Quantcast
Channel: বিজ্ঞান – Bigyan
Viewing all 311 articles
Browse latest View live

কৃষিজগতের নতুন বিপ্লব: জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড

$
0
0

জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড (GM Food) কি? কেন এর সচেতনতা আমাদের সমাজে আজ একান্ত দরকার?


“হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ–লালিত্য–ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো !
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা—
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী–গদ্যময় :
পূর্ণিমা–চাঁদ যেন ঝল্‌সানো রুটি ॥”

সুকান্ত ভট্টাচার্য ।

ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়”। সত্যিই তো পেটে ক্ষিধে থাকলে কবেই বা আর চাঁদের সৌন্দর্য মানুষের ভালো লেগেছে। তা এই মুহূর্তে না হলেও, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে যে দুবেলা ভরপেট খেতে পাওয়াটা অনেক মানুষের প্রধান সমস্যা হতে চলেছে এই ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা কিন্তু অনেকটাই সহমত।

মানবসভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনার একটা ছিল কৃষিবিপ্লব, যখন আমাদের পূর্বসূরিরা শিকার-প্রধান যাযাবর জীবন ছেড়ে চাষবাস-প্রধান সামাজিক জীবন শুরু করেছিল। সভ্যতার সেই আদিলগ্ন থেকেই ফলন বাড়ানোর জন্য আর্টিফিসিয়াল সিলেকশন বা কৃত্রিম প্রজনন আমাদের একটা বড় হাতিয়ার। আজকের ধান বা ভুট্টা গাছকে আমরা নিজেদের প্রয়োজনেই আগাছা থেকে বেছে নিয়েছি। তারপর ধীরে ধীরে আমাদের সংখ্যা, প্রয়োজন, আর চাহিদা সবই বেড়েছে। কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি বোঝাই করা কলসী হাঁড়ি সরিয়ে এসেছে মোটরগাড়ি আর রেলগাড়ি। আর কৃষিতে ফলন বাড়াতে এসেছে কেমিকাল ফার্টিলাইজার্স বা রাসায়নিক সার, যা আদতে মাটির তলায় জমে থাকা ফসিল ফুয়েল এবং আজ প্রায় শেষের পথে। ফলস্বরূপ আজ খাদ্য সুরক্ষা মানবজাতির একটা বড় সমস্যা।

স্বভাবতই গোটা পৃথিবীতে অনেক বিজ্ঞানী এই বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। নতুন কিছু আবিষ্কার নিয়ে তাঁরা অনেকটাই এগিয়ে গেছেন, যেমন বায়োলজিক্যাল নাইট্রোজেন ফিক্সিং (BNF) কিংবা জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড (GM food)। বর্তমান লেখার বিষয়বস্তু এই GM ফুড।

জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড (GM Food) কি জিনিস আর কিভাবেই তা তৈরি হয় ?

যেসব খাদ্যদ্রব্য বা গাছেদের আমরা নিজেদের প্রয়োজনে জিন-গত পরিবর্তন করি, সেগুলোকেই বলে জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড (GM Food)। GM Food-এর প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে জিন কি বস্তূ সেটা ছোট করে বলে নি।

সব জীবের শরীর প্রচুর কোষ (cell) দিয়ে তৈরি। প্রত্যেক কোষে আছে ডি এন এ (Deoxy-ribo Nucleic Acid/DNA)। এক একটা DNA অণু দুটো লম্বা শৃঙ্খল দিয়ে তৈরী, যারা একে ওপরের চারিপাশে প্যাচানো থাকে।

ডিএনএ-এর গঠন

এই DNA-শৃঙ্খলের এক-একটা অংশ, যাতে একটা বিশেষ প্রোটিন নির্মাণের নির্দেশাবলী থাকে, তাকে জিন বলে। জীবদেহের সমস্ত গঠন, ক্রিয়া ও ক্রমবিকাশ এই DNA-র ভিতরের জিনেরাই নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এরা সরাসরি কিছু করে না। এর জন্য আর এন এ (RNA) বা সেনাপতি ও প্রোটিন (protein) বা সৈন্যদের দিয়েই কাজ উদ্ধার করে (কিভাবে, তার বর্ণনা এখানে দেখো)। এই যে বাবা মায়ের সাথে ছেলে মেয়ের চেহারার মিল থাকে সেটাও এই জিন-দের খেলা।

গাছেদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি, ফলন, কম বৃষ্টিতে বেঁচে থাকার ক্ষমতা, ক্ষতিকর জীবাণুদের থেকে নিজেদের রক্ষা করা, এইসব বৈশিষ্ট্যগুলোও জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এইরকম একটা বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯৭০-এ গ্রীন রেভোল্যুশন হয়েছিল। তার কিছু বছর আগে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী Norman E. Borlaug গম গাছের “বামন প্রকৃতি” (dwarf trait) আবিষ্কার করেন। লম্বা গম গাছে যখন প্রচুর গম ধরতো তখন তার ভারে গম গাছ সহজেই উল্টে যেত। এর ফলে প্রচুর গম মাঠেই নষ্ট হয়ে যেত। এটা দূর করার জন্য Dr. Borlaug “বামন” (dwarf) গম গাছ খুঁজে বার করেন যার কাণ্ড ছোট, খুব শক্ত, এবং ফলন ভালো। এই আবিষ্কারে কৃত্রিম প্রজননকে হাতিয়ার করেন তিনি। তারপর এই আবিষ্কার ধান গাছেও হয়। এইসব আবিষ্কার প্রয়োগের ফলেই ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯৭০-এর গ্রীন রেভোল্যুশন হয়। অনেক পরে গবেষণার ফলে জানা যায় “dwarf trait” আসলে জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু বর্তমানে দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধি আর কৃষিজমির হ্রাস পাওয়ার ফলে গ্রীন রেভোল্যুশন-এর প্রভাব অনেকটা কমে গেছে। তাই এখন ফলন আরও বৃদ্ধি করার নতুন উপায় বার করা প্রয়োজন। জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড (GM Food) হল এই ফলন বাড়ানোর একটা আধুনিক উপায়।

কোনো একটা গাছের জিন-গত পরিবর্তন করা হয় তার DNA-র মধ্যে অন্য জীবের (গাছ, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া) জিন ঢুকিয়ে। প্রকৃতিতে জিন ট্রান্সফার ব্যাকটেরিয়া থেকে গাছপালায় বা একটা গাছ থেকে অন্য গাছে সবসময় ঘটে চলেছে। ল্যাবরেটরিতে গবেষকরা জেনেটিকালি মডিফাইড উদ্ভিদ তৈরী করে অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়াম (agrobacterium) নামক এক উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে। অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়াম-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের জিন ট্রান্সফার করার ক্ষমতা। সোজা কথায় বলতে গেলে এরা এক ধরনের বাহক। গাছেদের যেসব ভালো বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিন (যেমন dwarf trait এর জিন) আবিষ্কার হয়েছে এতদিন ধরে, সেগুলোকেই প্রথমে অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়াম-এর কোষে ঢোকানো হয়। তারপর সেই পরিবর্তিত অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়াম-এর সাহায্যে সেই জিন গাছেদের শরীরে ঢোকানো হয় তাদের কোনো একটা বৈশিষ্ট্যের উন্নতি ঘটাতে, যাতে তারা জীবাণুদের হাত থেকে বাঁচতে পারে কিম্বা বেশি ফলন দেয়। পুরো প্রক্রিয়াটির ছবি নিচে দেওয়া হলো।

তবে এর কিছূ সমস্যাও আছে। যেমন অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়াম-এর সাহায্যে গাছেদের দেহে কোনো জিন প্রবেশ করালে এটা একদম একটা ভাগ্যনির্ভর ঘটনা, জিন-এর অনুপ্রবেশ যে কোনো কোষে হতে পারে। তার ফলে অনেক সময় জেনেটিক পরিবর্তনের ভালো প্রভাবগুলো কমে যায়। আবার অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়াম-এর সাহায্যে জেনেটিকালি মডিফাইড উদ্ভিদ তৈরী করে তা বাজারজাত করতে ৭-১০ বছর সময় লেগে যায়। আর ঠিক তাই এখন আরো উন্নত প্রযুক্তি, যেমন জিন এডিটিং (gene editing) এসে গেছে। জিন এডিটিং-এর সাহায্যে এখন আরো সহজেই জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড উত্পাদন করা যাচ্ছে।

কিভাবে GM Plants তৈরি হয়। সাধারণত অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়াম নামের এক প্রকার উপকারি ব্যাক্টেরিয়ার সাহায্যে কিছু ভালো বা দরকারী জিন (অন্য উদ্ভিদ বা ব্যাকটেরিয়া থেকে নেওয়া) কে আমাদের টার্গেট উদ্ভিদের কোষে ঢোকানো হয়। যে চারাগাছটি তৈরি হয় সেটা বড় হলে যখন শস্য ফলায়, সেটাই GM Foods এর জন্ম দেয়।
(সূত্র-http://2010.igem.org/Team:Nevada/Agrobacterium_Transformations)

 

জিন এডিটিং কি এবং এর সাহায্যে কিভাবে GM foods তৈরী হচ্ছে ?

খুব সহজ ভাষায় এটা অনেকটা ওয়ার্ড প্রসেসর (word processor)-এর সাহায্যে কোনো ডকুমেন্ট এডিট করার মতই একটা ব্যাপার। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা ভালো বোঝা যাবে। তুমি কোনো ডকুমেন্ট টাইপ করার সময় কিছু বানান ভুল করলে যেমন সহজেই রিপ্লেস (replace) বা এডিট (edit) ব্যাবহার করে সেই ভুল টাকে শুধরে নিতে পারো, ঠিক তেমনই কোষ থেকে খারাপ জিনকে জিন এডিটিং-এর দ্বারা শুধরে ফেলা যায়। সাধারণত কোনো জীবের প্রয়োজনীয় জিন-এ পরিবর্তন (mutation) ঘটলে তার ফল অনেক সময় খুব খারাপ হয়। তখন বিজ্ঞানীরা Cas9 নামক এক ব্যাকটেরিয়াল প্রোটিন দিয়ে সেই দুষ্টু জিনটাকে কেটে বাদ দিয়ে একটা ভালো জিন দিয়ে বদল করে ফেলে। Cas9 নামক প্রোটিন ব্যাক্টরিয়ারা দূষ্টু ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে ব্যবহার করে। তাহলে কি দাঁড়ালো ব্যাপারটা, এই Cas9 আসলে ব্যাক্টেরিয়াদের একটা অতি সুক্ষ কাঁচি (molecular scissor), তাই না?

গবেষকরা এখন এই Cas9 ব্যবহার করে খুব সহজে ও কম সময়ে উপকারী জিন গাছে ঢোকানোর পদ্ধতি বার করেছে। নিচের ছবিতে প্রক্রিয়াটা দেখানো হলো। এই প্রযুক্তিতে ভালো ফলনশীল ধান বা কম বৃষ্টিতেও বেঁচে থাকবে এইরকম ফসলের বীজ খুব শীঘ্র তৈরি করতে পারা যাবে এরকম আশা করা হচ্ছে। প্রথাগত পদ্ধতিতে অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়াম-এর সাহায্যে জেনেটিকালি মডিফাইড উদ্ভিদ তৈরী করা একটা সময় ও ব্যয়-সাপেক্ষ বিষয়। তাই জিন এডিটিং-এর মাধ্যমে জেনেটিকালি মডিফাইড প্লান্টস এই মুহূর্তে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু কোম্পানি জিন এডিটিং-এর সাহায্যে তৈরী মাশরুম, উন্নত ফলনশীল ভুট্টা, টোম্যাটো নিয়ে বাজারে হাজির হয়েছে এর মধ্যেই। ব্যাপারটা বেশ মজার, না? জিন এডিটিং-এর দ্বারা জেনেটিকালি মডিফাইড উদ্ভিদ তৈরীর পুরো খুঁটিনাটি ব্যাপারটা নাহয় আর এক দিনের জন্য তোলা থাক। আরো জানতে তোমরা নিচের লেখা আর ভিডিওগুলো দেখো।

GM Plants তৈরির নতুন উপায় CRISPR জিন এডিটিং।
(সূত্র : https://www.frontiersin.org/articles/10.3389/fpls.2016.00506/full)

তাহলে GM ফুডস নিয়ে সমস্যাটি কোথায় আর এর সমাধান কি ?

GM ফুডস কোনো সোনার চামচ নয় যে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। তবে এটা ইতিমধ্যে প্রমাণিত যে আফ্রিকা, এশিয়া সহ অনেক জায়গায় খাদ্য সুরক্ষা দিতে GM ফুড সক্ষম হচ্ছে। আবার এটাও সত্যি এই GM ফুড-এর ব্যাপারে অনেক ভুল ধারণা ছড়িয়ে আছে। কিছু উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা ভালো বোঝা যাবে। যেমন অনেকেই ভুল ধারণা পোষণ করে যে জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড মানেই সেগুলো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া-র ডিএনএ নিয়ে পরিবর্তন করা। অনেক সময় এটা করা হয় কিন্তু ঘটনা সর্বদা ওরকম নয়। আবার অনেকেই ভয় পায় যে অনেক সময় আমরা কোনো জীবের জিন পরিবর্তন করলে তার ফল খারাপ হতে পারে। যেমন GM ফুড-এর পরাগরেণু (pollen) ছড়িয়ে পড়ার ফলে অনেক আগাছার বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়ে যেতে পারে। আবার অনেক প্রতিবাদী গোষ্ঠীর মতে GM ফুড শরীরের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এটা পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক সত্যি কিনা পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণিত নয় এবং আরো বিশদ গবেষণার প্রয়োজন আছে। সম্প্রতি National Academy of Science, USA মতামত দিয়েছে যে মানুষের শরীরের ওপর GM ফুড-এর কোনো খারাপ প্রভাবের প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি (এখানে বিস্তারিত খবরটা দেখো, এখানে সেই নিয়ে আলোচনা দেখো)। আর তাছাড়া কেই বা খালি পেটে স্কুল বা অফিস যেতে চায় বলোতো ?

তথ্য সুত্র ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলস

 

এই লেখাটি মনোযোগসহকারে পড়ে মূল্যবান কিছু মন্তব্য করেছেন ড: ইন্দ্রনীল মল্লিক, ড: সরিৎ পাল ও মিসেস শীর্ষা পাল। তাদের কাছে আমি অশেষ কৃতজ্ঞ।

The post কৃষিজগতের নতুন বিপ্লব: জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).


সুপারকন্ডাক্টারের কাহিনী: সাধারণ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটীর সন্ধান

$
0
0

সর্বোচ্চ কত তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটি সম্ভব? তার থেকেও বেশি তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটি পেতে বাধা কোথায়? সুপারকন্ডাক্টারদের ইতিবৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনায় শমাশিস সেনগুপ্ত।


প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বে সুপারকন্ডাক্টার আবিষ্কারের কাহিনী, তার অদ্ভূত সব আচরণ এবং সেই আচরণের ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আজকের কাহিনী সুপারকন্ডাক্টার-এর প্রযুক্তিগত ব্যবহার নিয়ে। কি ধরণের প্রযুক্তি বেরিয়েছে সুপারকন্ডাক্টার-এর অদ্ভূত আচরণ থেকে, এবং তাকে বাস্তবে রূপ দিতে বাধা কোথায়, আজকের আলোচনা এই বিষয়গুলি নিয়ে।

প্রযুক্তিতে সুপারকন্ডাক্টার-এর ব্যবহার

সুপারকন্ডাক্টারের প্রতিরোধক্ষমতা শূন্য হওয়ার কারণে প্রযুক্তিতে এর বহু উপযোগিতা রয়েছে। যেখানে অবিচ্ছিন্নভাবে বিরাট পরিমাণের বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা প্রয়োজন, সেখানে এর জুড়ি মেলা ভার। খালি একটাই ব্যাপার – যে সরঞ্জামের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ যাবে তাকে বেশ ঠাণ্ডা করে রাখতে হবে, কারণ আমাদের স্বাভাবিক জগতের তাপমাত্রায় (অর্থাৎ ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২৯৩ কেলভিনের আশেপাশে) থাকলে সুপারকন্ডাক্টার দশা লোপ পাবে। সুপারকন্ডাক্টিভিটীর ইতিহাসের একদম শুরুর দিন থেকেই চেষ্টা চলছে এমন বস্তু আবিষ্কার করার যা কিনা এরকম তাপমাত্রাতেও শূন্য প্রতিরোধক্ষমতায় বিদ্যুৎবহনে সক্ষম হবে। সেরকম জিনিসের এখনও দেখা মেলেনি। সেই কথায় আসছি একটু পরে।

প্রতিরোধক্ষমতা শূন্য হওয়ার কারণে সুপারকন্ডাক্টার দিয়ে তৈরি বলয়াকার তারের মধ্যে দিয়ে বিদু্ৎপ্রবাহ চলতে থাকে অবিরাম, কোনো শক্তির যোগান ছাড়াই।

সুপারকন্ডাক্টারের সবথেকে প্রচলিত ব্যবহার হচ্ছে শক্তিশালী চুম্বক তৈরিতে। সুপারকন্ডাক্টার দিয়ে বানানো বলয়াকার তারের মধ্যে বিদ্যুৎ পাঠিয়ে বিরাট মাত্রার চুম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায়। বিদ্যুৎপ্রবাহ ক্ষয় না পেয়ে অবিরাম চলতে থাকে এর ভেতর। তাকে ক্রমাগত শক্তির যোগান দেওয়ার দরকার পড়ে না।

কোথায় কোথায় এর প্রয়োগ হয় দেখা যাক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এম . আর . আই . বলে একটি যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। এম . আর . আই . আদ্যক্ষরের অর্থ হচ্ছে ম্যাগনেটিক রেসোনান্স ইমেজিং। অনেকেই এটিকে চিকিৎসাকেন্দ্রে দেখে থাকতে পারেন। শরীরের নানা বৃত্তান্ত এই যন্ত্র বাইরে থেকে দেখতে পায়, তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ ও শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে। এখানে ব্যবহৃত হয় একটি প্রকাণ্ড বলয়াকার সুপারকন্ডাক্টার।

আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে জাপানে আবিষ্কৃত এক অত্যাধুনিক ট্রেন প্রযুক্তি, যার নাম সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেটিক লেভিটেশন (প্রচ্ছদের ছবিটি দেখুন)। ট্রেনের গায়ে লাগানো থাকে সুপারকন্ডাক্টারজাত চুম্বক আর রেললাইনের সঙ্গে থাকে বিভিন্নরকম বিদ্যুতবাহী তারের সারি। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে ট্রেনের ওপর এক বলের সৃষ্টি হয় যা তাকে লাইনের একটুখানি ওপরে শূন্যে ভাসিয়ে রাখে! এতে প্রবল গতিতে ট্রেন চলাচল সম্ভব হয়। সারা পৃথিবীর মধ্যে দ্রুততম ট্রেন হওয়ার নজির গড়েছে এই প্রযুক্তি। এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে এবং আশা করা হচ্ছে শীঘ্রই একে দৈনন্দিন যাত্রী পরিষেবার কাজে লাগানো যাবে।

সুপারকন্ডাক্টার দশার তাপমাত্রা বৃদ্ধির দৌড়

পদার্থবিজ্ঞানী ও রসায়নবিদরা বহুকাল ধরে নতুন নতুন পদার্থ বানিয়ে পরীক্ষা করে চলেছেন কী করে সুপারকন্ডাক্টারের দশা পরিবর্তনের তাপমাত্রা বাড়ানো যায়। একটা সময় ছিল যখন চিত্রটা হতাশাজনক হয়ে পরে। ১৯৭০ এর দশকের দিকে তাকানো যাক। Nb3Ge সূত্রের যৌগে ২৩ কেলভিনে সুপারকন্ডাক্টিভিটী দেখা যেত। সেই সময়ে এটাই ছিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় অতিপরিবাহীতার নিদর্শন। ২৩ কেলভিন সাধারণ তাপমাত্রার দশ ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম।

বি. সি. এস. তত্ত্বকে ভিত্তি করে কোনও ধাতুর সুপারকন্ডাক্টার দশা পরিবর্তনের তাপমাত্রা কত হবে, তা আন্দাজ করা সম্ভব। প্রধানত তিনটে জিনিস এই তাপমাত্রা নির্ধারণ করে – ইলেক্ট্রনদের ঘনত্ব, আয়নদের নড়াচড়ার ফলে পদার্থের অভ্যন্তরীন কম্পনের শক্তির মাত্রা (পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ‘ফোনন’) ও ইলেক্ট্রনের সঙ্গে ফোননের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মাত্রা। এর প্রত্যেকটি যত বেশি হবে, তত উচ্চ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটী পাওয়ার আশা করা যেতে পারে। সমস্যা হল, যা যা ধাতব পদার্থের কথা ভাবা যাচ্ছিল, হিসেব করে দেখা যাচ্ছিল তাদের কারও সুপারকন্ডাক্টার দশার তাপমাত্রা তখন যা জানা আছে তাকে ছাড়িয়ে বেশিদূর বাড়বে না।

পরিচিত ধাতুদের বাইরে নতুন কী পদার্থ সৃষ্টি করা সম্ভব যার অভ্যন্তরীণ গঠনের ফলে ইলেক্ট্রনদের পারস্পরিক আকর্ষণ থেকে উষ্ণতর তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটী তৈরি হতে পারে? এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবছিলেন য়োহানেস বেডনোর্টস ও কার্ল আলেক্সান্ডার ম্যূলার। কিছুটা তাত্ত্বিক গণনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আর কিছুটা নিজেদের অনুমাণ কাজে লাগিয়ে তাঁরা সুপারকন্ডাক্টিভিটীর অস্তিত্ব খুঁজছিলেন ক্যূপ্রেট বলে একশ্রেণীর যৌগে।

ক্যূপ্রেটরা গঠিত হয় তামা, অক্সিজেন ও অন্যান্য মৌলিক পদার্থের অণু সহযোগে। ১৯৮৬ সালে বেডনোর্টস ও ম্যূলার দেখতে পেলেন ৩৫ কেলভিন তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটী ঘটে Ba-La-Cu-O সূত্রের ক্যূপ্রেটে, যা হল তখনকার দিনে উষ্ণতম সুপারকন্ডাক্টারের নিদর্শন।

ক্যূপ্রেট-এর চাঞ্চল্যকর আচরণ

যে যে পদার্থে সুপারকন্ডাক্টিভিটীর ব্যাখ্যা বি. সি. এস. তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে সাধারণ তাপমাত্রায় ধাতুর গুণ ভালো করে দেখা যায়। ক্যূপ্রেটদের মোটেই সেই গোত্রে ফেলা চলে না। এই আবিষ্কার প্রমাণ করল প্রচলিত ধারণার বাইরেও অন্যান্য বস্তু রয়েছে যাদের মধ্যে সুপারকন্ডাক্টার দশার খোঁজ করা প্রয়োজন।

এমন যুগান্তকারী কাজের জন্যে বেডনোর্টস ও ম্যূলার নোবেল পুরষ্কার পেলেন ঠিক তার পরের বছর, ১৯৮৭-তে। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানমহলে সারা পরে গেছে। নতুন সব ক্যূপ্রেটে সুপারকন্ডাক্টিভিটী খোঁজা শুরু হয়েছে। এই প্রচেষ্টা আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথেই পাওয়া গেল ৯৩ কেলভিনে সুপারকন্ডাক্টিভিটী, Y-Ba-Cu-O তে। এই বস্তুটিকে তরল নাইট্রোজেনে (যার তাপমাত্রা ৭৭ কেলভিন) রাখলেও সে সুপারকন্ডাক্টার দশায় থাকে। বাতাস নাইট্রোজেনে ভরপুর, তাই তরল নাইট্রোজেন অনেক গুণ বেশি সহজলভ্য তরল হিলিয়ামের চেয়ে। প্রযুক্তিতে কাজে লাগার জন্যে সুপারকন্ডাক্টার একটা নতুন যুগে পা দিল।

ক্যূপ্রেটে সুপারকন্ডাক্টিভিটীর আবিষ্কার বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে, প্রচারমাধ্যম তথা জনগণকে মৌলিক বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে উৎসাহী করে তোলে।

ক্যূপ্রেটে সুপারকন্ডাক্টিভিটীর আবিষ্কার কিরকম চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল তা একটা ঘটনা থেকে বোঝা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান ফিজিকাল সোসাইটি মার্চ মাসে একটি বার্ষিক সম্মেলন আয়োজন করে যেটি পদার্থবিজ্ঞানের জগতে সুপ্রসিদ্ধ। নিউ ইয়র্কে ১৯৮৭ সালের এই সম্মেলনটি ছিল বিশেষভাবে স্মরণীয়। তখন ক্যূপ্রেট-সংক্রান্ত নিত্যনতুন আবিষ্কার হয়ে চলেছে আর এই নিয়ে বিজ্ঞানমহলে উত্তেজনা তুঙ্গে। সম্মেলনের আয়োজকরা উচ্চ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটী নিয়ে একদিন একটি বিশেষ অধিবেশনের ব্যবস্থা করেন। এই অধিবেশন শুরু হয় সন্ধে সাড়ে সাতটায়। একান্ন জন তাঁদের বক্তব্য রাখেন আর অধিবেশন যখন শেষ হয় তখন বাজে রাত সোয়া তিনটে! শ্রোতার সংখ্যা ছিল প্রায় দুহাজার, সম্মেলনকক্ষে সকলের জায়গাও হয়নি। যাঁরা সেদিন উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় যে সেই পরিবেশ ছিল উৎসবের মত। পদার্থবিজ্ঞানের সম্মেলনে এমন উন্মাদনা খুবই বিরল ঘটনা।

কেন অপেক্ষাকৃত উচ্চ তাপমাত্রাতেও সুপারকন্ডাক্টিভিটি সম্ভব

সাধারণ বায়ুচাপের অধীনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটীর নজির হচ্ছে ১৩৩ কেলভিন। Hg–Ba–Ca–Cu–O সূত্রের বস্তুতে তা দেখা যায়। কেন এই নতুন জিনিসগুলোতে এত উষ্ণ অবস্থাতেও এই দশা দেখা যাচ্ছে, সেই প্রশ্নটি বিজ্ঞানীদের আজও ভাবিয়ে চলেছে। আয়নের সঙ্গে ইলেক্ট্রনের আকর্ষণ থেকে ফোননকে কেন্দ্র করে ইলেক্ট্রনদের মধ্যে আকর্ষক বল সৃষ্টি হওয়ার যে কথা বি. সি. এস. তত্ত্বে আছে, এখানে সেই ব্যাখ্যা খাটে না। সম্পূর্ণ নতুন কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন। এই নিয়ে তিন দশক পরেও হয়ে চলেছে অনেক আলোচনা, অনেক বিতর্ক। এমন কোন সমাধান পাওয়া যায়নি যাকে সব দিক থেকে সঠিক ঘোষণা করে বিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেন।
বি. সি. এস. তত্ত্ব থেকে যে ধাতুদের ধর্ম নিয়ে হিসেব কষা যায়, তাদের মধ্যে খুঁজলে সাধারণ তাপমাত্রায় অতিপরিবাহীতা পাওয়ার আশা নেই তা বলেছি একটু আগে। একটা ব্যতিক্রম অবশ্য ভাবা গিয়েছিল – কঠিন হাইড্রোজেন। কঠিন পদার্থের অভ্যন্তরে আয়নদের বন্ধনের স্থিতিস্থাপক ধর্মের কারণে তারা স্পন্দনরত অবস্থায় থাকে। কঠিন পদার্থে এমন তরঙ্গ সহজাতভাবে উপস্থিত। বিভিন্ন প্রকারের স্পন্দনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে শক্তির কিছু নির্দিষ্ট মাত্রা, যারই নাম ফোনন।

বি. সি. এস. তত্ত্বে ফোননদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুপার জোড়াদের সৃষ্টি হওয়ার মূলে রয়েছে ইলেক্ট্রনের সাথে আয়নদের শক্তি আদানপ্রদানের প্রক্রিয়া। হিসেব করলে দেখা যায় যে সুপারকন্ডাক্টিভিটীর দশা পরিবর্তনের তাপমাত্রা নির্ভর করে ফোননের ওপর। হাইড্রোজেনের অণু মৌলিক পদার্থের মধ্যে সবচেয়ে হাল্কা – সেই কারণে কঠিন হাইড্রোজেনের অন্তর্নিহিত কম্পনের শক্তির মাত্রা বৃহৎ হওয়ার কথা। এই ঘটনার ভিত্তিতে ও অন্যান্য আরও কিছু কারণ বিবেচনা করে হিসেব করে দেখা যায় যে এই পদার্থে অতিপরিবাহীতা ঘটতে পারে অনেক উচ্চ তাপমাত্রায়।

সমস্যা হল, হাইড্রোজেনকে সাধারণ তাপমাত্রায় কঠিন ধাতুর অবস্থায় রাখতে গেলে তার ওপর বিপুল চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বাস্তব জগতে এই সুপারকন্ডাক্টারকে পাওয়া দুরূহ কাজ। সাম্প্রতিক কালে কয়েকজন গবেষক এই কাজটিকে অপেক্ষাকৃত সরল করার চেষ্টা করেছেন হাইড্রোজেনের বদলে কিছু হাইড্রোজেন-সংবলিত যৌগ নিয়ে পরীক্ষা করে, যাদের পরিবাহী ধাতুতে পরিণত করা তুলনায় সহজ। সেভাবেই জানা গেছে H2S-এর ওপর সাধারণ বায়ুচাপের থেকে ১৫ লক্ষ গুণ বেশি চাপ দিলে (যা কিনা পৃথিবীর কেন্দ্রে চাপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) তাতে সুপারকন্ডাক্টিভিটী দেখা যায় ২০৩ কেলভিনে। এখনও অবধি সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটীর নিদর্শন এটাই। সাধারণ তাপমাত্রা থেকে যার দূরত্ব আর মাত্র ৯০ কেলভিন। এই বাকি পথটুকু যেতে আর কতদিন লাগবে? সেইটা আন্দাজ করার কোন উপায় নেই। সেই দিন না আসা পর্যন্ত সাধারণ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটীর সন্ধানে পৃথিবীর নানা প্রান্তে পরীক্ষানিরীক্ষা অবিরাম চলতেই থাকবে।

(প্রচ্ছদের ছবির সূত্র)

দ্বিতীয় পর্ব

 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : এই লেখাটি পড়ে মতামত দিয়ে সাহায্য করার জন্যে আমি শ্রীনন্দা ঘোষের কাছে কৃতজ্ঞ।

The post সুপারকন্ডাক্টারের কাহিনী: সাধারণ তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটীর সন্ধান appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

এবার ‘বিজ্ঞান’ মুদ্রিত সংস্করণে!

$
0
0

একটা সমাজের কথা ভাবা যাক – যেখানে মানুষমাত্রেই বিজ্ঞানমনস্ক। কল্পনা করা যাক, সেখানে লোকাল ট্রেনে তাসের সাথে লোকজন আড্ডা জুড়েছে মানুষের ক্লোনিং করা উচিত কিনা তাই নিয়ে। সেই আড্ডায় যারা অংশ নিয়েছে, তারা কেউই কিন্তু বিজ্ঞানী নয়। চাকরী শেষে বাড়ি ফিরছে মফস্বলে। আলোচনা হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত। মোটামুটি দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে জনতা। একদল ক্লোনিং-এর পক্ষে, তাদের যুক্তি কৃত্রিম ভাবে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বানানো সম্ভব হলে চিকিৎসাশাস্ত্রে যুগান্তর আসবে। আরেক দলের বক্তব্য সহজে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্লোনিং করা উচিত না, এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক ন্যায়নীতির প্রশ্ন। এই আলোচনার মাঝে হঠাৎ স্মার্টফোনের হোয়াটসঅ্যাপে এক ফরোয়ার্ডেড মেসেজ পেল একজন। ঝকঝকে ছবিতে সেখানে লেখা – জাতিসঙ্ঘ আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীতকে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের মর্যাদা দিয়েছে! পাশের জন দেখতে পেয়ে বলল – “আমায় ফরোয়ার্ড কর, দারুণ খবর”! কিন্তু সে ফরোয়ার্ড না করে জাতিসঙ্ঘের ওয়েবসাইটে গিয়ে খুঁজল এই খবরের সত্যতা।  কই, এমন খবর কোথাও নেই তো! এ হল ফেক বা ভুয়ো খবর, সবাইকে সতর্ক করে দিল সে।

বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ মানে প্রযুক্তিতে উন্নত সমাজ নয়। প্রযুক্তির সুফল তো পয়সা থাকলে কেনা যায়। কিন্তু, সমাজে বিজ্ঞান মানসিকতা তৈরি করার কাজটা সময়সাপেক্ষ, প্রকৃত অর্থেই দুরূহ। ভারতের সংবিধানে সায়েন্টিফিক টেম্পার বা বিজ্ঞান মানসিকতা সকল নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য হিসাবে উল্লিখিত আছে। অথচ, বিজ্ঞান মানসিকতা যে তেমন তৈরি হয়নি সেটা বোঝা যায় যখন দেখা যায় ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে ফেক খবর যাচাই না করে ফরোয়ার্ড করতে থাকে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। বিজ্ঞান মানসিকতার অভাব বোঝা যায় জ্যোতিষের রমরমা থেকেও। বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির কোন ম্যাজিক ফর্মুলা নেই। তবে তা তৈরিতে কয়েকটি বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। এক, বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি করতে বিজ্ঞানের নিয়মিত আলোচনা জরুরী। তার জন্য বিজ্ঞানী হওয়াটা আবশ্যক নয়। প্রয়োজন গোঁড়ামি মুক্ত, যুক্তিবাদী, স্বচ্ছ ও সাহসী চিন্তাধারার। দুই, যদি এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখি যেখানে পাড়ার রকে বা লোকাল ট্রেনে সিনেমা, ক্রিকেটের সাথে গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ক্লোনিং, ইবোলা কিভাবে দূর করা যায়, বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার যে কী রোমহর্ষক সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাহলে সেই সমাজ তৈরিতে বিজ্ঞানের আলোচনা ও নতুন উদ্ভাবনের কথা প্রচার করা জরুরী মাতৃভাষায়। অর্থাৎ, সেই ভাষায়, যে ভাষায় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে  শেখে।

বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ তৈরির লক্ষ্যে, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের আলোচনার স্বাদ আস্বাদনের উদ্দেশ্যে আত্মপ্রকাশ ‘বিজ্ঞান’-এর।

মুদ্রিত মাধ্যমে এই প্রথম আত্মপ্রকাশ করলেও ‘বিজ্ঞান’-এর সামান্য ইতিহাস আছে। প্রায় সাড়ে চার বছর আগে ‘বিজ্ঞান’ অনলাইন যাত্রা শুরু করেছিল www.bigyan.org.in-এ। বিজ্ঞান আর মাতৃভাষা বাংলার প্রতি যুগ্ম ভালবাসা ও স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাথে বিজ্ঞানের মজা ভাগ করে নেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এই উদ্যোগ শুরু করেছিল গুটিকয়েক বাঙালী বিজ্ঞানপ্রেমী। সময়ের সাথে বহু বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এই উদ্যোগে যোগদান করেন। কিছুদিনের মধ্যেই ‘বিজ্ঞান’ হয়ে ওঠে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালী বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানপ্রেমীদের এক সংগঠন। ‘বিজ্ঞান’-এ আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার বহু গভীর আলোচনা পাওয়া যাবে, যা গবেষণাপত্রের তুলনায় সহজবোধ্য। অথচ, সেগুলো প্রচলিত দৈনিক সংবাদপত্রে পরিবেশিত খবরের মত উপমায় অতিরঞ্জিত এবং প্রায়শই ভুলে ভরা নয়। গবেষণাজগতে প্রচলিত peer review-পদ্ধতিতে সম্পাদনার মাধ্যমে লেখাগুলির বৈজ্ঞানিক সত্যতা অক্ষুণ্ণ রাখতে আমরা সদা সচেষ্ট। bigyan.org.in-এ প্রকাশিত লেখার গুণমান আকৃষ্ট করেছে বহু বিজ্ঞানপ্রেমীকে। কাঁথি বিজ্ঞান সংস্থা (Contai Science Academy)-র সদস্যদের সাথে আলাপ সেই সূত্র ধরেই। সেই আলাপ থেকে একসাথে কাজ করার ভাবনা, তারই প্রথম ধাপ হল ‘বিজ্ঞান’ মুদ্রিত পত্রিকা। bigyan.org.in-এর মতই ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকাতেও থাকবে পপুলার সায়েন্স ও পাঠক্রমিক লেখার সংকলন। ওয়েবসাইটে পূর্ব প্রকাশিত ও নতুন কিছু লেখা নিয়ে তৈরি ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকাটি ছাপার অক্ষরে বাংলাভাষী সাধারণ মানুষের ও ছাত্রছাত্রীর উৎসাহী মনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়বে, এই আশা রাখি।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের মজা ভাগ করে নেওয়ার জন্য আমাদের এই সংগঠন গড়ে উঠেছে ইন্টারনেটেই। bigyan.org.in-এর সক্রিয় সদস্যদের বেশিরভাগই একে অপরকে বাস্তবে দেখেনি! তারা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের নানা প্রান্তে – ভারত, জার্মানী, নরওয়ে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড ইত্যাদি নানা দেশে। ইন্টারনেট আজ বিশ্বের এক বড় অংশের মানুষের সঙ্গী। স্যোশাল মিডিয়া থেকে ব্যাঙ্কের লেনদেন – সবই হয় ইন্টারনেটে। কিন্তু, এই ইন্টারনেটের আবিষ্কার কোথা থেকে হল? আশ্চর্য হলেও সত্যি যে যুগান্তকারী অন্যান্য বহু আবিষ্কারের মতই ইন্টারনেটও আবিষ্কার হয়েছে মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণার হাত ধরেই। মৌলিক বিজ্ঞান মানে যে গবেষণার উদ্দেশ্য কোন যন্ত্র বানানো নয়, অজানাকে জানার আনন্দে জ্ঞান আহরণ এবং মনের মধ্যে বুদবুদের মত উঠতে থাকা এক একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। যেমন মহাবিশ্বের উৎপত্তি কোথা থেকে হল? মহাবিশ্ব কি দিয়ে তৈরি? আপাতভাবে ‘অকাজের’ এই বিজ্ঞানের হাত ধরেই আসে ‘কাজের’ আবিষ্কার। যেমন এসেছে ইন্টারনেট। সুপ্রতীক পাল লিখছেন সে কথা।

এই সংখ্যার এক অন্যতম আকর্ষণ অভিনব কিছু কার্টুন। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক কৌশিক দাস আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশানের এক অভিনব প্রোজেক্টের প্রধান। হাই স্কুল এবং কলেজের শুরুর দিকে বহু ছাত্রছাত্রী পদার্থবিজ্ঞানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কনসেপ্ট ভুলভাবে বোঝে। যেমন বল বা ফোর্স আর গতি নিয়ে বহু ভুল ধারণা তৈরি হয়। সেই ধরণের কিছু প্রশ্ন কার্টুনের আকারে তৈরি করা হল এই অভিনব প্রোজেক্টের উদ্দেশ্য। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে বাংলাতেও আমরা সেই প্রশ্নগুলোর অনুবাদ করার সুযোগ পেয়েছি। প্রশ্নগুলো পাঠককে ভাবাবে, ছাত্রছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকা নির্বিশেষে। প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হল না ইচ্ছে করেই, যাতে প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা হয় সবার মধ্যে, যেমন ভাবে আমরা চায়ের দোকানে কোনো আকর্ষণীয় বিষয় নিয়ে তুমুল তর্কে মেতে উঠি, ও যুক্তি দিয়ে অন্যের মত খণ্ডন করার চেষ্টা করি ঠিক সেই ভাবে। ‘বিজ্ঞান’-এর ইমেইলে (bigyan.org.in@gmail.com)-এ প্রশ্নগুলোর উপর আলোচনা, উত্তর, বা প্রতিপ্রশ্ন পাঠানোর আহ্বান জানাই। সম্পাদকমন্ডলীর পছন্দের আলোচনা পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হতে পারে।

এছাড়াও থাকছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় বিজ্ঞানের প্রবন্ধ। মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার, সোঁদা গন্ধের পিছনে বৈজ্ঞানিক রহস্য, ময়ূরের পেখম রহস্য, বালি ও তার অদ্ভুত ধর্ম ইত্যাদি। সেই সাথে bigyan.org.in-এর পাঠকের পাঠানো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এক প্রশ্ন ‘নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে কি তৃতীয় সূত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়?’-এর উত্তর দিয়েছেন প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক জয়ন্ত ভট্টাচার্য। এই সব জমাটি বিজ্ঞানকথা নিয়েই যাত্রা শুরু হল ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকার মুদ্রণ সংস্করণের!

