা চোখ বন্ধ করে নিমেষে পৌঁছে যায় পৃথিবীর গভীর থেকে গভীরে আর ব্যস্ত থাকে জটিল রহস্যের সমাধানে। 

*~২২০ কিলোমিটারের কাছে আরো একটি বিযুক্তিরেখা লেম্যান বিযুক্তিরেখা হিসাবে পরিচিত 

লেখাটি পড়ে  ভাষাগত এবং ব্যাকরণগত ত্রূটিগুলি ঠিক করে দেবার জন্য অলক্তা দাস কে ধন্যবাদ। 


প্রচ্ছদের এবং অন্যান্য ছবি: জ্যোতির্ময় পাল

আরো জানার জন্য [১] The deepest hole we have ever dug

The post পৃথিবীর গভীর কথা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

কৃষ্ণগহ্বরের তত্ত্ব, পর্যবেক্ষণ ও নোবেল পুরস্কার ২০২০

$
0
0

২০২০-র পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো কৃষ্ণগহ্বর সংক্রান্ত তাত্ত্বিক গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের জন্য। সেই গবেষণায় কি বেরিয়েছিল?


২০২০ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন রজার পেনরোজ, আন্দ্রিয়া ঘেজ ও রাইনহার্ড গেনজেল। তাঁদের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষণায় ঘটেছে তত্ত্ব ও পর্যবেক্ষণের এক অতি উৎকৃষ্ট সমন্বয়, বৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপ এবং অসাধ্যসাধনের জেদ – মানুষের এই দুই অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এক উজ্জ্বল সংমিশ্রণ। এই প্রবন্ধে তাঁদের সেই গবেষণার কাজগুলিকে সহজ ভাষায় আলোচনা করার একটি প্রচেষ্টা করলাম।

কৃষ্ণগহ্বরের তাত্ত্বিক সম্ভাবনা

আমরা সবাইই কমবেশি শুনেছি যে ‘ব্ল্যাক হোল’ বা কৃষ্ণগহ্বর হলো এমন একটি বস্তু যার মহাকর্ষবল এতো বেশী যে আলোও সেখান থেকে বেরতে পারে না। যদি খুব ছোটো জায়গায় অনেক ভর ঘনসন্নিবিষ্ট হয়ে থাকে — যেমন গোটা পৃথিবীটা যদি সঙ্কুচিত হয়ে একটা সর্ষেদানার সমান  হয়ে যায় এবং তার ভর একই থাকে — তাহলে সেখানে মহাকর্ষবল ওইরকম বেশী হতে পারে।

এই সম্ভাবনা নিউটনীয় মহাকর্ষতত্ত্বের মধ্যেই রয়েছে, যদিও আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে তাঁর বিখ্যাত সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব প্রকাশ করার আগে বিজ্ঞানীমহলে এই বিষয় নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় নি। এক কথায় সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ হলো ‘স্পেসটাইম’ বা স্থান-কাল [১] সংক্রান্ত কিছু সমীকরণের সমন্বয়। সেগুলিকে একত্রে আইনস্টাইন সমীকরণ বলা হয়। কৃষ্ণগহ্বর হলো স্থান-কালে একটি তথাকথিত ‘সিঙ্গুলারিটি’ বা অদ্বৈত বিন্দু। সহজ ভাষায় বললে তার ঘনত্ব অসীম।

আইনস্টাইন তাঁর তত্ত্ব প্রকাশ করার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ১৯১৬ সালে বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্জসচাইল্ড দেখালেন যে কৃষ্ণগহ্বর হলো আইনস্টাইন সমীকরণের একটি সমাধান। অর্থাৎ আইনস্টাইন সমীকরণ অনুযায়ী বিশেষ অবস্থায় স্থান-কালে অদ্বৈত বিন্দু তৈরি হতে পারে।  সোয়ার্জসচাইল্ডের সমাধান থেকে আরও দেখা গেল, যে কেন্দ্রীয় ভরটিতে এই অদ্বৈত বিন্দু তৈরি হবে তার চারপাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে একটি গোলীয় তল থাকবে যার ভিতরে পদার্থ ও আলো ঢুকতে পারে কিন্তু বেরোতে পারে না। এই তলকে বলা হয় ‘ইভেন্ট হরাইজন’ বা ঘটনা দিগন্ত।

আইনস্টাইন-এর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব প্রকাশ হওয়ার পর কৃষ্ণগহ্বর থাকার তাত্ত্বিক সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠলো।

কিন্তু এরপরেও আইনস্টাইন সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে চালু ধারণাটি ছিল যে যদিও খাতায় কলমে এরকম একটি সমাধান রয়েছে, আসলে প্রকৃতিতে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ আইনস্টাইন সমীকরণের সমাধান করার জন্য সোয়ার্জসচাইল্ড যেসব শর্ত ধরে নিয়েছেন, যেমন ‘স্ফেরিকাল সিমেট্রি’ বা গোলীয় প্রতিসাম্য, প্রকৃতিতে সেই ধরণের সরলীকৃত পরিস্থিতি কখনোই তৈরি হবে না। এরপর বেশ কিছুদিন এই নিয়ে খুব উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয় নি। ১৯২০র দশকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিকাশ পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এক নতুন বিপ্লব নিয়ে এসেছে। ১৯৩০-এর দশকে শুরু হয়েছে নিউক্লিয়াসের বিভাজন ও পারমাণবিক শক্তি নিয়ে গবেষণা। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বের বেশীরভাগ পদার্থবিদ এইসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। 

১৯৬০-এর দশকের শুরুতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কোয়েজার নামক এক নতুন ধরনের মহাজাগতিক বস্তু আবিষ্কার করেন। নানা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে এগুলি আকারে আমাদের সৌরজগতের চেয়ে বড় নয় কিন্তু এগুলির ঔজ্জ্বল্য একটি গ্যালাক্সি তথা ছায়াপথের সমান অর্থাৎ সূর্যের প্রায় দশ হাজার কোটি গুণ। একটি ছোটো জায়গা থেকে এত বিপুল পরিমাণে শক্তির বিকিরণ কিভাবে হতে পারে? এমনকি তারাদের শক্তির উৎস যে ‘নিউক্লিয়ার ফিউশান’ বা নিউক্লিয়ার সংযোজন সেই পদ্ধতিও এতোটা ক্রিয়াশীল নয়।

তখন কেউ কেউ বললেন যে এই কোয়েজারগুলির কেন্দ্রে যদি একটি কৃষ্ণগহ্বর থাকে তাহলে তার চারপাশের বস্তু সেই কৃষ্ণগহ্বরের আকর্ষণে তার মধ্যে পড়ে যাবার আগে প্রচুর পরিমাণে শক্তি বিকিরণ করবে এবং সেই ক্ষেত্রে খুব ছোটো জায়গা থেকে এত বেশী মাত্রায় বিকিরণ সম্ভব।  এছাড়াও মহাবিশ্বের বিগব্যাং তত্ত্ব সেই সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এক অংশের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু এই তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। সুতরাং অতীতে কোনো এক সময়ে আমাদের মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল একটি অসীম ঘনত্ত্বসম্পন্ন অবস্থা তথা অদ্বৈত বিন্দু থেকে। এইসব বিভিন্ন কারণে মহাবিশ্বে অদ্বৈত বিন্দুর উপস্থিতি সম্ভব কিনা তাই নিয়ে বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু করলেন।

এঁদেরই মধ্যে একজন ছিলেন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ রজার পেনরোজ। তিনি ১৯৬৫ সালে প্রথমবারের জন্যে অভ্রান্তভাবে দেখালেন যে সোয়ার্জসচাইল্ডের ধরে নেওয়া শর্ত ছাড়াও স্থান-কালে অদ্বৈত বিন্দু তথা কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হতে পারে। শুধু তাইই নয় কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তে বা তার ঠিক বাইরে ও ভিতরে স্থান-কালের ধর্ম কি হবে তাও তিনি নিখুঁত অঙ্ক কষে দেখালেন।  এই ধরণের ব্যাখ্যা আরও কার্যকরভাবে করার জন্যে তিনি এক বিশেষ ধরণের রেখাচিত্র ব্যবহার করলেন যা পরবর্তীকালে পেনরোজ ডায়াগ্রাম নামে পরিচিত হয়। পেনরোজের এই গোটা তাত্ত্বিক ফলাফলকেই এক কথায় বলা হয় সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য। তাঁর এই গবেষণা প্রকাশিত হবার পর বিজ্ঞানীমহলে অনেকেই এটা মেনে নিলেন যে মহাবিশ্বে কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব না থাকাটাই হবে বিস্ময়কর। এই কাজের জন্যেই ২০২০ সালের নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক অংশ পেলেন রজার পেনরোজ।

এই প্রসঙ্গে আরও দুজন বিজ্ঞানীর কথা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। একজন হলেন স্টিফেন হকিং। পেনরোজ ১৯৬৫ সালে ওই গবেষনাপত্র প্রকাশ করার কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর তত্ত্বকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে হকিং দেখান যে আমাদের সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের অতীতেও অদ্বৈত বিন্দু থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পরবর্তী কয়েক বছরে হকিং আরও কয়েকজন সহযোগী বিজ্ঞানীদের সাথে অনেকগুলি গবেষণাপত্র লিখে প্রমাণ করেন যে আমাদের মহাবিশ্বের অতীতে অদ্বৈত বিন্দু থাকা অবশ্যম্ভাবী। অবশেষে ১৯৭০ সালে হকিং ও পেনরোজ আরেকটি গবেষণাপত্রে স্থান-কালে অদ্বৈত বিন্দু থাকার শর্ত কি হওয়া উচিৎ তার বিশদ বর্ণনা দেন যাকে এখনও অবধি সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্যের সব চেয়ে প্রামাণ্য সংস্করণ বলে ধরা হয়। স্টিফেন হকিং জীবিত থাকলে তিনি এই নোবেল পুরস্কারের একজন দাবিদার হতেন নিঃসন্দেহে।

হকিং ও পেনরোজ আরেকটি গবেষণাপত্রে স্থান-কালে অদ্বৈত বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি থাকার শর্ত কি হওয়া উচিৎ তার বিশদ বর্ণনা দেন।

দ্বিতীয়জন হলেন কলকাতার তদানীন্তন প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক অমল কুমার রায়চৌধুরি তথা একেআর। ১৯৫০-এর দশকের প্রথম ভাগ। একেআর তার কিছুদিন আগে এমএসসি পাশ করেছেন। প্রথমে আশুতোষ কলেজে ও পরে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান অফ কাল্টিভেশান অফ সায়েন্স নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী পদে থাকাকালীন তিনি স্থান-কালে অদ্বৈত বিন্দু থাকতে পারে কিনা তাই নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি স্থান-কালের ‘কার্ভড স্পেসটাইম’ বা বক্রতলে মুক্ত কণা ও আলোর গতিপথ কি হওয়া উচিৎ তার গাণিতিক হিসেব করেন। সেই হিসেব থেকে একটি সমীকরণের মাধ্যমে তিনি দেখান যে স্থান-কাল যদি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব মেনে চলে তাহলে ওই গতিপথগুলি পরস্পরের দিকে সরে যাবে এবং একটি বিন্দুতে মিলিত হতে পারবে। এর থেকে পরোক্ষভাবে দেখানো সম্ভব যে স্থান-কালে অদ্বৈত বিন্দু থাকতে পারে।

ওই সমীকরণ ‘রায়চৌধুরি সমীকরণ’ নামে পরিচিত এবং বর্তমানকালে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ বিষয়ক যে কোনো পাঠ্য বইয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গোলীয় প্রতিসাম্যের শর্ত না ধরে নিয়েও যে স্থান-কালে অদ্বৈত বিন্দুর অস্তিত্ব গাণিতিকভাবে দেখানো সম্ভব এটাই ছিল তাঁর কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল। এটিকে বলা যায় সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্যের একটি প্রাথমিক ধাপ। রজার পেনরোজ ও তাঁর পরবর্তী বিজ্ঞানীরা সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য ও তার নানান দিক নিয়ে যত গবেষণা করেছেন রায়চৌধুরি সমীকরণ সেই সব কাজেরই অন্যতম ভিত্তি। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় যত গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে একেআর-এর এই কাজ অগ্রগণ্য। পেনরোজ, হকিং, এবং তাঁদের সহযোগী বিজ্ঞানীরা তাঁকে নামে চিনতেন এবং পরবর্তীকালে রজার পেনরোজ কলকাতায় তাঁর সাথে দেখা করে সৌহার্দ্যবিনিময় করেছিলেন। গবেষণার সেরকম কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ও কোনো উপদেষ্টা ছাড়া অমল কুমার রায়চৌধুরি যেভাবে বিশ্বমানের গবেষণা করে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফলাফল পেয়েছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে তা বিরল।  

কৃষ্ণগহ্বরের পর্যবেক্ষণ

পেনরোজের গবেষণার মাধ্যমে মহাবিশ্বে কৃষ্ণগহ্বর সত্যিই থাকতে পারে এই সম্ভাবনা প্রকট হলেও পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে হাতেনাতে বিচার না করে কিছু মেনে নেওয়াটা বিজ্ঞানের সংজ্ঞার বাইরে। তাই এরপর শুরু হলো কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব সরাসরি পর্যবেক্ষণের নানা প্রচেষ্টা। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের পর্যবেক্ষণ সহজ নয়। কারণ সেখান থেকে কোনো আলো তথা তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নির্গত হয় না।

একমাত্র উপায় হলো কৃষ্ণগহ্বরের কাছাকাছি থাকা অন্যান্য বস্তুর উপর তার মহাকর্ষীয় প্রভাব দেখে পরোক্ষভাবে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করা। এদিকে সদ্য আবিষ্কৃত কোয়েজারগুলির কেন্দ্রে কৃষ্ণগহ্বর আছে ধরে নিয়ে দেখা গেল তাদের বিপুল পরিমাণ বিকিরণ তো বটেই সেই সাথে তাদের বর্ণালি ও অন্যান্য নানা ধর্ম খুব সহজে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। সুতরাং তাদের কেন্দ্রে যে সত্যিই কৃষ্ণগহ্বর আছে সেই তত্ত্ব বিজ্ঞানীমহলে কিছুটা স্বীকৃত হলো।

এরপর ১৯৮০-র দশকে বিজ্ঞানীরা নানা বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে শুধু কোয়েজার নয় সমস্ত গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের কেন্দ্রেই থাকতে পারে একটি করে কৃষ্ণগহ্বর। কোয়েজারের ক্ষেত্রে তার চারপাশের অনেক বস্তু তার দিকে আকৃষ্ট হয়ে কৃষ্ণগহ্বরটিতে গিয়ে পড়ছে এবং পড়ার আগে বিপুল পরিমাণে শক্তি বিকিরণ করছে। কিন্তু বাকী ছায়াপথগুলির ক্ষেত্রে কৃষ্ণগহ্বরটির চারপাশে যথেষ্ট পরিমাণে উপাদানের সরবারহ নেই। সুতরাং সেখান থেকে কোয়েজারের মতো বেশী মাত্রায় বিকিরণ হচ্ছে না। তাই কৃষ্ণগহ্বরটি রয়েছে অন্তরালে। তাহলে কি আমাদের ছায়াপথ ‘মিল্কি ওয়ে’ বা আকাশগঙ্গার কেন্দ্রেও রয়েছে একটি কৃষ্ণগহ্বর?

কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের উপায় হলো কাছাকাছি থাকা অন্যান্য বস্তুর উপর তার মহাকর্ষীয় প্রভাব দেখে পরোক্ষভাবে প্রমাণ করা।

আকাশগঙ্গার কেন্দ্র আমাদের থেকে ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিরিখে এই দূরত্ব নগণ্য। তার থেকে কোটিগুণ দূরের মহাজাগতিক বস্তু অনায়াসে ধরা পড়ে দূরবীক্ষণ যন্ত্রে। তাহলে তো একবার ভালো করে আকাশগঙ্গার কেন্দ্র অঞ্চলটি পর্যবেক্ষণ করলেই সেই কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের পরোক্ষ প্রমাণ মিলবে।

১৯৯০-র দশকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সেই চেষ্টায় লেগে পড়লেন। কিন্তু সেই পথে অনেক বাধা। আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে নক্ষত্রের ঘনত্ব খুব বেশী এবং নক্ষত্রের জীবনচক্রের কোনো কোনো পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা নক্ষত্রদের থেকে তাদের চারপাশের মাধ্যম অর্থাৎ ‘ইন্টারস্টেলার মিডিয়াম’ বা আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে এসে মেশে। এই মহাজাগতিক ধূলিকণা আলোর গতিবিধিতে বাধা দেয়। ফলে আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের কোনো তারা থেকে যে দৃশ্যমান আলো বেরোয় তার মাত্র দশ কোটি ভাগের এক ভাগ আমাদের দূরবীক্ষণ যন্ত্রে এসে পৌছাতে পারে।

কিন্তু সব তারাই ‘ইনফ্রারেড ওয়েভলেংথ’ বা অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যেও বিকিরণ করে এবং মহাজাগতিক ধূলিকণা সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মিকে খুব একটা বাধা দিতে পারে না। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রথমেই বুঝলেন যে দৃশ্যমান আলো দিয়ে এই পর্যবেক্ষণ করা যাবে না। ব্যবহার করতে হবে অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো এবং খুব শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র যাতে আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের কোনো তারা থেকে খুব ক্ষীণ আলোকসঙ্কেত এলেও ধরা যায়।

পৃথিবীতে দৃশ্যমান এবং অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ সনাক্ত করার সব চেয়ে শক্তিশালী যন্ত্র সেই সময়ে ছিল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মৌনা কিয়া পর্বতচূড়ায় অবস্থিত একজোড়া দূরবীক্ষণ যন্ত্র কেক ১ ও কেক ২। তারা এতোই শক্তিশালী যে কলকাতার মতো শহরের সব মানুষ যদি একসাথে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকান তাহলে যতোটা আলো প্রতি সেকেন্ডে তাদের চোখে ঢুকবে শুধুমাত্র কেক ১ ও কেক ২ প্রতি সেকেন্ডে সনাক্ত করে তার সমপরিমাণ আলো। শুধু তাই নয় চাঁদের উপর মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্বে থাকা দুটি জিনিসকে পৃথিবী থেকে আলাদা করে সনাক্ত করতে পারবে এই দূরবীক্ষণ। এই মহাযন্ত্রদুটিকে চালু রাখতে সারা বছর ওই পর্যবেক্ষণাগারে কাজ করে চলেছেন অনেক বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও কর্মচারী, এবং দৈনিক খরচ হচ্ছে আনুমানিক এক লক্ষ মার্কিন ডলার।  

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলস বা ইউসিএলএ-র জ্যোতির্বিজ্ঞানী আন্দ্রিয়া ঘেজ এবং তাঁর সহকর্মীরা ১৯৯৫ সালে কেক দূরবীক্ষণ ব্যবহার করে আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন। কিন্তু সেখানেও বাধ সাধলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। আমরা জানি যে বায়ুমণ্ডল না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের কোনো অস্তিত্বই থাকতো না। বায়ুমণ্ডলকে যথাযথভাবে রক্ষা করার জন্য চলছে নানা আন্দোলন, দেশবিদেশে পাশ হয়েছে বহু আইন। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণে বায়ুমণ্ডল একটি প্রতিবন্ধক বিশেষ। বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে আসার সময় আলোকরশ্মির ধর্মের কিছু পরিবর্তন ঘটে এবং তার ফলে দূরবীক্ষণে যে প্রতিবিম্ব তৈরি হয় তা হয় বিকৃত। এটি প্রধানত ঘটে কারণ আমাদের আবহাওয়ামণ্ডলের মধ্যে বায়ুস্তরগুলি স্থির নয়। বায়ুপ্রবাহের জন্যে সেগুলির মধ্যে পরিবর্তন ঘটে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণে বায়ুমণ্ডল বাধ সাধে কারণ আবহাওয়ামণ্ডলের মধ্যে বায়ুস্তরগুলি স্থির নয়, যার ফলে আলোকরশ্মির ধর্মের কিছু পরিবর্তন ঘটে।

হয়তো মনে হতে পারে আমরা তো এই বায়ুমণ্ডলের মধ্যেই রয়েছি। আমরা যখন দূরের জিনিস দেখি সেখানে তো কোনো বিকৃতি ঘটে না? তার কারণ আমরা দূরবীক্ষণের মতো সূক্ষ্মভাবে দেখি না। কিন্তু যদি আমরা পুকুর বা সুইমিং পুলের জলে ডুব দিয়ে জলের নিচ থেকে দেখি তাহলে বাইরের মানুষজন বা গাছপালা আমাদের চোখে বিকৃত ভাবে দেখা যায়, বিশেষ করে যদি জলটা স্থির না হয়। ভূপৃষ্ঠে থাকা যে কোনো দূরবীক্ষণে যেখানে দৃশ্যমান বা তার কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোয় পর্যবেক্ষণ করা হয় সেখানেই এই অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়। আন্দ্রিয়া ঘেজদের ক্ষেত্রে এই অসুবিধা ছিল বিশেষভাবে প্রকট কারণ তাঁরা চাইছিলেন খুব ক্ষীণ এবং পরস্পরের খুব কাছাকাছি থাকা একাধিক নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করে তাদের গতিপথ বুঝতে। তাহলে উপায়?

ছবি ১ – চিলির ভিএলটি দূরবীক্ষণে অ্যাড্যাপটিভ অপটিক্সের ব্যবহার (সূত্র – ইউরোপিয়ান সাদার্ন অবজারভেটারি)

এই বাধা অতিক্রম করতে তাঁরা দুটি প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করলেন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে যেগুলির ব্যবহার অল্প কিছুদিন আগে শুরু হয়েছিল। যেহেতু প্রতিবিম্বের বিকৃতির প্রধান কারণ সময়ের সাথে সাথে বায়ুস্তরের পরিবর্তন তাই তাঁরা একেকটি দীর্ঘসময়ের প্রতিবিম্বের বদলে অনেকগুলি স্বল্প সময়ের প্রতিবিম্ব নিয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশেষ পদ্ধতিতে সেগুলিকে সমন্বয় করে অবিকৃত প্রতিবিম্বটি তৈরি করলেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘স্পেকল ইমেজিং’। ২০০০-এর দশকে তাঁরা ব্যবহার করলেন আরও উন্নত একটি পদ্ধতি যা আগামী দিনে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের রূপরেখা বদলে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। তার নাম ‘অ্যাড্যাপটিভ অপটিক্স’। এই পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণাগার থেকে আকাশের দিকে লেসার রশ্মি নিক্ষেপ করা হয় (ছবি ১)। সেই লেসার রশ্মি  বায়ুমণ্ডলের একটি বিশেষ স্তরে প্রতিফলিত হয়ে নক্ষত্রের মতো কিন্তু কৃত্রিম একটি আলোর উৎস হিসেবে কাজ করে। সেই কৃত্রিম নক্ষত্রের প্রতিবিম্ব বায়ুমণ্ডলের দরুন কতটা বিকৃত হচ্ছে সেটা কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে তৎক্ষণাৎ সেই অনুযায়ী আসল নক্ষত্রের প্রতিবিম্বটিকে পরিমার্জনা করে তার অবিকৃত রূপটি নির্ধারণ করা হয়। এই দুই পদ্ধতি ব্যবহার করে আন্দ্রিয়া ঘেজ এবং তাঁর সহকর্মীরা পনেরো বছর ধরে নিয়মিত আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করে সেখানের অনেকগুলি নক্ষত্রের গতিবিধি খুব সূক্ষ্মভাবে নির্ধারণ করতে পারলেন।

এত দীর্ঘ এবং কৌশলী পর্যবেক্ষণ করে শেষমেশ কি জানা গেল? জানা গেল যে আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্যের চেয়ে চল্লিশ লক্ষগুণ বেশী ভরের একটি বস্তু বা বস্তুসমষ্টি। কিন্তু সেখান থেকে কোনো আলো আসছে না। শুধু তাইই নয় এই বস্তুটির আয়তন আমাদের সৌরজগতের থেকে বড় নয়। মনে রাখতে হবে যে আমাদের সৌরজগতের যা আয়তন তাতে পাশাপাশি রাখলে প্রায় দশহাজারটি সূর্য সেখানে ধরে যেতে পারে। কিন্তু চল্লিশ লক্ষটি সূর্যের সমান ভরের কোনো বস্তু অত কম জায়গায় থাকলে পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী তাদের পক্ষে স্থিতাবস্থায় থাকা সম্ভব নয়। তাদের মিলিত মহাকর্ষবলের অমোঘ প্রভাবে তারা একটি বিন্দুতে মিলিত হবে। অর্থাৎ তৈরি হবে একটি অদ্বৈত বিন্দু তথা কৃষ্ণগহ্বর। ঠিক কিভাবে বিজ্ঞানী ঘেজ ও তাঁর সহকর্মীরা তাদের পর্যবেক্ষণ থেকে বস্তুটির ভর ও আয়তনের হিসেব পেলেন? তার জন্য ছবি ২ দেখুন। ছবিটিতে আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের তারাগুলির গতিপথ দেখানো হয়েছে। আর ছবির ঠিক মাঝখানের কালো বৃত্তটি হলো আকাশগঙ্গার কেন্দ্রবিন্দু। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি তারা – এস০-২ এবং এস০-১৬। প্রথমটি তার কক্ষপথটি সম্পূর্ণ করেছে। অর্থাৎ কেন্দ্রের চারদিকে একবার পুরো ঘোরা হয়ে গেছে এস০-২ তারাটির। সেখান থেকে কেপলারের সূত্র তথা নিউটনিয় মহাকর্ষের নিয়ম ব্যবহার করে খুব সহজেই নির্ণয় করা যায় কেন্দ্রীয় বস্তুটির ভর। আর এস০-১৬ তারাটি তার কক্ষপথ অনুসরণ করে চলার সময় কেন্দ্রবিন্দুটির খুব কাছ দিয়ে চলে গেছে। তার থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কেন্দ্রে যে ভারি বস্তুটি রয়েছে তার আয়তন বেশী নয়। যদি হতো তাহলে এস০-১৬ সেখানে ধাক্কা খেতো।

ছবি ২ – আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে তারাদের গতিপথ (সূত্র – ইউসিএলএ গ্যালাকটিক সেন্টার রিসার্চ গ্রুপ, পরিমার্জনা – লেখক)

দীর্ঘ এবং কৌশলী পর্যবেক্ষণর শেষে জানা গেল যে আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্যের চেয়ে চল্লিশ লক্ষগুণ বেশী ভরের একটি বস্তু বা বস্তুসমষ্টি যেখানে থেকে কোনো আলো আসছে না।

কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে অত্যাধুনিক ও জটিল এই পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে পাওয়া ফলাফলের উপরে এককভাবে নির্ভর করে মহাজাগতিক কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা চট করে মেনে নিতে পারেন না। তাঁরা চান যে সেই ফলাফল কোনো স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে যাচাই করা হোক।

সৌভাগ্যক্রমে সেই সুযোগও পাওয়া গেল। জার্মানির গারকিংয়ে অবস্থিত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিক্স প্রতিষ্ঠানের সহঅধিকর্তা রাইনহার্ড গেনজেল ও তাঁর সহকর্মীরা ১৯৮০-র দশক থেকে এই ধরনের পর্যবেক্ষণ করছিলেন। প্রথমে তাঁরা আন্তর্নক্ষত্র মাধ্যমে যেসব গ্যাসীয় পদার্থ ও আয়ন থাকে তার গতি নির্ণয় করে আকাশগঙ্গার কেন্দ্র অভিমুখে একটি বড় অঞ্চলের মোট ভর গণনা করেন। এরপর কেন্দ্রের খুব কাছাকছি একটি সুনির্দিষ্ট ছোটো অঞ্চলের মোট ভর পাওয়ার জন্য ১৯৯০-এর দশকে তাঁরা ইউরোপিয়ান সাদার্ন অবজারভেটারির ‘নিউ টেকনোলজি টেলিস্কোপ’ এবং স্পেকল ইমেজিং পদ্ধতি ব্যবহার করে আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের তারাদের গতি নির্ধারণ করেন। ওই দূরবীক্ষণ অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী হওয়ায় তারাগুলি কেন্দ্রের একেবারে কাছাকাছি ছিল না কিন্তু কেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরের নক্ষত্রদের গতি থেকে তাঁরা কেন্দ্রীয় বস্তুটির যে ভর নির্ণয় করছিলেন তা একইরকম। পরবর্তীকালে ‘ভিএলটি’ নামক আরও শক্তিশালী দূরবীক্ষণে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করে করে ওনারাও আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে আমাদের সৌরজগতের সমান আয়তনের অঞ্চলের মোট ভর নির্ণয় করেন এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ ফলাফল পান।

দুটি আলাদা আলাদা বিজ্ঞানীদল দুটি ভিন্ন দূরবীক্ষণযন্ত্র এবং নিজস্ব বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে একই ফলাফল পাবার পর এই নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ রইলো না যে আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্যের চেয়ে চল্লিশ লক্ষ গুণ বেশী ভরের একটি বস্তু যার আয়তন আমাদের সৌরজগতের থেকে বড় নয়। পৃথিবীর সব চেয়ে শক্তিশালী দূরবীক্ষণ দিয়েও সেখান থেকে কোনো বিকিরণ সনাক্ত করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা থেকে কৃষ্ণগহ্বরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যা জানা যায় তার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে এই বস্তুটির ধর্ম। ২০১০-এর পর থেকে বেশীরভাগ বিজ্ঞানীই মেনে নিলেন যে আকাশগঙ্গার কেন্দ্রে রয়েছে একটি কৃষ্ণগহ্বর। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে আকাশগঙ্গার কেন্দ্রীয় কয়েকশো আলোকবর্ষের মধ্যে যে সূর্যের দশকোটিগুণ বা তার কিছু বেশী ভর রয়েছে সেটা ১৯৮০-৯০-এর দশকের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে কিছুটা জানা ছিল। কিন্তু সেই ভর যে এত ক্ষুদ্র একটি আয়তনের মধ্যে রয়েছে, যার ব্যাসার্ধ কয়েক আলোক-ঘন্টা বা তার কম, সেটা ঘেজ ও গেনজেলদের অতিসূক্ষ্ম ও সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণের আগে জানা ছিল না। আর এই জন্যেই আন্দ্রিয়া ঘেজ ও রাইনহার্ড গেনজেল ২০২০ সালের নোবেল পুরস্কারের যথাক্রমে এক চতুর্থাংশ করে পেলেন।   

শেষের কথা

রজার পেনরোজের সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্য সংক্রান্ত বিষয়ের অগুনিত শাখাপ্রশাখা ও তাদের প্রয়োগ আধুনিক পদার্থবিদ্যা ও গাণিতিক তত্ত্বের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আন্দ্রিয়া ঘেজ ও রাইনহার্ড গেনজেলদের পর্যবেক্ষণ এখনও চলছে। ছায়াপথের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এক ধরণের নতুন মহাজাগতিক বস্তু আবিষ্কার হয়েছে। কিছু ছোটো গ্যাসীয় পিণ্ড যেগুলি তাদের কক্ষপথে চলাকালীন কেন্দ্রীয় ভরটির প্রভাবে তাদের আকার পরিবর্তন করে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেমন হওয়ার কথা যদি কেন্দ্রবিন্দুতে একটি কৃষ্ণগহ্বর থাকে। এগুলির নাম দেওয়া হয়েছে ‘টাইডাল ডিসরাপশান ইভেন্ট’। সারা বিশ্বের অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দূরবীক্ষণ যন্ত্রে এই বস্তুগুলিকে পর্যবেক্ষণ করে কৃষ্ণগহ্বরজাতীয় বস্তুর কাছে তরল বা গ্যাসের প্রবাহ কেমনভাবে শুরু হতে পারে সেই সংক্রান্ত তত্ত্বের হাতেকলমে চর্চা করছেন যা এর আগে সম্ভব ছিল না। সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জের কেন্দ্রেই রয়েছে একটি করে কৃষ্ণগহ্বর এই তত্ত্ব আরও সুনিশ্চিত হওয়ায় নক্ষত্রপুঞ্জের গঠন ও বিবর্তনে তাদের কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বরের বিশেষ ভূমিকা আছে এরকম মনে করা হচ্ছে। এই ধারণা মহাবিশ্বের সাম্প্রতিক বিবর্তনের যে উপস্থিত তত্ত্ব তাতে অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। রজার পেনরোজ, আন্দ্রিয়া ঘেজ ও রাইনহার্ড গেনজেলদের গবেষণার এইসব সুদূরপ্রসারী প্রভাবই তাঁদের সব চেয়ে বড় সাফল্য যা নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির থেকে কম নয়।

আরেকটি কথা না বলে শেষ করা যায় না। পদার্থবিদ্যার নোবেলের ১২০ বছরের ইতিহাসে ২১৬ জন এই পুরষ্কার পেয়েছেন। আন্দ্রিয়া ঘেজ তাঁদের মধ্যে মাত্র চতুর্থ মহিলা। মাঝে মাঝে আশঙ্কা হয় এমন নয় তো যে ঐতিহাসিক ও সামাজিক নানা কারণের চোরাস্রোতে মনুষ্যসমাজের অর্ধেক সদস্য — অর্থাৎ মহিলারা — বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপে পুরোমাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন না? এই প্রশ্ন আমাদের নিজেদেরকেই করতে হবে। আর আমরা সবাই জানি অনুপ্রাণিত হবার জন্য দরকার হয় রোলমডেল বা অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।  আন্দ্রিয়া ঘেজের নোবেল পুরস্কারের খবর পড়ার পর যদি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকটি স্কুলপড়ুয়া মেয়ে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কল্পনা করতে চায় তারাদের অদৃশ্য কক্ষপথ আর পরের দিন সকালে যদি পড়াশোনায় আরেকটু বাড়তি মনযোগ দেওয়ার উৎসাহ পায় বা তাদের অভিভাবকরা যদি তাদের স্কুলছুট না করার মতো মনের জোর পান তাহলে তা হবে নোবেলের চেয়েও বড় পুরস্কার।।


প্রচ্ছদের ছবির সূত্র: ZMEScience

টীকা –

[১] স্পেসটাইম বা স্থান-কাল নিয়ে বিশদে জানতে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত এই লেখাটি পড়ুন: https://bigyan.org.in/2016/05/23/gravitational-wave-detection-ligo_1/

এই বিষয়ে আরও বিশদ জানার জন্যে নিচের লিঙ্কগুলি দেখা যেতে পারে।

রজার পেনরোজ ও অমল কুমার রায়চৌধুরির কাজের ব্যাপারে বিমান নাথের লেখা — https://epaper.sangbadpratidin.in/epaper/m/470894/5f826b33b1866?fbclid=IwAR2QbSFWnE_YZ9EDwMj9aeorUdXpha_XeXRqdijvVT_OpEDGyarHqNpF-yQ

ব্ল্যাকহোল প্রসঙ্গে সুপ্রতীক পালের লেখা —  https://bigyan.org.in/2020/06/26/back-in-black/?fbclid=IwAR1PntgWwZFRDahg0NN9uLf6zvlGlTYN9i4XsMKwZ6YLRnqEIEhy9kZLOPI   

অমল কুমার রায়চৌধুরির কাজের ব্যাপারে পার্থসারথি মজুমদারের লেখা — https://www.telegraphindia.com/science-tech/solitary-pursuit/cid/1537314?fbclid=IwAR0Gjq7IL6qqyTBij356EbfAeToc5mV1AFVETFEj4lp-nsuTC5QQjl7vR90

আন্দ্রিয়া ঘেজ ও তাঁর সহকর্মীদের ওয়েবসাইট — http://www.astro.ucla.edu/~ghezgroup/gc/animations.html

আন্দ্রিয়া ঘেজের বক্তৃতায় তাঁর নিজের কাজের ব্যাখ্যা —

সোমক রায়চৌধুরির বক্তৃতায় আন্দ্রিয়া ঘেজদের পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা —

বর্তমান বিশেষজ্ঞদের চোখে পেনরোজের ১৯৬৫ সালের গবেষণাপত্রের তাত্ত্বিক মূল্যায়ণ — https://arxiv.org/pdf/1410.5226.pdf

The post কৃষ্ণগহ্বরের তত্ত্ব, পর্যবেক্ষণ ও নোবেল পুরস্কার ২০২০ appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

একটা দূরত্বের পর কি বস্তুর মহাকর্ষ শূন্য ধরা যায়?

$
0
0

কোনো বস্তুর মহাকর্ষকে একটা দূরত্বের পর শূন্য ধরে নেওয়া একটা approximation (আসন্নায়ন)। এই approximation-টা কখন খাটে না?


-১-

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আমাদের বলে কোনো একটা বস্তুর (আরেকটি বস্তুর ওপর) মহাকর্ষ বল F তাদের দূরত্ব R-এর বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক:

F \propto \frac{1}{R^2}

অর্থাৎ দূরত্ব যত বাড়ে, বল তত কমতে থাকে, কিন্তু কখনোই শূন্য হয়ে যায় না। তা সত্ত্বেও পাঠ্যবইয়ে অনেক সময় লেখা থাকে যে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের পর এই বলের মান এতটাই কমে যায় যে তাকে শূন্য ধরা যায়। কিন্তু ওই নির্দিষ্ট দূরত্বটা ঠিক কত? মহাকর্ষ বল ঠিক যতটা কম হলে তাকে শূন্য ধরা যায় তারও কি একটা নির্দিষ্ট মান আছে? এই প্রবন্ধে একটা ছোট্ট পরীক্ষা আর কিছু সহজ গণনার দ্বারা আমরা এই প্রশ্নগুলো অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবো।

শুরু করার আগে প্রশ্নটা আরেকবার বলি: কতটা দূরত্বে গেলে মহাকর্ষ বলকে শূন্য ধরা যায়? এই প্রশ্নটা যদি কেউ করে, তাকে প্রথমে পাল্টা প্রশ্ন করতে হবে: বাপু তুমি কি করছো যার জন্য মহাকর্ষ বলকে ধরা না ধরার প্রশ্ন আসছে? কিসের অঙ্ক করছো? এটা জানা জরুরি কারণ পৃথিবীর চারিদিকে চাঁদের গতিবিধি  আর বৃহস্পতির চারিদিকে তার উপগ্রহ ইউরোপা-র গতিবিধি, এই দুটো অঙ্ক কষতে গেলে অবশ্যই আলাদা জিনিস ধরতে হবে।

ধরা যাক, আমি আপাতত পৃথিবী নিয়েই ভাবছি আর একটা খুব সহজ অঙ্ক কষছি। দাঁড়ানো অবস্থায় একটা কমলালেবু আমার মাথার কাছে নিয়ে এসে ছেড়ে দিলাম। লেবুটা মাটিতে পড়তে কতটা সময় নেবে? এই অঙ্কটা কষতে গেলে পৃথিবীর মহাকর্ষকে অবশ্যই ধরতে হবে। প্রশ্ন হলো, চাঁদের মহাকর্ষও ধরতে হবে কি? সেই তদন্তটাই করা যাক।

লেবুটা মাটিতে পড়তে কতটা সময় নেবে, এই প্রশ্নের উত্তর দুভাবে দেওয়া যায়। প্রথমতঃ আমি বাবাকে বলতে পারি স্মার্টফোনের ক্যামেরায় আমার লেবু ফেলার একটা ভিডিও তুলতে। তারপর একটা ভিডিও প্লেয়ার অ্যাপ (যেমন VLC) ব্যবহার করে ভিডিও ফাইলটার যে ফ্রেমে লেবু হাত থেকে ছাড়া পেলো আর যে ফ্রেমে লেবু মাটি স্পর্শ করলো তাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান মেপে ফেলতে পারি। এই দ্বিতীয় ধাপটা  আমি নিজে যেভাবে করেছিলাম তার বিস্তারিত বিবরণ লেখার নিচে দেখো। (আরেকটা ছোট্ট কথা এই ফাঁকে বলে রাখি। ধরে নিচ্ছি এই সময়ের ব্যবধানটা আমরা মাপতে পারলাম সেকেন্ডের এক দশমিক স্থান পর্যন্ত। এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ একটু পর বোঝা যাবে।)

দ্বিতীয়তঃ আমি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র আর দ্বিতীয় গতিসূত্র ব্যবহার করে সময়টা কষে বার করার চেষ্টা করতে পারি। ঠিকমতো করতে পারলে দুটোর মান সমান হওয়া উচিত, তাই তো? আপাততঃ বাবা রান্নাঘরে, তাই আমরা অঙ্কটা কষার চেষ্টা করি। পৃথিবী লেবুকে অভিকর্ষ বলের দ্বারা নিচের দিকে টানছে, তাই সে নিচে পড়ে। ধরি, লেবুর ভর m, পৃথিবীর ভর M, এবং পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R।  তাহলে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী এই বলের পরিমাণ:

F = \frac{G \cdot M \cdot m}{R^2}

বলের পরিমাণ যখন জানা গেলো, আমরা নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র ব্যবহার করে লেবুর ত্বরণ গণনা করতে পারি:

g= \frac{F}{m} = \frac{G \cdot M}{R^2}

মজার ব্যাপার লক্ষ্য করো: ত্বরণ কিন্তু লেবুর ভর m-এর  ওপর নির্ভর-ই করে না! অর্থাৎ, লেবুই ফেলি কি ওষুধের বড়ি কি পাথরের চাঁই, এই ত্বরণের মান একই হওয়া উচিত। এই সমীকরণে সার্বজনীন মহাকর্ষ ধ্রুবক G = 6.67 x 10-11  m3 kg-1 s2, M = 5.97 x 1024 kg, এবং R = 6.37 x 106 m বসিয়ে পাই:

g = 9.8m/s^2

আচ্ছা এখানে g-এর মান দশমিকের পর দুটো কি তিনটে স্থান পর্যন্ত  গণনা করলাম না কেন? তার কারণ আমি এই g ব্যবহার করে যে সময়টা কষে বার করব, সেটা বাবা আমায় যে সময়টা বলবে তার সাথে তুলনা করার জন্য দশমিকের পর একটা অঙ্কই যথেষ্ট। কারণ আগে বলেছি ভিডিও থেকে সময় বের করতে গিয়ে আমি সেকেন্ডের এক দশাংশ পর্যন্তই মাপতে পেরেছি। উদাহরণস্বরূপ, আমার গণনায় সময় যদি বেরোয় 0.78 s, তার 8 অংকটি আমার পরীক্ষার প্রসঙ্গে অর্থহীন। কারণ সেটা 8 না হয়ে 6 কি 7 হলেও ভিডিও থেকে সময় মাপার পদ্ধতিতে সেটা কতদূর সঠিক বুঝতে পারবো না। সুতরাং সেক্ষেত্রে দশমিক বিন্দুর পর প্রথম স্থান পর্যন্ত আসন্ন মান হিসেবে আমরা লিখতে পারি  0.78 s ≈ 0.8 s.

এবার এই ত্বরণের থেকে বার করতে হবে কতটা সময় লাগলো পড়তে। তবেই হাতে-কলমে পরীক্ষা থেকে মাপা সময়ের সাথে তুলনা করে দেখা যাবে মিলছে কিনা। ধরা যাক আমার উচ্চতা h = 5 foot = 1.5 m, আর এই দূরত্ব অতিক্রম করতে লেবু t সময় নেয়। তাহলে:

h = \frac{1}{2}gt^2\implies t = \sqrt\frac{2h}{g}  \approx 0.6s

বাবার রান্না শেষ হলে লেবু ফেলার ভিডিও তুলে তার থেকে সময় মাপা হলো। মিলেও গেলো!

[বাবা, মা, মাসি, পিসি কাউকে একটা ধরে আর একটা স্মার্টফোন জোগাড় করে এই খেলাটা তোমরাও খেলতে পারো। খালি মনে রেখো যে উচ্চতা থেকে লেবু বা টেনিস বল বা ওষুধের বড়ি ফেলছো সেটাকে উপরের সমীকরণে h-এর জায়গায় বসিয়ে t-এর মান গণনা করে নিতে হবে।]

এবার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে আসা যাক। খালি পৃথিবী না, চাঁদও তো লেবুকে অভিকর্ষ বলে নিজের দিকে টানছিলো। আমাদের অঙ্কে সেই আকর্ষণ বল ধরতে হবে কি? হিসেব করে দেখা যাক চাঁদের আকর্ষণের জন্যে লেবুর ত্বরণ (g\sp{\prime}) কত হবে। আগের পরিচ্ছেদের গণনা এখানেও খাটবে। অর্থাৎ,

g\sp{\prime}= \frac{G \cdot M\sp{\prime}}{{R\sp{\prime}}^2}

এক্ষেত্রে চাঁদের ভর M\sp{\prime} = 7.35 \times 10^{22} kg এবং পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব R\sp{\prime} = 3.84 \times 10^8 m.

