Quantcast
Channel: বিজ্ঞান – Bigyan
Viewing all 311 articles
Browse latest View live

কুকুর কাহিনী

$
0
0

নেকড়ের থেকে কুকুরের উদ্ভব এক আশ্চর্য কাহিনী। সেই নিয়ে গবেষণাও কম আশ্চর্যের নয়।

কুকুরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অন্তত ১৫,০০০ বছর পুরনো। নানারকম জীবাশ্ম (fossil) ও জিনগত   (genetic) সূত্র থেকে এটুকু পরিস্কার যে কুকুরদের পূর্বপুরুষ নেকড়ে (gray wolf) জাতীয় কোনো শ্বদন্তক (canid) প্রাণী। ঠিক কবে আর কিভাবে নেকড়ে থেকে কুকুরে রূপান্তর ঘটেছে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে পৃথিবী জুড়ে।

কুকুরের বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে মানুষের “ভাষা” বোঝার, মানুষের নানা অঙ্গভঙ্গি বুঝে সেইমত কাজ করার । পোষা কুকুর ছুঁড়ে দেওয়া বল মুখে করে নিয়ে আসে, সকালবেলা খবরের কাগজ মুখে নিয়ে এসে মালিককে দেয়, বসতে বললে বসে, শুতে বললে শোয়, এসব আমাদের জানা কথা। কুকুর যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা এক কথায় স্বীকার করবেন যে কুকুরের চোখের দিকে তাকালে তাঁদের মন গলে যায়, কুকুররা তাঁদের সঙ্গে যেন কথা বলে। পোষা কুকুরের চোখের দিকে তাকিয়ে তার অভিভাবকের এমন মনে হওয়া আশ্চর্য্যের নয়, কিন্ত রাস্তার নেড়ি কুকুর? তাদের দেখেও তো মানুষের দয়া হয়, মন গলে, মনে হয় “আহা বেচারা, বড্ড খিদে পেয়েছে ওর!” এই দয়ার জন্যই এতকাল ধরে টিঁকে রয়েছে হয়ত কুকুরেরা, হয়ে উঠেছে মানুষের সবচেয়ে প্রিয় প্রাণী, সবসময়ের সাথী।    

নেকড়ে থেকে কুকুর 

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের ভাষা বোঝার, এবং মানুষের সঙ্গে মানসিক যোগস্থাপন করার ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে কুকুরের বিবর্তনের চাবিকাঠি। মানুষের ভাষা বোঝার, মানুষের সঙ্গে  ভাবের আদানপ্রদান করার এই ক্ষমতাকে বলা হয় social cognition। বিভিন্ন রকম আচরণভিত্তিক ও মনস্তত্বভিত্তিক  পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে নেকড়েদের তুলনায় কুকুরদের এই ক্ষমতা অনেক বেশী। কুকুর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে অতীতে কোনো এক সময় নেকড়ে বা নেকড়ে জাতীয় কোনো পশু মানুষের সঙ্গে আদানপ্রদান করতে শুরু করে, এবং যাদের মধ্যে এই social cognition বেশী প্রবল, তারা মানুষের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে শেখে। কুকুরের এই পূর্বসূরিরা আমাদের পূর্বপুরুষদের আশেপাশে থেকে তাদের উচ্ছিষ্ট খেতে শুরু করে, স্বাভাবিক নেকড়েসুলভ হিংস্রভাব তাদের আচরণে কমে যেতে থাকে, তারা হয়ে ওঠে সহজবশ্য, পোষ মানে ক্রমশ। এই ধারণার নাম দেওয়া হয়েছে domestication hypothesis। এর মূল ভাব পোষ  মানানো হলেও তফাৎ হল যে এখানে মানুষ কুকুরকে ঠিক নিজের প্রয়োজনে জোর করে বেঁধে রেখে পোষ মানায় না, কুকুর নিজেই পোষ মানতে ইচ্ছুক। এতে অবশ্য লাভ উভয়পক্ষেরই। সমস্যা হল যে কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাস বোঝার জন্য বেশীর ভাগ গবেষণা করা হয় পাশ্চাত্যে, পোষা কুকুর নিয়ে। নানা জাতের পোষা কুকুর আমাদের চোখে যতই আলাদা হোক, একটি german shepherd এর সঙ্গে একটি poodle এর জিনে  আসলে খুব তফাৎ নেই। প্রায় ৩৫০টি কুকুরের breed ছড়িয়ে রয়েছে সারা পৃথিবীতে, এবং এরা সকলেই প্রায় মানুষের সৃষ্টি; ঠিক যেভাবে আমাদের যাবতীয় খাদ্যশস্য এবং গৃহপালিত পশু আমাদের সৃষ্টি, artificial selection পদ্ধতিতে। কুকুরের breed তৈরিতে মানুষের হাত থাকলেও, নেকড়ে থেকে কুকুরের বিবর্তন ঘটেছে এই কৃত্রিম প্রজনন আরম্ভ হওয়ার অনেক আগে। অর্থাৎ, ছবিটা কিছুটা এই রকম –

পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে কুকুরের জিন সংগ্রহ করে কুকুর নামক প্রাণীটির বিবর্তনের ইতিহাস বুঝতে চেষ্টা করছেন  নানা দেশের বৈজ্ঞানিকরা। গত কয়েক বছর ধরে কিছু নতুন প্রকাশিত তথ্য কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাস কিছুটা হলেও পরিস্কার করেছে, যদিও এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমে বলি কি কি জানা গেছে, সেই কথা, তারপরে ফিরব প্রশ্নে।

প্রাথমিক গবেষণা

কুকুরের বিবর্তনের বিষয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক কাজের নিদর্শন হিসেবে হয়ত ধরে নেওয়া যায় ১৯৬১-তে  প্রকাশিত Magnus Degerbøl নামক এক ড্যানিশ বৈজ্ঞানিকের কাজ [১]। তবে কুকুরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের প্রথম প্রমাণ প্রকাশিত হয় ১৯৭৮-এ Nature journal-এ তিন পাতার একটি গবেষণাপত্রে [২]। ইসরায়েলের Davis ও Valla জানান যে মধ্য-প্রাচ্যের নাতুফিয়ান সংস্কৃতির  (Natufian culture) এলাকার একটি বাসস্থানে একটি পাথরের নীচে একজন বয়স্ক মানুষের প্রায় আস্ত কঙ্কাল পাওয়া গেছে। এই মানুষটি পা মুড়ে শুয়ে রয়েছেন, একটি হাত মাথার ওপরে একটি কুকুর (অথবা নেকড়ে) ছানার গায়ে রাখা। বোঝা যায় যে এই স্বাপদশিশুকে কবর দেওয়া হয়েছিল তার “মালিকের” সঙ্গে। একই সঙ্গে আরো কিছু হাড় পাওয়া যায় ওই নাতুফিয়া এলাকা থেকে। ১৯৭৮-এ এখনের মত DNA analysis ছিল না, সুতরাং এই হাড়গোড়গুলি নানাভাবে মেপে, অন্যান্য কুকুর ও নেকড়ের হাড়ের সঙ্গে তুলনা করাই ছিল একমাত্র পদ্ধতি। এই কাজ থেকে পরিষ্কার হয়নি ওই হাড়গুলি কুকুরেরই ছিল কিনা, তবে ১২,০০০ বছর আগে নাতুফিয় আমলে যে কুকুরজাতীয় পশুকে মানুষ পোষ মানিয়েছিল তার সাক্ষী ১৩১ নম্বর বাসায় পাওয়া ওই কবর।

কাট টু ১৯৯৭, মার্কিন ও সুইডিশ বৈজ্ঞানিকদের কাজ থেকে প্রমাণিত হল যে নেকড়ে  থেকেই কুকুরের উৎস [৩]। Science পত্রিকায় Robert K. Wayne এবং তাঁর সহকর্মীদের কাজ প্রকাশিত হয়; ৬৭টি ব্রীডের ১৪০টি পোষা কুকুর ও পৃথিবীর ২৭টি জায়গার ১৬২টি নেকড়ের mitochondrial DNA পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন তাঁরা। সেই সঙ্গে জানা যায় যে অন্ততপক্ষে ১০০,০০০ বছর আগে কুকুর বিবর্তিত হয়েছে নেকড়ের থেকে, এমনকি, কুকুরের প্রথম আবির্ভাব ১৩৫,০০০ বছর আগেও ঘটে থাকতে পারে। সমস্যা হল যে, আদিম মানুষের আশেপাশে কুকুরের যে সমস্ত চিহ্ন পাওয়া গেছে, সেগুলির বয়স অত নয়। তারও আগে যদি কুকুরের অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে আমরা তার কোনো চিহ্ন পাইনি কেন, সেই প্রশ্ন উঠলো।