প্রাপ্তি স্থান:

রয়্যাল আই টি আই,

প্রফেসর কলোনি, কন্টাই,

পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ – ৭২১৪০৪

যোগাযোগ নং – ৯৪৩৪০০৫৭৫৭, ৯৪৩৪৯৯১৯১৫

ইমেইল – baruncontai@gmail.com,

মূল্য: ৩০ টাকা

The post এবার ‘বিজ্ঞান’ মুদ্রিত সংস্করণে! appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ থেকে প্লাজমা

$
0
0

সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড ইস্টার্ন শোর-এর কিছু গবেষক একটা মাইক্রোওয়েভ-এর মধ্যে পদার্থের প্লাজমা অবস্থাকে ধরাশায়ী করলেন। তাঁরা কিভাবে করলেন এই কাণ্ড?


কঠিন, তরল, গ্যাস এবং…

কঠিন, তরল, গ্যাস — ইস্কুলের পাঠ্যক্রমে পদার্থের এই তিনটে অবস্থার সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। এই তিন অবস্থার নমুনা আমাদের সর্বত্র রয়েছে। যখন যেমন প্রয়োজন, তিনটে অবস্থাকেই ধরাশায়ী করা যায় এবং পরীক্ষায় ফেলা যায়। কিন্তু এর বাইরেও পদার্থের একটা চতুর্থ অবস্থা হয়। সচরাচর তার কথা আমরা শুনি না। কারণ পৃথিবীতে কোনো পদার্থকে স্বাভাবিকভাবে এই অবস্থায় পাওয়া যায়না।

এই অবস্থার নাম প্লাজমা। যেভাবে কঠিন থেকে তরল হয় এবং তরল থেকে গ্যাস, সেই দিকে আরো এগোতে থাকলেই একসময় পদার্থের এই অবস্থা তৈরী হয়। কঠিন বস্তুকে তরল অবস্থাতে নিয়ে যেতে গেলে বাইরে থেকে শক্তি সরবরাহ করতে হয়, সাধারণত তাপ শক্তির মাধ্যমে। গলনাঙ্কে পৌছলে এই শক্তি কঠিন পদার্থের মধ্যে আন্তরাণবিক বন্ধনগুলো পট পট করে ভেঙে দেয়। আর যেহেতু এই যোগান দেওয়া শক্তির পুরোটাই এই বন্ধন ভাঙতে ব্যবহার হয়ে যায়, পুরো অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত বস্তুর তাপমাত্রা আর বাড়ে না। অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেলে অণু /পরমাণুগুলো একটু শিথিল হয়ে ঘোরাফেরা করতে পারে। সেই অবস্থাকেই তরল বলি। একইভাবে তরল থেকে গ্যাস অবস্থার পরিবর্তনও শক্তি সরবরাহের ফলেই সম্ভব হয়।

প্লাজমাও ঐভাবেই আসে। যদি আমরা গ্যাসে আরো শক্তি সরবরাহ করে যাই, তাহলে এক সময় অণুপরমাণুর ইলেক্ট্রনগুলো সেই শক্তি নিয়ে নিউক্লিয়াস-এর বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধান (charge) তৈরী হয়। এই ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধানগুলো যদি আবার তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের (electromagnetic field) মধ্যে থাকে তাহলে তড়িৎক্ষেত্রের প্রভাবে সেগুলোর ভরবেগ বাড়তে থাকে ও সেগুলো অন্যান্য অণু পরমাণুর উপর আছড়ে পড়ে। সেখান থেকে আরো ইলেক্ট্রন বেরিয়ে আসে। এগুলোকে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত ইলেক্ট্রন বলে। এই দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত ইলেক্ট্রনগুলোও আবার গতিসঞ্চার করে আছড়ে পড়ে তৃতীয় পর্যায়ভুক্ত ইলেক্ট্রন তৈরী করে। এটাকেই টাউনসেন্ড ধ্বস (Townsend discharge) নামা বলে। এই ধ্বস নামার ফলে হুড় হুড় করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সমস্ত গ্যাস ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধানের স্যুপে পরিণত হয়। এটাই প্লাজমা। যেহেতু পদার্থের তৃতীয় অবস্থার উপর শক্তি সরবরাহের ফলে এই নতুন অবস্থা তৈরী হয়, যার চরিত্র অন্য তিন অবস্থার থেকে আলাদা, প্লাজমাকে আমরা পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলি।

প্লাজমা তৈরীর হ্যাপা

এমন দানবিক শক্তি যা অণুর থেকে ইলেক্ট্রনকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়: এতো শক্তির যোগান হয় কোত্থেকে? এক হয় সূর্য এবং অন্যসকল নক্ষত্রের মধ্যে। অত্যধিক তাপমাত্রার ফলে সমস্ত পদার্থই সেখানে প্লাজমা অবস্থায় থাকে। কিন্তু পৃথিবীর ওপর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্লাজমা তৈরী হওয়া একটা বিরল ঘটনা। যেমন, বিদ্যুৎ চমকালে ক্ষণিকের জন্য বাতাসের অণুগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে প্লাজমা অবস্থার সৃষ্টি হয়।

কিন্তু গত একশো বছর ধরে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে পদার্থের এই অবস্থা তৈরী করে আসছেন। কখনো তারা প্লাজমাকে কাজে লাগাচ্ছেন আলোর উৎস হিসেবে (নিওন আলো আদতে প্লাজমা), আবার কখনো প্লাজমা ব্যবহার করে বিভিন্ন বস্তুর উপরিতলের চরিত্র পাল্টে ফেলা হচ্ছে।

করোনা ডিসচার্জ-এর সময় বাতাসের প্লাজমা অবস্থার স্পেকট্রাম (বর্ণালী), যেটা মিলে যাচ্ছে গবেষণাগারে তৈরী বাতাসের প্লাজমা অবস্থার স্পেকট্রাম-এর সাথে।

যেহেতু প্লাজমা সৃষ্টি করা এবং সামলানো বেশ দুরূহ কাজ, তাই কারখানার যন্ত্রপাতি বা বিশেষ কিছু গবেষণাগারের বাইরে এর প্রচলন হয়নি। এই যখন অবস্থা, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইস্টার্ন শোর) কৌশিক দাস ও তার সহকর্মীরা মাঠে নামলেন। রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ-এ বানিয়ে ফেললেন পদার্থের প্লাজমা অবস্থা। এই আবিষ্কারের ফলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটা দিগন্ত খুলে গেল বলা যায়। সুলভে প্লাজমা অবস্থার ওপর পরীক্ষা করা এখন অনেকের নাগালের মধ্যে এসে গেল। কি জানি, হয়তো পদার্থের এই অবস্থার অনেক নতুন প্রয়োগ বেরোবে এবার।

সুলভে প্লাজমা

আগেই যেটা বললাম, প্লাজমা তৈরী করতে বিপুল শক্তির তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনের ধ্বস নামাতে হয়। কৌশিক দাস এবং সহকর্মীরা এইটাই একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেনের মধ্যে সম্পন্ন করেছেন। মাইক্রোওয়েভ ছাড়াও প্রয়োজন হয়েছিল একটা সস্তার কাঁচের ফ্লাস্ক যাতে মোটামুটি ভ্যাকুয়াম-এর কাছাকাছি অবস্থা সীল করে ধরে রাখা যায়।

একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন-এ একটা দীর্ঘ তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরী হয়, ১২ সেন্টিমিটারের কাছাকাছি। এই তরঙ্গের উপস্থিতিতে কোনো দ্বিমেরু অণু (polar molecule) থাকলে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। দ্বিমেরু অণু অর্থে এমন অণু যাতে ধনাত্মক আর ঋণাত্মক আধান কেন্দ্র আলাদা আলাদা হয়ে দুই ধারে সরে গেছে।

যেমন, জলের অণু। একটা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গে তড়িৎ-ক্ষেত্রের (electric field) দিশা সময়ের সাথে পরিবর্তন হতে থাকে: একটা আধানযুক্ত কণা থাকলে তাকে এই দূরে ঠেলবে তো এই কাছে টানবে। একটা গোটা জলের অণু আধানযুক্ত নয় কিন্তু বিপরীত আধানের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে (অর্থাৎ দ্বিমেরু)। একটা স্থির তড়িৎ-ক্ষেত্রে এই ধরণের দ্বিমেরু অণুরা ক্ষেত্রের দিশার সাথে লম্বালম্বিভাবে নিজেদের সাজায়। কিন্তু সেই দিশাই যখন স্থির নয়, তখন সেই চেষ্টা বৃথা। তড়িৎ-ক্ষেত্রের দিশাকে ধাওয়া করতে গিয়ে জলের অণু অনন্তকাল চড়কিপাক খায়।

তড়িৎ-ক্ষেত্রের সাথে জলের অণুর দিশা পরিবর্তনের চেষ্টা।

বা চড়কিপাক খেত যদি না অন্যান্য জলের অণুর সাথে ঠোকাঠুকি লাগতো। এই ঠোকাঠুকিতে কিছুটা দম হারিয়ে ফেলে তারা। কিন্তু জলের অণুর সংখ্যা কমিয়ে ঠোকাঠুকির সম্ভাবনা নামিয়ে দিলে এক একটা অণুর ঘূর্ণনগতি রাতারাতি বাড়িয়ে দেওয়া যায়। এক সময় ঘূর্ণনশক্তি এতটাই বেড়ে যায় যে অন্য অণুর সাথে ধাক্কা লাগলে সেই অণুর থেকে ইলেক্ট্রন ছিটকে বেরিয়ে আসে। সৃষ্টি হয় প্লাজমা-র।

অণুর সংখ্যা কমাতে বিজ্ঞানীরা ফ্লাস্ক থেকে হাওয়া বার করতে থাকলেন। যে গ্যাসটা পড়ে থাকে, তা মূলত নাইট্রোজেন আর অক্সিজেন সম্পন্ন হলেও জলের অণু গুটিকয়েক থাকে। এই ফ্লাস্কটা মাইক্রোওয়েভ-এ ঢুকিয়ে চালু করে দেওয়া হলো। যদি সঠিক বায়ুচাপ তৈরী হয়ে থাকে অর্থাৎ অণুর সংখ্যা যদি যথেষ্ট কমে থাকে, তাহলে কাঙ্খিত ঘটনাবলী ঘটবে। মাইক্রোওয়েভ-এর তড়িৎ-ক্ষেত্রে দ্বিমেরু জলের অণু ঘুরতে থাকবে, তার গতিশক্তি কিছুটা নাইট্রোজেন অণুতে পরিচালিত হবে এবং ইলেক্ট্রন-এর ধ্বস নামবে।

এই পদ্ধতিতে তৈরী হওয়া প্লাজমা একটা হালকা নীল আলোর মাধ্যমে তার উপস্থিতি জানান দেয়। সেটা কয়েক সেকেন্ড-এর জন্য। এই নীল আলো নাইট্রোজেন প্লাজমার লক্ষণ। এরপর অক্সিজেন অণু থেকে ইলেক্ট্রন বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এর ফলে খুব তাড়াতাড়ি নীল আলো বেগুনিতে পরিবর্তিত হয়। বেগুনি আলো অক্সিজেন প্লাজমার চরিত্রগত সাক্ষর বহন করে।

পুরো পদ্ধতিটা নিচের এই ভিডিও থেকে দেখতে পাবে।

ফ্লাস্ক-এ বায়ুচাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করার পর একসময় বিজ্ঞানীরা এই আলো দেখতে পেলেন। বায়ুচাপটা কিন্তু সঠিক হওয়া জরুরি। কারণ খেয়াল করো, কথাচ্ছলে দুটো উল্টো কারণের কথা বলেছি আমরা। বায়ুচাপ অর্থাৎ অণুর সংখ্যা কম হতে হবে যাতে গাদাগাদি না হয়। জলের অণুর যেন গতিবৃদ্ধির জায়গা থাকে, অন্যান্য অণুর সাথে ঠোকাঠুকি যেন তাতে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। আবার এই ঠোকাঠুকির মাধ্যমেই তো ধ্বস নামে। তাই অণুর সংখ্যা এতো কম হলেও চলবে না যে সেই ধ্বস একেবারেই না হয়। বিজ্ঞানীরা লিখেছেন যে এই দুটো অবস্থার মাঝামাঝি বায়ুচাপে প্লাজমা তৈরী সম্ভব।

প্লাজমার ম্যাজিক

এখানেই শেষ নয়। প্লাজমা-র মাধ্যমে যেসব কাণ্ডকারখানা ঘটানো গেছে বিশেষ ল্যাবরেটরিতে, সেটা এই মাইক্রোওয়েভ ওভেন-এ তৈরী প্লাজমাতেও যে করা সম্ভব, সেটা দেখালেন বিজ্ঞানীরা। পলি-ডাইমিথাইলসিলক্সেন বা PDMS নামে একটা পলিমার-এর উপরিতলের চরিত্র পাল্টে ফেলা গেল প্লাজমা-র সাহায্যে।

সাধারণত PDMS জলের বন্ধু (hydrophillic)। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড প্লাজমার ভিতর রাখলেই সে জলকাতর (hydrophobic) হয়ে পড়ে। এই বিশেষ চরিত্রের একটা পরিমাপও রয়েছে। এক ফোঁটা জল পলিমার-এর ওপর ফেললে জলের ফোঁটার সাথে পলিমার-এর উপরিতলের কোণ মাপা যায়। প্লাজমা-র সংস্পর্শে আসার আগে এই কোণের মান ৬৪ ডিগ্রী। আর পরে ১৩৪ ডিগ্রী। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, মাইক্রোওয়েভ প্লাজমার আধানযুক্ত আয়নগুলো পলিমার-এর মধ্যে গেঁথে যায় এবং সাথে সাথে পলিমারের মধ্যে যে জলের কণা আছে তাদেরকে উত্তপ্তও করে। এই দু-এর প্রভাব পলিমারকে জলকাতর বানিয়ে দেয়।

এরকম আরো কয়েকটা ভেলকি দেখানো যায় প্লাজমার সাহায্যে। বিভিন্ন বস্তুর উপরিতলকে আঠালো করে দেওয়া যায়, এমনকি তার বিদ্যুৎপ্রবাহ ক্ষমতার পরিবর্তন করা যায়।

আর এসব করতে এখন লাগবে শুধু রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ ওভেন। অতএব ইস্কুলের ল্যাবরেটরিতে কিংবা ঘরের মধ্যেও প্লাজমা নিয়ে নাড়াচাড়া করা সম্ভব হবে, এমনই আশা করছেন গবেষকরা।

তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:

  1. গবেষণার মূল পেপারটি এখানে পাবে: Plasma Generation by Household Microwave Oven for Surface Modification and Other Emerging Applications
  2. লেখাটি মূলত MIT Technology Review-এর এই লেখা থেকে অনুবাদ করা: How to turn a kitchen microwave into a plasma-etching device
  3. যেমন বললাম, তাপ ছাড়াও তড়িৎ শক্তি প্রয়োগ করে ইলেক্ট্রনগুলোকে নিউক্লিয়াস-এর প্রভাব থেকে মুক্ত করা যায় ও প্লাজমা তৈরী করা যায়। এটাই প্লাজমা টিভির প্রাণ ভোমরা। Glow Discharge টিউবে প্লাজমা নিয়ে হাতে কলমে পরীক্ষা করতে চাইলে বাড়িতে বসেও এই লিংকের মাধ্যমে করতে পার: Remote Glow Discharge Experiment (RGDX) । প্রিন্সটন প্লাজমা ফিজিক্স ল্যাবরেটরীতে এই Glow Discharge টিউব রাখা আছে ও সামনে একটা ওয়েব ক্যাম রাখা আছে। প্লাজমা তৈরী হওয়া তোমরা দেখতে পাবে আবার নিজেরা ঘরে বসেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারবে।
  4. সাধারণ পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন তোমরা এই সিমুলেশন থেকে দেখতে পার: States of Matter: Basic

 

 

The post রান্নাঘরের মাইক্রোওয়েভ থেকে প্লাজমা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

বিজ্ঞানের গুরুত্ব

$
0
0

১৯৫৫ সালে ন্যাশনাল একাডেমী অফ সায়েন্স-এ বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান সমাজে বিজ্ঞান গুরুত্ব নিয়ে ওনার মনের কথা বলেছিলেন। কথাগুলো আজও সমানভাবে সত্যি।


মাঝেমধ্যেই আমাকে শুনতে হয় যে বিজ্ঞানীদের সামাজিক সমস্যা নিয়ে আরেকটু ভাবনাচিন্তা করা উচিত। বিশেষ করে, সমাজে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কি প্রভাব পড়তে পারে, সেই ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। আমার মতো অন্যান্য বিজ্ঞানীদেরও হয়তো এই কথাটা শুনতে হয়েছে। ভাবনাটা এরকম যে বিজ্ঞানীরা যদি একটিবার তাদের লঘু সমস্যাগুলোকে ছেড়ে সমাজের গুরুতর সমস্যাগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় তাহলে অভূতপূর্ব সাফল্য অপেক্ষা করে রয়েছে।

আমরা বিজ্ঞানীরা যে এইসব সমস্যা নিয়ে একদম মাথা ঘামাই না, তা নয়। কিন্তু কখনোই পুরোদমে লেগে থাকি না। এর কয়েকটা কারণ আছে। প্রথমত আমরা কোনো জাদুমন্ত্র জানিনা যে সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামালেই তার সমাধান বেরোবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক সমস্যাগুলো বৈজ্ঞানিক সমস্যার থেকে অনেক বেশি প্যাঁচালো। যতবার এগুলোকে বাগে আনার চেষ্টা হয়েছে, খুব বেশিদূর এগোনো যায়নি।

আমার মনে হয়, অবৈজ্ঞানিক সমস্যা নিয়ে ভাবতে বসলে একজন বিজ্ঞানীর আর পাশের বাড়ির ছোকরার কোনো তফাৎ থাকে না। সামাজিক সমস্যা নিয়ে মুখ খুললে দুজনকেই সমান আনাড়ি লাগে। সমাজে বিজ্ঞানের গুরুত্বের প্রশ্নটাও যেহেতু মোটেই বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন নয়, সেই নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে আমি হয়তো নিজেই নিজের কথা প্রমাণ করবো।

যাইহোক, বিজ্ঞানের একটা দানের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। বিজ্ঞানের দৌলতে হাজারো জিনিস বানাতে পারি আমরা, করতে পারি অনেক কিছু। অবশ্যই সবটা বিজ্ঞানের কৃতিত্ব নয়। যখন বৈজ্ঞানিক সৃষ্টি কোনো ভালো কাজে লাগাই, সেটা আমাদের মূল্যবোধেরও পরিচয় দেয়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ভালোমন্দ দুয়েই লাগতে পারে কিন্তু কিভাবে তার ব্যবহার হবে, সেই নির্দেশাবলী বিজ্ঞান দেয় না। তার ক্ষমতাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে সমাজের কল্যাণ হবেই কিন্তু অপপ্রয়োগে উল্টোটাও হতে পারে।

এটা মানবজাতির একটা সমস্যা। একবার হনোলুলু-তে বেড়াতে গিয়ে এই সমস্যাটাকে প্রকাশ করার একটা উপায় শিখেছিলাম। এক বৌদ্ধ মন্দিরে অধ্যক্ষমশাই যাত্রীদের বৌদ্ধধর্ম নিয়ে একটু ভূমিকা দিচ্ছিলেন। শেষে বললেন যে এমন একটি কথা বলতে চলেছেন যা কেউ কখনো ভুলতে পারবে না। আমি ভুলিওনি। বৌদ্ধধর্মেরই একটা প্রবাদ:

“সবার কাছেই স্বর্গের চাবিকাঠি দেওয়া আছে কিন্তু ওই চাবিতে নরকের দুয়ারও খোলে।”

তাহলে আর স্বর্গের চাবিকাঠি পেয়ে কি লাভ হলো? লাভ আছে। যদিও কোনটা স্বর্গের দরজা, কোনটা নরকের, সেটা না জানলে ওই চাবিটা ব্যবহার করা বিপজ্জনক, তাই বলে চাবিটার মূল্য তো অস্বীকার করা যায়না। ওটা না থাকলে স্বর্গে ঢুকবো কিকরে?

পথনির্দেশ যতই থাকুক, চাবি না থাকলে কিছুই হবে না। তাই যদিও বিজ্ঞানের হাত ধরে সমাজে চূড়ান্ত সর্বনাশ এসেছে, তবু তাকে ফেলা যায়না কারণ বিজ্ঞানের হাত ধরে অন্তত কিছু একটা করার সম্ভাবনা থাকে।

বিজ্ঞানের আরেকটা অবদান হলো মস্তিষ্কচর্চার সুযোগ। কিছু লোক বিজ্ঞান পড়ে, তার থেকে শিখে কিংবা সেই নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে অপার আনন্দলাভ করে। আবার কিছু লোকে হাতেকলমে বিজ্ঞানচর্চা করে সেই আনন্দের খোঁজ পায়। এই মস্তিষ্কচর্চার ব্যাপারটাকে কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অথচ বিজ্ঞানের সামাজিক প্রভাব নিয়ে যারা বিজ্ঞানীদের আরো সচেতন হতে বলে, তাদের এই দিকটা নিয়ে ভাবতে খুব একটা দেখিনা।

এই ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির কি গোটা সমাজের জন্য কোনো মূল্য আছে? একদমই নেই। কিন্তু এখানে সমাজের কেন প্রয়োজন, সেকথাও ভাবতে হবে। শেষমেশ সমাজ কি সকলের ব্যক্তিগত উপভোগের জন্য একটা জটিল আয়োজন নয়? তাই যদি হয়, তাহলে বিজ্ঞানচর্চার আনন্দ আর পাঁচটা উপভোগ্য বস্তুর থেকে কোনো অংশে কম নয়।

তবে এখানেই শেষ নয়। বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার ফলে মানবজাতির যে দৃষ্টিভঙ্গী তৈরী হয়েছে, সেটাকেও কোনোভাবে আড়াল করতে চাই না। পুরাকালের কবি কিংবা দূরদর্শী যা কল্পনাও করতে পারতো না, আজকে সেসব আমরা অনায়াসে ভাবতে পারি। আমরা দেখেছি যে প্রকৃতির কাছে আমাদের কল্পনাশক্তি কতটা তুচ্ছ। ভেবে দেখুন, কোনটা বেশি আশ্চর্যের: একটা তলহীন সমুদ্রে সাঁতার কাটছে একটা কচ্ছপ, তার উপর একটা হাতি, তার পিঠে রয়েছি আমরা1, নাকি একটা অজানা আকর্ষণের বলে কয়েক কোটি বছর ধরে ঘুরতে থাকা একটা গোলকের সাথে আমরা সেঁটে আছি, তাও আবার অর্ধেকজন হেঁটমুণ্ড হয়ে ঝুলে?

এই বিষয়টা নিয়ে আমি একান্তে অনেক ভেবেছি। সেইসব ভাবনার কথা বলতে গিয়ে হয়তো এমন কথার পুনরাবৃত্তি করছি যা আপনারাও নিশ্চয় ভেবেছেন। ভাবতে পেরেছেন কারণ আপনাদের সেইসব তথ্য জানা আছে যা অতীত মানুষের কাছে ছিল না।

এই যেমন ধরুন, আমি যখন সমুদ্রতীরে যাই, সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবতে শুরু করি।

সামনে বহমান ঢেউ, অণুর পাহাড়, যে যার নিজের কাজেই মত্ত, পরস্পরের থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন, অথচ সবাই মিলে একসাথে একটাই সাদা ফেনা তৈরি করছে।

বছরের পর বছর ধরে, যখন কোন দৃষ্টি তাকে স্পর্শ করেনি, সময়ের আপন বহমানতায় সে তীরে এসে আজকের মতই আছড়ে পড়েছে। কার জন্য, কিসের জন্য? একটা মৃত গ্রহে যেখানে প্রাণের সম্ভাবনা অনিশ্চিত।

বিরামহীন, শক্তি তাড়িত, সূর্যের আদরে লালিত, শূন্যের মাঝে এই সৃষ্টি। বিন্দু বিন্দু জুড়ে সমুদ্রের এই মহাগর্জন।

সমুদ্রগর্ভে একই অণু থরে থরে সাজানো, এর মধ্যে থেকেই নতুন জটিলতর অণুর সৃষ্টি হয়। ক্রমে এরা নিজেদের আদলে আরো অণু তৈরী করে, শুরু হয় একটি নতুন নৃত্য।

ক্রমে বাড়ে আয়তন, জটিলতা। আসে প্রাণের স্পন্দন, পরমাণুর ঢিবি, ডিএনএ, প্রোটিন, নাচের কারুশিল্প হয় আরো সূক্ষ্মতর।

হামাগুড়ি দিতে দিতে তারা আসে ডাঙায়। দুপায়ে ভর করে দাঁড়ায়, সচেতন পরমাণুর ঝুলি, কৌতহুলী দৃষ্টি মেলে।

শেষে তারা দাঁড়ায় এসে সমুদ্রের তীরে, নিজের বিস্ময় নিয়েই বিস্মিত হয়, তাদের একজন আমি, এক বিশ্ব পরমাণু নিয়ে গড়া অথচ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাঝে একটা পরমাণুরই সামিল।

সর্বসেরা অ্যাডভেঞ্চার

এই রোমাঞ্চ, প্রকৃতির বিশালতার সম্মুখে এই বিস্ময়, এটা বারে বারে আসে যখন কোনো সমস্যার তলদেশে আমরা পৌঁছতে পারি। যত জানতে পারি, রহস্য তত ঘনীভূত হয়, হাতছানি দিয়ে আরো ভিতরে টানে। হতাশার সম্ভাবনাকে ভ্রূক্ষেপ না করে হাসিমুখে বুক ফুলিয়ে মাঠে নামি। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখি কোথায় কি অভাবনীয় অদ্ভুত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে। জাগে নতুন প্রশ্ন, নতুন রহস্য। এ এক অ্যাডভেঞ্চার নয়তো কি?

এরকম ঐশ্বরিক অভিজ্ঞতা বিজ্ঞান না জানলে চট করে আসে না। আমাদের কবিরা এই নিয়ে লেখে না। আমাদের শিল্পীরা এই রোমাঞ্চকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা না। এরকমটা কেন হয়, আমি বুঝি না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে ছবি আমরা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে জানতে পেরেছি, সেটা কি তাদের অনুপ্রেরণা যোগায় না? বিজ্ঞানের দুর্মূল্য উপহারের কথা চারণকবিদের মুখে মুখে ফেরে না। তাই আপনাদের পোড়া কপাল যে কাব্য কিম্বা গানের পরিবর্তে সান্ধ্য লেকচারে তার কথা শুনতে হয়। নাহ, এখনো এই যুগটাকে বিজ্ঞানের যুগ বলার সময় আসেনি।

এর একটা কারণ হতে পারে, আপনাকে এই ছন্দটা পড়তে শিখতে হবে, সেই শিক্ষার অভাবে একে চিনতে পারছেন না। ধরুন, একটা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে এরকম কিছু একটা লেখা হলো: “একটা ইঁদুরের মস্তিষ্কের সেরেব্রাম অঞ্চলে তেজস্ক্রিয় ফসফরাস-এর পরিমাণ দু সপ্তাহে অর্ধেক হয়ে যায়।” এই কথাগুলোর মানে কি?

এর মানে হলো, একটা ইঁদুরের মস্তিষ্কে দু’সপ্তাহ আগে যে ফসফরাস ছিল (বা আপনার আমার মস্তিষ্কে ছিল), সেগুলো আজকে আর নেই2। মস্তিষ্কের পরমাণুগুলো প্রতিনিয়ত পাল্টে ফেলা হচ্ছে।

তাহলে মস্তিষ্কটা আসলে কি, পরমাণুদের মাধ্যমে চেতনা আসে কোত্থেকে? সত্যিই আশ্চর্যের! গত সপ্তাহে যে আলু খেয়েছিলাম, সেটা কোনোভাবে মনে রাখছে এক বছর আগে আমার মাথায় কি ঘুরছিলো। যে মাথাটার আর কিছুই আজ অবশিষ্ট নেই।

অর্থাৎ, যখন বৈজ্ঞানিকরা আবিষ্কার করেন কতক্ষণে মস্তিষ্কের পরমাণুগুলো বদলি হয়ে যায়, সে খবরটাকে এইভাবে পড়তে হবে। লক্ষ্য করতে হবে যে আমার আমিত্বটা শুধুই পরমাণুর একটা সজ্জা, তার মধ্যের পরমাণুগুলোর কোনো স্থায়িত্ব নেই। একটু আগে যে নৃত্যেভঙ্গিমার কথা বললাম, এ স্রেফ তাই। পরমাণুগুলো মস্তিষ্কে আসে, তাদের নৃত্য সেরে বেরিয়ে যায়। নতুন পরমাণু কিন্তু নৃত্যের ছন্দটা একই থেকে যায়।

আইডিয়ার চমক

তবে খবরের কাগজে লেখা থাকে এইরকমভাবে: “অমুক বিজ্ঞানী বললেন যে এই আবিষ্কার ক্যান্সার চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে।” এইসব কাগজের একটা আইডিয়ার ব্যবহার নিয়েই যত মাতামাতি, আইডিয়াটা নিয়ে নয়। সেটা যে আসলে কি বলছে, প্রায় কারোরই চোখে পড়ে না। কয়েকজন ছাত্র বাদে। একজন ছাত্র শিশু অবস্থায় এরকম একটা আইডিয়া ধরতে পারলে ওইখানেই একজন বিজ্ঞানী তৈরী হয়ে যায়। যতই বলি না কেন টিভি দেখে দেখে চিন্তাশক্তির বারোটা বাজছে, এইসব আইডিয়া মগজের ফাঁকফোকল দিয়ে ঠিকই গলে যায়। ধোঁয়াটে অবস্থায় হলেও শিশুরা তার সারবস্তু আয়ত্ত্ব করতে পারে আর সেটা হলেই আপনি ভবিষ্যতের একজন বিজ্ঞানীকে পেয়ে গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি আসতে বড্ড দেরি হয়ে যায়, তাই ছোটবেলা থেকেই এইসব আইডিয়া তাদের বোঝাতে হবে3

এবার আমি বিজ্ঞানের আরেকটা অবদানের কথা বলতে চাই। এটা কিছুটা পরোক্ষ তবে খুব বেশী নয়। অজ্ঞতা, সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা, একজন বিজ্ঞানী এই তিনটে অবস্থার সাথে খুবই পরিচিত। এইটে খুব জরুরি বলে আমি মনে করি। একজন বিজ্ঞানী যখন উত্তর জানে না, সে অজ্ঞ, যখন একটা উত্তরের আভাস পাচ্ছে, সে অনিশ্চিত আর যখন মোটামুটি উত্তরের ব্যাপারে সুনিশ্চিত, তখনও তার মনে দানা বেঁধে আছে সন্দেহ। আমরা বিজ্ঞানীরা বুঝেছি যে এগোতে হলে এই অজ্ঞতাকে স্বীকার করতে হবে, এই সন্দেহের জন্য জায়গা রাখতে হবে। একইরকমভাবে, আজকের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানে যে কথাগুলো বলা আছে, তার সবটা নিয়ে সমান নিশ্চয়তা প্রকাশ করা যায়না। কিছু একদমই অনিশ্চিত, কিছু প্রায় নিশ্চিতভাবেই ঠিক, কিন্তু কোনটাই প্রশ্নের আওতার বাইরে নয়।

এই অনিশ্চয়তার সাথে আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। আমরা ধরেই নিয়েছি যে সবটা নিশ্চিতভাবে না জেনেও দিব্যি চলাফেরা করা যায়, এর মধ্যে কোনো স্ববিরোধ নেই। কিন্তু আমি জানি না সবাই এটা বোঝে কিনা। আমাদের এই সন্দেহ করার স্বাধীনতা এসেছে বিজ্ঞানের শুরুর দিনগুলো থেকে যখন কর্তৃপক্ষের সাথে সমানে যুঝতে হতো। সে বড়ো গভীর সংগ্রাম ছিল। আর কিছুই চাই না, শুধু প্রশ্ন করতে চাই, এই নিশ্চয়তা থেকে বেরোতে চাই। সেদিনের সেই সংগ্রামের কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাহলে যা অর্জন করেছি, সেটাই হয়তো খোয়াতে বসবো। যাতে সেটা না হয়, সেখানেই সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ব।

যখন ভাবি মানুষের মধ্যে সম্ভাবনা কত আর আসলে কি করতে পেরেছে, মনখারাপ হয়ে যায়। বারবার মনে হয় কত বেশি কিছু করতে পারতাম। অতীতের মানুষ তাদের রাতের দুঃস্বপ্নের মধ্যে ভবিষ্যতের আশা খুঁজে পেত। আমরা তাদের সেই ভবিষ্যৎ। তাদের আশা মাঝেমধ্যে ছাপিয়ে গেছি বটে তবে বেশিরভাগই স্বপ্ন রয়ে গেছে। আজকে আমরা যা আশা করে বসে আছি, তার সিংহভাগই বিগত দিনেও আশা করে ছিলাম।

ভালোমন্দের শিক্ষা

একদা ভাবা হতো যে মানুষের মধ্যে সম্ভাবনাগুলো সাকার হয়নি কারণ বেশিরভাগ মানুষই অশিক্ষিত। কিন্তু সর্বশিক্ষা অভিযান সফল হলেই কি সবাই এক একজন ভলতেয়ার তৈরী হবে? কুশিক্ষাও তো দেওয়া যায় একই মাধ্যমে। শিক্ষার ক্ষমতা যতই হোক, তাকে ভালোমন্দ দুদিকেই পরিচালনা করা যায়।

তারপর একসময় ভাবা হলো সর্বত্র যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলে লোকে আরো বেশি বুঝতে শিখবে। কিন্তু এই ভাবনাতেও গণ্ডগোল আছে: যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তো কাঠি করা যায়, তাদের দাবিয়েও ফেলা যায়। যে কথাগুলো এই মাধ্যমে পাচার করা হচ্ছে, তা সত্যি মিথ্যে দুইই হতে পারে। তাই যোগাযোগব্যবস্থাও এমন একটা বাহন যাকে ভালোমন্দ দুদিকেই চালানো যায়।

ফলিত বিজ্ঞানগুলোর থেকে আশা ছিল তারা অন্তত মানুষকে দৈনন্দীন জীবনের ঝুটঝামেলা থেকে মুক্ত করবে। যেমন, ওষুধে অসুখ সারে। এখানে তো সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। অথচ দেখুন গিয়ে, কিছু লোক ভয়ানক মন দিয়ে এই ফলিত বিজ্ঞানেরই ইস্তামাল করছে মহামারী কিংবা মারণবিষ বানাতে। কালকের যুদ্ধে এগুলোকে ছাড়া হবে।

যুদ্ধের কথাতেই আসা যাক। যুদ্ধ কেউ চায় না। সবার স্বপ্ন শান্তি। শান্তি বজায় থাকলে তবেই মানুষের পূর্ণ বিকাশ ঘটবে। কিন্তু কে বলতে পারে যে ভবিষ্যতে আমাদের মনে হবে না, এই শান্তিও ভালো মন্দ দুইই হতে পারে। হয়তো মানুষ তার শান্তিপূর্ণ জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে মদ্যপানের দিকে ঝুঁকবে। তখন হয়তো মদ্যপানের সমস্যাটা হবে সেই একটা সমস্যা যেটা পার হলেই মানুষ তার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারবে।

অথচ বিশ্বজুড়ে শান্তি, মদ্যপান থেকে বিরত থাকা, দৈনন্দীন জীবনের আরাম, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, আদর্শবাদীদের স্বপ্ন, সবই এক একটা সাংঘাতিক ক্ষমতা।

এবং এরকম ক্ষমতা আমাদের কাছে পূর্বপুরুষদের থেকে অনেক বেশি রয়েছে। হয়তো এর ব্যবহার করে আমরা কিছু উন্নতিও করেছি। কিন্তু এলোপাথাড়ি হাতড়ে হাতড়ে যেটুকু করেছি, তার থেকে অনেক, অনেক বেশি করার কথা ছিল।

এরকমটা কেন হলো? নিজেদের জয় করতে পারলাম না কেন?