প্রথমেই g\sp{\prime} এর একটা নিখুঁত মান নির্ণয় না করে এটা দেখা যাক করা যে মোটের ওপর g\sp{\prime} কি g-এর তুলনায় খুব ছোট (g\sp{\prime} \ll g), নাকি খুব বড়ো (g\sp{\prime} \gg g), নাকি মোটামুটি ওরা একে ওপরের কাছাকাছি (g\sp{\prime} \approx g)? [এই তিনটের কোনটা ঠিক আন্দাজ করতে পারো ?] চট করে একটা “মোটের-ওপর” গণনা করার জন্যে আমরা G, M\sp{\prime}, এবং R\sp{\prime} এর সঠিক মানগুলোর জায়গায় তাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী 10 এর ঘাত ব্যবহার করতে পারি[1] :

G = 6.67 \times 10^{-11}m^3kg^{-1}s^2
\approx 10 \times 10^{-11} m^3 kg^{-1} s^2
= 10^{-10} m^3 kg^{-1} s^2

M\sp{\prime} = 7.35 \times 10^{22} kg \approx 10 \times 10^{22} kg = 10^{23} kg
R\sp{\prime} = 3.84 \times 10^8 kg \approx 1 \times 10^8 kg = 10^8 kg

এই মানগুলো সমীকরণে বসিয়ে পাই:

g\sp{\prime} \approx \frac{10^{-10} \times 10^{23}}{(10^{8})^2} ms^{-2}  = 0.001 ms^{-2}

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আমাদের এই ছোট্ট পরীক্ষার প্রসঙ্গে চাঁদ পৃথিবী থেকে এতটাই দূরে আছে যে তার অভিকর্ষকে শূন্য ভাবা যায়। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে এটা প্রসঙ্গনির্ভর সত্য। যদি আমার স্কুলে এমন কোনো যন্ত্র থাকে যা দশমিকের চতুর্থ স্থান পর্যন্ত t মাপতে পারে, তখন কিন্তু চাঁদের অভিকর্ষকে শূন্য ভাবা যাবে না! কারণ ওই 0.001m/s^{-2} এর তফাতও তখন ধরা পড়বে।

তাহলে দাঁড়ালো এই যে, কোন বস্তুটার মহাকর্ষ বল ধরবো আর কোনটাকে শূন্য বলে ধরে নেব, সেটা নির্ভর করছে কোন পরীক্ষার ফলাফলের সাথে অঙ্ক মেলাচ্ছি আর কতটা সূক্ষ্মভাবে সেই পরীক্ষাটা করা যাচ্ছে। যদি কোনো বস্তুর মহাকর্ষ ধরার জন্য উত্তরে এমন তফাৎ হয় যেটা আমার যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষাতে ধরাই পড়বে না, তাহলে সেই বস্তুর মহাকর্ষ ধরে লাভ নেই, পারতপক্ষে তাকে শূন্যই বলা চলে। যেমন, আমার অঙ্কটাতে স্টপওয়াচ যদি দশমিক সংখ্যা অব্দি মাপতে পারে, তখন লেবু ফেলার অঙ্কটাতে চাঁদের মহাকর্ষকে শূন্য বলা চলে।

তাই বলে, “নির্দিষ্ট দূরত্বের পর একটা বস্তুর মহাকর্ষ শূন্য হয়ে যায়”, এটা বলার কোনো মানে হয়না। বড়োজোর বলা যেতে পারে, “নির্দিষ্ট দূরত্বের পর একটা বস্তুর মহাকর্ষ থাকে ঠিকই কিন্তু সেটা ধরলে অঙ্কের উত্তরে যে তফাৎ হয়, সেটা যৎসামান্য। সেই যৎসামান্য তফাৎ যদি মাপতে না পারি আমার যন্ত্রে, তাহলে বস্তুটার মহাকর্ষ ধরে লাভ নেই।” অনেকসময় আলোচনার সুবিধের জন্য সহজ করে বলা হয় কিছু কথা। “মহাকর্ষ শূন্য হয়ে যায়” এই কথাটাও সেরকমভাবে বলা। কিন্তু এই সহজ করে বলার ফলে মাথায় একটা ভুল ধারণা রয়ে যেতে পারে যার ফলে ক্ষেত্রবিশেষে সমস্যা হতে পারে। যেমন, সূক্ষ্ম সময় মাপার যন্ত্র থাকলে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ না ধরলে তখন কিন্তু সমস্যা হবে।

[1] এই ধরণের চটজলদি গণনা বিজ্ঞান গবেষণার একটা বড় হাতিয়ার। একে বিজ্ঞানীরা back-of-envalope calculation বা খামের উল্টোপিঠে গণনা বলে থাকেন।


ভিডিও ফাইল থেকে t কিভাবে মাপলাম

পরীক্ষাটা করতে আমি লেবুর বদলে টেনিস বল ব্যবহার করেছিলাম। তোমরা যেকোনো অভঙ্গুর বস্তুপিন্ড ব্যবহার করতে পারো।

  1.  আমার বন্ধুকে বললাম তার স্মার্টফোনের ক্যামেরায় আমার বল ফেলার ভিডিও তুলতে। এটাও বলে দিলাম যে ভিডিওতে বলসমেত আমার হাত আর মাটির যেখানে বলটা পড়বে এই দুটোই  যেন দেখা যায়। ভিডিও ফাইলটা নিচে দেওয়া আছে। বলটা এখানে ৫ ফুট উচ্চতা থেকে ছাড়া হয়েছে।  ভিডিও তোলার আগে এই উচ্চতাটা টেপ দিয়ে শুরুতে মেপে নিয়েছিলাম।  
  2. ভিডিও ফাইলটা স্মার্টফোন থেকে আমার কম্পিউটারে ট্রান্সফার করলাম। 
  3. কম্পিউটারে VLC প্লেয়ারে ভিডিওটা খুললাম।  
  4. কিবোর্ডের E বোতাম টিপে টিপে VLC-তে খোলা ভিডিওটার একটা একটা করে ফ্রেম এগোনো যায়। এইভাবে ফ্রেম এগিয়ে এগিয়ে দেখলাম প্রথম এক সেকেন্ডে 30 টা ফ্রেম আছে। অর্থাৎ দুটো ফ্রেমের মধ্যে সময়ের ব্যবধান গড়ে 1/30 সেকেন্ড।
  5. বলটা আমার হাত থেকে যখন ছাড়া পেলো, সেইখান থেকে শুরু করে E বোতাম টিপে টিপে একেকটা করে ফ্রেম এগোলাম। গুণে গুণে 17 টা ফ্রেম এগোনোর পর বলটা মাটি ছুঁলো। তাহলে বলটা ফুট পড়তে সময় নিলো t = 17/30 সেকেন্ড = 0.6 সেকেন্ড। 

আরেকটা জিনিস: পরীক্ষাটা একবার করলে নানা কারণে মাপের একটু ভুলচুক হতেই পারে। সেটা কাটাতে পরীক্ষাটা বেশ কয়েকবার করে সবকটা মানের গড় নেওয়া উচিত। এটা শুধু এই পরীক্ষা নয়, বিজ্ঞানের যেকোনো পরীক্ষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

The post একটা দূরত্বের পর কি বস্তুর মহাকর্ষ শূন্য ধরা যায়? appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

করোনা ভ্যাকসিন-এর কার্যকারিতা এবং সীমাবদ্ধতা

$
0
0

ভ্যাকসিন কি সত্যিই আমাদের মুক্তি দেবে Covid-১৯-এর হাত থেকে? ভ্যাকসিন নিলেই কি আমরা সুরক্ষিত?


এই বিষয়টি নিয়ে এখনও পুরোদমে গবেষণা চলছে এবং নিত্যনতুন তথ্য সামনে আসছে। প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে ২৯.১১.২০২০ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে।

করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-2) ভ্যাকসিনের (টিকা) কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে একটা ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে ঠিক কি প্রভাব ফেলে। এর জন্য সবার আগে বোঝা দরকার কোনো সংক্রমণ হলে মানব শরীর কি ভাবে তা প্রতিরোধ করে।

যখন কোনো ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, তখন তার মূল লক্ষ্য হলো নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। জীবাণু আমাদের শরীরের বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে এই উদ্দেশ্য সফল  করে এবং এর ফলেই আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। আবার মানব দেহের ইমিউন সিস্টেমও তৈরি থাকে নানান অস্ত্র নিয়ে সংক্রমণ ঠেকাবার জন্য।

ইমিউন সিস্টেম-এর নানান অস্ত্র

আমাদের শরীরে ইমিউনিটি বা অনাক্রম্যতার দুটো ধাপ দেখা যায়। প্রথম ধাপ হলো ইননেট ইমিউনিটি, যাকে বলা যেতে পারে ‘first line of defence’। কোনো জীবাণুর সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায় (কয়েক মিনিট অথবা ঘন্টার মধ্যেই)। জীবাণুর কোষে বেশ কিছু প্যাটার্ন দেখতে পাওয়া যায়, যা শুধুমাত্র জীবাণুদের ক্ষেত্রেই থাকে। ইননেট ইমিউনিটি-তে আমাদের শরীর এই প্যাটার্ন দেখেই শত্রুদের চিহ্নিত করে। শত্রুকে চিহ্নিত করার পর এক বিশেষ ধরণের কোষ মাঠে নেমে পড়ে, এদেরকে বলে ম্যাক্রোফেজ (macrophage)। এটা এক বিশেষ ধরণের শ্বেত রক্ত কণিকা, যে বিভিন্ন জীবাণু অথবা কোনো মৃত কোষকে এক কথায় গিলে ফেলতে পারে। তবে এই ইননেট ইমিউনিটি দীর্ঘমেয়াদী নয়। কিন্তু ইননেট ইমিউনিটি সজাগ হওয়ার ফলে যে ম্যাক্রোফেজগুলো সক্রিয় হয়, এরাই পরের ধাপের ইমিউন রেস্পন্সকে কাজ করতে উদ্যত করে।

দ্বিতীয় ধাপ হলো এডাপ্টিভ বা অর্জিত ইমিউনিটি, এটাই কিন্তু কোনো জীবাণুর থেকে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা দেয়। এডাপ্টিভ ইমিউনিটি ঘটাতে সাহায্য করে কিছু বিশেষ ধরণের শ্বেত রক্ত কণিকা, বি-লিম্ফোসাইট বা বি-কোষ (B-lymphocyte) এবং টি-লিম্ফোসাইট বা টি-কোষ (T-lymphocyte)। বি-কোষ প্রধানত অস্থি মজ্জা বা বোনম্যারো (bone marrow) থেকে তৈরি হয়, আর সেই কারণেই ‘B’ কোষ নামকরণ। এরা মূলত অ্যান্টিবডি (antibody) তৈরি করে যেগুলো পরবর্তী কালে জীবাণু থেকে আসা একটা বিশেষ উপাদান (অ্যান্টিজেন)-কে আক্রমণ করে। এই অ্যান্টিবডি যেহেতু আমাদের শরীরের ফ্লুইড বা হিউমোর (humor) থেকে সনাক্ত করা যায়, তাই এই ধরণের প্রতিক্রিয়াকে বলে হিউমোরাল ইমিউন রেসপন্স। আবার টি-কোষর উৎসও সেই  অস্থি মজ্জা, কিন্তু অপরিণত অবস্থায় এরা থাইমাস (১) (thymus)-এ চলে যায় এবং সেখান থেকেই পরিণত টি-লিম্ফোসাইট তৈরি হয়। আর সেই কারণেই ‘T’ কোষ নাম। সংক্রমিত কোষদেরকে আক্রমণ করে নষ্ট করে ফেলাই এদের প্রধান কাজ।

শত্রু চিনতে শেখা

প্রথম বার কোনো কাজ করতে আমার বা আপনার যেমন কিছুটা সময় লাগে শিখতে, ঠিক তেমনই প্রথম বার কোনো সংক্রমণ ঘটলে আমাদের শরীরের বেশ খানিকটা সময় লেগে যায় শত্রুকে চিহ্নিত করে রোগ প্রতিরোধ করতে। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি আবার একই ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস-এর আক্রমণ হয় তখন কিন্তু মোটেই আমাদের ইমিউন সিস্টেম এক মুহূর্ত দেরি করেনা শত্রুকে চিনতে। একটা বিশেষ ধরণের বি এবং টি-লিম্ফোসাইট-এর জন্য এটা সম্ভব হয়, এদের বলে মেমরি কোষ বা ইমিউন সিস্টেমের স্মৃতি শক্তি। কোনো চেনা জীবাণু দেখলেই এই মেমরি কোষ বি-লিম্ফোসাইট-কে অ্যান্টিবডি তৈরির নির্দেশ দিয়ে দেয়।

প্রথম বার কোনো সংক্রমণ ঘটলে আমাদের শরীরের বেশ খানিকটা সময় লেগে যায় শত্রুকে চিহ্নিত করে রোগ প্রতিরোধ করতে।

এইবার আসি ভ্যাকসিনের কথায়। এই যে এতক্ষণ অচেনা শত্রুর প্রথম আক্রমণের কথা বললাম, ভ্যাকসিন ঠিক এই ঘটনাটাকেই অনুকরণ করে। এর দুটো প্রধান সুবিধা। প্রথমত, অচেনা জীবাণুর আক্রমণে আমরা যতটা অসুস্থ হতাম, এর ফলে মোটেই সেরকম অসুস্থ হতে হবেনা। কারণ, ভ্যাকসিন তৈরি করা হয় সংক্রমণে অক্ষম জীবাণু বা জীবাণুর অংশ বিশেষ (যেমন প্রোটিন, ডিএনএ অথবা আরএনএ ইত্যাদি) দিয়ে। দ্বিতীয়ত, আমাদের ইমিউন সিস্টেম-এর একটা ট্রেনিংও হয়ে গেলো, সে মেমরি টি কোষ এবং বি-কোষ তৈরি করে ফেললো, যাতে ভবিষ্যতে এই জীবাণুর আক্রমণ হ’লে তৎক্ষণাৎ তাকে পত্রপাঠ বিদায় করতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভ্যাকসিন নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। সফল ভাবে ভ্যাকসিন দেওয়ার পর আমাদের শরীর বেশ কিছুটা সময় নেয় (অন্তত ১০-১৫ দিন) রোগ প্রতিরোধকারী বি-কোষ এবং টি-কোষ তৈরি করতে। অতএব, কেউ যদি ভ্যাকসিন নেওয়ার ঠিক আগে বা পরে সংক্রমিত হয়, তাহলে কিন্তু সে অসুস্থ হবেই।

কিন্তু একবার ভ্যাকসিন নেওয়াই কি যথেষ্ট? এটা অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে আলাদা হতে পারে। কিছু ভ্যাকসিন আছে একবার নিলেই আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে যথেষ্ট সজাগ করে দিতে পারে কিন্তু কিছু ভ্যাকসিন-এর ক্ষেত্রে একাধিক ডোজ প্রয়োজন, এটাকে বলে বুস্টার ডোজ। বিভিন্ন ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হতে পারে।  যেমন কিছু ভ্যাকসিন হয় যা প্রাথমিক ডোজে যথেষ্ট ইমিউন রেসপন্স ঘটাতে পারেনা, তাই বুস্টার ডোজের দরকার (উদাহরণ মেনিনজাইটিস রোগের ভ্যাকসিন), আবার কিছু ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ডোজ নেওয়ার কিছু দিন পর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে যায়, তখনও বুস্টার ডোজ দিতে হয় (উদাহরণ ডিপথেরিয়া রোগের ভ্যাকসিন)।

ভ্যাকসিন তৈরির নানান ধাপ

কিন্তু ভ্যাকসিন তৈরি করা কোনো সহজ কাজ নয়। কোন রোগের ভ্যাকসিন তৈরি করতে গেলে অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হয়।

ভ্যাকসিন তৈরির ছ’টা ধাপ আছে:

  • প্রথম ধাপ: গবেষকরা অনুসন্ধান করেন এমন কোনো প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিমভাবে তৈরি অ্যান্টিজেন-এর যেটা দিয়ে শত্রুকে কাবু করা যায়।
  • দ্বিতীয় ধাপ (pre-clinical stage): এই অ্যান্টিজেনকে (সম্ভাব্য ভ্যাকসিন) কোষ, কলা (টিস্যু) কিংবা মডেল প্রাণীর উপর পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার উদ্দেশ্য রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা জন্মালো কিনা, সেইটা পরখ করা। যদি সেরকম না হয় কিংবা উল্টে ক্ষতি হয়, তাহলে আর পরের ধাপে এগোনো হয়না।
  • তৃতীয় ধাপ (clinical trials): এখানে তিনধাপে পরীক্ষা হয়। কোনো বেসরকারী সংস্থা সরাসরি ভলান্টিয়ারদের ওপর পরীক্ষা করে, ক্রমশ সংখ্যা বাড়িয়ে (প্রথমে ১০০-র কম, দ্বিতীয় ধাপে ১০০-র বেশি, শেষে প্রায় ১০,০০০-এর কাছাকাছি বা তারও বেশি)। যদি অ্যান্টিজেন সবরকম পরীক্ষায় পাশ করে, তবেই চতুর্থ ধাপে যায়।
  • চতুর্থ ধাপ (regulatory review): এই ধাপে সংশ্লিষ্ট দেশের ড্রাগ কন্ট্রোল বোর্ড (যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে FDA, ভারতে CDSCO ইত্যাদি)-এর কাছে বায়োলজিক্যাল লাইসেন্স-এর জন্য আর্জি পাঠানো হয়। সেখান থেকে সম্মতি দিলে তবেই ব্যাপক হারে এই ভ্যাকসিন তৈরি করা যায়।
  • পঞ্চম ধাপ (manufacturing): কোনো বড়ো ফার্মা কোম্পানি ব্যাপক হারে ভ্যাকসিন তৈরি ও বন্টনের দায়িত্ত্ব নেয়।
  • ষষ্ঠ ধাপ (quality control): FDA তথা অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ভ্যাকসিন-এর কিরকম প্রভাব হচ্ছে, সেইদিকে নজর রাখে।

এতক্ষণ ভ্যাকসিন সম্পর্কে যা যা বললাম, একটা কার্যকরী ভ্যাকসিনের থেকে ঠিক সেগুলোই প্রত্যাশা করা হয়।

Covid-১৯ এর ভ্যাকসিন কদ্দুর এগিয়েছে

Covid-১৯ সংক্রমণের প্রায় ৯ মাস অতিক্রম করার পর, সারা পৃথিবীর মানুষের এখন প্রশ্ন ভ্যাকসিন কবে আসবে? অথবা এলেও কতটা কার্যকর হবে?

এই Covid-১৯ অতিমারীর আবহে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা দিন রাত এক করে ভ্যাকসিনের গবেষণা করে চলেছেন। আশানুরূপ ফলও মিলেছে বিস্তর। সারা পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত অন্তত  ১৩ টা ভ্যাকসিনের phase -৩ অর্থাৎ অন্তিম পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে এবং আরো ৩০ টারও বেশি ভ্যাকসিন বিভিন্ন প্রাথমিক পর্যায়ের ট্রায়াল-এ  রয়েছে (phase ১ অথবা ২)। এর মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হলো অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং AstraZeneca-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি ChAdOx-1। করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-2)-এর একটা বিশেষ প্রোটিন (স্পাইক প্রোটিন) প্রস্তুতকারী জিনকে সংক্রমণে অক্ষম আডেনো ভাইরাস-এর মধ্যে ঢুকিয়ে এই ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে।

প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে এই ভ্যাকসিন-টি নন-হিউমান প্রাইমেটদের মধ্যে (যেমন বাঁদর, ওরাংওটাং, গরিলা ইত্যাদি) SARS-CoV-2 সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম। Phase-১/২ ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এ প্রাথমিক এবং বুস্টার ডোসে (২৮ দিনের তফাতে) এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল ৫৪৩ জন সেচ্ছাসেবককে। পরীক্ষায় দেখা গেছে বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবকের ক্ষেত্রেই এই ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা আশার আলো। এখন বিভিন্ন দেশে ৩০০০০ সেচ্ছাসেবককে নিয়ে phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে এই ভ্যাকসিন-এর। তবে একজন সেচ্ছাসেবক অপ্রত্যাশিত ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়াতে এই ট্রায়াল কিছু দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে ব্রিটেনে ৫ই অক্টোবর থেকে আবার এই ট্রায়াল শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক ফলাফল থেকে দেখা গেছে যে এই ভ্যাকসিন বয়স্ক মানুষের (বয়স ৬০ – ৭০ এর মধ্যে) মধ্যে বেশ ভালো কাজ করছে। তবে চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য phase-৩ ট্রায়াল শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ভারতীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা (pharmaceutical company) সিরাম ইনস্টিটিউট AstraZeneca-র সাথে যৌথ উদ্যোগে এই ভ্যাকসিন তৈরির দায়িত্ব নিয়েছে। 

এখনও পর্যন্ত যেকটা ভ্যাকসিন phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়ালে রয়েছে তার বেশিরভাগ-ই মানব দেহে উল্লেখযোগ্য ভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং বেলজিয়ামে জনসন এন্ড জনসন-এর উদ্যোগে আরও একটা ভ্যাকসিন-এর phase-৩ ট্রায়াল চলছিল ৬০০০০ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে, কিন্তু সংস্থার তরফ থেকে কিছুদিনের জন্য তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণটা সেই অপ্রত্যাশিত অসুস্থতা।বিশেষজ্ঞদের মতে যেকোনো ভ্যাকসিন ট্রায়াল -এর ক্ষেত্রেই এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে আশার খবর এই যে, অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আবার এই ট্রায়াল শুরু হয়েছে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ এবং মডার্না-র যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকসিন-ও বেশ আশানুরূপ ফল দিয়েছে এবং এটাও phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়ালে আছে। প্রাথমিক রিপোর্টে দেখা গেছে যে এই ভ্যাকসিন SARS-CoV-2-কে ঠেকাতে প্রায় ৯৪% কার্যকর। তবে  phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাকাপাকি ভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।

ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা Pfizer এবং BioNTech নামে এক জৈবপ্রযুক্তি (biotech) সংস্থা যৌথ ভাবে বেশ কিছু mRNA ভ্যাকসিন তৈরি করেছে , এবং এর মধ্যে দুটো ভ্যাকসিন (BNT162b1 এবং BNT162b2) phase ১/২ ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এ আশানুরূপ ফলও  দিয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে চলা phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এর  প্রাথমিক তথ্য থেকে দেখা গেছে যে BNT162b2 ভ্যাকসিন-টি SARS-CoV-2-এর সংক্রমণ ঠেকাতে ৯০% সক্ষম। তবে এই phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এর সম্পূর্ণ ফলাফল চলতি বছরের শেষের দিকে পাওয়া যেতে পারে।

এখনও পর্যন্ত যেকটা ভ্যাকসিন phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়ালে রয়েছে তার বেশিরবাগ-ই মানব দেহে উল্লেখযোগ্য ভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তবে প্রায় প্রত্যেকটা ভ্যাকসিন-এর ক্ষেত্রেই প্রাথমিক ডোজ দেওয়ার পর বুস্টার ডোজ দিতে হয়েছে এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক কিছু উপসর্গ দেখা গেছে, যেমন ভ্যাকসিন দেওয়ার পর জ্বর জ্বর ভাব, গায়ে ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, গা গোলানো ইত্যাদি। তবে এই ধরণের উপসর্গ অনেক সময়ই হয়ে থাকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে। অক্সফোর্ডের গবেষকরা দেখেছেন সাধারণ প্যারাসিটামলেই এইসব উপসর্গ কমে যাচ্ছে।

এতক্ষন যেসব ভ্যাকসিনের কথা বললাম তা সবই ইন্ট্রামাস্কুলার অর্থাৎ পেশীতে ইনজেকশন দিতে হয়। সম্প্রতি ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন-এর একদল বিজ্ঞানী ইন্ট্রা-ন্যাসাল  অর্থাৎ নাকে স্প্রে করতে হয় এমন একটা ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। তাঁরা দেখেছেন পেশীতে ইনজেকশন দেওয়ার তুলনায় নাকে স্প্রে হিসেবে দিলে ভ্যাকসিনটি অনেক বেশি কার্যকরী হয়।  গবেষণায় দেখা গেছে এই ভ্যাকসিনটি ইঁদুরের মধ্যে upper এবং lower respiratory tract (শ্বাস নালী)-এ SARS-CoV-2-এর সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম। ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক ভারত বায়টেক ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন-এর সাথে যৌথ উদ্যোগে এই ভ্যাকসিনের phase-৩ ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করবে ভারতে।

কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরির পথে অন্যান্য বাধা

এত খানি আশার আলোর মধ্যেও বেশ কিছু প্রশ্ন এখনও বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো দ্বিতীয়বার করোনা সংক্রমণ। বিশ্বের বেশ কিছু জায়গা থেকে এরকম তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? আমাদের শরীর কি তবে দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারছেনা? নাকি দ্বিতীয়বার একই ভাইরাস-এর অন্য কোনো স্ট্রেন বা প্রকার আক্রমণ করার ফলে এমনটা হচ্ছে? এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। এর আগে SARS-CoV-2-এর মতো SARS-CoV-1 অথবা MERS (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) করোনা ভাইরাস সংক্রমণ-এর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পেশেন্টদের মধ্যে ২-৩ বছর পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে। ৫-৬ বছর পর কিন্তু তা কমে যায়। যেহেতু নভেল করোনা ভাইরাস বা SARS-CoV-2 একটা সম্পূর্ণ নতুন ভাইরাস, এর সংক্রমণ পরবর্তী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। বিজ্ঞানীরাও নিত্য নতুন তথ্য থেকে পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছেন। আর সেই জন্যই ভ্যাকসিন যতই আশার আলো দেখাক না কেন, আমরা এখনো জানিনা ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি আমাদের শরীরে কতদিন স্থায়ী হবে। অথবা একই ধরণের ভ্যাকসিন কি সব বয়সের বা সব রকম ভৌগোলিক অবস্থানের মানুষের ক্ষেত্রে সমান ফল দেবে? এসবই সময় বলবে।

আরো একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সেটা হলো এই এত্ত ভ্যাকসিন স্টোর করার সমস্যা। এখনও অব্দি যত ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ হচ্ছে, তার বেশিরভাগই রাখতে হচ্ছে -২০ ডিগ্রি বা -৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস-এ, যেটা গরিব দেশের পক্ষে খুবই ব্যয় সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ভ্যাকসিন তৈরি করার পথে আরো একটা সমস্যা হলো অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহ্যান্সমেন্ট অফ ডিসিস বা সংক্ষেপে ADE। যে অ্যান্টিবডি আমাদেরকে রোগের হাত থেকে বাঁচাতে পারে, সেই অ্যান্টিবডিরই ক্ষমতা আছে অযাচিত ভাবে রোগ সংক্রমণ বাড়িয়ে তোলার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি না হয় তাহলে এমনটা হওয়ার সম্ভবনা থাকে। তবে যে সমস্ত ভাইরাস ম্যাক্রোফেজকে আক্রমণ করে তাদের ক্ষেত্রে মূলত ADE-এর আশঙ্কা থাকে। যদিও প্রি-ক্লিনিকাল ট্রায়াল-এ ADE কিছু প্রাণীর (নন-হিউমান) মধ্যে দেখা গেছে যাদের SARS-CoV-2-এর ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এটা পাকাপাকি ভাবে এখনও বলা যাচ্ছেনা যে SARS-CoV-2 ভ্যাকসিন-এর ক্ষেত্রে ADE হবেই। এর জন্য আরো অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।

সব শেষে বলি, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যেভাবে ভ্যাকসিন গবেষণার জন্য কাজ করছেন তাতে হয়তো কোনো না কোনো সমাধান এই রোগের একদিন পাওয়া যাবে। কিন্তু একবার কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেলেও তা প্রতিটা মানুষের কাছে পৌঁছতে অন্তত ২-৩ বছর লেগে যাবে। তাই এখন আমাদের কর্তব্য হলো মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে বার বার হাত ধোয়া এবং অযাচিত ভীড় এড়িয়ে চলা। এভাবেই আমরা নিজেদের এবং আমাদের আশেপাশের মানুষদের সুরক্ষিত রাখতে পারবো।

কভার ইমেজ : বনানী মন্ডল।

টীকা : থাইমাস (Thymus): এটি একধরণের গ্রন্থি, যেটা মানব দেহের দুটো ফুসফুসের মাঝে ঠিক হৃদপিণ্ডের সমান উচ্চতায় অবস্থিত। একটি মানব শিশু জন্মানোর পর এক বছর বয়স অব্দি থাইমাস দ্রুত গতিতে আকারে বাড়তে থাকে; তারপর অবশ্য খুব ধীর গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত। মূলত থাইমোসিন (thymosin) নামক হরমোন ক্ষরণ করা এই গ্রন্থির কাজ। পরিণত টি সেল তৈরি করতে উদ্দীপিত করে এই থাইমোসিন হরমোন।

তথ্যসূত্র :

  1.  Immunological memory cells (DOI: https://doi.org/10.5114/ceji.2018.77390 ).
  2.  Understanding How Vaccines Work (https://www.cdc.gov/vaccines/hcp/conversations/downloads/vacsafe-understand-color-office.pdf?fbclid=IwAR1n8hXXk_ZJtbiu7yfGW9sUiIiIsK68HVgASBrFQreMogRqIcyP8bVtBFY)
  3. https://www.khanacademy.org/science/in-in-class-12-biology-india/xc09ed98f7a9e671b:in-in-human-health-and-disease/xc09ed98f7a9e671b:in-in-types-of-immunity-and-the-immune-system/a/adaptive-immunity
  4.  Alberts B, Johnson A, Lewis J, et al. Molecular Biology of the Cell. 4th edition. New York: Garland Science; 2002. Innate Immunity. Available from: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK26846/
  5. https://www.nytimes.com/2020/10/14/health/covid-clinical-trials.html
  6. https://onlinepublichealth.gwu.edu/resources/producing-prevention-the-complex-development-of-vaccines/
  7. Safety and immunogenicity of the ChAdOx1 nCoV-19 vaccine against SARS-CoV-2: a preliminary report of a phase 1/2, single-blind, randomised controlled trial. (https://doi.org/10.1016/S0140-6736(20)31604-4)  
  8. https://www.bbc.com/news/health-54993652
  9. SARS-CoV-2 immunity: review and applications to phase 3 vaccine candidates. (https://doi.org/10.1016/S0140-6736(20)32137-1).
  10. https://www.bbc.com/news/health-54902908
  11. https://www.pfizer.com/news/press-release/press-release-detail/pfizer-and-biontech-announce-vaccine-candidate-against
  12. A Single-Dose Intranasal ChAd Vaccine Protects Upper and Lower Respiratory Tracts against SARSCoV-2 (https://doi.org/10.1016/j.cell.2020.08.026)
  13. https://www.thehindu.com/sci-tech/science/bharat-biotech-inks-pact-with-wus-school-of-medicine-for-covid-19-intranasal-vaccine/article32674865.ece
  14. A perspective on potential antibody-dependent enhancement of SARS-CoV-2 (https://www.nature.com/articles/s41586-020-2538-8).
  15.  Immunological considerations for COVID-19 vaccine strategies  (https://doi.org/10.1038/s41577-020-00434-6).
  16. ADE সম্পর্কে আরো জানতে এই ভিডিওটা দেখুন:

The post করোনা ভ্যাকসিন-এর কার্যকারিতা এবং সীমাবদ্ধতা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

দেওয়ালে পিঠ ইলেকট্রনিক্সের –আলোয় চলবে নতুন যুগের কম্পিউটার? –প্রথম পর্ব

$
0
0

ইলেকট্রনিক্স-এর ক্ষুদ্রায়ণে (miniaturization) যেসব সমস্যা, সেগুলোকে আলোককণা বা ফোটনের সার্কিট দিয়ে কীভাবে এড়ানো যায়?


মানুষের প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার অদম্য মনোবাসনাকে ঘিরে ক্রমশ উন্নত থেকে উন্নততর প্রযুক্তিবিদ্যার সৃষ্টি। প্রথমে সে শেখে বিভিন্ন শক্তির ব্যবহার, যেমন আগুনের আবিষ্কার।  তারপর প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে প্রয়োজনমতো অপর শক্তিতে রূপান্তরের পালা, যেমন বাষ্পচালিত যান, অবশেষে বিংশ শতাব্দীর সূচনায় মানুষ সাফল্যের সঙ্গে রপ্ত করে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার বিদ্যা এবং মেতে ওঠে প্রকৃতিকে বশ করার খেলায়। পরমাণু শক্তির আহরণ থেকে শুরু করে টেস্টটিউব বেবি, আবার চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘DNA-Engineering’ হলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বুঝে না বুঝে দৈনন্দিন জীবনেও আমরা এইরকম প্রযুক্তির ব্যবহার করে থাকি। কীরকম? একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় প্রতিটি ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্র, টেলিভিশন, মোবাইলফোন, ক্যামেরা, ট্যাবলেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদি যা আপনি আমি অহরহ ব্যবহার করে চলেছি, সর্বত্রই রয়েছে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার সুনিপুণ প্রচেষ্টা।

তবে জানেন কি, এই ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে হয়তো খুব শীঘ্রই বাজারে আসতে চলেছে নতুন প্রযুক্তি। আরও গতিশীল, কম্‌প্যাক্ট, হালকা, এবং সুলভ, কারণ ব্যাটারির খরচাও অনেক কম! হ্যাঁ, সেই প্রযুক্তির নাম ‘ফোটোনিক্স’। তবে তার আগে ভালো করে জেনে নেওয়া দরকার আজকের যুগের ইলেকট্রনিক টেকনোলজির ঘাটতিগুলো ঠিক কী কী এবং এর সমাধানই বা কী করে সম্ভব [১-৪]?

ইলেকট্রনিক যন্ত্র কাজ করে কীভাবে? এর ঘাটতিগুলো কী কী?

 ‘ইলেকট্রনিক্স’ বা ‘তড়িৎ-কণা বিদ্যা’ হলো পদার্থবিজ্ঞানের এমন একটি শাখা বা বিদ্যা যেখানে বিভিন্ন যন্ত্র বা যন্ত্রাংশের  সাহায্যে উপযুক্ত মাধ্যমে কী করে তড়িৎ কিম্বা ইলেকট্রনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে নিজের সুবিধা মতো কাজে লাগানো যায়  তাই নিয়ে আলোচনা করা হয় [৫]। যন্ত্র বলতে গ্যাসটিউব, ট্রানজিস্টার, কিংবা মাইক্রোচিপ হতে পারে। তাতে মাধ্যম হতে পারে তড়িৎ পরিবাহী গ্যাস, সেমিকন্ডাক্টার/অর্ধপরিবাহী পদার্থ যেমন সিলিকন ইত্যাদি। ইলেকট্রনিক্সে  অভূতপূর্ব পারদর্শিতার নিদর্শন আমাদের হাতের মুঠোয় বন্দি তন্বী স্মার্ট ফোনটি, বা ডেস্কের উপর রাখা ছিমছিমে গড়ন ল্যাপ্‌টপখানি।

কম্পিউটার চলে তড়িৎ শক্তিতে। সে আমাদের মতন সংবেদনশীল বা আবেগপ্রবণ নয়।  সে বোঝে শুধু তার ‘মাদার বোর্ড’-এ থাকা ট্রানজিস্টরগুলোতে তড়িৎ-বিভব বা ভোল্টেজের ওঠানামা। যদি ভোল্টেজ কম দেওয়া হয় তবে ভাবে শূণ্য (০) আর বেশি দিলে (সাধারণত ৫ ভোল্ট) বোঝে এক (১)। যা কিছু কাজ, জটিল গাণিতিক হিসাব-নিকাশ, রকেট উৎক্ষেপণ থেকে গেম খেলা বা চ্যাট, সিনেমা দেখা, সবই হয় এই ‘০’ ও ‘১’ এর সমন্বয়ে অথবা কম্বিনেশনে। শুধু কম্পিউটার কেন, ইলেকট্রনিক্সের যে কোনো যন্ত্র, মোবাইল ফোন থেকে আজকের ডিজিটাল টেলিভিশন, সব এভাবেই কাজ করে। এই ‘০’ বা ‘১’ কে বলে এক একটি ‘বিট’। শুধুমাত্র দুটি সংখ্যা, ‘০’ এবং ‘১’ এর সমন্বয়ে তৈরি এ হেন গাণিতিক শাখাকে বলে ‘বাইনারি সিস্টেম’ যা ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্স-এ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলির মধ্যে থাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র (প্রায়শই ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার থেকেও ছোটো [৬], মাত্র কয়েক ন্যানোমিটার (১০−৯) সাইজের) ‘সুইচ’ বা ট্রানজিস্টার যা অভ্যন্তরীন সার্কিটের মধ্যে তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ এবং অভিমুখকে আমাদের প্রয়োজনানুসারে নিয়ন্ত্রণ করে (চিত্র ১)। বাইরে থেকে কি-প্যাডের মাধ্যমে আমরা আসলে এই সুইচগুলোই চালু  (অন্‌) বা বন্ধ (অফ্‌) করে সার্কিটের বিভব বা ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। আজকের যুগের উন্নত কম্পিউটারে এরকম কয়েক কোটি সুইচ বা ট্রানজিস্টার বর্তমান, যেগুলোকে আমরা বাইরে থেকে প্রোগ্রামের সাহায্যে নিমেষের মধ্যে অন্‌ বা অফ্‌ করতে পারি। কম্পিউটারের স্পিড কত বেশি হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে কত দ্রুত এই সুইচগুলো অফ্‌ বা অন্‌ করা যায়, এককথায় কম্পিউটারের ‘ক্লক-স্পিড’-এর উপর [৭]।

চিত্র ১। (ক) সেমিকন্ডাক্টর ট্রানজিস্টার আবিষ্কারের ঐতিহাসিক মুহূর্ত (সূত্রঃ https://en.wikipedia.org/wiki/John_Bardeen)
(খ) প্রতীকী ছবিঃ অচিরেই ইলেকট্রনিক্সের জায়গা নেবে ফোটোনিক্স, বিদ্যুতের বদলে আলো হবে চালিকাশক্তি [৮]।
(গ) আজকের যুগের ইলেকট্রনিক ট্রানজিস্টার যেমন ফেট/মসফেট (FET/MOSFET) ইত্যাদি ভাইরাসের আকারের তুলনীয় (~১০০ ন্যানোমিটার)।
প্রসঙ্গত, ১ মিটার = ১০৩ মিমি = ১০৬ মাইক্রোমিটার = ১০৯ ন্যানোমিটার [৯]।
(চিত্র সূত্রঃ https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Biological_and_technological_scales_compared-en.svg)।

উদাহরণস্বরূপ, আমাদের কম্পিউটারের এই ক্লকগুলির স্পিড সাধারণত গিগা (১০) হার্ৎজ হয়, যার মানে হল এই কম্পিউটারের কন্ট্রোলিং সুইচগুলি সেকেন্ডে প্রায় ১০ বার বা একশো কোটি বারের বেশি অন্‌-অফ্‌ করা যায়। আপনিও আপনার প্রসেসরের ক্লক-স্পিড দেখতে পারেন ‘windows’ এর ‘run’ এ গিয়ে ‘dxdiag’ টাইপ করে। বুঝতেই পারছেন, সেকেন্ডে কয়েকশো কোটি সংখ্যাটা নেহাতই ছোটো নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এতেই থেমে থাকতে চাননা এবং পারেনও না। কারণ দিনবদলের সাথে সাথে তামাম বিশ্বজুড়ে তথ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিপুলহারে যা প্রসেস করা আজকের যুগের ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের পক্ষে খুব শীঘ্রই হয়ে উঠবে সাধ্যাতীত [১০]।

অতএব নিরন্তর প্রয়াস চলে কী করে এই কম্পিউটারগুলিকে আরও ছোটো, গতিশীল এবং সুদক্ষ করে তোলা যায়। সমস্যা এখানেই!  ইলেকট্রনিক সার্কিটের মিনিয়েচারাইজেশন যেমন খুশি তেমন ভাবে করা সম্ভব না। কারণ, যখনই দুটি ইলেকট্রনিক সার্কিট একে অপরের খুব কাছে আসে, তখন এদের মধ্যে তড়িৎ-কণা বা চার্জ জমা করে রাখার ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়। চার্জ-ধারণ করার এই প্রবণতাকে বলে ধারকত্ব বা capacitance। এরা তখন পাত্রের মতন ইলেকট্রনগুলিকে এদের চারিধারে বন্দি করে ফেলে। ফলস্বরূপ, আমরা যত স্পিডেই বাইরে থেকে এই সুইচগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করিনা কেন, যেহেতু বন্দি ইলেকট্রনগুলি সহজে নড়াচড়া করতে পারেনা, সেহেতু কম্পিউটারের স্পিড-ও মিনিয়েচারাইজেশনের সঙ্গে কমতে শুরু করে। তাই এতদিন ইন্টেল-এর সহপ্রতিষ্ঠিতা গর্ডন মূরের ১৯৬৫ সালে করা বিখ্যাত ভবিষ্যতবাণী (Moore’s law) যে সেমিকন্ডাক্টর চিপে ট্রানজিস্টারের ঘনত্ব প্রতি দুইবছরে দ্বিগুণ হবে তা কমবেশি সত্যি বলে প্রতিপন্ন হলেও, ইলেকট্রনিক ট্রানজিস্টারের আয়তন আরও ছোটো করা ক্রমশই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে [১১]। এই সমস্যার সমাধানেই আজ আমরা আলোকবিজ্ঞানের একটি শাখা ফোটোনিক্স বা আলোক-কণা বিজ্ঞানের শরণাপন্ন।

আলোকবিজ্ঞানের বিস্তার

ইলেকট্রনিক্সের মতো কিন্তু আলোকবিজ্ঞানের ব্যবহারও সর্বত্র। হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত দুই দানবীয় যমজ কৃষ্ণ-গহ্বরের সংঘর্ষে উদ্ভূত অতিদুর্বল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পরিমাপ থেকে [১২] পারমাণবিক ঘড়িতে অতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণুর কম্পনের মাধ্যমে এক সেকেন্ডের কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ের নিখুঁত পরিমাপ করা পর্যন্ত আলোকবিজ্ঞানের বিস্তার [১৩, ১৪]। অবাক করা কান্ড হোলো, একদিকে যেমন উচ্চ উষ্ণতায় ধাতু গলিয়ে ঢালাইয়ের কাজ, তেমনি অন্যদিকে পরম শূন্য তাপমাত্রায় পৌঁছানো, দুই ক্ষেত্রেই লেসার ব্যবহৃত হয়। আবার সমুদ্রের নিচে পাতা মাইলের পর মাইল দীর্ঘ অপটিক্যাল ফাইবার (Optical Fiber) কেবল্‌-এর সৌজন্যে আজ আমাদের বাড়িতে দ্রুত-গতি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট (চিত্র ২) যা আমার আপনার নিত্য অনলাইন লেকচার শোনার, ইউটিউব ভিডিও অথবা নেটফ্লিক্সে রোমহর্ষক সিরিজ দেখার সঙ্গী [১৫, ১৬]। আলোক ঝলমলে পুজো প্যান্ডেলের LED লাইট, ছানি অপারেশনে ব্যবহৃত লেসার রশ্মি, বা আপনার টেবিলে অযত্নে লালিত একসময়ের খুব প্রিয় ধূলিমাখা সিডিটা, সবই আলোকবিজ্ঞানের দান। তবে আলোকবিজ্ঞান (অপটিক্যাল সায়েন্স) আর আলোক-কণা বিজ্ঞান (ফোটোনিক্স) পুরোপুরি এক নয়। সেটা বিস্তারিতভাবে জানতে গেলে আলোর গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। বস্তুত, ফোটোনিক্সকে আলোকবিজ্ঞানের একটি বিশেষ ধারা বলে চিহ্নিত করা চলে।

আলোর গতিপ্রকৃতি

 আলো একপ্রকার তরঙ্গ (wave) নাকি দ্রুতগতি সম্পন্ন কণার (particle) সমন্বয়? এই শতাব্দীব্যাপী বিতর্কে মহাবিজ্ঞানী নিউটন (কণা) থেকে হাইগেন্‌স (তরঙ্গ), ম্যাক্সওয়েল (তরঙ্গ) থেকে  প্ল্যাঙ্ক অথবা আইনস্টাইন (আবার কণা!), কেউই বাদ যাননি। অবশেষে, পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী ডি ব্রগলী এবং অন্যান্যরা ব্যাখ্যা দেন যে খামখেয়ালী আলোর দ্বৈতস্বত্বা বিদ্যমান। সে কখনও তরঙ্গধর্মী, কখনও বা কণাধর্মী। যেকোনো বস্তু থেকে যখন আলো প্রতিফলিত হয় তখন আমরা তাকে দেখতে পাই। প্রতিফলন (reflection), প্রতিসরণ (refraction), এবং ব্যতিচার (interference) আলোর তরঙ্গধর্ম দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। আবার আলোকে ছোটো ছোটো এক-গুচ্ছ কণা বা ফোটনের সমন্বয় হিসাবে না ভাবলে আলোকতড়িতক্রিয়ার (Photoelectric effect) ব্যাখ্যা করা সহজসাধ্য হয়না। এই আলোক-কণিকা বা ফোটন সাধারণত কোয়ান্টাম মেকানিক্স যা কিনা অতিক্ষুদ্র কণার ধর্ম ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, তার সূত্র মেনে চলে। ‘ফোটন’ শব্দটির বুৎপত্তি গ্রীক শব্দ ‘ফোস্‌’ বা ‘ফোট্‌’ থেকে যার অর্থ হলো ‘আলো’। ভেবে দেখুন, ‘ফোটো’-গ্রাফি কিন্তু আলোরই কারসাজি। মজার কথা, স্বয়ং আইন্‌স্টাইন যিনি আলোকতড়িতক্রিয়া আবিষ্কারের মাধ্যমে আলোর কণাধর্ম প্রমাণ করেন ও ১৯২১ সালে নোবেল প্রাইজ পান, তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আজগুবি এবং ভূতুড়ে নিয়মাবলীর ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। প্রসঙ্গত, আলোকবিজ্ঞান, সর্বোপরি, আলোক-কণা বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কারের সঙ্গে একাধিক ভারতীয় বিজ্ঞানীর নাম  ওতপ্রোতভাবে জড়িত যা নিয়ে আমরা পরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।

চিত্র ২। (ক) বিশ্বকে জুড়েছে ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট কেবল্‌ (সূত্রঃ https://www.submarinecablemap.com/),
(খ) অপটিক্যাল ফাইবার। চিত্রাঙ্কণেঃ রক্তিম
(গ) ফাইবার অপটিক ল্যান (LAN) কানেকশন (সূত্রঃ https://www.pinterest.co.uk/pin/125749014566322505/)।

আলোক-কণা বিজ্ঞান বা ফোটোনিক্স কী? কেন?

যাইহোক, তাহলে কাকে বলে এই ‘ফোটোনিক্স’? ফোটোনিক্স হল এমন এক টেকনোলজি যার মাধ্যমে প্রয়োজনমতো বিভিন্ন রঙের (শক্তির) ফোটনকে তৈরী করা যায়, প্রবল বেগে ধাবিত দ্রুতগতি সম্পন্ন সেই ফোটনকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এবং অবশেষে সেই ফোটনগুলোকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন কাজে লাগানো যায়। ইলেকট্রনিক্স সার্কিটের সমস্যাগুলির সমাধান লুকিয়ে আছে কিন্তু এখানেই। আচ্ছা, যদি সার্কিটে কারেন্ট বা ইলেকট্রন না পাঠিয়ে তার পরিবর্তে লাইট বা একগুচ্ছ ফোটন পাঠিয়ে একই কাজ করা যায়? ফোটনকণা একে অপরকে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করেনা। তাই অপটিক্যাল সার্কিটে ইলেকট্রনিক সার্কিটের তুলনায় নয়েজ (Noise) অনেক কম হয়। এছাড়াও, ফোটনের রেস্ট-মাস শূন্য (০) হওয়ায় ইলেকট্রনের মতন ফোটন কোনো জায়গায় স্থিতাবস্থায় জমে থাকতে অক্ষম। ফলতঃ ধারকত্বের সমস্যা আলোর ক্ষেত্রে একদমই খাটে না। এই ফোটোনিক কম্পিউটারগুলোয় থাকে ছোটো ছোটো লেসার। লেসার অন্‌ থাকলে ‘১’ আর বন্ধ থাকলে বোঝায় ‘০’। নিরলস গবেষণায় অচিরেই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে ফেলেন অপটিক্যাল ট্রানজিস্টার [১৭] বা সুইচ যা আলোর গতিবিধি এবং লেসারগুলোর অন-অফ নিয়ন্ত্রণ করে। এই কাজ অপটিক্যাল রেসোনেটরের মাধ্যমেও করা যায় (চিত্র ৩)।

চিত্র ৩। (ক) কম্পিউটার ইন্টারকানেক্ট বটল্‌নেক সমাধানে ইলেকট্রনিক-ফোটোনিক হাইব্রিড সার্কিট
(খ) ইন্টিগ্রেটেড ফোটোনিক সার্কিটের কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন অপটিক্যাল ওয়েভগাইড বা তার, রিং রেসোনেটর, ইন্টারফেরোমিটার ইত্যাদি।
(গ) মাইক্রোরিং রেসোনেটরকে অপটিক্যাল সুইচ, ট্রানজিস্টার বা ইলেকট্রো-অপটিক মড্যুলেটর হিসাবে ব্যবহার করা যায় [১৭]। । মাইক্রোরিং রেসোনেটর দিয়ে তৈরী ইলেকট্রো-অপ্‌টিক্‌ সুইচ। (সূত্রঃ মিকাল লিপ্‌সন গ্রুপ ওয়েবসাইট- https://lipson.ee.columbia.edu/, চিত্রাঙ্কণেঃ রক্তিম)

সরু সরু তামার তারের বিকল্প হিসাবে আসে অতিসূক্ষ্ম কাঁচের তার যাকে বলে অপটিক্যাল ওয়েভগাইড। এরা মানুষের চুলের বেধের থেকে প্রায় একশভাগ সরু হলেও বিনা বাধায় আলো-কে সার্কিটের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে একনিমেষে পৌঁছে দেয়। দেখা যায়, ফোটনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে আরও ছোটো আকারের কম্পিউটার তৈরি করা যায় যার ক্লক-স্পিড কমপক্ষে কয়েক হাজারগুণ বেশি (১০১২ বা টেরা-হার্ৎজ) [৩, ১৫, ১৬]। এছাড়াও ফোটন ভর ও চার্জহীন হওয়ায় ফোটোনিক সার্কিটে খুব কম তাপ উৎপন্ন হয়। শক্তির অপচয় কমে [১৭]।

তথ্য আদানপ্রদান বা কম্যুনিকেশনে ফোটোনিক্স

তাহলে এখন বোঝা গেল কেন কম্পিউটারের ভিতরে ইলেকট্রনিক্সের জায়গায় আসতে চলেছে ফোটোনিক্স? কিন্তু এক কম্পিউটার থেকে আরেক কম্পিউটারে তথ্যের আদান-প্রদান করার জন্য ফোটোনিক্সের ব্যবহার ইতিমধ্যেই বহুল প্রচলিত। ফাইবার অপ্টিক্‌ ইন্টারনেট কেবলের মাধ্যমে অত্যন্ত উচ্চ-কম্পাঙ্কের (শক্তির) ফোটন কণিকার বা আলোর মধ্যে তথ্য এনকোড করে সমুদ্রের তলা দিয়ে পাঠানো হয় (সাধারণত, তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫৫০ ন্যানোমিটার/কম্পাঙ্ক ১৯৩.৫৫ টেরা হার্ৎজ) এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ (চিত্র ২)। এখানেও আলো ব্যবহার করার সুবিধাটা কী? উচ্চ কম্পাঙ্ক মানেই বিশাল ডেটা ব্যান্ডউইথ। বেশী ব্যান্ডউইথ মানে একসাথে অনেক ইউজার; বাফারিং ছাড়াই ইউটিউব ভিডিও! কিন্তু ইলেকট্রনিক তরঙ্গ বা সিগনালের কম্পাঙ্ক যত বাড়ে, ধাতব তারের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়ে তার শক্তি তত বেশী শোষিত হয় (উৎসাহী পাঠকেরা ‘skin effect’ সম্বন্ধে সার্চ করে দেখতে পারেন কেন এটা হয়)। এর দরুণ গিগা-হার্ৎজ এর বেশী কম্পাঙ্কে কাজ করে এমন ধাতব তার সহজলভ্য নয়, বা পেলেও খুবই দামি।  এছাড়া ব্জ্র-বিদ্যুৎ বা অন্যান্য প্রাকৃতিক/কৃত্রিম উৎস হতে উৎসারিত নয়েজও ইলেকট্রনিক সিগনালকে প্রভাবিত করে। আলোতে সেই নয়েজের প্রভাব কম।  অতএব সবদিক থেকেই ইলেকট্রনিক্সের বদলে ফোটোনিক্সের ব্যবহার লাভজনক।

(প্রচ্ছদের ছবি: ইন্টিগ্রেটেড ফোটোনিক সার্কিট, সূত্র)

সূত্র (References):

[১] L. C. Kimerling, “Photons to the rescue: Microelectronics becomes microphotonics,” Electronic Device Failure Analysis, vol. 4, no. 3, pp. 15-20, 2002.