জিন সিকোয়েন্সিং

নতুন সহস্রাব্দে সহজলভ্য (ভারতে তখনো নয়) gene sequencing নিয়ে এল নতুন বিপ্লব, যেসব দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড শক্ত, সবাই যুগপৎ নেমে পড়লেন নতুন ধরণের বিবর্তনের গবেষণায়, যার নাম molecular evolution, এবং যার মূলে রয়েছে জিন। ক্রমশ অনেক নতুন তথ্য প্রকাশ পেতে থাকল, এবং বোঝা গেল যে Wayneদের হিসেবে ভুল ছিল। তবুও, এই কাজ থেকে কুকুরের বিবর্তন বিষয়ক গবেষণার এক নতুন দিক খুলেছিল, তা অস্বীকার করা যায় না। ইতিহাস পড়লে জানা যায়, অতীতের এমন অনেক ভুলে ভবিষ্যতের অনেক আবিষ্কারের বীজ রোপিত হয়েছে।

২০০২, আবার Science পত্রিকা, আবার কুকুরের mitochondrial DNA [৪]। এবারে সুইডেন ও চীনের বৈজ্ঞানিকরা ৬৫৪টি কুকুরের জিনের বিশ্লেষণ করে জানালেন যে পৃথিবীর সব কুকুরের উৎস একটিই  gene pool (বা population) এবং জন্মস্থান এশিয়ায়, উরাল পর্বতের পূর্ব দিকে, সময় ১৫,০০০ বছরের আশেপাশে। ২০০৯-এ এই বৈজ্ঞানিকদের দলটি আরো গবেষণা করে জানালেন যে ১৬,৩০০ বছর আগে চীনের দক্ষিণ দিকের বাসিন্দা কয়েকশ নেকড়ে সমগ্র সারমেয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা [৫]। সময়টা মানব ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ মোটামুটি এই সময়েই ধান চাষের সূত্রপাত ঘটে।

Peter Savolainen দের এই গবেষণা থেকে আরো জানা গেল যে এই সারমেয়কুলের মূলে একজন নয়, ছিল অন্তত ৫১ জন নেকড়ে-সরমা – অর্থাৎ সেই সময়ের চৈনিক মানুষদের মধ্যে নেকড়ে পোষ মানানর বেশ ভালই চল ছিল। চীনের এইসব অঞ্চলে আজও কুকুরের মাংস খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। তবে কি সদ্য চাষবাস শেখা মানুষেরা নিতান্তই খাদ্য হিসেবে পোষ মানিয়েছিলেন নেকড়েদের?  

এশিয়া না ইউরোপ?

স্যাভোলেইনেনদের সঙ্গে ঠিক একমত ছিলেন না মার্কিন  বৈজ্ঞানিক আডাম বোয়কো ও তাঁর সহকর্মীরা। ২০০৯-এই তাঁদের কাজ প্রকাশিত হয়েছিল PNAS journal-এ [৬]। বোয়কোদের মতে, শুধুমাত্র পূর্ব এশীয় নেড়ি কুকুরদের নিয়ে গবেষণা করেই এতদিন প্রমাণ করা হয়েছে যে কুকুরদের উৎস পূর্ব এশিয়াতে। অথচ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে নানা জাতের কুকুর, রয়েছে অনেক জংলী বা আধপোষা কুকুরের গোষ্ঠী, রয়েছে নেড়ি কুকুরের দল। কুকুরজাতির ইতিহাস বুঝতে গেলে এই বিরাট জনসংখ্যাকে  বাদ দিলে কি করে চলবে? আফ্রিকার সাতটি জায়গা থেকে ৩১৮টি নেড়ি কুকুর, আর তার সঙ্গে বিভিন্ন breed-এর (আমাদের হিসেবে যারা ভালো জাতের, বা বনেদি) কুকুরের DNA নানাভাবে নেড়েচেড়ে, তুলনা করে বোয়কোৱা  দেখেছিলেন যে আফ্রিকার নেড়িরা “বিলিতি” বনেদি কুকুরদের থেকে আলাদা, যদিও আফ্রিকার বনেদি কুকুরদের সঙ্গে তাদের অল্প মিল রয়েছে। মূলতঃ বোঝা গেল যে নেড়ি কুকুরদের মধ্যে জিনের বৈচিত্র বনেদীদের তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং, বিবর্তনের ইতিহাস বুঝতে হলে পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা নেড়ি কুকুরদের জিনের বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এই কাজে বনেদি কুকুরদের তেমন দাম নেই।