কারণ ক্ষমতা যতই থাকুক, তাকে ব্যবহার করার উপায় সাথে সাথে আসেনা। যেমন ধরুন, প্রকৃতির আচরণ নিয়ে আমরা যত জেনেছি, ততই মনে হয়েছে তার মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই। বিজ্ঞান এই উদ্দেশ্যবিহীনতা থেকে উদ্ধার করতে আসেনি। ভালোমন্দ নিয়ে সে সরাসরি কিছুই শেখায় না।

সর্বকালেই মানুষ জীবনের অর্থ খুঁজতে হয়রান হয়েছে। তাদের মনে হয়েছে, শুধু যদি একটা অর্থ বা দিশা দেওয়া যেত আমাদের কাজকর্মগুলোকে, তাহলেই মনুষ্যজাতির মধ্যে নিহিত সম্ভাবনাগুলোর বাঁধ ভেঙ্গে যেত। তাই এই প্রশ্নের অনেক উত্তরও এসেছে। কিন্তু সে উত্তর নানারকমের। যারা একটা বিশেষ উত্তরে বিশ্বাস করে, তারা আতঙ্কিত হয় আরেক দলের কাজকর্ম দেখে। অন্য দলের বিশ্বাসীরা মনুষ্যজাতির সব সম্ভাবনাকে একটা মিথ্যে অন্ধকূপে ঠেলে দিচ্ছে যে! সত্যি কথা বলতে কি, অন্ধ বিশ্বাসের বশে মানুষ যে ভয়াবহ সর্বনাশ করতে পারে, সেটা দেখেই হয়তো দার্শনিকরা মানুষের অসীম ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন। এবার খালি সঠিক পথটা দেখানোর অপেক্ষা।

কি সেই পথ? এই বিপুল আয়োজনের মানেই বা কি? কেন আছি, সেই রহস্যের কোনো সমাধান দেওয়া যায় কি?

আজ অব্দি যা জেনেছি যদি তাকে খতিয়ে দেখি — প্রাচীনকালের লোকেরা যা জানতো, যা তারা জানতো না অথচ আমরা আজ জানি — তাহলে একটা কথাই খোলাখুলি স্বীকার করতে হয়: আমরা ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো জানি না।

কিন্তু জানি না, এই কথাটা স্বীকার করেই হয়তো আমরা সেই সঠিক পথটা খুঁজে পেয়েছি।

এটা নতুন কথা বলছি না। যুক্তিবাদী সভ্যতার এটাই মূলমন্ত্র। এই দর্শনের হাত ধরেই আমাদের গণতন্ত্র এসেছে। যখন লোকে বুঝলো যে কোনো ব্যক্তিবিশেষ সরকার চালাতে জানে না, তখন এমন একটা ব্যবস্থা তৈরী হলো যাতে নতুন চিন্তাধারার জন্য সুযোগ তৈরী হতে পারে, সেগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে, আবার প্রয়োজনে ছুঁড়ে ফেলে অন্য কোনো চিন্তাধারাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। একদম যাকে বলে ট্রায়াল এন্ড এরর সিস্টেম। এটা সম্ভব হলো কারণ ওই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিজ্ঞানের সাফল্যের কিছুটা আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো। সমাজব্যবস্থা নিয়ে যারা ভাবনাচিন্তা করেন, তারা বুঝতে পারছিলেন যে সব জেনেশুনে বসে না থেকে সম্ভাবনার রাজত্বে পাড়ি দিলে লাভ বই ক্ষতি হবে না। সন্দেহপ্রকাশ এবং আলোচনার মাধ্যমেই অজানাতে উত্তরণ সম্ভব। যদি এমন সমস্যার সমাধান করতে চাই যা আগে করিনি, তাহলে সম্ভাবনার দরজাগুলো তো খোলা রাখতেই হবে।

বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব

এখনো আমরা মনুষ্যজাতির জন্মলগ্নেই আছি। তাই আমরা যে অনেক সমস্যা নিয়ে লড়াই করছি, সেটা স্বাভাবিক। আরো কত হাজার হাজার বছর আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। আমাদের উচিত যতটুকু সম্ভব করা, যতটা সম্ভব শেখা, গতকালের সমাধানগুলোকে একটু ঘষেমেজে পরের প্রজন্মকে চালান করে দেওয়া। কিন্তু ভবিষ্যতের মানুষকে ভাবনাচিন্তার স্বাধীনতা দিতে যেন না ভুলি, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। মনুষ্যজাতির কৈশোরে আমরা এমন ভুল করতে পারি যা আমাদের বিকাশকে অনেকদিনের জন্য আটকে দেবে। তার মধ্যে একটা ভুল হলো এখনই সব উত্তর জানার দাবি করা। এখন বয়েসই বা কত আমাদের! এখনই যদি সব আলোচনা সমালোচনা থামিয়ে দি, যদি বলি: “ব্যাস, এইখানেই শেষ! মানবজাতিকে উদ্ধার করলাম!”, তাহলে তো ভবিষ্যতের মানুষকে আমরা অনেকদিনের জন্য আমাদের তৈরী কয়েদে বন্দি করে দেবো। যে কয়েদ আমাদের সীমিত কল্পনাশক্তির দ্বারা আবদ্ধ। এরকমটা তো আগেও কতবার হয়েছে।

তাই বিজ্ঞানী হিসেবে আমাদের অবশ্য কর্তব্য এই অজ্ঞতার দর্শনকে মাথায় রেখে, চিন্তার স্বাধীনতাকে প্রচার করা। এইটা শেখানো যে মনে প্রশ্ন এলে তাকে ভয় পেতে নেই, বরং হাসিমুখে খোলাখুলি আলোচনা উচিত। এই চিন্তার স্বাধীনতাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের লক্ষ্য।

টিকা:

  1. এখানে ফাইনম্যান পুরাণের মহাজাগতিক কচ্ছপ বা কসমিক টার্টল-এর কথা বলছেন। বিভিন্ন সভ্যতার পুরাণে মহাবিশ্বের বাহক এই কচ্ছপকে দেখা যায়।
  2. ১৯৫৩ সালে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন-এর এক গবেষণায় রেডিও আইসোটোপ-এর সাহায্যে দেখানো হয়েছিল যে এক বছরের মধ্যে দেহের ৯৮ শতাংশ পরমাণু পাল্টে যায়। ফাইনম্যান সেই গবেষণার কথাই বলছেন।
  3. ফাইনম্যান পরবর্তীকালে বলেছেন: “আমি এখন বলবো যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে আসতে দেরি হয়ে যায়, তবু তাদের পক্ষে বিজ্ঞানের স্বাদ পাওয়া একেবারে অসম্ভব নয়।”

ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-র অনুমোদনে ফাইনম্যান-এর এই লেখাটি প্রকাশিত হচ্ছে। অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর স্বেচ্ছাসেবকরা।

The post বিজ্ঞানের গুরুত্ব appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

পরিবেশ পর্যবেক্ষণ প্রতিযোগিতা –২

$
0
0

প্রিয় বিজ্ঞানের পাঠকবন্ধুরা,

পরিবেশ পর্যবেক্ষণ প্রতিযোগিতার প্রথম পর্বে তোমাদের কাছ থেকে অনেক লেখা পেয়ে আমরা খুব উৎসাহিত হয়েছি। প্রত্যেকটা লেখাই অনবদ্য হয়েছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে দুটি লেখার লেখকদের নজরদারির জুড়ি মেলা ভার। কুমোরে পোকার বাসা বানানো পর্যবেক্ষণ করে পাঠিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় আর গাছের উপরে জড়িয়ে থাকা পরগাছার নজরদারি করেছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের নয়নমণি রায়। এরা দুজনেই পরিবেশ পর্যবেক্ষণ প্রতিযোগিতার প্রথম পর্বের বিজয়ী। নিচে তাদের পাঠানো লেখা, ছবি, ও ভিডিও তুলে ধরলাম তোমাদের জন্য।

প্রিয় পাঠকবন্ধুরা, আবার তোমাদের আহ্বান করছি ‘বিজ্ঞান’-এর দরবারে তোমাদের আশেপাশের প্রকৃতি থেকে  নানা পর্যবেক্ষণ পাঠাতে। পাঠাতে পারো লেখা, ছবি, বা ভিডিও। ছবি বা ভিডিও পাঠালে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও পাঠিও। তোমাদের পাঠানো লেখা, ছবি, ভিডিও থেকে সম্পাদকমন্ডলীর সবথেকে পছন্দের কয়েকটি পুরস্কৃত হবে ও ‘বিজ্ঞান’-এর পাতায় ছাপা হবে। লেখা, ছবি, বা ভিডিও পাঠানোর আগে নিচে দেওয়া নিয়মগুলো একটু পড়ে নিও। তোমাদের লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

নিয়মাবলী:

  1. লেখা, ছবি, বা ভিডিও পাঠাতে হবে ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯-এর মধ্যে।
  2. ই-মেইলে পাঠাও লেখা, ছবি, বা ভিডিও – bigyan.org.in@gmail.com । তোমাদের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ কর।
  3. ভিডিও পাঠাতে হলে, ভিডিওটিকে youtube এ তুলে তার লিংক আমাদের পাঠালে ভালো। আর ছবি পাঠালে ছবির ক্যাপশন দিতে হবে। youtube-এ ভিডিও তোলার পদ্ধতি দেখে নাও এই পাতায়: https://support.google.com/youtube/answer/57407 লেখাগুলি অনধিক ৩০০ শব্দের মধ্যে হতে হবে এবং প্রত্যেক সংখ্যার জন্য একেকজন কেবল একটা লেখাই পাঠাতে পারবে।
  4. থাকছে আকর্ষণীয় পুরস্কার। সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।

প্রথমপরিবেশ পর্যবেক্ষণ প্রতিযোগিতা ফলাফল

প্রথম ‘পরিবেশ পর্যবেক্ষণ প্রতিযোগিতা’-র বিজয়ীরা হল কলকাতা থেকে সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় ও চট্টগ্রাম থেকে নয়নমণি রায়। 

—–

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীতত্ত্ব বিভাগে পিএইচডি করছে। সে আমাদের কুমোরে পোকার বাসা তৈরির একটি ভিডিও ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাঠিয়েছে। সেই ভিডিও ও বর্ণনা রইল এখানে (ইউটিউব লিংক)।

ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে Sceliphron sp.  নামের এক mud dauber wasp কেমন নিখুঁত দক্ষতায়ে তার মাটির বাড়ি বানাতে ব্যস্ত।

কুমোরে পোকার বাসা

দরজার খাঁজে বাঁ জানলার কোণায়ে আমরা প্রায়শই কুমোরে পোকার বাসা দেখতে পাই। ভেজা মাটির ঢেলা দিয়ে নিখুঁত কায়দায়ে এই পোকারা তাদের বাসা বানায়। বোলতা প্রজাতির এইসব পোকাদের সবাইকে বাংলায়ে  “কুমোরে পোকা” বলা হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে এদের ভেতর প্রকারভেদ স্পষ্ট। যেসব কুমোরে পোকা কলসির মত কানা উঁচু গোলাকার বাসা বানায় তাদের ইংরাজিতে বলা হয় Potter Wasp (Vespidae family), আর যাদের বাসা হয় লম্বাটে তারা হল Mud Dauber Wasp (Sphecidae family)। দুই দল পোকাই তাদের মুখে করে কাদা মাটির ঢেলা বয়ে নিয়ে এসে এক আশ্চর্য কায়দায়ে তৈরি করে তাদের বাসা। সেই বাসায়ে তারা থাকেনা। বাসা বানানো শেষ হলে এই বোলতারা শিকারে বের হয়। Potter wasp শিকার করে শুঁয়োপোকা আর Mud dauber wasp ধরে আনে ছোট মাকড়সা। হুলের আঘাতে অর্ধমৃত এইসব শিকারদের দিয়ে বাসা ঠেসে ভর্তি  হয়ে গেলে বোলতারা প্রতি বাসায়ে একটা করে ডিম পেড়ে তারপর সেই বাসার মুখ আবার ভাল করে কাদা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরলে সে আগে সেই অর্ধমৃত সব পোকাদের খেয়ে গায়ে শক্তি যোগায় আর তারপর বাসার মুখের শুকনো শক্ত মাটি কেটে বাইরে বেরিয়ে আসে। এই খাবার ভরা বাসা বানিয়ে দেওয়ার পর সচরাচর মা বোলতা আর তার ছানার খবর নিতে ফিরে আসেনা। ছানা বড় হয়ে নিজের মত উড়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।

কুমোরে পোকার উপর ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত হয়েছিল ‘মায়েরা যেমন হয়কুমোরে পোকার সন্তান পালন’ – এই লেখাটি


নয়নমনি রায় বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে নিচের ছবি ও লেখা পাঠিয়েছে।

 

 

বর্ণনা –  গাছটির দিকে তাকাতেই মনে হবে,’ওরে বাবা! পাতার লোমে আবৃত এ কোন গাছ।’ কিন্তু ফেলুদার মত খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝা যাবে ঐ পাতাগুলো বড় গাছটির কোনো অংশ নয়। এগুলো এক ধরণের পরগাছা।এগুলোর নিজস্ব কান্ড রয়েছে যার সাথে মূল রয়েছে এবং মূল দ্বারাই এরা বড় গাছটি আকড়ে ধরে রাখে।খাদ্যও শোষণ করে মূলের সাহায্যেই।

দুই বিজয়ীকে অভিনন্দন জানাই। তোমাদের পুরস্কার হিসাবে একটি করে ফোল্ডস্কোপ ও একটি করে ‘বিজ্ঞান’ মুদ্রিত পত্রিকা ডাকযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফোল্ডস্কোপ সম্বন্ধে জানো এখানে

The post পরিবেশ পর্যবেক্ষণ প্রতিযোগিতা – ২ appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

কলকাতা বইমেলায় ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকা, ও অন্যান্য প্রাপ্তিস্থান!

$
0
0

‘বিজ্ঞান’-এর চলার পথে এক নতুন অধ্যায় যোগ হয়েছিল ডিসেম্বর ২০১৮ সালে। কন্টাই সায়েন্স অ্যাকাডেমীর সাথে হাত মিলিয়ে এই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মিউজিয়াম থেকে বাংলা রেডিওর কিংবদন্তী মীরের সাথে লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে অভিনব উপায়ে পত্রিকার উদ্বোধন হয় । ‘বিজ্ঞান’ মুদ্রিত সংখ্যায় ধরা থাকল bigyan.org.in-এ প্রকাশিত কিছু অনবদ্য লেখা। এছাড়াও লেখার ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে পাঠকের মধ্যের বিজ্ঞানীকে বার করে আনার কিছু সুযোগ।  যেমন প্রথমবারের জন্য বাংলা ভাষায় আত্মপ্রকাশ করল বিশ্ববিখ্যাত কার্টুনিস্ট ল্যারি গণিকের আঁকা কার্টুন যার মাধ্যমে মজার ছলে তুলে ধরা হল কিছু স্কুল পাঠ্যক্রমের পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্ন। কার্টুনগুলোতে উঠে এসেছে বাহুবলীর মত মজাদার কাল্পনিক চরিত্র।

‘বিজ্ঞান’-এর এই মুদ্রিত সংখ্যাটি পাওয়া যাবে ২০১৯ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের স্টলে। দাম পড়বে ভারতীয় মুদ্রায় ২৭ টাকা। হল নম্বর ২, স্টল নম্বর ৬৫। বইমেলার ৩ নম্বর গেট -এর কাছেই ২ নম্বর হল (Hall No. -2, Stall Number -65)।

এছাড়া পত্রিকাটি পাওয়া যাবে নিচের জায়গাগুলোতে –

  • মেদিনীপুর শহরে তা‍ঁতিগেড়িয়া লেবেল ক্রসিং এর কাছে ভূর্জপত্র বই দোকানে (সঙ্গম apartment এর বিপরীতে)।
  • কলকাতার কলেজ স্ট্রীট এর ১৩ বঙ্কিমচন্দ্র স্ট্রীট, কলকাতা ৭৩, দে বুক স্টোর এর বই দোকানে (দীপু)
  • কাঁথিতে প্রভাত কুমার কলেজের কাছে কুসুম বুক হাউসে ‘বিজ্ঞান’ পাওয়া যাবে।  চলভাষ – ৯৪৭৪৪০৫২৪১
ল্যারি গণিকের আঁকা এমন কিছু কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকায়! কপিরাইট – কৌশিক দাস ও ল্যারি গণিক, মেরীল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় (ইস্টার্ণ শ্যোর)

Bigyan.org.in-এর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই বসু বিজ্ঞান মন্দিরকে, বিশেষত অধ্যাপক গৌতম বসুকে। সেই সাথে কৃতজ্ঞতা জানাই কন্টাই সায়েন্স অ্যাকাডেমীর সদস্যদের, যাদের উৎসাহ ছাড়া এমন একটি মুদ্রিত সংস্করণ বের করা সম্ভব হত না। কৃতজ্ঞতা রইল মীর আফসার আলি ও তাঁর সহকর্মীদের, যাঁরা সম্পূর্ণ অব্যবসায়িকভাবে ‘বিজ্ঞান’-এর কথা তাঁর অগুণিত গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছেন। আর অবশ্যই আবারও ধন্যবাদ জানাই অসংখ্য লেখক, পাঠক, শুভানুধ্যায়ীদের, যাদের উৎসাহ ছাড়া পাঁচ বছর ধরে bigyan.org.in-এর প্রয়াসটি চালানো সম্ভব হত না।

শিরোনামের ছবি – ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকার প্রথম মুদ্রিত সংস্করণের উদবোধনে মীর, bigyan.org.in ও কন্টাই সায়েন্স অ্যাকাডেমীর কিছু সদস্য। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মিউজিয়ামে।

বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মিউজিয়াম থেকে লাইভ ভিডিও-র লিঙ্ক

The post কলকাতা বইমেলায় ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকা, ও অন্যান্য প্রাপ্তিস্থান! appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

বাঁদর থেকে মানুষ হতে কেউ দেখে নি। তাহলে বিজ্ঞানীরা কি করে বিবর্তন সম্বন্ধে নিশ্চিত হলেন?

$
0
0

এটা ঠিক যে কেউ কোনদিন বাঁদরকে মানুষ হতে দেখে নি। এও ঠিক যে কেউ কোনদিন ডাইনোসরদের দেখেনি। তার মানে এই নয় যে ডাইনোসররা ছিল না। আমরা ফসিল বা জীবাশ্ম থেকে জানতে পারি ডাইনোসরদের কথা। তেমনই ফসিল থেকে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসও জানা যায়। আফ্রিকার তানজানিয়ার লেটলি (Laetoli)-তে পাওয়া পায়ের ছাপ থেকে আমরা জেনেছি যে ৩৫ লাখ বছর আগে সেখানে দু’পেয়ে মানুষ বা মানুষের মত কোন জীব হেঁটে গেছে (দু’জন)। যে পলিস্তরে (sediment layer) এই পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে, সেই স্তরেই পাওয়া গেছে অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস (Australopithecus afarensis)-দের জীবাশ্ম। দুয়ে দুয়ে চার করলেই বলা যায় যে অস্ট্রালোপিথেকাসরা দু পায়ে হাঁটতে পারত। একটা প্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাস বোঝা অনেকটা গোয়েন্দা গল্পের মত। এক একটা সংকেত বা ক্লু এক একটা নতুন তথ্যকে সামনে নিয়ে আসে। কিছু তথ্য এক হলে একটা ছবি ফুটে ওঠে।

বিজ্ঞান যখন বলে যে মানুষ এসেছে বাঁদর থেকে, তার মানে এই নয় যে একদিন হঠাৎ কোন বাঁদর মানুষ হয়ে গেছে। এর অর্থ হল যে বাঁদর জাতীয় কোন প্রাণী বিবর্তিত হতে হতে মানুষের মত হয়েছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। প্রকৃতিতে বৈচিত্র থাকে সবসময় – আমার বাগানের সূর্যমুখীরা সবাই সূর্যের দিকে চেয়ে থাকলেও, গাছগুলো কিছুটা হলেও আলাদা। ফুলেদের মধ্যেও তারতম্য আছে। মানুষদের মধ্যেও প্রত্যেকে আলাদা – এমনকি যমজ সন্তানদের মধ্যেও পার্থক্য থাকে, এর কারণ আমাদের জীন। এবং, তার সঙ্গে কিছুটা হলেও আমাদের পরিবেশ। প্রাকৃতিক কোন বড় পরিবর্তন ঘটলে একটা জনসংখ্যার (population) কিছু ব্যক্তি (individual) নতুন পরিবেশে সহজে মানিয়ে নিতে পারবে হয়তো তাদের কিছু বৈশিষ্টের জন্য, আবার কেউ কেউ পারবে না। এভাবেই কিছু বৈশিষ্ট্য ‘selected’ হবে, রয়ে যাবে, এবং সেই বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রাণীরা প্রজনন করে নিজেদের সংখ্যা বাড়াতে থাকবে। প্রাকৃতিক বাছাই (natural selection)-এর মূলে হল এই যুক্তি।

এখন জিনোমিক্সের সাহায্যে আমরা মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস অনেকটা ভালভাবে বুঝতে পেরেছি। এখন জানা যাচ্ছে যে একই সময়ে মানুষের মত অনেক প্রজাতি ছিল, এবং তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বিলুপ্ত হয়েছে। এও জানা যায় যে কিছু প্রজাতির মধ্যে breeding বা মিলন হয়েছে। এর ফলে তাদের জীনের সংমিশ্রণ ঘটেছে।

মানুষের মত প্রাণীর সবথেকে পুরনো যে ফসিল পাওয়া গেছে, তার বয়স ৬০-৭০ লক্ষ বছর। নাম Sahelanthropus tchadensis। এর মস্তিষ্ক ছিল ছোট (খুলির মাপ থেকে বোঝা যায়), বাঁদরদের মত। কিন্তু এরা দু’পেয়ে, মানুষের মত। কিভাবে জানা গেল যে সাহেলানথ্রোপাস দু’পেয়ে প্রাণী ছিল? এখানেই বিজ্ঞানীদের গোয়েন্দা হতে হয়। সাহেলানথ্রোপাস-এর শুধু মাথার হাড় পাওয়া গেছে এখনো পর্যন্ত, পশ্চিম-মধ্য আফ্রিকা থেকে। এই খুলিতে ফোরামেন ম্যাগনাম বাঁদরদের তুলনায় অনেকটা নিচের দিকে। ফোরামেন ম্যাগনাম হল খুলির নিচের দিকে একটা বড় গর্ত, যেখান দিয়ে আমাদের স্পাইনাল কর্ড মস্তিষ্ক থেকে বের হয়। চার পেয়ে স্তন্যপায়ীদের খুলিতে এই গর্ত থাকে আড়াআড়িভাবে, আর মানুষদের ক্ষেত্রে থাকে খুলির নিচের দিকে। সুতরাং, শরীরের বাকি হাড়গোড় না পাওয়া গেলেও, সাহেলানথ্রোপাস যে দু-পেয়ে ছিল, সেই বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিন্ত হতে পারেন।

এভাবেই ফসিলের সূত্র ধরে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের নানান বৈশিষ্ট্য আমরা জানতে পারি। আধুনিক বিজ্ঞান সেই সঙ্গে যোগ করেছে জীনের সূত্র, যা থেকে এই ছবি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৫০ লক্ষ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা অবশ্যই আমাদের মত কোন মানুষ দেখে নি, এবং নথিভুক্ত করেনি। কিন্তু, বিজ্ঞানীদের চোখ দিয়ে এবংযুক্তি ও তথ্যের হাত ধরে সেই ইতিহাসকে স্পষ্ট দেখতে পারি আমরা।

বিজ্ঞানবাজী-২

(বাবা – মীর, জগা – অগ্নিজিৎ, সংলাপ – সৌম্য, আবহ – সায়ক, কার্টুন – অত্রি)

প্রচ্ছদের ছবির সূত্র

The post বাঁদর থেকে মানুষ হতে কেউ দেখে নি। তাহলে বিজ্ঞানীরা কি করে বিবর্তন সম্বন্ধে নিশ্চিত হলেন? appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).


লিলিপুটদের দেশে এক আশ্চর্য গালিভার (প্রথম পর্ব)

$
0
0

এককোষী ব্যাকটেরিয়ার ভিতরে জেনেটিক তথ্যপ্রবাহ আধুনিক কোষের থেকে কতটা আলাদা?


“বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ শিক্ষার জন্যে পারিভাষিকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু পারিভাষিক চর্ব্যজাতের জিনিস। দাঁত-ওঠার পরে সেটা পথ্য।” — বিশ্বপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ।  

পারিভাষিক বর্জন করে বিজ্ঞান নিয়ে লেখা বিশ্বপরিচয়-এর প্রবন্ধগুলি বিশ্বকবির প্রতিভা ও অধ্যবসায়-এর এক অনন্যসাধারণ পরিচয়। শুরুতেই একথাটির উল্লেখের কারণ ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াদের নিয়ে লেখা এই সামান্য প্রবন্ধটি লিখতে গিয়ে পরিভাষিক বর্জনের দুরহ ভার সমূহভাবে উপলব্ধি করছি। কথ্য ভাষায় যাকে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া বলে। শুধু এইটুকু বলে লেখা শুরু করি যে যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি।

গোড়ার কথা

সব জীবের দেহ এক বা একাধিক কোষ দিয়ে তৈরী। যেসব বৈশিষ্ট্যগুলো গোটা জীবটাকে জড়বস্তুর থেকে আলাদা করে (যেমন বিপাক, বৃদ্ধি, প্রজনন) তার অনেকগুলোই এক-একটা ছোট্ট কোষেরও বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ একটা কোষকে পৃথকভাবে জীবিত বলা যায়। এই কারণেই জীববিজ্ঞানের মূল তত্ত্বগুলো বোঝার একটা প্রধান উপায় হলো একটা কোষের মধ্যে উঁকি মেরে তার গঠন ও ভেতরের ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করা।  

    জীবকোষ মূলত দুধরণের।  প্রাণী ও উদ্ভিদের মতো আধুনিক জীবের (অর্থাৎ যারা বিবর্তনের ধারায় অপেক্ষাকৃত পরে এসেছে) কোষ বেশ সুচারুভাবে তৈরি। তার মধ্যিখানে থাকে পর্দাবেষ্টিত নিউক্লিয়াস, যার ভেতরকার ক্রোমোসোমে কোষের সমস্ত জেনেটিক তথ্য ঠাসা থাকে। কোষের গঠন ও ক্রিয়া সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে এই জেনেটিক তথ্য। নিউক্লিয়াসের বাইরে থাকে জেলির মতো সাইটোসল, তাতে ভেসে থাকে কুচি কুচি মাইটোকন্ড্রিয়া, রাইবোসোম, গলগি বডি-র মতো কোষের বাকি অংশগুলো। এই ধরণের  কোষ-সমৃদ্ধ জীবকে ইউক্যারিওট বলে।

কিন্তু ব্যাকটেরিয়া-র মতো আদিম জীবের কোষের গঠন এতো সুন্দর নয়। একটা ব্যাকটেরিয়ার কোষের ভেতরটা দেখে মনে হয় কেউ যেন ক্রোমোসোম আর বাকি সব মালমসলা একসাথে একটা থলের মধ্যে পুরে দিয়েছে। কিন্তু এই আপাত বিশেষত্বহীনতার আড়ালে ব্যাকটেরিয়া-র কোষেও যেসব জটিল জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে বিজ্ঞানীরা ইদানিং তার আভাস পেতে শুরু করেছেন। জানা গেছে জেনেটিক তথ্য থেকে প্রোটিন নির্মাণের ধাপগুলো। …

গালিভার এবং লিলিপুট

ব্যাকটেরিয়া বলতেই আমাদের মাথায় আসে ক্ষুদ্র জীবাণু। কিন্তু শুধু ‘ক্ষুদ্র’ বললেই হয় না, কিসের তুলনায় ক্ষুদ্র সেটা বোঝা দরকার। যেমন, মানবদেহের একটা কোষ মানবদেহের তুলনায় আকারে ১০১২ গুন্ ছোটো কিন্তু ব্যাক্টেরিওলজিস্টদের সবচেয়ে পরিচিত ই. কোলাই(E. coli) কোষের তুলনায় ১,০০০ গুণ বড় হতে পারে। শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া-র জগতেই আকারের বিস্তর ফারাক দেখা যায়। এমন ব্যাকটেরিয়া-ও দেখা গেছে যাদের ক্ষুদ্র বললে বাকি ব্যাকটেরিয়াদের জন্য ক্ষুদ্র বিশেষণটা আর প্রযোজ্য থাকে না।  এর একটা উদাহরণ হলো আক্রমাটিয়াম অক্সালিফেরাম (Achromatium oxaliferum) [১]। অনেকটা হ্যারি পটার জগতের কোনো এক ম্যাজিকমন্ত্রের মতো শুনতে এই ব্যাকটেরিয়াটি গড়ে ১৫০ মাইক্রন পর্যন্ত লম্বা এবং ৩০ মাইক্রন পর্যন্ত চওড়া হয় (১ মাইক্রন = ১ মাইক্রোমিটার বা ১ মিটারের ১০ভাগের এক ভাগ ) [২]। ‘আক্রমাটিয়াম’-ই এই গল্পের গালিভার। আমাদের চেনা প্রায় সমস্ত ব্যাকটেরিয়াই এর তুলনায় লিলিপুট। তুলনাটা সম্পূর্ণ করতে সবচেয়ে পরিচিত ব্যাকটেরিয়া ই. কোলাই-এর পরিমাপটা এখানে বলি: দৈর্ঘ্যে ৩ মাইক্রন আর প্রস্থে ১ মাইক্রন। বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগ চেনা ব্যাকটেরিয়াই  আকারে এই ই. কোলাই-এর খুব কাছাকাছি [৩]।


চিত্র ১: ই. কোলাই (A) এবং তার চাইতে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ৫০ গুন বড় আক্রমাটিয়াম অক্সালিফেরাম (B)।

ক্ষুদ্র  ই. কোলাই  এবং সুবৃহৎ আক্রমাটিয়াম অক্সালিফেরাম-এর মধ্যে আকার-আয়তন ছাড়াও বিস্তর ফারাক রয়েছে।  সেই ফারাকগুলির কিছু হয়তো এসেছে আকারগত পার্থক্য থেকেই। তেমনি কিছু বিভেদ, এবং সেই বিভেদের অন্তর্নিহিত কারণ  নিয়েই এই লেখা।

লিলিপুটরা কেন লিলিপুট ?