[২] A. Alduino and M. Paniccia, “Interconnects: Wiring electronics with light,” Nature Photonics, vol. 1, no. 3, pp. 153-155, 2007.

[৩] R. Won and M. Paniccia, “Integrating silicon photonics,” Nature Photonics, vol. 4, pp. 498-499, 2010.

[৪]  https://www.intel.com/content/www/us/en/architecture-and-technology/silicon-photonics/silicon-photonics-overview.html

[৫] A. S. Sedra, and K. C. Smith, Microelectronics Circuits, Oxford University Press, 2015.

[৬] https://cml.harvard.edu/assets/Harvard%20Magazine_Virus-Sized%20Transistors_Jan-Feb2011.pdf

[৭] https://www.intel.com/content/www/us/en/gaming/resources/cpu-clock-speed.html

[৮] https://bartamanpatrika.com/detailNews.php?cID=67&nID=201922

[৯] https://scaleofuniverse.com/

[১০] https://www.technologist.eu/harnessing-optics-to-handle-the-data-crunch/

[১১] https://en.wikipedia.org/wiki/Moore%27s_law

[১২] B. P. Abott et al., “Observation of Gravitational Waves from a Binary Black Hole Merger,” Phys. Rev. Lett. Vol. 116, no. 061102, 2016.

[১৩] N. Picqué, and T. Hänsch, “Rulers of light,” Nature Photonics, vol. 13, no. 137, 2019.

[১৪] S. B. Papp, K. Beha, P. Del’Haye, F. Quinlan, H. Lee, K. J. Vahala, and S. A. Diddams, “Microresonator frequency comb optical clock,” Optica, vol. 1, no. 1, pp. 10-14, 2014. 

[১৫] https://www.extremetech.com/computing/187258-43tbps-over-a-single-fiber-worlds-fastest-network-would-let-you-download-a-movie-in-0-2-milliseconds

[১৬] R. G. H. van Uden et al., “Ultra-high density spatial division multiplexing with a few-mode multicore fiber,” Nature Photonics, vol. 8, pp. 865-870, 2014.  [১৭] Q. Xu and M. Lipson, “All-optical logic based on silicon micro-ring resonators,” Opt. Express, vol. 15, no. 3, pp. 924-929, 2007. 

The post দেওয়ালে পিঠ ইলেকট্রনিক্সের – আলোয় চলবে নতুন যুগের কম্পিউটার? – প্রথম পর্ব appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

দেওয়ালে পিঠ ইলেকট্রনিক্সের –আলোয় চলবে নতুন যুগের কম্পিউটার? –দ্বিতীয় পর্ব

$
0
0

একটা সম্পূর্ণ ফোটোনিক্স সার্কিট বানাতে বাধা কোথায়? ফোটোনিক্স গবেষণায় আর কী কী সমস্যা এবং সম্ভাবনা রয়েছে?


« প্রথম পর্ব

গত পর্বে দেখেছি আমাদের প্রচলিত কম্পিউটারের মধ্যে ট্রানজিস্টারগুলো ছোটো করতে করতে এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে আর ছোটো করা প্রায় অসম্ভব। খুব ছোটো সার্কিটের ধারকত্ব বা capacitance-এর সমস্যার জন্য কম্পিউটারকে আরও গতিশীল করাও বিশাল সমস্যা। মুশকিল আসান করতে পারে আলো দিয়ে তৈরী সার্কিট! আলোক-কণা বা ফোটনের ভর নেই। এরা একে অপরকে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে না। সুতরাং, ফোটনের ধারকত্ব সমস্যাও নেই। ফোটনিক্সের মাধ্যমে তাই ইলেকট্রনিক্সের থেকে অনেক বেশী ব্যান্ডউইথের আদান প্রদান করা যায় আর অনেক দ্রুত কম্পিউটারও বানানো যেতে পারে। এই পর্বে ফোটনিক্সের ইতিহাস, সম্ভাবনা ও অন্তরায় নিয়ে জানব। আর, জানব এই গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানচর্চায় ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদান কী? 

ফোটোনিক্সের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস [১-৪]

ফোটোনিক্সের সূচনা ঠিক কবে এবং কোথায় তা বলা খুব শক্ত।  ১৮৬৫ সালে ম্যাক্সওয়েলের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক সূত্র-প্রকাশ, ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ সংক্রান্ত কোয়ান্টাম থিয়োরির প্রবর্তন নাকি ১৯০৫ এ আইনস্টাইনের ফোটো-ইলেকট্রিক এফেক্ট আবিষ্কার, কোন ঘটনাটাকে ফোটোনিক্স-এর সূচনা বলা যায়, তা তর্কসাপেক্ষ।

চিত্র ১ (ক) জাপানে ত্রিমাত্রিক ন্যানো-প্রিন্টিং টেকনোলজির মাধ্যমে নিখুঁতভাবে নির্মিত বিশ্বের সবচেয়ে ছোটো তাজমহলের মডেল (SEM image) [৫],
(খ) আই. আই. টি খড়্গপুরে ফাইবার অপটিক্‌সিস্টেম ল্যাবের (FOSLAB) তত্ত্বাবধানে একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরী ফোটোনিক-মাইক্রোরিং যা ব্লাড সুগার বা ব্লাড প্রেসার মাপার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে (SEM image) [৬]। একটি চুলের বেধের (৬০-৭০ মাইক্রোমিটার) থেকেও সূক্ষ্ম এই রিংটির ব্যাস মাত্র ২০ মাইক্রোমিটার।
(গ) ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে CMOS-টেকনোলজি ব্যবহার করে তৈরী দেশলাই কাঠির থেকেও ছোটো সাইজের কোয়ান্টাম ফোটোনিক চিপ [৭-৯]।

তবে ১৯৬০-এ  থিয়োডর মেইম্যান-এর সেমিকন্ডাক্টিং লেসার আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে ফোটোনিক্সের মূল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। অবশ্য ঘরে ঘরে ফোটোনিক-টেকনোলজি প্রথম পোঁছায় বিজ্ঞানী নরীন্দর সিংহ কাপানী এবং চার্লস কাও-এর যুগান্তকারী আবিষ্কার, অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে। তবে এই প্রযুক্তিটা তো কম্যুনিকেশন বা যোগাযোগব্যবস্থার জগতে। কারেন্টের বদলে আলো ব্যবহার করে কম্পিউটারে ইলেকট্রনিক চিপের বদলে ফোটনিক চিপ, এই ধারণার প্রণয়ন খুব বেশীদিন আগেকার নয়, বড়জোর বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে। বলা চলে তারপর থেকেই ইলেকট্রনিক বা সিলিকন ইন্ডাস্ট্রির অগ্রগতিকে ফোটোনিক ইন্ডাস্ট্রি ছায়ার মতন অনুসরণ করে চলেছে কারণ ফোটোনিক ডিভাইস এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইস উভয়েই মূলত একই টেকনোলজির (CMOS টেকনোলজি) মাধ্যমে বানানো হয়ে থাকে। একবিংশ শতাব্দীর সূচনায় গ্রাফিনের আবিষ্কার, লিথোগ্রাফি, ন্যানোটেকনোলজি এবং ত্রিমাত্রিক (3D) ন্যানো-প্রিন্টিং টেকনোলজির (চিত্র ১) সমূহ অগ্রগতি ফোটোনিক টেকনোলজিকে এক অনন্য মাত্রা দিতে চলেছে [৫, ৬]।

সম্ভাবনা এবং অন্তরায়

আগেই বলেছি, ফোটন ভরহীন, আধানবিহীন এক ধরণের বোসন কণা। তাই দুটো ফোটনকণা একে অপরকে সাধারণভাবে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে না। অর্থাৎ, তাদের মধ্যে কোনোরকম আন্তঃক্রিয়া (interaction) হয়না। আবার অন্য কণা বা বল দ্বারাও সহজে এদের প্রভাবিত করা যায় না।

এর সুবিধা অনেক। প্রথমত, ধারকত্বের সমস্যা এই জন্যেই আলোর ক্ষেত্রে খাটে না। আলোককণাকে ধরে রাখবে কীভাবে? দ্বিতীয়ত, একই কারণে ফাইবার অপটিক্‌কম্যুনিকেশন লিঙ্কে অনভিপ্রেত নয়েজ ইলেকট্রনিক কম্যুনিকেশন লিঙ্কের থেকে অনেক কম। ফাইবার লিঙ্কের স্পিডও বেশী। আজকের যুগের ইন্টারনেট পরিষেবা পুরোপুরি ফাইবার অপটিক্সের উপর নির্ভরশীল এবং ইন্টারনেট হাব থেকে তথ্য আলোয় এনকোড করে সমুদ্রের তলায় বিস্তৃত অপটিক্যাল ফাইবারের সাহায্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় (চিত্র ২)।

চিত্র ২। (ক) বিশ্বকে জুড়েছে ফাইবার অপটিক্‌ইন্টারনেট কেবল্‌ (সূত্রঃ https://www.submarinecablemap.com/)
(খ) অপটিক্যাল ফাইবার। চিত্রাঙ্কণেঃ রক্তিম,
, (গ) ফাইবার অপটিক্‌ল্যান (LAN) কানেকশন (সূত্রঃ https://www.pinterest.co.uk/pin/125749014566322505/)

কিন্তু ফোটনকণারা নিজেদের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া করে না – এই ঘটনার অসুবিধাও বিস্তর। সহজে প্রভাবিত হয়না বলে ফোটনকে নিয়ন্ত্রণ করাও যে সহজ নয়। দেখা গেছে পুরো সার্কিটটাই অপটিক্যাল করা গেলে তার স্পিড প্রায় ১০০ টেরা- হার্ৎজ অবধিও হতে পারে [১০, ১১]। কিন্তু ‘অল্‌ অপটিক্যাল কন্ট্রোল’ এখনও খুব প্রাথমিক পর্যায়ে।

অগত্যা ইলেকট্রনিক স্যুইচ ব্যবহার করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফোটনকে কন্ট্রোল করা হয়, অথবা সার্কিটের শুধুমাত্র বিশেষ কিছু অংশ যেগুলি খুব মন্থর  সেসব জায়গায় ফোটোনিক সার্কিট ব্যবহার করা হয়।  আজকের কম্পিউটারের প্রসেসর স্পিড বাড়ানো গেলেও ইন্টারকানেক্ট অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক তারগুলোতে কারেন্ট ধারকত্বের কারণে খুব ধীরে যাতায়াত করে। তাই একে বলে ‘ইন্টারকানেক্ট বটল্‌-নেক’ (চিত্র ৩ (ক)) [১২]।

চিত্র ৩। (ক) কম্পিউটার ইন্টারকানেক্ট বোটল্‌নেক সমাধানে ইলেকট্রনিক-ফোটোনিক হাইব্রিড সার্কিট
(খ) ইন্টিগ্রেটেড ফোটোনিক সার্কিটের কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন অপটিক্যাল ওয়েভগাইড বা তার, রিং রেসোনেটর, ইন্টারফেরোমিটার ইত্যাদি।
গ) মাইক্রোরিং রেসোনেটরকে অপটিক্যাল সুইচ, ট্রানজিস্টার বা ইলেকট্রো-অপটিক্‌মড্যুলেটর হিসাবে ব্যবহার করা যায়। মাইক্রোরিং রেসোনেটর দিয়ে তৈরী ইলেকট্রো-অপ্‌টিক্‌ সুইচ। (সূত্রঃ মিকাল লিপ্‌সন গ্রুপ ওয়েবসাইট- https://lipson.ee.columbia.edu/, চিত্রাঙ্কণেঃ রক্তিম)

এই সমস্যার সমাধানে তাই প্রাথমিকভাবে কম্পিউটারে শুধু ইলেকট্রনিক ইন্টারকানেক্ট-গুলোকে ফোটোনিক ইন্টারকানেক্ট দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার কথা ভাবা হচ্ছে। ফলত, গোটা সার্কিটের সর্বোচ্চ স্পিড সেই ইলেকট্রনিক প্রসেসরের সর্বোচ্চ স্পিড দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা কিনা তুলনায় কম। তবু এটাও একটা বিশাল পদক্ষেপ। একে বলে ‘ইলেকট্রনিক-ফোটোনিক হাইব্রিড টেকনোলজি’। কম্পিউটার চলবে আধা আলোয়, আধা কারেন্ট-এ। এই ধরণের প্রযুক্তিতে তথ্যের আদানপ্রদান কারেন্ট থেকে আলোয় রূপান্তরিত করে ইলেকট্রো-অপটিক্‌মড্যুলেটর। সুইচ/অপটিক্যাল-ট্রানজিস্টার, বা মড্যুলেটর হিসাবে ছোটো ছোটো লাইট ইন্টারফেরোমিটার বা রেসোনেটর (অনুনাদক) যেমন, ম্যাক-জ়েন্ডার ইন্টারফেরোমিটার, মাইক্রোরিং রেসোনেটর ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় (চিত্র ৩ (খ)-(গ))। চিত্র ৩ (গ)-তে ফোটোনিক চিপের উপর একটা রিং দেখা যাচ্ছে। রিঙটিতে যতক্ষণ বাইরে থেকে ৫ ভোল্ট (ডেটা ‘১’) দেওয়া হয় ততক্ষণ রেসোনেন্স হয় না। ফলে লেসার রশ্মি সটান গিয়ে আউটপুট পোর্ট থেকে নির্গত হয়। আবার, তামার তারে কোনো ভোল্টেজ বা ডেটা না দিলে রিং-এ রেসোনেন্স হয় ফলে লেসার রশ্মি রিং এর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে ঘুরতে থাকে। অতএব আউটপুট ‘০’ হয়। সুতরাং এইভাবে খুব সহজেই অপটিক্যাল সুইচ বানানো যায় [১১]।

তবুও ভবিষ্যত উজ্জ্বলঃ কোয়ান্টাম কম্পিউটার, নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং ফোটোনিক্স

বিশ্ববরেণ্য নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফাইনম্যান নব্বই এর দশকে দেখান, পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণু যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভূতুড়ে নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ, সেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের শক্তিকে আহরণ করে অর্থাৎ কোয়ান্টাম টেকনোলজির মাধ্যমে বানানো যায় অসীম ক্ষমতাশালী কোয়ান্টাম কম্পিউটার এবং কোয়ান্টাম ইন্টারনেট। আজকের যুগের সাধারণ (ক্লাসিকাল) ইলেকট্রনিক কম্পিউটার যে কোনো পাসওয়ার্ড বা কোড হ্যাক করতে যদি লক্ষ-কোটি বছর সময় নেয়, কোয়ান্টাম কম্পিউটার সেই কাজ করতে পারবে নিমেষে। এছাড়াও কোয়ান্টাম কম্যুনিকেশন লিঙ্ক হবে সম্পূর্ণ হ্যাক-প্রুফ। অতএব কোনো দেশ যদি এই কোয়ান্টাম প্রযুক্তি গোপনে কুক্ষিগত করে ফেলে, বাকি দেশগুলোর জাতীয় সুরক্ষার পক্ষে তা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। সেই দেশ চাইলেই নিজে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থেকে মেঘনাদের মতন দূর্ভেদ্য মেঘের আড়াল থেকে আক্রমণ শানিয়ে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে অন্য দেশের স্বাভাবিক জনজীবন। এ যেন এক ঢিলে দুই-পাখি।

এতদিন সুপারকন্ডাক্টিং পদার্থ ব্যবহার করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো খুব সম্ভাবনাময় মনে হয়েছিল। গুগলের সিকামোর প্রসেসর-এর কথা নিশ্চয় শুনেছেন। এই প্রসেসর কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর লক্ষ্যে এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। সমস্যা হল, এই ধরণের সুপারকন্ডাক্টিং পদার্থ দিয়ে তৈরী প্রসেসর শুধু অতিশীতল উষ্ণতায় কাজ করে, অতএব একেবারেই সাধারণ মানুষের ব্যবহারোপযোগী নয়। বিজ্ঞানীরা তাই মূলত তিনটি কারণে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বা কোয়ান্টাম কম্যুনিকেশন লিঙ্ক তৈরী করতে ফোটোনিক টেকনোলজি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন [৭, ৮]। তা হোলোঃ (১) ফোটনের উপর নয়েজের প্রভাব সীমিত, (২) নয়েজের প্রভাব কম বলে, অতিশীতল উষ্ণতা নিষ্প্রয়োজন, ঘরের তাপমাত্রাতেই (২৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড) কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানো সম্ভব, (৩) উন্নত মানের ফোটোনিক সার্কিট বাজারে এসে গেছে যা কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে সরাসরি ব্যবহার করা যেতে পারে। খুব সম্প্রতি গুগলের সিকামোর প্রসেসরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে এরকম ‘কোয়ান্টাম ফোটোনিক প্রসেসর’-ও এসে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে [৯]।

এদিকে আজকের যুগের কম্পিউটার নিজে থেকে ভেবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ। আমরা যা নির্দেশ দিই, তা-ই পালন করে মাত্র। এর নিজস্ব কোনো বুদ্ধি নেই। গবেষণা চলছে এমন এক ধরণের বিচক্ষণ কম্পিউটার বানানোর যা মানুষের মতন নিজে থেকে ভাবতে সক্ষম। মানুষের ব্রেন এর মতন করে বানানো হচ্ছে এদের প্রসেসর। এইসব কম্পিউটারের সার্কিটে থাকবে ব্রেনের স্নায়ুকোষ বা নিউরোন সদৃশ কোটি কোটি কানেকশন কিম্বা নিউরাল নেটওয়ার্ক। এই সার্কিটগুলো কম্পিউটারকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নানা ইনপুট দিলে কী আউটপুট অথবা ফলাফল আসবে তার গুণাগুণ বিচার করে ভাবতে শেখাবে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল [১৩]! ইলেকট্রনিক সার্কিটের থেকে ফোটোনিক সার্কিটে শক্তির অপচয় অনেক কম বলে এই ধরণের নিউরো-মর্ফিক কম্পিউটার পরিচালনার  জন্য যে ফোটোনিক টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে তা সহজেই অনুমেয়। তাই ‘deep learning’ বা ‘machine learning’-এর ভবিষ্যতও হয়তো ফোটোনিক্সেই নিহিত।

ফোটোনিক্সের অন্যান্য ব্যবহারঃ চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং গ্রীন ম্যুভমেন্ট

ফোটোনিক্স যে শুধুমাত্র কম্পিউটার তৈরী করার কাজে বা যোগাযোগ ব্যবস্থাতে ব্যবহৃত হয় তা নয়। চোখের চিকিৎসা থেকে বিভিন্ন রোগ যেমন ক্যান্সার নির্ণয়ে এর ভূমিকা আছে। এছাড়াও ফোটোনিক সেন্সর এতটাই সূক্ষ্ম পরিমাপ করার ক্ষমতা রাখে যে রক্তে ক্ষতিকারক অতিক্ষুদ্র ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাসের উপস্থিতি পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারে [১৪]। সুতরাং কোভিড-১৯ পরবর্তী দুনিয়ায় ফোটোনিক সেন্সর বহুলব্যবহৃত হতে চলেছে। উন্নতমানের সোলার সেল তৈরী করতেও আজকাল ফোটোনিক সার্কিট ব্যবহার করা হচ্ছে যা দূষণমুক্ত সবুজ পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় [১৫]। 

বিশ্বে এবং ভারতে ফোটোনিক্স

নতুন যুগের কম্পিউটারে ইলেকট্রনিক্সের বদলে ফোটোনিক্স আসতে চলেছে অনুধাবন করে বড় বড় কোম্পানিগুলি যেমন ইন্টেল, আই. বি. এম., অ্যাপল ইত্যাদিকয়েক দশক ধরেই পুরোদমে ফোটোনিক্সের গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়াও আছে থোরল্যাবস, নিউপোর্ট, মেনলো, ফিনিসার, নেভিটার, লাইকা যারা লেসার, অপটিক্যাল বেঞ্চ, অপটিক্যাল লেন্স, মাইক্রোস্কোপ, আল্ট্রা-স্পিড ক্যামেরা, এবং ফিল্টার বানায়। টেলিকম্যুনিকেশনে অগ্রগণ্য কোম্পানি যেমন সিস্‌কো, বা জাপানের এন টি টি কম্যুনিকেশনস ফাইবার অপটিক্‌ টেকনোলজি সংক্রান্ত গবেষণায় অনেক অর্থ বরাদ্দ করছে। এরই সঙ্গে আবার বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বিশ্বজুড়ে ছোটো-বড় আরও প্রায় কয়েকশ কোম্পানি (লিস্ট আমার ওয়েবসাইটে প্রদত্ত [১৬])  কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে।

ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, জার্মানী, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, চিন, জাপান, তাইওয়ান, সাউথ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি যেকোনো উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন ফোটোনিক্স নিয়মিত কোর্স এবং গবেষণার অন্তঃর্ভূক্ত। ভারতে প্রথমসারির গবেষণাকেন্দ্র যেমন আইসার (IISER), নাইসার (NISER), টি. আই. এফ. আর. (TIFR), রমন রিসার্চ ইন্সটিটিউট (RRI), সি. এস. আই. আর. (CSIR) (CGCRI – কেন্দ্রীয় কাঁচ ও সেরামিক গবেষণা সংস্থা) বসু বিজ্ঞান মন্দির, হরিশ চন্দ্র রিসার্চ ইন্সটিটিউট (HRI) এবং প্রযুক্তিকেন্দ্র যেমন আই. আই. টি. (IIT), বা এন. আই. টি. (NIT) গুলোতেও বর্তমানে ফোটোনিক্স নিয়ে রিসার্চ করার সুযোগ হয়েছে [১৭]। সঙ্গে রয়েছে কিছু ননপ্রফিট অরগ্যানাইজেশন যেমন Optical Society of America (OSA), IEEE, SPIE, Optical Society of India (OSI), American Physical Society (APS) ইত্যাদি যারা প্রতিবছর পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন সেমিনার, কনফারেন্স বা অন্যান্য মনোগ্রাহী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের ফোটোনিক্স নিয়ে গবেষণার কাজে প্রবল উৎসাহ প্রদান করে চলেছে [১৮-২০]।

ভারতীয় বিজ্ঞানী এবং ফোটোনিক্স

আলোকবিজ্ঞানে এবং ফোটোনিক্সে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদান উল্লেখ না করলে ‘ভারতে ফোটোনিক্স’ নিয়ে আলোচনাটি অসম্পূর্ণই থেকে যায় (চিত্র  ৪)। ভারতীয় বিজ্ঞানী সি. ভি. রামন যেমন রামন-এফেক্ট আবিষ্কার করে ১৯৩০ সালে নোবেল-প্রাইজ পান। বাঙালী বিজ্ঞানী সত্যেন বসু আইন্‌স্টাইনের সঙ্গে যুগ্মভাবে বোসন কণার ধর্ম সর্বপ্রথম ব্যাখ্যা করেন। ফোটন কণিকা একপ্রকার বোসন কণিকা।

চিত্র ৪। (ক) নোবেলজয়ী ভারতীয় বিজ্ঞানী সি. ভি. রামন, (খ) মহান বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস । চিত্রাঙ্কণেঃ রক্তিম।

এছাড়াও বিজ্ঞানী নরীন্দর সিংহ কাপানীকে ফাইবার অপটিক্সের  জনক বলে আখ্যা দেওয়া হয়। প্রফেসর ই. সি. জি. সুদর্শনের আবার কোয়ান্টাম অপটিক্সে অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়াও আছেন মণি ভৌমিক (লাসিক eye-অপারেশন), বিজ্ঞানী অজয় ঘটক (ফাইবার অপটিক্স), দিলীপ ভাওলকর (লেসার অপটিক্স), চন্দ্র কুমার পটেল (কার্বন-ডাই-অক্সাইড লেসারের আবিষ্কার), প্রফেসর বিশ্বনাথ মুখার্জি, ও প্রফেসর অনুরাগ শর্মা (অপটিক্যাল কম্যুনিকেশন এবং নেটওয়ার্কিং),  গোবিন্দ আগ্রাওয়াল (নন্‌লিনিয়ার অপটিক্স), গিরীশ আগরওয়াল এবং রূপমঞ্জরী ঘোষ (কোয়ান্টাম অপটিক্স), প্রমুখ। এদের ভূমিকা আলোকবিজ্ঞানের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আরও কিছু তথ্যঃ গত বিশ বছরে ফোটোনিক্স সংক্রান্ত গবেষণায় নোবেল প্রাইজের পরিসংখ্যান

পরাধীন ভারতবর্ষের অবিস্মরণীয় এবং দুর্লভ প্রতিভা আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা পরবর্তীকালে নরীন্দর সিংহ কাপানী, এবং ই. সি. জি. সুদর্শন কেন নোবেল প্রাইজ পেলেন না সে বিতর্কে আজ যাব না। তবে সবশেষে পরিবেশন করবো এক মজার তথ্য [২১]। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পেতে চাইলে কিন্তু ফোটোনিক্স নিয়ে গবেষণার পথ বেছে নেওয়াই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়! অন্তত গত কুড়ি বছরের পরিসংখ্যান তো তাই বলে। 

২০১৮ তে আল্ট্রা-ফাস্ট লেসারের আবিষ্কার করার জন্য নোবেল পান ডনা স্ট্রিকল্যান্ড এবং অন্যান্যরা। ২০১৪ তে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় কয়েক দশক আগে আবিষ্কৃত নীল LED এর জন্য। এছাড়া ২০০৯ তে ফাইবার অপ্‌টিক টেকনোলজিতে (বিজ্ঞানী চার্লস কাও) এবং সিসিডি ফোটো সেন্সর আবিষ্কার করে (বয়েল ও স্মিথ), ২০০৫ এ কোয়ান্টাম অপটিক্সে (গ্লবার), অপটিক্যাল ফ্রিকোয়েন্সি কম্ব (প্রফেসর থিয়োডর হ্যন্স, জন হল), এবং ২০০০ সালে অপ্টো-ইলেকট্রনিক সার্কিট সংক্রান্ত গবেষণায় নোবেল প্রাইজ আসে। আরও চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হলো বাকি নোবেল বিজয়ীরাও কোনো না কোনো ভাবে ফোটোনিক্সের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। যেমন ধরুন, লেসার কুলিং-এর সাহায্যে পরমাণুকে অতিশীতল তাপমাত্রায় বন্দি করে ফেলার উপায় বাতলে নোবেল পান বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং লেখক ক্লুড-কোহ্‌ন-তনুডজি (Claude Cohen-Tannoudji) (উল্লেখ্য যে ওনার লেখা কোয়ান্টামের পাঠ্যবইটি বিখ্যাত), উইলিয়াম ফিলিপ্স, স্টিভেন চু (১৯৯৭), এবং উলফ্‌গ্যাং কেটারলী, এরিক কর্নেল, ও কার্ল ওয়াইম্যান (২০০১)। ২০১২ সালে ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড আর সার্জ হারোশ নোবেল পুরস্কার পান যথাক্রমে লেজার দিয়ে পরমাণুকে এবং পরমাণু দিয়ে ফোটনকে প্রভাবিত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এমনকি ২০১৭-তে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের জন্য নোবেল আসে কিন্তু লেসার সেন্সিং টেকনোলজির উপর ভরসা রেখেই। আবার ২০১০ সালে আন্দ্রে গিম গ্রাফিন আবিষ্কার করেন যা ফোটোনিক টেকনোলজিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।

সুতরাং প্রযুক্তির জগতে বিপ্লব আনতে চলেছে ফোটোনিক্স। বলা যেতেই পারে যে ইলেকট্রনিক যুগের জয়যাত্রা ব্যাহত হওয়া অবশ্যম্ভবী এবং নতুন যুগের আলোকবর্তিকা আলোকবিজ্ঞানের হাতেই।

সূত্র (References):

[১] https://www.osa.org/en-us/history/milestones/centennial_book/

[২] https://www.light2015.org/Home/WhyLightMatters/Connecting-the-World.html

[৩] https://www.technologist.eu/a-brief-history-of-photonics/

[৪] https://www.photonics.com/LinearChart.aspx?ChartID=3

[৫] https://www.nanoscribe.com/en/

[৬] S. Bag, R. Haldar, M. Wan, S. K. Varshney, “Fabrication and Performance Analysis of Mach-Zehnder Interferomter Couplerd Polymer Microring Resonator with Microfluidic Channel for Refractive-index Sensing,” Frontiers in Optics and Laser Science (FiO/LS), Washington DC, USA, Paper ID: FW6C.3.

[৭] J. L. O’brien, A. Furusawa, and J. Vučković, “Photonic quantum technologies,” Nature Photonics, vol. 3, no. 12, pp. 687-695, 2009.

[৮] J. Carolan et al., “Universal linear optics,” Science, vol. 349, no. 6249, pp. 711-716, 2015.

[৯] Han-Sen Zhong et al., “Quantum computational advantage using photonics,” Science , recently published on December 3, 2020 (সদ্য প্রকাশিত).   

[১০] R. G. H. van Uden et al., “Ultra-high density spatial division multiplexing with a few-mode multicore fiber,” Nature Photonics, vol. 8, pp. 865-870, 2014.

[১১] Q. Xu and M. Lipson, “All-optical logic based on silicon micro-ring resonators,” Opt. Express, vol. 15, no. 3, pp. 924-929, 2007.

[১২] A. Alduino and M. Paniccia, “Interconnects: Wiring electronics with light,” Nature Photonics, vol. 1, no. 3, pp. 153-155, 2007.

[১৩] P. R. Prucnal, and B. J. Shastri, Neuromorphic Photonics, CRC Press, 2017.

[১৪] F. Vollmer, S. Arnold, and D. Keng, “Single virus detection from the reactive shift of a whispering-gallery mode,” Proceedings of National Academy of Sciences, vol. 105, no. 52, pp. 20701-20704, 2008.

[১৫] M. L. Brongersma, Y. Cui, S. Fan, “Light management for photovoltaics using high-index nanostructures,” Nature Materials, vol. 13, no. 5, pp. 451-460, 2014.

[১৬] https://sites.google.com/view/raktim-haldar/resources/photonic-industries?authuser=0

[১৭] B. Pal, “Photonics in India,” Nature Photonics, vol. 5, no 8, pp. 440-443, 2011.

[১৮] https://www.photonicssociety.org/.

[১৯] https://www.osa.org/en-us/home/.

[২০] https://physics.aps.org/ [২১] https://www.osa.org/en-us/about_osa/osa_nobel_laureates/

The post দেওয়ালে পিঠ ইলেকট্রনিক্সের – আলোয় চলবে নতুন যুগের কম্পিউটার? – দ্বিতীয় পর্ব appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).


কোভিড-১৯ ধরার এতোরকমের টেস্ট কেন?

$
0
0

করোনাভাইরাস  SARS-CoV‑2 এবং তার থেকে জাত কোভিড-১৯, এখনো এদের প্রভাব সম্পূর্ণ বোঝা যায়নি। একদল লোক নিজের অজান্তেই ভাইরাস বয়ে বেড়ায়, অপরদিকে অন্য একদল ভাইরাসের কবলে পড়লো তো আর রক্ষে নেই। ভারত আস্তে আস্তে যত স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরত আসার চেষ্টা করছে, ভাইরাসও তেমনি ছড়াচ্ছে আরো প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে স্বাস্থ্য পরিষেবা তুলনায় দুর্বল। তাই বোঝা দরকার ভাইরাসের ছোয়াঁচ কিভাবে লাগে এবং কাদের বেশি সুরক্ষার প্রয়োজন।

এই দুটো প্রশ্নেরই একটা চটজলদি উত্তর আছে। তাদেরই বেশি সুরক্ষার প্রয়োজন যাদের মধ্যে কোভিড-১৯-এর উপসর্গগুলো বেশিমাত্রায় দেখা যায়, প্রায়শই যাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়ে। অন্যদিকে ছোঁয়াচের সম্ভাবনা তাদের থেকেই বেশি যাদের মধ্যে সেই উপসর্গগুলো একেবারেই নেই, তাই তাদের চেনার উপায় নেই। এই উত্তর থেকে কোভিড-১৯ সামলানোর যে উপায়টা বেরোয় সেটা খুব সহজ: যত বেশি রোগ সনাক্ত করা যাবে, তত সুবিধে হবে সামলাতে। যদি এই ভাইরাসকে অল্প খরচে চেনার উপায় থাকতো, যেটা বাড়িতে কিনে রাখা যেত, যেমন সুগার বা প্রেসার মাপার যন্ত্র কিনে রাখা যায়, তাহলে  কোভিড-১৯-এর ছবিটা হয়তো এদ্দিনে অন্যরকম হতো। কিন্তু সেসব না থাকায় আমাদের ভাইরাস সনাক্তকরণের জন্য বিভিন্ন রকমের উপায় অবলম্বন করতে হয়েছে। প্রত্যেকটা উপায়েরই কিছু ভালোখারাপ দিক রয়েছে।

একটা ভাইরাস চেনা যায় কিভাবে?

ভাইরাসের মতো অতিক্ষুদ্র জিনিস খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। একটা উপায় হতে পারে পরোক্ষ সনাক্তকরণ। ভাইরাস থাকলে যে উপসর্গগুলো দেখা যায়, তাই থেকে তাকে চেনা সম্বব। কিন্তু কোভিড-১৯-এর উপসর্গ বিভিন্ন রকমের। তার মধ্যে কিছু যেমন কাশি কিম্বা জ্বর সার্স-কভ-২-এর  (SARS-CoV-2) একার বিষেশত্ব নয়। অনেকরকম ভাইরাসের আক্রমণেই সেগুলো দেখা যায়। তাই, বাইরের উপসর্গের উপর ভরসা না করে রোগীর স্যাম্পল-এ মলিকুলার বায়োলজি-র নানা পদ্ধতিতে ভাইরাস-এর টুকরো খোঁজা হয়। এই টুকরোগুলো হতে পারে ভাইরাসের প্রোটিন বা জিনোম-এর অংশ, যেমন রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (আরএনএ)। এগুলো পাওয়া যায় নাসিকা কিম্বা গলা থেকে নেওয়া swab কিম্বা থুতুর স্যাম্পল-এ। তুলনায় কম হলেও  কিছু রোগীর মলে ভাইরাসের আরএনএ পাওয়া যায়।

বহিরাগত বস্তুর সংক্রমণ হলে আমাদের দেহ প্রত্যুত্তরে অ্যান্টিবডি তৈরী করে। দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা (immune system) সেই বস্তুর প্রোটিনের অংশবিশেষ থেকে বুঝতে পারে, এ জিনিস এখানকার নয়, এদের এখানে থাকলে চলবে না। সেই চিনিয়ে দেওয়া প্রোটিনগুলোকে বলে অ্যান্টিজেন। এদের উত্তরে দেহও তৈরী করে নিজের একদল প্রোটিন, যেগুলো সেই অ্যান্টিজেন-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এই প্রোটিনগুলোকেই বলে অ্যান্টিবডি। এদের তৈরী করে রক্তে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে, রক্তপরীক্ষা করে কোনো বিশেষ অ্যান্টিবডি কিম্বা অ্যান্টিজেন খুঁজে পেলে তার থেকে সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের উপস্থিতি টের পাওয়া যেতে পারে।

RT-PCR – ভাইরাস চেনার সর্বস্বীকৃত পদ্ধতি

ভাইরাসের আরএনএ ক্রমবিন্যাস (RNA sequence) ২০২০-র ফেব্রুয়ারীতেই হাসিল হয়ে গেছিল। এর ফলে গবেষকরা সেই বিন্যাসের বিশেষ কিছু জায়গাকে ভাইরাসের ‘দস্তখত’ হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলোকে খোঁজার পদ্ধতি বার করে ফেললেন। Reverse Transcriptase – Polymerase Chain Reaction বা সংক্ষেপে RT-PCR পদ্ধতিতে উৎসেচকের মাধ্যমে এই বিশেষ জায়গাগুলোকে সংখ্যায় বাড়িয়ে তারপর সেগুলোকে সনাক্ত করা হয়। এই পদ্ধতির সাফল্যের হার ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০-টা ভাইরাস-আক্রান্ত স্যাম্পলের মধ্যে ৩০-টা ধরা নাও পড়তে পারে। এছাড়াও এই পদ্ধতিটার জন্য চাই বিশেষ PCR মেশিন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেশিনচালক এবং মূলত বাইরে থেকে আমদানি করা রিঅ্যাকশন কিট (reaction kit)। এই সবই যোগ হয় শেষের হিসেবে। যেহেতু স্যাম্পলে জীবন্ত ভাইরাস রয়েছে, সেগুলোকে যেখানে সেখানে পরীক্ষা করা যায়না। বিশেষ সুরক্ষাব্যবস্থা থাকলে –বায়োসেফটি লেভেল ২ (Biosafety Level 2) বা তার উপরে– তবেই একটা জায়গায় এই পরীক্ষার  অনুমতি পাওয়া যায়। এসবই শ্রম এবং খরচ সাপেক্ষ। তাই অনেক লোককে অল্পখরচে পরীক্ষা করার জন্য RT-PCR মোটেই সুবিধের নয়।

একটা কোভিড পরীক্ষাগারের এক ঝলক (সূত্র: CSIR-CCMB)

অ্যান্টিবডি বা অ্যান্টিজেন-এর খোঁজ

গণহারে পরীক্ষা তখনই সম্ভব যখন সেই পরীক্ষা করতে যৎসামান্য পরিকাঠামো বা প্রশিক্ষণ থাকলেই চলবে এবং যথাসম্ভব অল্পখরচে চটজলদি করা যাবে। এই ধরণের পরীক্ষার সময়োত্তীর্ণ উপায় হলো অ্যান্টিবডি বা অ্যান্টিজেন-এর খোঁজ করা। অ্যান্টিবডি যেহেতু তার জুড়িদার অ্যান্টিজেন-এর সাথেই বন্ধন স্থাপন করতে পারে, একগুচ্ছ অ্যান্টিবডি স্টকে থাকলে রক্তের স্যাম্পলে অ্যান্টিজেন-এর উপস্থিতি সনাক্ত করা যায়। বা উল্টোটা, অর্থাৎ অ্যান্টিজেন-এর সাহায্যে অ্যান্টিবডির সনাক্তকরণ, সেটাও করা যায়। অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি দুটোকেই ব্যাপক হারে তৈরী করা, আলাদা করা এবং শুদ্ধিকরণ করা সম্ভব। বিশুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেলে এদের একটা প্লেট কি কাগজের স্ট্রিপে বন্দী করে যেখানে প্রয়োজন সেখানে ব্যবহার করা যায়। অ্যান্টিজেন-এর সাথে যে অ্যান্টিবডির বন্ধন ঘটলো, সেটা সাব্যস্ত করা যায় নানাভাবে, এবং এই ধরণের পরীক্ষা ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন রোগ সনাক্ত করা হয়েওছে। শুনতে সোজা লাগলেও একটা নতুন অ্যান্টিবডি বা অ্যান্টিজেন টেস্টিং কিট বানাতে কিছু ধকল রয়েছে। সার্স-কভ-২ ভাইরাসটার অ্যান্টিজেন টেস্টিং কিট বানাতে প্রথমে শুধু এই ভাইরাসেই প্রকাশ পায়, এরকম অ্যান্টিজেন চিহ্নিত করতে হবে। সেই অ্যান্টিজেন-এর অ্যান্টিবডি তৈরী করে জমাতে হবে ভবিষ্যতের পরীক্ষার জন্য। তার জন্য একটা শর্ত হলো, অ্যান্টিজেনটাকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রকাশিত হতে হবে যাতে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার কাছে সেটা ধরা পড়ে। কেন? কারণ অ্যান্টিবডিটা সৃষ্টি করা হয় গবেষণাগারের ইঁদুর-প্রভৃতি জন্তুর শরীরে (সবরকম অনুমতি নিয়ে)। তারপর তাকে আলাদা করে তবেই অ্যান্টিজেন টেস্টিং কিট-এ ব্যবহার করা হয়।

গবেষণাগারে ইঁদুরের দেহে নির্জীব সার্স-কভ-২ ভাইরাস ইনজেকশন-এর মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে (সবরকম অনুমতি নিয়ে তবেই এইভাবে অ্যান্টিবডি তৈরী করা যায়)

অ্যান্টিবডি টেস্টিং কিট বানাতে গবেষণাগারে তৈরী কোষের ভিতর সার্স-কভ-২-এ পাওয়া যায়, এরকম অ্যান্টিজেন বানানো হয়। এভাবে কৃত্রিম উপায়ে প্রচুর অ্যান্টিজেন বানানো গেলেও সেই অ্যান্টিজেন-এর সহজাত গঠনের সাথে এদের কিছু তফাৎ থেকে যায়। তাই, সেই অ্যান্টিজেন আমাদের দেহের ভিতর তৈরী অ্যান্টিবডির সাথে বন্ধন স্থাপন করবে কিনা, তার নিশ্চিত গ্যারান্টি নেই। এছাড়া, স্যাম্পলে ভাইরাসের সংখ্যা কম থাকলে, যেমন ছোঁয়াচ লাগার শুরুর দিকে, অ্যান্টিবডি টেস্টিং-এ ধরা নাও পড়তে পারে। তাই, এই পরীক্ষায় নেগেটিভ রেজাল্ট এলেও RT-PCR-এর মাধ্যমে সেই রেজাল্ট যাচাই করে নেওয়া উচিত। ওটাই এখনো অব্দি সবথেকে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা।

অ্যান্টিবডি টেস্টিং কিট-এর আরেকটা সমস্যা হলো, যতই সার্স-কভ-২-এর জন্য ডিজাইন করা হোক না কেন, সে অন্য ধরণের করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডিকেও চিহ্নিত করে ফেলতে পারে। অপরদিকে, উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর  দেহে অ্যান্টিবডির জন্ম হতে সপ্তাদুয়েক লাগে। তাই তার মধ্যে পরীক্ষাটা করলে পজিটিভ ধরাই পড়লো না, এমনও হতে পারে। আনুমানিক ১০ শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তি এই পরীক্ষায় পজিটিভ ধরা পড়ে না। আমরা এটাও নিশ্চিতভাবে জানি না যে দেহে অ্যান্টিবডি জন্মানোর পর সেটা কতদিন অব্দি থাকে। তার মানে অ্যান্টিবডি টেস্টিং করে একটা অঞ্চলের কতজন আক্রান্ত, তার সঠিক ছবি পাওয়া গেল কিনা, সেটাও আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়।

সার্স-কভ-২-এর স্পাইক (S) এবং নিউক্লিওক্যাপসিড (N) প্রোটিন এইসব পরীক্ষার কিট বানাতে অ্যান্টিজেন হিসেবে ব্যবহারের জন্য আদর্শ। বিশেষ করে N প্রোটিন এই ভাইরাসে সবথেকে বেশি রয়েছে এবং ফলে সহজেই অ্যান্টিবডির জন্ম দেয়। যদিও S প্রোটিন ব্যবহার করলে আরো ভালো কারণ এই প্রোটিনটা সার্স-কভ-২-কে অন্যান্য করোনাভাইরাসের থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।

জনগণের উপর নজর রাখার উপায়

এখন বাজারহাট, দোকানপত্তর সব খুলে গেছে। তাই, কোথাও সংক্রমণ বাড়ছে কিনা, সেটা নজর রাখার একটা সহজ উপায় থাকলে ভালো। লোকের ঘরে ঘরে গিয়ে পরীক্ষা করার উপর নির্ভরশীল না হয়ে অন্য কোনো উপায়ে এই নজরদারি করতে পারা জরুরি। বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে যেখানে অনেকগুলো অঞ্চলে জনসংখ্যা ঘনত্বের কারণে এইধরণের  ঘরে-ঘরে পরীক্ষা প্রায় সাধ্যের বাইরে।

মুম্বাই, দিল্লী, পুনে এবং অন্যান্য অনেক শহরে এখনো অব্দি এইরকম পরীক্ষা হয়েছে। কিছু অঞ্চলে ঘরে-ঘরে রক্তের স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করে তার ফলাফলের ভিত্তিতে পুরো শহরটার একটা ছবি তৈরী করার চেষ্টা হয়েছে। গোটা দেশেই এখন এরকমভাবে নজর রাখার চেষ্টা চলছে। এইসব পরীক্ষার উপর নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার যাচাই করতে পারে তাদের কোভিড সামলানোর নিয়মকানুনগুলো কাজে দিলো কিনা। কিন্তু এইভাবে নজর রাখতে হলে অনেক স্বেচ্ছাসেবক লাগবে। সংক্রমণের উপর নজর রাখার এমন উপায়ও হয় যাতে স্বেচ্ছাসেবক লাগে না এবং লোককে ধরে ধরে পরীক্ষাও করতে হয়না। আক্রান্ত ব্যক্তি মূলত নিশ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে বাতাসে কিম্বা জলে যেসব ভাইরাস ছেড়ে যায়, সেগুলোকে সনাক্ত করেও এই কাজটি করা যায়। তবে বাতাসের মাধ্যমে নজরদারির উপায় নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। আরেকটা উপায় হলো নিকাশী পদার্থের (sewage) উপর নজর রাখা। কোভিড আক্রান্ত রোগীদের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশের মলের মধ্যে  ভাইরাসের আরএনএ থাকে, ফলে নিকাশী পদার্থে তাদের উপস্থিতি সনাক্ত করা যায়। চেন্নাই বা হায়দরাবাদ-এ এরকম নিকাশী পদার্থের উপর নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানে এইসব  পদার্থগুলোকে রাসায়নিকভাবে সংস্কার করা হয়, সেইসব সিওয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট-এ কতটা পদার্থ এলো, কোত্থেকে এলো সেসবের হিসেব থাকে। নিকাশী জলে কতটা ভাইরাস-এর আরএনএ রয়েছে, সেটা RT-PCR পদ্ধতিতে মাপা যায়। দুইয়ে মিলে গবেষকরা একটা পরোক্ষ ধারণা করতে পারেন শহরের কোথায় কতটা সংক্রমণ হয়েছে।

সিওয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে স্যাম্পল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পরীক্ষার জন্য (সূত্র: CSIR-CCMB)

উপসর্গ দেখা দেওয়ার প্রায় ৩৫ দিন পর অব্দি রোগীর মলে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের আরএনএ থাকতে পারে। অতএব এইরকম নিকাশী পদার্থের উপর পরীক্ষা করলে যে কোনো একটা অঞ্চলে গত এক মাস কি অবস্থা ছিল, তার একটা মোটামুটি ছবি পাওয়া যায়।

এতসব জেনে কি হবে?