বোয়কো ও স্যাভোলেইনেনদের দুপক্ষের কাজেই কটাক্ষ করেছেন প্রাজ্ঞ বিবর্তন বিশেষজ্ঞ রবার্ট ওয়েন। তাঁর মতে, কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাস বুঝতে এখনকার কুকুরের জিন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করা নিতান্তই বোকামি, কারণ এই রহস্যে আলোকপাত করতে পারে একমাত্র প্রাচীন কুকুররা। অতএব, আধুনিক কুকুরদের ভুলে গিয়ে প্রাচীনদের হাড়গোড় নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। ঠিক তাই করেছেন ওয়েন ও তাঁর সহকর্মীরা – ইউরোপ ও এশিয়াতে পাওয়া ১৮টি ফসিল ও তার সঙ্গে বেশ কিছু আধুনিক কুকুর ও নেকড়ের mitochondrial genome বিশ্লেষণ করে তুলনা করেছেন [৭]। ১৫ই নভেম্বর ২০১৩-র Science পত্রিকার প্রচ্ছদ জুড়ে ছিল একটি Basenji hound-এর ছবি, কারণ সেই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ওয়েনদের গবেষণার ফল। প্রাচীন শ্বদন্তকদের DNA থেকে জানা গেছে যে আধুনিক কুকুর নামক প্রাণীটির উৎস মধ্য ইউরোপ। ১৮,৮০০ থেকে ৩২,০০০ বছর আগে এই অঞ্চলে বাস করা নেকড়েদের পোষ মানিয়েছিলেন আমাদের hunter gatherer পূর্বপুরুষরা। বলাই বাহুল্য, কুকুরপ্রেমী পাশ্চাত্য এতে খুশি হল; অতি প্রিয় ঘরের প্রাণীটি যে আসলে ভিনদেশী, তা ভাবতে কার আর ভাল লাগে! 

জেনেটিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা মেলানোর প্রয়াস

এই ধরনের কাজের একটা সমস্যা হল, যে ফসিল পাওয়া গেছে শুধু সেগুলির ভিত্তিতেই গবেষণা চালাতে হয়, এবং তার ফলে অনেক সময় আসল ছবিটা প্রকাশিত হয় না। ওয়েনদের কাজের মধ্যেও রয়ে গিয়েছিল এই ধরণের ফাঁক, যা পরিষ্কার হল আরো বিশদ গবেষণায়।

২০১২-তে গ্রেগর লারসন ও একটি আন্তর্জাতিক টীম PNAS পত্রিকায় একটি কাজ প্রকাশ করলেন, যাতে নড়েচড়ে বসল বিজ্ঞান নিয়ে উৎসাহী প্রচার মাধ্যম [৮]। ৩৫টি ব্রীডের মোট ১৩৭৫টি কুকুরের এবং ১৯টি নেকড়ের DNA থেকে লারসনরা বের করলেন ৪৯,০২৪টি SNP, বা single nucleotide polymorphism – নামটা খটমট শোনালেও, ব্যাপারটা বোঝা সহজ।  মনে কর, তোমার একটি জিনের DNAতে ৪৫৫তম nucleotideটি হল A, কিন্তু সেই একই জিনের একই জায়গায় আমার রয়েছে T। এতে জিনটির কাজ দিব্যি চলে যাচ্ছে, কিন্তু আসলে এরা দুজনে একই জিনের দুটো আলাদা রূপ, বা allele। সুতরাং, একে বলা যায় একটি nucleotide-এর ভিন্ন রূপ, বা polymorphism, যার উৎস কোনো একটি mutation বা পরিব্যক্তি।