প্রথমেই যে প্রশ্নটা আমাদের মনে আসে, বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়ার ই. কোলাই-এর মতো ক্ষুদ্র হওয়ার পিছনে কোনো কারণ আছে কি? মূল কারণ হলো পরিবহন। ‘পরিবহন’ বলতে আমরা এখানে বুঝবো কোষের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্তরকমের তথ্য ও উপকরণ-এর পরিবহন। আধুনিক ইউক্যারিওট কোষদের মতো ‘উন্নত’ পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় [৪], ব্যাকটেরিয়ার ভিতরে জেনেটিক তথ্য (প্রোটিন, আরএনএ, ইত্যাদি) থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য প্রয়োজন যাবতীয় ‘মেটাবোলাইটস’-দের পরিবহন হয় ব্যাপন বা ডিফিউশন (diffusion) পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। এই পদ্ধতিটা খুবই সাদামাঠা। এক জায়গায় কোনো এক অণুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেলে তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হয় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া।

ব্যাপন-নির্ভর পরিবহন যেমন সাদামাঠা তেমনি মন্থর। কতটা মন্থর তার একটা হিসেব দেওয়া যায়। এইভাবে পরিবহনের জন্য যে সময় লাগে, তা দূরত্বের দ্বিতীয় মাত্রার সাথে সমানুপাতিক। অর্থাৎ, ১ মাইক্রন পথ অতিক্রম করতে যদি ১ সেকেন্ড সময় লাগে, তাহলে ২ মাইক্রন যেতে সময় লাগবে (২) = ৪ সেকেন্ড। দূরত্বের সাথে সময় কি রাতারাতি বেড়ে যায়, সেটা বুঝতে নিচের ছবিটা দেখো।


চিত্র ২: একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করতে কতটা সময় লাগে (required time), তা নির্ভর করে ঠিক  কিভাবে সেই দূরত্ব অতিক্রম করা হচ্ছে। সাধারণ ভাবে একটা নির্দিষ্ট দিকে স্থির গতিতে চলতে থাকলে (directed motion), এই ‘required time’  দূরত্বের সাথে সমানুপাতিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ডিফিউশন-নির্ভর (diffusion-limited) পদ্ধতিতে চললে, প্রয়োজনীয় সময় দূরত্বের দ্বিতীয় মাত্রার সাথে বৃদ্ধি পায়।

তাই দ্রুত তথ্য পরিবহনের জন্য ব্যাকটেরিয়াদের ক্ষুদ্র হওয়া অত্যন্ত জরুরি।  ব্যাকটেরিয়ারা আকারে খুব বেশি বড় হলে, কোষের মধ্যেকার একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে জেনেটিক তথ্য কিংবা মেটাবোলাইটসদের পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যাবে। কিন্তু শুধু ক্ষুদ্র আকারই দ্রুত তথ্য পরিবহনের জন্য যথেষ্ট নয়।

সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ

ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যেকার সংগঠনও তথ্য পরিবহনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, অর্থাৎ জেনেটিক তথ্যের কথাই ধরা যাক। আমরা জানি, যাবতীয় জেনেটিক তথ্য DNA থেকে RNA হয়ে প্রোটিনে পৌঁছায়। কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ঠিক কিভাবে সেই জেনেটিক তথ্য পরিবহন হয়? ঠিক কিভাবেই বা জেনেটিক তথ্য পরিবহনের কান্ডারিরা কোষের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে? জানার জন্য আমাদের উঁকি দিতে হবে ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যে।

কিন্তু এতো ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেকার সংগঠন খুঁটিয়ে দেখা মোটেই মুখের কথা নয়।  সাধারণ অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ব্যবহৃত “দৃশ্যমান” আলোকরশ্মির দীর্ঘ দৈর্ঘ্যের জন্য মোটামুটি ২০০ ন্যানোমিটার-এর চেয়ে ছোট কোন কণার গঠনগত বিশেষত্ব বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয় ( ১ ন্যানোমিটার = ১০-৯ মিটার )। আলোর ডিফ্র্যাকশন বা অপবর্তনের জন্যে সেইসব বিশেষত্বগুলো হারিয়ে যায়। তাই সাধারণ অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে একটা গোটা ব্যাকটেরিয়া দেখা সম্ভব হলেও, তার ভিতরের গঠন-সজ্জা দেখা সম্ভব নয়। এই সমস্যার সমাধান হলো ২০০৬ সালে। বিজ্ঞানী এরিক বেটজিগ ফ্লুরোসেণ্ট অণুর সাহায্যে আবিষ্কার করলেন এমন এক মাইক্রোস্কোপ, যাতে ১০ ন্যানোমিটার ফারাকের দুটি বস্তুকে আলাদা করে দেখা সম্ভব হলো। তারই নাম ‘সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ’। এইখানে জানিয়ে রাখি, বিজ্ঞানী এরিক বেটজিগ এবং স্টেফান হেল-কে সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের জন্য ২০১৪ সালে রসায়ন বিভাগে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়।

লিলিপুটদের অন্দরমহল

এই গল্পে আমার ছোট্ট একটা ভূমিকা রয়েছে। ২০০৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিন ম্যাডিসন-এর প্রফেসর জেমস ওআইশার-এর ল্যাব-এ আমি এইরকমই একটা ‘সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ’ তৈরী করার চেষ্টা করছিলাম। তখনও বাজারে ‘সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ’ তৈরী করা চালু হয়নি, তাই সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপি করতে ইচ্ছুক সমস্ত বিজ্ঞানীকেই তাদের নিজেদের ল্যাবে নিজস্ব একটা মাইক্রোস্কোপ তৈরী করতে হত। সেইসময় আমার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল এই মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে কিছু ক্যান্সার কোষের ভিতরকার সজ্জা দেখা। কিন্তু ভাগ্যের ফেরেই হোক, বা ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াদের নিয়ে আমার কৌতুহলের কারণেই হোক, এক বছর পর মাইক্রোস্কোপটি তৈরী হতেই আমি ব্যাকটেরিয়ার অন্দরমহলে দেখতে শুরু করলাম। এর পর প্রায় চার বছর আমি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেকার সজ্জা নিয়ে গবেষণা করেছি।

আমার গবেষণার কাজ ছিল ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে জেনেটিক তথ্য পরিবহনের বন্দোবস্ত ঠিক কিরকম তা পর্যবেক্ষণ করা। আমরা জানি, জেনেটিক তথ্য পরিবহন হয় দুই ধাপে

  1. প্রথম ধাপকে বলে ট্রান্সক্রিপশন (transcription), যার মাধ্যমে আরএনএ পলিমারেস (RNA Polymerase) নামক এনজাইম DNA থেকে RNA তৈরী করে।
  2. এর পরের ধাপ হলো, ট্রান্সলেশন (translation), যার মাধ্যমে রাইবোজোম নামক জটিল আণবিক যন্ত্র এই আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরী করে।

আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কোষের মধ্যে কোথায় এবং কিভাবে এই আরএনএ পলিমারেস এবং রাইবোজোম সাজানো রয়েছে তা জানা। আশাটা এইরকম যে আরএনএ পলিমারেস এবং রাইবোজোম-এর সজ্জার কথা জানলে আমরা তথ্য পরিবহনের দুটো ধাপ কিভাবে সম্পন্ন হচ্ছে, তার একটা ছবি পেয়ে যাবো। এই কাজের জন্য আমরা  ব্যবহার করেছিলাম একটা বিশেষ ব্যাকটেরিয়া, আমাদের সবার পরিচিত ই. কোলাই। তবে যেহেতু তা সর্বজনবিদিত ‘Model Organism’, তাই আমি এখন থেকে আমাদের পর্যবেক্ষণগুলোকে ব্যাকটেরিয়াদের জন্য সাধারণভাবে সত্যি ধরে নিয়ে আলোচনা করবো।

ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে একটা সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে উঁকি মেরে আমরা দেখলাম যে জেনেটিক তথ্যপরিবহনের ব্যবস্থাটি খুব সুচারু ভাবে গোছানো [৫]। ব্যাকটেরিয়ার কোষ-রসের আপাত বিশেষত্বের অভাব থেকেই ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় “ Bag of Enzymes”, অর্থাৎ কিনা উৎসেচক দিয়ে ভর্ত্তি একটা থলে। আমরা দেখলাম যে তা একেবারেই সত্যি নয়।

অন্দরমহলের সজ্জা

প্রথমে বলা যাক জেনেটিক তথ্যের উৎসের কথা। ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যে একদম শিড়দাঁড়া-বরাবর থাকে যাবতীয় জেনেটিক তথ্যের ভান্ডার, অর্থাৎ ক্রোমোসোম। ক্রোমোসোমাল ডিএনএ অনেকটা একটা প্রলম্বিত পিন্ডের মতো কোষের সাইটোপ্লাজম এর মধ্যে ভেসে থাকে। উন্নত ইউক্যারিওটিক কোষের মতো ব্যাকটেরিয়া ক্রোমোসোমের কোনো সজ্জাবিন্যাস না থাকায় এবং ক্রোমোসোম পর্দাবেষ্টিত না থাকায়, একে নিউক্লিয়াস এর বদলে নিউক্লিওয়েড বলে। প্রায় নিউক্লিয়াস-ই কিন্তু নিউক্লিয়াস নয়।

সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপে আমরা দেখলাম কোষের মধ্যে আরএনএ পলিমারেস সজ্জিত রয়েছে কোষের কেন্দ্রের নিকটবর্তী নিউক্লিওয়েড-এর গায়ে। এখানে ‘গায়ে’ কথাটা একটু  জোর দিয়ে বলছি। নিউক্লিওয়েড-এর ভেতরে না থেকে, বেশিরভাগ সক্রিয় আরএনএ পলিমারেস নিউক্লিওয়েডের পরিধি বরাবর বিস্তৃত। অপরপক্ষে রাইবোজোমরা ছড়িয়ে রয়েছে নিউক্লিওয়েড আর কোষপর্দার মাঝামাঝি জায়গায় [৫]। নিচের ছবিটা দেখলেই তথ্য পরিবহনের পথটা স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথমে  নিউক্লিওয়েড-এর গা ঘেঁষে ট্রান্সক্রিপশন, তারপর নিউক্লিওয়েড আর কোষপর্দার মাঝামাঝি জায়গায় ট্রান্সলেশন।


চিত্র ৩: ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে DNA, RNA Polymerase, এবং ribosome-দের অবস্থান

ইউক্যারিওটিক কোষের মতো নিউক্লিয়ার পর্দা না থাকা সত্ত্বেও ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে জেনেটিক তথ্য পরিবহনের এই দুই ধাপ-এর মধ্যে স্থানভেদ বেশ চমকিত  করেছিল আমাদের, এবং সম্ভবত অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া-অনুরাগীদেরও। তার কারণ প্রচলিত ধারণা ছিল যে এই দুই ধাপ সবসময় একসাথে হয়, যাকে কো-ট্রান্সক্রিপশনাল ট্রান্সলেশন (cotranscriptional translation) বলে [৬]। আমাদের গবেষণা দেখালো যে ট্রান্সলেশন সবসময় ট্রান্সক্রিপশন-এর সাথে হয় না।

এমন সজ্জার কারণ কি ?

এর থেকে বোঝা গেলো যে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে জেনেটিক তথ্য পরিবহনের দুই ধাপ ঘটে দুই জায়গায়। কিন্তু এমনটা ঘটার কারণ কি? বা এইভাবে ভাবা যেতে পারে, এমনটা হলে ব্যাকটেরিয়ার কি সুবিধে হয় ? বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে যে কোনো সুনির্দিষ্ট সুবিধা অর্জন ব্যতীত কোনো বৈশিষ্টই দীর্ঘ সময়কাল ধরে স্থায়ী হতে পারে না, বিবর্তনধারায় লুপ্ত হয়ে যায়। এই প্রশ্নের উত্তরে এককথায় বলা যায় যে, জেনেটিক তথ্য পরিবহনের দুই ধাপ দুটো জায়গায় সংগঠিত হওয়ার সুবিধে হলো ধাপদুটোর দ্রুততা বৃদ্ধি।

তথ্য পরিবহনের প্রথম ধাপের দ্রুততার জন্য প্রয়োজন আরএনএ পলিমারেস-এর খুব তাড়াতাড়ি নিউক্লিওয়েড-এর মধ্যে ছড়িয়ে থাকা প্রয়োজনীয় ‘জিন’ খুঁজে বার করা এবং তা থেকে আরএনএ তৈরী করা।  ঠিক একই ভাবে দ্বিতীয় ধাপের দ্রুততার জন্য প্রয়োজন এমন এক ব্যবস্থা যাতে রাইবোজোমরা খুব তাড়াতাড়ি RNA-গুলোকে খুঁজে বার করতে পারে, এবং তা থেকে প্রোটিন তৈরি করতে পারে। দুই ধাপের প্রতিটাতেই ‘Rate-limiting Step’, অর্থাৎ তথ্য পরিবহনের হার আটকে দেয় এই খুঁজে বার করার পদ্ধতি। এই খুঁজে বার করার  সুবিধে করে দিতে পারলে তথ্য পরিবহনকে দ্রুততর করা যায়। এটি সম্ভবত ব্যাকটেরিয়া-র অন্দরমহলের সজ্জার কারণ। তথ্য-পরিবহনের ধাপ দুটো দুই জায়গায় হওয়ায়, এই খুঁজে বের করাটা আরো দ্রুত হয়।

এই ব্যাপারটাকে আরেকটু তলিয়ে ভাবা যাক।  ধাপদুটো আলাদা আলাদা স্থানে না হয়ে, কোষের সমস্ত অন্দরমহল জুড়ে হলে, আরএনএ পলিমারেস এবং রাইবোজোম উভয়কেই তাদের লক্ষ্যবস্তু, যথাক্রমে জিন এবং RNA-কে সারা কোষময় খুঁজতে হতো। আর খোঁজার পদ্ধতিটা যথারীতি ব্যাপন-নির্ভর।  ব্যাপন-নির্ভর পরিবহনের সময় কিভাবে দূরত্বের সাথে খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে চলে, তা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। এথেকে খুব সহজেই ধারণা করা যায় যে, কোষের সম্পূর্ণ অন্দরমহল জুড়ে খোঁজার চেয়ে তার একটা নির্দিষ্ট অংশে খোঁজা অনেক বেশি সহজ।   

তাই আরএনএ পলিমারেস ‘জিন’ খোঁজে কোষের অর্ধেক জুড়ে থাকা নিউক্লিওয়েড-এর গায়ে।  ট্রান্সক্রিপশন এর পর RNA তৈরী হয়ে কোষের বাকি অর্ধেক অংশে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে রাইবোজোমদের পক্ষ্যে দ্রুত সেই RNA-গুলোকে খুঁজে প্রোটিন সংশ্লেষ করা সম্ভব হয়। অযথা নিউক্লিওয়েড-এর মধ্যে খুঁজে সময় নষ্ট করতে হয় না।  

সব লিলিপুট কি একরকম ?

আগেই বলেছি আমাদের বেশিরভাগ চেনা ব্যাকটেরিয়াই  আকারে এই ‘ই. কোলাই’-এর খুব কাছাকাছি। খুব বেশি হলে ৫ গুন ছোট কি বড়। এর কারণ বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়া  যাদের একটার বেশি ক্রোমোসোম নেই, তাদের পক্ষে খুব বেশি বড় হওয়া কঠিন। ডিফিউশন-নির্ভর পদ্ধতিতে তথ্য পরিবহন খুব মন্থর হয়ে গিয়ে কোষের যাবতীয় কাজকর্মকে গতিহীন করে তুলবে। কোষের বৃদ্ধি এবং বিভাজন-এর হার কমে  যাবে এবং তাতে সেই জীবটা বিবর্তনের ধারায় বাকিদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে এবং ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যাবে।

জেনেটিক তথ্য পরিবহনের দুই ধাপ দুটো আলাদা স্থানে হওয়াটা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যেও  পর্যবেক্ষিত হয়েছে। যেমন গ্রাম-পজিটিভ (Gram Positive) ব্যাকটেরিয়া ব্যাসিলাস সাটিলিস (Bacillus subtilis)-এর মধ্যেও দেখা গিয়েছে ট্রান্সক্রিপশন এবং ট্রান্সলেশন আলাদা আলাদা জায়গায় সম্পন্ন হয় [৭]। গ্রাম-নেগেটিভ ই. কোলাই এবং গ্রাম-পজিটিভ ব্যাসিলাস সাটিলিস বিবর্তনের সময়ধারায় একে ওপরের থেকে শতকোটি বছর দূরে। সুতরাং একথা মোটামুটি জোর দিয়েই বলা যায় যে, সাধারণ ব্যাকটেরিয়া, যারা এই গল্পের লিলিপুটরা, তাদের সকলের মধ্যেই জেনেটিক তথ্যপ্রবাহের দুই ধাপ কোষের দুই জায়গায় সম্পন্ন হয়। জেনেটিক তথ্য কোষের কেন্দ্রে নিউক্লিওয়েড থেকে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ছোট আকার আর সুচারুভাবে গোছানো ব্যাকটেরিয়া-র অন্দরমহল, এই দুইয়ের সম্মিলিত উপস্থিতিতে তথ্য পরিবহন যথাযথ সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়।

    তাই, ব্যাকটেরিয়া-র লিলিপুট জগতে এক গালিভার-এর আবির্ভাব আশ্চর্যের বইকি! প্রথমেই তথ্য পরিবহনের প্রশ্নটার একটা উত্তর খোঁজার দরকার হয়ে পড়লো। যারা সাইজে ছোট নয়, তাদের মধ্যে ব্যাপন-নির্ভর তথ্য পরিবহন তো বেশিদূর যেতে পারেনা। সেই গল্প পরের পর্বে।

(প্রচ্ছদের ছবির সূত্র)

তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:

  1. [১] আক্রমাটিয়াম অক্সালিফেরাম: ১৮৯৩ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী ভ্লাদিমির শেওয়াকফ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে প্রথমবার এই ব্যাকটেরিয়াটিকে পর্যবেক্ষণ করার সময়, এর মধ্যে ক্যালসাইট ক্রিস্টাল গুলিকে ক্যালসিয়াম অক্সালেট বলে ভুল করেন, এবং সেই অক্সালেট থেকেই অক্সালিফেরাম নামের উৎপত্তি।
  2. [২] A Lakeside Tale, Small Things Considered,  by Christoph Weigel
  3. [৩] ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াদেরও খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, যেমন নানোআর্কিয়াম ইকুইটান্স, যারা কিনা আকারে ই. কোলাই-এর ১০০ ভাগের একভাগ।
  4. [৪] ইউক্যারিওট কোষে পরিবহন খুব উন্নত মানের। মলিকুলার মোটোর্স্ নামের একধরণের প্রোটিন এবং ভেসিকল দিয়ে কোষের বিভিন্ন অংশে খুব দ্রুত প্রোটিন, আরএনএ, ডিএনএ, এবং অন্যান্য মেটাবোলাইটস পৌঁছে যায়।
  5. [৫] Superresolution imaging of ribosomes and RNA polymerase in live Escherichia coli cells: Somenath Bakshi, Albert Siryaporn, Mark Goulian, James C. Weisshaar
  6. [৬] ব্যাকটেরিয়ায় জিনগত তথ্যের আদান-প্রদান (প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব)
  7. [৭] Compartmentalization of transcription and translation in Bacillus subtilis: Peter J. Lewis, Shail D. Thaker, and Jeffrey Errington

The post লিলিপুটদের দেশে এক আশ্চর্য গালিভার (প্রথম পর্ব) appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

কর্ভাস

$
0
0

প্রাণীজগতের এই বিপুল বৈচিত্র্যের মধ্যেও মানুষকে আলাদা করে চেনা যায়। মনে হয়, বিবর্তনের যাত্রায় সবাই একসাথে নেমেছিল, হঠাৎ মানুষ কোথা থেকে তেড়েফুঁড়ে বাকিদের থেকে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের মনে স্বাভাবিকভাবেই জাগে প্রশ্ন: আমাদের বুদ্ধির ক্রমবিকাশ ঠিক কিভাবে হলো? কিভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আরও উন্নত হলো মানবসভ্যতা? সাথে সাথে আরো একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়: এই বিবর্তনটা মানুষের সাথেই হলো কেন? মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী কি বিবর্তনের এই ধাপগুলো দিয়ে যায়নি? বা যেতে পারেনা? এর উত্তরে সম্প্রতি কিছু চাঞ্চল্যকর সম্ভাবনা দেখা গেছে এক বিশেষ প্রজাতির কাকের মধ্যে।

প্রশ্নগুলো শুনতে সহজ মনে হলেও আসলে এর সূত্র লুকিয়ে আছে “সংস্কৃতি” (Culture) এবং “সাংস্কৃতিক বিবর্তন” (Cultural evolution) এই দুই শব্দবন্ধের মাঝে। প্রায় সমস্ত প্রাণী তাদের চারিপাশের সমাজ থেকে অনেক কিছু শেখে যা তাদের আচরণে প্রকাশ পায়। যেমন কুকুর, পেঙ্গুইন, শিম্পাঞ্জি, ইঁদুর, খরগোশ, অক্টোপাস এদের সবার আচরণের কিছু অংশ পার্শ্ববর্তী পরিবেশ থেকে শেখা। এই “সামাজিক শিক্ষা”-র ফলে আচরণের যে তারতম্য দেখা যায়, তাকেই সমাজবিজ্ঞানীরা “সংস্কৃতি” বলে থাকেন [১]। এটা মোটামুটি এখন মেনে নেওয়া হয় যে প্রকৃতিতে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য (cultural diversity) একটা সাধারণ ব্যাপার [২]।

কিন্তু এক প্রজন্মের মধ্যে যে শিক্ষা অর্জিত হয়, সেটা দিয়ে মানুষের অগ্রগতিকে বোঝানো যায়না। এর জন্য সামাজিক শিক্ষা গ্রহণ করা এবং তা মনে রেখে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে পারা অত্যন্ত জরুরি। আমরা আমাদের চারপাশে অনেক কিছু দেখি, হয়ত কিছুটা শিখি বা মনেও রাখি কিন্তু আবার ভুলে যাই। এক্ষেত্রে তিনটি ব্যাপার হতে পারে। এক, দেখলাম কিন্তু কিছু শিখলাম না। দুই, দেখলাম, শিখলাম কিন্তু সে শিক্ষা ধরে রেখে অন্য কাউকে শেখাতে পারলাম না। এবং তিন, দেখলাম, শিখলাম এবং অন্য প্রজন্মকে একজন অভিজ্ঞের মত শিখিয়ে গেলাম কিম্বা নতুন প্রজন্ম দেখে দেখে শিখে নিল। এই শেষের অবস্থাটা যখন হয় তখন অনেক সামাজিক শিক্ষা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বংশ পরম্পরায় পৌঁছতে পারে। জিনগত বিবর্তন এবং পরিবেশের প্রভাবে বিবর্তন, এর বাইরেও স্রেফ সামাজিক শিক্ষা সঞ্চয়ের মাধ্যমে মানুষ এতদূর এগোতে পেরেছে। এমন সব ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পেরেছে যা কোনো ব্যক্তিবিশেষের একার পক্ষে অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। এই কৃতিত্ব মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীকে দেওয়া যায়না। “সংস্কৃতি” স্বাভাবিক হলেও এই “ক্রমসঞ্চিত সাংস্কৃতিক বিবর্তন” (cumulative cultural evolution) প্রাণীজগতে খুবই দুর্লভ। প্রসঙ্গত, জিনগত বিবর্তনের সাথে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একটা মূল তফাৎ হলো যে দ্বিতীয় বিবর্তনটা জিনগত কোড-এর মধ্যে গেঁথে যায়না। অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিবর্তনটার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে অগ্রজদের কাছ থেকে নিজের তাগিদে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। জন্মসূত্রে আপনা থেকেই সেই শিক্ষা আসে না।

এক প্রজন্মের মধ্যে যে শিক্ষা অর্জিত হয়, সেটা দিয়ে মানুষের অগ্রগতিকে বোঝানো যায়না।

মানুষ কিন্তু আজকের অর্থে সভ্য হওয়ার অনেক আগেই গোটা প্রাণিজগৎকে পিছনে ফেলে দিয়েছিলো। যেমন, আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমিতে যে বুশ ম্যান-রা বসবাস করে তারা জানে কোন গাছের ফল বা পাতা তাদের খাদ্য, বিভিন্ন আবহাওয়ায় কি ভাবে তাদের সংগ্রহ করতে হয়, কি ভাবে তীর বা ধনুক বানাতে হয়, কিভাবে জলের অনুসন্ধান করতে হয় এবং আরও অনেক কিছু। আবার যে মানুষ সুমেরু-কুমেরুতে বাস করে বা গভীর জঙ্গলে বাস করে সেও নিজেদের প্রয়োজনের অনেক কিছু জানে। কালাহারি, সুমেরু-কুমেরু কিম্বা গভীর জঙ্গলে থাকার জন্য এদের কিন্তু আলাদা আলাদা জ্ঞান, শিক্ষা বা যন্ত্র/যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে হয়। অথচ এই হরেকরকম জ্ঞান বা শিক্ষার মালিক কিন্তু একই প্রজাতি, মানুষ। একই ধরণের মস্তিষ্ক নিয়ে বিভিন্ন ধরণের জ্ঞানের অধিকারী হয়েছে সে। অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে এই বিপুল বৈচিত্র্য দেখা যায় না। এটা অনুমান করা যায় যে “ক্রমসঞ্চিত সাংস্কৃতিক বিবর্তন” না থাকলে এটা কখনই সম্ভব নয় বা হত না [২]। প্রত্নতাত্ত্বিক চেষ্টায় আবিষ্কৃত প্রায় দশ হাজার বছর আগের নানা রকম হাতিয়ার বা পাত্র ইত্যাদি প্রমাণ করে মানুষ ক্রমশ প্রকৃতি, পরিবেশ এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজেদের “সাংস্কৃতিক বিবর্তন” করেছে। প্রস্তর যুগের বিভিন্ন প্রকার সামগ্রী দেখে অনুমান করা হয় আমাদের পূর্বপুরুষদের এই “সাংস্কৃতিক বিবর্তন” প্রায় ১.৬ মিলিয়ান বছর (১৬ লক্ষ বছর) আগে শুরু হয়েছিল।

কেন এই ক্রমসঞ্চিত সাংস্কৃতিক বিবর্তন এত বিরল, সেই নিয়ে অনেক মত রয়েছে। বিজ্ঞানীদের একাংশ বলেন যে সামাজিক শিক্ষার মধ্যে অনুকরণ করতে পারার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। বাপ-মা কিংবা অন্যান্য শিক্ষকদের সফলভাবে অনুকরণ করতে পারলে তবেই পরবর্তী প্রজন্ম নতুন কোনো ক্ষমতা আয়ত্ব করতে পারে। তাই এই দলের বিজ্ঞানীরা অন্য প্রজাতির মধ্যে সাংস্কৃতিক বিবর্তনের অভাবের একটা কারণ হিসেবে অনুকরণের অক্ষমতার কথা বলেন। তবে আরেকদলের মতে সামাজিক শিক্ষার এই ধারণাটা একটু সংকীর্ণ: সবসময় সরাসরি অনুকরণের হয়তো প্রয়োজন নেই। পূর্ব প্রজন্মের সৃষ্ট বস্তুর সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচিতি থাকলেই চলবে। বয়োজ্যেষ্ঠরা কিভাবে সেই বস্তু সৃষ্টি করছে, সেটা লক্ষ্য করে সেই ধাপগুলো হুবহু নকল করতে পারার প্রয়োজন নেই। কিছু ক্ষেত্রে শেষমেশ যে বস্তুটা তৈরী হলো, তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই নতুন প্রজন্ম তাকে তৈরী করার পদ্ধতিগুলো আয়ত্ব করে ফেলতে পারে। এর জন্য শেষের বস্তুটা চোখের সামনে থাকারও প্রয়োজন নেই। আগে কখনো সেটাকে দেখে থাকলেই চলবে।

একদল বিজ্ঞানীর মতে, শিক্ষার জন্য সরাসরি অনুকরণের হয়তো প্রয়োজন নেই,  পূর্ব প্রজন্মের সৃষ্ট বস্তুর সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচিতি থাকলেই চলবে।

স্বভাবতই এই ধারণাটা বিতর্কের বিষয়। এবং প্রমাণসাপেক্ষেও। সেই প্রমাণের খোঁজে ইংল্যান্ড আর নিউ জিল্যান্ড-এর একদল বিজ্ঞানী কাকেদের নিয়ে এক অদ্ভূত পরীক্ষা করলেন। ২০১৮ সালে নেচার পত্রিকায় বেরিয়েছিল সেই গবেষণার কথা [১]। কাক দেখেনি এমন মানুষ বাংলায় বিরল। অনেক সময় তাদের ঝাড়ুদার পাখি বলা হলেও গল্পের বই-এ কাকেদের বুদ্ধির পরিচয় কিন্তু আমরা সবাই দেখেছি। নুড়ি ফেলে ফেলে কুঁজোর জল উপরে তুলে এনে সেই জল পান করে তৃষ্ণা মেটানোর গল্প কে না জানি! পাখিদের মধ্যে কাক যে একাই সংস্কৃতি-র পরিচয় দেয়, এরকম নয়। অনেক পাখি তাদের নিজেদের বাসা তৈরি করে, যা নিঃসন্দেহে স্থাপত্যের নিদর্শন। পরিযায়ী পাখিদের নির্ভুল ভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পরিভ্রমণ ও পুনরায় আগমন তাদের সমবেত বুদ্ধিমত্তার (collective intelligence) পরিচয় বহন করে [১]।

যাইহোক, নিউ ক্যালাডনিয়ার কাকেদের বেছে নেওয়া হলো পরীক্ষার জন্য। অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ড-এর কাছাকাছি দ্বীপে এদের দেখা যায়। এদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এরা প্যানড্যানাস প্রজাতির গাছের পাতা ছিঁড়ে নিজেদের প্রয়োজনমত কোন কাজের জন্য যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ (tool) বানিয়ে নিতে পারে। যেমন, তারা পাতাগুলোকে ঠোঁট দিয়ে কেটে একটা নির্দিষ্ট মাপে আনে যাতে ওদের প্রয়োজনের কাজটা আরও সহজে করতে পারে [১]। এই পাতা থেকে তৈরী যন্ত্রাংশের অন্তত তিন রকম সম্পূর্ণ ভিন্ন নকশা চিহ্নিত করা গেছে, যার থেকে অনুমান করা যায় বিভিন্ন প্রয়োজনে এই ভিন্ন নকশার উৎপত্তি হয়েছে। এর মধ্যে একটা নকশা বাকিগুলোর থেকে বেশ প্যাঁচালো। অতএব বলা যায়, শুরু হয়েছিল সহজ যন্ত্র দিয়ে, আস্তে আস্তে তাতে জটিলতার প্রলেপ পড়েছে। তাই, এই কাকেদের মধ্যে হালকা হলেও একটা সাংস্কৃতিক বিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়। অথচ এদের মধ্যে শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় ভাষার জটিলতা কিংবা অনুকরণের প্রবৃত্তি কোনোটাই দেখা যায়নি। তাই, এদের যন্ত্রাংশ তৈরির ক্ষমতাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকিয়ে রাখা এবং সেই ক্ষমতাকে আরো শান দেওয়ার পিছনে একটাই ব্যাখ্যা মাথা চারা দিচ্ছিলো। এরা হয়তো পাতার যন্ত্র দেখেই একদম মেড-টু-অর্ডার বানিয়ে ফেলতে পারে। এই ব্যাখ্যাটা ঠিক কিনা সেটা বিজ্ঞানীরা আশ্চৰ্য এক পরীক্ষার মাধ্যমে পরখ করে দেখলেন।

ভেন্ডিং মেশিনের নাম তোমরা হয়ত শুনে থাকবে যেখানে নির্দিষ্ট টাকা বা পয়সা দিলেই পছন্দের জিনিসটি মেশিন থেকে বেরিয়ে আসে। অনেকটা ষ্টেশনে ওজন মাপার যন্ত্রের মত। সেই রকম কিছু বিশেষ ভেন্ডিং মেশিন বানানো হয়েছিল এই পরীক্ষার জন্য, যেখানে একটি নির্দিষ্ট মাপের কাগজের টুকরো ফেললে কাকেদের খাবার বেরিয়ে আসে। এবার কাকগুলোকে এক একটি ভেন্ডিং মেশিনের সামনে কিছু বিশেষ মাপের কাগজের টুকরো দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে কাকেদের দুই ধরণের কাগজের টুকরো দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। ৮টি কাগজের টুকরো খুব ছোট (১৫ x ২৫ মিমি), এগুলো ভেন্ডিং মেশিনে দিলে কোন খাবার পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় ৮টি বড় টুকরো (৪০ x ৬০ মিমি), এই বড় টুকরো দিলে ভেন্ডিং মেশিন থেকে খাবার বেরিয়ে আসবে। কাকগুলোকে ২-৪ দিন ধরে ট্রেনিং দেওয়া সমাপ্ত হলো। যখন ট্রেনিং সমাপ্ত হলো, ওরা ৮টি সঠিক মাপের (৪০ x ৬০ মিমি) কাগজ দিয়ে খাবার বের করতে শিখলো এবং কোন ছোট মাপের কাগজ ব্যবহার করলো না।

এবার ওই খাঁচায় কোন টুকরো কাগজ না দিয়ে দুটি বড় আকারের কাগজ (১০ x ১০ সেমি) দেওয়া হলো যেগুলো ওই নির্দিষ্ট খোপে কোনভাবেই ঢুকবে না। এখন ভেন্ডিং মেশিন থেকে খাবার বের করার একমাত্র উপায় হলো কাগজগুলোকে কেটে ছোট করা যাতে ওই খাপের সঙ্গে এক মাপের হয়। এই কাজটি করার জন্য যা প্রয়োজন তা হল পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে কাগজের মাপ (বা টেম্পলেট) স্মরণে রাখা এবং সেই জ্ঞান থেকে নতুন টুল/যন্ত্রাংশ (এক্ষেত্রে ছোট মাপের কাগজের টুকরো) তৈরি করা যা বর্তমান কাজকে সহজ ও সফল করবে। এক্ষেত্রে নিউ ক্যালাডোনিয়ার কাকগুলো কি করল? তারা কি ওই বড় কাগজটি ছোট করে কেটে নিয়ে ওই ভেন্ডিং মেশিন থেকে খাবার বের করতে সক্ষম হয়েছিল? অবাক ব্যাপার হল, হ্যাঁ। ঠোঁট ও পায়ের সাহায্যে তারা ওই বড় কাগজ কেটে ছোট টুকরো বানিয়ে খাবার বের করতে সক্ষম হয়েছিল।
শুধু তাই নয় দ্বিতীয় বার ঠিক উল্টো ভাবে কাকেদের ট্রেনিং দেওয়া হয় যেখানে ছোট কাগজের টুকরো (১৫ x ২৫ মিমি) ভেন্ডিং মেশিনে দিলে খাবার বের হবে।  এবং তাজ্জব ব্যাপার হলো এই নিউ ক্যালাডনিয়ার কাকগুলো সেই টেম্পলেটটির কথা মনে রেখে ছোট কাগজ কেটে ভেন্ডিং মেশিন থেকে খাবার বের করতে সক্ষম হয়। (চিত্র ১)

অর্থাৎ, এই কাকগুলো মনে রেখেছে কাগজের টুকরোর কি সাইজ হলে কাজে লাগবে। যেহেতু কাগজের টুকরো আর প্যানড্যানাস পাতা এক জিনিস নয়, তাই পূর্বপরিচিত শিক্ষার কোনো প্রভাব এই পরীক্ষাতে পড়েনি বলেই ধরা যায়। একটা সম্পূর্ণ নতুন জিনিস দেখে সেটা মনে রেখে তারপর নিজের চেষ্টায় সেটা সৃষ্টি করেছে এই কাকগুলো।

বিজ্ঞানীদের মতে, এইভাবেই প্রকৃতিতেও এই প্রজাতির কাকের সাংস্কৃতিক বিবর্তন হয়েছে। শিশুরা দেখেছে তাদের গুরুজনদের ছেঁড়া পাতার যন্ত্র ব্যবহার করতে, তারপর সেই যন্ত্রকে মনে রেখে পরবর্তীকালে সেগুলি নিজেরাই তৈরী করেছে। একে বিজ্ঞানীরা বলেন  মানসিক টেম্পলেট ম্যাচিং হাইপোথিসিস (mental template matching hypothesis)। এটা পাখীদের গান শেখার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। একজন কিশোর পাখী প্রথমে তাদের সমগোত্রীয়দের থেকে গানটা শোনে এবং মনের মধ্যে একটা টেম্পলেট তৈরি করে, পরে সেটা তাদের নিজের গলায় প্রকাশ করে এবং মনে রাখা সুরের সাথে তার নিজের গলাকে সম্পূর্ণ ভাবে মেলানোর চেষ্টা করে। মনের মধ্যে টেম্পলেট তৈরি থাকার ফলে যখন তারা নতুন ভাবে কিছু তৈরি করে সেসময় ওই বস্তু বা বিষয়টি চোখের/কানের পাশে থাকার কোন প্রয়োজন হয় না। সুতরাং ওই যন্ত্র বানানোর সময় যদি কোন নতুন জিনিসের সংযোজন হয় তাহলে সেটাও পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হয় এবং আরও উন্নত বা জটিল যন্ত্রে রূপায়িত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। এই প্রক্রিয়া “সাংস্কৃতিক বিবর্তন” (cultural evolution)-এর প্রাথমিক ধাপ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই প্রথম মানসিক টেম্পলেট ম্যাচিং হাইপোথিসিস-এর পরীক্ষামূলক প্রমাণ গবেষণাগারে পাওয়া গেল। তবে গবেষকরা এটাও বলেছেন যে এইভাবে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পরিচয় দেওয়া গেলেও ভীষণ জটিল কিছু হয়তো করা যায়না। তার জন্য ভাষার জটিলতা ও অনুকরণের ক্ষমতা হয়তো জরুরি।

এক কথায়, এই পরীক্ষা প্রমাণ করলো যে মানুষ অনেক, অনেকটা এগিয়ে থাকলেও একেবারে একা নয়। অন্য প্রজাতিতেও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রাথমিক ধাপগুলোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ভিডিও ক্যাপশন: কাকেদের ভেন্ডিং মেশিন থেকে খাবার আদায় করা

প্রচ্ছদের ছবি: সূর্যকান্ত শাসমল

তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:

  1. ১। Mental template matching is a potential cultural transmission mechanism for New Caledonian crow tool manufacturing traditions, S. A. Jelbert, R. J. Hosking, A. H. Taylor & R. D. Gray, Scientific Reports, volume 8, Article number: 8956 (2018) (https://www.nature.com/articles/s41598-018-27405-1)
  2. ২। R. Boyd* & P. J. Richerson,  Proceedings of the British Academy 1996,  88, 77-93

The post কর্ভাস appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

লিলিপুটদের দেশে এক আশ্চর্য গালিভার (দ্বিতীয় পর্ব)

$
0
0

আকারে বড় ব্যাকটেরিয়ারা পরিবহন সমস্যা কিভাবে সমাধান করে?