এইরকম বিভিন্ন পদ্ধতিতে পাওয়া ফলাফলগুলোকে নিয়ে সরাসরি একে অপরের সাথে মেলানো ঠিক নয়। হায়দরাবাদে যখন নিকাশী পদার্থের পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া ফলাফল ঘোষণা করা হলো, তখন হইচই পড়ে গেছিল। হঠাৎ সংক্রমণ বেড়ে গেল কি করে? যেটা লক্ষ্য করা হয়নি সেটা হলো যে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ পরীক্ষার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। দ্বিতীয়টাতে অনেক বেশী লোককে পরীক্ষার আওতায় আনা যায়।

নিকাশী পদার্থ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনেক বড় এলাকা জুড়ে সংক্রমণের চেহারাটা যথাসামান্য কম খরচে পাওয়া যায়। কিন্তু এই পদ্ধতিটা মূলত শহুরে অঞ্চলেই সীমিত। অন্যদিকে, বেশীরভাগ স্বাস্থ্যকর্মীই রক্তে অ্যান্টিবডির মাধ্যমে রোগনির্ণয়ে অভ্যস্ত। এটা অবশ্যই শহর গ্রাম দুজায়গাতেই চালু আছে। রক্তপরীক্ষার ফলাফলের তথ্যে খুব নিখুঁতভাবে খেয়াল রাখা যায় রোগীদের বয়েস কত, তাদের মধ্যে স্ত্রী কতজন আর পুরুষ কতজন, বা তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা কিরকম। সেই অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়া যায় একটা বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে রোগের প্রকোপ কমাতে। কিন্তু এই ধরণের পরীক্ষার ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে খেয়াল রাখা উচিত যে কাদের পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেই গোড়ার প্রশ্নটাতেই একটা পক্ষপাত থাকতে পারে। যেমন, মুম্বাইতে যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল সেখানে মহিলাদের কম আক্রান্ত মনে হয়েছিল কারণ মহিলাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণই ছিল কম।

এত ধরণের পরীক্ষা হচ্ছে যে তাদের ভিত্তিতে পাওয়া রোজকার খবর শুনে ঘেঁটে যাওয়া স্বাভাবিক। কি ধরণের পরীক্ষা এবং তথ্যসংগ্রহ হচ্ছে, সেটা অনেকাংশেই সে অঞ্চলে কি যন্ত্রপাতি বা প্রশিক্ষণ রয়েছে, তার উপর নির্ভর করে। এইসব পরীক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে শুধু ব্যক্তিস্বাস্থ্য নিয়ে মাথা ঘামানো বা হতে পারে একটা গোটা এলাকায় সংক্রমণ ঠেকানো। যেহেতু একেকটা পদ্ধতি একেকরকম সূক্ষ্মভাবে রোগ চিহ্নিত করতে পারে, তাই তাদের ভিত্তিতে পাওয়া সংক্রমণের ছবিটাও আলাদা হতে পারে। এই লেখাটা পড়ার পর আশা করি, আগামী দিনে যদি আপনার বা আপনার অঞ্চলে কোভিড পরীক্ষা হয়, আপনি বুঝতে পারবেন ঠিক কি পরীক্ষা করা হচ্ছে, কি তার পদ্ধতি, এবং কিভাবে তার ফলাফলগুলোর পাঠোদ্ধার করা যায়।

(লেখাটি প্রথম IndiaBioscience-এ প্রকাশিত হয়েছিল। মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়।)

The post কোভিড-১৯ ধরার এতোরকমের টেস্ট কেন? appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

নজিরবিহীন দ্রুততায় করোনা টিকা –কিন্তু নিরাপদ তো?

$
0
0

করোনা ভাইরাসের অনুমোদিত ভ্যাক্সিনগুলোর বেশিরভাগ ‘পরবর্তী প্রজন্ম’ বা next generation vaccine। তাড়াতাড়ি তৈরীর পিছনে রয়েছে দীর্ঘ দশ বছরের বেশী গবেষণা, সেই সাথে অপরিসীম অর্থ ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য সরকারী সহযোগিতা ও বহু ভলেন্টিয়ার। BioNTech/Pfizer আর Moderna-র mRNA প্রযুক্তি আর Oxford-Astrazeneca-র ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো নিরাপদ আর কার্যকরী Next gen টিকা খুব চালাকি করে আমাদের শরীরকে দিয়ে অ্যান্টিজেন আর অ্যান্টিবডি দুটোই তৈরী করায়। তবে, করোনা টিকার সাথে শিম্পাঞ্জীর সর্দির একটা সম্পর্ক থাকতে পারে – কী বলতো?


শুরুর সময়

জানুয়ারী ২০২০, শীতের সকাল। জার্মানীর মাইনজ শহর, সেই মাইনজ, যেখানে গুটেনবার্গ ১৪৪০ সালে তাঁর প্রথম ছাপাখানা তৈরী করে গোটা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিলেন। আর পাঁচটা ছুটির দিনের মতই দিনটা শুরু হয়েছে। এক কাপ কফি হাতে ব্রেকফাস্ট টেবিলে অনেকটা দেহাতী হিন্দুস্তানী দেখতে এক ভদ্রলোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে গোগ্রাসে একটা লেখা পড়ছেন। বিশ্ব বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট এ চীনদেশের এক নতুন ভাইরাস নিয়ে একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছে আগের দিনই। সেখানে দেখা যাচ্ছে কি ভাবে এই ভাইরাস একজন মানুষ থেকে আর একজন মানুষে সংক্রামিত হচ্ছে। কখনো কখনো যিনি সংক্রামিত হচ্ছেন, তিনি জানতেও পারছেন না, কারণ তার মধ্যে সংক্রমণের তেমন লক্ষণ ফুটে উঠছে না। এই জায়গাটা পড়েই ভদ্রলোক উত্তেজিত ভাবে তার স্ত্রীকে ডেকে উঠলেন।

কফি কাপেই জুড়িয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী দম্পতি নিবিষ্ট মনে বার বার প্রবন্ধটি পড়ে চলেছেন।

তখনও বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাসের দাপাদাপি শুরু হয় নি। ঘটনাকাল ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের প্যান্ডেমিক ঘোষণারও দুমাস আগে। লকডাউন, N95/KN95 মাস্ক, কোয়ারিন্টিন, ইত্যাদি শব্দগুলো আমজনতার কাছে প্রায় অজানা। চীনের উহান প্রদেশ থেকে অজানা জ্বর সংক্রান্ত কিছু উদ্বেগজনক খবর বেরোতে শুরু করলেও, তার যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব হতে পারে, বা সেটা যে গোটা পৃথিবী জুড়ে অভূতপূর্ব উথালপাথাল তৈরী করতে পারে, তা কারও কষ্টকল্পিত ভাবনাতেও আসে নি।

ভুল বললাম, এ ভাবনা এসেছিল কয়েকজন দূরদর্শী বিজ্ঞানীর মনে। তাঁদের মধ্যে একজন জার্মানির মাইনজ শহরের সেই ডাক্তার গবেষক উগুর শাহীন। প্রথম দর্শনে হয়তো আর পাঁচ জনের মত, সাধারণ কেউ মনে হবে। কিন্তু উগুর শাহীনের জীবন গল্পকথাকেও হার মানায়। ডঃ শাহীন ল্যানসেট এর প্রবন্ধটি পড়েই বুঝতে পেরেছিলেন কি হতে চলেছে; বুঝতে পেরেছিলেন যে ভাইরাস লক্ষণহীন ভাবে সংক্রামিত হতে পারে, তার গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা [1]। গোটা পৃথিবী জুড়ে এক সাংঘাতিক মহামারীর মারণলীলার টাইম বোমার মত বিস্ফোরণ শুধু এক সময়ের অপেক্ষা!

চিত্র ১: ডঃ উগুর শাহীন

আদতে তাঁদের বাবা মা তুরস্কের মানুষ, মধ্যপ্রাচ্যের সেই দেশ, যার সীমানার একদিকে যুদ্ধবিক্ষত সিরিয়া, মাঝে অশান্ত ইরাক আর অন্যদিকে ইরান। কামাল আতাতুর্কের দেশের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলি অনেক আগেই অস্তমিত। উগুরের জন্ম তুরস্কতেই। যখন তার মাত্র চার বছর বয়স তখন উগুরের মা তাকে নিয়ে চলে আসেন জার্মানিতে। সেই উগুর শাহীন, যিনি সেই যাত্রার পঞ্চাশ বছর পর প্রথম অনুমোদিত করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরীর অন্যতম পথিকৃৎ হয়ে পৃথিবীতে নতুন আশার আলো দেখাবেন।

আসলে বিজ্ঞান বোধ হয় এইরকমই। বিজ্ঞানকে স্থান, কাল বা দেশের সীমানাতে বেঁধে রাখা যায় না। বিজ্ঞানী যে দেশেই থাকুন না কেন, তাঁর আবিষ্কারের সুফল ভোগ করে গোটা পৃথিবী। যেমন জোনাস সাল্ক , আমেরিকার এই প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানী পোলিও রোগের টিকা আবিষ্কার করেন নিউইয়র্কে বসে, আর সেই পোলিওর টিকা ব্যবহার করে ভারতবর্ষের মত জনবহুলদেশও পোলিও মুক্ত হয়। পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি বাচ্চা সুস্থ জীবন নিয়ে বাঁচতে পারে। সব দেশের মত এযাত্রাতেও তুরস্কের কিছু কূপমণ্ডূক হইচই জুড়ে দিয়েছে কেন তাঁরা তুরস্ক ছেড়ে জার্মানি গিয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা ঠিক ঠিক ‘দেশপ্রেমিক’ নন। কিন্তু কে জানে, হয়ত তা না করলে সুযোগের অভাবে এই প্রতিভার সঠিক বিকাশ হত না, আর শুধু তুরস্ক নয় গোটা পৃথিবীই তাঁর এই আবিষ্কার থেকে হয়তো বঞ্চিত হত!

যাই হোক, ফিরে আসি ভাইরাস এর টিকা আবিষ্কারের গোড়ার কথায়। পোলিওর টিকা আবিষ্কার করতে জোনাস সাল্ক এর লেগেছিলো প্রায় দশ বছর। দ্রুততম টিকা তৈরী হয়েছিল মাম্পস্ এর ক্ষেত্রে। সেই টিকা তৈরী করতে মরিস হিলম্যানের লেগেছিল প্রায় চার বছর। তাই স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসে কোন জাদুমন্ত্রের জোরে BioNTech এর উগুর শাহীন, Moderna-র ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার বিজ্ঞানীরা প্রায় আট মাসের মধ্যেই কোভিড – ১৯ (SARS-CoV-2) ভাইরাস এর টিকা তৈরী করে আমেরিকার আহার্য ও ঔষধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা Food and Drug Administration(FDA) বা ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রক সংস্থা Medicines and Healthcare products Regulatory Agency (MHRA) -র অনুমোদন করিয়ে নিতে পারলেন। আর তৈরী করে ফেলতে পারলেও এই টিকাগুলি নেওয়া নিরাপদ তো?

আবার চলে আসা যাক মাইনজ শহরে। জানুয়ারির শীতের শনিবার সকালে তৃপ্তির ধুমায়িত কফির কাপ ছেড়ে উগুর তাঁর সাইকেল নিয়ে পড়িমরি করে দৌড় লাগালেন তাঁর রিসার্চ ল্যাবে। যথেষ্ট উপার্জন স্বত্বেও তিনি গাড়ি ব্যবহার করেন না, এমনকি তাঁর নিজস্ব ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই [1]। তড়িঘড়ি পৌঁছলেন তাঁর নিজস্ব কোম্পানীর, BioNTech এর গবেষণাগারে যা তিনি তিলতিল করে তৈরী করেছেন নিজের পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দিয়ে। পেশায় ডাক্তার হলেও, উগুর আর তাঁর ডাক্তার স্ত্রী ওজলেম তুরেসির বরাবরের ঝোঁক নতুন ওষুধ আবিষ্কারের দিকে। দিনের পর দিন তাঁরা দেখেছেন কিভাবে ক্যান্সার রোগীরা কার্যকরী ওষুধের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আর ডাক্তার হয়েও অসহায়ের মত দেখা ছাড়া তাঁদের কিছুই করার থাকে না। ততদিনে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তাঁরা তৈরী করে ফেলেছেন একটি ওষুধ কোম্পানি, যেখানে তাঁরা অন্যরকম উপায়ে ক্যান্সার প্রতিষেধক টিকা তৈরী করবেন, যাতে আর কোন রোগী ওষুধের অভাবে ক্যান্সারে মারা না যান। এই নতুন প্রযুক্তির নাম mRNA বা messengar RNA প্রযুক্তি।

জানুয়ারী ২০২০ এর আগে BioNTechএর গবেষণা পুরোদমে চলছিল mRNA-র সাহায্যে ক্যান্সার ওষুধ তৈরীর কাজে। কয়েক বছর আগে তারা ত্বকের ক্যান্সারের টিকা BNT122 ও তৈরী করে ফেলেছে। BioNTechএর দুবছর পর তৈরী Moderna, বা CareVac -র মত আরও পুরোনো কয়েকটি কোম্পানিও mRNA প্লাটফর্ম নিয়ে জোর কদমে গবেষণা করছে। এই পটভূমিতে ল্যানসেট এর কোভিড- ১৯ নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ এবং উগুর শাহীনের পড়িমরি করে ল্যাবে ছোটা।

চিত্র ২: নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা জিনের কাছ থেকে সংকেত নিয়ে নিউক্লিয়াসের বাইরে সাইটোপ্লাজমে থাকা রাইবোজোম পর্যন্ত জিনের নির্দেশ পৌঁছে দিয়ে আসে মেসেঞ্জার RNA বা mRNA [2]।

করোনা ভাইরাসের যে টিকাগুলি সবচেয়ে দ্রুত তৈরী করা গিয়েছে, তার মধ্যে একটা হচ্ছে এই mRNA পদ্ধতিতে তৈরী টিকা, যা নেক্সট জেনারেশন টিকাগুলির মধ্যে অন্যতম (চিত্র ৩)।

নেক্সট জেনারেশন টিকা

১) mRNA প্লাটফর্ম

আমরা জানি যে প্রোটিন শরীরের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তুগুলির মধ্যে একটি। কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা জিন প্রোটিন তৈরীর নির্দেশ দেয় আর নিউক্লিয়াসের বাইরে থাকা রাইবোজোম জিনের নির্দেশ অনুযায়ী সেই প্রোটিন তৈরী করে।

কিন্তু নিউক্লিয়াস থেকে রাইবোজোম পর্যন্ত জিনের এই নির্দেশ পৌঁছে দিয়ে আসবে কে?

ঠিক এই কাজটি-ই করে mRNA । mRNA জিনের কাছ থেকে যে প্রোটিন তৈরী করতে হবে তার কোড নকল করে রাইবোজোমকে দিয়ে আসে। রাইবোজোম তখন সেই কোড পড়ে নির্দেশিত প্রোটিনটি উৎপাদন করে [2]। (জিন, DNA, RNA ও প্রোটিন তৈরীর বিষয়ে আরো বিশদে জানতে চাইলে এই লেখার শেষে পরিশিষ্ট দেখতে পার)। এখন যদি mRNA তে কারসাজি করে ভাইরাসের গায়ে যে প্রোটিন থাকে রাইবোজোমকে সেই প্রোটিন তৈরীর নির্দেশ পাঠানো যায়, তাহলে কোষ ধরে নেবে যে আমাদের শরীরে সেই প্রোটিন সমেত জীবাণু ঢুকেছে। আর তার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে উঠে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরী করতে শুরু করবে। সুতরাং শরীরের মধ্যে ক্ষতিকর আসল ভাইরাস না ঢুকিয়েও mRNA কে ব্যবহার করে রোগ প্রতিরোধক টিকা তৈরী করা যেতে পারে।

ঠিক এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই করোনা ভাইরাসের প্রথম অনুমোদিত টিকা তৈরী করেন BioNTech এবং Moderna-র বিজ্ঞানীরা।

চিত্র ৩: নেক্সট জেনারেশন টিকা ও প্রথাগত টিকার পার্থক্য। নেক্সট জেনারেশন টিকার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জেনেটিক ভ্যাকসিন প্রযুক্তি, যেখানে সিনথেটিক DNA বা RNA-র মধ্যে ভ্যাকসিন অ্যান্টিজেনটি এনকোড করা থাকে। অন্য আর এক ধরণের নেক্সট জেন প্রযুক্তি হচ্ছে ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তি, যেখানে প্রথমে অ্যান্টিজেন এনকোড করা নিউক্লিক অ্যাসিড একটি নিরীহ ভাইরাসের মধ্যে ঢুকিয়ে একটা পুর তৈরী করা হয়। এরপর এই ভেক্টর বা জেনেটিক সংকেত বহনকারী কুলি কে শরীরের মধ্যে ইঞ্জেক্ট করা হয়। অন্যদিকে প্রথাগত টিকাতে আসল ভাইরাসের শরীরের প্রোটিন অংশকে অথবা আংশিক নিষ্ক্রিয় বা মৃত ভাইরাসকেই শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরী করা হয় [10]।

উহান প্রদেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের পরেপরেই খুব দ্রুত চৈনিক গবেষকেরা কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোম  প্রকাশ করে জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করে দেন। চৈনিক বিজ্ঞানীদের এই তৎপরতাও এত দ্রুত জেনেটিক ভ্যাকসিন তৈরী করে ফেলতে  পারার অন্যতম কারণ।  

জেনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশিত হওয়া মাত্র নাওয়া খাওয়া ভুলে বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯ এর জিন সিকোয়েন্স পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে ফেলেন! প্রয়োজনীয় প্রোটিনের কোডটাকেও শনাক্ত করে ফেলেন।    করোনা ভাইরাস দেখতে অনেকটা কদম ফুলের মতো, একটা গোল বলের উপর যেন সারি সারি আঁকশি লাগানো।  এই আঁকশি গুলিই S-প্রোটিন, বা স্পাইক প্রোটিন (চিত্র ৪)।

চিত্র ৪: SARS-CoV-2 বা করোনা ভাইরাসের গঠন। লাল আঁকশি গুলি স্পাইক প্রোটিন বা S-প্রোটিন। উৎস: CDC

করোনা ভাইরাস যখন শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে তখন এই আঁকশি গুলোর সাহায্যেই ভাইরাস কোষের মেমব্রেনের সঙ্গে আটকে থাকে ও শরীরের ক্ষতি করতে শুরু করে।  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে গোটা ভাইরাসটি শরীরের জন্য  ক্ষতিকর, আলাদাভাবে এই S-প্রোটিনটি নয়। 

বিজ্ঞানীরা ফন্দি আঁটলেন যে কোভিড-১৯ এর জিনোম পরীক্ষা করে যদি স্পাইক প্রোটিন তৈরির সংকেত ধরে ফেলা যায়, তাহলে  শরীরের মধ্যে গোটা ভাইরাসটা না ঢুকিয়ে সিনথেটিক (ল্যাবে তৈরী করা) মেসেঞ্জার RNA -র সাহায্যে শুধু স্পাইক প্রোটিনটাকেই কোষের মধ্যে তৈরী করে ফেলা যেতে পারে।  আর তাহলেই তো কেল্লা ফতে ! তখন কোষ ধরে নেবে যে আসল ভাইরাস ঢুকে পড়েছে আর শরীরে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরী হতে থাকবে।

চৈনিক গবেষকেরা কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোম  প্রকাশ করে জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করে দেন। চৈনিক বিজ্ঞানীদের এই তৎপরতাও এত দ্রুত জেনেটিক ভ্যাকসিন তৈরী করে ফেলতে  পারার অন্যতম কারণ।

তন্ময় হয়ে কোভিড-১৯ এর জেনেটিক সিকোয়েন্স দেখতে দেখতে তাঁরা  ধরেও ফেললেন কোভিড-১৯ এর স্পাইক প্রোটিন তৈরীর  রহস্য। এই ভাবে তাঁরা কয়েকদিনের মধ্যেই  কম্পিউটারে তৈরী করে ফেললেন বেশ কয়েকটা  mRNA ভ্যাকসিন ডিজাইন, যারা মানুষের শরীরে কোষের মধ্যে গিয়ে কোষকে স্পাইক প্রোটিন তৈরী করার সংকেত দিতে পারে, সেই স্পাইক প্রোটিন, যার সাহায্যে আসল করোনা ভাইরাস কোষের দেওয়ালে গেঁড়ে বসে। এই ডিজাইনগুলির মধ্যে একটাও যদি কার্যকরী হয়, আর কোষ সত্যি সত্যিই বিষক্রিয়া ছাড়া যদি এই S-protein (বা তার নানা অংশ, সেটা  পুরো S -প্রোটিন হতে পারে বা যে অংশ receptor এর সঙ্গে bind করে সেই অংশ)  তৈরী করতে শুরু করতে পারে, তাহলে আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা শরীরে স্পাইক প্রোটিনওয়ালা  ক্ষতিকারক জীবাণু ঢুকেছে মনে করে সঙ্গে সঙ্গে শরীরে করোনা প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি তৈরী করতে  শুরু করবে। 

এ যেন একঢিলে দুই পাখি মারা ! প্রথমত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংএর সাহায্যে আমাদের শরীরের কোষকেই অ্যান্টিজেন তৈরির কারখানা বানানো, আর দ্বিতীয়ত  চালাকি করে কোষকে বেওকুফ বানিয়ে  বোঝানো যে শরীরে আসল জীবাণু ঢুকেছে এবং ‘Aal izz not well’, যাতে তারা তড়িঘড়ি প্রতিষেধক অ্যান্টিবডি তৈরী করতে শুরু করে, ও শরীর আসল জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়! সাধারণত টিকার উপযোগী অনেকগুলি mRNA ভ্যাকসিন ডিজাইনের সবকটাই  S  প্রোটিন (বা তার নানা অংশ) তৈরী করে কিন্তু neutralizing antibody তৈরী করতে পারে  কিনা আর পারলেও  toxicity কোনটার কম সেটা দেখে  সবচেয়ে ভালো ডিজাইনটিকে বেছে নেওয়া হয়।   ঠিক এভাবেই mRNA ব্যবহার করে SARS-CoV-2 ভাইরাসের টিকা তৈরী করা হয়েছে।

চিত্র ৫: mRNA প্রযুক্তিতে তৈরী টিকা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্রথমে করোনা ভাইরাস পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে জিন সিকোয়েন্স বের করা হয়। জিনোম বিশ্লেষণ করে স্পাইক প্রোটিন তৈরীর কোডটি বুঝে ফেলে সেটি RNA -তে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এর পর এই সিনথেটিক মেসেঞ্জার RNA কে শরীরের মধ্যে ইঞ্জেক্ট করা হয় ও শরীরের কোষ স্পাইক প্রোটিন তৈরী করতে শুরু করে। শরীরের রোগপ্রতিরোধক ব্যবস্থা তখন প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরী করে আসল ভাইরাসের আক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে।

অথচ শুরুর দিকের পথচলা এত সহজ ছিল না। বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হওয়ার আগে mRNA প্রযুক্তিকে কেউই খুব একটা গুরুত্ব দেয় নি। নিরাপদে শরীরের immune system কে শান্ত রেখে  mRNA পদ্ধতিকে  ব্যবহার করার  অন্যতম পথিকৃৎ  হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভুত বিজ্ঞানী প্রফেসর ক্যাটালিন কারিকোর কাছে এই পথ ছিল কানাগলির সমান [3,4]। ঢোকার রাস্তা শুধু পিচ্ছিলই ছিল না, সামনে এগোনোর পথও  ছিল রুদ্ধ। প্রথম দিকে রোগের বিরুদ্ধে তাঁর mRNAর শক্তিকে কাজে লাগানোর প্রয়াস সকলেই বাঁকা চোখে দেখত। তাঁর প্রচেষ্টা সরকারি অর্থ সাহায্য থেকেও বঞ্চিত ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ গবেষণা এবং সাফল্য নিশ্চিত না হওয়ায় কর্পোরেট ফান্ডিংও ছিল অধরা। প্রথম দিকে একের পর এক গবেষণার জন্য তাঁর  ফান্ডিং এর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে।  সহকর্মীদের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় সমর্থন পাওয়া যায় না।  অবশেষে ১৯৯৫ সালে ছবছর নিরন্তর চেষ্টা এবং প্রত্যাখানের পর আরো বড় আঘাত আসে। যথেষ্ট গবেষণা ও পর্যাপ্ত ফান্ডিং না আনতে পাড়ার কারণে পেনসিলভেনিয়া উনিভার্সিটির চাকরিতে তাঁকে নিজস্ব পদমর্যাদা থেকে সরিয়ে নিচের পদে নামিয়ে দেওয়া হয়! এইরকম অবমাননাকর ও হতাশাজনক ঘটনার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রায় সব সাধারণ মানুষই ভেঙে পড়ে । কিন্তু ক্যাটালিন কারিকো অন্য ধাতুতে তৈরী। নিজের প্রস্তাবিত mRNA প্রযুক্তির কার্যকারিতার উপর অগাধ বিশ্বাস ছিল তাঁর।  বিশ্বাস ছিল সাফল্য একদিন আসবেই। শুরু হয় দাঁতে দাঁত চেপে আরো আরো পরীক্ষা, আরো রাত জাগা, আবারও ফান্ডিং এর জন্য আবেদন!

চিত্র ৬: ডঃ ক্যাটালিন কারিকো

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফান্ডিং আবেদন প্রত্যাখ্যানের প্রধান কারণ ছিল  mRNA প্রবেশ করানোর পর কোষের অতি সক্রিয়তা। সিনথেটিক mRNA কোষের মধ্যে ঢোকানোর পর কোষ সম্পূর্ণ mRNA স্ট্র্যান্ডটাকেই বহিরাগত জীবাণু বলে ধরে নিচ্ছিল  এবং সেটিকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লাগছিল। এর ফলে শরীরের  সম্পূর্ণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাটিই উথাল পাথাল হয়ে যাচ্ছিল, এবং mRNA প্রযুক্তি তার কার্যকারিতা হারাচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন বিশেষজ্ঞরা এই পদ্ধতির খুব বেশি উপযোগিতা দেখতে পাচ্ছিলেন না। 

প্রায় দশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর  ডঃ কারিকো এবং তাঁর সহকর্মী ডঃ ওয়াইজম্যান ২০০৫ সাল নাগাদ এই সমস্যার সমাধান পেলেন [5]।  mRNAর  প্রতিটি স্ট্র্যান্ড নিউক্লিওটাইড নামে চারটি আণবিক বিল্ডিং ব্লক দিয়ে তৈরী। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পর ওনারা দেখলেন যে সিনথেটিক mRNAর একটি বিল্ডিং ব্লক সমস্ত রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনাকে ওলটপালট করে দিচ্ছে।  ডঃ কারিকো এবং ডঃ ওয়াইজম্যান এই সমস্যারও সমাধান করলেন। ওনারা ওই গোলমেলে বিল্ডিং ব্লকটিকে প্রতিস্থাপিত করলেন অন্য একটি নিরীহ অণু দিয়ে। এবং ইউরেকা ! এই মডিফায়েড নিউক্লিওটাইডওয়ালা  mRNA গুলি  আর শরীরের মধ্যে উথালপাথাল প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া তৈরী করল না ! অনেকের মতে এই সমাধানই mRNA গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিল, হয়তো বা অদূর ভবিষ্যতে ডঃ কারিকো এবং ডঃ ওয়াইজম্যান-কে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের দাবিদারও করে তুলল। 

mRNA প্রযুক্তিতে প্রথম করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরী হল। এটিই পৃথিবীতে প্রথম অনুমোদিত নেক্সট জেন ভ্যাকসিন।

কিন্তু এরপরও  একটা সমস্যা থেকেই গেল। দেখা গেল বাইরে থেকে RNA শরীরের কোষে ঢোকানো ভীষণ কঠিন কাজ। শতকোটি বছরের বিবর্তনে আমাদের শরীর শিখেছে কিভাবে বাহ্যিক RNA চটজলদি ধ্বংস করা যায়। তার ওপর এতগুলো নেগেটিভ চার্জ থাকার জন্য RNA নিজে থেকে কোষের মধ্যে ঢুকতেও চায় না। ততদিনে পিটার কালিসের মত বিজ্ঞানীরা দেখিয়ে দিয়েছেন যে কিছু কিছু ভঙ্গুর ওষুধ কণাকে লিপিড ন্যানোপার্টিকেল দিয়ে আস্তরণ দিয়ে দিলে সহজেই তাদেরকে স্থিতিশীল করে ফেলে  কোষের মধ্যে চালান করে দেওয়া যায় [6]। কিভাবে লিপিড  ন্যানোপার্টিকেলের মাধ্যমে mRNA কোষের মধ্যে নিরাপদে ঢুকিয়ে প্রোটিন তৈরী করা যায় তাও ততদিনে বিজ্ঞানীরা জেনে গেছেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা  প্রতিটা mRNA কে লিপিড বা ফ্যাটের ন্যানোপার্টিকলের  একটা পোঁচ দিয়ে একটা আস্তরণে ঢেকে দিলেন যাতে পুরো mRNA টি ফ্যাটের আস্তরণের মধ্যে সংরক্ষিত থাকে। এই আস্তরণ মডিফায়েড  mRNA কে অনেক স্থিতিশীল করে তুলল যাতে সেটি শরীরের মধ্যে সময়োপযোগী অ্যান্টিবডি তৈরী করতে পারে। এভাবেই mRNA প্রযুক্তিতে প্রথম করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরী হল। এটিই পৃথিবীতে প্রথম অনুমোদিত নেক্সট জেন ভ্যাকসিন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে কিভাবে BioNTech/Pfizer বা Moderna-র বিজ্ঞানীরা রোগীর শরীরে পুরোনো পদ্ধতির টিকার মত ক্ষতিকর রোগজীবাণু না ঢুকিয়েও  mRNA পদ্ধতিতে কোরোনার টিকা কয়েক মাসের মধ্যেই তৈরী করে ফেলতে পারলেন। শুধু তাই নয়, এই প্রযুক্তি  ভবিষ্যতের জন্য খুব দ্রুত আরো নতুন নতুন মারণ রোগের ওষুধ তৈরির দিগন্ত খুলে দিল [7-9]।

 ) ভাইরাল ভেক্টর প্লাটফর্ম

নেক্সট জেনেরেশন টিকার মধ্যে অন্যটি হচ্ছে ভাইরাল ভেক্টর ব্যবহার করে তৈরী করোনার টিকা, যা তৈরী করেছে অক্সফোর্ড উনিভার্সিটির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানি। প্রসঙ্গত মনের মধ্যে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে তাহলে  BioNTech/Pfizer বা Modernaর টিকার সঙ্গে Oxford-Astrazenecaর টিকার পার্থক্যটা ঠিক কোথায়?

চিত্র ৭: অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভাইরাল ভেক্টর টিকার কার্যপদ্ধতি [10]। প্রথমে অ্যান্টিজেন এনকোড করা জিন একটি নিরীহ অ্যাডেনো ভাইরাসের মধ্যে ঢুকিয়ে একটা পুর তৈরী করা হয়। এরপর এই জেনেটিক সংকেত বহনকারী ভাইরাল ভেক্টর অ্যাডেনো ভাইরাস কে শরীরের মধ্যে ইঞ্জেক্ট করা হয়। জিন তখন mRNA-এর মাধ্যমে রাইবোজোমকে স্পাইক প্রোটিন তৈরীর নির্দেশ পাঠায় ও শরীরের কোষ স্পাইক প্রোটিন তৈরী করতে শুরু করে। শরীরের রোগপ্রতিরোধক ব্যবস্থা তখন প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরী করে আসল ভাইরাসের আক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে।

যেখানে BioNTech/Pfizer বা Moderna-র টিকা সিনথেটিক mRNA নিউক্লিক অ্যাসিডকে সরাসরি কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরী করে, সেখানে Oxford-Astrazeneca কোষের মধ্যে স্পাইক প্রোটিনের কোড সমেত আস্ত একটা DNA কেই ঢুকিয়ে দেয়।  এই DNA ঢোকানোর জন্য সাহায্য নেওয়া হয় অন্য প্রজাতির একটা নিরীহ ভাইরাস এর, যেটি SARS টাইপ  ভাইরাস নয়।  এই ভাবে জেনেটিক পদার্থ যখন  অন্য একটি নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের সাহায্যে কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে টিকা তৈরী করা হয়, তখন সেই পদ্ধতিকে ভাইরাল ভেক্টর প্লাটফর্ম বা প্রযুক্তি বলে।  এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরী করতে Oxford-Astrazeneca-র বিজ্ঞানীরা মানুষের জন্য আপাত নিরীহ এক ভাইরাস ব্যবহার করেছেন যা শিম্পাঞ্জির সর্দি হওয়ার জন্য দায়ী হলেও মানুষের ক্ষতি করে না। এই ভাইরাসের নাম অ্যাডেনোভাইরাস।  মলিক্যুলার বায়োলজিস্টরা এই ধরণের নিষ্ক্রিয় ভাইরাসদের ভেক্টর বা জেনেটিক কুলি বলে থাকেন। এই অ্যাডেনোভাইরাস শিম্পাঞ্জিদের ঠান্ডা লাগার ভাইরাস হলেও মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। এই ধরণের ভাইরাসকে অনেক ক্ষেত্রেই জেনেটিক মালপত্র কোষের মধ্যে চালান করার কাজে লাগানো হয়, অনেকটা রেল স্টেশনে মালবাহকদের মত।  এই নিষ্ক্রিয় ভাইরাসদের কাজ শুধু জেনেটিক কোডটাকে ট্যাঁকে গুঁজে কোষের মধ্যে দিয়ে আসা।  ব্যাস, তা হলেই তার কাজ শেষ।  Oxford-Astrazeneca-র বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে SARS-CoV-2 ভাইরাস এর স্পাইক প্রোটিনের DNA অ্যাডেনোভাইরাস এর মধ্যে পুরে শরীরের মধ্যে ইঞ্জেক্ট করেছিলেন (উপরের চিত্র ৭ ছবিটা দেখ, আর আরো জানতে [10,11] নম্বর রেফারেন্সগুলি দেখ)। তার পরের গল্পটা একই।  অর্থাৎ এই স্পাইক প্রোটিনের DNA কোষকে স্পাইক প্রোটিন তৈরী করতে উদ্বুদ্ধ করে, এবং সেই স্পাইক প্রোটিন তৈরী হতেই শরীর রে রে করে অ্যান্টিবডি তৈরী করতে শুরু করে। 

সহজ ভাষায় বলতে গেলে BioNTech/Pfizer বা Modernaর টিকা এবং Oxford-Astrazenecaর টিকা সবকটাই  DNA অথবা RNA ব্যবহার করে শরীরের কোষকেই স্পাইক প্রোটিন তৈরীর কারখানা হিসাবে ব্যবহার করে। সবকটাই  নেক্সট জেনারেশন ভ্যাকসিন।

কিন্তু BioNTech/Pfizer বা Moderna-র টিকা RNA ভিত্তিক, আর Oxford-Astrazenecaর টিকা ভাইরাল ভেক্টর ভিত্তিক, যেখানে DNA কে অ্যাডেনোভাইরাসের সাহায্যে কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। BioNTech/Pfizer বা Moderna-র টিকা mRNA কে কোষের সাইটোপ্লাজমে পাঠায়, আর  Oxford-Astrazenecaর টিকা DNA কে কোষের নিউক্লিয়াস ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। 

আর যে পার্থক্যগুলো আছে তা হল কার্যকারিতায়।  BioNTech/Pfizer বা Moderna-র টিকা যেখানে ৯৫% এরও বেশি কার্যকরী, সেখানে Oxford-Astrazeneca-র টিকা ৭০% ক্ষেত্রে কার্যকরী।  যদিও Oxford-Astrazeneca টিকার এই খামতি পুষিয়ে যায় অন্য জায়গায়। দামের দিক থেকে Oxford-Astrazeneca-র টিকা অনেকটাই  সস্তা অন্য দুটোর থেকে।  টিকা সংরক্ষণ করার জন্য Oxford-Astrazeneca-র টিকার বাকি দুটোর মত অতি  ঠান্ডা পরিকাঠামোর দরকার পরে না, যা উন্নয়নশীল ও গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলির কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। এখানে আর একটা তথ্য  দিয়ে রাখা ভালো যে আর একটি বড় ওষুধ কোম্পানিও (Johnson & Johnson)  অ্যাডেনোভাইরাস ভিত্তিক ভাইরাল ভেক্টর টিকা তৈরী করছে, যদিও তারা শিম্পাঞ্জী নয়, মানুষের সাধারণ ঠান্ডা লাগার জন্য দায়ী তুলনামূলক নিরীহ অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করছে। এ ছাড়াও আরো কিছু টিকার খবর জানা গিয়েছে যেমন ভারতবর্ষে তৈরী কোভ্যাকসিন বা কোভিশিল্ড (যেটি আসলে Oxford-Astrazeneca-র টিকার দেশীয় সংস্করণ), চীনদেশের তৈরী সিনোভ্যাক বা রাশিয়ার তৈরী স্পুৎনিক।  কিন্তু বাকি টিকাগুলির তুলনামূলক আলোচনা করার মত পর্যাপ্ত তথ্য এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই।

প্রচলিত টিকা পদ্ধতির সঙ্গে নেক্সট জেন টিকার পার্থক্য

আমরা দেখলাম যে নেক্সট জেন টিকাতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং -এর মাধ্যমে শরীরের কোষকেই অ্যান্টিজেন (এক্ষেত্রে S -প্রোটিন) তৈরীর কারখানা হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বাইরে থেকে কোন আসল রোগের  জীবাণু শরীরের মধ্যে ঢোকাতে হয় না [3-7]।  

প্রচলিত টিকা তৈরির ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো রোগের মৃত বা দুর্বল কিছু আসল রোগজীবাণু শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরী করানো হয়। এক্ষেত্রে প্রথমে কিছু জীবাণু নিয়ে হাঁসমুরগীর ডিমের মধ্যে বা অন্য কোন জীবকোষের মধ্যে ঢুকিয়ে তাদের বংশবৃদ্ধি করানো হয়। যেহেতু সেগুলি আসল মারণরোগের জীবাণু, এই পদ্ধতির  সময় অত্যন্ত সতর্কতা এবং বিভিন্ন প্রোটোকল মেনে চলতে হয়, যা যথেষ্ট খরচ ও  সময়সাপেক্ষ। কল্পনা কর, পৃথিবীজুড়ে করোনা ভাইরাসের কয়েকশ কোটি টিকা তৈরীর জন্য যদি আমাদের প্রচলিত পদ্ধতিতে টিকা তৈরী করতে হত, তাহলে কি অবিশ্বাস্য বিশাল মাপের পরিকাঠামো এবং তার আনুষঙ্গিক সুরক্ষা প্রোটোকল তৈরী করতে হত! কিন্তু নেক্সটজেন টিকায় এসব কিছুই করতে হয় নি, কারণ এতে আসল ভাইরাস ব্যবহারই করা হয় নি, শুধু S-প্রোটিন তৈরীর জেনেটিক কোড ব্যবহার করা হয়েছে।। যাই হোক এর পরের ধাপে আসে ইঁদুর বা অন্য স্তন্যপায়ী জীবের উপর টিকার কার্যকারিতার পরীক্ষা নিরীক্ষা। সাধারণত এই পরীক্ষা এবং তার ফল বিশ্লেষণ, কতখানি ভাইরাস শরীরের মধ্যে গেলে শরীর নিতে পারবে, শরীরের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে কিনা, না হলেও আদৌ কার্যকরী অ্যান্টিবডি তৈরী হবে কি না, অ্যান্টিবডি তৈরী হলেও কোন মাত্রা সবচেয়ে উপযোগী,  এই ধরণের হাজারো প্রশ্নের উত্তর পেতে পেতে বহু বছর লেগে যায়। টিকা তৈরীর প্রচলিত ধাপগুলো  সম্বন্ধে জানতে বিজ্ঞান পত্রিকার এই লেখাটি পড় [12] ।

নেক্সট জেন টিকাতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং -এর মাধ্যমে শরীরের কোষকেই অ্যান্টিজেন (এক্ষেত্রে S -প্রোটিন) তৈরীর কারখানা হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বাইরে থেকে কোন আসল রোগের  জীবাণু শরীরের মধ্যে ঢোকাতে হয় না

এত তাড়াতাড়ি কি ভাবে তৈরী করা এবং অনুমোদন পাওয়া সম্ভব হল?

আমরা আগেই দেখেছি যে নেক্সট জেন টিকার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি তৈরী করতে বাইরে থেকে শরীরের মধ্যে কোন রোগজীবাণু ঢোকাতে হয় না, বরঞ্চ  জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে প্রোটিনের কোড সমেত DNA বা  mRNA তৈরী করে কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে  সুচতুরভাবে শরীরের কোষকে অ্যান্টিবডি তৈরীর কারখানা হিসাবে ব্যবহার করা হয় । উল্টোদিকে প্রথাগতভাবে ভাইরাসের টিকা তৈরির প্রথম ধাপে, যেমন উদাহরণস্বরূপ  ইন্ফ্লুয়েঞ্জার টিকার ক্ষেত্রে,  ফুটবে ফুটবে করছে এইরকম ডিমের মধ্যে আসল জীবাণু ইঞ্জেক্ট করে দেওয়া হয়। তারপর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে জীবাণুর বৃদ্ধিসাধন করা হয়। এইভাবে জীবাণুর  বৃদ্ধিসাধন অত্যন্ত জরুরি, যাতে অনেক সংখ্যক দুর্বল বা মৃত ভাইরাস তৈরী করা যায়। এইভাবে  নিষ্ক্রিয় ভাইরাস তৈরী করে পরবর্তীকালে  তা শরীরের মধ্যে ঢুকিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরী করা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে আনুপাতিক হারে  টিকার উৎপাদন বাড়ানো (scaling-up) অনেক সময় সাপেক্ষ। নেক্সট জেন ভাইরাসে এই ধাপটা সম্পূর্ণভাবে এড়ানো যায় এবং স্কেল-আপও অনেক সহজে এবং দ্রুত করা যায়।

প্রথাগত টিকার ক্ষেত্রে প্রোটিনের ক্ষণভঙ্গুর প্রকৃতি বোঝা এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা, কোন প্রোটিন অ্যান্টিজেন হিসাবে সবচেয়ে কার্যকারী, কোনটার বিষক্রিয়া (toxicity) কম, ইত্যাদি বুঝতেই বহু সময় চলে যায়। আবার এই ভাবে টিকা তৈরী হয়ে গেলেও, ভাইরাস যদি mutate করে, তাহলে এই পরিবর্তিত ভাইরাসের টিকা তৈরী করতে সমস্ত ধাপ গুলো প্রথম থেকে আবার কেঁচেগণ্ডূষ করতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ এখনই করোনা ভাইরাসের নতুন নতুন স্ট্রেনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই নতুন স্ট্রেনগুলিতে S – প্রোটিনের গঠনে বড়রকম পরিবর্তন না করছে আমরা আশা  করতেই পারি যে নেক্সট জেন টিকাগুলি  নতুন স্ট্রেনগুলোর ক্ষেত্রেও কাজ করবে (যদিও এটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে গেলে আরো পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দরকার) । যদি এই টিকা কাজ নাও করে, বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারে বসে কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন ভ্যাকসিন ডিজাইন করে ফেলতে পারবেন, যেটা প্রথাগত ভাবে এত তাড়াতাড়ি কোন ভাবেই সম্ভব নয়। 

তদুপরি  কোভিড-১৯  ভাইরাসের  ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা ভাগ্যবান, কারণ SARS-CoV-2 ভাইরাস গঠনমূলক ভাবে SARS-CoV-1 অথবা MERS ভাইরাসের খুব কাছাকাছি। তাই বিজ্ঞানীদের SARS-CoV-2 বা কোভিড-১৯ ভাইরাস বা তার প্রোটিনের গঠন সম্বন্ধে আগে থেকেই অনেকটাই ধারণা ছিল।  তাই প্রিক্লিনিক্যাল বিচারের সময়েও অনেকটা সময় বাঁচানো গিয়েছে। এর পর আসে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, বা মানুষের শরীরের উপর পরীক্ষা।  প্রথাগতভাবে যেখানে এক দফার ট্রায়াল শেষ হওয়ার ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য বিশ্লেষণের পরে দ্বিতীয় বা তৎপরবর্তী ট্রিয়ালে যাওয়া হয়, সেখানে করোনার টিকার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দফার ট্রায়াল সমান্তরাল ভাবে ও অত্যন্ত দ্রুত করা হয়েছে (নিচের চিত্র ৮ ছবিটা দেখ)। এক্ষেত্রে অনেককটি দেশ তাদের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, একসঙ্গে এবং সমান্তরাল ভাবে  প্রচুর মানুষের উপর ট্রায়াল হয়েছে, যা টিকা তৈরীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব।  তদুপরি বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সমস্ত দিক খাতিয়ে  দেখে জরুরি ভিত্তিতে টিকা ব্যবহারের ছাড়পত্র দিয়েছে, যার ফলে এতো দ্রুত করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরী করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে এই ভ্যাকসিনগুলো কতদিন পর্যন্ত কার্যকরী থাকবে বা এদের দীর্ঘমেয়াদী কোন সাইড এফেক্ট আছে কিনা তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই।

চিত্র ৮: প্রথাগত ও নেক্সট জেন টিকা তৈরী থেকে বাজারে আসার বিভিন্ন ধাপ ও তাদের সময়কাল [13]।
এই চিত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে যে করোনা ভাইরাসের টিকা তৈরীর ক্ষেত্রে সবকটি ফেজ ট্রায়াল-ই করা হয়েছে, কিন্তু সমান্তরাল ভাবে, এবং একসঙ্গে প্রচুর মানুষের উপর। উদাহরণস্বরূপ BioNTech-এর দুটি ভ্যাকসিন ডিজাইনের একটি চিনে Fosun ফার্মা অনেক মানুষের উপর, এবং অন্য একটি ডিজাইন ফাইজার অন্যান্য দেশের ট্রায়ালে সমান্তরাল ভাবে পরীক্ষা করেছে, এবং বেশি ভালো ডিজাইনটি কে বেছে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং এই টিকা নিরাপদ কিনা সেটা বিচার করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে কোন আপোষ করা হয় নি। শুধু ত্বরান্বিত করা হয়েছে।

পরিশেষে এটা হয়তো বলাই যায় যে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্য, কিছু মানুষের অদম্য প্রচেষ্টা এবং হার না মানা মনোভাব, বিশ্বজুড়ে বিরাট মাপে হিউমান ট্রায়াল এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান, কোরোনার টিকা তৈরিতে সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অভূতপূর্ব তৎপরতা পৃথিবীকে নতুন আশার আলোর দিশা দেখালো।

আশা করাই যায় যে এই ভয়ঙ্কর মহামারীর এটাই শেষের শুরু [14]! 