লারসনরা নিজেদের এই data-র সঙ্গে আগে প্রকাশিত জিনগত এবং প্রত্নতাত্ত্বিক data যোগ করে একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ১২১টি ব্রীডের। সমস্যা হল, প্রত্নতত্ত্বের  সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধন হল না – জিনের হিসেবে প্রাচীনতম ব্রীডগুলো যেসব অঞ্চলে পাওয়া যায়, প্রাচীনতম জীবাশ্মগুলি সেই সব অঞ্চলে পাওয়া যায়নি। প্রাচীনতম তিনটি ব্রীড হল ডিঙ্গো, ব্যাসেনজি ও নিউ গিনি সিংগিং ডগ; এদের পাওয়া যায় এমন সব অঞ্চলে, যেখানে প্রাচীন কুকুর (Canis lupus) আগে ছিল না, এদের মানুষ নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছে কুকুর পোষ্য হয়ে ওঠার অন্ততঃ ১০,০০০ বছর পরে।  এই গরমিল দেখে লারসনরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে আরো আন্তঃবিষয়ক গবেষণার প্রয়োজন কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাসের সঠিক ছবিটা বোঝার জন্য। 

পাওয়া গেল প্রাচীন কুকুরের খুলি

আলতাই পর্বতমালার এক গুহা থেকে উদ্ধার করা হয় একটি কুকুর বা কুকুর গোত্রীয় প্রাণীর দাঁত সমেত খুলি [৯]। ২০১১ তে প্রথম প্রকাশিত হয় এই বিষয়ে গবেষণা, এবং বিভিন্ন সংবাদপত্র সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেয় খবরটি।

https://doi.org/10.1371/journal.pone.0022821

আধুনিক ও প্রাক্তন কুকুর ও নেকড়ের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এই প্রাণীটির নিকটতম আত্মীয় এখনকার গ্রীনল্যান্ডের পোষা কুকুরেরা। প্রাচীনকালের নেকড়েদের সঙ্গে এদের মিল নেই বিশেষ। রেডিওকার্বন ডেটিং করে জানা গেল যে এই খুলির আনুমাণিক বয়স ৩৩,০০০ বছর। এই খুলির mitochondrial DNA বিশ্লেষণ করেন রাশিয়ার একদল বৈজ্ঞানিক, রবার্ট ওয়েনের সহযোগিতায় [১০]। ২০১৩তে  প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে তাঁরা জানান যে এই আলতাই পর্বতমালার কুকুরটির সঙ্গে আধুনিক কুকুর এবং প্রাগৈতিহাসিক কালের নতুন বিশ্ব (New World) থেকে পাওয়া শ্বদন্তকদের  মিল রয়েছে, কিন্তু আধুনিক নেকড়েদের সঙ্গে মিল এদের অনেক কম। আনা দ্রুস্কভা ও তাঁর সহযোগী বিজ্ঞানীরা দাবি রাখেন যে পূর্ব এশিয়া অথবা মধ্য প্রাচ্যের বাইরে কুকুরের বিবর্তনের ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন, এবং এই বিষয়ে আরো বিশদভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন। সমস্যা হল, এই ধরণের গবেষণার জন্য প্রয়োজন আরো জীবাশ্ম।

বড় মাপের গবেষণা

২০১৩-র নভেম্বর মাসে, Science-এ প্রকাশিত হল আর একটি বড় মাপের কাজ – ওয়েন, ওলাফ থালম্যান ও আরো ২৯জন নানা দেশীয় বিজ্ঞানীর যৌথ প্রয়াস [৯]। ইউরোপ-এশিয়া ও নতুন বিশ্বের থেকে পাওয়া মোট ১৮টি প্রাগেতিহাসিক শ্বদন্তকের জীবাশ্ম এবং অনেকগুলি আধুনিক কুকুর ও নেকড়ের মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ (mitochondrial  DNA) নিয়ে এই কাজ। আমাদের mitochondriaতে যে DNA থাকে (mt DNA), তা আমরা পাই আমাদের মায়ের থেকে, বাবার জিনের সংমিশ্ৰণ ঘটে না এর সঙ্গে। সুতরাং mtDNA বিবর্তনের ধারা বোঝার জন্য অনেক সময় খুবই কাজের। থালম্যানরা একটি বংশ পরিচয় তৈরী করলেন এই mtDNA -র সূত্র ধরে, এবং দেখা গেল যে আধুনিক সমস্ত ব্রীড, এমনকি ডিঙ্গোদের পর্যন্ত জন্ম ইউরোপেই। ১৮,৮০০ থেকে ৩২,১০০ বছরের মধ্যে ইউরোপেই বাস করত আজকের সমস্ত কুকুরের common ancestor, অর্থাৎ, ইউরোপ থেকেই বংশ বিস্তার করেছে সারমেয়কুল।      