আগের পর্বে যা বলা হয়েছিল

ব্যাকটেরিয়া কোষে যেহেতু আধুনিক কোষের মতো জটিল সাজসরঞ্জাম অনুপস্থিত, তাদের ক্ষুদ্র না হয়ে উপায় নেই। সেটা না হলে কোষের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় জেনেটিক তথ্য উৎস থেকে লক্ষ্যে পৌঁছতে বেলা কাবার করে দেবে।

আধুনিক কোষের মতোই ব্যাকটেরিয়াতেও জেনেটিক তথ্যের পাচার হয় দুটো ধাপ-এ: ট্রান্সক্রিপশন (অর্থাৎ, DNA থেকে RNA-তে পরিবর্তন) আর ট্রান্সলেশন (অর্থাৎ, RNA থেকে প্রোটিন)। সুপাররেসল্যুশন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে ব্যাকটেরিয়া কোষে উঁকি মেরে দেখা গেলো যে আধুনিক কোষের মতোই দুটো ধাপ হয় দু-জায়গায়। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কারণ এর আগে ভাবা হতো ট্রান্সক্রিপশন-এর সাথে সাথেই ট্রান্সলেশন হয়। দুটো ধাপ দু-জায়গায় হওয়ার ফলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে পরিবহন-এর প্রশ্ন এসে যায়।

ব্যাকটেরিয়া-র আদিম কোষে এই পরিবহন হয় ডিফিউশন বা ব্যাপনের মাধ্যমে। এক জায়গায় কোনো অণুর জমায়েত হলে তারা সময়ের সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়তে চায়, এটাই ডিফিউশন। এই পদ্ধতি বড়  মন্থর। তাই, ব্যাকটেরিয়া কোষের কাজকর্মে যাতে অহেতুক ঢিলে না পড়ে যায়, পরিবহনের পথ যত ছোট হয়, ততই মঙ্গল। ফলে ব্যাকটেরিয়া-রা সবাই লিলিপুট। এই লিলিপুট-দের জগতে যদি হঠাৎ অনেক বড় একটা সদস্যের আবির্ভাব হয়, তাহলে বিজ্ঞানীদের ভাবনা-র বিষয় হবে বৈকি। তখন নতুন করে ভাবতে হবে, এই গালিভার তথ্য পরিবহনের সমস্যাটা সমাধান করলো কিকরে? ————————————————————————————————————————

গালিভারদের কথা

এই লিলিপুটদের জগতে কিছু গালিভার রয়েছে । এর মধ্যে কেউ কেউ দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সাধারণ ব্যাকটেরিয়াদের তুলনায় ১০০-২০০ গুন বড়।  সুতরাং আয়তনে আমাদের মডেল ব্যাকটেরিয়া ‘ই. কোলাই’-এর তুলনায় কয়েক লক্ষ গুন্ বড় [১]। তবে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াদের মতোই এই গালিভার-ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যেও যাবতীয় পরিবহন ডিফিউশন-নির্ভর। তাহলে কিভাবে সময়মতো জেনেটিক ইনফরমেশন পরিবেশন সম্ভব এই দানবিক কোষের মধ্যে? কোষের কেন্দ্রের নিউক্লিওয়েড থেকে বাইরের বিশাল আয়তন জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে তো কয়েক লক্ষ-কোটি গুন বেশি সময় লেগে যাবে।

এই বিশালাকৃতি ব্যাকটেরিয়ারা এই সমস্যার এক অভূতপূর্ব সমাধান খুঁজে নিয়েছে। এদের কোষের মধ্যে একটার বদলে প্রায় শতাধিক ক্রোমোসোম থাকে। প্রতিটি ক্রোমোসোমের চারপাশে কিছু জেনেটিক তথ্য পরিবহন করার যন্ত্রাদি (আরএনএ পলিমারেস এবং রাইবোজোম) প্রস্তুত থাকে, যাতে পরিবহনের জন্য অযথা সময় ব্যয় না হয়। এই ধরণের খুব বড় ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা গেছে যে, অসংখ্য ক্রোমোসোম কোষপর্দার খুব কাছে সারি দিয়ে সাজানো (চিত্র ১)। এইভাবে প্রতিটি ক্রোমোসোমের জেনেটিক তথ্য খুব তাড়াতাড়ি কোষেপর্দার কাছে পৌঁছে যায়। একই সাথে কোষের বাইরে থেকে আসা কোনো সিগন্যাল বা মেটাবোলাইট ক্রোমোসোমের কাছে পৌঁছে জেনেটিক তথ্যের প্রভাবে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।


চিত্র ১: Epulopiscium fishelsoni-এর ক্রোমোসোমগুলোর অবস্থান। কোষপর্দার গা ঘেঁষে উজ্জ্বল স্থানগুলো হলো ক্রোমোসোম [২]।

ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যে ‘পলিপ্লয়ডি’

এই গালিভারদের উদাহরণ হিসেবে বিশালাকৃতি ব্যাকটেরিয়া এপুলোপিসিয়ামের (চিত্র ৪ )কথা বলা যায়।  ব্যাকটেরিয়াটা এতটাই বড় যে প্রায় খালি চোখে দেখা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে একজন বিজ্ঞানী হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, ই. কোলাই-কে যদি মানুষের মতো বড় ধরা যায়, তাহলে একটা এপুলোপিসিয়ামের আকার একটা নীলতিমির মতো হবে (রেফ: মোসেলিও সেক্টর)। ২০০৮ সালে বিজ্ঞানী এস্টার আংগার্ট এবং তারা সহকারীরা দেখেন একটা এপুলোপিসিয়ামের মধ্যে প্রায় সহস্রাধিক ক্রোমোসোম রয়েছে, এবং প্রায় সমস্ত ক্রোমোসোমই কোষপর্দার খুব কাছে রয়েছে [২]। এর আগে থাইওমারগারিটা ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখা গিয়েছে। একই কোষের মধ্যে একই ক্রোমোসোমের অনেকগুলো প্রতিলিপি থাকার বৈশিষ্টকে বায়োলজিতে ‘পলিপ্লয়ডি’ বলা  হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা যতই নতুন নতুন ‘গালিভার’-দের সন্ধান পাচ্ছেন, ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যে এইরূপ ‘পলিপ্লয়ডি’-র উদাহরণের সংখ্যা ততই বাড়ছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো ব্যাকটেরিয়ার পলিপ্লয়ডি-র মাত্রা ইউক্যারিওটিক কোষদের তুলনায় অনেক বেশি।

এক আশ্চর্য্য গালিভার

এবার আসি এই গালিভারদের মধ্যেই এক ব্যতিক্রমী ব্যাকটেরিয়া, আক্রমাটিয়াম অক্সালিফেরাম-এর কথায়। গত বছরের (২০১৭) নেচার কমিউনিকেশনস পত্রিকায় এই অক্সালিফেরাম-এর সম্পর্কে এমন এক তথ্য  প্রকাশিত হয় যা ব্যাকটেরিয়া সংক্রান্ত বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব [৩]। বার্লিনের লাইবনিজ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী হান্স পিটার গ্রোসার্ট এবং তার সহকারীরা অক্সালিফেরাম-এর জেনোমিক কনটেন্ট নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখলেন যেঅক্সালিফেরাম-এর মধ্যে যথারীতি তার বিশাল আয়তনের সমানুপাতিক ভাবে কয়েকশত ক্রোমোসোম রয়েছে, কিন্তু তাদের ধরণ ঠিক পলিপ্লয়ডির মতো নয়। পলিপ্লয়ডির ক্ষেত্রে প্রায় একইধরণের ক্রোমোসোমের  বহুসংখ্যায় প্রতিলিপি থাকে, কিন্তু অক্সালিফেরাম-এর ক্ষেত্রে একই কোষের মধ্যে বিভিন্ন আলাদা আলাদা ক্রোমোসোমের সন্ধান পাওয়া গেল। ক্রোমোসোমগুলোর sequence পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেলো যে তারা একে ওপরের থেকে এতটাই আলাদা যে  ভাবা যেতেই পারে ক্রোমোসোমগুলো একটা ট্যাক্সনমি ফ্যামিলি (taxonomy family) বা একটা জেনাস (genus) – এর বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়াদের থেকে এসেছে। একটা কোষের মধ্যেই উপস্থিত ক্রোমোসোমেদের এতো বৈচিত্র সত্যিই অভাবনীয়।
এই আপাত-বিস্ময়কর পর্যবেক্ষণকে পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদের অক্সালিফেরাম-এর কোষগুলোকে এবং ক্রোমোসোমগুলোকে একটু ঘেঁটে দেখতে হবে। অক্সালিফেরাম-এর ক্রোমোসোম পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে তাদের মধ্যে প্রচুর বহিরাগত জিন অনুপ্রবেশের (insertion) চিহ্ন রয়েছে। অর্থাৎ ফেজ-ভাইরাস (phage virus) বাহিত কিংবা অন্য ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রজনন-ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে জিন স্থানান্তরের (horizontal gene transfer) মাধ্যমে অর্জিত বহিরাগত জিন প্রচুর পরিমাণে প্রতিটি ক্রোমোসোমে ঢুকেছে এবং ক্রোমোসোমগুলোকে পরিবর্তিত করেছে। অন্য গালিভারদের তুলনায় আরেকটা বিষয়ে অক্সালিফেরাম-এর পার্থক্য রয়েছে।অক্সালিফেরাম-এর মধ্যে ক্রোমোসোমগুলো কোষপর্দার গায়ে নয়, বরং কোষের মধ্যে বৃহৎ ক্যালসাইট ক্রিস্টালগুলোর ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে। অক্সালিফেরাম-এর কোষের মধ্যে উপস্থিত ক্রোমোসোমেদের বৈচিত্রের পিছনে এই ক্যালসাইট ক্রিস্টালগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই ক্যালসাইট ক্রিস্টালগুলো কোষের সাইটোপ্লাজমের মধ্যে আলাদা আলাদা কামরা (compartmentalization) তৈরী করেছে। যার ফলে, প্রতিটি ক্রোমোসোম একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে এবং বিচ্ছিন্নভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে। এই ব্যাপারটাকে আরেকটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাক।


চিত্র ২: ঠিক কি ভাবে অক্সালিফেরাম-এর একটা কোষের মধ্যেই প্রায় একটা গোটা ট্যাক্সনমি ফ্যামিলির বিভিন্ন ক্রোমোসোম এক আধারে এসে হাজির হলো, তার প্রস্তাবিত মডেল। কোনো প্রাকৃতিক কারণে অক্সালিফেরাম-এর একটা পূর্বপুরুষের আয়তন খুব বড় হয়ে যাওয়ায়, কোষের মধ্যে ক্রোমোসোমের সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন হয়। ফলে, ‘genome replication’-এর মাধ্যমে একটা কোষের মধ্যে একাধিক ক্রোমোসোম তৈরী হয়।  সময়ের সাথে সাথে বাইরে থেকে ‘horizontal gene transfer’ , কিংবা ‘phage attack’-এর ফলে প্রচুর ‘transposase’ কোষের মধ্যে ঢুকে পরে, এবং genome-গুলোকে পরিবর্তিত করে। কিন্তু, কোষের মধ্যে বিশাল আকারের ক্যালসাইট কেলাসগুলোর জন্য এই পরিবর্তন ‘locally’ হয়, এবং তার ফলে আলাদা আলাদা ক্রোমোসোম তৈরী হয়, যাদের আলাদা আলাদা রঙে দেখানো হয়েছে।

ঠিক কি ভাবে অক্সালিফেরাম-এর এক-একটা কোষের মধ্যেই প্রায় একটা গোটা ট্যাক্সনমি ফ্যামিলির বিভিন্ন ক্রোমোসোম এক আধারে এসে হাজির হলো? আসুন উপরের তথ্যের উপর নির্ভর করে একটু একটু করে সেই রহস্যের জট ছাড়াই। অন্যান্য ‘গালিভার’-দের সাথে তুলনা করে বলা যায়, অতীতে কোনো একসময় বর্তমান অক্সালিফেরামের কোনো পূর্বপুরুষ তার বিশাল আকারের সাথে খাপ খাওয়াতে নিজের ক্রোমোসোম সংখ্যা শতগুন বাড়িয়ে ফেলে। কিন্তু কোষের ভিতরে থাকা ক্যালসাইট ক্রিস্টালগুলোর কারণে ক্রোমোসোমগুলো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যায়। সময়ের সাথে সাথে বাইরে থেকে phage infection কিংবা horizontal gene transfer-এর মাধ্যমে বিভিন্ন জিন আলাদা আলাদা ক্রোমোসোমে যুক্ত হয়। তাই আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে ক্রোমোসোমের মধ্যে এক বিপুল বৈচিত্র যা থেকে মনে হয়, একটা নয়, আলাদা প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া থেকে ক্রোমোসোমগুলো এসেছে। অক্সালিফেরাম যেন একটা বৃহৎ ব্যাকটেরিয়া নয়, একই কোষপর্দার আড়ালে রক্ষিত এক বিপুল ব্যাকটেরিয়া-কলোনি।

কিন্তু সব রহস্যের জট ছাড়ানো গেছে বললে অত্যুক্তি করা হবে। সত্যি কথা বলতে গেলে ব্যাকটেরিয়াদের লিলিপুট-জগতের এই আশ্চর্য গালিভার আরো একগুচ্ছ আনুসঙ্গিক রহস্য এনে জোগাড় করেছে। ঠিক কিভাবে একটা কোষের মধ্যে এই বিভিন্ন ক্রোমোসোমগুলো সাজানো রয়েছে? যখন একটা অক্সালিফেরাম কোষ থেকে দুটো নতুন কোষের জন্ম হয়, তখন ঠিক কিভাবে এই নতুন কোষদুটোতে এই ক্রোমোসোমদের সুষ্ঠু বন্টন সম্ভব হয়? আশা করা যায় খুব শিগগিরই এর উত্তর মিলবে। এটুকু বলা যায়, একই কোষের মধ্যে এই বৈচিত্রময় ক্রোমোসোমের অবস্থান ব্যাক্টেরিওলজিতে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:

  1. [১] ব্যাকটেরিয়া আকারে একটা সিলিন্ডারের মতো।  তাই এর আয়তন দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধির সাথে সমানুপাতিকভাবে, এবং প্রস্থের বৃদ্ধির দ্বিতীয় ‘পাওয়ার’ এর সাথে সমানুপাতিক ভাবে বৃদ্ধি  পায়। তাই শুধু দৈর্ঘ্য-এ ১০০ গুন্ বড় হলে আয়তনে ১০০ গুন্ বড়, শুধু প্রস্থে ১০০ গুন্ বড় হলে আয়তনে ১০,০০০ গুন বড়, এবং দৈর্ঘ্য-প্রস্থ উভয়েই ১০০ গুন্ বড় হলে আয়তনে ১০,০০,০০০ বা ১০ লক্ষ গুন্ বড়।
  2. [২] Extreme polyploidy in a large bacterium. Mendell JE1, Clements KD, Choat JH, Angert ER.
  3. [৩] Community-like genome in single cells of the sulfur bacterium Achromatium oxaliferum: Danny Ionescu, Mina Bizic-Ionescu, Nicola De Maio, Heribert Cypionka & Hans-Peter Grossart

The post লিলিপুটদের দেশে এক আশ্চর্য গালিভার (দ্বিতীয় পর্ব) appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

জোনাকি আলোকে (দ্বিতীয় পর্ব)

$
0
0

জোনাকির আলোর পিছনে রাসায়নিক এবং শারীরবৃত্তীয়  ক্রিয়াপদ্ধতিটি ঠিক কী ? কেনই বা জোনাকির আলো দপদপ করে জ্বলে আর নেভে?


প্রায় বছরখানেক আগেকার কোন এক সন্ধ্যেবেলার ঘটনা।  আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এন সি বি এস-এর বাইরে গান্ধী কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আচমকা চোখে পড়লো কাছের বেশ কিছু গাছের  ঝোপে বিন্দু বিন্দু আলো ঝিক্-মিক্ করে জ্বলছে, নিভছে আর উড়ে বেড়াচ্ছে। বহু বছর বাদে নিজের চোখে জোনাকি দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেছিল।  মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা, লোডশেডিং হলেই জোনাকি ধরে কাচের শিশিতে ভরে রাখতাম, সব কিছু ফেলে অবাক হয়ে সেই শিশিবন্দী জোনাকিদের থেকে বেরনো আলোর জ্বলা-নেভা দেখতাম। তখন জোনাকির আলো আমার কাছে রহস্যই ছিল। এসব ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল ‘বিজ্ঞান’-এ পূর্ব প্রকাশিত ‘জোনাকি আলোকে’ লেখাটার কথা [১]। লেখাটা পড়তে গিয়ে বুঝলাম জোনাকির আলোর পিছনে যেমন রাসায়নিক কারণ লুকিয়ে আছে ঠিক তেমনই এর  জীববিজ্ঞানের দিকও আছে। জীববিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে চট করে দুটো প্রশ্ন মাথায় এসে গেল। সেই নিয়েই দুই পর্বে এই লেখা। প্রশ্নগুলো হলঃ

প্রথমত, জোনাকির দেহের আলোনির্গতকারী কোষের মধ্যে ঘটা রাসায়নিক এবং শারীরবৃত্তীয়  ক্রিয়াপদ্ধতিটি ঠিক কি ?

দ্বিতীয়ত, জোনাকির বিবর্তনে এবং বংশ বিস্তারে এই আলোক সংকেতের কোন গ্রহণযোগ্য কারণ আছে কি ? জোনাকির এই বায়োলুমিনেসেন্সের (জৈবিক আলো নির্গমন) বায়োলজিকাল দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখার আগে আমরা সবাই রাসায়নিক বিক্রিয়াটা আর একবার ঝালিয়ে নিই।

প্রথম পর্বঃ জোনাকির আলোর রাসায়নিক কারণ

চিত্র ১ – লুসিফেরিন, লুসিফারেজ উৎসেচক, এ টি পি এবং অক্সিজেনের সম্মিলিত রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি অক্সিলুসিফেরিন থেকেই জোনাকির আলো বের হয়। ছবির উৎস : http://bigyan.org.in/2014/12/04/jonaki-aloke/

জোনাকির দেহের যে সমস্ত  কোষ থেকে আলো বের হয় সেগুলোকে ফটোসাইট (photocyte) বলে।  ফটোসাইটের ভিতরে লুসিফেরিন, লুসিফারেজ উৎসেচক, এ টি পি এবং অক্সিজেনের সম্মিলিত রাসায়নিক বিক্রিয়ায়  অক্সিলুসিফেরিন তৈরি হয় আর ওই অক্সিলুসিফেরিন থেকেই আলো বের হয় (চিত্র ১)।

চকমকি জোনাকি

জোনাকির ফটোসাইটে ঘটা রাসায়নিক বিক্রিয়াটি ঠিক কি ভাবে হয় সেটা জানতে গেলে আমাদের জোনাকির দেহের যে প্রান্তভাগ থেকে আলো নির্গত হয় সেই অংশের অ্যানাটমিটা একটু জানতেই হবে। আলো নির্গতকারী এই দেহাংশের বেশ একটা মজাদার নাম রয়েছে – ফায়ারফ্লাই ল্যান্টার্ন, কখনও ছোট করে শুধু ল্যানটার্ন-ও বলা হয়।

চিত্র ২ – জোনাকির আলো নির্গতকারী দেহাংশের অ্যানাটমি

জোনাকির  আলো নির্গতকারী দেহাংশের অ্যানাটমি : জোনাকির দেহের শেষাংশটি  যদি আড়াআড়ি ভাবে কাটি তাহলে প্রস্হচ্ছেদের ছবিটা অনেকটা উপরের ছবির (চিত্র ২) মতো দেখাবে । দেহাংশের শেষভাগটির সবচেয়ে বাইরের ত্বকটি স্বচ্ছ। তার ঠিক ভিতরের ত্বকেই রয়েছে আলো নির্গতকারী কোষ বা ফটোসাইট এবং আরো ভিতরে রয়েছে ইউরিক অ্যাসিড কৃস্টালে ভরা অন্তঃত্বক। এই ফটোসাইটের ভিতরেই রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে যা হল জোনাকির আলোর মূল কারণ। রাসায়নিক বিক্রিয়ার মূল উপাদান হল লুসিফেরিন, লুসিফারেজ উৎসেচক, এ টি পি এবং অক্সিজেন। বিক্রিয়ায় তৈরি হয় অক্সিলুসিফেরিন। এই অক্সিলুসিফেরিন থেকেই আলো বের হয়, যা ভিতরের ইউরিক অ্যাসিডের কৃস্টালের স্তর থেকে প্রতিফলিত হয়ে দেহের বাইরে বেরিয়ে আসে।

চিত্র ৩ – শ্বাসনালিকা দিয়ে ফটোসাইটে অক্সিজেনের প্রবেশ

ফটোসাইটে লুসিফেরিন, লুসিফারেজ উৎসেচক এবং এ টি পি সব সময় মজুদ থাকে। কিন্ত বিক্রিয়াটি ঘটানোর জন্য অক্সিজেন শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রিত ভাবে সরবরাহ হয়ে থাকে কোষের বিশেষ অংশের মধ্যে। মূল শ্বাসনালি থেকে শ্বাসনালিকার মাধ্যমে কোষের ভিতরে ঢোকা  অক্সিজেন (চিত্র ৩) নির্দিষ্ট সময়ের ছন্দে বাকি তিনটি রাসায়নিক পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে আর সেই জন্যেই আলোর নির্গমন ছন্দোবদ্ধ। তাই যদি না হত তবে আমরা শুধু স্থির আলো দেখতে পেতাম।

[Pullquote: জোনাকির আলোক নির্গমনের বার্তা আসে স্নায়ুতন্ত্র থেকে]

এই আলোক নির্গমনের বার্তা আসে স্নায়ুতন্ত্র থেকে। জোনাকির আলো জ্বলা বা নেভা নিয়ন্ত্রিত হয় তার স্নায়ুতন্ত্র থেকে আসা ছন্দোময় রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে। স্নায়ুপ্রান্ত থেকে নির্দিষ্ট ছন্দে ক্ষরিত হয় অক্টোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার, যা ধাপে ধাপে  অনেকগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন করে নাইট্রিক অক্সাইড [৪]। জোনাকি যখন আলো ছাড়বে মনে করে তখন নির্দিষ্ট কিছু স্নায়ুপ্রান্ত থেকে  (ফটোসাইট সংলগ্ন নিউরোন) অক্টোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার ক্ষরিত হয়। অক্টোপামিন বিশেষ কিছু কোষের মধ্যে অনেক ধাপ বিশিষ্ট বেশ কিছু জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে নির্দেশ দেয়। ওই সব রাসায়নিক বিক্রিয়াসমূহের মধ্যে উৎপাদিত অন্যতম  রাসায়নিক পদার্থ হ’ল নাইট্রিক অক্সাইড সিন্থেজ (NOS)।  নাইট্রিক অক্সাইড সিন্থেজ কোষের মধ্যে এক বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে   নাইট্রিক অক্সাইড (NO) উৎপন্ন করে, যা পরিবাহিত হয়ে আসে শ্বাসনালিকার মধ্যে দিয়ে ফটোসাইটে, আর তার ফলে ফটোসাইটে মাইটোকন্ড্রিয়াগুলি অক্সিজেন গ্রহণে অক্ষম হয় এবং  শ্বাসনালিকা থেকে অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ক্ষণিকের জন্য রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য অক্সিজেনের ঘাটতি মিটে যায় এবং  লুসিফেরিন, লুসিফারেজ উৎসেচক ও এ টি পি-র সাথে বিক্রিয়ার ফলে আলো বের হয় [২,৩]।  মেকানিজমটা আরো গভীরে গিয়ে বুঝতে উৎসাহী পাঠককে চতুর্থ রেফারেন্স আর্টিকলটি পড়ার জন্য অনুরোধ করবো [৪]।

চিত্র ৪ – কোষে নাইট্রিক অ্যাসিডের উপস্থিতি জোনাকির আলো উৎপন্ন করার জন্য আবশ্যিক।

আরেকটু পরিষ্কার করে উপরের ছবি (চিত্র ৪) দেখে বোঝা যাক। নাইট্রিক অক্সাইডের অনুপস্থিতিতে কোষের মধ্যে উপস্থিত মাইটোকন্ড্রিয়া শ্বাসনালিকার চারপাশে জড়ো হয়ে থাকে আর সমস্ত পরিবাহিত অক্সিজেন মাইটোকন্ড্রিয়া শুষে নেয় বলে লুসিফেরিন, লুসিফারেজ উৎসেচক, এ টি পি-র সাথে অক্সিজেনের বিক্রিয়া হয় না, তাই কোন আলো উৎপন্ন হয় না। নাইট্রিক অক্সাইডের উপস্থিতিতেই আলো উৎপন্ন হয়, আর তাই আমরা জোনাকির আলো হিসাবে দেখি।

পরের পর্বে দ্বিতীয় প্রশ্নের, অর্থাৎ বিবর্তনে জোনাকির আলোর ভূমিকা আছে কিনা, তার উত্তর দেব।

প্রচ্ছদের ছবির উৎস: http://blog.arkive.org/tag/adaptation/

বিশদে জানতে :

[১] জোনাকি আলোকে

[২] Nitric oxide and Firefly Flashing

[৩] Nitric Oxide and the Control of Firefly Flashing

[৪] Role of Nitric Oxide and Mitochondria in Control of Firefly Flash

The post জোনাকি আলোকে (দ্বিতীয় পর্ব) appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

জোনাকি আলোকে (তৃতীয় পর্ব)

$
0
0

বিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে জোনাকির আলোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা যায়? পরিবেশ দূষণের সাথেই বা জোনাকির আলোর কী সম্পর্ক?


আগের পর্বে (জোনাকি আলোকে ২) জোনাকির আলোর রাসায়নিক কারণ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।  এবার আসি আমার দ্বিতীয় প্রশ্নে। অর্থাৎ, জোনাকির  বিবর্তনে এবং বংশ বিস্তারে এই আলোক সংকেতের কোন গ্রহণযোগ্য কারণ আছে কি ?

খুব স্বাভাবিক ভাবেই তোমরা উৎসুক হবে যে এই আলোর সংকেতের উদ্দেশ্যটা ঠিক কি ?            

বিবর্তনের উপর কয়েকটি কথা

তোমরা যারা স্কুলে পড়ছো তাদের একটা কথা বলি। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী থিয়ডোসিয়াস ডোবঝান্সকি বলেছিলেন, “বিবর্তন প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে জীববিদ্যায় কোন ব্যাখ্যাই অর্থবহ হয় না” ( “Nothing in Biology Makes Sense Except in the Light of Evolution”)। তাই  জীববিজ্ঞানে যখনই কোন জীবের অস্তিত্ব সংক্রান্ত প্রশ্ন মাথায় আসবে তখন বিবর্তন তত্ত্বটি মাথায় রাখবে। বেশ কিছু উত্তর পাবে,  আবার কখনো কখনো অতিরিক্ত জটিলতার কারণে অনেক উত্তর পেতে বেশ বেগ পেতে হবে বা যুক্তিযুক্ত  উত্তর  পাবেই  না হয়তো। কথা হচ্ছিল জোনাকি নিয়ে, হঠাৎ এসব  খটমট কথা কেন ? ধীরে ধীরে সে প্রসঙ্গে যাবো, তবে তার আগে  বরং তোমাদের দিকে কয়েকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই! খুব সাধারণ প্রশ্ন, যার বেশ কিছু উত্তর বিজ্ঞানীরা দিতে পেরেছেন আবার কিছু পারেন নি এখনও পর্যন্ত। যেমন সাদা ফুল কেন রাতে ফোটে ? জোনাকি কেন রাতে আলো দেয় ? ঝিঁঝিঁ কেন শব্দ করে ? ময়ূরের পেখম অত উজ্জ্বল এবং বড় কেন ? কারোর কাছ থেকে না শিখেই  মাকড়শা নিজে নিজেই কেমন করে তার জাল বানাতে পারে ? গিরগিটি কেন রং বদলায় ? ইত্যাদি। বেশিরভাগ প্রশ্নেরই উত্তর লুকিয়ে রয়েছে বিবর্তনের পাতায়। তাই জোনাকির আলো প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু বিবর্তনের কয়েকটা উল্লেখযোগ্য কথা বলি।

“বিবর্তন প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে জীববিদ্যায় কোন ব্যাখ্যাই অর্থবহ হয় না” – থিয়ডোসিয়াস ডোবঝান্সকি

বিবর্তনের সময়ের  নিরিখে কোন জীবের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে গেলেই প্রথম যে দিকে নজর দিতে হয় সেটা হল তারা বংশবিস্তারে কতটা সক্ষম। যে কোন প্রজাতির জীব গোষ্ঠীরই বংশবিস্তারের সাফল্যে কোন না কোন উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য থাকে যার ফলে তারা অন্যান্য প্রতিযোগী তুল্য-প্রজাতির জীবের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের জৈবিক অস্তিত্বকে আরো সবল করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রেই বিবর্তন তত্ত্ব বোঝার বা ব্যাখ্যার  জন্য জনন  বিশেষ এক চাবি কাঠি, জননের সাফল্য (অনেক সময় অস্তিত্বের সাফল্য) প্রত্যক্ষও  হতে পারে কিংবা পরোক্ষ (টীকা -১)। আরো একটু যদি গভীরে যাই তা হলে দেখবো অনেক  প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে জননের (জোর দিয়ে বললে যৌন জনন) আগে মহিলা-পুরুষ নিজেদের মধ্যে কিছু মিলন সংকেতের (mating signal) মাধ্যমে ভাব আদান প্রদান করে, পরস্পর সন্তুষ্ট হলে হয় মিলন, ফল বংশবিস্তার। জীবজগতে এই মিলন সংকেত নানা রকমের এবং বড়ই বৈচিত্র্যময়। মিলন সঙ্গী (বা সঙ্গিনী) পরস্পরকে প্রভাবিত করতে কি রকম সংকেত দেয় তার একটা বড় উদাহরণ ময়ূরীর সামনে পেখম মেলে ময়ূরের নাচ।

জোনাকির আলোমিলন সংকেত!

এবার আশা রাখি তোমরা জোনাকির আলোর আর একটা কারণ আন্দাজ করে ফেলেছো। হ্যাঁ, জোনাকির এই আলো আসলে মেটিং সিগন্যাল। মহিলা জোনাকিরা ঝোপের নিচে মাটিতে বসে থাকে আর পুরুষ জোনাকিরা উড়তে উড়তে আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে মহিলাদের সংকেত পাঠায়। মহিলা জোনাকির কোনো পুরুষের সংকেত পছন্দ হলে একই রকম ছন্দ ও তীব্রতার আলো ছেড়ে তাকে মিলনের বার্তা দেয়। জোনাকির আলোর রং, আলোর স্পন্দন, তীব্রতারও অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে। এতো রকমফের থাকা সত্ত্বেও নিজের নিজের  প্রজাতিকে চিনে নিতে জোনাকিরা ভুল করে না। এ প্রসঙ্গে বলি শুধু মাত্র পূর্ণাঙ্গ জোনাকিই  আলো ছাড়ে তা নয়, তাদের ডিম, লার্ভা থেকেও আলো বের হয়। পতঙ্গভুক খাদকদের মুখে  জোনাকির দেহ মোটেই সুস্বাদু নয় তাই ওই আলো সতর্কবার্তার মতোও কাজ করে, ফলে খাদকদের হাত থেকে বেঁচে থাকতে বেশ সুবিধে হয়। বেশ অবাক করা ব্যাপার তাই না ?

মহিলা জোনাকিরা ঝোপের নিচে মাটিতে বসে থাকে আর পুরুষ জোনাকিরা উড়তে উড়তে আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে মহিলাদের সংকেত পাঠায়।

শহরে জোনাকিরা হারিয়ে গেল কেন?

এবার আমি আমার একটা অভিজ্ঞতা তোমাদের কাছে বলি। আমি কলকাতার মূল শহরে কোন দিন জোনাকি দেখি নি, দেখেছি আমাদের মফঃস্বলের বাড়িতে। স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে দেখলাম শেষ জোনাকি দেখেছি প্রায় বছর পনেরো আগে। আমার কাছে এ এক বহুদিনের রহস্য, জোনাকিরা হারিয়ে গেল কেন? ঠিক কি ধরনের দূষণের জন্য জোনাকিরা তাদের অস্তিত্ব হারাচ্ছে? কীটনাশক, বায়ু দূষণ ছাড়া আর কোনো দূষণের কথা মাথায় আসেই নি। জোনাকি নিয়ে পড়তে গিয়ে জানলাম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোকদূষণ [১]। এই আধুনিক যুগে আজ সব জায়গাতেই  বৈদ্যুতিক আলোতে ভরে গেছে, এতে আমাদের সুবিধে যে হয়েছে সেটা অনস্বীকার্য কিন্তু জোনাকিদের ক্ষেত্রে তা তাদের অস্তিত্ব সংকটে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে বৈদ্যুতিক আলোর তীব্রতার কারণে জোনাকিদের নিজেদের মধ্যে সংকেতের আদান-প্রদান বিঘ্নিত হচ্ছে ফলে সমস্যা ঘটছে প্রজননে এবং বংশবিস্তারে।

সব কিছু ছাড়িয়ে ক্ষণিকের মধ্যে জোনাকি বদলে দিয়েছে কোন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস !

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ” । জোনাকি সাহিত্যে এসেছে বার বার, সে দেশেই হোক বা বিদেশে। জীববিদ্যার গবেষণায় জোনাকির অবদান অনস্বীকার্য [২]। কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে ক্ষণিকের মধ্যে জোনাকি বদলে দিয়েছে কোন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস [৩]! ১৬৩৪ সাল, ব্রিটিশ নৌবাহিনী ভেসে চলেছে কিউবায় ঘাঁটি গাড়বে  বলে। তীরে পৌঁছানোর আগে নৌবাহিনী দেখলো কিউবার দিক থেকে ভেসে আসছে প্রবল আলো, অনেকটা ঝলকানির মতো।  ব্রিটিশ সৈন্যরা ভাবলো স্প্যানিশ নৌবাহিনী  তাদের আগেই কিউবা দখল করে বসেছে, ওই আলো বোধ হয় স্প্যানিশদের সৈন্য শিবির থেকেই আসছে। কিন্তু ইতিহাস বলে ওই সময় কিউবায় কোনো  স্প্যানিশ বাহিনী ছিল না। ব্রিটিশরা অধিকসংখ্যক জোনাকির আলোকে ভুল করেছিল স্প্যানিশ অধিকৃত যুদ্ধ শিবিরের আলো ভেবে, তাই তারা আর কিউবার দিকে এগোয় নি  [৩]!


টীকা ১ : “জননের সাফল্য (অনেক সময় অস্তিত্বের সাফল্য) প্রতক্ষও হতে পারে কিংবা পরোক্ষ”  একটু জটিল বিষয়।  বোঝার সুবিধার্থে ‘বিজ্ঞান’-এ পূর্বে প্রকাশিত কয়েকটা  লেখা পাঠককে পড়তে অনুরোধ করবো।

লেখাগুলি হ’ল, পেখম রহস্য, ছদ্মবেশী, কাটা গাছে রসের ফোঁটা

প্রচ্ছদের ছবির উৎস: http://blog.arkive.org/tag/adaptation/

লেখকের পক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি: জোনাকি নিয়ে গবেষণার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই জোনাকি সম্বন্ধে জানতে গিয়ে আমি বিস্মিত হয়েছি তাই কলম ধরেছি যদি সেই আনন্দ কিঞ্চিৎ ভাগ করে নেওয়া যায় লেখার  উৎসাহ পেয়েছি মার্ক জিমারের লেখা গ্লোয়িং জিন্স : অ্য রিভলুশন ইন বায়োটেক্নলজি [, ] ,  পদক্ষেপ স্বেচ্ছাসেবীর লেখা জোনাকি আলোকে এবং জি কে ভি কে, ব্যাঙ্গালোরের জ্বলন্ত জোনাকিদের কাছ থেকে, যারা মনের মধ্যে উস্কে দিয়েছে অনেক অনেক প্রশ্ন

লেখকের পক্ষ থেকে বিশেষ ধন্যবাদবিজ্ঞান’-এর সম্পাদকদের প্রতিযারা লেখাটির মূল্যায়ন  পরিমার্জনে সহযোগিতা করেছেন

বিশদে জানতে :

[১] Illuminating Insights into Firefly Luciferase and Other Bioluminescent Reporters Used in Chemical Biology

[২] Role of Nitric Oxide and Mitochondria in Control of Firefly Flash

[৩] www.firefly.org/

[৪] Glowing Genes: A Revolution In Biotechnology [৫] Review on Glowing Genes: A Revolution in Biotechnology

The post জোনাকি আলোকে (তৃতীয় পর্ব) appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

মহাবিশ্বের নতুন জানালা

$
0
0

বহুদূত জ্যোতির্বিজ্ঞান বা মাল্টি-মেসেঞ্জার অ্যাস্ট্রোনমি: মহাকাশ পর্যবেক্ষণে এই নতুন সংযোজনটিকে কিভাবে দেখবো?