পরিশিষ্ট

এখন যারা আরো তলিয়ে দেখতে চায়, তাদের জন্য জিন, DNA এবং RNA-র গঠন এবং তাদের কাজগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক।  আমরা জানি যে আমাদের শারীরিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্টের অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের জিনের উপর। এই জিন আমাদের DNA-র একটা অংশ। হৃতিক রোশন বা ঐশ্বর্য রাইয়ের চোখের রঙের সঙ্গে রবিঠাকুরের কৃষ্ণকলির কালো হরিণ চোখের রঙের কাব্যিক পার্থক্য অনেক হলেও, বৈজ্ঞানিক কারণ কিন্তু সেই জিন।

চিত্র ৯: আমাদের শারীরিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্টের অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের জিনের উপর [2] . এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে জিন চোখের রং নিয়ন্ত্রণ করে যে রঞ্জক পদার্থ, সেই প্রোটিন তৈরী করে। এই রঞ্জক প্রোটিনের গুণ এবং ঘনত্বের উপর নির্ভর করে চোখের রং। একই ভাবে গায়ের বা চুলের রংও জিন নিয়ন্ত্রিত প্রোটিনের উপর নির্ভর করে।

সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু জিন বা DNA কিভাবে এই রং নিয়ন্ত্রণ করে?

এর পুরোটাই হয় প্রোটিন তৈরির মাধ্যমে। চোখ, চুল বা গায়ের রং নির্ধারণ করে যে রঞ্জক পদার্থগুলি সেগুলি আসলে এক এক ধরণের প্রোটিন।  DNA কোষের রাইবোজোমকে নির্দেশ পাঠায় কি ধরণের প্রোটিন কত পরিমানে তৈরী করতে হবে, আর কোষের মধ্যে থাকা রাইবোজোম সেই নির্দেশ অনুযায়ী প্রোটিন সংশ্লেষ করে। কিন্তু DNA অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো বসে থাকে কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে, আর রাইবোজোম থাকে নিউক্লিয়াসের বাইরে সাইটোপ্লাজমে! সেক্ষেত্রে DNA -র এই নির্দেশ  নিউক্লিয়াস থেকে রাইবোজোম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে কে?

চিত্র ১০: DNA ও RNA-র পার্থক্য [2] । DNA ডাবল হেলিক্স বা দুটো স্ট্র্যান্ড দিয়ে তৈরী, RNAতে সে জায়গায় একটি মাত্র স্ট্র্যান্ড। DNA-এর বেসগুলি হল A,T,C,G, সেখানে RNA-র বেসগুলি A,U,C,G ইত্যাদি পার্থক্য আছে।

এইখানেই RNA -র কারিকুরি শুরু।  RNA বা রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড, সমস্ত জীবকোষে উপস্থিত একটি নিউক্লিক অ্যাসিড। প্রসঙ্গত কার্বোহাইড্রেট, লিপিড আর প্রোটিনের মতো নিউক্লিক অ্যাসিডও আমাদের শরীরে উপস্থিত বাইওমলিকিউলগুলির মধ্যে অন্যতম। DNA যেমন ডাবল হেলিক্স, দুটো স্ট্র্যান্ড দিয়ে তৈরী, RNAতে সে জায়গায় একটি মাত্র স্ট্র্যান্ড।  DNA -র মত RNA -ও যে বিল্ডিং ব্লক দিয়ে তৈরী হয় সেগুলি কে বলে নিউক্লিওটাইড। প্রতিটা নিউক্লিওটাইড একটা সুগার, একটা ফসফেট আর একটা নাইট্রোজেন সমন্বিত বেস, এই তিনটি অংশ দিয়ে তৈরী। ফসফেট ছাড়া  নিউক্লিওটাইডের পোশাকি নাম  নিউক্লিওসাইড।

চিত্র ১১: মূলতঃ তিন ধরণের RNA : ১) mRNA বা মেসেঞ্জার RNA, ২) rRNA বা ribosomal RNA এবং ৩) tRNA বা ট্রান্সফার RNA [2]

কোষের মধ্যে সাধারণত তিন ধরণের RNA থাকে: ১) mRNA বা মেসেঞ্জার RNA, ২) rRNA বা ribosomal RNA যা প্রোটিন তৈরীর কারখানা রাইবোজোমের একটা বড় উপাদান, এবং ৩) tRNA বা ট্রান্সফার RNA, যা রাইবোজোমকে অ্যামিনো অ্যাসিড সরবরাহ করে, যে অ্যামিনো অ্যাসিড আদতে প্রতিটি প্রোটিনের বিল্ডিং ব্লক। এর মধ্যে mRNA এর প্রধান ভূমিকাটি হল কোষে প্রোটিন সংশ্লেষ নিয়ন্ত্রণের জন্য DNA -র নির্দেশ  নিউক্লিয়াস থেকে রাইবোজোম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসা। rRNA আর tRNA তারপর সেই নির্দেশ অনুযায়ী DNA নির্দেশিত প্রোটিনটি তৈরী করে।

চিত্র ১২: জেনেটিক কোডের প্রতিলিপি DNA থেকে RNA তে প্রতিলিপিত হয় ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতির মাধ্যমে [2]। প্রতিলিপিত RNA -ই মেসেঞ্জার RNA বা mRNA।

কোষের মধ্যে যখন কোন প্রোটিন তৈরী করার দরকার পরে তখন জিনের মধ্যে সেই প্রোটিনের কোডটি ‘সক্রিয়’ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ তখন RNA পলিমার তৈরীর এনজাইম এসে DNA-র প্রোটিন সিকোয়েন্সের প্রতিলিপিটি   RNA -তে তৈরী করে।   এই প্রিতিলিপিত RNA টিই মেসেঞ্জার RNA বা mRNA ।  RNA -র এই প্রতিলিপিতে DNA-র সিকোয়েন্সের একই তথ্য থাকে, যদিও mRNA অণুতে T বেসগুলি  U বেস দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনও DNA কোডিং স্ট্র্যান্ডের সিকোয়েন্স AATACGC থাকে তবে সংশ্লিষ্ট mRNA-র অনুক্রম হয়ে যায় AAUACGC। এই পদ্ধতির নাম ‘ট্রান্সক্রিপশন’ ।

চিত্র ১৩: রাইবোজোম প্রোটিন তৈরীর কারখানা। mRNA -র কোডন অনুসারে tRNA একটি একটি করে অ্যামিনো অ্যাসিড সরবরাহ করে [2]।

একবার mRNA  তৈরি হয়ে গেলে, এটি নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে এসে রাইবোজোমের সাথে যুক্ত হয়।  রাইবোজোম তখন mRNA -র সংকেত অনুযায়ী অ্যামিনো অ্যাসিড জুড়ে জুড়ে প্রয়োজনীয় প্রোটিনটি তৈরী করতে পারে।  রাইবোজোম mRNA -র সিকোয়েন্সটি নিয়ে তিনটে নিউক্লিওটাইডের এক একটা গ্রুপ তৈরী করে।  এই গ্রুপ গুলোর নামই ‘কোডন’ । প্রতিটি tRNA এরপর একেকটি কোডন অনুযায়ী অ্যামিনো অ্যাসিড একটার সঙ্গে আর একটা জুড়ে দিতে থাকে, যতক্ষণ না পর্যন্ত জিন নির্দেশিত প্রোটিনটি তৈরী হয়। এই পুরো পদ্ধতিটির নাম ট্রান্সলেশন।

চিত্র ১৪: ট্রান্সক্রিপশন আর ট্রান্সলেশন পদ্ধতির মাধ্যমে জিন থেকে নির্দেশ নিয়ে mRNA রাইবোজোমে এসে tRNA -র সাহায্যে নির্দেশিত প্রোটিনটি সংশ্লেষ করে [2]।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতিতে প্রথমে জিন থেকে প্রোটিনের কোড কপি করে নেয় mRNA । আর তার পর রাইবোজোম mRNA থেকে সেই কোডটি পড়ে  tRNA-র সাহায্যে ট্রান্সলেশন পদ্ধতিতে প্রোটিনটি তৈরী করে। প্রোটিন সংশ্লেষ নিয়ে আরো জানতে এই ভিডিও টা  দেখ [2].

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

প্রযোজনীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য লেখক ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির  ডঃ অর্ণব রুদ্রের কাছে কৃতজ্ঞ। 

কভার ইমেজ: ল্যারি গণিক এবং কৌশিক দাস

তথ্যসূত্র

[1] The Journal. – The Creator of the Record-Setting Covid Vaccine

[2]https://www.youtube.com/watch?v=oefAI2x2CQM

[3] https://www.ft.com/content/6633221e-3b28-4a15-b02d-958854644c79

[4] The story of mRNA: From a loose idea to a tool that may help curb Covid

[3] Sahin, Ugur, Katalin Karikó, and Özlem Türeci. “mRNA-based therapeutics—developing a new class of drugs.” Nature reviews Drug discovery 13.10 (2014): 759-780.

[4] Dolgin, Elie. “Unlocking the potential of vaccines built on messenger RNA.” Nature  574.7778 (2019): S10-S12.

[5] Karikó, Katalin, et al. “Suppression of RNA recognition by Toll-like receptors: the impact of nucleoside modification and the evolutionary origin of RNA.” Immunity 23.2 (2005): 165-175.

[6] Allen, Theresa M., and Pieter R. Cullis. “Drug delivery systems: entering the mainstream.” Science 303.5665 (2004): 1818-1822.

[7] The story of mRNA: From a loose idea to a tool that may help curb Covid

[8]How do mRNA coronavirus vaccines work? Science with Sam explains, New Scientist.

[9] Ball, Philip. “The lightning-fast quest for COVID vaccines-and what it means for other diseases.” Nature 589, 16-18 (2021).

[10] https://www.youtube.com/watch?v=KMc3vL_MIeo&feature=youtu.be

[11] https://www.nytimes.com/interactive/2020/health/oxford-astrazeneca-covid-19-vaccine.html

[12] https://bigyan.org.in/2020/12/04/usefulness-limitations-of-corona-vaccine/

[13] Krammer, Florian. “SARS-CoV-2 vaccines in development.” Nature 586.7830 (2020): 516-527.

[14] https://www.bbc.com/news/health-55040635

The post নজিরবিহীন দ্রুততায় করোনা টিকা – কিন্তু নিরাপদ তো? appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

জলবায়ু পরিবর্তন কিরকম দেখতে

$
0
0

জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট কিন্তু বহুদূরের কথা নয়, একেবারে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে। কিরকম দেখতে সেই সংকটের চেহারাটা, ছবিতে বোঝানো হয়েছে। যদি ক্লাইমেট চেঞ্জ (climate change) বা “জলবায়ু পরিবর্তন” শব্দটা এখনো তোমার কাছে অপরিচিত ঠেকে, তাহলে চট করে পড়ে ফেলো।


The post জলবায়ু পরিবর্তন কিরকম দেখতে appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

প্রতিক্রিয়া আর টানের ব্যাখ্যা: কিছু জটিল সমস্যা

$
0
0

ভরহীন সুতোয় টানের অঙ্ক কষা যত সোজা, সে সুতো না হয়ে দড়ি হলে আর দড়ির ভর ধরতে হলে তখন আর ব্যাপারটা অতটা সোজা থাকে না। একে তো সেই দড়ির সর্বত্র টান (tension) একই হয়না। তার ওপর সে দড়ি যদি আগাগোড়া একইরকম না হয়, তখন সমস্যাটা আরো কঠিন হয়ে যায়। অথচ সে দড়ি না হয়ে হালকা সুতো হলে তাকে একেবারে ভরহীন ধরে যে উত্তর পাওয়া যায়, সেটা খুব একটা ভুল না। এরকম সরলীকরণ কখন খাটে আর কখন খাটে না, সেই নিয়ে আলোচনা করেছেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ধীরঞ্জন রায়।


আগের পর্বে জমির প্রতিক্রিয়া আর টান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। এই পর্বে সেই টানের অঙ্কটাকেই আরেকটু প্যাঁচালো করা হলো।

ধরা যাক,  m ভর এবং  দৈর্ঘ্যের একটি সুতো উল্লম্বভাবে একটি কীলক (pivot) থেকে ঝোলানো হল (চিত্র-১)। এটাও ধরা যাক যে সুতোটা আগাগোড়া একইরকম। এখন প্রশ্ন হলো, এই সুতোর কোন এক বিন্দুতে কিরকম টান অনুভূত হবে?

ধরা যাক, সুতোর  বিন্দুর নিচের অংশে একটা বল প্রয়োগ করা হলো সুতোর সাম্যাবস্থা বজায় রাখার জন্য। সুতরাং

T(x)= \frac{mg}{l}(l-x)= mg(1-\frac{x}{l})

যেখানে

\frac{m}{l}=\rho

অর্থাৎ সুতোর রৈখিক ঘনত্ব (linear density) সর্বত্র সমান ধরা যেতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো, যদি সুতোটা আগাগোড়া একইরকম না হয়, তাহলে এই টান কিভাবে গণনা করা যাবে? সেক্ষেত্রে, সুতোর রৈখিক ঘনত্ব \rho-এর মান সুতোর কোনখানটা ধরছি, তার উপর নির্ভর করবে। অর্থাৎ, ঘনত্বটাকে এবার \rho(x)  বলতে হবে। তবে সুতোটাকে অনেকগুলি ছোট ছোট অংশের সমষ্টি বলে ধরা যেতে পারে এবং একেকটা ছোট অংশের মধ্যে সুতোটার পরিবর্তন উপেক্ষা করা যেতে পারে। সুতোর x এবং (x+dx) বিন্দুতে টান যদি যথাক্রমে T(x) এবং T(x+dx) হয়, সাম্যবস্থা বজায় রাখার জন্য নিচের সমীকরণটি মেনে চলতে হবে।

T(x)= T(x+dx) + \rho(x)gdx

বা

\frac{dT}{dx}= -\rho(x)g

এখানে \rho(x) জানা থাকলে ওপরের ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ সমাধান করা যাবে। এরকম একটা সমীকরণের সম্পূর্ণ সমাধান করতে কোথাও একটা টান জানা থাকা প্রয়োজন। এটাকে প্রাথমিক শর্ত (initial condition) বলে। ধরা যাক, সুতোর নিচে কিছু ঝুলে নেই। তাহলে, সুতোর মুক্ত প্রান্তে কোন টান অনুভূত হবে না। এই শর্তটি অর্থাৎ

T(l)= 0

প্রয়োগ করলে T(x) এর একটি ফর্মুলা পাওয়া যাবে (কষে দেখ)।  সেই ফর্মুলাতে যদি আগের সেই সর্বত্র সমান ঘনত্বের সুতো বসিয়ে দি, অর্থাৎ যদি

\rho(x)= \frac{m}{l}

বসাই, তাহলেও আগের সমাধানে ফিরে যাওয়া যাবে (তোমার সমাধানটা ঠিক হলো কিনা, সেটাও যাচাই করতে পারবে)।

দড়ি ধরে মারো টান

এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা শুধু সাম্যবস্থায় থাকা স্থির সুতোর কথাই ধরেছি। এবার দড়ি টানাটানি খেলার কথা দেখা যাক, যেখানে দড়ি একবার এদিকে যাচ্ছে, একবার ওদিকে (চিত্র-২)। দড়ির দুই প্রান্তে যথাক্রমে  F_{1} এবং F_{2} বল প্রয়োগ করা হলো, যেখানে

F_{2}>F_{1}

একদিকের  বল বেশি হওয়ার কারণে সুতোটি কিছুটা সেইদিকে সরে যাবে সাম্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য। অর্থাৎ সেদিকে তার একটা ত্বরণ (acceleration) সৃষ্টি হবে। যদি দড়ির ভর m হয় এবং সুতোটির ডানদিকে a ত্বরণ থাকে তাহলে:

F_{2} - F_{1}= ma

এটা গেল সম্পূর্ণ দড়িটা কিভাবে নড়বে, তার সমীকরণ। এবার দড়িটার একটা অংশের কথা ভাবা যাক। দড়ির l_{1} দৈর্ঘ্যের একটি অংশে এই সমীকরণটি কেমন হবে দেখা যাক। যদি এই l_{1} দৈর্ঘ্যের অংশের দুই প্রান্তে যথাক্রমে T_{1} এবং T_2 টান অনুভূত হয় তাহলে:

T_{2} - T_{1}= \frac{ml_{1}}{l}a

যেখানে l হলো পুরো দড়ির দৈর্ঘ্য। এই সমীকরণটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সুতোর বিভিন্ন বিন্দুতে টান বিভিন্ন হবে। সমীকরণটা যে ঠিক সেটা যাচাই করতে সাম্যাবস্থা অর্থাৎ a= 0 বসানো যাক। পাওয়া যাবে যে

T_{1}= T_{2}

মনে রাখতে হবে যে সুতোটি এখানে অনুভূমিক, তাই ওজনের প্রশ্ন আসে না কারণ মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে সুতোটার সাথে উল্লম্বভাবে। অর্থাৎ ত্বরণ না থাকলে দড়ির সর্বত্র টান সমান হওয়াই স্বাভাবিক।

এখানে লক্ষণীয় হল যে a= 0 না হলেও T_{1}= T_{2} হবে যদি দড়ি না হয়ে টানাটানির জিনিসটা একটা ভরশূন্য সুতো হয়। এবার কয়েকটি কপিকল (pulley) এর কথা ধরা যাক যারা পরস্পর সুতো দিয়ে যুক্ত। এখানে সুতোটি ভরহীন বলে ধরে নিলে সমস্যাটির সরলীকরণ করা যাবে, যেহেতু এইক্ষেত্রে সুতোর সমস্ত বিন্দুতে টান সমান হবে। এক্ষেত্রে সুতোর নির্দিষ্ট ভর ধরা হলে আগে উল্লেখ করা সমীকরণের মতো একাধিক সমীকরণের সমাধান বের করতে হবে সুতোর প্রান্ত বিন্দুতে টান নির্ণয় করার জন্য।

যাইহোক, যদি সুতোর ভর ব্লক বা কপিকলের ভরের তুলনায় খুব ছোট হয়, তাহলে ভরহীন সুতোর ধারণা এই ধরনের সমস্যাকে সরলীকরণ করে । সরলীকরণ করা সত্ত্বেও যথেষ্ট ভালো সমাধান পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এই ধরনের ধারণা বা assumption প্রয়োগ করি। একটি বাস্তব সমস্যাকে সরল রাখার জন্য এই ধরনের assumption ওই সমস্যার গভীরে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

অঙ্ক বাগে আনতে সমস্যার সরলীকরণ করলে কোথায় অসুবিধে হতে পারে

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আবার এই ধরনের সরলীকরণের থেকে সঠিক সমাধান পাওয়া যায় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে মেকানিক্স-এর অনেক সমস্যার কথা, যেখানে আমরা এমন বস্তুর কথা ধরি যা একেবারে নিখুঁতভাবে কঠিন, অর্থাৎ চাপ পড়লেও যার কোন রকম বিকৃতি হয় না। আসলে যখন এরকম দুটো বস্তু পরস্পরের সংস্পর্শে আসে তখন সবসময়ই কিছুটা বিকৃতি ঘটে। এটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যায় যখন কোন ভারী বস্তুকে একটা নরম গদির উপর রাখা হয় বা কোনো ত্বরণ যুক্ত গতিশীল বস্তু মেঝের ওপর চলার সময় বিকৃত হয়। কিন্তু আমরা বিকৃতি ভুলে তর্কের খাতিরে ধরতে পারি যে বস্তুদুটো একটা বিন্দুতে একে অপরের সংস্পর্শে আসছে, এবং সেই সংস্পর্শ বিন্দুতে একজোড়া বল উৎপন্ন হচ্ছে। সেই বলের উৎস নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

এই কথাগুলো মাথায় রেখে একটা পরিচিত সমস্যার কথা ধরা যাক। একটা কড়িকাঠ দুই প্রান্তে দুটো অবলম্বনের ওপর রাখা হলো। এখানে কড়িকাঠ, প্রান্তের অবলম্বনগুলো, সবাইকে নিখুঁতভাবে কঠিন ধরা যাক, অর্থাৎ সংস্পর্শ বিন্দুতে বল উৎপন্ন হচ্ছে। যদি কড়িকাঠের ওজন W হয়, অবলম্বন দুটোর প্রতিক্রিয়া সমান এবং বিপরীতমুখী হবে, অর্থাৎ প্রত্যেক অবলম্বনের প্রতিক্রিয়া হবে

\frac{W}{2}

এখন কড়িকাঠের নিচে একেবারে মধ্যিখানে তৃতীয় একটা অবলম্বন রাখা হলো (চিত্র-৩)। কিভাবে তিনটি অবলম্বনের প্রতিক্রিয়া বের করা যাবে?

তিনটি অবলম্বনের থেকে প্রতিক্রিয়া ধরা যাক যথাক্রমে R_{1}, R_2 এবং R_3। কড়িকাঠের সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে হলে তার ওপর কার্যকরী মোট বল এবং টর্ক (torque) শূন্য হবে। বল শূন্য অর্থাৎ ঊর্ধ্বমুখী আর নিম্নমুখী বল সমান:

R_{1}+ R_{2}+ R_{3}= W

আর টর্ক শূন্য মানে যেকোনো একটা বিন্দু ধরে মোমেন্ট (moment) বার করলে দু’তরফের মোমেন্ট এক হবে।  নিচের চিত্রের মত বাঁদিকের অবলম্বনের ওপর কার্যকরী বলের মোমেন্ট ধরে আমরা লিখতে পারি:

R_{2}l_{1}+ R_{3}l= \frac{Wl}{2}

সুতরাং দেখা যাচ্ছে আমাদের কাছে তিনটি অজানা রাশি (R_{1}, R_2 এবং R_3) আর কেবলমাত্র দুটি সমীকরণ আছে। এখানে লক্ষ্যণীয় যে যদি বলের মোমেন্ট অন্য কোন বিন্দুর পরিপ্রেক্ষিতে ধরা হয় তাহলেও কিন্তু আমরা নতুন কোনো সমীকরণ পাবো না। এর থেকে বলা যায় যে এই সমস্যাটির অসীম সংখ্যক সমাধান হতে পারে।

কেন এই সমস্যার নির্দিষ্ট কোনো সমাধান নেই সেটা বোঝার জন্য আমরা অবলম্বনগুলোর জায়গায় স্প্রিং ব্যবহার করতে পারি (যদিও কড়িকাঠটাকে তখনও কঠিনই ধরছি)। ধরা যাক, এই তিনটি স্প্রিং এর স্প্রিং ধ্রুবক ,  k_{1}, k_2 এবং k_3  (নিচের চিত্র-৪)  এবং স্প্রিং তিনটে যথাক্রমে x_{1}, x_2 এবং x_3 সংকুচিত হয়েছে।

তাহলে, আগের দুটো সমীকরণকে লেখা যায়:

k_{1}x_{1} + k_{2}x_{2} + k_{3}x_{3}= W

k_{2}x_{2}l_{1} + k_{3}x_{3}l= \frac{Wl}{2}

যেহেতু আমরা কড়িকাঠটিকে একটি  নিখুঁতভাবে কঠিন বস্তু  বলে ধরেছি, সুতরাং আমরা নিম্নলিখিত শর্তগুলি পাব:

\frac{x_{1} - x_{3}}{l} = \frac{x_{1} - x_{2}}{l_{1}}

বা:

(l - l_{1})x_{1} - lx_{2}  + l_{1}x_{3} = 0

আমরা এখন ওপরের সমীকরণগুলিকে সমাধান করতে পারি  x_{1}, x_2 এবং x_3  এর জন্য। ক্র্যামার-এর সূত্র (Cramer’s rule) প্রয়োগ করে পাই:

x_{1}= \frac{\begin{vmatrix}W&k_{2}&k_{3}\\\frac{W_{1}}{2}&k_{2}l_{1}&k_{3}l\\0&-l&l_{1}\end{vmatrix}}{\begin{vmatrix}k_{1}&k_{2}&k_{3}\\0&k_{2}l_{1}&k_{3}l\\l-l_{1}&-l&l_{1}\end{vmatrix}}

x_{2}= \frac{\begin{vmatrix}k_{1}&W&k_{3}\\0&\frac{W_{1}}{2}&k_{3}l\\l-l_{1}&0&l_{1}\end{vmatrix}}{\begin{vmatrix}k_{1}&k_{2}&k_{3}\\0&k_{2}l_{1}&k_{3}l\\l-l_{1}&-l&l_{1}\end{vmatrix}}

x_{3}= \frac{\begin{vmatrix}k_{1}&k_{2}&W\\0&k_{2}l_{1}&\frac{Wl}{2}\\l-l_{1}&-l&0\end{vmatrix}}{\begin{vmatrix}k_{1}&k_{2}&k_{3}\\0&k_{2}l_{1}&k_{3}l\\l-l_{1}&-l&l_{1}\end{vmatrix}}

এই ডিটারমিনেন্টগুলির বিস্তার কষলে আমরা পাব:

R_{1}= k_{1}x_{1}= \frac{W}{2}\frac{k_{1}k_{3}l^2 - k_{1}k_{2}l_{1}(l-2l_{1})}{k_1k_2l_{1}^2 + k_{1}k_{3}l^2 + k_{2}k_{3}(l-l_{1})^2}

R_{2}= k_{2}x_{2}= \frac{W}{2}\frac{k_{1}k_{2}ll_{1} + k_{2}k_{3}l_{1}(l-l_{1})}{k_1k_2l_{1}^2 + k_{1}k_{3}l^2 + k_{2}k_{3}(l-l_{1})^2}

R_{3}= k_{3}x_{3}= \frac{W}{2}\frac{k_{1}k_{3}l^2 + k_{2}k_{3}l_{1}(l-l_{1})(l-2l_{1})}{k_1k_2l_{1}^2 + k_{1}k_{3}l^2 + k_{2}k_{3}(l-l_{1})^2}

উপরের ফর্মুলাগুলো অনেক সহজ হয়ে যায় যদি ধরি

l_{1}= \frac{l}{2}

তখন পাই:

R_1= R_3= W\frac{2k_1k_3}{k_1k_2 + k_2k_3 + 4k_1k_3}

R-2 = W\frac{k_1k_2 + k_2k_3}{k_1k_2 + k_2k_3 + 4k_1k_3}

কঠিন অবলম্বনের ওপর রাখা একটি লম্বা কড়িকাঠের সমস্যাটি বোঝার জন্য আমরা -এর মান সীমিত রেখে k_i \to \infty এবং x_i \to 0 এই সীমা পর্যন্ত যেতে পারি (এখানে i= 1, 2, 3)। সরলীকরণের জন্য আমরা l_1 কে \frac{l}{2} তেই স্থির এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব।

সমস্ত স্প্রিং গুলি যদি একই ক্ষমতাসম্পন্ন হয় তাহলে আগের সমীকরণ থেকে পাই:

R-1= R_2= R_3= \frac{W}{3}

আবার যদি k_2= k_3 হয় এবং k_1 এর মান k_2 বা k_3-এর থেকে অনেকটা বড় হয়, তাহলে:

\frac{k_2}{k_1} বা \frac{k_3}{k_1}

যে পদগুলি থাকবে তাদের মান খুব ছোট হওয়ার জন্য সেগুলোকে আমরা বাদ দিতে পারি। সুতরাং:

R_1= R_3= 2W\frac{k_3}{k_2+4k_3+k_2\frac{k_3}{k_1}}= 2W\frac{k_2}{k_2+4k_2}= \frac{2}{5}W

R_2= W\frac{k_2+k_2\frac{k_3}{k_1}}{k_2+4k_3+k_2\frac{k_3}{k_1}}= W\frac{k_2}{k_2+4k_2}= \frac{1}{5}W

অন্যদিকে আবার যদি k_1= k_3 হয় এবং k_2 এর মান k_1 বা k_3 এর থেকে অনেকটা বড় হয়, তাহলে আমরা পাব:

R_1= R_3= 2W\frac{k_1\frac{k_3}{k_2}}{k_1+k_3+4k_1\frac{k_3}{k_2}}= 0 R_2= W\frac{k_1+k_3}{k_1+k_3+4k_1\frac{k_3}{k_2}}= W

এর মানে হল, যদি মাঝের স্প্রিংটি প্রান্তস্থ দুটি দুই স্প্রিং-এর থেকে অনেকটা বেশী শক্তিশালী হয়, তাহলে প্রান্তস্থ স্প্রিংগুলির কার্যত কোন ভুমিকা থাকেনা। এখানে লক্ষ্যণীয় যে সমস্ত সমাধানই ওপরের বল ও টর্ক এর সমীকরণগুলি মেনে চলে।

অর্থাৎ একেকটা অবলম্বন কতটা ওজন বইছে, সেটা নির্ভর করছে কিভাবে আমরা

k_i \to \infty এবং x_i \to 0 সীমার দিকে যাচ্ছি, তার ওপর। কোনো একটা নির্দিষ্ট উত্তর নেই। সমস্যাটাকে সহজ করতে কড়িকাঠ অবলম্বন উভয়কেই কঠিন বস্তু হিসেবে ধরা যায় কিন্তু সেটা করলে আর কোনো সমাধানই পাওয়া যায়না। আসলে ইঞ্জিনিয়ারদের থামের উপর কড়িকাঠ বানানোর সময় থামের প্রতিক্রিয়ার একটা আন্দাজ দিতে হয়। এটা করার সময় তারা কিন্তু কড়িকাঠ থাম কাউকেই একেবারে নিখুঁতভাবে কঠিন ধরে না।

প্রচ্ছদ ও অন্যান্য ছবি: বনানী মণ্ডল

(এই লেখাটি মূল ইংরাজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর ঝুমা সন্নিগ্রাহী আর অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়।)

The post প্রতিক্রিয়া আর টানের ব্যাখ্যা: কিছু জটিল সমস্যা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

নিজে করো: আলোর পোলারাইজেশান নিয়ে মজা!

$
0
0

মৌমাছি যেভাবে আলোকে দেখে, আমরা সেটা পারি না। আলোর পোলারাইজেশান (polarization) এমন একটা ধর্ম যেটা আমাদের চোখে এমনিতে ধরা পড়ে না। কিন্তু যদি দু-তিনটে পোলারাইজার ফিল্ম জোগাড় করা যায় (যেমনটা সানগ্লাসে থাকে), তখন আলোর এই ধর্মের জোরেই অনেক লুকোনো জিনিস বেরিয়ে আসে। নিচে তার কয়েকটা নমুনা দেখো। তবে এগুলো যে হয়, সেটা বিশ্বাস করতে হলে কিন্তু নিজে করে দেখতে হবে!


ঝলমলে রোদ্দুরের দিনে সানগ্লাস পরে ঘুরতে বেরোই আমরা অনেকেই। চোখ ধাঁধানো থেকে বাঁচতে সানগ্লাসের জুড়ি নেই। সানগ্লাস যেন ম্যাজিকের মত বিভিন্ন মসৃণ তল থেকে (যেমন গাড়ির বনেট বা ছাদ) প্রতিফলিত আলোর তীব্রতা কমিয়ে দেয়! আকাশের নীল রঙ সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে সানগ্লাস পরা চোখে!

ভেবে দেখেছো, ঠিক কীভাবে সানগ্লাস কাজ করে? কেন সানগ্লাস পরলে চোখ-ধাঁধিয়ে দেওয়া আলোর প্রতিফলন কমে যায়? এ সবের পিছনে আছে আলোর এক বিশেষ ধর্ম, যার নাম পোলারাইজেশান। বেশিরভাগ সানগ্লাসের উপরে একটা সূক্ষ্ম ফিল্ম লাগানো থাকে, যা বিশেষ পোলারাইজেশান-ওয়ালা আলোকে একদম আটকে দিতে পারে। আজকে আমরা পোলারাইজেশান নিয়ে কিছু খেলা করব – হাতে কলমে বিজ্ঞানের মজা নেওয়ার কোন বিকল্প নেই!

কী কী লাগবে আমাদের পরীক্ষাগুলো করতে? সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল কিছু পোলারাইজেশান ফিল্ম। নানাভাবে এই পোলারাইজেশান ফিল্ম জোগাড় করা যায়। ই-কমার্সের ওয়েবসাইটে (যেমন amazon.in, aliexpress) polarization film-এর খোঁজ করলে বেশ কিছু পণ্য পাওয়া যাবে। গোটা পাঁচ কি দশেক পোলারাইজেশান ফিল্মের একটা প্যাকেট পাওয়া যাবে – দাম কয়েকশো টাকা থেকে এক-দেড় হাজার টাকার মধ্যে। আমাদের পরীক্ষাগুলো করার জন্য দুটো কি তিনটে ফিল্ম হলেই চলবে। আগেই বলেছি সানগ্লাস আলোর পোলারাইজেশান দেখতে পায়, তাই দুটো সানগ্লাসের কাচ দিয়েও এই পরীক্ষাগুলো করা যায়। অথবা, মোবাইল সারানোর দোকান থেকে যদি পুরনো নষ্ট হয়ে যাওয়া মোবাইলের LCD ডিসপ্লের সাথে আটকানো পোলারাইজিং ফিল্ম পাওয়া যায় তাহলেও কাজ হবে! পোলারাইজিং ফিল্ম, বা সানগ্লাস, বা LCD ডিসপ্লের ফিল্ম – ইত্যাদির যেকোন একটা বোঝাতে আমি পোলারাইজার কথাটা ব্যবহার করছি এখন থেকে।

পোলারাইজেশান কী?

পোলারাইজেশান বলতে আমরা আলোক তরঙ্গের তড়িৎক্ষেত্রের দিক বুঝি।

আলো এক রকম তরঙ্গ। নানারকমের তরঙ্গ বা ঢেউ আমরা দেখে অভ্যস্ত। যেমন, শরতে হাওয়া কাশের ক্ষেতে ঢেউ তোলে। কাশফুলগুলো এদিক ওদিক দুলতে থাকে, আর সেই দোলা এক কাশ থেকে অন্য কাশ হয়ে ক্ষেতের এপার থেকে ওপার ছুটে চলে। মহাবিশ্বের সুদূর কোন তারা থেকে তৈরি হওয়া আলোও ঠিক এভাবেই দোলা দিয়ে ছুটে এসে আমাদের চোখে আছড়ে পড়ে। কিসের দোলা? আলো আসলে এক

তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। অর্থাৎ, আলোর ছোটার পথে তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকক্ষেত্রের মান বা দিক (বা দুটোই) দুলতে থাকে। কাশ ক্ষেতের উদাহরণে যদি আমরা কোন একটা নির্দিষ্ট কাশের দিকে তাকাই তাহলে কাশের মাথাটা যে দিক বরাবর দুলছে, সেই দিককে কাশঢেউ-এর পোলারাইজেশান বলতে পারি। সেটা কোন এক দিক বরাবর (রৈখিক) হতে পারে, বা কাশে মাথা ঘুরতে (বৃত্তীয়) পারে। আবার, এই পোলারাইজেশান কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর পাল্টাতেও পারে, যেমন হাওয়ার দিক ঘুরে গেলে।

চিত্র ১ – আলোর বৃত্তীয় পোলারাইজেশান। তরঙ্গের কোন এক বিন্দুতে তড়িৎক্ষেত্র এক বৃত্ত বরাবর ঘুরতে থাকছে সময়ের সাথে। (ছবির উৎস – wikipedia/Dave3457)

তড়িৎক্ষেত্র যেদিকে নির্দেশ করে আছে তাকে আমরা আলোর পোলারাইজেশান বলি। সেটা রৈখিক হতে পারে, বৃত্তীয় হতে পারে, আবার সময়ের সাথে এলোমেলোভাবে পালটাতেও পারে। চিত্র-১ এ যেমন একটি বৃত্তীয় পোলারাইজেশানের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। 

এখানে যে সব পরীক্ষার কথা বলছি তার জন্য আমরা পোলারাইজার বলে একটা জিনিস ব্যবহার করব। পোলারাইজার হল এমন একটা বস্তু, যার উপর আলো পড়লে, সেই আলোর যেটুকু অংশের পোলারাইজেশান একটি বিশেষ দিকে হয়, শুধু সেইটুকুই পার হতে পারে। বাকীটা শোষিত বা প্রতিফলিত হয়ে যায়। এই বিশেষ দিকটি নির্ভর করে পোলারাইজারটা কীভাবে তৈরি করা হয়েছে তার উপর। চিত্র ২ -এ যেমন পোলারাইজারটা কেবল উল্লম্ব দিকে রৈখিক  পোলারাইজেশানই পার হতে দেয়। পরীক্ষার কথায় ফিরে আসা যাক। নিচে কয়েকটি পরীক্ষার উল্লেখ করলাম। সেগুলো দিয়ে শুরু করলেই তোমরা বুঝে যাবে পোলারাইজেশান নিয়ে কত মজা করা যায়। তারপর নিজেরাই নতুন নতুন পরীক্ষা ভেবে করতে পারবে।

চিত্র ২ – পোলারাইজারের কারসাজি! বামদিক থেকে আলো এসে পড়ছে পোলারাইজারে (মাঝখানে)। পোলারাইজারটি কেবল আলোক তরঙ্গের সেই অংশকেই তার মধ্যে দিয়ে পার হতে দিচ্ছে যার পোলারাইজেশান উল্লম্ব দিকে। এখানে তীরচিহ্নগুলো আলোর তড়িৎক্ষেত্র নির্দেশ করছে। (উৎস – http://physicsopenlab.org/2016/03/13/electromagnetic-waves-polarization/)

পরীক্ষা ১ – সানগ্লাস ও প্রতিফলিত আলো

বালতি বা গামলাতে জল ভরে জলের নিচে কিছু খেলনা ফেলে রাখো। এবার এই বালতি বা গামলাকে এমন জায়গায় রাখো যাতে জলের উপর আশেপাশের জিনিসের প্রতিফলন দেখা যায়। দিনের বেলায় বাড়ির বারান্দায় যেখানে আশেপাশে গাছপালা আছে সেখানে এমন দৃশ্য দেখা যাবে। এখন যেহেতু জলের নিচে খেলনাগুলো আছে, অথচ বাইরের গাছপালার প্রতিফলনও হচ্ছে জলের উপর থেকে, তাই খেলনাগুলো খুব স্পষ্ট দেখা যাবে না। প্রতিফলন এসে খেলনার ছবির উপর পড়বে। এবার একটা পোলারাইজারের (যেমন সানগ্লাসের) মাধ্যমে খেলনাগুলোকে দেখার চেষ্টা কর। পোলারাইজারটা একটু করে ঘোরাতে থাকো – দেখো তো পোলারাইজারের কোন বিশেষ সজ্জার ফলে আশেপাশের প্রতিফলন ভ্যানিশ করে শুধু জলের তলার খেলনা দেখা যাচ্ছে কিনা? একটা উদাহরণ দিচ্ছি। নিচের তিনটে ছবি দেখো। এটা একটা জলা জায়গার ছবি। জলের তলায় কিছু শ্যাওলা জাতীয় গাছ আছে, আবার জলার উপরে কিছু বড় (পামজাতীয়) গাছের পাতার তীব্র প্রতিফলনও চোখে এসে পড়ছে। আমি আমার সানগ্লাসটা ফোন ক্যামেরার সামনে রেখে ছবি তিনটে তুলেছি। সানগ্লাসের হাতলদুটো দেখে বুঝতে পারবে সানগ্লাসটা কীভাবে ধরেছি এই তিনটে ছবিতে। চিত্র ৩ -এ দেখো – সানগ্লাসটা উল্লম্বভাবে রয়েছে। পাতার প্রতিফলন এতটাই উজ্জ্বল যে জলের তলার গাছ দেখাই যাচ্ছে না। চিত্র ৪-এ সানগ্লাসটা মোটামুটি পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণে রেখেছি, ধীরে ধীরে জলের তলার গাছটা বোঝা যাচ্ছে। চিত্র ৫-এ সানগ্লাসটা অনুভূমিকভাবে রয়েছে। এবার জলের তলার গাছটা পরিষ্কার। বরং পাতার প্রতিফলনটাই ভ্যানিশ!

চিত্র ৩ – সানগ্লাস উল্লম্বভাবে ধরা হয়েছে ফোন ক্যামেরার সামনে। পামগাছের পাতার প্রতিফলন এত তীব্র যে জলের তলার শ্যাওলা জাতীয় গাছ নজরেই আসছে না প্রায়। (ছবি – লেখক)
চিত্র ৪ – সানগ্লাস উল্লম্ব ও অনুভূমিকের মাঝামাঝি কোণে ধরা হয়েছে। পামগাছের পাতার প্রতিফলনের তীব্রতা চিত্র ৩-এর তুলনায় কমে এসেছে। জলের তলার গাছগুলো একটু বেশী পরিষ্কার হয়েছে। (ছবি – লেখক)
চিত্র ৫ – সানগ্লাস অনুভূমিকভাবে ধরা হয়েছে ক্যামেরার সামনে। এবার দেখো পামগাছের পাতার প্রতিফলন প্রায় নেই বললেই চলে। জলজ শ্যাওলাগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মাছও দেখা যাচ্ছে! (ছবি – লেখক)

কেন এমন হচ্ছে বলতে পারো? আমাদের ইমেইল করে জানাও – bigyan.org.in@gmail.com-এ। সেই সাথে জানাও এমন আর কী পরীক্ষা করতে পারলে। ফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলে পাঠাও।

পরীক্ষা ২ – তৃতীয় পোলারাইজারের কারসাজি

এই পরীক্ষাটার জন্য তিনটে পোলারাইজার লাগবে। প্রথমে কোন একটা বই বা ছবির সামনে প্রথম পোলারাইজারটা ধর। দেখবে ছবিটার ঔজ্জ্বল্য একটু কমলেও ঠিকঠাকই দেখা যাচ্ছে (চিত্র ৬ এর মত)।

চিত্র ৬ – একটা ছবির সামনে একটা পোলারাইজার ধরা হয়েছে। ঔজ্জ্বল্য একটু কমলেও ছবিটাকে ঠিকই দেখা যাচ্ছে। (ছবি – লেখক)

এবার দ্বিতীয় পোলারাইজারটাকে প্রথমটার সামনে ধর ও ঘোরাতে থাকো। দেখবে দুটো পোলারাইজারকে একটা বিশেষ কোণে রাখলে পিছনের ছবিটা পুরো অন্ধকার হয়ে গেছে (চিত্র ৭-এর মত)!

চিত্র ৭ – ছবিটার সামনে দুটো পোলারাইজার ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় পোলারাইজারকে প্রথমটার সাপেক্ষে ঘোরাতে থাকলে একটা বিশেষ কোণে প্রথম পোলারাইজার পের করেছে এমন আলোর প্রায় কোন অংশই দ্বিতীয় পোলারাইজার পেরোতে পারে না! তাই ছবিটা অন্ধকার হয়ে গেছে! (ছবি – লেখক)

কেন এমন হচ্ছে বল তো? পোলারাইজার তৈরি করতে যে পদার্থের অণু ব্যবহার করা হয়, তাদের একটা নির্দিষ্ট সজ্জা আছে। দেশলাই-এর বাক্সের মধ্যে দেশলাই কাঠির যেমন সজ্জা থাকে। সেই অণুর সজ্জা বরাবর আলোর তড়িৎক্ষেত্র বা পোলারাইজেশান থাকলেই তবেই সেই আলো পার হতে পারে। এবার, দ্বিতীয় একটা পোলারাইজারকে যদি এমনভাবে রাখি যে তার অণুগুলোর সজ্জা প্রথম পোলারাইজারের সাথে লম্বভাবে, তাহলে যে আলো প্রথম পোলারাইজার দিয়ে পার হতে পেরেছিল, সেই আলো দ্বিতীয় পোলারাইজার দিয়ে আর পার হতে পারবে না!

এবার, এই দুই পোলারাইজারের মাঝে তৃতীয় একটি পোলারাইজার ঢুকিয়ে দেখো তো, কী হয়! তৃতীয় পোলারাইজারটাকে বিভিন্ন কোণে ঘুরিয়ে দেখো। কী দেখলে আমাদের জানাও।

পরীক্ষা ৩ – রংবাহারী টেপ!

রঙ নেই এমন কোন টেপ নাও যার একদিকে আঠা আছে, যেমন সেলোফেন টেপ। এবার একটা স্বচ্ছ ফিল্ম বা কাচের উপর টেপের অংশ কেটে কেটে টানটান করে লাগাতে থাকো। যেমনভাবে ইচ্ছে একটা টেপের উপর অন্য টেপ, বিভিন্ন কোণে লাগাতে থাকো। চিত্র-৮ এ একটা উদাহরণ দিলাম।

এবার, এই টেপের কোলাজের উপরের ও নীচে একটা করে পোলারাইজার ধরলে দেখবে টেপ আর রঙহীন নেই! হয়ে গেছে রঙবাহারী! পোলারাইজার দু’টোকে একে অপরের সাপেক্ষে ঘুরিয়ে দেখো তো রঙ পালটাচ্ছে কিনা! এবার তোমার মধ্যেকার শিল্পী সত্ত্বা কাজে লাগিয়ে দেখো তো সেলোফেন টেপ দিয়ে কত নকশা আর ছবি তৈরি করতে পারো। রহস্য গল্পের মতই, সে ছবি সহজে চোখে পড়বে না। কিন্তু, যেই দুই পোলারাইজারের মাঝে ধরবে, অমনি বেরিয়ে আসবে সেই নকশা (চিত্র ৯)।

চিত্র ৮ – অনেকগুলো সেলোফেন টেপকে একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ফিল্মের উপর টানটান করে আটকানো হয়েছে। সেলোফেনগুলো স্বচ্ছই রয়েছে। (ছবি – লেখক)
চিত্র ৯ – সেলোফেন আটকানো ফিল্মটার সামনে ও পিছনে একটা করে পোলারাইজার রাখা হয়েছে। এবার দেখো সেলোফেন কেমন রঙীন হয়ে উঠেছে! (ছবি – লেখক)

পোলারাইজার ছাড়া বোরিং, কিন্তু দুই পোলারাইজারের মাঝে পড়লে নকশা ফুটে উঠছে – এমন পরীক্ষা আরও করা যায়। চিত্র ১০ দেখো। একটা প্লাস্টিকের স্বচ্ছ চশমা দুই পোলারাইজারের মাঝে পড়ে কেমন রঙবাহারী হয়ে উঠেছে। শুধু প্লাস্টিকই নয়, দুটো পোলারাইজারের মাঝে বিভিন্ন স্বচ্ছ জিনিস ফেলে দেখো – অনেকক্ষেত্রেই দেখবে নতুন এক রঙের জগত তৈরি হচ্ছে! সেলোফেন বা চশমার পরীক্ষায় আসলে যা হচ্ছে তা হল, সেলোফেন বা প্লাস্টিকের মধ্যের অণুগুলোর সজ্জা এমন (বিশেষত প্লাস্টিকের উপর টান বা স্ট্রেস সৃষ্টি করলে) যে আলোর পোলারাইজেশানকে একটু করে পালটে দেয়। সাদা আলো যেহেতু বিভিন্ন রঙের সমষ্টি, আর বিভিন্ন রঙের আলোর পোলারাইজেশান বিভিন্ন মাত্রায় পালটায় এইসব অণুর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়, বিভিন্ন রঙের আলো বিভিন্ন মাত্রায় দ্বিতীয় পোলারাইজারের মধ্যে দিয়ে বের হতে পারে।

চিত্র ১০ – দুই পোলারাইজারের মধ্যে রাখা এক চশমা। চশমাটি কেমন রঙ-বেরঙের লাগছে দেখো। অথচ, পোলারাইজার ছাড়া চশমাটার কোন রঙ দেখা যাবে না। (ছবি – লেখক)

দুই পোলারাইজারের মধ্যে বিভিন্ন বস্তু রেখে দেখো তো – চাপ দিয়ে বাঁকানো প্লাস্টিক থেকে ঝিঁঝি পোকার ডানা – রঙ দেখতে পাচ্ছ কিনা?