অক্টবর ২০১৫-তে বোয়কোর নেতৃত্বে PNAS পত্রিকায় প্রকাশিত হল একটি কাজ [১১] – সেই পেপারে দেওয়া নামের দীর্ঘ তালিকায় রয়েছেন বিভিন্ন দেশের আরো ২৬ জন; তাঁদের মধ্যে একজন ভারতীয় – রাজশ্রী খলাপ। পৃথিবীতে প্রায় ৪০০ ধরনের বনেদি কুকুর রয়েছে, আর রয়েছে  নেড়িরা – বিজ্ঞানের ভাষায় যাদের বলা হয় free-ranging বা free-roaming dogs – অর্থাত যারা পোষা নয়। সারা পৃথিবীর সব কুকুরের হিসেবে করলে দেখা যায় যে নেড়িরাই দলে ভারী, বিশ্বের প্রায় ৮০% কুকুর নেড়ি! ২০০৯-এর কাজের রেশ ধরে, এবারে পৃথিবীব্যাপী যজ্ঞে নেমেছিলেন বোয়কোরা। ১৬১ ব্রিডের মোট ৪,৬৭৬টি কুকুর আর তার সঙ্গে ৩৮টি দেশের ৫৪৯ গ্রাম থেকে ৫৪৯টি কুকুরের শরীর থেকে সংগ্রহ করা রক্তের নমুনা থেকে DNA নির্যাস তৈরী করে তিন ধরনের বিশ্লেষণ করেন তাঁরা। এই বিশ্লেষণের ফলে জানা যায় যে প্রথমত, বনেদি কুকুরদের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র রয়েছে নেড়িদের জিনে। একটু ভেবে দেখলেই বুঝবে, এতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই; কুকুরদের যে নানান ব্রীড সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে, সেগুলি প্রায় সবই মানুষের হাতে তৈরী, artificial breeding বা নির্বাচনী প্রজননের ফল।

কুকুরের বিবর্তনে একাধিক ধারা

বোয়কোদের  এই কাজ থেকে যে নতুন তথ্যটি পাওয়া গেল তা এল নেড়িদের থেকে –  পূর্ব এশিয়ার নেড়িদের মধ্যে জিনগত  বৈচিত্র্য যেমন বেশী, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও ভারতের নেড়িদের মধ্যেও জিনগত  বৈচিত্র খুব বেশী। তিন ধরণের জেনেটিক বিশ্লেষণ থেকে বোঝা গেল যে নেকড়ে জাতীয় পূর্বপুরুষের থেকে কুকুরদের প্রথম পোষ মানা শুরু হয় মধ্য এশিয়াতে, এবং সেখান থেকে কুকুররা ছড়িয়ে যায় এশিয়ার বিভিন্ন এলাকায়, আফগানিস্তান, ভারত, মায় ভিয়েতনামে। বিভিন্ন অঞ্চলের নেড়িদের মধ্যে পাওয়া গেল স্পষ্ট জিনগত  প্রভেদ। পূর্ব এশিয়া (ভিয়েতনাম, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া), মধ্য  এশিয়া (মোঙ্গলিয়া, নেপাল), ভারত, মধ্য প্রাচ্য (মিশর, লেবানন, কাতার, তুরস্ক, আফগানিস্তান) এবং সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত আফ্রিকা – এই পাঁচটি মূল ভাগ পাওয়া গেল নেড়ি কুলে। ইউরোপ-আমেরিকার কুকুরদের থেকে এরা সকলেই অনেকটা আলাদা। গত ১৫,০০০ বছরে  ইউরোপের কুকুর সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচুর জিনগত  পরিবর্তন ঘটেছে, যে কারণে এখনকার ইউরোপীয় কুকুরদের ব্যবহার করে তাদের বিবর্তনের ইতিহাস বোঝা সম্ভব নয়। বোয়কোদের কাজ থেকে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় মধ্য এশিয়াতেই প্রথম কুকুররা পোষ মেনেছিল কিনা, তবে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের কুকুরদের বিবর্তন যে এই সময় থেকে ভিন্ন পথে চলেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। এই গবেষণাপত্র থেকে আধুনিক কুকুরদের জিনগত  আত্মীয়তা অনেকটা পরিষ্কার হলেও, তাদের পূর্বপুরুষদের বিবর্তনের ইতিহাস ঠিক স্পষ্ট হয় না, কারণ কোনো নির্দিষ্ট সময়ের হিসেব দেননি বোয়কোরা; উপরে দেওয়া ওই ১৫,০০০ বছর সংক্রান্ত উক্তিটি বাদে। 