বহুদূত জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্ম  

একটিমাত্র মহাজাগতিক ঘটনা। তাকে নিয়েই লেখা হলো অসংখ্য গবেষণাপত্র, তাও মাত্র দু’মাসের মধ্যে। বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার জ্যোতির্বিজ্ঞানী অবদান রাখলেন এসব গবেষণায়। এমন কাণ্ড জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে আগে কখনো বোধহয় হয়নি। কি সেই ঘটনা? কি তার মাহাত্ম্য? ঘটনাটি হলো মহাকাশে দুটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষ আর তাদের মিলন। আর মাহাত্ম্য হলো, এই প্রথম বিজ্ঞানীরা একইসঙ্গে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আর মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সাহায্যে আবিষ্কার করলেন একটি মহাজাগতিক ঘটনা। আর সেইসঙ্গে জন্ম নিলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা: মাল্টি-মেসেঞ্জার অ্যাস্ট্রোনমি (multi-messenger astronomy) বা বহুদূত জ্যোতির্বিজ্ঞান। আর এই জন্মের দিনটি, অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ই অগস্ট বিজ্ঞানের ইতিহাসে লাল হরফে লেখা  রইলো।

জানালা কেন?

শুরু করা যাক প্রথম থেকেই। আপনার কি মনে হয় দূরবীন দিয়ে আকাশ দেখে দেখে সময় কাটানো আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো, দুই সমান? তাহলে মনে করুন, আপনি আছেন একটি ঘরের মধ্যে, যার বাইরেটা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। ঘরের একমাত্র দরজাটি তালাবন্ধ আর চাবি আপনার কাছে নেই। একটি জানলা আছে ঘরে। সেটি বন্ধ কিন্তু খোলা যায়। প্রশ্ন হলো, আপনি কি জানালাটি খুলবেন? আমি জানি যে আপনি খুলবেন। আর খুলতে যদি বেশ কষ্ট করতে হয়? তাহলেও আপনি খুলবেন।

যদি জিজ্ঞেস করি কেন, আপনি অবাক হয়ে বলবেন: এর আবার কারণ কি দেবো? এটাই তো স্বাভাবিক! বাইরে কি আছে দেখবো না? ব্যাস, অমনি আপনি মেনে নিলেন দূরবীন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণের যৌক্তিকতা।

ছবি ১: একটি সেক্সট্যান্ট (সূত্র)

আমরা সত্যিই ভূপৃষ্ঠে, বলা যায় একটা ঘরের মধ্যে আমৃত্যু বন্দী। দরজায় তালা, বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু জানালা একটা আছে।  দৃশ্যমান আলো। মানে যে আলোয় আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। তাই যুগ যুগ ধরে আমাদের পূর্বসূরিরা আকাশের দিকে তাকিয়েছেন, আকাশ চেনার চেষ্টা করেছেন, তারাদের সাহায্যে সময়ের হিসেব করেছেন, দিকনির্ণয় করেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান বোধহয় প্রাচীনতম বিজ্ঞান। দূরবীন ছিল না এককালে। তাতে কি? খালি চোখে আর অন্য যন্ত্রপাতির সাহায্যে তারাদের অবস্থান, গ্রহদের অবস্থান, কালকে একই সময় তারা কোথায় থাকবে, এইসবই জেনেছে মানুষ। এমনই একটি যন্ত্র সেক্সট্যান্ট (sextant), যার সাহায্যে দুটি বস্তুর মধ্যে কৌণিক দূরত্ম মাপা যায়।

আমরা আমৃত্য ভূপৃষ্ঠে বন্দী কিন্তু দৃশ্যমান আলোর জানালা আমাদের কাছে সর্বদা খোলা আছে।

দৃশ্যমান আলোর জানালা

তবে গ্যালিলিও গালিলি যখন সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একটি দূরবীন দিয়ে নভঃবস্তুদের দেখতে শুরু করলেন, আর যা দেখলেন সেইসব তথ্য লিখে রাখতে শুরু করলেন, তখনই বলা যায় মহাবিশ্বের প্রথম জানালা ভালো করে খুললো। এ ছিল দৃশ্যমান আলোর জানালা। আর এইসঙ্গে সূচনা হলো আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের।

কি দেখলেন গ্যালিলিও? দেখলেন চাঁদের পাহাড়, শনির বলয়, বৃহস্পতি গ্রহের চারিদিকে ঘূর্ণায়মান চাঁদ, আরো কতসব আশ্চর্য জিনিস। এও কি সম্ভব যে আকাশের স্বর্গীয় সব বস্তুতে থাকতে পারে খুঁত (পাহাড় আর গহ্বর)? পৃথিবীকে ছেড়ে বৃহস্পতির চারিদিকে কেন ঘুরবে কোনো নভঃবস্তু? কিন্তু জানালা দিয়ে তো আমরা তাই দেখলাম।

ব্যাস, শুরু হয়ে গেল অনুসন্ধান। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর লোকেদের অভাব কোনো কালেই হয়নি। তাদেরই একজন ছিলেন টাইকো ব্রাহে। ইনি অবশ্য আগেই, দূরবীন ছাড়াই, গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। আর মূলত সেইসব তথ্য ব্যবহার করে তাঁরই এক সহকর্মী, জোহান কেপলার, আবিষ্কার করলেন গ্রহদের গতিবিধির নিয়ম। কিন্তু কেন গ্রহগুলি এইসব নিয়ম মেনে চলে তা কিন্তু তখনো বোঝা যায়নি। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী আইসাক নিউটন গাণিতিকভাবে কেপলারের পর্যবেক্ষণজনিত সূত্রগুলি প্রমাণ করেন। তিনি  দেখান যে প্রকৃতিতে বস্তুর গতিবিধি আর তাদের পারস্পরিক মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কতগুলি সাধারণ নিয়ম আছে যা পার্থিব বস্তু আর মহাজাগতিক বস্তুদের ক্ষেত্রে একইরকমভাবে খাটে।

মানবজাতির ইতিহাসে এ এক অসামান্য আবিষ্কার। এর ফলে মহাজাগতিক বস্তুগুলি আর আমাদের বুদ্ধির অগম্য রইলো না, কুসংস্কার আর মনগড়া ধারণা পিছিয়ে গেল অনেক দূরে, পৃথিবীর বাইরের এক বিশাল জগৎ এসে গেল আমাদের জ্ঞানের পরিধির মধ্যে আর এক অসীম সম্ভাবনার দরজা খুলে মানুষের মনন আর ধীশক্তি প্রথম এই ছোট গ্রহের বাইরে পা রাখলো।

বিজ্ঞানী আইসাক নিউটন-এর সূত্র থেকেই মহাজাগতিক বস্তুগুলি আমাদের বুদ্ধির নাগালে আসে।

ছবি ২: আমেরিকা-র উইলসন পাহাড়ের উপর আড়াই মিটার ব্যসের দূরবীন-এর সামনে লেখক। এই দূরবীন দিয়েই হাবল আবিষ্কার করেছিলেন আমাদের মহাবিশ্ব।

জানালা বড় হতে শুরু করলো। অর্থাৎ বড়, আরো বড়, দূরবীন তৈরী হতে লাগলো। দূরবীন যত বড় হবে তত একটি নভঃবস্তু থেকে বেশি আলো সংগ্রহ করতে পারবে আর তত ভালো করে নভঃবস্তুটিকে দেখা আর বোঝা যাবে। অবশেষে ১৯১৭ সালে আমেরিকা-র ক্যালিফোর্নিয়া-র পাসাডেনা শহরের বাইরে উইলসন পাহাড়ের উপর বসানো হলো আড়াই মিটার ব্যসের একটি দূরবীন। পরবর্তী বত্রিশ বছর ধরে এটিই ছিল বিশ্বের বৃহত্তম দূরবীন। আর এই দূরবীন দিয়েই বিজ্ঞানী এডউইন হাবল আবিষ্কার করলেন এই মহাবিশ্ব! এই সময়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ বা Milky Way-ই মহাবিশ্ব। হাবল এমন অনেক নক্ষত্রজগৎ আবিষ্কার করলেন যা আকাশগঙ্গা-র অনেক বাইরে। আর মানুষের মনন আর ধীশক্তি আরেকবার পা বাড়ালো সীমা থেকে অসীমের দিকে।

আরো জানালার সম্ভাবনা

আমরা এখনো পর্যন্ত্য যে মহাবিশ্বকে জানি, তা তো মোটামুটিভাবে আবিষ্কার হলো প্রথম জানালা দিয়েই। কিন্তু এই একটি জানালা, তাকে যতই বড় করা হোক না কেন, তা কিন্তু এই মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণভাবে জানা বা বোঝার পক্ষে মোটেই যথেষ্ট নয়। কিন্তু অন্য জানালাগুলি কি?

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে-র অসংখ্য পরীক্ষানিরীক্ষার ফলে তড়িৎ-চুম্বকীয় বিদ্যার কতগুলি সূত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল এই সূত্রগুলি থেকে গাণিতিকভাবে দেখান যে দৃশ্যমান আলো প্রকৃতপক্ষে এক ধরণের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। আসলে এই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মান যদি একটি নির্দিষ্ট ব্যাপ্তির মধ্যে থাকে তবেই তাকে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। কিন্তু কি হবে যদি এই তরঙ্গদৈর্ঘ্য সেই ব্যাপ্তির বাইরে, অর্থাৎ দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে কম বা বেশি হয়? যদি তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্রমাগত কমতে থাকে, তাহলে আমরা পাবো শক্তিশালী, আরো শক্তিশালী রশ্মিসমূহ, যেমন আল্ট্রা-ভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি, এক্স-রে আর গামা-রে। আর যদি তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হতে থাকে তবে আমরা পাবো ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আর রেডিও তরঙ্গ।

দৃশ্যমান আলো প্রকৃতপক্ষে এক ধরণের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, যার বাইরেও অনেক ধরণের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ রয়েছে

এইসব রশ্মিগুলো একে একে আবিষ্কৃত হয়। উইলিয়াম হার্শেল আবিষ্কার করেন অবলোহিত তরঙ্গ, উইলহেম রন্টজেন আবিষ্কার করেন এক্স-রে। বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের ব্যাপ্তি বিশাল। রেডিওতে তরঙ্গদৈর্ঘ্য হতে পারে বড় বড় বাড়ির আকারের মতো। আবার গামা রশ্মিতে তা হতে পারে পরমাণুর কেন্দ্রকের মতো, যা কিনা এক মিটার-এর এক কোটি ভাগেরও দশ কোটি ভাগের এক ভাগ! আর এই অকল্পনীয় ব্যাপ্তির একটা ছোট্ট অংশ অধিকার করে আছে দৃশ্যমান আলো, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য জীবাণুদের আকারের মতো। তাহলে এ কি সম্ভব যে শুধু দৃশ্যমান আলো দিয়েই মহাবিশ্বকে জানা আর বোঝা যাবে আর তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের বাকি অংশের কোনো ভূমিকাই থাকবে না?

রেডিও জানালা

না, একথা বিজ্ঞানীরা মেনে নিতে পারেননি, আর তাতেই খুলতে লাগলো একের পর এক জানালা। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম জানালাটি খুললো রেডিও তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। কেন? কারণ রেডিও দিয়ে বহুদূরে যোগাযোগ করা যায়। তাই শুধু গবেষণাগারের মধ্যে এই তরঙ্গ-সংক্রান্ত কাজ সীমিত নয় আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর বাইরেও এর একটা উপযোগিতা আছে।

ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই যেসব বিজ্ঞানীরা রেডিও তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন তাদের কেউ কেউ সূর্য থেকেও রেডিও তরঙ্গ খুঁজেছিলেন। কিন্তু কেউই সফল হননি। এদিকে ১৯৩০-র দশকের প্রথমদিকে ইঞ্জিনিয়ার কার্ল জানস্কি একটি কোম্পানির হয়ে রেডিও-র সাহায্যে অতলান্তিক মহাসাগরের এপার থেকে ওপারে যোগাযোগের উপরে গবেষণা করছিলেন।  মহাকাশ থেকে রেডিও তরঙ্গ খুঁজে পাওয়ার কথা তিনি ভাবেনও নি। কিন্তু সেইটাই পেলেন তিনি। পেতে লাগলেন একটি অদ্ভুত সিগন্যাল যা বেড়ে উঠছিলো ঠিক ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট পর পর। প্রথমে তিনি ভাবলেন, এ হলো সূর্য থেকে আসা রেডিও তরঙ্গ। তাঁর অ্যানটেনা-টি একটি নির্দিষ্ট দিক থেকেই মূলত রেডিও তরঙ্গ ধরতে পারে। দিনে একবার যখন সূর্য সেই নির্দিষ্ট দিকে আসে, তখনি তার অ্যানটেনা হয়তো সূর্যের রেডিও তরঙ্গ ধরছে, এরকমই প্রথমে ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু তাহলে ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট পর পর রেডিও সিগন্যাল বেড়ে উঠছে কেন? ২৪ ঘন্টা পর পর নয় কেন? বহুদূরের প্রায় স্থির হয়ে থাকা তারার সাপেক্ষে পৃথিবী ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিটে একবার নিজের অক্ষের চারিদিকে ঘুরে আসে, ২৪ ঘন্টায় একবার নয় [১]। তাই বহুদূরের থেকে আসা কোনো রেডিও সিগন্যাল ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিটেই একবার তাঁর অ্যানটেনা-য় বিশেষভাবে ধরা পড়ার কথা। অর্থাৎ তার সিগন্যাল-টি নিশ্চয় আসছে বহুদূরের কোনো জগৎ থেকে। শেষে বোঝা গেল সিগন্যাল-টি আসছে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সবচেয়ে ঘন অংশ থেকে। আমরা এখন জানি যে সেখানে বসে আছে একটি রাক্ষুসে কৃষ্ণগহ্বর। আর জানস্কি-র এই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে খুললো মহাবিশ্বের রেডিও জানালা।

ইঞ্জিনিয়ার কার্ল জানস্কি-র তৈরী অ্যানটেনায় ধরা পড়লো এক অদ্ভুত সিগন্যাল। আবিষ্কার হলো মহাবিশ্বের রেডিও জানালা।

তবে এর মধ্যে বেজে উঠলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যুদ্ধ ধ্বংস ডেকে আনে। মহাজগৎকে জানার প্রচেষ্টা স্তব্ধ করে দেয়। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর অর্থ, সময় বা সুযোগ কারোরই থাকে না। তবে যুদ্ধের দরকারে রেডিও প্রযুক্তির বেশ উন্নতি হলো। ফলস্বরূপ, যুদ্ধের পরেই রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেশ রমরমা শুরু হলো। রেডিও জানালা দিয়ে আমরা মহাবিশ্বকে নতুন চোখে দেখলাম, নতুনভাবে বুঝলাম আর আবিষ্কার হলো নতুন ধরণের সব নভঃবস্তু। যেমন, নিউট্রন-তারা, যার কথা আমরা এই লেখার প্রথমেই বলেছি, যা কিনা বহুদূত জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্ম দিতে সাহায্য করলো, তাও আবিষ্কৃত হলো এই রেডিও তরঙ্গের সাহায্যেই। এই নিউট্রন-তারাগুলি অতি আশ্চর্য বস্তু, এদের ভর সূর্যের ভরের থেকেও বেশি, কিন্তু আকারে এরা একটি শহরের মতো। আর তাই তাদের ঘনত্ব এতো বেশি যে নিউট্রন তারার এক পেয়ালা বস্তুর ভোর এভারেস্ট শৃঙ্গকেও হার মানিয়ে দিতে পারে।

সত্যি বলতে কি দৃশ্যমান আলো দিয়ে আমরা মহাবিশ্বের বিস্তার, উপাদান আর রহস্যের বেশ কিছুটা আবিষ্কার করলেও তা ছিল বাংলা প্রবচন ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’-এর মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নতুন নতুন জানালা খোলা আর সেই জানালাগুলি ক্রমাগত বড় করার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে এতো নতুন নতুন জিনিস জানতে পেরেছি যে তার তুলনায় এই যুদ্ধের আগে পর্যন্ত্য আমাদের হাজার হাজার বছরের জ্ঞানকে শুধু ভিত-ই বলা চলে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ হিসেবে যদি কোনো সময়কে অভিহিত করা যায় তবে সেই সময় এখনই। আমি এখানে শুধু তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গে আরেকটা জানালা খোলার কথা বলবো।

এক্স-রে জানালা

রিকার্ডো জিয়াকোনি আর তার সহকর্মীদের একটি যন্ত্র যখন ১৯৬২ সালে সৌরমণ্ডলের বাইরের একটি বস্তু থেকে এক্স-রে খুঁজে পেলো, তখনি খুললো মহাবিশ্বের এক্স-রে জানালা। এই বস্তুটি হলো একটি যুগ্ম-তারা, যার একটি হলো নিউট্রন-তারা। লক্ষ্য করুন, বহুদূত জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো এক্স-রে জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও জন্ম হলো নিউট্রন তারার হাত ধরেই। এক্ষেত্রে সঙ্গী তারাটি থেকে গ্যাস ভীষণ বেগে নিউট্রন তারার উপর পড়ছে। ফলে সেই গ্যাস-এর তাপমাত্রা হয়ে যাচ্ছে দশলক্ষ সেলসিয়াস-এরও বেশি, আর তাই সেই গ্যাস বিকিরণ করছে এক্স-রে। তবে এই মহাজাগতিক এক্স-রে আবিষ্কারের জন্য জিয়াকোনি-কে তার যন্ত্রটিকে পাঠাতে হয়েছিল বায়ুমণ্ডলের উপরে, রকেট-এর সাহায্যে। কারণ মহাজাগতিক এক্স-রে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আসতে পারেনা, পারলে আমাদের অস্তিত্ব থাকতো না।

আর কি কি দূত?

তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গই কিন্তু একমাত্র দূত নয়, যা দূর মহাবিশ্বের খবর আমাদের কাছে বয়ে আনে। ‘কসমিক রে’ নামে অতি শক্তিশালী নানা ধরণের কণাও আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। এছাড়া রয়েছে অতি হালকা কিন্তু অত্যন্ত দ্রুতগতি নিউট্রিনো কণা যা প্রায় সবকিছুই ভেদ করে চলে যায় আর তাই তাদের খুঁজে পাওয়াও কঠিন। এইসব কণারাও কিন্তু মহাবিশ্বের একেকটি জানালা। তবে এই জানালাগুলির পুরো সদ্ব্যবহার এখনো শুরু করা যায়নি [২]।

মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জানালা

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ঘোষণা করলেন তাঁর নতুন মহাকর্ষীয় তত্ত্ব। তিনি বললেন যে বস্তুর মহাকর্ষের প্রভাবে স্থানকাল বেঁকে যায়, দুমড়ে যায়। আর কি আশ্চর্য, মহাকাশ পর্যবেক্ষণ-জনিত তথ্যগুলিও তাঁর এই অদ্ভুত তত্ত্বকে সমর্থন করলো। এখন প্রশ্ন হলো, একটি অত্যন্ত ঘন ও ভারী মহাজাগতিক বস্তুর বিশেষ গতির ফলে এই স্থানকালে এমন তরঙ্গের সৃষ্টি হতে পারে কিনা, যা মহাবিশ্বের দূর প্রান্ত থেকে আমাদের কাছে পৌঁছতে পারে।

উত্তর হলো, হ্যাঁ, পারে। কয়েক দশকের তাত্ত্বিক আর প্রযুক্তিগত গভীর গবেষণার ফলস্বরূপ ২০১৫ সালে আবিষ্কৃত হলো এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ [৩]। গবেষণায় প্রমাণিত হলো যে এই তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল বহুদূরের দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মিলনের ফলে। আর সেইসঙ্গে খুলে গেলো মহাবিশ্বের একটি নতুন জানালা। তবে স্বাভাবিকভাবেই কোনো আলো দেখা গেলো না এই মিলন থেকে কারণ দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মিলনে সাধারণভাবে কোনো তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরিত হওয়ার কথা নয়। এইভাবে দেখার একটা ছোট্ট মুশকিল হলো যে একটা নতুন-পরিচয়-হওয়া দূতের খবর কতটা নির্ভরশীল তা আপনি ঠিক জানেন না। হয়তো এই দূত বলছে এক আর আপনি বুঝছেন আরেক।  এ যেন আপনি চোখ বুজে থাকতে থাকতে হঠাৎ মুখে তাপ অনুভব করলেন আর ভাবলেন রোদ এসে পড়লো আপনার মুখে। কিন্তু তাতো না-ও হতে পারে, পাশে হিটার চালানো হতে পারে। চোখ খুললেই আপনি জানবেন। অর্থাৎ মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জানালা যে ঠিক খবর দিচ্ছে সেবিষয়ে যথার্থভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটা মহাজাগতিক ঘটনা একইসাথে মহাকর্ষীয় আর তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের দ্বারা দেখতে পাওয়া প্রয়োজন!

মহাকর্ষীয় তরঙ্গ মহাবিশ্বের আরো একটি জানালা খুলে দিয়েছিলো।

এই চোখ খোলা গেল ২০১৭ সালের ১৭ই অগাস্ট যখন দূর মহাবিশ্বের দুটি নিউট্রন তারার মিলন আমরা প্রত্যক্ষ করলাম শুধু মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জানালা দিয়েই নয়, তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের বিভিন্ন জানালা দিয়েও। সম্পূর্ণ দুই ধরণের দূত একই সঙ্গে জানান দিলো এই অসামান্য মহাজাগতিক ঘটনার আর খুলে গেলো এক বহুদূত জানালা। অসামান্য ঘটনা কেন? কারণ এই ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারলাম অনেক কিছু, যার প্রমাণ পাওয়া যায় মাত্র দু’মাসে লেখা অসংখ্য গবেষণাপত্র থেকে। আমরা জানলাম যে মহাবিশ্বের ভারী মৌলিক পদার্থগুলি এইরকম নিউট্রন তারাদের মধ্যে সংঘর্ষ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। আর তাই আপনার হাতের সোনার আংটি আর গলার সোনার হারের উপাদান অতীতের দুটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষের ফলশ্রুতি।

প্রচ্ছদের ছবি: সূর্যকান্ত শাসমল

টীকা :

[১]  যে সময় অন্তর সূর্য দিনের আকাশে নিজের সর্বোচ্চ অবস্থানে ফিরে আসে তাকে এক সৌর দিন বলে। এক সৌর দিন =  ২৪ ঘন্টা। এই সময় টা পৃথিবী নিজের অক্ষের চারিপাশে এক পাক ঘুরতে যত সময় নেয়  তার থেকে মিনিট চারেক বেশি। এর কারণ পৃথিবী নিজের অক্ষের চারিপাশে এক পাক ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের চারিপাশে নিজের কক্ষপথেও ১ ডিগ্রী মতো এগিয়ে যায়। এই এক্সট্রা সরণের জন্য সূর্যকে মাথার ওপর ফিরিয়ে আনতে পৃথিবীকে এক চরকিপাকের পরও আর একটুখানি পাক খেতে হয়। এতেই চার মিনিট বেশি সময় যায়।  বিস্তারিত জানতে এখানে দেখুন।

[২] মিউয়ন কণা-র সাহায্যে সাম্প্রতিক এক আশ্চর্য আবিষ্কারের কথা জানতে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত এই লেখাটি পড়ুন: https://bigyan.org.in/2018/08/24/great-pyramid-muon-tomography/
[৩] মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আবিষ্কার নিয়ে বিশদে জানতে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত এই লেখাটি পড়ুন: https://bigyan.org.in/2016/05/23/gravitational-wave-detection-ligo_1/

The post মহাবিশ্বের নতুন জানালা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

ক্রায়ো-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ: ভাইরাস চেনার ‘গুগল আর্থ’ ও নোবেল পুরস্কার (১)

$
0
0

ক্রায়ো – ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের আবিষ্কার ও তার মাধ্যমে জৈব অণুর গঠন কাঠামো দেখিয়ে ২০১৭ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিন বিজ্ঞনীঃ রিচার্ড হেন্ডারসন, জ্যাক দুবোসে ও জোয়াকিম ফ্রাঙ্ক।  জিকা, ইবোলা, ডেঙ্গু, এইডস ইত্যাদি ভাইরাসের হাই-রেজোলিউশন ছবি তুলতে সক্ষম এই ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে লিখছে চঞ্চল চক্রবর্তী। আজ প্রথম পর্ব।


‘ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল’…. আর এই ‘ঠান্ডা’ মন্ত্রেই চাক্ষুষ দেখা যেতে পারে জিকা, ইবোলা, ডেঙ্গি, এইডস, এমনকি ক্যান্সার বা আলঝাইমার্সের মতো ভয়ানক শত্রুদের! তাত্ত্বিক অর্থে এই ‘ঠান্ডা’ পদ্ধতিতে বিভিন্ন জৈব অণু যেমন প্রোটিন, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদির ত্রিমাত্রিক বা 3D গঠন দেখার প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ২০১৭ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান রিচার্ড হেন্ডারসন, জ্যাক দুবোসে ও জোয়াকিম ফ্রাঙ্ক। প্রচলিত ট্রান্সমিশন ইলেক্ট্রন  মাইক্রোস্কোপির সাথে গুরুত্বপূর্ণ এক ‘কুলিং স্টেজ’ যুক্ত করে ছবি তোলার এক নতুন পদ্ধতির সূত্রপাত হয় ক্রায়ো-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ (ক্রায়ো-ইএম)-এর মাধ্যমে। বায়োকেমিস্ট্রির গবেষণা হয়ে ওঠে সহজতর। জীবদেহের ভিতরের জটিল থেকে জটিলতর জৈব অণুগুলির পরমাণু স্তরের ত্রিমাত্রিক ছবি, তাদের গঠন কাঠামো, মানবদেহে তাদের চলাচল (ডায়নামিক্স) ও আচার-আচরণ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর ভাবে দেখা সম্ভব হয়েছে এই ‘ক্রায়ো-ইএম’ এর মাধ্যমে। এতদিন এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি, নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স (NMR) স্পেকট্রোস্কোপি কিম্বা ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে অনেক অণুর গঠন নির্ভুল ভাবে নির্ণয় করা যেত না। সেই কাজটা খুব সহজ করে তুলেছে ‘ক্রায়ো-ইএম’। এর মাধ্যমেই সুচারু ভাবে সম্ভব হবে মানব দেহের বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া কিংবা ক্যান্সারের টার্গেট প্রোটিন গুলিকে পর্যবেক্ষণ করা ও তাদের প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক ঔষধ আবিষ্কার।

জীবদেহের ভিতরের জটিল থেকে জটিলতর জৈব অণুর পরমাণু স্তরের ত্রিমাত্রিক বা 3D ছবি স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব হয়েছে ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে।

চিত্র ১ – ক্রায়ো-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের আবিষ্কর্তা: বাম দিক থেকে জ্যাক দুবোসে, জোয়াকিম ফ্রাঙ্ক ও রিচার্ড হেন্ডারসন। ছবির উৎস Science News Vol. 192 No. 7, October 28, 2017, p. 6

ক্রায়ো উষ্ণতা ও ক্রায়ো-ইএম কি ?

‘ক্রায়ো’ শব্দটি ‘ক্রায়োজেনিক’ (Cryogenic) শব্দ থেকে এসেছে। শব্দটির মানে হল খুব কম উষ্ণতা – মোটামুটি ভাবে -১৫০ oC এর  নিচে। এই কম উষ্ণতায় কোনো জৈব অণুর জলীয় দ্রবণকে সরাসরি এবং খুব তাড়াতাড়ি কঠিনে পরিণত করা হয়।  এই পদ্ধতির নাম ভিট্রিফিকেশন। এই ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে কোনো জৈব অণুর চারপাশে থাকা জল খুব তাড়াতাড়ি জমে কঠিনে পরিণত হয়। অথচ, সেই জৈব অণুটির চেহারা অবিকৃতই থেকে যায়, এমনকি ক্রায়ো ই-এম যন্ত্রের অতি-শূন্য পরিবেশেও (ultra-high vacuum)। আগে তরল নাইট্রোজেন (-১৯৫.৭৯ °C) দিয়ে তৈরী করা হত এই ক্রায়ো উষ্ণতা। যদিও বর্তমানে নাইট্রোজেনের বদলে তরল ইথেনের (-১৮৮ °C)  ব্যবহার হয়।

ক্রায়ো-ইএম-এ এই জমে যাওয়া ভিট্রিফায়েড জৈব প্রোটিন অণুর উপর আলোর গতিবেগে ছুটে আসা ইলেক্ট্রনের স্রোত (যে ইলেক্ট্রনদের শক্তি ৮০-৩০০ কিলোভোল্টের মত) ফেলা হয়। বিশেষ ভাবে তৈরী এক ক্যামেরা এই ইলেক্ট্রনের ছবি ও ভিডিও তোলে। এত শক্তিশালী ইলেকট্রনগুলো প্রোটিন অণুটিকে ধ্বংস করতে পারে না তার আশেপাশে জমে যায় ‘ভিট্রিফায়েড’ জলের অণুর জন্য। অর্থাৎ, বলা যেতে পারে, ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতি হলো ক্রায়ো-ইএম-এ ব্যবহৃত নমুনার (sample-এর) সুরক্ষার উৎসস্থল।

ক্রায়ো-ইএম যন্ত্রে কোন জৈব অণুর একই সাথে তোলা হাজার হাজার ঝাপসা ছবি থেকে কম্পিউটার অ্যালগরিদম ব্যবহার করে এক হাই-রেজোলিউশন ত্রিমাত্রিক বা 3D ছবি তৈরী করা হয়!

 এরপর কম্পিউটার এলগোরিদম এর সাহায্যে ক্যামেরায় তোলা ছবি ও ভিডিও গুলিকে ‘এডিট’ করার পালা। জৈব অণুটির একই সাথে তোলা হাজার হাজার ঝাপসা ছবি থেকে এক স্পষ্ট বা হাই-রেজোলিউশন (৩ অ্যাংস্ট্রম এর কম রেজোলিউশন) ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরী করা হয়। এই ত্রিমাত্রিক ছবি থেকে ওই জৈব অণুর আণবিক গঠন কাঠামো বা আচার আচরণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া সম্ভব হয়।

পুরনো প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ও ‘ক্রায়ো-ইএম’ এর ঔৎকর্ষ

পঞ্চাশের দশক থেকে এক্সরে-ক্রিস্টালোগ্রাফির মাধ্যমে জৈব অণু বিশেষত প্রোটিনের গঠন কাঠামো দেখার কাজ শুরু হয়।  আর তার আগে ১৯৩১ সালে জার্মান ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার  ম্যাক্স নোল ও জার্মান পদার্থবিদ আর্নস্ট রুসকা ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরী করেন।  তাঁর এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৮৬ সালে আর্নস্ট রুসকা পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান।  দুৰ্ভাগ্যবশতঃ নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগেই ম্যাক্স নোল ১৯৬৯ সালে মারা যান। অন্যদিকে ১৯৬২ সালে ব্রিটিশ ক্রিস্টালোগ্রাফার জে সি কেন্ড্রিউ ও অস্ট্রিয়া জাত ব্রিটিশ বায়োলজিস্ট ম্যাক্স পেরুজ এক্সরে-ক্রিস্টালোগ্রাফির সাহায্যে ‘গ্লোবিউলার  প্রোটিন’ এর গঠন কাঠামো আবিষ্কার করে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান। ওই সালেই ডিএনএ  ডাবল হেলিক্স গঠন আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পান ফ্রান্সিস ক্রিক, জেমস ওয়াটসন ও ফ্রেডেরিক উইলকিন্স।  তারপর আশির দশকের শেষের দিকে ব্যবহার হতে শুরু করে NMR (Nuclear Magnetic Resonance) স্পেকট্রোস্কোপি। ১৯৯১ সালে সুইস বিজ্ঞনী রিচার্ড আর্নস্ট রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান NMR স্পেকট্রোস্কোপি আবিষ্কারের জন্য। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যেখানে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ, এক্সরে-ক্রিস্টালোগ্রাফি বা NMR স্পেক্ট্রোস্কোপির মতো প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই প্রোটিনের গঠন কাঠামো দেখার জন্য আবিষ্কৃত ও নোবেল পুরস্কার দ্বারা স্বীকৃত, সেখানে ক্রায়ো-ইএম পদ্ধতি এমন কি নতুন করে দেখালো যার ফলে আবার নোবেল পুরস্কার দিতে হল?

চিত্র ২ – ক্রায়ো – ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ ও তার কার্যপদ্ধতি । ছবির উৎস The Royal Swedish academy of Science/Nobel prize

আসলে ক্রায়ো-ইএম পদ্ধতি আগের ব্যবহৃত তিনটি পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা সহজেই অতিক্রম করেছে, আর জৈব অণুর ছবি তোলার পদ্ধতিকে সাফল্যের চরম শিখরে নিয়ে গেছে।

  1.  প্রথমতঃ ক্রায়ো-ইএম পদ্ধতিতে যে জৈব অণুর ছবি তুলতে আমরা আগ্রহী, তাকে  ‘ফ্রোজেন লিকুইড’ অবস্থায় ব্যবহার করা যায়। এক্সরে ক্রিস্টোলোগ্রাফিতে শুধু ক্রিস্টাল বা কেলাস ব্যবহৃত হয়।  অনেক জৈব অণু যেমন জটিল পলিমেরিক প্রোটিন কেলাস তৈরীই করে না, তাই তাদের জন্য ক্রায়ো-ইএমই একমাত্র ভরসা। আবার ক্রায়ো-ইএম এ যেহেতু প্রোটিনের দ্রবণ নিয়ে তাকে ‘ফ্রোজেন লিকুইড’ করা হয় তাই একসাথে একধিক প্রোটিন অণুর গঠন কাঠমো দেখারও সুযোগ থাকে। ফলে অত্যন্ত জটিল প্রোটিন অণুর দশায় দশায় গঠন কাঠামোর পরিবর্তন অর্থাৎ ‘ফেজ ট্রান্সফরমেশন’ বোঝাও সম্ভব হয়েছে।
  2. দ্বিতীয়তঃ খুব সামান্য প্রোটিন অণু দ্রবণের মধ্যে হলেই কাজ হয়ে যায়, এনএমআর স্পেকট্রোস্কোপি বা ক্রিস্টালোগ্রাফির মতো বেশি পরিমানে নমুনা প্রোটিন দরকার হয় না।
  3. তৃতীয়তঃ ক্রায়ো-ইএম পদ্ধতিতে ব্যবহৃত উন্নত কম্পিউটার এলগোরিদম এর জন্য এর ছবির রেজোলিউশন বা স্পষ্টতা প্রচলিত নেগেটিভ  স্টেইনিং  ট্রান্সমিশন  ইলেক্ট্রন  মাইক্রোস্কোপির থেকে অনেকটা বেশি।
  4. চতুর্থতঃ খুব ছোট ছোট প্রোটিন বা পেপটাইড এর গঠন নির্ণয় করা জন্য এনএমআর স্পেকট্রোস্কোপি খুব কার্যকরী। কিন্তু খুব বড় আকারের প্রোটিন যেখানে অনেক হাইড্রোজেন আর কার্বন অণুর উপস্থিতি সেখানে এনএমআর স্পেকট্রোস্কোপি পদ্ধতি খুব জটিল এবং ত্রূটিপূর্ণ।  এসব ক্ষেত্রে ক্রায়ো-ইএম পদ্ধতি খুব কার্যকরী।
  5. পঞ্চমতঃ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ক্রায়ো-ইএম পদ্ধতিতে প্রোটিন অণুর চারপাশে কঠিন অবস্থায় ‘ভিট্রিফায়েড’ জল থাকার জন্য উচ্চশক্তির ইলেক্ট্রন স্রোত নমুনা প্রোটিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না।

এইসব কারণের জন্যই ক্রায়ো-ইএম পদ্ধতি আধুনিক জৈব-রসায়ন গবেষণাতে অনেক বেশি গ্রহণ যোগ্য ও কার্যকরী হয়ে উঠেছে।  তাই ক্রায়ো-ইএম নিয়ে নোবেল কমিটির দাবি, ”এই গবেষণা জৈব রসায়ন দুনিয়ায় নিশ্চিত ভাবেই যুগান্তকারী”।

পরের পর্বে আমরা এই বিস্ময় যন্ত্রটির আবিষ্কারের পিছনে আরও কিছু কথা শুনব।

(পরের পর্বে সমাপ্য)

রেফারেন্স ও আরো বিশদে জানতে :

(১) Nature 2017, 550, 167.