আশেপাশের চিরপরিচিত জগতকে নতুন করে দেখার মজাই আলাদা! এ প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি, আমরা পোলারাইজারের সাহায্য ছাড়া আলোর পোলারাইজেশান আলাদা করে বুঝতে পারি না, কিন্তু মৌমাছিরা আলোর পোলারাইজেশান বুঝতে পারে! এমনকী, মৌমাছিরা এই পোলারাইজেশানের ধারণা কাজে লাগিয়ে মৌচাক থেকে কতদূরে মধুর উৎস বা ফুল আছে, তা অন্য মৌমাছি বন্ধুদের জানানও দেয়!

উৎসাহী পাঠকদের জন্য

১। https://www.youtube.com/watch?v=HH58VmUbOKM – পোলারাইজেশানের উপর খান অ্যাকাডেমীর ইউটিউব ভিডিও।

২। https://bigyan.org.in/2016/08/01/chirality/ – রসায়নে আলোর পোলারাইজেশান কীভাবে ব্যবহার হয় তার উদাহরণ।

৩। https://bigyan.org.in/2014/10/26/honeybee_waggle_dance/ – মৌমাছি আলোর পোলারাইজেশান ব্যবহার করে মধুর খোঁজ করে।

The post নিজে করো: আলোর পোলারাইজেশান নিয়ে মজা! appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

সময় গণনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: প্রথম পর্ব

$
0
0

একসময়ের সূর্যঘড়ি থেকে আজকের সিজিয়াম ক্লক বা অপটিকাল ক্লক, সময় পরিমাপ ক্রমশ হয়েছে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর। কবে থেকে এই সময় পরিমাপের প্রয়োজন হলো? কেনই বা হলো? সেই পরিমাপকে আরো সূক্ষ্মতর করারই বা দরকার হলো কেন? এতো জায়গার বিভিন্ন সময়কে একই ব্যবস্থার আওতায় কিভাবে আনা হলো? এইসব প্রশ্নের চমকপ্রদ উত্তর দিচ্ছেন অধ্যাপক শুভদীপ দে, যিনি নিজেই এই সময় পরিমাপের আধুনিকতম যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করছেন।


স্টিফেন হকিং-এর লেখা বইটির দৌলতে “সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” (A brief history of time) নামটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। এই প্রবন্ধের প্রথম পর্বে আমি “সময় গণনার” ইতিহাস সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব, যেটা “পরম সময়”-এর (absolute time) ইতিহাসের থেকে আলাদা। সময় এমন একটা বিষয় যেটা মানুষের হাতের নাগালের বাইরে। পরম সময় কখনোই মাপা যায়না কিন্তু সময় গণনা একটা সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ব্যাপার। যন্ত্রের সাহায্যে দুটো ঘটনার মধ্যে সময়ের পার্থক্য মাপা যায়। সময় গণনার অভ্যাসটা আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনার অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু খোদ সময়ের শুরু তো  একেবারে আমাদের এই বিশ্বসংসারের জন্মলগ্ন থেকে অর্থাৎ বিগ ব্যাং থেকে। সুতরাং সেই ভাবে দেখতে গেলে সময়ের ইতিহাসের কাছে সময় গণনার ইতিহাসকে একেবারে সদ্যজাত শিশুই বলা চলে।

সময় গণনার প্রয়োজন কেন পড়লো

সময় মাপা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক উপকরণ তৈরিকে হরোলজি (Horology) (সময় দেখা এবং ঘড়ি-নির্মাণবিদ্যা) বলা হয়। সময় মাপতে মূলত চাই একটা ঘটনা যেটার নির্ভরযোগ্যভাবে পুনরাবৃত্তি হয়। আনুমানিক প্রায় তিরিশ হাজার বছর আগে মানুষ এরকমই একটা ঘটনা খুঁজে পায় চাঁদের বিভিন্ন দশার মধ্যে (২৯.৫ দিনে পৃথিবীর পূর্ণ প্রদক্ষীণ করার ফলে চাঁদের একই দশার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়)। চাঁদের বিভিন্ন দশা দেখে থাকলেও তাই দিয়ে যে সময় মাপা যায় (lunar time), সেই ধারণা মানুষের শুরুতেই হয়নি। সেটা এসেছে আরো অনেক পরে যখন সময় গণনার প্রয়োজন হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে যত দিন গেছে, সময়কে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতরভাবে গণনার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে সময় গণনার প্রযুক্তিরও উন্নতি হয়েছে। এককালে যেখানে সময় মাপতে সূর্যঘড়ির ব্যবহার হতো, এখন সেখানে সময় মাপতে লেসার-এর প্রয়োগ করে পরমাণুকে পরমশূন্য তাপমাত্রার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আজকের অত্যাধুনিক পারমাণবিক ঘড়ি (atomic clock) মানুষের তৈরি যাবতীয় যন্ত্রের মধ্যে অন্যতম সূক্ষ্ম একটি পরিমাপযন্ত্র। সময় পরিমাপের সূক্ষ্মতা এক অভূতপূর্ব স্থানে পৌঁছে গিয়েছে।

সময় গণনার বিভিন্ন পদ্ধতি এবং তাদের উৎস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমে এই প্রশ্নটা মাথায় আসে: মানুষের আদৌ সময় গণনার প্রয়োজন হ’ল কেন? এর অনেকগুলো কারণ পড়েছি। আমার ব্যক্তিগত পছন্দের  কারণটা হলো, বিভিন্ন ধর্মস্থানে সূর্যচন্দ্রের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে প্রার্থনার ঘন্টা বাজানোর জন্য একটা সময় গণনার যন্ত্রের প্রয়োজন পড়েছিল। এটা অবশ্য অনেক সম্ভাবনার মধ্যে একটা, যদিও অনেকগুলো সূত্রে এর কথা বলা হয়েছে। যাইহোক, মূল বক্তব্য হলো, সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সাপেক্ষে দিনেরবেলা কতদূর গড়ালো, সেইটে মাপা প্রথম জরুরি হয়ে পড়েছিল। আস্তে আস্তে মানুষ এটাও বুঝলো যে সময় মাপতে পারলে ঋতু নির্ণয় করা যায় কারণ ঋতু অনুযায়ী দিনের দৈর্ঘ্য পাল্টায় (অবশ্যই জ্যোতির্বিদ্যার নানা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও ঋতু নির্ণয় সম্ভব)। ঋতু নির্ণয় করতে পারলে চাষবাসে প্রচুর লাভ।

প্রাচীন ইজিপ্টে সূর্যঘড়ি ব্যবহার করা হত দিনেরবেলা সময় মাপতে। সেই সঙ্গে অন্যান্য সভ্যতা যেমন পারস্য, গ্রিক, রোমানদের মধ্যেও সূর্যঘড়ির  ব্যবহার দেখা গেছে। কয়েক হাজার বছর ধরে, একেবারে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়া অব্দি, সূর্যঘড়ির সময় মাপা আরো নিখুঁত হয়েছে।

ভারতে সময় গণনার ইতিহাস

যেসব সূর্যঘড়ির চিহ্ন এখনো ভারতবর্ষে পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটা হলো কোনারকের সূর্য মন্দিরে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈরি একটা সূর্যঘড়ি। তারপর রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা জয় সিং-এর তৈরি জয়পুরের যন্তর-মন্তর। যন্তর-মন্তর-এর সূর্যঘড়িটা সেইসময় পৃথিবীর সবথেকে বড় সূর্যঘড়ি ছিল। পরবর্তীকালে রাজা জয় সিং দিল্লী, বেনারস, ম্থুরা এবং উজ্জয়নেও এরকম সূর্যঘড়ি তৈরি করেন। এইসব যন্তর-মন্তরে সূর্যঘড়ি ছাড়াও আরও অনেক রকমের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার আধুনিক যন্ত্র রয়েছে। (এপ্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে আমাদের দেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা অনেক উন্নত দেশের থেকেও পুরোনো এবং আজও জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার উন্নত দেশিগুলোর থেকে এগিয়ে আছি।) জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার সূত্রে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করতে গিয়ে দেখা গেল যে সেই অবস্থান সারাবছর এক থাকছে না। অবস্থানের এই পরিবর্তনকে সুনিশ্চিত করতে সময় গণনার দরকার পড়লো। অতএব সময় গণনার প্রয়োজন কিছুটা এসেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের থেকেও।

এইসব পুরোনো সূর্যঘড়িগুলোর তুলনায় আধুনিক এবং বেশি সঠিক সূর্যঘড়ি রয়েছে আইআইটি রূড়কি এবং আমি যেখানে কাজ করি, সেই পুনে-র IUCAA-তেও (ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রনমি এন্ড অ্যাস্ট্রফিজিক্স)। এই সমস্ত সূর্যঘড়ির ছবি চিত্র-১-এ দেখানো হয়েছে। এগুলো ছাড়াও আমার জানার বাইরে হয়তো ভারতবর্ষের আরো অনেক সূর্যঘড়ি আছে।

চিত্র -১: ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত কিছু সূর্যঘড়ি (a) কোনারক; (b) যন্তর মন্তর, জয়পুর; (c)যন্তর মন্তর, নিউ দিল্লি; (d) আই ইউ সি এ এ, পুনে এবং (e) আই আই টি রূড়কি (চিত্রগুলি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া হয়েছে)

সেভাবে দেখলে কয়েক দশক আগে অব্দিও সূর্যঘড়ির ব্যবহার আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল। আমার মনে আছে, আশির দশকের শেষের দিকে আমার ঠাকুমা আমাদের বর্ধমানের বাড়ির বাগানে একটা টগর গাছের ছায়া দেখে সময় বলে দিতে পারতেন। এটাও একরকম সূর্যঘড়ি বইকি! সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে ছায়ার দৈর্ঘ্য দেখে সময় বলার প্রথা কিন্তু বেশিদিন আগের কথা নয়। 

সূর্যঘড়ির কিছু সমস্যা

সূর্যঘড়ি দিয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে নির্ভুল সময় মাপতে গেলে কিন্তু কিছুটা খাটতে হবে। পৃথিবীর অক্ষাংশ ২৩.৫ ডিগ্রি হেলে থাকার ফলে সারা বছর ধরে দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য বাড়ে-কমে। একই কারণে ঋতু পরিবর্তনও হয়। তাই গ্রীষ্মকালে যে ছায়া দেখে একটা সময় বলা যায়, শীতকালে সেই ছায়াই আরো আগেভাগে দেখা যায়। তাছাড়া সূর্যঘড়িগুলোকে অক্ষাংশ-নির্ভর (latitude-dependant) বানাতে হয় কারণ  পৃথিবীর অক্ষাংশ বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের উচ্চতাও (altitude) কমে।

এই ব্যাপারগুলো যদি ধরাও হয়, তাহলেও কিছু সমস্যা থেকে যায়। যেমন, পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ নিজেই ২৬,০০০ বছরে একটা বৃত্ত পূর্ণ করে কিম্বা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো প্রাকৃতিক কারণেও সামান্য পরিবর্তিত হয়। সুতরাং নানান কারণে শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একেবারে নির্ভুল সূর্যঘড়ি বানানো সম্ভব নয়। যত সময় যাবে, সেই ঘড়ির পরিমাপে গলদও বাড়তে থাকবে।

বাতিঘড়ি, জলঘড়ি, বালুঘড়ি

সূর্যঘড়ি ছাড়াও চীনের মানুষ একধরণের তৈল-প্রদীপ-নির্ভর ঘড়ি ব্যবহার করত। এই ঘড়িতে পাত্রে কতটা তেল বেঁচে আছে, তার ভিত্তিতে সময় বলা হতো। হয়তো এগুলোর মূল ব্যবহার ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, যাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষও এর ব্যবহার শুরু করে। তৈল-প্রদীপ ঘড়ির একটা পরিমার্জিত সংস্করণ হ’ল মোমবাতি ঘড়ি, যেখানে মোমবাতিতে কিছু দাগ দেওয়া থাকে এবং পুড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সেই দাগ গুলোর সাহায্যে সময়ের পরিমাপ করা যায়।

কিন্তু এইধরণের ঘড়ি সঠিক সময় দেবে এবং প্রত্যেকটা বাতিই একই সময় দেবে, এমনটা আশা করা উচিত না। বাতির সলতে কত তাড়াতাড়ি পুড়ে যাচ্ছে, সেটা নির্ভর করে বাতি কি দিয়ে তৈরি, কিরকম পরিবেশে জ্বালানো হয়েছে, দাগ দেওয়াতে কতটা ভুলচুক হয়েছে, এই সবকিছুর উপর।

ইজিপ্সিয়রা আবার একধরণের জলঘড়ির আবিষ্কার করে। সেখানে একটা খালি কলসির গায়ে দাগ দেওয়া থাকে এবং কেন্দ্রে একটা ছোট্ট ফুটো করা থাকে। তারপর কলসিটাকে একটা জলপূর্ণ পাত্রে রেখে দেওয়া হয়। জল আস্তে আস্তে কলসিতে প্রবেশ করতে থাকে এবং যতক্ষণ না কলসি ভর্তি হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত দাগগুলো থেকে সময়ের একটা হিসেব পাওয়া যায়।  প্রাচীন ভারতীয় সিন্ধু সভ্যতায় এই ধরণের জলঘড়ি ব্যবহার করা হতো। দ্রাবিড়ীয় ভাষায় একে বলা হতো “ঘটিকা যন্ত্র” (সাদা ভাষায় ‘ঘড়ি’)। এই ধরণের ঘড়ি বলিউড ছবি ‘মহেঞ্জদরো’-তেও দেখানো হয়েছে।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বালুঘড়ি (hour glass) খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, বিশেষত সমুদ্রযাত্রায় নাবিকদের কাছে। এইধরণের ঘড়িতে কোন তরল বা সূক্ষ বালির মত কণা ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগে আরও সূক্ষ্মভাবে সময় নির্ধারণকারী ঘড়ির উদ্ভব হয়, যেমন ক্লক্কা (“clocca”,  ল্যাটিন ভাষায় clock বা ঘড়ি)। এরকম একটা ঘড়ি ইতালির একটি চার্চের দেওয়ালে আজও টাঙানো আছে বলে শুনেছি।

পেন্ডুলাম ঘড়ি

১৬৫৭ সালে ক্রিস্টিয়ান হাইগেন্স পেন্ডুলাম ঘড়ির আবিষ্কার করেন। পেন্ডুলাম ব্যবহারের ফলে ঘড়ি আরো অনেক নিখুঁত সময় দিতে শুরু করে। এবং নাবিকদের প্রয়োজনে এই ঘড়ি উন্নততর হতে থাকে। 

এই প্রসঙ্গে ব্রিটেনের জন হ্যারিসন-এর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পেশায় ছুতোর মিস্ত্রি, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তিনি এমন ঘড়ি বানালেন যার সময় পরিমাপে ভুল ছিল আগের সব ঘড়ির তুলনায় অনেক কম। দ্রাঘিমাংশ (longitude) মাপতে পারা তখন একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল। জন হ্যারিসন এই চ্যালেঞ্জ-এর উত্তরে ক্রোনোমিটার (chronometer) নামক একটা যন্ত্র বানালেন যেটা একটা বিশেষ জায়গার সময়, এক্ষেত্রে গ্রীনিচ মিন টাইম (Greenwich Mean Time), যেকোনো জায়গায় বলে দিতে পারে। দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করতে এটাই দরকার ছিল। দুপুরবেলা সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে, সেইসময়ে ক্রোনোমিটার-এ গ্রীনিচ মিন টাইম থেকে একজন নাবিক বলে দিতে পারতো কোন দ্রাঘিমাংশে সে অবস্থিত।

হ্যারিসনের এই ঘড়িতে গোটা দিনে বড়োজোর তিন সেকেন্ড এদিকওদিক হতো। তাই তাঁর এই আবিষ্কার দূর সমুদ্রযাত্রায় একটা যুগান্তকারী বিপ্লব এনে দিয়েছিল। এবং একারণে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে প্রভূত পুরষ্কার অর্জন করেন, যদিও ওনাকে এই পুরস্কার পেতে অমানুষিক বেগ পেতে হয়েছিল। 

সময় পরিমাপের মানদণ্ড স্থাপন

চিত্র-২-এ আমরা দেখতে পাচ্ছি গত 700 বছরে ঘড়ির সময় পরিমাপ কত নিখুঁত হয়েছে [১]। এই চিত্রের উলম্ব অক্ষটিতে (y-axis) দেখানো হয়েছে, কতটা সময় গেলে পর ঘড়িতে এক সেকেন্ডের ভুল হয়। পাঠকের সুবিধার জন্য বলি, ১০ সেকেন্ড ভুল হলে ঘড়িতে আনুমানিক এক বছর মতো ভুল হয়ে  যাবে। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, যত ঘড়ির আধুনিকীকরণ হয়েছে, তত এই এক সেকেন্ডের ভুলের জন্য সময়ের ব্যবধান অনেক বেড়ে গেছে।

চিত্র-২: গত ৭০০ বছরে ঘড়ির নির্ভুল সময়ের ক্রমবিকাশ, ডানদিকের তীরচিহ্ন গুলি কিছু ঘটনার সময়কাল নির্দেশ করছে যা পাঠক সহজে বুঝতে পারবে। আজকের দিনের সর্বাধুনিক পারমানবিক ঘড়ি ১০১৮ সেকেন্ডের, যা এই ব্রহ্মাণ্ডের বয়সের থেকেও বেশী, পরিমাপকে ১ সেকেন্ড নিখুঁত ভাবে মাপতে পারে।

শুধু সময়ের সাথে সাথে পরিমাপে ভুল নয়, আরো একটা সমস্যা ছিল। ঘড়িগুলো চলতো নিজস্ব নিয়মে, তাদের মধ্যে কোনো সংযোগ ছিল না। আন্তর্জাতিক স্তরে তো দূরের কথা, জাতীয় স্তরেও কোনো একটা বিশেষ ঘড়িকে মানদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে বাকি ঘড়িগুলোকে মিলিয়ে নেওয়ার কোনো প্রচেষ্টা ছিল না। তাই, ভিন্ন জায়গায় সময় পরিমাপের ভিন্ন নিয়ম চলতো।

উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন ভারতে “নিমেষ” ছিল সময়ের সবথেকে ছোট একক। এই এককটাকে ভাবা হতো চোখের এক পলক ফেলার সমান, অর্থাৎ ০.২১৩৩ সেকেন্ড। ক্রমানুসারে বৃহত্তর এককগুলো হল কাস্থ = ১৫ নিমেষ, কাল = ৩০ কাস্থ, মূহুর্ত = ৩০ কাল, অহোরাত্রম = ৩০ মূহুর্ত = ১ দিন, মাস = ৩০ অহোরাত্রম, ঋতু = ২ মাস, সামবাৎসারা = ৬ ঋতু = ১ বছর। সূর্যসিদ্ধান্ত, বেদ এবং অন্যান্য বইতে এই এককগুলোর উল্লেখ আছে, এবং আজও আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋতু, মূহুর্ত বা মুহরাত এগুলোর ব্যবহার করে থাকি। এই এককগুলোর ভিত্তি যেহেতু ব্যাক্তিসাপেক্ষ, তাই এই ধরণের এককের সাহায্যে নিখুঁত মানদণ্ড স্থাপন করা (standardization) সম্ভব নয়।

জাতীয় স্তরে সময়ের মানদণ্ড স্থাপনের দরকার পড়লো রেল তথা অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োজনে। আন্তর্জাতিক স্তরে এই প্রয়োজন অনুভূত হলো আরো অনেক পরে। বিভিন্ন দেশে যখন পশ্চিমী দেশগুলো উপনিবেশ শুরু করলো, তখন একটা সর্বজনীন একক মেনে সময় জানা জরুরি হয়ে উঠলো। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৪৭ সাল থেকে ব্রিটেনে রেলগাড়ি তথা স্টেশনের সময়ের জন্য গ্রীনিচের রয়্যাল অবসারভেটরির দেওয়া সময়কে ব্যবহার করা শুরু হয়। এক এক করে স্টেশনগুলো এই সময়টা মেনে চলতে শুরু করে, নিজেদের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে (synchronization)। ১৮৫৫ সাল থেকে এই সময়টা টেলিগ্রাফ সিগনাল মারফত সর্বত্র প্রচার করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রিটেনের প্রায় সমস্ত ঘড়ির সময় গ্রীনিচ মিন টাইম-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ১৮৮০ সাল থেকে এই সময়টা দেশের সরকারী সময় হিসাবে স্বিকৃতি লাভ করে। এখনো এটা গ্রীনিচ মিন টাইম বা জিএমটি নামে খ্যাত।

পেন্ডুলাম ঘড়ির পরবর্তী যুগ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন উন্নত প্রযুক্তির আবির্ভাবের সাথে সাথে, বিশেষত আন্তর্মহাদেশীয় কৌশলগত পথ নির্দেশক যোগাযোগ ব্যবস্থা (navigation) ও সম্প্রচারের (broadcasting) কারণে, নির্ভুল সময় গণনা, তার নিখুঁত প্রচার এবং সঠিক কম্পাঙ্কে বেতার-তরঙ্গ (রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি) পাঠানোর প্রয়োজন রাতারাতি বেড়ে গেল। বিজ্ঞানীরা একটা বিশেষ দোলকের (oscillator) সন্ধান করতে শুরু করলেন যার দোলনকাল দিয়ে আরো নিখুঁতভাবে সময় মাপা যাবে এবং যার উপর পৃথিবীর ঘূর্ণনের কোন প্রভাব থাকবে না।

৯৪৫ সালে ইসিডোর আইসাক রাবি (Isidor Isaac Rabi) NMR-এর (Nuclear magnetic resonance) সাহায্যে সময় মাপার প্রস্তাব দেন। এই পদ্ধতিতে পরমাণুগুলোকে দোলক (oscillator) হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে কিন্তু প্রফেসর রাবি NMR–এর সাহায্যে পরমাণুর চৌম্বক ভ্রামক (magnetic moment) এবং পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ঘূর্ণনের (nuclear spin) মধ্যেকার সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ম্যানহাটন প্রোজেক্টেও কাজ করেছেন।

রাবি-র প্রস্তাবিত ধারণা অনুযায়ী তখনকার ন্যাশান্যাল বুরো অফ স্ট্যান্ডার্ড (NBS) ১৯৪৯ সালে অ্যামোনিয়ার শোষণ রেখার (ammonia absorption line) উপর ভিত্তি করে প্রথম পারমাণবিক ঘড়ি তৈরি করে। প্রথম প্রজন্মের পারমাণবিক ঘড়ি এক সেকেন্ডের ১০১০ ভাগ অবধি নির্ভুল সময় গণনা করতে পারত, অর্থাৎ ১০০০ বছরে তার মাত্র এক সেকেন্ড বিচ্যুতি হয়। পারমাণবিক ঘড়ি প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী পর্বে করা হয়েছে।

দ্রাঘিমাংশ অনুযায়ী পৃথিবীর চব্বিশ ভাগ

১৮৫৮ সালে ইতালীর গণিতজ্ঞ কুইরিকো ফিলোপান্তি (Quitico Filopanti) প্রথম দ্রাঘিমাংশভিত্তিক দিনের (longitudinal days) ধারণা দেন। এই ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীকে  চব্বিশটা ফালিতে বিভক্ত করা হয়, একেকটা ফালিকে বলে টাইম জোন (time zone)। দ্রাঘিমাংশ 0°0’0’’ এবং অক্ষাংশ 51°28’38” উত্তরে অবস্থিত গ্রীনিচকে কেন্দ্র মেনে পূর্ব বা পশ্চিমে ১৫ ডিগ্রী দ্রাঘিমা রেখার পার্থক্যে গেলে একটা টাইম জোন থেকে পরেরটাতে যাওয়া হবে। এবং সময়ের পার্থক্য হবে +১ ঘন্টা (পূর্বে গেলে) বা -১ ঘণ্টা (পশ্চিমে গেলে)। উদাহরণস্বরূপ গ্রীনিচকেই ধরা যায়। গ্রীনিচ যেহেতু একেবারে একটা টাইম জোন-এর সীমান্তে, তাই তার পূর্ব দিকে দিনের সময় পশ্চিমের তুলনায় এক ঘন্টা এগিয়ে থাকবে। বা, আমি বর্ধমানের ছেলে বর্তমানে পুনেতে থাকি। এই দুটি জায়গার মধ্যে দ্রাঘিমাংশের পার্থক্য ১৫ ডিগ্রী এবং পুনে পশ্চিমে অবস্থিত। তাই সূত্র অনুযায়ী, পুনেতে বর্ধমানের তুলনায় এক ঘন্টা বাদে সূর্য উদয় হবে এবং অস্ত যাবে।

১৮৮৪ সালে ইন্টারন্যাশানাল মেরিডিয়ান কনফারেন্স-এ এই টাইম জোন-এর প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। 0°0’0’’ দ্রাঘিমাংশতে রাত্রি ১২:০০:০০টা-কে ০০:০০:০০ GMT ধরে সেই টাইম জোন-এর পুরোটাতেই  দিনের শুরু করা হয়। GMT-কে মানদণ্ড ধরে এটাই প্রথম আন্তর্জাতিক সময় স্থাপন করার চেষ্টা।  চিত্র-৩-এ বর্তমান টাইম জোন-গুলোকে দেখানো হয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে এই টাইম জোন-এর সীমান্তগুলো কিন্তু শুধুমাত্র দ্রাঘিমাংশ মেনে চলে না। বাস্তবে কোন অঞ্চলে এক সময় থাকলে সুবিধে হবে, সেই ব্যাপারটাও ধরা হয়। এই টাইম জোন-এর বিভাগকে কোঅর্ডিনেটেড ইউনিভার্সাল টাইম (Coordinated Universal Time) বা UTC বলা হয়।

চিত্র ৩: বিশ্বব্যাপী টাইম জোন-এর মানচিত্র, সূত্র – উইকিপিডিয়া।

ভারতের টাইম জোন

উত্তরে সুবিশাল হিমালয় এবং দক্ষিণে ডেকান মালভূমি (Decan platue) নিয়ে গঠিত ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। তার আয়তন ৩২,৮৭,২৬৩ বর্গ কিলোমিটার। ভারতের মূল ভূখণ্ড দ্রাঘিমাংশ ৮°৪’২৮” উঃ থেকে ৩৭°১৭’৫৩” উঃ (৩,২১৪ কিমি) এবং অক্ষাংশ ৬৮°৭’৫৩” পূ থেকে ৯৭°২৪’৪৭” পূ  (২,৯৩৩ কিমি) অব্দি বিসতৃত। জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। দ্রাঘিমাংশের বিস্তার প্রায় ৩০° হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ একটাই টাইম জোন পালন করে। এই টাইম জোন-এর সময়, যাকে বলে ভারতীয় মানক সময় (Indian standard time : IST), UTC-র থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা এগিয়ে, অর্থাৎ UTC+৫:৩০।

ভারতীয় স্ট্যান্ডার্ড সময় ৮২.৫° পূ দ্রাঘিমাংশের সময় অনুসারে স্থির করা হয়েছে। এই দ্রাঘিমাংশটা উত্তর প্রদেশের শঙ্করগড় ফোর্ট, মিরজাপুরের (২৫.১৫° উ, ৮২.৫৮° পূ) কাছাকাছি দিয়ে যায় (চিত্র-৪ দ্রষ্টব্য)।

চিত্র ৪: (a) ইন্ডিয়ান স্ট্যানডার্ড টাইম (IST) বা ভারতীয় মানক সময় অনুযায়ী সরকারী টাইম জোন প্রদর্শনকারী ভারতের মানচিত্র; ৮২.৫° পূ এবং ৭৫° পূ ও ৯০° পূ দ্রাঘিমাংশ আন্তর্জাতিক টাইম জোন মেনে ভারতের উপর দিয়ে অতিক্রম করেছে; (b) এলাহাবাদের কাছে মীরজাপুরে অবস্থিত ‘ঘণ্টা ঘর’ যা ভারতের নির্ধারিত টাইম জোন-এর প্রতিনিধিত্ব করে (৮২.৫° দ্রাঘিমাংশ)।

১৮৮৪-তে সাব্যস্ত দ্রাঘিমাংশ-ভিত্তিক টাইম জোন-গুলো ধরলে কিন্তু ভারতের মধ্যে দিয়ে দুটো সীমাসূচক দ্রাঘিমাংশ চলে যায়, যথা, ৭৫° পূ (যেটা মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নের উপর দিয়ে গেছে) এবং ৯০° পূ (যেটা অসমের অভয়াপুরি দিয়ে গেছে)। কিন্তু এই দ্রাঘিমাংশগুলোর কোনোটাকেই ব্যবহার করা হয়না ভারতীয় সময়ের জন্য।

ইতিহাসে ফেরত গেলে, চতুর্দশ শতাব্দীর ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’-এ উল্লেখ আছে যে ভারতের প্রধান মধ্যাহ্নরেখা (Prime Meridian) অবন্তি (২৩°১০’৫৮” উ, ৭৫°৪৫’৩৮” পূ,  বর্তমান নাম উজ্জয়ন) এবং রোহিতাক-এর (২৮°৫৪’ উ, ৭৫°৩৮, পূ, বর্তমান নাম রোহতাক) উপর দিয়ে গেছে এবং এই রেখার উপর সময়কেই ভারতের মানক সময় (standard time) ধরা হয়। এরপরের সময় পরিমাপের প্রচেষ্টা দেখা যায় ১৭৩৩-তে, যখন মহারাজা সোয়াই জয় সিং জয়পুরে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে নিখুঁত সময় গণনার কাজে যন্তর মন্তর মানমন্দির স্থাপন করেন।

ব্রিটিশদের শাসনকালে ১৮৮৪-তে GMT আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত হবার পর ভারতকে দুটো টাইম জোন-এ বিভক্ত করা হয়। একটা হ’ল বম্বে (এখন মুম্বাই) এবং অন্যটা ক্যালকাটা (এখন কোলকাতা), যারা যথাক্রমে UTC+৪:৫১ এবং UTC+৫:৫৪তে অবস্থিত। এই দুটো টাইম জোন আন্তর্জাতিক সময় রেখা (international time line) মেনেই নিজেদের মধ্যে মোটামুটি এক ঘন্টার সময় ব্যবধানে অবস্থিত (চিত্র-৪)। ভারতের পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মধ্যে সাধারণত ২ ঘণ্টার ফারাক থাকে। সুতরাং পুরো দেশকে এক ঘণ্টার সময়ের ব্যবধানে দুটি সময় অঞ্চলে ভাগ করা একদিক থেকে যেমন বিজ্ঞানসম্মত, তেমনি মানব কর্মদক্ষতা বাড়াতেও সাহায্য করে [২]।

কিন্তু ১৯০৪ সালে রেলব্যবস্থা শুরুর সাথে সাথে দুটো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের সময় বিভ্রান্তি দেখা দিলো। ফলস্বরূপ রেলওয়ে পুরো দেশের জন্য একটা আলাদা টাইম জোন ব্যবহার করতে শুরু করলো, যা মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) টাইম জোন বা UTC+৫:২১ দ্বারা চিহ্নিত হয়। সেসময় জনসাধারণের কাছে এটা রেলওয়ে স্ট্যান্ডার্ড টাইম নামেই পরিচিত ছিল। অনেকগুলো টাইম জোন সামলাতে গিয়ে শেষকালে যাতে রেল দুর্ঘটনার মুখোমুখি না হতে হয়, তাই এই ব্যবস্থা। যদিও স্থানীয় সময়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা সময় মেনে চলাও মোটেই সুবিধের ছিল না। সেইসঙ্গে  বঙ্গোপসাগরের উপর আন্দামান এবং নিকোবার দ্বিপপুঞ্জ আবার একটা আলাদা টাইম জোন-এ অন্তর্ভুক্ত ছিল। আবার ১৯৫১ সালের প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট অনুযায়ী অসমের চা বাগানের কর্মীরা তাদের নিজেদের জন্য একটা টাইম জোন স্থির করে, তার নাম দেয় “চা বাগান সময়” (Tea garden time)। ভারতীয় টাইম জোন-এর তুলনায় এটা  ১ ঘণ্টা এগিয়ে। এর উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়ানো এবং বৈদ্যুতিক শক্তির অপচয় কম করা। এখনও উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কিছু স্থানে এই “চা বাগান সময়” বেশ প্রচলিত।              

ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে থাকাকালীনই ৮২.৫°-কে মধ্য মধ্যাহ্নরেখা  (Central meridian) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তবে ১৯৪৭-এর পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে প্রথম এটাকে সরকারীভাবে কার্যকর করা হয়। IST চালু হবার পরেও মুম্বাই ও কোলকাতায় যথাক্রমে ১৯৪৮ ও ১৯৫৫ অবধি তাদের স্থানীয় সময় বোম্বে সময় ও ক্যালকাটা সময় চলেছে। বর্তমানে গোটা দেশ জুড়ে একটাই সময়ব্যবস্থা (IST) চালু আছে (চিত্র ৪)। পার্লামেন্ট-এর নিদের্শ অনুসারে দিল্লীর ন্যাশানাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি [৩] আমাদের দেশের IST রক্ষণাবেক্ষণের এবং দেশব্যাপি প্রচারের দ্বায়িত্বে নিযুক্ত আছে।   

(লেখাটি মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর অমলেশ রায় ও অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়। )  

কভার ইমেজ: https://www.pexels.com/

টীকা :

[1] “A brief history of time measurement”, Leo Rogers, University of Cambridge (2011). url – nrich.maths.org/6070.

“From sundials to atomic clocks understanding time and frequency”, James Jespersen and Jane Fitz-Randolp, NIST Publication (1999).

[2] “Necessity of ‘two time zones: IST-I (UTC + 5 : 30 h) and IST-II (UTC + 6 : 30 h)’  in India and its implementation” Lakhi Sharma et al., Current Science 115, 1252 (2018).

[3] NPL, New Delhi website – http://www.nplindia.in

The post সময় গণনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: প্রথম পর্ব appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

গ্যালিলিও পিসা শহরের মাঝে ভ্যাকুয়াম পেলেন কোত্থেকে ?

$
0
0

গ্যালালিও পিসার হেলানো মিনারের উপর থেকে বিভিন্ন ভরের গোলক ফেলে দেখালেন মাধ্যাকর্ষণের জন্য তাদের ত্বরণ সমান। কারণ তারা প্রায় একসাথে মাটি স্পর্শ করে। অর্থাৎ ত্বরণ ভরের উপর নির্ভর করেনা। এই অব্দি শুনে এক ছাত্র প্রশ্ন করলো, স্যার, এই পরীক্ষাটা কি ভ্যাকুয়াম-এ করা হলো? নইলে তো আলাদা ভরের উপর বায়ুর প্রতিরোধ আলাদা হওয়ার কথা (বায়ুর কারণেই পাখীর পালক ভাসতে ভাসতে পড়ে, আর ভারী জিনিস পড়ে সরাসরি)। এইরকম প্রশ্নের উত্তর সহজ কিছু অঙ্ক কষে (আর একটু গুগল সার্চ করে) কিভাবে দেওয়া যায়, তার একটা উপায় এখানে বাতলানো হলো।


প্রশ্ন

শোনা যায় গ্যালিলিও আলাদা ভরের দুটি গোলক ইতালির পিসা শহরের বিখ্যাত হেলানো মিনারের শীর্ষ থেকে একসঙ্গে ছেড়ে দেন। মিনারের নিচে দাঁড়ানো দর্শকরা অবাক হয়ে দেখেন ভারী এবং হালকা গোলক দুটি প্রায় একসঙ্গে নামতে থাকে এবং প্রায় একসঙ্গে এসে মাটি স্পর্শ করে। পরীক্ষাটা এইটা সাব্যস্ত করেছিল যে অভিকর্ষ জনিত ত্বরণ (acceleration due to gravity) যে কোনো বস্তুর ক্ষেত্রেই সমান।

এই বর্ণনা পড়ে মনে হয় পরীক্ষাটা খোলা হাওয়ায় করা হয়েছিল, বায়ুশূন্য স্থানে নয়। সেক্ষেত্রে গোলকদুটির ওপর পৃথিবীর অভিকর্ষ ছাড়াও বায়ুর বাধাজনিত বল কাজ করছিলো। আমরা জানি ভারী বস্তু বেশি সহজে বায়ুর বাধা অতিক্রম করতে পারে হালকা বস্তুর তুলনায়। ঠিক যে কারণে একই আকারের কয়েন ও শোলার টুকরো সমান উচ্চতা থেকে ফেললে কয়েনটা আগে মাটিতে পৌঁছয়। তাহলে গ্যালিলিওর পরীক্ষায় হালকা গোলকটার বায়ুর বাধা অতিক্রম করে মাটিতে পড়তে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় লাগলো না কেন?

আলোচনা

মজার ব্যাপার হলো গ্যালিলিওর নিজের লেখায় পিসা শহরের হেলানো মিনারের কোনো উল্লেখ নেই। তাঁর লেখায় দেখা যায় [১] যে তিনি উঁচু স্থান থেকে আলাদা আলাদা ভরসম্পন্ন বস্তুপিন্ড ফেলে দেখেছেন যে তারা প্রায় একসাথে মাটি স্পর্শ করে। কত উচ্চতা, ঠিক কি আকারের বস্তুপিন্ড, তার উপাদান কি, ভর কত, সেই নিয়ে সঠিক তথ্য তাঁর লেখায় পাওয়া যায় না।

তাই এই আলোচনায় আমরা নিজেদের মতো করে একটা পরীক্ষা কল্পনা করবো যেখানে একই মাপের   একটা লোহার আর একটা কাঠের গোলক (অর্থাৎ দুটোর ব্যাসার্ধ সমান, ধরা যাক R = 5 cm)  একসাথে ফেলা হচ্ছে উচ্চতা H = 1.5 m থেকে। দেখা যাক, বায়ুর বাধাকে ধরলে এদের পতনে তফাৎ হয় কিনা।

পতনের সময় গোলকটির ওপর দু’ধরণের বল কাজ করে:

  • পৃথিবীর অভিকর্ষ বল: আমরা স্কুলে বিজ্ঞানের ক্লাসে শিখেছি যে এই বলের প্রভাবে গোলকটির g= 9.8cm/s^2 নিম্নমুখী ত্বরণ হয়।
  • বায়ুর বাধাজনিত বল: এই ঊর্ধ্বমুখী বল গোলককে নীচে পড়তে বাধা দেয়। একটু খুঁটিয়ে দেখলে, এই বলের আবার দুটো অংশ আছে :
    • প্রথমত, গোলকটা কিছুটা বাতাসকে সরিয়ে দিয়ে জায়গা দখল করে বসেছে। আর্কিমিডিসের সূত্র অনুযায়ী, ঠিক যতটা বাতাস সরিয়েছে তার ওজনের সমান একটা উর্দ্ধমুখী বল গোলকটার ওপর কাজ করে। এই বলের নাম প্লবতা (buoyant force) এবং  গোলকটি পড়ার সাথে সাথে এর মান পাল্টায় না।
    • দ্বিতীয়ত, চলন্ত গোলকের উপরিতলের সাথে বায়ুর ঘর্ষণবল-ও পতনের বিরোধিতা করে। একে আমরা পিছুটান (drag force) বলতে পারি। এই বল কিন্তু গোলকটি পড়ার সাথে সাথে পাল্টায়। গোলকটি স্থির থাকলে এই বলের পরিমাণ শূন্য। গোলকের গতি যত বাড়তে থাকে এই পিছুটান-ও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।

এই দু’রকম ঊর্ধ্বমুখী বলের প্রভাবে গোলকটির ত্বরণের নাম দেওয়া যায় যথাক্রমে a_{buoyant} এবং a_{drag}. আমাদের মূল প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে অভিকর্ষ ত্বরণ g-এর সাথে a_{buoyant} এবং a_{drag}-কে তুলনা করতে হবে। এই তুলনা করার সবচেয়ে সোজা উপায় হলো \frac{a_{buoyant}}{g} এবং \frac{a_{drag}}{g} এই অনুপাত দুটো গণনা করা। এই অনুপাত দুটোকে যদি গোলকের কিছু বৈশিষ্ট্যের (যেমন তার ব্যাসার্ধ R বা উপাদানের ঘনত্ব \rho_{ball}) মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়, তাহলে গোলক দেখেই বলে দেওয়া যাবে এই অনুপাতগুলো খুব ছোট না বড়।  অর্থাৎ, বায়ুর বাধাকে ধর্তব্যে আনা উচিত কি না। এই গণনাটাই আমরা এবার করবো।

বাধা নাম্বার ওয়ান : প্লবতা

আর্কিমিডিসের সূত্র অনুযায়ী এই বল উপরের দিকে কাজ করে, অর্থাৎ গোলককে নিচে পড়তে বাধা দেয়। বাতাসের ঘনত্ব যদি \rho_{air} হয় তাহলে উর্ধমুখী প্লবতা বলের পরিমাণ

F_{buoyant} = \rho_{air}Vg,

যেখানে V = \frac{4}{3}\pi r^3 হলো গোলকটির আয়তন।

গোলকটির উপাদানের ঘনত্ব যদি \rho_{ball} হয় তাহলে তার ভর M_{ball} = \rho_{air}Vg। নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র প্রয়োগ করে গোলকটির প্লবতাজনিত উর্ধমুখী ত্বরণের মান পাওয়া যায়:

a_{buoyant} = \frac{f_{buoyant}}{M_{ball}} = \frac{\rho_{air}Vg}{\rho_{ball}V} = \frac{\rho_{air}}{\rho_{ball}}g

\implies \frac{a_{buoyant}}{g} = \frac{\rho_{air}}{\rho_{ball}}

অর্থাৎ গোলকের উপাদানের (কাঠ বা লোহা) তুলনায় বাতাস যত গুণ হালকা, প্লবতাজনিত ত্বরণও অভিকর্ষজ ত্বরণের তুলনায় তত গুণ কম হবে! সমীকরণে \rho_{air}এবং \rho_{ball}-এর মান বসানোর আগেই নিশ্চই আন্দাজ করতে পারছ যে আমাদের পরীক্ষায় প্লবতা বলের প্রভাব  সম্ভবতঃ উপেক্ষণীয়।


নিজে করো: কাঠের ঘনত্বের মান ওপরের সমীকরণে বসিয়ে দেখো a_{buoyant, wood} ঠিক কত হয়। a_{buoyant, wood}-এর প্রভাবে আমাদের পরীক্ষার ফলে কোনো পরিমাপযোগ্য তারতম্য হবে কি ?


বাধা নাম্বার টু: পিছুটান

বায়ুগতিবিদ্যার (aerodynamics) গবেষকরা নির্ণয় করেছেন যে বস্তুপিণ্ডের গতি v যত বাড়ে, বাতাসের ঘর্ষণজনিত পিছুটান বলও তত বাড়তে থাকে এই সমীকরণ অনুযায়ী:

F_{drag} = \frac{1}{2}C_{D}\rho_{air}Av^2

যেখানে:

  •  A হলো গতি v-এর উল্লম্বতলে বস্তুপিণ্ডটির প্রস্থচ্ছেদ। অর্থাৎ, গোলকের ক্ষেত্রে A = \pi r^2.
  • C_{D} একটি রাশি যার মান বস্তুপিণ্ডের আকার, গতি, এবং বায়ুর সান্দ্রতা সহগের (coefficient of viscosity) ওপর নির্ভর করে। গোলকাকৃতি বস্তু এবং আমরা যে ধরণের গতি নিয়ে কাজ করছি তার জন্য এর মান মোটামুটিভাবে 0.1 থেকে 0.5 এর মধ্যে হয় [২]।

আমরা আগের প্লবতা নিয়ে আলোচনার সূত্র ধরে পিছুটান F_{drag}-এর জন্য গোলকের ত্বরণ a_{drag} = \frac{F_{drag}}{m_{ball}} গণনা করার চেষ্টা করবো, এবং বোঝার চেষ্টা করবো যে \rho_{drag}-এর প্রভাবে আমাদের পরীক্ষার ফলের পরিমাপযোগ্য তারতম্য হবে কিনা।

প্রথমেই লক্ষ্য করো যে প্লবতা এবং পিছুটানের একটা প্রধান পার্থক্য হলো যে একটা বিশেষ গোলকের জন্যে F_{buoyant} একটা ধ্রুবক, কিন্তু F_{drag} গোলকের গতির ওপর নির্ভর করে। যখন গোলকটি সবে ছেড়েছি তখন তার গতি প্রায় শূন্য, সুতরাং তার ওপর প্রযুক্ত পিছুটানও প্রায় শূন্য। গোলকটি যখন প্রায় মাটি স্পর্শ করছে, তখন তার ওপর পিছুটান সবথেকে বেশি।

এই ধরণের পরিবর্তনশীল বল নিয়ে গণনা করা বেশ কঠিন, তাই শুরুতে গণনা সহজতর করার জন্য আমরা F_{drag}-এর সর্বোচ্চ সীমা (যা একটি ধ্রুবক F_{drag.max}) নিয়ে কাজ করতে পারি। যদি এই সর্বোচ্চ সীমার প্রভাব-ও অভিকর্ষের তুলনায় উপক্ষেণীয় হয়, তাহলে আসল বলটার-ও তাই হবে। যদি না হয়, তখন সীমা-টীমা ভুলে আসল বলটা নিয়ে কাজ করতে হবে।

অঙ্কটা করে দেখা যাক। পিছুটানের সর্বোচ্চ সীমার জন্য ত্বরণের মান:

a_{drag} = \frac{F_{drag.max}}{m_{ball}} = \frac{\frac{1}{2}C_{D.max}\rho_{air}Av_{max}^2}{\rho_{ball}V}

সমীকরণের ডানপার্শ্বের রাশিগুলির  মান একে একে নির্ণয়  করা যাক:

  • আগেই  বলা হয়েছে আমরা যে ধরণের গতি নিয়ে কাজ করছি তার জন্য C_{D}-এর মান মোটামুটিভাবে  0.1 থেকে 0.5 এর মধ্যে হয় [২]। সুতরাং C_{D.max} = \frac{1}{2}.
  • গতি v-এর উল্লম্বতলে গোলকটির প্রস্থচ্ছেদ A = \pi R^2। গোলকটির আয়তন হলো  \frac{4}{3}\pi R^3
  • গোলকটি ফেলা হচ্ছে H উচ্চতা থেকে। বায়ুশূন্য স্থানে H উচ্চতা থেকে পতন ঘটলে গোলকটির সর্বোচ্চ গতি হতো:
    • v_{0}^2 - 0^2 = 2gH \implies v_{0} = \sqrt{2gH}
  • বায়ুর পিছুটান থাকলে সর্বোচ্চ গতি v_{0}-এর থেকে একটু কমই হবে। তাই গতির সর্বোচ্চ সীমা v_{max}-এর জায়গায় আমরা v_{0}-এর মানই ব্যবহার করতে পারি:
    • v_{max} = v_{0} = \sqrt{2gH}

এই মানগুলো বসিয়ে পাই:

\frac{a_{drag.max}}{g} = \frac{3}{8}\frac{H}{R}\frac{\rho_{air}}{\rho_{ball}}

এটা বেশ একটা সুন্দর সমীকরণ কারণ এর থেকে পিছুটানের প্রভাবের একটা পরিষ্কার ছবি পাওয়া যাচ্ছে। সামনের \frac{3}{4} গুণিতকটা ভুলে গেলে মোটামুটিভাবে বলা যায় যে মাটি স্পর্শ করার সময় পিছুটান ও অভিকর্ষের প্রভাব সমান করতে হলে গোলকটির উপাদান বায়ুর থেকে যতগুণ ভারী, গোলকটিকে নিজের ব্যাসার্ধের তুলনায় ঠিক ততগুণ উচ্চতা থেকে ফেলতে হবে ! (মোটামুটি বললাম কারণ এই গণনার মধ্যে কয়েকটা আসন্নায়ন ছিল।) আমাদের পরীক্ষায় কাঠ ও লোহার গোলক ব্যবহার করেছি আমরা। কাঠ লোহার থেকে অনেক হালকা, তাই প্রথমে কাঠের গোলকের জন্য \frac{a_{drag.max}}{g}বের করা যাক। গুগল সার্চ করে ঘনত্বের মান খুঁজলে দেখতে পাবে যে কাঠ মোটামুটিভাবে বাতাসের থেকে পাচঁশোগুণ ভারী। সুতরাং,

\frac{a_{drag.max.wood}}{g} = \frac{3}{8}\frac{1.5}{0.05}\frac{1}{500} \approx \frac{1}{40}

লোহা বায়ুর তুলনায় আরও অনেক ভারী (7300 গুণের কাছাকাছি)। সুতরাং লোহার ক্ষেত্রে পিছুটানের প্রভাব কাঠের থেকেও চোদ্দ-পনেরো গুণ কম হবে।


নিজে করো: a_{drag.max.wood} এবং a_{buoyant.wood} -এর অনুপাত কত? a.{drag.max.wood}-এর প্রভাবে আমাদের কল্পিত পরীক্ষার ফলে কোনো পরিমাপযোগ্য তারতম্য হবে কি ?