২০১৬-র জুন মাসে Science পত্রিকায় প্রকাশিত হল আরো একটি কাজ, আবার একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক দল, এবং আবার সেই লারসন; তবে এবার ডারহাম নয়, তাঁর ঠিকানা অক্সফোর্ড [১২]। এই দলের নেতৃত্বে লারসনের সঙ্গে রয়েছেন অক্সফোর্ড-এর লরেন্ট ফ্রানৎজ ও ডাবলিনের ড্যানিয়েল ব্র্যাডলি। আয়ারল্যান্ড-এর নিউগ্রাঞ্জ থেকে উদ্ধার হওয়া একটি কুকুরের হাড় এই কাজের মূল চাবিকাঠি। ৪৮০০ বছর পুরনো এই হাড়ের থেকে DNA নিষ্কাশন করে তার সঙ্গে তুলনা করলেন ৫৯টি প্রাচীন কুকুরের mt DNA, ৬০৫টি আধুনিক কুকুর থেকে পাওয়া SNP (ওপরে দেখ) এবং ৮০টি আধুনিক কুকুরের সমগ্র জিনোম (whole genome)। এই বিশ্লেষণ থেকে বিজ্ঞানীরা একটি নতুন তথ্য আবিষ্কার করলেন – পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম ইউরেশিয়ার কুকুরদের মধ্যে বিভাজন ঘটেছিল আজ থেকে ৬৪০০ – ১৪,০০০ বছর আগে। অথচ, ইউরোপ এবং এশিয়াতে এর চেয়ে অনেক প্রাচীন কুকুরের জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। সুতরাং, লারসন ও তাঁর সহকর্মীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে পৃথিবীর এই দুই ভাগে অন্তত দুবার নেকড়েদের পোষ মানিয়েছে মানুষ, মানুষের সঙ্গেই কুকুর ছড়িয়ে পড়েছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, এবং নতুন জায়গায় পৌঁছে সেখানে বাস করা নেকড়েদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরি করেছে নতুন কোনো ব্রীড।

নাকি একই ধারা অবিচ্ছিন্ন?

লারসনদের এই কাজে খুশি ছিলেন না অনেকেই, Nature News-এর পক্ষ থেকে  এই কাজের সম্পর্কে  বোয়কোকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে তিনি ঠিক সহমত নন ফ্রানৎজ – লারসনদের সঙ্গে, তবে এটি একটি “intriguing hypothesis” – আরো অনেক কাজ প্রয়োজন এই বিষয়টা ঠিক মত বোঝার জন্য। বছরখানেক বাদেই, জুলাই ২০১৭-তে আরো একটি কাজ প্রকাশিত হল Nature Communications -এ, নতুন একটি আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় স্টোনি ব্রূকের বিজ্ঞানী কৃষ্ণা ভীরামাহর নেতৃত্বে [১৩]। জার্মানি থেকে পাওয়া দুটি জীবাশ্ম, একটি ৭০০০ বছর পুরনো, অন্যটি ৪৭০০ বছর – অর্থাৎ, neolithic যুগের শুরু এবং শেষের সময়সীমা মাথায় রেখে বেছে নেওয়া এই দুটি জীবাশ্ম। এই দুই জার্মান সারমেয়র সঙ্গে নেওয়া হল আয়ারল্যান্ড থেকে পাওয়া ৫০০০ বছর আগের একটি জীবাশ্ম।  ভীরামাহ ও তাঁর সহকর্মীরা mtDNA -র দিকে গেলেন না, বরং এই তিনটি প্রাচীন কুকুরের পুরো জেনোমিটাই বিশ্লেষণ করে ফেললেন। তারপর এদের তুলনা করলেন আধুনিক কুকুরদের সঙ্গে।