(২) The Rise of Cryo-Electron Microscopy, spring 2016, 13-21.

(৩) https://en.wikipedia.org/wiki/Cryogenics

(৪) এক্ষেত্রে ক্রিস্টাল ও কাচ বা গ্লাসের গঠনগত পার্থক্য আলোচনা করলে ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতির ধারণাটা পরিষ্কার হবে। কোনো দ্রবণকে দ্রুত জমিয়ে (quenched)  ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে কাচ তৈরি হয়। এই দ্রুত জমিয়ে কঠিনে পরিণত হওয়ার ফলে দ্রবণের অণুগুলি স্থিতিশীল সজ্জায় (equilibrium configuration) আসার সময় পায় না – বিশৃঙ্খল (disordered) অবস্থাতেই কঠিনে পরিণত হয়। অন্যদিকে, ক্রিস্টাল কোনো দ্রবণ থেকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হওয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়  সংশ্লিষ্ট অণুগুলি একটি স্থিতিশীল সজ্জা পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়। সুতরাং, এক্ষেত্রে একটি সুশৃঙ্খল অণুসমষ্টির কেলাস বা ক্রিস্টাল তৈরী করে।

যদিও তরল নাইট্রোজেনের তাপমাত্রা অনেক কম (-১৯৫.৭৯ °C), ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে বর্তমানে তরল নাইট্রোজেন ব্যবহৃত হয় না।  তরল নাইট্রোজেনের তাপ ধারণ ক্ষমতা ও তাপ পরিবাহিতা অনেক কম হওয়ায়, যখন কোনো সাধারণ তাপমাত্রার জলীয় দ্রবণ এর মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, তা গরম হয়ে ফুটতে শুরু করে এবং তা ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতিকে মন্দীভূত করে। তরল নাইট্রোজেনের মাধ্যমে ভিট্রিফিকেশনের জন্য সময় বেশি লাগাতে এই পদ্ধতিতে ‘ভিট্রিফায়েড’ জলের পাশাপাশি বরফের ঘনক তৈরির সুযোগ থাকে। এক্ষেত্রে তরল ইথেনের তাপ ধারণ ক্ষমতা ও তাপ পরিবাহিতা তরল নাইট্রোজেনের তুলনায় বেশি, যদিও তাপমাত্রা মোটামুটি একই (-১৮৮ °C)। তাই, দ্রুত ও সঠিক ভাবে জৈব অণুর জলীয় দ্রবণকে ভিট্রিফিকেশনের জন্য বর্তমানে তরল ইথেন বাব্যহৃত হয়। 

(৫) https://www.youtube.com/watch?v=026rzTXb1zw

(৬) J. Chem. Educ. 2014, 91, 2009−2012

(৭) Science News 2017, 192, 6.

(৮) Nature, 2015, 525, 172–174.

(৯) BBA – General Subjects 2018, 1862, 324–334

(১০)https://www.chemistryworld.com/news/explainer-what-is-cryo-electron-microscopy/3008091.article

(১১)https://phys.org/news/2017-10-nobel-winning-technique-google-earth-molecules.html (১২) Mol. Cancer Ther. 2009, 8, 626.

The post ক্রায়ো-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ: ভাইরাস চেনার ‘গুগল আর্থ’ ও নোবেল পুরস্কার (১) appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).


ক্রায়ো-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ: ভাইরাস চেনার ‘গুগল আর্থ’ ও নোবেল পুরস্কার (২)

$
0
0

ক্রায়ো – ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের আবিষ্কার ও তার মাধ্যমে জৈব অণুর গঠন কাঠামো দেখিয়ে ২০১৭ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিন বিজ্ঞনীঃ রিচার্ড হেন্ডারসন, জ্যাক দুবোসে ও জোয়াকিম ফ্রাঙ্ক।  জিকা, ইবোলা, ডেঙ্গু, এইডস ইত্যাদি ভাইরাসের হাই-রেজোলিউশন ছবি তুলতে সক্ষম এই ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে লিখছে চঞ্চল চক্রবর্তী। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।


প্রথম পর্বে আলোচনা করেছিলাম কীভাবে ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ বা ক্রায়ো-ইএম জৈব অণুদের খুব তাড়াতাড়ি -১৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে ঠান্ডা করে স্পষ্ট ত্রিমাত্রিক বা 3D ছবি তুলতে পারে।  ইবোলা, জিকা ইত্যাদি ভাইরাসের ও ক্যান্সারের ছবি তুলে ক্রায়ো-ইএম চিকিৎসাশাস্ত্রে ও গবেষণার জগতে যুগান্তর এনেছে।

ক্রায়ো-ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের ইতিবৃত্ত

ক্রায়ো-ইএম

ক্রায়ো-ইএম-এর এই ”এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন” অবস্থা একদিনে তৈরী হয় নি। ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে স্কটিশ মলিকুলার বায়োলজিস্ট রিচার্ড হেন্ডারসন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি দিয়ে প্রোটিনের কাঠামো বের করার উপর পিএইচডি করেন। এরপর তিনি কেমব্রিজের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল’স  ল্যাবরেটরি  অফ  মলিকুলার বায়োলজিতে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে ব্যাক্টেরিয়োরোডোপ্সিনের গঠন বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু মুশকিল হলো প্রতিবারেই ব্যাক্টেরিয়োরোডোপ্সিন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রে ব্যবহৃত উচ্চশক্তির ইলেক্ট্রনের স্রোত ও অতি-শূন্যতায় (vacuum) ভেঙে যাচ্ছিল। তাই হেন্ডারসন গ্লুকোজ দ্রবণের আস্তরণ বা কোটিং দিয়ে ব্যাক্টেরিয়োরোডোপ্সিন কে সুরক্ষিত করে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের মধ্যে ব্যবহার করলেন। একই সঙ্গে তিনি ইলেক্ট্রন স্রোতের শক্তিও কমিয়ে দিলেন। কিন্তু এত সবের পরও হেন্ডারসন খুব একটা স্পষ্ট ছবি পেলেন না। তবে এই কোটিং পদ্ধতি তাঁর মনে ধরলো। তখন ১৯৭৫ সাল। পরের কয়েক বছরের মধ্যে হেন্ডারসন উদ্ভাবন করলেন ‘কুলিং টেকনোলজি’। ব্যাক্টেরিয়োরোডোপ্সিনকে তরল নাইট্রোজেনের মধ্যে জমিয়ে ১৯৯০ সালে সূচনা করলেন ক্রায়ো-ইএম- এর। ছবির স্পষ্টতাও বেড়ে গেল!  কিন্তু তা তো শুধুমাত্র একটি প্রোটিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। শুরু হলো আরো গভীর গবেষণা।

β-galactosidase এর কম্পোজিট ইমেজ দেখায় কিভাবে cryo-EM এর রেজোলিউশন সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নাটকীয়ভাবে উন্নতি করেছে। বাম দিকে পুরোনো চিত্র, আরও সাম্প্রতিকতম ডানদিকে। ছবির উৎস Subramaniam Lab, National Cancer Institute.
১৯৯০ সালে ক্রায়ো-ইএম পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ব্যাক্টেরিয়োরোডোপ্সিনের প্রথম হাই-রেজোলিউশন চিত্র। ছবির উৎস Henderson et al. J. Mol. Biol. (1990) 213, 899-929

১৯৮২ সালে সুইস বিজ্ঞনী জ্যাক দুবোসে ইউনিভার্সিটি অফ লুসানে আবিষ্কার করলেন ‘ভিট্রিফিকেশন’ পদ্ধতি। খুব তাড়াতাড়ি জলকে তরল নাইট্রোজেনে (−১৯৫.৭৯ °C) ঠান্ডা করে কঠিনে পরিণত করাই হলো ‘ভিট্রিফিকেশন’। প্রোটিনের জলীয় দ্রবণ ‘ভিট্রিফিকেশন’ এর সাহায্যে কঠিন পরিণত হলো। আগেই বলেছি, এই ভিট্রিফায়েড নমুনা প্রোটিনের মধ্যে থাকা জমা জলের অণুই ক্রায়ো-ইএমে ব্যবহৃত প্রোটিনের সুরক্ষার বর্ম। এই সুরক্ষাই ছিল হেন্ডারসনের কাছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’! আশির দশকের মাঝামাঝি জার্মান বিজ্ঞানী জোয়াকিম ফ্রাঙ্ক তৈরী করলেন এক উন্নততর অ্যালগরিদম যা অনেক দ্বিমাত্রিক বা 2D ছবির প্রক্রিয়াকরণ (image processing) করে এক স্পষ্ট ত্রিমাত্রিক বা 3D ছবি বের করে আনে। প্রথমে প্রাপ্ত অসংখ্য দ্বিমাত্রিক ছবিগুলিকে সিগন্যাল-টু-নয়েস রেসিও বাড়িয়ে শ্রেণীকরণ (classify) করা হয়। ছবিগুলির প্রজেকশন অনুযায়ী তুলনা করে (চিত্র ৪) একই রকম ছবিগুলিকে শ্রেণীবদ্ধ করার জন্য আধুনিক অ্যালগোরিদম এর সাহায্য নেওয়া হয়। এরপর শ্রেণীবদ্ধ 2D ছবিগুলিকে বিভিন্ন কোণে বিন্যস্ত করে উচ্চ স্পষ্টতা সম্পন্ন ত্রিমাত্রিক বা 3D মডেল পাওয়া যায়।

চিত্র ৪ – ক্রায়ো-ইএম এ প্রাপ্ত 2D ছবির 3D প্রক্রিয়াকরণ। ছবির উৎস E. V. Orlova et al. Chem. Rev., 2011, 111, 7710–7748.

চিকিৎসাশাস্ত্রে ইউরেকা

জিকা ভাইরাস ও ক্রায়ো-ইএম




চিত্র ৫ – ক্রায়ো-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে দৃশ্যমান জিকা ভাইরাস। ছবির উৎস Johan Jarnestad/The Royal Swedish Academy of Sciences

টাইম মেশিনে চড়ে পিছিয়ে যাওয়া যাক ২০১৪ সালের অগাস্ট মাসে। ব্রাজিল আন্তর্জাতিক ক্যানুইং প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে আসা কোনো অতিথির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এক অজানা ভাইরাস। মৃত্যর কোলে ঢলে পড়ল গর্ভস্থ ভ্রূণ ও সদ্যজাতকেরা। ব্রাজিল এবং পুরো ল্যাটিন আমেরিকাতে মহামারীর আকার নেয় এই ভাইরাসের আক্রমণ। সেই পরিস্থিতিতে একান্ত প্রয়োজন ছিল ভাইরাসটিকে চেনা ও তার প্রতিষেধক আবিষ্কার করা।  এক্স-রে-ক্রিস্টালোগ্রাফি বা NMR পদ্ধতি দিয়ে চেষ্টা করা হল, কিন্তু এই ভাইরাসটাকে চেনা সম্ভবই হচ্ছিল না। এখানেই ক্রায়ো-ইএমের কারসাজি শুরু। নির্ভুলভাবে চেনা গেল এই ‘জিকা ভাইরাস’ আর তার মাস তিনেকের মধ্যেই আবিষ্কৃত হলো জিকা ভাইরাস এর প্রতিষেধক।১০ ২০১৬ তে থামানো গেলো সদ্যোজাতের মৃত্যুযজ্ঞ।

ক্রায়ো-ইএমের সাহায্যে একে একে ইবোলা, ডেঙ্গু, এইডস বা সিভিয়ার ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো জটিল রোগের ভাইরাসগুলির ছবি তোলা গিয়েছে। এর ফলে তাদের প্রতিষেধক ঔষধ আবিষ্কারের পথও সুগম হয়েছে। এজন্যই আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির সভাপতি অ্যালিসন ক্যাম্পবেলের মতে ক্রায়ো-ইএম যেন প্রকৃত অর্থে শরীরে ভাইরাসের গতিবিধি বোঝার ‘গুগল আর্থ’।১১

“ক্রায়ো-ইএম যেন প্রকৃত অর্থে শরীরে ভাইরাসের গতিবিধি বোঝার ‘গুগল আর্থ’।” –  অ্যালিসন ক্যাম্পবেল, আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির সভাপতি

ক্যান্সার ও ক্রায়ো-ইএম

মানবদেহে  ডিএনএ পুনরাবৃত্তি (রেপ্লিকেশন) একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতি যা একটি কোষ থেকে আরেকটি কোষে জেনেটিক কোড অণুলিপি করে। এর ফলে জিনগত নির্দেশাবলী এক প্রজন্মের কোষ থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কোষে পৌঁছয়। শরীরে যখন এই স্বাভাবিক জিনগত পরিবর্তন ও ডিএনএ রেপ্লিকেশন বাধা পায় তখন তৈরী হয় ক্যান্সার। ক্যান্সারের ফলে শরীরে অস্বাভাবিক কোষ লাগামছাড়াভাবে বাড়তে থাকে ও ত্রুটিপূর্ণ জেনেটিক রেপ্লিকেশন হতে থাকে। ক্রায়ো-ইএম ক্যান্সার কোষে এই ডিএনএ রেপ্লিকেশন সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়ে ক্যান্সার গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেছে। ক্যান্সারের রোগীর শরীরে জিনের মিউটেশনে বড় ভূমিকা নেয় দুটি প্রোটিন; আইসোসাইট্রেটে ডিহাইড্রোজিনেজ (IDH-1) ও ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজিনেজ (LDH)। IDH-1 ও LDH স্বাভাবিক অবস্থাতে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করলেও এদের মিউটেটেড অবস্থাতে সমস্যা শুরু হয়।  IDH-1এর মিউটেশনের ফলে উৎসেচকের স্বাভাবিক কার্যকলাপ ব্যহত হয় ও প্রচুর ২-হাইড্রক্সিগ্লুটারেট (2-HG) তৈরী হয়।  এর ফলে ডিএনএ মিথ্যাইলেশন ব্যহত হয় ও টিউমারজেনেসিস তথা ক্যান্সার এর সূত্রপাত হয়।১২ এছাড়াও, IDH-1 জিনের মিউটেশনের মাধ্যমে এই দুটি প্রোটিন ক্যান্সার রোগীর জিনের সজ্জায় অদলবদল ঘটায় আর তার ফলে ব্যবহৃত ঔষধগুলি শরীরে অকেজো হয়ে যায়। ক্রায়ো-ইএম এই IDH-1, LDH ও তাদের মিউটেটেড অবস্থার প্রমান, গঠন ও আচার-আচরণ সম্পর্কে তথ্য দিয়ে ক্যান্সার গবেষণাকে সহজতর করে তুলেছে।

ক্রায়ো-ইএম ক্যান্সার গবেষণাকে সহজতর করে তুলেছে।

শুধু ক্যান্সার বা ভাইরাস নয়, ক্রায়ো-ইএম মানবদেহে আলঝাইমার্সের জন্য দায়ী আম্যাইলয়েড পেপটাইডের গঠন কাঠামো ও শরীরে তাদের সমাবেশ সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়ে আলঝাইমার্সের গবেষণায় অনেক রহস্য উদ্ঘাটিত করেছে। এইসব কারণের জন্যই নোবেল কমিটি একে যুগান্তকারী আবিষ্কারের আখ্যা দিয়েছে।

 (সমাপ্ত)

রেফারেন্স ও আরো বিশদে জানতে :

(১) Nature 2017, 550, 167.

(২) The Rise of Cryo-Electron Microscopy, spring 2016, 13-21.

(৩) https://en.wikipedia.org/wiki/Cryogenics

(৪) এক্ষেত্রে ক্রিস্টাল ও কাচ বা গ্লাসের গঠনগত পার্থক্য আলোচনা করলে ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতির ধারণাটা পরিষ্কার হবে। কোনো দ্রবণকে দ্রুত জমিয়ে (quenched)  ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে কাচ তৈরি হয়। এই দ্রুত জমিয়ে কঠিনে পরিণত হওয়ার ফলে দ্রবণের অণুগুলি স্থিতিশীল সজ্জায় (equilibrium configuration) আসার সময় পায় না – বিশৃঙ্খল (disordered) অবস্থাতেই কঠিনে পরিণত হয়। অন্যদিকে, ক্রিস্টাল কোনো দ্রবণ থেকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হওয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়  সংশ্লিষ্ট অণুগুলি একটি স্থিতিশীল সজ্জা পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়। সুতরাং, এক্ষেত্রে একটি সুশৃঙ্খল অণুসমষ্টির কেলাস বা ক্রিস্টাল তৈরী করে।

যদিও তরল নাইট্রোজেনের তাপমাত্রা অনেক কম (-১৯৫.৭৯ °C), ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে বর্তমানে তরল নাইট্রোজেন ব্যবহৃত হয় না।  তরল নাইট্রোজেনের তাপ ধারণ ক্ষমতা ও তাপ পরিবাহিতা অনেক কম হওয়ায়, যখন কোনো সাধারণ তাপমাত্রার জলীয় দ্রবণ এর মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, তা গরম হয়ে ফুটতে শুরু করে এবং তা ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতিকে মন্দীভূত করে। তরল নাইট্রোজেনের মাধ্যমে ভিট্রিফিকেশনের জন্য সময় বেশি লাগাতে এই পদ্ধতিতে ‘ভিট্রিফায়েড’ জলের পাশাপাশি বরফের ঘনক তৈরির সুযোগ থাকে। এক্ষেত্রে তরল ইথেনের তাপ ধারণ ক্ষমতা ও তাপ পরিবাহিতা তরল নাইট্রোজেনের তুলনায় বেশি, যদিও তাপমাত্রা মোটামুটি একই (-১৮৮ °C)। তাই, দ্রুত ও সঠিক ভাবে জৈব অণুর জলীয় দ্রবণকে ভিট্রিফিকেশনের জন্য বর্তমানে তরল ইথেন বাব্যহৃত হয়। 

(৫) https://www.youtube.com/watch?v=026rzTXb1zw

(৬) J. Chem. Educ. 2014, 91, 2009−2012

(৭) Science News 2017, 192, 6.

(8) Nature, 2015, 525, 172–174.

(৯) BBA – General Subjects 2018, 1862, 324–334

(১০)https://www.chemistryworld.com/news/explainer-what-is-cryo-electron-microscopy/3008091.article

(১১)https://phys.org/news/2017-10-nobel-winning-technique-google-earth-molecules.html (১২) Mol. Cancer Ther. 2009, 8, 626.

The post ক্রায়ো-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ: ভাইরাস চেনার ‘গুগল আর্থ’ ও নোবেল পুরস্কার (২) appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

ভালুকের নিদ্রা থেকে রাইবোসোম-এর গঠন: এডা ইয়োনাথের সাক্ষাৎকার

$
0
0

ইসরায়েলের ওয়েজম্যান ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স(Weizmann Institute of Science)-এর এডা ইয়োনাথ ২০০৯ সালে রসায়নে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল রাইবোসোমের গঠন ও কার্যকলাপ (রাইবোসোম হলো কোষের সেই অংশ যা জেনেটিক কোড পড়ে শরীরের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য প্রোটিন তৈরী করে)। বর্তমানে তাঁর গবেষণার মূল বিষয় হল পরিবেশবান্ধব অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা। বোস ইন্সিটিউট-এর ১০১তম প্রতিষ্ঠা দিবসে, ৭৯তম আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু স্মৃতি বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করতে বিজ্ঞানী এডা ইয়োনাথ কলকাতায় এসেছিলেন। সেইসময় আমাদের পক্ষ থেকে স্বাগতা ঘোষ তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। স্বাগতা ঘোষ বর্তমানে বোস ইন্সিটিউটে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে নিযুক্ত।


আপনি রাইবোসোম নিয়ে কাজ করা শুরু করলেন কেন?

বিষয়টা মজার, তাই !

হঠাৎ রাইবোসোমএর উপর কাজ করার অনুপ্রেরণা পেলেন কিভাবে?

নিজের উৎসাহ, কৌতূহল, যা বলবে। একটা বাইসাইকেল দুর্ঘটনায় আমি আহত হয়েছিলাম। সেরে ওঠার জন্য বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হয়। তখন অনেকটা ফাঁকা সময় পেয়েছিলাম বই পড়ার জন্য। ওর মধ্যেই উত্তরমেরুর মেরুভাল্লুক (polar bear) সম্পর্কে পড়ার সুযোগ হয়েছিল। 

মেরুভাল্লুকদের শীতঘুম (hibernation) সম্পর্কে?

ওটা শীতঘুম নয়। আমি ওটাকে শুধু ঘুম বলি। শীতে ওরা ঘন্টার পর ঘন্টা খালি ঘুমোয়। শীতঘুমে শরীরের তাপমাত্রা বেশ কয়েক ডিগ্রী কমে যায়। কিন্তু মেরুভাল্লুকদের ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা মাত্র ১/২ ডিগ্রী কমে। তাই ওটাকে  শীতঘুম না বলে শুধু ঘুম বলাই ভালো। ভালুক যখন ঘুমোয় তখন শরীরের ভেতর কি পরিবর্তন হয়? দেখা গেছে, শরীরের রাইবোসোমগুলি তখন কোষপর্দার ভিতর একত্রিত অবস্থায় (packed) এবং সুসজ্জিত থাকে। ঐভাবে যে রাইবোসোম সুসজ্জিত থাকতে পারে, এইটাই তখন ভাবা যায়নি। রাইবোসোম এই অবস্থায় পুরো শীতকালটা টিঁকে থাকে। যখন বসন্ত আসে, ভালুকের ঘুম ভাঙ্গে। জেগে উঠে সব কাজকর্ম করার জন্য তার প্রয়োজন প্রোটীন। এই প্রোটীন বানানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রাইবোসোম তাদের কাছে মজুত থাকে।

কোষপর্দার ভিতর রাইবোসোম-এর সজ্জা (ছবির সূত্র)

আমার মনে হলো যে নিশ্চয়ই এই একত্রিত অবস্থাই সক্রিয় রাইবোসোমকে ভেঙ্গে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। এটাও মনে হলো যে এরকম ভাবনা অনুসরণ ক’রলেই হয়তো রাইবোসোমের গঠনের হদিশও পাওয়া যাবে। এটা বুঝলাম যে প্রকৃতির নিয়মে চাপ প্রয়োগ করলে রাইবোসোম সুশৃঙ্খল(orderly)  অবস্থায় থাকার চেষ্টা করে। তাই যে সমস্ত রাইবোসোম চাপে টিঁকে থাকতে পারে সেগুলোর ওপর মনঃসংযোগ করলাম। 

বর্তমান সময়ে যে বিজ্ঞানের একাধিক শাখা মিলিয়ে গবেষণা হয়, সে বিষয়ে আপনার মতামত কি?

বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যের সীমারেখা এখন মুছে গেছে, প্রায় নেই বললেই চলে। আমি রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম, সেগুলো সবই জীবনবিজ্ঞান বা জৈব-রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যা, ওই ঘেঁষা । আবার আমার কর্মপদ্ধতি পদার্থবিদ্যা ঘেঁষা। আমি যখন কাজের পরিকল্পনা শুরু করেছিলাম তখন আমায় প্রচুর অঙ্ক কষতে হয়েছিল। তাই আমার নিজের গবেষণা আন্তঃ-বিষয়ক (Interdisciplinary) তো বটেই।

ভারতে সাধারণ মানুষ ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে দূরত্ব আছে তা কিভাবে কমিয়ে আনা যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

ভারতে বিজ্ঞানের গবেষণা এখন খুবই উচ্চ পর্যায়ের হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার  সাথে সাধারণ মানুষের বিজ্ঞানমনস্কতার অনেক দূরত্ব রয়েছে। যদিও সেটা বিজ্ঞানীদের ত্রুটি নয়। আসলে প্রচুর ভারতবাসীর রোজকার জীবনযাপনটাই সেরকম। বুদ্ধিজীবিরা কি ভাবছেন, সেই নিয়ে মাথা ঘামানোর বা সেইদিকে কিছু করার সম্ভাবনা কম। তাই দূরত্ব অনেকটাই।

নোবেল পুরস্কার আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

পুরস্কার পেয়ে তো খুবই ভাল লেগেছিলো। কিন্তু সত্যিকারের উত্তেজনা আমি অনুভব করেছিলাম যেদিন প্রথম রাইবোসোমের গঠন দেখতে পাই। তবে অন্য অনেক দিক থেকে নোবেল পুরস্কার আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নোবেল পুরস্কার তোমাদের সবার সাথে মিলিত হবার সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছে। অন্তত আমি ছোট ছেলেমেয়েদের আমার কাজের মাধ্যমে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।

আপনার জীবনে কাউকে পথিকৃৎ হিসেবে অনুসরণ করেছিলেন?

না, আমি কাউকে অনুসরণ করার বিপক্ষে। আমার মনে হয় তোমরা সবাই নিজের মতো করে শিখে থাকো এবং নিজের মতো করেই শেখা উচিতও। আমি তোমাদের উৎসাহিত করতে পারি বা বড়োজোর আমার অভিজ্ঞতা তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি। কিন্তু কাউকে রোল মডেল করা মানে তো তাকে নকল করা।

ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের কি আপনি কোন উপদেশ দিতে চান?

একটাই উপদেশ – কারোর কাছে উপদেশ চেয়ো না। তোমার যা করতে ভাল লাগে ও যা তোমার কাছে আকর্ষণীয়, সেটাই করো আর তবেই তুমি করতে পারবে।

বিজ্ঞান ছাড়া আপনার আর পছন্দের কাজ কি কি? 

আমার পরিবার আছে, বন্ধুবান্ধব আছে। আমি তাদের সাথে দেখা করি, সময় কাটাই। আমি সাঁতার কাটি। আমি বই পড়তে ভালবাসি, ধ্রুপদী সঙ্গীত শুনতে ভালবাসি। এতে হবে?(হাসি)।

উৎসাহী পাঠকদের জন্য

[১] এডা ইয়োনাথ-এর ওয়েবসাইট:  https://www.weizmann.ac.il/YonathNobel/index.html

[২] অ্যানিমেশান-এর মাধ্যমে রাইবোসোমের কর্মপদ্ধতি: https://www.youtube.com/watch?v=Jml8CFBWcDs

The post ভালুকের নিদ্রা থেকে রাইবোসোম-এর গঠন: এডা ইয়োনাথের সাক্ষাৎকার appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

ভরের উৎস সন্ধানে

$
0
0

বস্তুর ভরের পরিমাপ তার আরো মৌলিক কোনো ধর্ম থেকে পাওয়া যায় কি? আধুনিক কণাপদার্থবিদ্যা কি বলে?


ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যা কিভাবে ভরের উপর নির্ভরশীল

স্কুলের পাঠ্যবইতে ভরের সংজ্ঞাটা যেভাবে দেওয়া হয়, সেটা অনেকের একটু হলেও গড়বড়ে লেগে থাকতে পারে,—আলোচনাটা সেখান থেকেই শুরু করা যাক।

“কোনো বস্তুর মধ্যে যে পরিমাণ পদার্থ থাকে, তাকে ঐ বস্তুর ভর বলে।”

কিন্তু পদার্থকে কিভাবে মাপা যায়? ধরা যাক, আমার স্কুলের এক বন্ধু ডেমোক্রিটাসকে এরকম একটা প্রশ্ন করা হল। বুদ্ধিমান ডেমোক্রিটাসের তো উত্তর রেডি, ‘খুব সোজা। কোনো বস্তু অজস্র অণু দিয়ে তৈরি, একটা অণুর মধ্যে যে পরিমাণ পদার্থ আছে তা মেপে নে। তাকে বস্তুটির মধ্যে যতগুলো অণু আছে তা দিয়ে গুণ করে ফেল। তাহলে বস্তুর ভর =মোট অণুর সংখ্যা ⁢⨉ একটা অণুর ভর।’

ডেমোক্রিটাসের কথা থেকে একটা জিনিস জানা গেলো। ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যায় ভরের ধারণাটা একরকমভাবে আসে ঘনত্ব (এক্ষেত্রে একটা অণুর ভর) আর আয়তন (এক্ষেত্রে কটা অণু), এই যৌথ ধারণা থেকে। অর্থাৎ, ভর = ঘনত্ব X আয়তন।

কিন্তু ভরের এই ধারণাটা ঠিক সম্পূর্ণ নয়। যেমন, নিউটন প্রদত্ত গতিসূত্রে উপনীত হতে গেলে ভরের অত্যন্ত মৌলিক আরো একটা ধর্ম আমাদের অনুমান করতে হয়। তা হল ভরের নিত্যতা,— ভর সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। নিউটনীয় গতিবিদ্যায় এই ধর্মটা এতটাই মৌলিক যে একে নিউটনের শূন্যতম গতিসূত্রের তকমা দেওয়া যায় আর কি! অথচ, ডেমোক্রিটাস-এর থেকে পাওয়া ধারণা থেকে ভর কেন নিত্য (constant) হবে,সেটা বোঝা যায় না। কারণ একটা অণুর ভর কেন নিত্য হবে, সে সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না।

এরপর আমরা ভরবেগকে সংজ্ঞায়িত করি ‘বস্তুর গতিজাড্যের পরিমাপ’ হিসেবে,— গাণিতিকভাবে যা লেখা হয় বস্তুর ভর X গতিবেগ হিসেবে। ভরবেগের সংজ্ঞা এবং ভরের নিত্যতা ব্যবহার করে খুব সহজভাবে নিউটনের প্রথম গতিসূত্র থেকে একটি বস্তুকণার ভরবেগ সংরক্ষণ সূত্র এবং দ্বিতীয় গতিসূত্র থেকে বলের ধারণা পাওয়া যায়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, নিউটনীয় গতিবিদ্যায় ভরই মূল ধারনা যাকে কেন্দ্র করে ক্লাসিক্যাল পদার্থবিদ্যা বেড়ে ওঠে। এই নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা এখানে দেখুন।

নিউটন প্রদত্ত গতিসূত্রে উপনীত হতে গেলে ভরের অত্যন্ত মৌলিক একটা ধর্ম আমাদের অনুমান করতে হয়, তা হল ভরের নিত্যতা।

কিন্তু ভরের উৎস কী? আমরা কি বস্তুর ভরের পরিমাপ তার আরো মৌলিক কোনো ধর্ম থেকে পেতে পারি? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ‘পদার্থে’র অবর্তমানে কি বস্তুর ভর থাকতে পারে? শেষের প্রশ্নটা অনেকের ভাবনায় সেই বিখ্যাত E=mc2 সূত্রটা এনে ফেলতে পারে। এইভাবে ভাবাই ঠিক কিন্তু আমরা একটু ধীরে ধীরে আরো বেশী যুক্তি ও প্রমাণ নিয়ে এগোবো এবং বোঝার চেষ্টা করবো ভরের বেশীর ভাগটাই কিভাবে আসলে শক্তি থেকে আসে। আসলে একটা পরমাণুর বেশীর ভাগ ভরটাই নিউক্লিয়াস থেকে আসে আর নিউক্লিয়াসে থাকে বেশ ভারী দুটো কণা— প্রোটন আর নিউট্রন। এই দুটো কণাই আসলে কয়েদ করা বিপুল পরিমাণ শক্তি, পদার্থ-টদার্থ ওতে নামমাত্র আছে আর কি!