উত্তর

নিশ্চয় দেখলে যে উপরের দুটো “নিজে করো” প্রশ্নেরই উত্তর “না”। সুতরাং আমাদের পরীক্ষা বায়ুশূন্য স্থানে না করা হলেও এর ওপর বায়ুর প্রভাব উপেক্ষণীয় এবং দুটো গোলকই প্রায় একসাথে মাটি স্পর্শ করবে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে গ্যালিলিও যদি আরও অনেক উঁচু (H_{Galileo}) কোনো স্থান থেকে আরও অনেক বড়ো ব্যাসার্ধ (R_{Galileo}) ওয়ালা দুটো গোলক ফেলেও থাকেন, তাঁর ক্ষেত্রে \frac{H_{Galileo}}{R_{Galileo}}-এর মান আমাদের মতোই কিছু একটা ছিল।  যে কারণে ওঁর পরীক্ষাতেও বায়ুর বাধা হয়তো বিশেষ প্রভাব ফেলেনি।

(প্রচ্ছদের ছবির সূত্র)

[১] https://en.wikipedia.org/wiki/Galileo_Galilei#Falling_bodies

[২] https://www.grc.nasa.gov/www/k-12/airplane/dragsphere.html

The post গ্যালিলিও পিসা শহরের মাঝে ভ্যাকুয়াম পেলেন কোত্থেকে ? appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).


গামা রশ্মির চোখে জ্যোতির্ময় মহাবিশ্ব: কসমিক রে কারখানার হদিশ

$
0
0

১৯৬৭ সালের ২-রা জুলাই। সোভিয়েতের উপর নজরদারী চালানো আমেরিকান স্যাটেলাইটে হঠাৎ ধরা পড়ল সুদূর মহাবিশ্ব থেকে ধেয়ে আসা অতি শক্তিশালী গামা রশ্মি।এই কাকতালীয় আবিষ্কারের সাথে জন্ম নিল আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে দেখার এক নতুন চোখ- গামা রে অ্যাস্ট্রোনমি! কল্পনাতীত শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রে তৈরির কারখানা, যা লুকিয়ে ছিল পালসার, সুপারনোভার ধ্বংসাবশেষ সেই সাথে আরও এক্সট্রাগ্যালাকটিক নানা উৎসে, তার হদিশ পাওয়া শুরু হল। এই শক্তিশালী গামা রশ্মি কি আমাদের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে?


গামা-রে অ্যাস্ট্রোনমি হলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি অভূতপূর্ব সুন্দর এবং আকর্ষণীয় গবেষণার ক্ষেত্র। প্রতিনিয়ত আমাদের মাথার উপর অসংখ্য অতি শক্তিশালী চার্জ কণা (charged particles) বর্ষিত হচ্ছে। এই চার্জ কণাকে আমরা কসমিক-রে (cosmic ray) বা মহাজাগতিক রশ্মি বলে থাকি। কসমিক-রের  প্রায় ৯০% প্রোটন, ৯% হিলিয়াম এবং বাকিগুলো উচ্চ ভরযুক্ত পরমাণু।  কসমিক-রের গতিশক্তি বিপুল। এতটাই বেশী, যে এতো গতিশক্তি কোনো পরমাণুকে দিতে পারে এমন গবেষণাগার বা কারখানা আমাদের পৃথিবীতে নেই।  অথচ প্রকৃতির কারখানায় অনবরত এই শক্তিশালী কসমিক রে তৈরি হয়ে চলেছে।

এখন স্বভাবতই আমাদের মনে এই প্রশ্ন আসে যে কীভাবে প্রকৃতির কারখানা এত শক্তিশালী কণা তৈরি করতে পারছে? গামা-রে অ্যাস্ট্রোনমি আমাদেরকে মহাবিশ্বের এই ধাঁধার সমাধান করতে সাহায্য করে। অ্যাস্ট্রোনমির অন্যান্য শাখার তুলনায় গামা-রে অ্যাস্ট্রোনমি অপেক্ষাকৃত অনেক নবীন। বিগত ১০ বছরে গামা-রে অ্যাস্ট্রোনমি এর স্বর্ণযুগে প্রবেশ করেছে। আজ আমরা এই নতুন অ্যাস্ট্রোনমির কথা জানব।

শক্তির মাপকাঠি

প্রথমেই বলি যে, পদার্থবিদ্যার অনেক বিভাগে শক্তির একক হিসেবে আমরা ইলেকট্রন ভোল্ট (eV) ব্যবহার করে থাকি (১ eV = ১.৬ x ১০১২ erg)। এই মহাজাগতিক রশ্মির বা কসমিক-রের গতিশক্তি ১০২০ eV (অর্থাৎ, ১ এক পর কুড়িটা শূন্য) পর্যন্ত হতে পারে । এ যে কত বড় শক্তি তা আন্দাজ করা যায় এই উদাহরণ থেকে – এই শক্তি ঘন্টায় ৯০ কিলোমিটার বেগে যাচ্ছে এমন একটা ৫০ গ্রাম টেনিস বলের গতিশক্তির সমান। কিন্তু, এই টেনিস বলের মধ্যে সঞ্চিত শক্তি ১০২৪গুলি পারমাণবিক কণার মধ্যে ভাগ হয়ে আছে।  সুতরাং, টেনিস বলের এক একটি কণার মধ্যে যে শক্তি থাকে তার পরিমাণ ১ ইলেকট্রন ভোল্টেরও কম হয়।

অন্যদিকে কসমিক-রের  ক্ষেত্রে এই পরিমাণ শক্তি, অর্থাৎ ১০২০ eV শক্তি, মাত্র একটি কণার মধ্যেই  সঞ্চিত থাকে! এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, কি অসীম পরিমাণ শক্তি এই কসমিক-রে ধারণ করতে পারে।  আজ পর্যন্ত আমরা পৃথিবীতে ২০ বছর ধরে ফ্রান্স আর সুজারল্যান্ড সীমান্তে অবস্থিত সার্ন গবেষণাগারে যে গতিশক্তি বাড়ানোর যন্ত্র (accelerator) “লার্জ হাড্র্ন কোলাইডার  (LHC)” বানিয়েছি, তাতে সর্বোচ্চ প্রায় ১৩ TeV-এর প্রোটন কণা বানাতে পেরেছি। (টেরাইলেকট্রন ভোল্ট; ১ TeV = ১০১২ eV = ১০ keV (কিলো ইলেকট্রন ভোল্ট) =  ১০ MeV (মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট) = ১০ GeV (গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট)।) কসমিক-রের শক্তি এর প্রায় কোটিগুণ বেশি। বিভিন্ন ধরণের শক্তি সম্বন্ধে ধারণা তৈরির জন্য আলোর বর্ণালী, তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং তাদের উৎসের সাথে শক্তির একটা রেখাচিত্র চিত্র ১-এ দেওয়া হল।

মহাজাগতিক রশ্মি আবিষ্কারের ইতিহাস

এবার একটু ইতিহাসের পাতা ওল্টানো যাক।  ১৯১২ সালে এই মহাজাগতিক রশ্মি অর্থাৎ কসমিক-রের আবিষ্কার করেছিলেন এক অস্ট্রিয়ান গবেষক, ভিক্টর হেস্ (Victor Hess)।  তিনি গ্যাস বেলুনে চড়ে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে উঠে এক ধরনের বিকিরণ মাপতে থাকেন। এই বিকিরণকে আমরা আয়োনাইজেশন রেডিয়েশন বলে থাকি এবং এই আয়োনাইজেশন মাপার জন্য আমরা electroscope ব্যবহার করে থাকি। প্রাথমিক ভাবে এটা অনুমান করা হয়েছিল যে, এই  আয়োনাইজেশন রেডিয়েশনের জন্য মূলত আমাদের ভূপৃষ্ঠ থেকে আসা চার্জ কণা বা তেজস্ক্রিয় রশ্মি দায়ী। এবং এর ফলস্বরূপ, ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে গেলে এর প্রভাব ক্রমশ কমতে থাকবে। ভিক্টর হেস্ এই প্রচলিত ধ্যান-ধারণা কে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেখলেন যে বেলুনে করে যত উপরের দিকে যাচ্ছিলেন ততো আয়োনাইজেশন রেডিয়েশন-এর প্রভাব বাড়তে থাকছিল। এই রেডিয়েশন যদি পৃথিবী সমতল পৃষ্ঠ থেকে নির্গত উচ্চ ক্ষমতাশক্তি সম্পন্ন চার্জ কণা বা তেজস্ক্রিয় রশ্মির জন্য সৃষ্টি হতো তবে উচ্চতার সাথে সাথেই এই বিকিরণ এর প্রভাব ক্রমশ কমতে থাকত।  অথচ ভিক্টর হেস্ দেখলেন যে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো হচ্ছে।

এই অভূতপূর্ব পর্যবেক্ষণ থেকে ভিক্টর হেস্ এই সিদ্ধান্তে পৌছেলেন যে, এই আয়োনাইজেশন রেডিয়েশন সৃষ্টিকারী চার্জ কণা ভূপৃষ্ঠ থেকে আসছে না, বরং তা আসছে মহাশূন্য থেকে এবং সেই জন্যই এই বিকিরণের প্রভাব উচ্চতার সাথে সাথে বাড়তে থাকছে। এই চার্জ কণাগুলোকেই পরবর্তীকালে কসমিক-রে বলা হয়ে থাকে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য প্রফেসর হেস্ কে ১৯৩৬ সালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় [২, ৩ , ৪ ]।

আমাদের এই বহুদূর বিস্তৃত মহাশূন্যে অসংখ্য কসমিক-রের কারখানা আছে, যেখানে প্রচণ্ড উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ধনাত্মক ও ঋণাত্মক কণা প্রতিনিয়ত তরান্বিত (accelerated) হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই কারখানাগুলো আসলে কি ? এদের উৎপত্তিস্থলই বা কোথায়? আমরা কিভাবেই বা খুঁজে পাব এই কারখানাগুলিকে?

আমরা পদার্থবিদ্যার খুব সাধারণ একটা জ্ঞান থেকে জানি যে চার্জড কণার গতিপথ চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বেঁকে যায়। চার্জড মহাজাগতিক রশ্মিগুলোর গতিপথও ইন্টার গ্যালাক্টিক ও ইন্টারস্টিলার চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বেঁকে যায়। তাই, তারা যখন পৃথিবীর সীমানায় পৌঁছায়, তখন ঠিক কোথা থেকে এসেছে তা বোঝার উপায় থাকে না। তাই, এই কসমিক-রের উৎপত্তিস্থল সম্বন্ধে কোন সুস্পষ্ট ধারণা পাই না। এখানেই আরেকধরণের তরঙ্গ, অর্থাৎ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক গামা-রে তরঙ্গের অপরিসীম গুরুত্ব। এই গামা রে  আমাদেরকে সেইসব মহাজাগতিক কারখানার সন্ধান অতি সহজেই দিতে পারে।

কিন্তু, এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের সাথে এই কসমিক -রের সম্পর্ক কি?

মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রে আর গামা রশ্মির সম্পর্ক খুব গভীর! মহাজাগতিক রশ্মি তার জন্মের পর আশেপাশের চৌম্বক ক্ষেত্র বা তুলনামূলকভাবে কম শক্তির তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের সাথে আন্তঃক্রিয়া (interact) করে উচ্চ শক্তির গামা রশ্মি বিকিরণ করে। কসমিক রে-র শক্তি যত বেশি হয়, গামা রশ্মির শক্তিও তত বেশি হয়।                       

গামা-রে অ্যাস্ট্রোনমির জন্ম

গামা-রে জ্যোতির্বিজ্ঞানের শুরু ভীষণ অযাচিত ভাবে হয়।  ১৯৬৩ সালে আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বায়ুমণ্ডল বা জলাশয়ে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আমেরিকা সন্দেহ করেছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন গোপনে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারে। তাই আমেরিকাও গোপনে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর উপর নজর রাখছিলো। এই নজরদারির অঙ্গ হিসেবে আমেরিকা বেশ কয়েকটি স্যাটেলাইট মহাকাশে  পাঠায় যারা “ভেলা” (Vela) নামে পরিচিত। এই স্যটেলাইটগুলোর মধ্যে দুটিতে  গামা-রে  ডিটেক্টর বসানো ছিল।  উদ্দেশ্য ছিল  যে পৃথিবীতে কোনো পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললে  পারমাণবিক অস্ত্রে ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে নির্গত গামা-রে অতিসহজেই এই  ডিটেক্টরে ধরা পড়ে যাবে।  ১৯৬৭  সালের ২রা জুলাই অতি শক্তিশালী গামা-রের একটি সিগনাল্  ধরা পড়ে এই স্যাটেলাইটে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যে, বিজ্ঞানীরা দেখলেন এই গামা বিকিরণ ভূপৃষ্ঠ থেকে আসে নি, বরং এর উৎপত্তিস্থল মহাজাগতিক [৫ ,৬ ]।

এই মহাজাগতিক গামা-রের আবিষ্কারেই জন্ম হয়,  গামা-রে অ্যাস্ট্রোনমির।

গামা-রে নির্ণায়ক পদ্ধতি

গামা-রের শক্তির অনেক রকমফের হতে পারে। তাই একটা কোন ডিটেক্টর যথেষ্ট না গামা রে-র উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য। এর জন্য লাগে বিভিন্ন ধরনের ডিটেক্টর।  ডিটেক্টর মানে যে যন্ত্রের উপর গামা রে পড়লে সিগন্যাল বেরোয়।  আমরা কম শক্তিশালী গামা-রে (২০ মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট থেকে ১০০ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট) সনাক্ত করতে স্যাটেলাইট এর সাহায্য নিয়ে থাকি। আর বেশি শক্তি সম্পন্ন গামা-রে কে সনাক্ত করতে আমরা ভূপৃষ্ঠের  ডিটেক্টর এর সাহায্য নিয়ে থাকি। এখন স্বভাবতই আমরা প্রশ্ন করতে পারি কেন কম শক্তির গামা-রে ভূপৃষ্ঠ থেকে সনাক্ত করা যায় না? এর উত্তর আমরা এই অনুচ্ছেদ-এর শেষে পাব।

গামা-রে স্যাটেলাইট ডিটেক্টর এর মধ্যে আন্তঃক্রিয়া (interaction) করে  ইলেকট্রন এবং পজিট্রন তৈরি করে। এই ইলেকট্রন-পজিট্রন মানিকজোড় ডিকেক্টরের একটা অংশ, যাকে পার্টিকেল ট্র্যাকার বলে, তারা এর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় নিজেদের গতিপথের নিদর্শন রেখে যায় (চিত্র ২)। সেই নিদর্শন থেকেই আমরা বুঝতে পারি কোন দিক থেকে গামা-রে আসছে। বর্তমানে স্যাটেলাইট-ভিত্তিক গামা-রে ডিটেক্টর এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নাসা-র “ফারমি লার্জ এরিয়া টেলিস্কোপ (Fermi-LAT)” (চিত্র ২)।

২০০৮ সালে এই ডিটেক্টরকে উৎক্ষেপণ করা হয়। ১২ বছর ধরে এই স্যাটেলাইট ডিটেক্টর আমাদেরকে অসংখ্য গামা-রের উৎসের সন্ধান দিয়ে চলেছে [৭ ]।

অন্যদিকে ভূপৃষ্ঠের ডিটেক্টর দিয়ে একটা ভীষণ আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে গামা-রে কে পরোক্ষভাবে ডিটেক্ট করা হয়। এই পদ্ধতি বলার আগে একটা ছোটো ঘটনা বলে রাখি।

আমরা জানি যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে নির্গত গামা-রে খুব ক্ষতিকারক। এরা আমাদের শরীরে ক্যানসার তৈরি করতে সক্ষম। আবার তাদেরকে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে ব্যবহার করে, আমরা ক্যানসার কোষ বিনাশও করে থাকি। এই গামা-রের শক্তি (কিলোইলেকট্রন ভোল্ট থেকে মেগা ইলেকট্রন ভোল্টের ) মহাজাগতিক গামা-রের থেকে বহুগুণ কম। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই  মহাজাগতিক রশ্মি কি আমাদের শরীরে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে?

উত্তর হলো-“না”।   ক্যানসার সৃষ্টিকারী এত অতিশক্তিশালী গামা-রে থেকে আমাদেরকে  রক্ষা করে চলেছে আমাদের বায়ুমণ্ডল। গামা-রে যখন আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন তা বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত অণু/পরমাণুর  সাথে  আন্তঃক্রিয়া (interaction)  করে তৈরি করে ইলেকট্রন এবং পজিট্রন। এই উচ্চশক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রন এবং পজিট্রন থেকে আবার গামা-রে নির্গত হয়, যেগুলো পুনরায় ইলেকট্রন এবং পজিট্রনের জোড়া তৈরি করে। এই প্রক্রিয়া ততক্ষণ চলতে থাকে, যতক্ষণ না বায়ুমণ্ডলে তৈরি গামা-রের শক্তি এক জোড়া ইলেকট্রন এবং পজিট্রন তৈরি করার জন্য যে নূন্যতম শক্তি লাগে, তার থেকে কমে যায়। এই ভাবে বায়ুমণ্ডলে চার্জ কণা এবং আলোককণার একটি ঝর্ণা তৈরি হয়, যাকে আমরা বলি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শাওয়ার।

এই শাওয়ার যখন বায়ুমণ্ডলের নিচের দিকে নামতে থাকে তখন এই  চার্জ কণাগুলো বায়ুমণ্ডলকে উদ্দীপিত করে একধরনের নীল আলোর একটি বৃহৎ কোনাকার ক্ষেত্র তৈরি করে যেটা ভুপৃষ্ঠে ১৫০-২০০ মিটার বিস্তৃত হয়, যাকে আমরা চেরঙ্কভ লাইটপুল (Cherenkov lightpool) বলে থাকি (চিত্র ৩ ) । এই লাইটপুলের মধ্যে আমরা আমাদের টেলিস্কোপগুলোকে রেখে সেই নীল আলোকে ডিটেক্ট করি, তার মাধ্যমে আমরা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শাওয়ারের চিত্র পাই, যেটা পরোক্ষভাবে গামা-রের দিক নিদর্শন করতেও সাহায্য করে। এটা বলে রাখি যে, এই নীল আলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অন্যান্য নীল আলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের থেকে ভিন্ন। আর তার জন্যই একে ডিটেক্ট করে আমরা সহজেই গামা-রের  গতিপথকে সুনির্দিষ্ট করতে পারি। কম শক্তিসম্পন্ন গামা-রে থেকে আমাদের বায়ুমণ্ডলে তৈরি এই চেরেঙ্কভ আলোর পরিমাণ খুব কম হয় এবং তা অতি সহজেই বায়ুমণ্ডলেই শোষিত হয়ে যায়।তাই তাদেরকে ভূপৃষ্ঠে ডিটেক্ট করা কঠিন হয়ে যায়।

আমাদের বিশ্বে ভূপৃষ্ঠ-ভিত্তিক অনেক গুলো গামা-রে টেলিস্কোপ আছে। তাদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য হল ম্যাজিক (MAGIC: Major Atmospheric Gamma Imaging Cherenkov) টেলিস্কোপ (চিত্র ৪)। এই  টেলিস্কোপ স্পেন এর ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের লা-পালমা দ্বীপে অবস্থিত।এই টেলিস্কোপ অসংখ্য গামা-রের উৎস আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে[৮]।

গামা-রের উৎসের ভিন্ন ভিন্ন রূপ

বিগত ১০-১৫ বছরে এই গামা-রে টেলিস্কোপ দিয়ে আমরা  অসংখ্য ভিন্ন জাতীয় গামা-রের উৎসের আবিষ্কার করেছি। গ্যালাক্টিক এবং এক্সট্রা  গ্যালাক্টিক উভয় ক্ষেত্রেই আমরা এর সন্ধান পেয়েছি। আমাদের সৌরমণ্ডল যে ছায়াপথ বা গ্যালাক্সির অন্তর্গত তাকে আমরা মিল্কীওয়ে বলে থাকি এবং এই মিল্কীওয়ের অন্তুরভুক্ত উৎসগুলোকে আমরা গ্যালাক্টিক উৎস বলে থাকি। আর আমাদের মিল্কীওয়ের বাইরের উৎস গুলো হল এক্সট্রাগ্যালাক্টিক। গ্যালাক্টিক উৎসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সুপারনোভা রেমন্যান্ট। এছাড়া রয়েছে পালসার, পালসার উইন্ড নেবুলা, স্টার ক্লাস্টার, বাইনারী সিস্টেম। আমাদের মিল্কীওয়ের বাইরে অর্থাৎ এক্সট্রাগ্যালাক্টিক  উৎসের  মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অ্যাক্টিভ গ্যালাক্টিক নিউক্লিয়াই যার নিউক্লিয়াসটা হলো একটা ব্ল্যাকহোল। এছাড়া রয়েছে স্টার বার্স্ট গালাক্স্যী যেখানে নতুন নতুন তারা-র জন্ম হয়ে চলেছে। ৫ নম্বর চিত্রে এই উৎস গুলোর প্রতীকি চিত্র দেখানো হয়েছে।

এরা সবাই কম বেশি মহাজাগতিক রশ্মির কারখানা। তবে প্রতিটি উৎসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন। এই সব উৎস থেকে গামা-রের সনাক্তকরণ এবং তার যথোপযুক্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা এই মহাজাগতিক রশ্মির কারখানাগুলোর সম্বন্ধে বিশদে জানতে পারি। এই আবিষ্কার গুলোর মাধ্যমে আমরা শুধু এই উৎসগুলোর সম্বন্ধেই জানতে পারি না, পদার্থবিদ্যার অনেক মৌলিক গবেষণাও এর মাধ্যমে করে থাকি।

আমরা পরবর্তী অংশে এই উৎসগুলোর সমন্ধে এবং যেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি তাদের বিস্তারিত বিবরণ দেব। উৎসাহী পাঠকেরা এই উৎসগুলো এবং অন্যান্য বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু সম্বন্ধে জানতে সূত্র [৯] এর সাহায্য নিতে পারে।

তথ্যসূত্র এবং আরো জানতে

[১] CTA টেলিস্কোপ নিয়ে জানতে: https://www.cta-observatory.org/

[২] https://www.nature.com/articles/483400a

[৩] https://timeline.web.cern.ch/victor-hess-discovers-cosmic-rays-0

[৪] বিজ্ঞ্যান এ প্রকাশিত প্রবন্ধ: https://bigyan.org.in/2014/04/13/victor-hess-and-cosmic-ray/

[৫] https://imagine.gsfc.nasa.gov/science/toolbox/gamma_ray_astronomy1.html

[৬] https://en.wikipedia.org/w/index.php?title=History_of_gamma-ray_burst_research&oldid=982740244

[৭] Fermi-LAT টেলিস্কোপ নিয়ে জানতে: https://fermi.gsfc.nasa.gov/

[৮] MAGIC টেলিস্কোপ নিয়ে জানতে: https://magic.mpp.mpg.de/

[৯] মহাজাগতিক উৎস সম্বন্ধে জানতে: https://imagine.gsfc.nasa.gov/science/objects/

[10] https://images.nasa.gov/

The post গামা রশ্মির চোখে জ্যোতির্ময় মহাবিশ্ব: কসমিক রে কারখানার হদিশ appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

মৌলিক সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্যতা

$
0
0

স্বাভাবিক সংখ্যাজগতের (natural numbers) এক অনন্য প্রজাতির বাসিন্দা হলো “মৌলিক সংখ্যা” (prime numbers)। যে সংখ্যাগুলো কেবলমাত্র ১ এবং সেই সংখ্যাটি দ্বারা বিভাজ্য, তাদের বলে “মৌলিক সংখ্যা”। আক্ষরিক অর্থে মৌলিক সংখ্যারাই সংখ্যাজগতের ভিত্তিপ্রস্তর কারণ তারা অন্যান্য স্বাভাবিক সংখ্যা গঠনের প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে  (অন্য সংখ্যাগুলোকে বলে “যৌগিক সংখ্যা”)। একেবারে গোড়ার দিকের মৌলিক সংখ্যাগুলো, অর্থাৎ ২, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩, ১৭, ১৯, ২৩, ২৯, ৩১, ৩৭, … ইত্যাদিদের দিকে যদি তাকাও, তাহলে দেখতে পাবে ২ ছাড়া সবকটি সংখ্যাই বিজোড় (odd numbers) এবং এদের বিন্যাসেরও কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম আপাতভাবে দেখা যায় না। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে এই মৌলিক সংখ্যাদের কি কোনো শেষ আছে ? এটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত যে মৌলিক সংখ্যার কোনো শেষ নেই। সুতরাং পরবর্তী  সমস্ত গবেষণার একটা মূখ্য কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হলো এরকম – তোমায় একটা বড় সংখ্যা দেওয়া হলো, যতটা বড় তুমি ভাবতে চাও, তুমি কি বলতে পারবে সংখ্যাটা মৌলিক নাকি  মৌলিক নয় ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমাদের আরেকটা  প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।  এই প্রশ্নটা হলো কোনো একটি সংখ্যার উৎপাদক নির্ণয়ের সমস্যা। আমরা এবার চেষ্টা করবো এই প্রশ্নটার উত্তর একটু বৃহত্তর প্রেক্ষিতে খোঁজার।


জানা কথা থেকে অজানার দিকে :

স্কুলের গন্ডির মধ্যে আমরা ইতিমধ্যেই প্রাথমিক কিছু মৌলিক সংখ্যা (যেমন – ২, ৩, ৫, ১১ , … ইত্যাদি) দ্বারা বিভাজ্যতার নিয়ম সম্পর্কে জেনেছি। যেমন ধরো –  কোনো সংখ্যা যদি “জোড়” (even numbers) হয়, তাহলে তা ২ দ্বারা বিভাজ্য। আবার কোনো একটি সংখ্যার অঙ্কগুলির বা রাশিগুলির (digits) সমষ্টি যদি ৩ দ্বারা বিভাজ্য হয়, তাহলে সংখ্যাটিও ৩ দ্বারা বিভাজ্য হবে। কোনো সংখ্যার এককের রাশিটি যদি ০ বা ৫ হয়, তাহলে সংখ্যাটিও ৫ দ্বারা বিভাজ্য। কোনো সংখ্যার একান্তর রাশিগুলির (alternating digits) সমষ্টির অন্তর যদি ০ বা ১১ দ্বারা বিভাজ্য হয়, তাহলে সংখ্যাটি ১১ দ্বারা বিভাজ্য হবে।

কিন্তু ৭, ১৩, ১৭, বা ১৯ … ইত্যাদি মৌলিক সংখ্যাগুলি দ্বারা বিভাজ্যতার নিয়ম সম্বন্ধে আমরা কি বলতে পারি ? এই সংখ্যাগুলি দ্বারা বিভাজ্যতার নিয়ম সম্পর্কে আলোকপাত করার জন্যই এই প্রবন্ধের অবতারণা। বৃহত্তর আঙ্গিকে আমাদের উদ্দেশ্য হলো এমন নিয়মের উল্লেখ করা যা শুধু এই কয়েকটি বিশেষ মৌলিক সংখ্যাই নয়, যেকোনো মৌলিক সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্যতার জন্য প্রযুক্ত হবে।

পুনশ্চ : আমাদের আসন্ন আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা ২ ও ৫ – এই দুটি মৌলিক সংখ্যাকে বাদ রাখবো। তার দুটি কারণ – প্রথমতঃ, ২ এবং ৫ দ্বারা বিভাজ্যতার নিয়ম সত্যিই সহজ ; এবং দ্বিতীয়তঃ, এই দুই মৌলিক সংখ্যা ব্যতিরেকে অন্য সকল মৌলিক সংখ্যা “p” এর জন্য \frac{1}{p} একটি “আবৃত্ত দশমিক” (recurring decimals) গঠন করে (যেখানে \frac{1}{2} = 0.5 এবং \frac{1}{5} = 0.2)।

চাবিসংখ্যার কারসাজি :

আমাদের আলোচনায় প্রতিটি মৌলিক সংখ্যার সঙ্গে একটি করে “চাবি সংখ্যা”কে জুড়ে দেওয়া যাক। এই চাবি-সংখ্যাগুলো ওই মৌলিক সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্যতার নিয়মের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে। ধরা যাক, একটা মৌলিক সংখ্যা “p” এর চাবি সংখ্যা খুঁজছি। “p” কে ১, ২, ৩… এইভাবে একেকটা সাধারণ সংখ্যা দিয়ে গুণ করা যাক। সর্বপ্রথম যেই গুণফলের এককের রাশিটা ৯ হবে, গুণফলের অবশিষ্ট রাশিগুলো নিয়ে তার সাথে “১” যোগ করা যাক। এতে যে সংখ্যাটি পাবো, তাকে আমরা p-এর “চাবি সংখ্যা” (key numbers) বলবো এবং “k” দিয়ে চিহ্নিত করবো। উদাহরণস্বরূপ “৭” একটি মৌলিক সংখ্যা। ৭ কে ৭, ১৭, ২৭, … ইত্যাদি সংখ্যাগুলো দিয়ে গুণ করলে গুণফলের এককের অঙ্ক বা রাশিটি হয় ৯। এর মধ্যে ক্ষুদ্রতম সংখ্যাটি হলো ৭। অর্থাৎ গুণফলটি হলো ৭ x ৭ = ৪৯, যার দশকের রাশিটি হলো ৪। সুতরাং ৭-এর চাবি সংখ্যাটি হলো ৪+১ = ৫। পরবর্তী আলোচনার সুবিধার্থে আমরা প্রাথমিক কিছু (২৩ পর্যন্ত) মৌলিক সংখ্যার চাবি সংখ্যাগুলিকে একটি তালিকাবদ্ধ করলাম।

১১১০
১৩
১৭১২
১৯
২৩

ধরা যাক “abcd” একটি চার অংকের সংখ্যা, যেখানে “d”, “c”, “b”, এবং “a” হলো যথাক্রমে “একক”, “দশক”, “শতক” এবং “সহস্র”-স্থানের অংক বা রাশি (digit)। এইবার আমরা যে গাণিতিক ফলাফলের উল্লেখ করবো তা হলো –

“কোনো একটি মৌলিক সংখ্যা “p” দ্বারা abcd বিভাজ্য হবে যদি

((dk+c)k + b)k +a  অর্থাৎ  dk^3 + ck^2 + bk + a রাশিটি “p” দ্বারা বিভাজ্য হয়, যেখানে k হলো p-এর চাবি সংখ্যা।”

নিজে করো :

চেষ্টা করে দেখো খাতায়-কলমে এই বক্তব্যটা প্রমাণ করার!!

একটা সহজ উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা জলের মতো সোজা হয়ে যাবে। ধরো – তুমি জানতে চাও “৪৬৬৯” সংখ্যাটি “৭” দ্বারা বিভাজ্য কিনা !! তার জন্য শুরুতেই আমাদের প্রয়োজন খুঁজে বের করা ৭ এর চাবি সংখ্যাটি। বেশি ছোটাছুটি না করে ওপরের তালিকায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই দেখতে পাবে ৭ এর চাবি সংখ্যাটি হলো ৫। সুতরাং – ৭ দ্বারা ৪৬৬৯-এর বিভাজ্যতার সমস্যাটির সমতুল্য সমস্যাটি হলো ৭ দ্বারা ৯x১২৫+৬x২৫+৬x৫+৪ = ১৩০৯-এর বিভাজ্যতা, এবং এখান থেকে সিদ্ধান্তে আসাই যায় যে ৪৬৬৯ সংখ্যাটি ৭ দ্বারা বিভাজ্য। এবার তোমরা বলতেই পারো, এটা করে লাভ কি ? দুটোই তো বিভাজ্যতার সমস্যা। ব্যাপারটা হলো ছোট মৌলিক সংখ্যার ক্ষেত্রে পার্থক্যটা বোঝা মুশকিল কিন্তু “p”-এর মান যত বাড়তে থাকবে, আমাদের এই নিয়মটার ভূমিকাও ততো গুরুত্ব পাবে।

নিজে করো :

ঠিক একইভাবে তোমরা চেষ্টা করে দেখতে পারো ১৩৪৯ সংখ্যাটি ১৯ দ্বারা বিভাজ্য কিনা !!

মডিউলার অপেক্ষক : আমাদের পরবর্তী আলোচনার সুবিধার্থে আমরা এবার “ভাগশেষ”-কে একটু ভদ্র চোখে দেখবো। কোনো একটি সংখ্যা “n” কে “p” দ্বারা ভাগ করলে ভাগশেষকে “Mod[n,p]” চিহ্নিত করবো, যা ঋণাত্মকও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ  – Mod [১৩,৭] যেমন “৬” হবে তেমনই “-১” ও হবে, কারণ ১৩ = ৭x১ + ৬ যেমন সত্যি, তেমনই ১৩ = ৭x২ – ১ ও সত্যি। আমাদের পরবর্তী আলোচনার সুবিধার্থে আমরা p = ৭, ১১, এবং ১৩ এই তিনটি মৌলিক সংখ্যার (যাদের চাবি সংখ্যা হলো যথাক্রমে k = ৫, ১০, এবং ৪) জন্য “n” এর বিভিন্ন অঋণাত্মক পূর্ণ সাংখ্যমানের জন্য “Mod [10^n,p]” এবং “Mod [k^n,p]” এর একটি তালিকা লিপিবদ্ধ করলাম।

n১০১১১২
Mod [10^n,7]
Mod [10^n,11]-১-১-১-১-১-১
Mod [10^n,13]১০১২১০১২
Mod [5^n,7]
Mod [4^n,13]১২১০১২১০

আগেও আমরা যেমনটা দেখেছি, তেমনই কল্পনা করি যে “abcdef” একটি ছয় অংকের সংখ্যা, যেখানে “f”, “e”, “d”, “c” ইত্যাদি হলো যথাক্রমে “একক”, “দশক”, “শতক”, “সহস্র”-স্থানের অংক বা রাশি (digit)। এইবার আগের ফলাফলটার অনুকরণে আমরা যে গাণিতিক ফলাফলের উল্লেখ করবো তা হলো –

“কোনো একটি মৌলিক সংখ্যা “p” দ্বারা abcdef বিভাজ্য হবে যদি Mod[fk^5 + ek^4 + dk^3 + ck^2 + bk +a, p] = 0 হয়, যেখানে k হলো p-এর চাবি সংখ্যা। ”

নিজে করো :

চেষ্টা করে দেখো খাতায়-কলমে এই বক্তব্যটা প্রমাণ করার!! একটু খেয়াল করে দেখলেই বুঝবে, যদি “p = 3” হয় সেক্ষেত্রে চাবি সংখ্যা হবে “k = 1”, অর্থাৎ abcdef সংখ্যাটি ৩ দ্বারা বিভাজ্য হবে তখনই যদি Mod [f+e+d+c+b+a, 3] = 0 হয়। সুতরাং সংখ্যাটি তখনি ৩ দ্বারা বিভাজ্য হবে, যখন তার অংকসমষ্টি ৩ দ্বারা বিভাজ্য হবে – যা তোমরা সকলেই স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছো। আবার যদি “p=11 এবং k = 10” হয়, সেক্ষেত্রে উপরের তালিকাকে কাজে লাগিয়ে আমরা বলতে পারি abcdef সংখ্যাটি ১১ দ্বারা বিভাজ্য হবে তখনই যদি Mod [-f+e-d+c-b+a,11] = 0 হয়, অর্থাৎ যদি, {(e+c+a)-(f+d+b)} রাশিটি ০ বা ১১ দ্বারা বিভাজ্য হয়। একটু খোলসা করে বলতে গেলে ব্যাপারটা কিছুটা এইরকম – আমাদের দেখা দরকার কখন

হবে। এবার খেয়াল করে দেখো, সেইক্ষেত্রে কোনো a' , b', c', d' , e' বা f' এর জন্য

Mod [a \times (11a' + Mod [100000,11]) + b \times (11b' + Mod [10000,11]) + \cdots + f \times (11f' + Mod [1,11]), 11] = 0

হতে হবে। অর্থাৎ

Mod [a \times (Mod [100000,11]) + b \times (Mod [10000,11]) + \cdots + f \times (Mod [1,11]),11]= 0

হতে হবে। যা Mod [-f+e-d+c-b+a,11] = 0 – এরই সমতুল্য। সুতরাং এই নিয়মটিও তোমাদের পূর্বলব্ধ জ্ঞানেরই একটি বৃহত্তর রূপ।

নিজে করো :

তোমরা চেষ্টা করে দেখো তো নির্ণয় করতে পারো কিনা abcdef এই ছয় অংকের সংখ্যাটি কোন কোন শর্তে ৭ এবং ১৩ এই দুটি মৌলিক সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য হবে ?

পরিশেষে দাঁড়িয়ে দুই গণিতজ্ঞের কথা বলতেই হয়, ফার্মা এবং অয়লার। যাঁদের অবিস্মরণীয় কীর্তি “ফার্মা’স লিটল থিওরেম” এবং “অয়লার্স থিওরেম” যা “মডুলার পাটিগণিত” এর দুই স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যেখান থেকে খুব সহজেই তোমরা দেখতে পাবে বিভিন্ন বড়ো বড়ো সংখ্যাকেও যেকোনো মৌলিক সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে সেই কঠিন কাজও কত সহজে করা যায়। তাই চোখ বুলিয়ে দেখতে পারো নিচের তথ্যসূত্রে।

প্রচ্ছদ : স্টিফেন শ্যানক্ল্যান্ড

তথ্যসূত্র: নিচে উইকিপিডিয়ার তিনটি পেজ এবংএকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করলাম। তোমরা যারা উৎসাহী, ওই জায়গাগুলোয় দেখার সাথে সাথে সেখানে উল্লিখিত অন্য বইও দেখতে পারো।

১) https://en.wikipedia.org/wiki/Fermat%27s_little_theorem ,

২) https://en.wikipedia.org/wiki/Euler%27s_theorem ,

৩) https://en.wikipedia.org/wiki/Modular_arithmetic ,

৪) ডেভিড এম. বার্টন এর লেখা “এলিমেন্টারি থিওরি অফ নাম্বারস” .

The post মৌলিক সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্যতা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

একই জিনিস বারবার মেপে লাভ কী?

$
0
0

“হাপরে চুল্লি জ্বেলে কী যে করে ভস্ম, সে এক রহস্য!”। গবুচন্দ্রের বিটকেল কার্যকলাপ দেখে হীরক রাজা ভাবেন এত সব কেন করছে – লাভ কী? গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীদের কত কিছু করতে হয় – তা শুনে আমাদের মাথায়ও একই প্রশ্ন আসে – লাভ কী? সোজা-সাপটা উদাহরণে এইসব কিছু ‘লাভ কী?’ প্রশ্নের উত্তর রইল এই সিরিজে!


আজকের প্রশ্ন

পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানীরা, মানে যাদের আমরা এক্সপেরিমেন্টালিস্ট বলি আর কী, তারা এক জিনিস হাজার বার মাপে কেন? একবারই তো ভালো করে, মন দিয়ে, মাপলেই হয়! একই জিনিস বার বার মেপে কাঁড়ি কাঁড়ি ডেটা দিয়ে হার্ড ড্রাইভ ভর্তি করে লাভ কী?

উত্তর

একই পরিমাপ বারবার নেওয়া অর্থাৎ পরিসংখ্যান বা statistics (স্ট্যাটিস্টিক্স) নেওয়ার পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে, একটি অন্যতম কারণ হল পরিমাপের ত্রুটি বা error (এরর) সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া। এরর মানে কিন্তু এই না, যে পরীক্ষাটা করতে গিয়ে আমরা ভুল করেছি! আমরা যা-ই মাপি, তার কিন্তু একটা না একটা এরর থাকে! কোন পরীক্ষামূলক রাশির এরর না জানলে আমাদের জানাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।  একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সোহম ক্লাসে পড়েছে যে একটা বস্তুর কতটা তল মেঝের সাথে লেগে আছে, তার উপর ঘর্ষণবল (friction) নির্ভর করে না। সে এটা যাচাই করতে একটা পরীক্ষা করবে ভাবলো। একটা  ইঁট নিল।

সোহম ভাবলো, ক্লাসে পড়া জিনিসটা যদি ঠিক হয়, তাহলে ইঁটটাকে ওই চওড়া তলের উপর রাখলেও যা ঘর্ষণ বল হবে, সরু কোনো তলের উপর রাখলেও তাই হবে। ও ইঁটের সাথে একটা স্প্রিং তুলা লাগিয়ে দিয়ে, তাই দিয়ে মাপলো কতটা জোরে টানলে ইঁটটা চলতে শুরু করছে। সেই বলটাই হবে সবথেকে বেশি সম্ভব ঘর্ষণবল। ইঁটটাকে যে তলের উপরই রাখা হোক না কেন, এই সর্বাধিক ঘর্ষণবলটা একই আসবে।

কিন্তু মেপে দেখে, ওমা, চওড়া তলের উপর রাখলে আসছে ২.৬ নিউটন। আর সরু তলে ২.০ নিউটন। তাহলে তো দুটো আলাদা! ক্লাসে কি তাহলে ভুল বলছে? না কী, মাপতে গিয়ে কোন ভুল হচ্ছে?

মুশকিল হলো, সোহম মেপেছিল একবারই। এই যে মাপগুলো সে পেল, তার এরর কী, তা জানে না সে। অর্থাৎ, ২.৬ নিউটনটা যে ২.৬ নিউটন-ই, সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চিন্তি নেই। হতেই পারে, বার কয়েক  মাপলে ও হয়তো দেখতো যে চওড়া তলে গড় মাপ ২.৬-এর নিচে আর সরু তলে পরিমাপ-টা ২.০-র উপরে।

কেন বারবার মাপলে আলাদা উত্তর পেতে পারে সোহম? অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন, ঠিক যে মুহূর্তে ইঁটটা চলতে শুরু করছে, সেই মুহূর্তে স্প্রিং তুলায় কত বল দেখাচ্ছে, তা দেখতে একটু এদিক ওদিক হতে পারে। কখনো হয়তো সে ইঁট চলতে শুরু করার এক মুহূর্ত আগে বলটা মাপছে, কখনো এক মুহূর্ত পরে। আবার হতেই পারে যে সোহম স্প্রিং তুলার স্কেলের কোন দাগের উপর কাঁটাটা আছে, তা দেখতে গিয়ে একটু ভুল করছে। একাধিকবার পরীক্ষা করার মাধ্যমে সোহম বুঝতে পারবে যে সে কতটা Precision বা সূক্ষ্মতার সাথে মাপতে পেরেছে। 

সোহম কীভাবে এরর কমাতে পারে যন্ত্রপাতি না পালটে? এখানেই অনেকবার মাপা, যাকে আমরা বলি অনেক ডেটা নেওয়া, তার সার্থকতা। যত বেশী ডেটা নেবে, তত তার precision বাড়তে থাকে। পরিসংখ্যানের অঙ্ক কষে মোটামুটিভাবে দেখানো যায় যে যদি একই রাশি K বার মাপা হয়, তাহলে গড় মানের এরর কমতে থাকে 1/sqrt(K-1) হিসাবে। যেমন, সোহম যদি চারবার পরীক্ষা করে এই সংখ্যাগুলো পেত মোটা তলের ক্ষেত্রে (নিউটন-এ বললে):

২.২, ২.৬, ২.৪, ২.৪ 

তাহলে, এই বলগুলোর গড় হত ২.৪ নিউটন। এরপর গড়ের চারিদিকে মানগুলোর বিস্তৃতি বা standard deviation মাপতে হতো এবং সেটাকে sqrt(K-1) বা ৩-এর বর্গমূল দিয়ে ভাগ করতে হতো (কেন, সেই ব্যাখ্যায় এখানে যাচ্ছি না)। এরর পাওয়া যেত ০.১ নিউটন। অর্থাৎ, বলটা আসলে ২.৪ ± ০.১ নিউটন।

আর সরু তলের ক্ষেত্রে যদি চারবার পরীক্ষা করে পেত (নিউটন-এ বললে):

২.০, ২.২, ২.০, ২.০

তাহলে গড় হতো ২.০ আর এরর হতো ০.১ নিউটন-এর কম। যেহেতু বলটাই মাপা যায় ০.১ নিউটন ধাপে, তাই ০.১ নিউটনকেই এক্ষেত্রে এরর ধরা যায়। অর্থাৎ, বলটা আসলে ২.০ ± ০.১ নিউটন।

এবার সে সিদ্ধান্তে আসতে পারত যে গড় ঘর্ষণ বল এই দুই তলের ক্ষেত্রে একই না আলাদা। প্রশ্ন আসবে, তাহলে কি একই জিনিস অনেক বার মেপে এরর প্রায় শূন্য করে দেওয়া যায়? উপরের অঙ্কটাতেই উত্তরটা আছে। সেটা হলো – সবসময় না। যেমন, সোহমের যন্ত্রের একটা ক্ষুদ্রতম ধাপ আছে, যার নিচে সে মাপতে পারে না। এই ক্ষুদ্রতম মাপকে যন্ত্রের রিসোলিউশন (resolution) বলে। হতে পারে, তার তুলা যন্ত্রের যে স্কেল তাতে ০.১ নিউটন অন্তর দাগ টানা আছে। হয়তো দুটো দাগের মধ্যে চোখের আন্দাজে বড়জোর ০.০৩ নিউটনের মত মাপা যায়। তাহলে, বারবার পরীক্ষা করে হিসেব করা এরর এই যন্ত্রের রেজোলিউশানের কাছাকাছি চলে এলে আর বেশী খেটে লাভ নেই!

The post একই জিনিস বারবার মেপে লাভ কী? appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

শব্দের তাপ – তাপের শব্দ পর্ব ১: বেন এ্যাণ্ড জেরীর ‘সবুজ’ রেফ্রিজারেটার

$
0
0

শব্দ দিয়ে কি কোন জিনিসকে ঠাণ্ডা করা যায়? মানে এই যেমন আইসক্রিম বা খাবার জিনিস! শুনতে অবাক লাগলেও এই ধরনের পরিবেশ বান্ধব “সবুজ” রেফ্রিজারেটর কিন্তু বানিয়ে ফেলেছেন এক দল গবেষক। শব্দ যখন কোন মাধ্যম দিয়ে যায় তৈরি হয় সংকোচন ও প্রসারণ। উচ্চচাপে সংকুচিত অংশ তাপ ছাড়ে আর নিম্নচাপে প্ররসারিত অংশ তাপ গ্রহণ করে। আর এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে শব্দকে কিভাবে চিরাচরিত শক্তি হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেই গল্প শোনাবে রূপক বর্ধন রায়।


“অনেক ঘুমিয়ে নিয়েছ, এবার চট পট উঠে পড় দেখি। হাতে বেশি সময় নেই।”, ঋভু বললো।

আগের সপ্তাহে রাত জেগে আলট্রাসাউণ্ড নিয়ে আড্ডাটা যে জায়গায় ছেড়েছিলাম, তাতে ব্যাটাছেলে যে শনিবার সকাল সকালই হামলা করবে এই ধারণাটা আমার মোটা মুটি ছিলই। মূলত যখন সামনের বুধবারই আমার রিটার্ন ফ্লাইট। তা বলে সাড়ে ছটা?

আমিঃ রিভু ৭ টাও বাজেনি। তুই পিসির কাছে আগে কফি টফি খা। ২ ঘন্টা আগে আমায় জ্বালাবি না।

ঋভুঃ তুমি যদি এক্ষু্নি না ওঠো আমি মশারীর মধ্যে ঢুকে তোমায় জ্বালাবো। আগের শনিবার যা তা করেছ। তার উপর বুধবার আবার বছর খানেকের জন্য হাওয়া। উঠে ছাদে চল কফি খেতে খেতে গল্পটা শেষ করবে, তারপর আমরা বেরোবো।

আর কি? অগত্যা উঠতেই হল! মুখ হাত ধুয়ে ফ্রীজ থেকে আধখান ঠান্ডা স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়েছি সবে, রিভু বলল

“ফ্লুরিজ যাবো। ৯ টায় বেরোনো । বেশি পেট ভরিয়ো না।”

আমিঃ বেশ। কি খাবি?

ঋভুঃ একটা কেক আর আইস্ক্রীম।

আমিঃ এই সাত সকালে আইস্ক্রীম?

ঋভুঃ আজ্ঞে।

আমিঃ খাবি পরে, আগে বল দেখি, শব্দ দিয়ে যে আইস্ক্রীম বাঁ খাবার ঠাণ্ডা রাখা যায়, এটা জানা আছে কি?

স্যান্ডুইচের বাকি আধখান ওকে দিয়েছিলাম। আমার কথাটা শুনে প্রায় মুখ থেকেই পড়ে যাচ্ছিল।

ঋভুঃ সকাল সকাল গুল মারছো তো?

আমিঃ মোটেই না! ছাদে চল, বলছি।

ঋভুঃ(আমার হাত ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে ছাদে এসে) চটপট বল। আগের দিনের মত মাঝ পথে থামলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবো বলে রাখলাম কিন্তু।

শব্দের তাপ – তাপের শব্দ

আমিঃ বেশ বেশ।      আজ তোকে খুব মজার দুটো তিনটে ব্যাপারে বলবো। সবগুলোই শব্দ, তাপ এবং তাদের যৌথ আদান প্রদান সংক্রান্ত।

ঋভুঃ আরিব্বাস। এই দুটোয় আবার যোগ আছে নাকি? দুটো তো দুই গ্রহের প্রাণী!

আমিঃ হু হু বাবা। ওরম মনে হয়। “থার্মোএ্যাকাউস্টিকস” কথাটার নাম শুনেছিস?

ঋভুঃ না তো

একটু থেমে…

বুঝেছি। “থার্মো” এসেছে থার্মাল থেকে, থার্মোমিটারের মত, তাইতো? আর আগের-বার তো বললেই আলট্রাসাউণ্ড বা এ্যাকাউস্টিক্সের কথা। আমিঃ সাবাস! ফাটিয়ে দিয়েছিস তো। একটু উল্টো ভেবেছিস, তবে কুছ পরোয়া নেহি! থার্মাল বা থার্মোমিটার এসেছে থার্ম থেকে। যাক এবার বোঝাতে সুবিধা হবে। কাজেই শব্দ থেকে তাপ আর তাপ থেকে শব্দের যৌথ রূপান্তরের বিজ্ঞানকে আমরা “থার্মোএ্যাকাউস্টিক্স” নাম দিয়েছি। তাপীয় প্রসারণ বা থার্মাল এক্সপ্যানশান তো জানিস, ওই যে ভাবে গরম কালে ট্রেনের লাইন বা ধাতুর তৈরী ব্রীজ আকারে বেড়ে যায়?

ছবি ১: তাপীয় প্রসারণ। তাপের সাথে সাথে জলের আয়তন বাড়ে। (fireball.ca)

ঋভুঃ হ্যা তা তো পড়েছি।

আমিঃ বেশ। তেমনই ঠান্ডা করলে যে কোনো পদার্থ আকারে ছোট হবে? তাইতো?

ঋভুঃ একদম!

আমিঃ বেশ, তবে বল দেখি, আমি যদি একটা পদার্থকে পর পর ক্রমাগত গরম-ঠাণ্ডা গরম-ঠাণ্ডা করি তবে সে পদার্থের কি হবে?

ঋভুঃ বাড়বে কমবে, বাড়বে কমবে…তাইতো?

আমিঃ এক্সেলেন্ট! আগের গল্পটা মনে কর। কৃত্রিম শব্দ কিভাবে তৈরী করা যায়?

ঋভুঃ ওইতো আগেরদিন বলেছিলে। আমার নাম মনে থাকে না। তড়িৎ-এর মাধ্যমে কৃত্রিম কম্পন সৃষ্টি করা হয়।

আমিঃ ঠিক, যন্ত্রটার নাম “আল্ট্রাসনিক ট্রান্সডিউসার”। ট্রান্সডিউসার একপ্রকারের শক্তিকে অন্য প্রকারের শক্তিতে রূপান্তরিত করে। আলট্রাসাউণ্ড ট্রান্সডিউসার হল তড়িৎ শক্তি এবং শব্দ শক্তি আদানপ্রদানের যন্ত্র।

ঋভুঃ হ্যা মনে পড়েছে। ট্রান্সডিউসার! কিন্তু এই ক্ষেত্রে তুমি যা বলছো তেমন কোনো যন্ত্র তো ব্যবহার হচ্ছে না, তাইতো? একটু বুঝিয়ে বলবে?

আমিঃ ঠিক। এও তো একরকমের কম্পনই হল নাকি? তাপ দিয়ে কম্পন। সেই কম্পন কত ফ্রিকোয়েন্সীর বা কম্পাঙ্ক-এর, তার উপর নির্ভর করছে শব্দের কম্পাঙ্ক ।

ঋভুঃ বুঝেছি। মানে তাপ কাজ করছে, তা দিয়ে পদার্থ আকারে বাড়ছে কমছে, তা থেকেই শব্দের উৎপত্তি যা কিনা আশে পাশে হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। আমিঃ ঠিক। প্রথমবার বাইরন হিগিন্স ওনার বিক্ষ্যাত “সিঙ্গিং ফ্লেম” এক্সপেরিমেন্টে (নীচের হাইপারলিংক-এ যে ভিডিওটা আছে তাতে এই সিংগিং ফ্লেমের সাহায্যেই থার্মোএ্যাকাউস্টিক ইঞ্জিন তৈরী করা হয়েছে, তাই আলাদা ভিডিওর প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়) থার্মোএ্যাকাউস্টিক্স প্রত্যক্ষ করেন। এরপর ১৮৫০এ, প্রফেসার সণ্ডহাস দেখান, একটি কাচের টিউবের(যার একদিকে তাপ প্রদান করা হচ্ছে) দৈর্ঘ এবং আয়তন কিভাবে শব্দের কম্পাঙ্ক ও তীব্রতা নির্ধারণ করে। এরপর  ধীরে ধীরে কার্চফ, গ্রাহাম বেল ও সামার টেইন্টারের (বেল ও টেন্টার দেখান আলো কিভাবে তাপ এবং তার থেকে শব্দ সৃষ্টি করে) হাত ধরে থার্মোএ্যাকাউস্টিক্সের নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ানো [১]।  যা বলতে চাইছি তা আরেকটু ভাল করে বুঝতে হলে এই ছবিটা খেয়াল কর ভাল করে। তারপর থার্মোএ্যাকাউস্টিক এঞ্জিনের এই ভিডিওটা দ্যাখ। (দরকার পড়তে পারে ভেবে ফোনটা নিয়েই এসেছিলাম)।

শব্দের সাহায্যে কিভাবে আইস ক্রীম ঠান্ডা করা হয়?

ঋভুঃ সবই তো বুঝলাম। কিন্তু এর ব্যবহার কোথায়?

আমিঃ এইযে বললাম, বেরিয়ে যে গাদা গুচ্ছের আইস্ক্রীম খাবি বলে ঠিক করেছিস, তোর আইস্ক্রীম থার্মএ্যাকাউস্টিকস দিয়েও ঠান্ডা করা যায়। আসলে সণ্ডহাস এক্সপেরিমেন্টের অপর দিকটা যদি ভাবিস, শব্দ চলাচলের জন্য তৈরী হওয়া -তার কম্পাংক ভীত্তিক- সংকোচন ও প্রসারণ তাপ বাড়াতে বা কমাতে পারে।

ঋভুঃ ফ্যাসিনেটিং। ঠাণ্ডা মাথায় গোটা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বল তো দেখি।

আমিঃ আসলে যে পদ্ধতিতে এই ঠাণ্ডা করার কাজটা করা হয় তার নাম থার্মোএ্যাকাউস্টিক রেফ্রিজারেশান [১-২]। বেন এ্যাণ্ড জেরী আইস্ক্রীম কোম্পানির জন্য পেনসিল্ভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ম্যাট পোএজ, ডঃ স্টিভেন গারেট এবং বব স্মিথের আবিষ্কার।

ঋভুঃ দূর। সে আবার কি? এইরকম দূম করে এক একটা নাম বললে বোঝা যায়? শুরু থেকেই বরং শুরু কর। কি, কেন, কিভাবে, সবকিছু!

আমিঃ বেশ শোন তবে।

যে কোনো উন্নত অথবা উন্নয়নশীল দেশেই খাদ্যশিল্প একটা অতি প্রয়োজনীয় শিল্প। কাজেই, তৈরী খাবার অথবা খাবার তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী শীতল বা অতিশীতল আবহাওয়ায় সুস্থ উপায়ে লম্বা সময়ের জন্য জমিয়ে রাখার প্রয়োজনীতা ঘীরেও গড়ে উঠেছে আরেক ধরণের বিরাট শিল্প, যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি “ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রেফ্রিজারেশান”। তুই যদি এই শিল্পের ইতিহাস নিয়ে খানিকটা ঘাটা ঘাটি করিস তাহলে দেখতে পাবি যে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল পর্যায়ে এই কাজের শুরু ১৯৩০ সালে “ভেপার কম্প্রেশান রেফ্রিজারেশান” অথবা বাংলায় বললে “সংকুচিত বাষ্পের দ্বারা হিমায়ন”এর হাত ধরে। এইবার তোকে আমি যেটুকু চিনি তাতে তোর মনে প্রশ্ন এসেছে যে সেটা কিভাবে হয়, তাই তো?

ঋভুঃ সে আর বলতে। আমিঃ বেশ, এই ছবিটা দ্যাখ।

ছবি ২: একটি “ভেপার কম্প্রেশান সিস্টেম” (researchgate.com)

আসলে “ভেপার কম্প্রেশান রেফ্রিজারেটর” এমন এক যন্ত্র যেখানে একটি তরল পদার্থের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট জায়গার তাপ শোষণ করে  আরেকটা জায়গায় সেই তাপকে বের করা হয়ে থাকে। সেই তরলকে পদার্থবিজ্ঞানে “রেফ্রিজারেন্ট” বলা হয় অর্থাৎ কিনা যে পদার্থ হিমায়নের কাজটা করছে।

ঋভুঃ বাহ! এতো দারুণ কারসাজি!

আমিঃ তা তো বটেই। এত কারসাজি করতে হচ্ছে, তার কারণ রেফ্রিজারেন্ট-কে লাগাতার ঠান্ডা রাখতে হবে। না হলে আইসক্রীম ঠান্ডা থাকবে কী করে? তাই, রেফ্রিজারেন্টকে একটা চক্রের মধ্যে ঘোরানো হচ্ছে – আইসক্রীম ঠান্ডা করতে গিয়ে সে নিজে গরম হয়ে যাচ্ছে, আবার এই চক্রের অন্য একটা জায়গায় গিয়ে সেই তাপ ছেড়ে দিচ্ছে।

আরো খানিকটা বিস্তারিত ভাবে বুঝতে হলে ছবিটার ব্লকগুলোকে খেয়াল কর। এই ধরণের যন্ত্রে সাধারণত চারটি অংশ থাকে।

  1. কম্প্রেসার (সংক্ষেপক যন্ত্র)
  2. কণ্ডেনসার (বাষ্পকে ঠাণ্ডা করে তরলে রুপান্তর করার যন্ত্র)
  3. এক্সপানশান বা প্রসারন ভালভ; আর সব শেষে
  4. ইভাপোরেটার (বা বাষ্পীভূত করার যন্ত্র)

ওই যে তোকে বললাম রেফ্রিজারেন্ট তরলের কথা, সেই তরল পদার্থ আসলে এই চারটি খণ্ডের মধ্যেই চক্রাকারে আবর্তিত হয়, এবং এক একটি অংশের মধ্যে একবার বাষ্প এবং একবার তরলে রুপান্তরিত হয়।

ঋভুঃ বেশ। এরপর?

আমিঃ ধর প্রথমে বাষ্পীভূত তরলকে আমরা কম্প্রেসারে ঢোকালাম।  বাষ্পের যে অবস্থায় এই কাজটা করা হয় তাকে আমরা বলি “স্যাচুরেটেড ভেপার”। স্যাচুরেটেড ভেপার হল বাষ্পের এমন অবস্থা যেখানে তার তাপ ধারণের ক্ষমতা অত্যন্ত অল্প, কিন্তু এতটাও কম নয় যে সে তরলে রুপান্তরিত হবে। কম্প্রেসারের মধ্যে সেই বাষ্পের সংকোচন হয় এবং তার সাথে সাথে তার তাপমাত্রার বৃদ্ধি হয়। এই অবস্থার বাষ্পের নাম সুপার-হিটেড বা অতি উত্তপ্ত বাষ্প। এই অবস্থার বাষ্পের চাপ এবং তাপমাত্রা এমনই থাকে যে, জল অথবা ঠাণ্ডা হাওয়ার সংস্পর্শে আসলেই সে তার তাপ সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করে এবং তরলে রুপান্তরিত হয়। এই কাজটাই করে “কনডেনসার” এবং যে তাপ বেরিয়ে এলো তা ওই ঠাণ্ডা জল বা হাওয়া (যা ঠান্ডা করছে) কণ্ডেনসারের বাইরে বয়ে নিয়ে যায়। এই যে তরলটি তৈরী হল এর নাম “স্যাচুরেটেড লিকুইড”।

ঋভুঃ বুঝেছি। অর্থাৎ ওই স্যাচুরেটেড ভেপারের ঠিক উল্টোটা, তাইতো? এমন অবস্থার তরল যার তাপ ধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি কিন্তু সে নিজে বাষ্পীভূত হচ্ছে না!

আমিঃ স্প্লেণ্ডিড মাই বয়!

ঋভুঃ (বেশ উত্তেজিত) তারপর বল বল!

আমিঃ আচ্ছা, এরপর এই তরলকে আমরা প্রসারণ ভালভের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাই এবং সেখানে তার চাপ এক ঝটকায় অনেকখানি কমিয়ে আনা হয়। এর ফলে অবশ্য খানিকটা তরল বাষ্পীভূত হয়। যেহেতু একটা নির্দিষ্ট চাপে এই বাষ্পীকরণের কাজটা হচ্ছেতাই সেই বাষ্প-তরল মিশ্রণের তাপমাত্রার বেশ খানিকটা কমে যায়। এই তাপমাত্রা সাধারণত যে চেম্বারে খাবার বা আইস্ক্রিম ঠাণ্ডা হবে তার থেকে অনেকটাই কম।

ঋভুঃ অবশ্যই! এতো বোঝাই যাচ্ছে। না হলে আর চেম্বার ঠণ্ডা হবে কিভাবে?

আমিঃ রাইট! এবার আমরা এই মিশ্রনকে নিয়ে গিয়ে ফেলি আমাদের সর্বশেষ কক্ষে যার নাম ইভাপোরেটার। একটি ইলেকট্রিক পাখা বা ফ্যানের সাহায্যে বাইরে থেকে এই কক্ষটিতে গরম হাওয়া প্রদান করা হয়। ফলে সে মিশ্রনে যে অতি-শীতল তরল রয়েছে তা তৎক্ষণাৎ অতি-ঠান্ডা বাষ্পে      রূপান্তরিত হয়। সেই বাষ্পই      আসলে খাবার ভরতি ঘরের      নিজস্ব হাওয়া কে ঠাণ্ডা করে এবং তোর আইস্ক্রিমকেও ঠাণ্ডা রাখে।

ঋভুঃ ওহ দারুণ। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

আমিঃ বলে ফেল।

ঋভুঃ এই ঠাণ্ডা বাষ্পের তাহলে কি হবে? একেই কি আবার কম্প্রেসারে পাঠানো হবে?

আমিঃ হ্যা একেবারেই তাই। এটাই সেই রেফ্রিজারেন্টের তাপ চক্র। আরেকটা মজার ব্যাপার, আজকাল দেখিস ফ্রিজে লেখা থাকে “অটো ডিফ্রস্ট”?

ঋভুঃ হ্যা সে তো থাকেই। সেটা কি?

আমিঃ এই যে ইভাপোরেটারের সাথে চেম্বারের যোগ, তার যোগ তো আবার বাইরের স্বাভাবিক বাতাসের সাথে, যাকে আমরা বলি এ্যাম্বিয়েন্ট কণ্ডিশান বা চারিপার্শ্বিক অবস্থা। এই আবহাওয়ায় থাকা আর্দ্রতার কারণে বেশ কিছু সময় পর ইভাপোরেটারে জল অথবা বরফ জমে যেতে পারে। সেই বরফ বা ঠাণ্ডা জলকে পরিষ্কার করার পদ্ধতিই হল ডি-ফ্রস্টিং। পুরনো ধরণের ফ্রিজ বা সাধারণ      ফ্রিজে সেই কাজ নিজে হাতে করতে হয়। আর হালফিলের এ্যাডভানসড ফ্রিজে সেই কাজটা ফ্রিজ নিজেই একটা পাম্পের সাহায্যে করে নেয়। সেই কাজটই হল অটো- ডিফ্রস্টিং!

ঋভুঃ বাহ! কিন্তু এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যে এই পদ্ধতিতে কাজ হলে তোমার থার্মোএ্যাকাউস্টিক্সের দরকারটা পড়ছে কেন?

আমিঃ গুড কয়েশ্চেন!

দ্যাখ। ব্যাপারটা হল, ১৯৩০ সালের সময় থেকেই ঐতিহাসিকভাবে রেফ্রিজারেন্ট হিসাবে বিভিন্ন ধরণের রাসায়ণিক তরল ব্যবহৃত হয়ে আসছে [3,4]। এবার সমস্যা হল এই ধরণের কেমিকাল যেমন ক্লোরোফ্লুরো কার্বন (সি এফ সি) বা হাইড্রো ক্লোরো ফ্লুরো কার্বন (এইচ সি এফ সি)- ব্যবহার করল,  বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে যে বিষাক্ত গ্যাসগুলির সৃষ্টি হয় তা যেমন আমাদের স্বাস্থের জন্য খারাপ তার সাথে সাথে ভয়ংকর পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। যেমন ধর সি এফ সি আমাদের বায়ুমণ্ডলের উর্ধতন ওজোন স্তরের দারুণ ক্ষতি করে।

এই ধরণের বেশ কিছু অসুবিধার হাত থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে বেন এ্যাণ্ড জেরী কোম্পানি তাদের তৈরী আইসক্রীম ঠান্ডা করার জন্য এক অন্য ধরণের রেফ্রিজারেটার আবিষ্কার করার দায়িত্ব দেন ম্যাট পোএজের গ্রুপকে। এই গবেষণারই ফল থার্মোএ্যাকাউস্টিক রেফ্রিজারেটার এবং আমাদের বায়ুমণ্ডল আর আবহাওয়ার কথা ভেবে আবিষ্কৃত বলে তার নাম দেওয়া হয় “গ্রীন ফ্রিজার”।

ঋভুঃ আচ্ছা। এইবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।

আমিঃ তবে আর কি? চল আপাতত তোর ফ্লুরিজে খানিক আইস্ক্রিম সাবড়ে আসি। সেখানে গিয়েই বাকিটা হোক নাকি?

ঋভুঃ মোটেই না! অন্তত বেন এ্যাণ্ড জেরী শেষ কর। তারপর যাবো। ওখানে গিয়ে বরং মেডিকাল এ্যাপ্লিকেশানের ব্যাপারটা হবে। আমিঃ যো হুকুম জাহাঁপনা!

ছবি ৩: একটি থার্মোএ্যাকাউস্টিক রেফ্রিজারেশান ব্যাবস্থা (researchgate)

এই ছবিটা ভালো করে দেখলেই বুঝতে পারবি এই রেফ্রীজারেটর কীভাবে কাজ করছে। বাদিকে যেখানে Driver কথাটা লেখা আছে, সেটা হল একটা লাউডস্পিকার বা ট্রান্সডিউসার। এখান থেকে শব্দ তৈরি করা হচ্ছে। টিউবে রয়েছে অদাহ্য একটি গ্যাসের মিশ্রন (হিলিয়াম, আরগন, বায়ু ইত্যাদি)। লাউডস্পিকার থেকে তৈরী হওয়া শব্দ টিউবের মধ্যে ঢুকে গ্যাসটির সম্প্রসারণ ও প্রসারণের মাধ্যমে বা তার চাপ বাড়িয়ে-কমিয়ে বামদিক থেকে ডানদিকে ছুটে যাচ্ছে। তারপর সেই শব্দ টিউবের ডানদিকের দেওয়াল থেকে, যেখানে Reflecting surface লেখা আছে সেখান থেকে,  প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসছে।  এবার ভেবে দ্যাখ, টিউবের মধ্যে দুটো তরঙ্গ – মূল যেটা বামদিক থেকে ডানদিকে যাচ্ছিল, আর প্রতিফলিত তরঙ্গ যেটা ডানদিক থেকে বামদিকে ফিরে আসছে – একে অপরের উপর পড়ছে অথবা তাদের ইন্টারফিয়ারেন্স হচ্ছে, ঠিক তো? এর ফলে যেটা তৈরী হয় তার নাম হল স্থির তরঙ্গ বা      স্ট্যাণ্ডিং ওয়েভ, অর্থাৎ খুব সহজ ভাষায় বললে টিউবের মধ্যে বেশী চাপ(প্রসারণ) ও কম চাপের(সংকোচন) একটা স্থির বিন্যাস। এই অবধি পরিষ্কার?

ঋভুঃ হ্যা, ব্যাপারটা খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি। এই সংকোচন ও প্রসারণই তো তাপমাত্রা বাড়া অথবা কমার জন্য দায়ী তাই না? একটু আগেই তো বললে।

আমিঃ ঠিক ধরেছিস। মানে, এই ফ্রীজে শব্দই compression আর expansion-এর কাজটা করে দিচ্ছে। তবে কি জানিস, গ্যাসের তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা খুব বেশী নয়। তাই, এই শব্দের মাধ্যমে তৈরি ঠান্ডা জায়গাটা আইসক্রীম পর্যন্ত নিয়ে যেতে আর দুটো জিনিস ব্যবহার করা হয়। একটাকে বলে স্ট্যাক, যা আসলে একটা কঠিন পদার্থ, যে এই গ্যাসের থেকে তাপ শুষে নেয়। আর, একটা এক্সচেঞ্জার, যা এই স্ট্যাককে আইসক্রীম যেখানে রাখা থাকে তার সাথে যোগ করে।

ঋভুঃ আরেকটু খোলসা করে বলবে?

আমিঃ আসলে একটা গ্যাসের থেকে একটি কঠিন পদার্থের তাপ ধারণের ক্ষমতা বেশি। একে বলা হয় হিট ক্যাপাসিটি। একটি কম্পমান গ্যাস কে একটি কঠিন পদার্থের সান্নিধ্যে আনা হলে, গ্যাসের সঙ্কোচন বা প্রসারণের উপর ভিত্তি      করে সেই নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় থাকা কঠিন পদার্থ হয় গ্যাস থেকে বাড়তি তাপ শুষে নেয় অথবা নিজের তাপ গ্যাসটিকে প্রদান করে। ফলে হয় তার তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে কিম্বা সে নিজে আরো ঠাণ্ডা হয়।

এই পোরাস স্ট্যাক এমনই একটা কঠিন পদার্থ।

ঋভুঃ কিন্তু সেটা পোরাস বা ছিদ্র যুক্ত কেন?

আমিঃ এর পিছনে দুটো কারণ আছে। প্রথমটা হল স্ট্যাকের তাপ পরিবহন শক্তি কমিয়ে আনা, এবং দ্বিতীয়ত এই স্ট্যাকের কঠিন পদার্থ ও টিউবের গ্যাসের মিথষ্ক্রিয়া (interaction) যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দেওয়া। বুঝতেই পারছিস মিথষ্ক্রিয়া (interaction) যতটা বাড়বে স্ট্যাক-গ্যাসের তাপ আদানপ্রদান ততটাই বাড়বে।

ঋভুঃ কিন্তু তাপ পরিবহণ কমানোর প্রয়োজনটা কি? আমিঃ লস এ্যালামোস নাশানাল ল্যাবোরেটারির এই ভিডিওটাতেও তুই স্ট্যাকের ব্যাপারটা আরো ভাল করে বুঝতে পারবি।

ছবি ৪: (ক-খ) স্ট্যাকের কাজ করার পদ্ধতি (https://www.ijret.org/)

ধর আমরা যদি “ক” ছবিটা দেখি, দেখা যাবে যে দুটো স্ট্যাক প্লেটের মাঝে একটি গ্যাস বাবল আকারে আড়াআড়ি বাড়ছে (লাল ইলিপ্স) অর্থাৎ সেখানে গ্যাসের প্রসারণ হচ্ছে। ফলত সেই বাবলটির তাপমাত্রা     কমছে। আমরা জানি যে স্ট্যাক প্লেটটির নিজস্ব একটি স্থির তাপমাত্রা আছে। কাজেই তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করার উদ্দেশ্যে স্ট্যাক নিজের তাপ সেই গ্যাস বাবলকে দিয়ে নিজে শীতল হবে।

ঋভুঃ হ্যা হ্যা ঠিকই তো। পাশের ছবিটায় একেবার তার উলটো ঘটনা ঘটছে তাইনা?

আমিঃ হ্যা অবশ্যই। ওদিকে গ্যাসের সংকোচন ঘটেছে। কাজেই বাবলটি আকারে একটা নির্দিষ্ট দিকে (আড়াআড়ি) বেশ খানিকটা চ্যাপটা। তার তাপমাত্রাও বেশি। একইভাবে তাপমাত্রা ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে স্ট্যাক সেই বাবলের তাপ শোষন করে নিজে গরম হয়ে উঠছে।

এইবার মজার ব্যাপার হল এই স্ট্যাক পদার্থের তাপ পরিবহন শক্তি খুব বেশি হলে সে তার নিজের শরীরের দুদিকের তাপমাত্রার মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে স্বক্রিয় হবে তাই না? সেক্ষেত্রে তুই আলাদা করে একটা ঠাণ্ডা দিক কি আর পাবি? আর তা না পেলে আইস্ক্রীম চেম্বার ঠাণ্ডা হবেই বা কি করে?

ঋভুঃ বুঝলাম।

আমিঃ হুম। আবার অন্য দিকে এই স্ট্যাকের দুটি প্লেটের মাঝে দুরত্ব যে অঙ্ক ঠিক করে দেয় তার নাম “থার্মাল পেনিট্রেশান ডেপথ (thermal penetration depth)     ”। অর্থাৎ সেই প্লেটের পৃষ্ঠ থেকে গ্যাসের মধ্যে কতদুর  অবধি তাপের বিকিরণ হতে পারে তার একটা আনুমানিক মান। সেটা নির্ভর করছে গ্যাসের ঘনত্ব, তাপ প্রসারণ ক্ষমতা, তাপ ধারণ ক্ষমতা এবং অবশ্যই শব্দের কম্পাঙ্কের উপর। একটি নির্দষ্ট স্ট্যাক প্লেট ও গ্যাসের জন্য সেই দুরত্ব যদি  “x” হয় তবে দুটি পাতের মধ্যে দুরত্ব কমপক্ষ্যে “2x” থেকে “4x” এর মধ্যে হতেই হবে। কাজেই বুঝতে পারছিস যে দুটো স্ট্যাক প্লেটের মধ্যে কতটা দুরত্ব থাকবে এবং স্ট্যাক কি দিয়ে তৈরী হবে তা নির্ভর করছে এই গোটা অঙ্কটার উপর। মাইলার এমন একটা পদার্থ । এবং এই মাইলার পাত দিয়ে তৈরী একটি পোরাস স্ট্যাকের আকার খানিকটা এই নীচের (ছবি ৫) ছবিটার মত। এছাড়াও আরো নানান আকারের স্ট্যাক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই ছবিটার ক্ষেত্রে, দুটো প্লেটের মধ্যে দুরত্ব বজায় রাখার জন্য ব্যবহার করা হয় মাছ ধরার ছিপের অংশ। তাছাড়া স্ট্যাক পদার্থের তাপ ধারণ ক্ষমতা (হিট ক্যাপাসিটি) গ্যাসের তাপ ধারণ ক্ষমতার থেকে বেশ খানিকটা বেশি হওয়া প্রয়োজন।

ছবি ৫: একটি পোরাস স্ট্যাকের আকার (https://www.ijret.org/)

ঋভুঃ হ্যা তা না হলে তাপ আদান প্রদান সম্ভবই না।

আমিঃ এগজ্যাক্টলি! এবার বুঝতে পারছিস নিশ্চই, কি কারণে শুধু মাত্র গ্যাস থাকলেই রেফ্রিজারেশান সম্ভব নয়? স্ট্যাক থাকাটা খুব জরুরী?

ঋভুঃ হ্যা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু এবার আইস্ক্রীমটা কোথায় রাখা হচ্ছে? সেট তো বুঝলাম না?

আমিঃ হ্যা সে কথাতেই আসছি। এখানে প্রয়োজন পরে একটা গরম ও একটা ঠাণ্ডা “হিট এক্সচেঞ্জার”এর।

ঋভুঃ সেটা কি? আমিঃ হিট এক্সচেঞ্জার হল ধাতুর তৈরী টিউব বা শেল, যার সাহায্যে এক জায়গার তাপ অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এছাড়াও আরো নানা ধরণের পোরাস হিট এক্সচেঞ্জার পাওয়া যায় [4]। প্রথমে স্ট্যাকের গরম দিকটায় একটা এক্সচেঞ্জার ব্যবহার করে অতিরিক্ত তাপ বের করে বাতাসের সাহায্যে সেই তাপ আবহাওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে স্ট্যাকের ঠাণ্ডা দিকের তাপমাত্রা আরো হ্রাস পায়। পরবর্তী পর্যায়ে একটি ঠাণ্ডা এক্সচেঞ্জারের সাহায্যে আইস্ক্রীম রাখার চেম্বারের আবহাওয়াকে স্ট্যাকের ঠাণ্ডা দিকের নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নামিয়ে আনা হয়। এভাবেই কোন রকম পারিপার্শ্বিক ক্ষতি সাধন ছাড়াই বেন এ্যান্ড জেরী তাদের আইস ক্রীম ঠাণ্ডা করে থাকেন। হালে অবশ্য হাইড্রো কার্বোনের সাহায্যে হিমায়নের  পদ্ধতি ওনারা আবিষ্কার করেছেন যা এই থার্মোএ্যাকাউস্টি রেফ্রিজারেশানেই মতই সবুজ।

ঋভুঃ হ্যা তা না হলে তাপ আদান প্রদান সম্ভবই না।

আমিঃ এগজ্যাক্টলি! এবার বুঝতে পারছিস নিশ্চই, কি কারণে শুধু মাত্র গ্যাস থাকলেই রেফ্রিজারেশান সম্ভব নয়? স্ট্যাক থাকাটা খুব জরুরী?

ঋভুঃ হ্যা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু এবার আইস্ক্রীমটা কোথায় রাখা হচ্ছে? সেট তো বুঝলাম না?

আমিঃ হ্যা সে কথাতেই আসছি। এখানে প্রয়োজন পরে একটা গরম ও একটা ঠাণ্ডা “হিট এক্সচেঞ্জার”এর।

ঋভুঃ সেটা কি?

আমিঃ হিট এক্সচেঞ্জার হল ধাতুর তৈরী টিউব বা শেল, যার সাহায্যে এক জায়গার তাপ অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এছাড়াও আরো নানা ধরণের পোরাস হিট এক্সচেঞ্জার পাওয়া যায় [4]। প্রথমে স্ট্যাকের গরম দিকটায় একটা এক্সচেঞ্জার ব্যবহার করে অতিরিক্ত তাপ বের করে বাতাসের সাহায্যে সেই তাপ আবহাওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে স্ট্যাকের ঠাণ্ডা দিকের তাপমাত্রা আরো হ্রাস পায়। পরবর্তী পর্যায়ে একটি ঠাণ্ডা এক্সচেঞ্জারের সাহায্যে আইস্ক্রীম রাখার চেম্বারের আবহাওয়াকে স্ট্যাকের ঠাণ্ডা দিকের নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নামিয়ে আনা হয়। এভাবেই কোন রকম পারিপার্শ্বিক ক্ষতি সাধন ছাড়াই বেন এ্যান্ড জেরী তাদের আইস ক্রীম ঠাণ্ডা করে থাকেন। হালে অবশ্য হাইড্রো কার্বোনের সাহায্যে হিমায়নের  পদ্ধতি ওনারা আবিষ্কার করেছেন যা এই থার্মোএ্যাকাউস্টি রেফ্রিজারেশানেই মতই সবুজ।

ছবি ৬: বামদিকে গ্রীন রেফ্রিজারেটারের প্রথম প্রোটোটাইপ, এবং ডানদিকে ২০০৪ সালের পেনসিল্ভানিয়ে স্টেট ইউনিভার্সিটির গোটা টিম (বামদিক থেকে ম্যাট পোএজ, ডঃ স্টিভেন গারেট এবং বব স্মিথ) ও পিছনে গ্রীন ফ্রীজার।

মাথায় ঢুকলো পুরোটা?

রৃভুঃ একদম পরিষ্কার। তবে এবার মেডিকাল এ্যাপ্লিকেশান টা হোক?

আমিঃ ফ্লুরিজে পৌছানোর আগে যদি আর একটা প্রশ্ন করেছিস তো আমি এ যাত্রায় তোকে আর একটা গল্পও বলবো না। এখুনি বেরোবি চল।

ঋভুঃ (হাসতে হাসতে) আচ্ছা যাচ্ছি যাচ্ছি। অত চটে যাচ্ছো কেন?

আমরা বেড়িয়ে পড়লাম।

কভার ইমেজ : Pinterest

কিছু রেফারেন্সঃ

  1. Chris J Lawn and Guillaume Penelet, “Common features in the thermoacoustics of flames and engines” , International Journal of Spray and Combustion Dynamics, 2018.
  2. 2)    K. Augustine Babu, P. Sherjin, A Critical Review of Thermoacoustic Refrigeration and its Significance, International Journal of ChemTech Research, 2455-9555, Vol 10, No-7, 2017.
  3. S A Tassou, et al. A review of Emerging technologies for food refrigeration applications, Applied thermal engineering (2009).
  4. Comparative Performance of Thermoacoustic Heat Exchangers with Different Pore Geometries in Oscillatory Flow. Implementation of Experimental Techniques: Antonio Piccolo , Roberto Siclari , Fabrizio Rando and Mauro Cannistraro; NDPI Appl. Sci. 2017, 7, 784.

The post শব্দের তাপ – তাপের শব্দ পর্ব ১: বেন এ্যাণ্ড জেরীর ‘সবুজ’ রেফ্রিজারেটার appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড-এর দৌরাত্ম্য

$
0
0

ছোটবেলায় অনেক উচিত-অনুচিত শেখানো হয়, বাস্তব জগতে কিভাবে আচরণ করা উচিত, সেই নিয়ে। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে অর্থাৎ ইন্টারনেটে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে কিভাবে আচরণ করা উচিত, সেটা কিন্তু আমরা এখনো ঠেকে ঠেকেই শিখছি। যেমন, একটা হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড পেলে সেটাকে কিভাবে নেওয়া উচিত, সেই শিক্ষাটা কিন্তু এখনো ইস্কুলের পাঠ্যবইয়ে ঢোকেনি।


ধরুন, সকালবেলা চায়ের কাপ হাতে আপনি ফোনটা চেক করতে গিয়ে এরকম একটা হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড পেলেন। ফরওয়ার্ড-এর শুরুটা এইরকম:

Covid 19 নিয়ে এই মুহূর্তে সবচাইতে আলোচিত Lancet report.

Lancet পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ Science Journal. এটি New York থেকে প্রকাশ হয়। Covid সংক্রান্ত বহু বহু তথ্য এখানে নিয়মিত প্রকাশ হয়। সারা পৃথিবীর সব দেশ, WHO, UNICEF ইত্যাদি সবাই Lancet report কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। 12 April 2021 এর এই report এ বহু বহু তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে, যে Covid19 বায়ু দ্বারা সংক্রামিত হয়। অন্য কোনো ভাবেই নয়। প্রসঙ্গত বলা উচিৎ, July 2020 এর এই Lancet journal এই 22 টি দেশের প্রায় 223 জন বিখ্যাত বিজ্ঞানী (যাঁদের মধ্যে 45 জন নোবেলজয়ী) জানিয়েছিলেন যে Covid নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সম্ভবতঃ ভুল পথে যাচ্ছে। Lock down, Sanitization এসব করে এই Super spread রোখা যাবেনা। এতে বিপর্যয় বাড়বে। তখন এটা প্রমাণ করার মতন Data তাঁরা পাননি, এটা একটা hypothesis ছিল। এখন বিশাল তথ্য, data দিয়ে আরো বহু বিজ্ঞানী এটা প্রমাণ করেছেন। যাঁদের আগ্রহ আছে Duck Duck Go বা Google করে এই report পড়তে পারেন। খুব সহজবোধ্য ভাবে বোঝানো হয়েছে।

লম্বা ফরওয়ার্ড-এর অনেক কথার মধ্যে এইগুলো আপনার নজর কাড়লো:

লক ডাউন এই রোগ নিয়ন্ত্রণে কোনো উপকারী তো নয়ই, বরং দীর্ঘদিন ঘরে বন্দী থেকে শহর এলাকায় এই রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই ঘরে আবদ্ধ দশা না কাটালে সামনে ভয়াবহ রূপ দেখা যাবে, যা এখনো কল্পনার বাইরে।

লকডাউন-এর চোটে ঘরবন্দী হয়ে হয়তো আপনার দমবন্ধ হয়ে এসেছে। এই ফরওয়ার্ড-টা দেখে আপনি চমকে গেলেন। উত্তেজিত হয়ে পরিবারের অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন: “এই দেখো, কি বলছে!” সাড়া না পেয়ে আপনি ফরওয়ার্ড-টা সিলেক্ট করে উপরের এই বোতামটি টিপলেন:

প্রথমে ফরওয়ার্ড-টা পাঠালেন পরিবারের গ্রুপে, তারপর অফিসের, তারপর পাড়ার ক্লাবের, তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে ফরওয়ার্ড-টা ভালো করে পড়তে শুরু করলেন। আপনি লোকজনকে সচেতন করতে পেরেছেন, এই ভেবে হয়তো মনে একটু স্বস্তিও হলো।

মাস তিনেক পর দেশে মহামারীর প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে যখন লকডাউন জারি করা হলো, এবং একটা বিক্ষোভ জন্মালো তার বিরুদ্ধে, সেই বিক্ষোভের পিছনে আপনার ওই একটা সামান্য কাজ কতটা দায়ী, সেই ধারণা আপনার আছে কি? (এরকম লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কিন্তু মনগড়া কাহিনী নয়, আমেরিকার অনেক রাজ্যে এটা হয়েছে।)

এই ধারণা থাকা সম্ভব নয় কারণ হোয়াটস্যাপ সেই উপায় দেয় না। আপনি যেমন একদিকে শুধু এটুকুই জানেন আপনার ফরওয়ার্ড-টা কোত্থেকে এসেছে, অন্যদিকে আপনি এটাই জানেন যে ফরওয়ার্ড-টা আপনি কাদের পাঠালেন। ফরওয়ার্ড-এর সূত্রপাত কোত্থেকে বা শেষ অব্দি কদ্দুর পৌঁছচ্ছে, সে সম্বন্ধে ধারণা করার উপায় হোয়াটস্যাপ আপনাকে দেয়নি। শুধু তাই না, end-to-end encryption-এর ফলে হোয়াটস্যাপ-এর নিজেরও ক্ষমতা নেই একটা ফরওয়ার্ড-এর চেন-এ কারা আছে, সেটা উদ্ধার করার।

কিন্তু ধরুন যদি সেই উপায় থাকতো, এবং তিন মাস পর জানতে পারতেন যে আপনি ওই ফরওয়ার্ড-এর চেন-এ একটা মূল লিঙ্ক, অর্থাৎ আপনি ওই ফরওয়ার্ড-টা এগিয়ে না দিলে ওটা বেশিদূর যেত না, তাহলেও কি আপনি অতটাই স্বস্তিতে থাকবেন? যে তথ্যটা ফরওয়ার্ড করলেন, তার দায়িত্ত্ব নিতে কি আপনি রাজি আছেন?

হোয়াটস্যাপ-এর বিতর্কিত ফরওয়ার্ডগুলোর বিশেষত্ত্ব

উপরে যে হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড-টা দেওয়া হলো, এরকম ফরওয়ার্ড আমরা হামেশাই পেয়ে থাকি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটা লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো:

[১] এদের বিষয়বস্তু একটু বিতর্কিত হয়। সাধারণভাবে consensus বা ঐক্যমত যেকথা বলছে, এগুলো সাধারণত তার বিরুদ্ধে যায়।

[২] যেহেতু বিষয়টা বিতর্কিত, তাই এর স্বপক্ষে কিছু expert বা বিশেষজ্ঞের নাম দেওয়া হয়। উপরের ফরওয়ার্ড-এ যেমন Lancet জার্নাল-এর নাম এবং ২২৩ বিজ্ঞানী, যার মধ্যে ৪৫ জন নোবেলজয়ী, তাদের কথা বলা হয়েছে।

তবে এদুটো ছাড়াও আরেকটা লক্ষ্যণীয় বিষয় থাকে। সেটা হলো, এগুলোতে কোনো পরিচিত site -এর হাইপারলিংক থাকে না (বেশিরভাগ সময়ই কোনো হাইপারলিংক-ই থাকেনা)। অর্থাৎ আপনি চট করে তথ্যটার সত্যতা যাচাই করতে পারবেন না। আপনাকে একটু খাটতে হবে। সকালবেলা চা খেতে খেতে বা কাজের অবসরে ফোন চেক করতে করতে সেই খাটনিটা যে বেশিরভাগ  লোকেই খাটবে না, সেই ভরসাতেই এই মেটেরিয়াল-গুলো বানানো। কয়েকজন বিশেষজ্ঞের নাম বা জার্নালের নাম, এইগুলোই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভরসা অর্জন করতে যথেষ্ট।

কেন এইরকম ফরওয়ার্ড

এই ফরওয়ার্ড-গুলো যদি ডাহা মিথ্যে হয় বা সত্যিমিথ্যে মেশানো হয়, এরকম জিনিস তৈরী করার পিছনে অভিসন্ধিটা কি? এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিসন্ধিটা হয়তো রাজনৈতিক। আপনাকে খুব আলতো করে কোনো একটা দলের মতাদর্শের প্রতি ক্রমাগত ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অনেকসময় একটা ফরওয়ার্ড-এর কারণে কোন রাজনৈতিক দলের কি উদ্দেশ্যসাধন হচ্ছে, সেটাও স্পষ্ট নয়। ধরা যাক, অমুক রাজ্যে সরকার লকডাউন-এর পক্ষপাতী। প্রশাসন-পুলিশ সেই কাজে নামিয়েছে। উপরের ফরওয়ার্ড-টার মতো রাজনীতির সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন একটা ফরওয়ার্ড সেই সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে।

আবার এরকমও হতে পারে যে ফরওয়ার্ড-টার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্কই নেই। কোনো এক দিগ্গজ ব্যক্তি একটা মস্ত ষড়যন্ত্রের খোঁজ পেয়েছেন এবং তাঁর আবিষ্কারগুলো  তিনি চিল্লে চিল্লে সবাইকে জানাতে চান। এখানেই হোয়াটস্যাপ-এর মজা। যেহেতু ফরওয়ার্ড-এর সূত্রটা বেশিরভাগ লোকেই জানতে পারছে না, তার উপর যে কোনো আঁচ আসবে, সেই সম্ভাবনা কম। একটা ওয়েবসাইট-এ গেলে তার About অংশে দেখা যায় কারা সেই ওয়েবসাইট-এর সাথে জড়িত। একটা facebook রিপোস্ট-এ দেখা যায় কোথায় post-টা হয়েছিল। একটা হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড-এ সেসবের বালাই নেই। অচিরেই ফরওয়ার্ড-এর জন্মদাতার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়না (খোঁজ পেতে হলে পুলিশ লাগিয়ে ধরে ধরে সূত্রে যেতে হবে, আর ভুয়ো খবর দেওয়ার বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই, অতএব সেসবের ভয় নেই)। অতএব ফরওয়ার্ড-এর জন্মদাতাকে কোনো জবাবদিহিও করতে হয়না। ফরওয়ার্ড-টা আমার-আপনার কাঁধে চড়ে নিজে নিজেই এগোতে থাকে।

হোয়াটস্যাপ-এর মতো প্ল্যাটফর্ম-এ এই যে আড়ালে থেকে খুব চট করে অনেকের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়, এটা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কাজেরও। অনেক সময়, এই আড়ালে থাকতে পারার ফলেই কিছু দেশের সাধারণ নাগরিক অত্যাচারী সরকারের চোখ এড়িয়ে একটা বড়সড় বিক্ষোভমিছিল-এর আয়োজন করতে পারে। আবার ভুয়ো খবর ছড়ানোর বিরুদ্ধে যে জেল-জরিমানা-সমৃদ্ধ আইন করা উচিত, এটাও স্পষ্ট নয়। সেই আইন কিভাবে ব্যবহার হতে পারে, সেটাও আমরা জানি না।

ফরওয়ার্ড-এর দৌরাত্ম্য কিভাবে কমানো যায়

অতএব আপনি, এই ফরওয়ার্ড-এর চেন-এ একটা লিঙ্ক, আপনাকেই আরেকটু দায়িত্ত্ব নিতে হবে। উপরের ফরওয়ার্ড-টার মতো কোনো ফরওয়ার্ড পেলে সেটাকে এগিয়ে দেওয়ার আগে আরেকটু খোঁজখবর করুন। বেশিরভাগ ভুয়ো খবরের ক্ষেত্রেই একটু গুগল সার্চ করলেই তার সারশূন্যতা বেরিয়ে যায়। কোনো ফরওয়ার্ড এগিয়ে দেওয়ার আগে ওই সামান্য সার্চটুকু আপনার করা উচিত। সার্চের উদ্দেশ্য হলো, অন্তত মতামতের মূল সূত্রটা খুঁজে বার করুন (এবং পারলে, পড়ুন)। মূল সূত্রটা যদি একটা কঠিন গবেষণাপত্র হয়, সেগুলো সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়ার মতো অনেক সাইট থাকে, সেগুলো ঘেঁটে দেখুন। (‘বিজ্ঞান’-এও আমরা এরকমই চেষ্টা করি, সহজ করে গবেষণার ফলাফল বোঝাতে।) ইন্টারনেট-এ সার্চ করে যদি চট করে কিছু না মেলে, যে আপনাকে ফরওয়ার্ড-টা করেছে, তাকে জিজ্ঞেস করুন। হয়তো সে-ও সকালবেলা চা খেতে খেতে বেশি না ভেবে ফরওয়ার্ড-টা করেছে এবং আপনার প্রশ্নের ফলে পরের ফরওয়ার্ড-টা করার আগে সে-ও তার সত্যতা যাচাই করার ন্যূনতম চেষ্টাটা করবে।

The post হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড-এর দৌরাত্ম্য appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

Viewing all 308 articles
Browse latest View live


<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>