নিউক্লিয়াস নিয়ে দুচার কথা

প্রোটন এবং নিউট্রনের ভর কীভাবে আসে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হলে প্রথমে পরমাণুর নিউক্লিয়াস সম্বন্ধে এই দুটো পরীক্ষামূলক তথ্য একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক: 

  1. নিউক্লিয়াস একটা খুব টেঁকসই জিনিস, তার মধ্যে নিউট্রন আর প্রোটনগুলো খুব ভালোভাবে বাঁধা থাকে। কোন বল এদের এতো ভালোভাবে একসাথে ধরে রাখে? সেটা আমাদের চেনা তড়িচ্চুম্বকীয় বল হতে পারে না। কারণ নিউট্রন আধানহীন – তা তড়িচ্চুম্বকীয় বলের দ্বারা প্রভাবিতই হয় না। আর প্রোটনের অবস্থা আরও সঙ্গীন। সবকটা প্রোটন ধনাত্মক আধানযুক্ত, সুতরাং তারা একে অপরকে তড়িচ্চুম্বকীয় বল দ্বারা বিকর্ষণ করে। এইসবের থেকে অনুমান করা যায় যে নিউক্লিয়নদের (প্রোটন ও নিউট্রনদের একসাথে এই নামে ডাকা হয়) মধ্যে আর একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন আকর্ষক বল কাজ করে যা আধানের ওপর নির্ভরশীল নয়। আর সব নিউক্লিয়নকে একসাথে ধরে রাখতে হলে এই বলকে প্রোটনদের মধ্যেকার তড়িচ্চুম্বকীয় বিকর্ষক বলকে পরাস্ত করতে হবে। সুতরাং এই বল তড়িচ্চুম্বকীয় বলের থেকে বেশি শক্তিশালী।
  2. ঊনিশশো বত্রিশ সালে জেমস স্যাডউইক নিউট্রন আবিষ্কার করার সাথে সাথে আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার বিজ্ঞানীদের নজরে আসে। প্রোটন আর নিউট্রন দুটো কণার ভর মোটামুটি একই এবং প্রোটনের ধনাত্মক আধান আছে এইটুকু ভুলতে পারলে দুটো কণাই একইরকম আচরণ করে। ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ এ থেকে অনুমান করেন প্রোটন এবং নিউট্রন একই কোয়ান্টাম অবস্থার এপিঠ-ওপিঠ। ঠিক up-spin আর down-spin ওয়ালা ইলেক্ট্রনের মতো।  তাই spin-প্রতিসাম্যের সাথে মিল রেখে এই অদ্ভুত প্রতিসাম্যের নাম রাখা হয় ‘isotopic spin’ বা ‘isospin’। অঙ্কের ভাষায় বললে, এই প্রতিসাম্য আসলে SU(2) প্রতিসাম্য এবং ইলেক্ট্রনের স্পিনেও একই প্রতিসাম্য মুখ্যভাবে রূপায়িত (fundamental representation) হয়। যাই হোক, এই প্রতিসাম্যের অর্থ দাঁড়ায়, দুটো প্রোটন বা দুটো নিউট্রন অথবা একটা প্রোটন আর একটা নিউট্রনের মধ্যে মোটামুটি একই পরিমাণ নিউক্লিয়ার বল কাজ করবে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, পদার্থবিজ্ঞানীদের এরকম সাম্যের প্রতি একটা আলাদা ভালবাসা থাকে কারণ তা একটা তত্ত্বকে সুন্দর বানায়। এর ফলে ক্যালকুলেশনগুলোও অনেক সময় বেশ সহজ হয়ে যায়।

ওয়ার্নার হাইসেনবার্গ অনুমান করেন যে প্রোটন এবং নিউট্রন একই কোয়ান্টাম অবস্থার এপিঠ-ওপিঠ।

এরপর একেবারে চল্লিশ বছর এগিয়ে যাওয়া যাক। এটা বোঝা গেছে যে হাইসেনবার্গের অনুমান মোটামুটিভাবে সঠিক। সাথে সাথে এটাও দেখা গেছে যে প্রোটন ও নিউট্রন মৌলিক বা অবিভাজ্য কণা নয়। ওরা প্রত্যেকে তিনটে আরও মৌলিক কণা দিয়ে তৈরী। তাদের নাম রাখা হয়েছে কোয়ার্ক (quark)।  প্রোটন-নিউট্রন প্রায় একইরকম কিন্তু পুরো এক নয় কারণ কোয়ার্কগুলোর আলাদা আলাদা ‘flavor’ হয়। প্রোটন আর নিউট্রন  দুটোতেই ‘up’ আর ‘down‘ ফ্লেভারের কোয়ার্ক থাকে, তবে প্রোটনে দুটো up একটা down আর নিউট্রনে একটা up দুটো down (প্রচ্ছদের ছবিটি দেখুন)। up-এর আধান +(২/৩)e আর down-এর -(১/৩)e, ফলে প্রোটনের আধান +e আর নিউট্রন নিস্তড়িৎ (-e = একটা ইলেক্ট্রনের আধান)। আর প্রোটন-নিউট্রনের SU(2) প্রতিসাম্যটা আসলে আসে up আর down-এর SU(2) প্রতিসাম্য থেকে।

নিউক্লিয়নের এত ভর আসে কোত্থেকে

এসব ঠিক থাকলেও সমস্যা অন্য জায়গায়। দুটো সমস্যা, এবং দুটোই বেশ পাগলাটে। প্রথমত, একলা মুক্ত কোয়ার্কের কখনো দেখা পাওয়া যায় না। যদিও এই কোয়ার্কগুলো যে যৌগিক কণাগুলোর মধ্যে আবদ্ধ থাকে তাদের আচরণ থেকে কোয়ার্কগুলোর অস্তিত্বের পরোক্ষ পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, কোয়ান্টাম ক্ষেত্রগতিবিদ্যার (quantum field theory) গণনা থেকে up এবং down কোয়ার্কের যে ভর পাওয়া যায়, নিউক্লিয়নের ভর তার চেয়ে প্রায় একহাজার গুণ বেশী। এদিকে নিউক্লিয়নে কোয়ার্ক আছে মাত্র তিনটে করে।  কোয়ার্ক থেকে না এলে নিউক্লিয়নের এতটা পরিমাণ ভর আসে কোথা থেকে? ধাঁধা দুটো বুঝতে আমাদের চেনা তড়িচ্চুম্বকীয় বলের উদাহরণ থেকে শুরু করা যাক। দুটো আধান (charge) একে অন্যের ওপর বল প্রয়োগ করে ফোটন (photon) কণা বিনিময়ের মাধ্যমে। ফোটন হল তড়িচ্চুম্বকীয় বলের বাহক এবং এর ভর (rest mass) না থাকলেও আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী মোমেন্টাম বা ভরবেগ থাকতে পারে। দুটো আধান ফোটন বিনিময় করলে ভরবেগেরও বিনিময় হয়, যেটা তড়িচ্চুম্বকীয় বল হিসেবে প্রতিভাত হয়।

দুটো ইলেক্ট্রন (e-^)-এর মধ্যে বিকর্ষণ বলের উৎপত্তি হয় তাদের মধ্যে ফোটন (γ) বিনিময়ের মাধ্যমে। তীরচিহ্ন দিয়ে ইলেক্ট্রন দুটোর গতিপথ বোঝানো হচ্ছে। একইভাবে প্রোটন বা নিউট্রনের ভিতর কোয়ার্কদের মধ্যে বল সৃষ্টি হয় গ্লুওন বিনিময়ের মাধ্যমে।

মজার কথা হলো ফোটন নিজে কিন্তু আধানহীন, অর্থাৎ দুটো ফোটন একে অপরের ওপর বল প্রয়োগ করতে পারে না। 

এই ধারণাগুলোর সাধারণীকরণ করলে একটা নিউক্লিয়নের ভেতর কোয়ার্কদের যে বল বেঁধে রাখে তাকেও বোঝা যায়। এই বলের নাম হলো স্ট্রং বল (strong force) বা বর্ণময় বল (color force)। দুটো কোয়ার্কের বর্ণাধান (color charge) থাকে এবং ওদের মধ্যে ভরবেগ বিনিময় হয় গ্লুওন (gluon) কণা বিনিময় দ্বারা, যেটা বর্ণময় বল হিসেবে প্রতিভাত হয়।

ফোটনের মতো গ্লুওনও ভরহীন কণা। কিন্তু এই দুটো কণার সবচেয়ে  বড় পার্থক্য হল, গ্লুওনের বর্ণাধান থাকে, ফলত কোয়ার্কের অনুপস্থিতিতেও এরা নিজেদের মধ্যে ক্রিয়া (interact) করতে পারে। এভাবে তারা নতুন গ্লুওনও সৃষ্টি করতে পারে। তাই দুটো কোয়ার্কের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে থাকলে ওদের মধ্যে থাকা গ্লুওনগুলোর ক্রিয়ায়(interaction) আরো আরো গ্লুওন তৈরী হয়। এতে এত বেশি বর্ণময় বল সৃষ্টি হয় যে কোয়ার্কগুলো পুরোপুরি বাঁধা পড়ে যায় এবং একে অপরকে ছেড়ে বেরোতে পারে না। এই কারণেই একলা মুক্ত কোয়ার্কের কখনো দেখা পাওয়া যায় না।

শুধু তাই নয়, একটা নিউক্লিয়নের সাইজ এক ফার্মির ( মিটার) কাছাকাছি। এই দূরত্বে কোয়ার্কগুলো থাকলে তাদের মধ্যে এত অজস্র গ্লুওন তৈরী হয় যে গ্লুওনের সমুদ্রে ওই তিনটে কোয়ার্ক যেন ভাসতে থাকে। এই গ্লুওনগুলোও আবার নিউক্লিয়নের কয়েদ থেকে বেরোতে পারে না কারণ একটা নিউক্লিয়নের সমষ্টিগত বর্ণাধান শূন্য এবং সে এরকম অবস্থাতেই থাকতে চায়। যেহেতু গ্লুওনের বর্ণাধান আছে তাই কোনো নিউক্লিয়ন থেকে গ্লুওন বেরোলে নিউক্লিয়নের আর শূন্য বর্ণাধান থাকবে না যেটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত (favorable) নয়। এভাবে একটা প্রোটন বা নিউট্রন নিজের মধ্যে বিপুল পরিমাণ শক্তি ধরে রাখতে পারে, যা E=mc2 সূত্রানুযায়ী এদের ভর হিসেবে প্রতিভাত হয়।

প্রশ্নের শেষ নেই

বেশ সুন্দর ব্যাখ্যা! তবুও আরও কয়েকটা প্রশ্ন থেকেই যায় যাদের উত্তর আমাদের এখনও অজানা। একটা নিউক্লিয়াসের ভেতর নিউক্লিয়নগুলোর নিজেদের মধ্যে যা দূরত্ব, নিউক্লিয়নের ভেতর কোয়ার্কগুলোর দূরত্বও প্রায় ততটাই। তাহলে এই কোয়ার্কগুলো মিলেমিশে নিউক্লিয়াসে একটা কোয়ার্ক-কমিউন্ বানিয়ে ফেলে না কেন? প্রোটন এত স্থায়ী কণা কেন? প্রোটন কি নিজে থেকেই ভেঙে যেতে পারে? আসলে কণা-পদার্থবিদরা মন থেকে চান না যে প্রোটন চিরস্থায়ী একটা কণা হোক। কারণ প্রোটন অস্থায়ী হলে আমরা সেটা ব্যবহার করে আরও বড় একটা ধাঁধার সমাধান করতে পারব। তা হল, এই মহাবিশ্বে বস্তুর (matter) পরিমাণ প্রতিবস্তুর (antimatter) চেয়ে এত বেশী কেন? (এর গল্প বলতে আরেকটা গোটা লেখা লাগবে। তাই আপাতত চেপে যাচ্ছি। ব্যারিয়ন অপ্রতিসাম্য (Baryon asymmetry) গুগল করে দেখতে পারেন।) কোয়ার্ক বা ইলেক্ট্রনের মতো কণার ভর কোথা থেকে আসে তা কিন্তু এখনো বোঝা  গেলো না। কণাপদার্থবিদরা সেই প্রশ্ন-ও করেছেন আর তার উত্তর-ও দিয়েছেন। এরা হিগস্ বোসনের সাথে ক্রিয়া করে ভর পেয়ে থাকে, কিন্তু কীভাবে, তার ব্যাখ্যা বেশ গভীর। সে বিষয়ে আমরা পরে কোন সময়  আলোচনা করব।

প্রচ্ছদের ছবির সূত্র: এক, দুই

টীকা:

[১] ফোটন-এর প্রকৃতি সম্বন্ধে আমরা একভাবে জানতে পারি। আশেপাশের যেকোনো বস্তুকে আমরা দেখতে পাই তার দুটো প্রধান কারণ: এক, ওই বস্তু থেকে যে ফোটনগুলো আসে তারা নিজেদের মধ্যে ক্রিয়া করে না। দুই,  ফোটনগুলো নাইট্রোজেন বা অক্সিজেন পরমাণুর সাথেও ক্রিয়া করে না, কারণ সাধারণ উষ্ণতায় পরমাণু নিস্তড়িৎ। তার মানে কোনো বস্তু থেকে ফোটন প্রতিফলিত হয়ে আমাদের দিকে আসার পথে অন্য কোনোকিছুর সাথে ক্রিয়া করে না।

The post ভরের উৎস সন্ধানে appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

ঘন্টুদার দপ্তর –ইসরো

$
0
0

ভারতের অন্যতম প্রধান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ISRO-তে কিভাবে কাজ করা যায়?


হ্যাঁ ঘন্তুদা, ঠিক বলেছ । অ্যাস্ট্রোস্যাট-এর ব্যাপারে তো আমি ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকা-তেই পড়েছি [১]। অ্যাস্ট্রোস্যাট হল  কৃত্রিম উপগ্রহের উপর স্থাপিত ভারতবর্ষের প্রথম দূরবীন যা দিয়ে অনেক বর্ণের আলো একসাথে ধরা যায়। তাই না ঘন্তুদা?

একদম ঠিক ঝন্তু। অ্যাস্ট্রোস্যাট ইসরো তথা আমাদের দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

জান ঘন্টুদা, মাঝে মাঝে খুব মনে হয় এমন একটা জায়গা যদি কোনদিন নিজের চক্ষে দেখতে পেতুম তাহলে জীবনটাই সার্থক হয়ে যেত।

তাতে অসুবিধে কি নান্টু, শুধু দেখা কেন;  তুই চাইলে ভবিষ্যতে ওখানে চাকরীও তো করতে পারিস।

কি বলছ ঘন্টুদা, আমিও ইসরো-তে চাকরি পেতে পারি?  কি করতে হবে তার জন্য ?

নিশ্চয়ই পারিস। শুধু তুই কেন, এই দেশের যে কোন ছেলে মেয়ে যদি ঠিক করে পড়াশোনা করে শুধুমাত্র ৬৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে স্নাতক হতে পারে তাহলেই সে  ইসরোতে  চাকরীর সুযোগ পেতে পারে।

কি নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে  গো তার জন্য?

ইসরো প্রধানত কারিগরি বিভাগের ছাত্রছাত্রীদেরকেই বেশি সুযোগ দেয়। সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে ৬৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে B.E / B.Tech ডিগ্রি  পেলেই ৩৫ বছর বয়সের চেয়ে কম বয়সী যে কেউ ইসরোতে চাকরীর জন্য আবেদন করতে পারে। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে স্থাপত্য শাখার ছাত্রছাত্রীদের জন্যও সুযোগ আসে।

তাহলে তো ইসরো-তে আমার চাকরি পাকা ঘন্টুদা, আমার এখন মেকানিক্যাল তৃতীয় বর্ষ চলছে, সব সেমেস্টার-এই কিন্তু ৭০ শতাংশ-এর বেশি নম্বর পেয়েছি।

এতো সহজ তো নয় নান্টুবাবু। এই প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত হতে গেলে তোমাকে একটি সর্বভারতীয় লিখিত প্রবেশিকা পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হতে হবে। সেখানে সফল প্রার্থীদের তারপর একটি ইন্টার্ভিউ-এর জন্য ডাকা হবে।  সেখানেও সফল হতে পারলে তবে তুমি ইসরো-তে বৈজ্ঞানিক পদে নিযুক্ত হতে পারবে।

ওরে বাবা , এত কিছু করতে হবে? তা কি করে আবেদন করব?

এখন তো সব জায়গাতেই অনলাইন আবেদন করতে হয়। ইসরো-র ওয়েবসাইট-এই এইসব নিয়গের বিজ্ঞপ্তি বেরোয় আর সেখানেই আবেদন করতে হয়। ওয়েবসাইট-টি হল https://www.isro.gov.in/career। দেশের মধ্যে মাত্র বারোটি জায়গা থেকেই এই প্রবেশিকা পরীক্ষাটি দেওয়া যায়। সেগুলি হল- আমেদাবাদ, ব্যাঙ্গালুরু, ভোপাল, চণ্ডীগড়, চেন্নাই, গুয়াহাটি, হায়দ্রাবাদ, কলকাতা, লখনৌ, মুম্বই, দিল্লী এবং তিরুবনন্তপুরম। চেষ্টা করিস নান্টু, শুধু উচ্চমানের কাজ নয় ওখানে বেতন ও বেশ ভাল কিন্তু; শুরুতেই প্রতি মাসে ৫৬১০০ টাকা।

আচ্ছা ঘন্টুদা, ওখানে শুধু কারিগরি শাখার ছেলেমেয়েরাই সুযোগ পায়?

না না, সেটা নয়। তোর মতন পদার্থবিদ্যা-র ছাত্রছাত্রীও সুযোগ পায়। তুইও চেষ্টা করতে পারিস ঝন্টু।

শুধু চাকরি কেন ওখান থেকে স্পেস সাইন্স ও টেকনোলজি-র বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণাও করতে পারিস। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি ডিপার্টমেন্ট অফ স্পেস এর অধীনে ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অফ স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (আই আই এস টি) প্রতিষ্ঠানটি থেকে স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ওপর স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভ করা যায়। এই বিষয়ে বিশদে জানতে হলে  https://www.iist.ac.in/admission/   ওয়েবসাইট-টি দেখতে পারিস।

অসংখ্য ধন্যবাদ ঘন্টুদা। তোমার থেকে আবার আমরা বিজ্ঞানের জীবিকা সম্পর্কে অনেককিছু জানতে পারলাম।

(প্রচ্ছদের ছবির সূত্র)

উৎসাহী পাঠকদের জন্য: [১] অ্যাস্ট্রোস্যাট নিয়ে আরো জানতে এই লেখাটি পড়ুন: https://bigyan.org.in/2016/02/01/astrosat/

The post ঘন্টুদার দপ্তর – ইসরো appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

বিস্মৃতির রহস্য সন্ধানে

$
0
0

প্রথমরোগী

 ১৯০১ সাল। শীতকাল। ক্রিসমাসের এখনো কিছু দেরি আছে। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে মনোবিদ ডাঃ অ্যালইস অ্যালজাইমার সদ্য হাসপাতালে ভরতি হওয়া রোগিনীর সাথে কথা বলছেন।

আপনার নাম ? অগুস্তে।

আপনার পদবি ? অগুস্তে।

আপনার স্বামীর নাম ? মনে হয় অগুস্তে।

আপনার স্বামীর কথা বলছিলাম। ও হ্যাঁ, আমার স্বামী।

আপনি কি বিবাহিত? হ্যাঁ, অগুস্তের সঙ্গে…. 

        রোগিণীর বয়স তখন একান্ন বছর। গত কয়েক বছর ধরেই তিনি নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। স্মৃতি পথভ্রান্ত, তার সঙ্গে ঘুমের সমস্যা, সন্দেহবাতিক, অমূলক ভয় – এইসব উপসর্গ নিয়ে অগুস্তের পরিবার ব্যতিব্যস্ত। এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রুতিবিভ্রম—ফাঁকা ঘরেও মানুষজনের কণ্ঠস্বর শুনতে পান অগুস্তে—চেঁচাতে শুরু করেন ভয়ে। অগত্যা তাকে ভরতি করা হয় ফ্রাঙ্কফুর্টের মানসিক হাসপাতালে [১]।  

        মানসিক হাসপাতালের বিছানাতেই জীবনের শেষ পাঁচটা বছর কাটান অগুস্তে। ১৯০৬ সালে শরীরের ক্ষত থেকে রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে রোগিণী যখন ঢলে পড়লেন মৃত্যুশয্যায় তখন তার কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতাটুকুও নিঃশেষিত। ততদিনে ডাঃ অ্যালজাইমার জার্মানির অন্য শহরে কাজে যোগ দিয়েছেন। সারাদিন রোগীর চিকিৎসা, ছাত্র পড়ানো আর প্রশাসনিক কাজ সামলে গবেষণার সময় পান সামান্যই। তিনটি শিশু সন্তান রেখে স্ত্রী গত হয়েছেন অল্প বয়সে। এত সব কিছুর মধ্যেও তিনি ভুলে যাননি তাঁর পুরনো রোগিণীর কথা। ১৯০৬ সালে অগুস্তের মৃত্যুসংবাদ পোঁছল তাঁর কাছে। বিজ্ঞানের স্বার্থে অগুস্তের মস্তিষ্ক দান করেছিল তার পরিবার। অণুবীক্ষণের নীচে সেই মস্তিষ্কের রহস্য সন্ধানে ব্রতী হলেন অ্যালজাইমার এবং তাঁর সহকর্মীরা।

মাথার কোষে জট কী দেখতে পেয়েছিলেন অ্যালজাইমার? তাঁর সমসাময়িক অন্য একজন বিজ্ঞানী ম্যাক্স বিয়েলচোস্কি ততদিনে আবিষ্কার করেছেন এমন এক রঞ্জনপদ্ধতি (Staining) যা দিয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যায়। বিয়েলচোস্কির পদ্ধতি ব্যবহার করেই অগুস্তের মস্তিষ্কের কোষগুলো পর্যবেক্ষণ করেছিলেন অ্যালজাইমার। তিনি দেখতে পেলেন মস্তিষ্কে ছড়িয়ে রয়েছে অস্বাভাবিক এক ধরণের পদার্থ যা কোষের ভেতরে জটের মতো চেহারা নিয়েছে (tangles) আর কোষের বাইরে পাতের মতো (plaques)। আজও এই রোগটা সনাক্ত করতে এই দুটো চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।

স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক মস্তিস্ককোষ (সূত্র)

        অত্যন্ত উৎসাহের সাথে নিজের কাজের কথা সবাইকে জানাবেন বলে ঠিক করলেন তিনি। ১৯০৬ সালে মনোবিদদের সম্মেলনে নিজের গবেষণাপত্র পাঠ করলেন  অ্যালজাইমার। কিন্তু শ্রোতাদের মনে দাগ কাটতে পারলেন না। তাঁর বক্তৃতার পরে কেউ কোনও প্রশ্নও করলেন না। সেইসময় সাইকো-অ্যানালিসিস-এর রমরমা চলছিল। মনের গভীর অবচেতন থেকে চিন্তাভাবনাকে টেনে হিঁচড়ে বার করে আনা যায়, আরিব্বাস! সেই নিয়েই মেতে ছিল জনসাধারণ। তার মধ্যে কোন একজন রোগীর কোষে কি একটা দেখা গেছে, তার কোনো আকর্ষণই ছিল না। বিংশ শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তাই অবহেলার  অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল।

বিজ্ঞানচর্চা বলতে আমাদের মানসলোকে ভেসে ওঠে গবেষণাগারে মগ্ন একাকী এক বিজ্ঞানীর সাধনার চিত্র। কিন্তু বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস শুধুমাত্র মেধার জয়যাত্রা নয়, ব্যক্তি মানুষের অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তির কাহিনীও বটে। গ্যালিলিও থেকে ব্রুনো, সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে ওয়ারেন মারশাল—কত যে বিজ্ঞানীকে মুখোমুখি হতে হয়েছে সামাজিক অবহেলা আর অবজ্ঞার তার হিসেব কেউ লিখে রাখেনি। অনেকে আপোষ না করে প্রাণ দিয়েছেন, কেউ কেউ ডুবে গেছেন ব্যক্তিগত অন্ধকারে। কিন্তু তাঁদের সাধনার ফল যুগকে অতিক্রম করে হয়েছে কালজয়ী। 

        অ্যালজাইমারও দমে যাবার পাত্র ছিলেন না। তিনি চোখকান খোলা রাখলেন যদি আরো স্মৃতির অসুখে আক্রান্ত রোগীদের মস্তিস্ককোষের মধ্যে সেই তালগোল পাকানো জট কিংবা সেইরকম পাত খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯০৯ সালে একইরকম আরও তিনজন রোগীর বিষয়ে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল। তাঁর অগ্রজ সহকর্মী এমিল ক্রেপলিন তার কাজে বরাবরই উৎসাহী ছিলেন। তাঁর মনোবিজ্ঞানের ওপর বিখ্যাত গ্রন্থে ডাঃ অ্যালজাইমার বর্ণিত অসুখের বিষয়ে একটি অধ্যায় সংযোজন করলেন আর এই অসুখের নামকরণ করলেন– অ্যালজাইমারস ডিজিজ। সবশেষে ১৯১১ সালে জোসেফ নামে আর একজন রোগীর বৃত্তান্ত নিয়ে অ্যালজাইমার একটি গবেষণাপত্র রচনা করেন। তার মস্তিস্কে সেই জট পাওয়া না গেলেও একই রকম পাত পাওয়া গেল। অ্যালজাইমার সেটাকে একটা ভিন্ন অসুখ হিসেবে চিহ্নিত করলেও পরবর্তীকালে আমরা জানতে পারি সেটা তার নিজের বর্ণিত অসুখের একটি ভিন্ন পর্যায় মাত্র।

১৯১৫ সালে মাত্র একান্ন বছর বয়সে অ্যালজাইমার গত হন। তারপর দীর্ঘ পাঁচ দশকের জন্যে তাঁর অসামান্য অবদান বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবে ছিল। মনে করা হত অ্যালজাইমারস ডিজিজ বাস্তবে অত্যন্ত বিরল একটি অসুখ, কাজেই এই রোগ নিয়ে গবেষণায় বিশেষ কেউ আগ্রহী হলেন না।  

গবেষণায় নতুন জোয়ার

        অ্যালজাইমার যখন গবেষণারত ছিলেন জীবকোষের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান করার মতো প্রযুক্তিও জানা ছিল না। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে যে পাতগুলো (plaque) অ্যালজাইমার দেখেছিলেন সেগুলো কী ভাবে তৈরি হচ্ছে তা জানার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক বছর। আশির দশকে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন অ্যামায়লয়েড বিটা (Amyloid β) নামে এক রকমের পদার্থ এই পাতগুলোর মূল উপাদান। ততদিনে এও জানা গেছে যে অ্যামায়লয়েড অন্যান্য অনেক অসুখের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে  অ্যালজাইমারস ডিজিজ সম্পর্কে গবেষণার আগ্রহ বাড়তে থাকে। পাশ্চাত্য দেশগুলিতে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় অ্যালজাইমারস ডিজিজ এখন আর কোনও বিরল রোগ নয়, বরং অসংখ্য মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত [২]। যেহেতু অ্যালজাইমারস ডিজিজ খুব ধীর গতিতে বাড়ে, আক্রান্ত হবার পর রোগীরাও বেঁচে থাকেন বেশ কিছু বছর। সেইসাথে তাদের চিকিৎসার খরচও বেড়ে চলে দ্রুতগতিতে। অতএব এর একটা বিহিত করার দরকার পড়লো। জোরকদমে শুরু হলো গবেষণা। আর গবেষণায় গতি বাড়ায় চিকিৎসা বিজ্ঞান অল্প দিনেই অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে সমর্থ হল।

        ১৯৯২ সালে বিজ্ঞানী জন হারডি এবং অন্যান্যরা অ্যামাইলয়েড সংক্রান্ত তত্ত্ব প্রকাশ করলেন [৩]। যে প্রশ্নটা তখনো অজানা ছিল, সেটা হলো, অ্যালজাইমারস-এর উৎপত্তি হয় কোত্থেকে। ওই জটগুলো আগে হয়, না অ্যামাইলয়েড-সমৃদ্ধ পাতগুলো না অন্যকিছু। এটা জানা জরুরি কারণ উৎস জানলে গোড়াতেই একে থামিয়ে দেওয়া যাবে। ১৯৯২-র ওই গবেষণাপত্রে বলা হলো যে অ্যামাইলয়েড বিটা-ই যত নষ্টের গোড়া এবং দেখানো যায় যে অ্যালজাইমারস-এর সবকটা উপসর্গ এই অত্যন্ত ক্ষতিকর পেপটাইড-এর হাত ধরেই আসে। কিন্তু জিনিসটা যখন এতই ক্ষতিকর, দেহে এর উৎপত্তি হয় কিভাবে, সেই প্রশ্নেরও উত্তর দেওয়া প্রয়োজন।

রোগের ঘাঁটি গবেষকদের দেওয়া উত্তরটা বুঝতে ছোটবেলার রসায়নে একবার ঢুঁ মারতে হবে। আমরা শিখেছিলাম যে প্রোটিন, পেপটাইড, এগুলো আসলে অ্যামিনো অ্যাসিড-এর ইয়া লম্বা লম্বা চেন। আর অ্যামিনো অ্যাসিড হলো সেইসব জৈব (organic) যৌগ যাতে একদিকে আছে একটা অ্যামাইন (-NH2) গ্রুপ আর অন্যদিকে আছে একটা কার্বক্সিল (-COOH) গ্রুপ। এদের অনেকগুলোকে পেপটাইড বন্ধনের মাধ্যমে জুড়লে তৈরী হয় ওই চেনগুলো। যেরকম এইটা:

পেপটাইড চেন কিরকম দেখতে হয় (সূত্র)
অ্যামাইলয়েড বিটা-র পাকিয়ে যাওয়া গঠন (সূত্র, কৃতজ্ঞতা স্বীকার: jeff brender (biophysik) [CC BY-SA 3.0 (https://creativecommons.org/licenses/by-sa/3.0)]

অ্যামাইলয়েড বিটা-ও তেমনি একটা পেপটাইড। এগুলো এতটাই লম্বা হয় আর পাকিয়ে যায় (folding) যে উপরের ছবির মতো রাসায়নিক গঠনটা দেখানো কঠিন। এই হলো ছবিতে অ্যামাইলয়েড বিটা। কল্পনা করে নিন, ওই ফিতে-টা আসলে উপরের যৌগের মতোই ছোট ছোট অ্যামিনো অ্যাসিড জুড়ে তৈরী।

দেহে যদি এমন কোনো প্রোটিন থাকে যার লম্বা চেন-টা ভাঙ্গলে অ্যামাইলয়েড বিটা-র অপেক্ষাকৃত ছোট চেন-টা বেরিয়ে আসে, তাহলেই বোঝা যাবে কোত্থেকে আসে সেই ক্ষতিকর অ্যামাইলয়েড বিটা নামক পেপটাইড। গবেষকরা সেই প্রোটিন-এরই খোঁজ দিলেন।

তাঁরা বিভিন্ন পূর্ব গবেষণাকে একত্র করে দেখালেন যে অ্যামাইলয়েড প্রিকারসর প্রোটিন (APP) নামে এক ধরণের প্রোটিন ভাঙ্গলে তৈরী হতে পারে অ্যামাইলয়েড বিটা পদার্থটি। মানবদেহের ২১ নম্বর ক্রোমোজমে রয়েছে APP নামে একটি জিন।  APP জিন থেকে কোষের ভিতর তৈরি হয়  APP প্রোটিন, যা অ্যামায়লয়েডের পূর্বসুরি। যে সে ভাবে ভাঙ্গলে চলবে না। এমন জায়গায় সেই প্রোটিন-এর মধ্যে কোপ মারতে হবে যে অ্যামাইলয়েড বিটা-র চেন-টা অক্ষত বেরিয়ে আসে। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রোটিনটা যেভাবে ভাঙ্গে, তাতে অ্যামাইলয়েড বিটা-র মাঝে কোপ পরে।

কিন্তু দেখা গেলো, এমন কিছু পন্থা (pathway) আছে যাতে অক্ষত অ্যামাইলয়েড বিটা বেরিয়ে আসতে পারে। সাধারণত আলফা এবং গামা সিক্রেটেজ ( secretase) দুটি উৎসেচক APP প্রোটিনকে ভেঙে ফেলে। এর ফলে যে ধরণের অ্যামায়লয়েড তৈরি হয় তা কোষের পক্ষে  ক্ষতিকর নয়। কিন্তু অ্যালজাইমারস রোগের  ক্ষেত্রে গামা-র জায়গা নেয় বিটা-সিক্রেটেজ। বিটা সিক্রেটেজ-এর হাতে পড়ে প্রোটিন ভেঙ্গে তৈরি হতে পারে ৪২ টি অ্যামিনো-এসিড-লম্বা অ্যামাইলয়েড। এই অ্যামায়লয়েড যাকে বিজ্ঞানীরা এ বিটা ৪২ বলে জানেন তা স্নায়ুকোষের চারদিকে জমা হতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, খুব সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে এ বিটা ৪২ একবার তৈরি হতে শুরু করলে তা স্বাভাবিক অ্যামায়লয়েডের গঠনকে প্রভাবিত করে  ক্ষতিকর অ্যামায়লয়েডে পরিণত করতে পারে। এই  অ্যামাইলয়েড সহজে দ্রবীভূত হয়না এবং তাই স্নায়ুকোষের পক্ষে ক্ষতিকর। বহু বছর ধরে এরা স্নায়ুকোষের মধ্যে জমা হতে থাকে এবং শেষে কোষটির মৃত্যু ঘটে।

রোগের কার্যপ্রণালী

        অ্যামাইলয়েড বিটা যদি রোগের উৎস হয়, তাহলে বাকি উপসর্গগুলো কিভাবে হয়, সেটাও ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। যেমন, ড: অ্যালজাইমার বর্ণিত কোষের মধ্যে জট বা  neurofibrillary tangle। তারও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল।

অ্যামাইলয়েডের দোসর হল টাউ নামের আর এক প্রোটিন। স্বাভাবিক স্নায়ুকোষের কাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে সাহায্য করে এই প্রোটিন। স্নায়ুকোষের চেহারাটা অনেকটা এইরকম: একদিকে কোষের মূল অংশটা যেটা মূলত অন্যান্য কোষের মতো, কিন্তু তার থেকে বেরিয়ে থাকে একটা লম্বা চোঙ্গামতো জিনিস যেটা কোষের নানান সিগন্যাল বাইরে নিয়ে যায়। তাকে বলে অ্যাক্সন।  এই চোঙ্গার মতো অ্যাক্সন-এর কাঠামোটাকে দাঁড় করিয়ে রাখে টাউ প্রোটিন।  কিন্তু অ্যালজাইমারস ডিজিজে টাউ প্রোটিন তার নিজের স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। তারা অ্যাক্সন-এর দেয়াল থেকে সরে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। ভেঙ্গে পড়ে স্নায়ুকোষের দেয়াল, আর অন্যদিকে তৈরি হয় টাউ প্রোটিন-এর জট (যে জট-টা দেখেছিলেন ড: অ্যালজাইমার)। হয়তো বা স্নায়ুকোষের সিগন্যাল-এ বাধাও পড়ে। নিচের ছবিটা দেখুন। টাউ প্রোটিন-এর নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি করার পেছনেও অ্যামাইলয়েড বিটা-র হাত থাকতে পারে, এমনই দাবি করলো ১৯৯২-এর গবেষণাপত্রটি।

অ্যামাইলয়েডের দোসর হল টাউ নামের আর এক প্রোটিন। স্বাভাবিক স্নায়ুকোষের কাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে সাহায্য করে এই প্রোটিন। স্নায়ুকোষের চেহারাটা অনেকটা এইরকম: একদিকে কোষের মূল অংশটা যেটা মূলত অন্যান্য কোষের মতো, কিন্তু তার থেকে বেরিয়ে থাকে একটা লম্বা চোঙ্গামতো জিনিস যেটা কোষের নানান সিগন্যাল বাইরে নিয়ে যায়। তাকে বলে অ্যাক্সন।  এই চোঙ্গার মতো অ্যাক্সন-এর কাঠামোটাকে দাঁড় করিয়ে রাখে টাউ প্রোটিন।  কিন্তু অ্যালজাইমারস ডিজিজে টাউ প্রোটিন তার নিজের স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। তারা অ্যাক্সন-এর দেয়াল থেকে সরে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। ভেঙ্গে পড়ে স্নায়ুকোষের দেয়াল, আর অন্যদিকে তৈরি হয় টাউ প্রোটিন-এর জট (যে জট-টা দেখেছিলেন ড: অ্যালজাইমার)। হয়তো বা স্নায়ুকোষের সিগন্যাল-এ বাধাও পড়ে। নিচের ছবিটা দেখুন। টাউ প্রোটিন-এর নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি করার পেছনেও অ্যামাইলয়েড বিটা-র হাত থাকতে পারে, এমনই দাবি করলো ১৯৯২-এর গবেষণাপত্রটি।

অ্যালজাইমারস ডিজিজ-এ টাউ প্রেটিন-এর সাধারণ কার্যপ্রণালীতে বিঘ্ন ঘটে (সূত্র)

এ তো গেল অ্যালজাইমারস ডিজিজ-এর রাসায়নিক প্রক্রিয়া। মস্তিস্কে কিভাবে রোগটা ছড়ায় সেটাও গবেষণার আরেকটা বিষয়। শেষ পর্যায়ে রোগটা ধরা সোজা কিন্তু যখন রোগটা পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি, তখন মস্তিস্ক কিরকম দেখতে হয়, সেটাও বোঝা প্রয়োজন। জার্মান গবেষক হাইকো ব্রাক এবং এভা ব্রাক একটি গবেষণাপত্রে প্রমাণ করলেন কী ভাবে ধাপে ধাপে অ্যালজাইমারস ডিজিজ ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কে [৪]। মস্তিষ্কের দুধারে থাকে টেম্পোরাল লোব। টেম্পোরাল লোবের অংশ ট্র্যান্সএন্টোরাইনাল কর্টেক্সে টাউ প্রোটিনের জট সবার আগে জমতে শুরু করে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে হিপ্পোক্যাম্পাস এবং অন্যত্র।         হিপ্পোক্যাম্পাস আর তার সংলগ্ন মস্তিষ্কের অংশগুলি সবার আগে আক্রান্ত হয় বলে  অ্যালজাইমারস ডিজিজের অধিকাংশ রোগীর প্রাথমিক লক্ষণ হয় স্মৃতির দুর্বলতা। আমাদের যে কোনও অভিজ্ঞতা বা সে সংক্রান্ত তথ্য প্রথমে সঞ্চিত থাকে হিপ্পোক্যাম্পাসে। এটা হল স্বল্পমেয়াদী স্মৃতির ভাণ্ডার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর একটা অংশ মস্তিষ্ক অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যায় আর এভাবেই আমরা বহু বছরের পুরনো ঘটনার কথা মনে রাখতে পারি। অ্যালজাইমারস ডিজিজের প্রাথমিক স্তরে স্বল্পমেয়াদী স্মৃতির (short term memory) দুর্বলতাই প্রথমে আমাদের নজরে আসে।

হিপ্পোক্যাম্পাস (সূত্র)

অ্যালজাইমারস ডিজিজের  রহস্য কিন্তু এখানেই শেষ হল না। বিজ্ঞানীরা মনে করলেন অ্যামাইলয়েড আর টাউ –এই দুধরণের প্রোটিন যদি মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে হয়তো অসুখের গতিও থমকে যাবে।  অ্যামাইলয়েডের বিরুদ্ধে তৈরি করা হল একাধিক এন্টিবডি। অনেক আশা নিয়ে রোগীদের ওপর তা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগও করা হল। কিন্তু দেখা গেল তাতে মস্তিষ্কে অ্যামাইলয়েডের পরিমাণ কমলেও তাতে রোগীদের বিশেষ উপকার হল না। সবার কপালে তাই নতুন করে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তবে কি নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও অপরাধী? এখনও সেই রহস্যময় অপরাধীর অনুসন্ধান চলছে পুরোদমে। আশা আছে এই অনুসন্ধানের কাজে উৎসাহী পাঠকেরা সহযাত্রী হবে আগামী দিনে।

(প্রচ্ছদের ছবির সূত্র)

তথ্যসূত্র অন্যান্য টুকিটাকি:

[১] অ্যালজাইমার-এর সেই প্রথম রোগীর কথা বিশদে এখানে পড়ুন: https://alzheimer.neurology.ucla.edu/pubs/alzheimerLancet.pdf

[২] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Alzheimer’s Association-এর ২০১৯-এর রিপোর্ট বলে যে এই মুহূর্তে দেশে আনুমানিক ৫৮ লক্ষ অ্যালজাইমারস রোগী রয়েছে। ৬৫-র ঊর্ধ্বে গেলে দশজনের একজন এই রোগের শিকার।

[৩] Alzheimer’s Disease: The Amyloid Cascade Hypothesis, J.A. Hardy, G.A. Higgins, Science, 256, 184-185। [৪] Neuropathological staging of Alzheimer-related changes, H. Braak, E. Braak, Acta Neuropathologica,82, 239-259।

The post বিস্মৃতির রহস্য সন্ধানে appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

Viewing all 311 articles
Browse latest View live


<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>