এঁরা জানালেন, ফ্রানৎজদের সঙ্গে এঁদের হিসেবে মোটেই মিলছে না – ইউরোপীয় কুকুরদের মধ্যে সেই Neolithic যুগের শুরু থেকে এখকার সময় পর্যন্ত  পাওয়া যাচ্ছে অবিচ্ছিন্ন জিনগত  ধারাবাহিকতা। অতএব, ইউরোপের আধুনিক কুকুরেরা এসেছে সেই Neolithic কুকুরদের থেকেই। neolithic-এর শেষের দিকে ইউরোপীয় কুকুরদের সঙ্গে মিশেছে পূর্বদিক থেকে আসা একটি জিন-ধারা, সুতরাং ভেবে নেওয়া যেতে পারে যে Steppe থেকে যেসব মানুষ এই সময় ইউরোপে এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গেই এসেছিল এই কুকুরেরা। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তীয় কুকুরদের মধ্যে বিভাজনের সময়সীমা ১৭,০০০ থেকে ২৪,০০০ বছর, অর্থাৎ, মানুষ নেকড়েদের পোষ মানিয়েছে একবারই, ২০,০০০ থেকে ৪০,০০০ বছর আগে, এবং সেই পোষ মানা প্রাচীন কুকুররাই ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, মানুষের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে।

কুকুর আর নেকড়ের প্রভেদ

বলাই বাহুল্য, বৈজ্ঞানিক প্রচার মাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ল এই খবরে, বিতর্ক বলে কথা! সমস্যা হল, এত করেও কুকুরের বিবর্তনের ছবিটা সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার হয়ে উঠল না।  এ যেন অনেকটা jigsaw puzzle -এর মত, একটা করে টুকরো পাওয়া যাচ্ছে, একটু করে বেরিয়ে আসছে ছবিটা, কিন্তু পুরোটা কিছুতেই মিলছে না, এখানে ওখানে ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক দিন রাত কাজ করে চলেছেন এই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে। একদল মানুষ যেমন জীবাশ্ম ও আধুনিক কুকুর ও নেকড়েদের জিনের মধ্যে মিল-অমিল খুঁজে চলেছেন, তেমন আর একদল চাইছেন বুঝতে, কি সেই জিনগত  বৈশিষ্ট্য যা কুকুরের নিজস্ব, যেগুলির জন্য কুকুররা কুকুর, নেকড়ে নয়। 

আধুনিক কুকুরদের সঙ্গে নেকড়েদের জিনগত  প্রভেদ খুঁজে বের করলে এমন কিছু পরিব্যক্তি (mutation) পাওয়া যেতে পারে, যেগুলি কুকুরদের আলাদা করে তাদের নিকটতম আত্মীয়দের থেকে।  ২০১৩-তে এইরকম একটি গবেষণা প্রকাশিত হয় Nature -এ; কুকুর ও নেকড়ের whole genome sequence করে এরিক এক্সেলসন (Eric Axelsson) ও তাঁর সহকর্মীরা ৩৬টি জিন খুঁজে পেলেন, যেগুলি কুকুরের পোষ মানার প্রক্রিয়াতে সহায়ক হয়ে থাকতে পারে। এদের মধ্যে অনেকগুলি জিন মস্তিষ্কের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত। দশটি জিন এমন পাওয়া গেল যেগুলি শর্করা (carbohydrate) জাতীয় খাবার ও চর্বি হজম করার পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে তিনটি জিন তাঁরা চিহ্নিত করলেন, যেগুলি নেকড়েদের থাকে না, কিন্তু কুকুরদের থাকে, এবং যেগুলি শর্করা-সমৃদ্ধ খাবার হজম করার পদ্ধতিতে অত্যন্ত জরুরি।

এই কাজটির গুরুত্ব বুঝতে হলে একটু ভাবতে হবে, কিভাবে এই নতুন বা পরিবর্তিত জিনগুলি আদীম কুকুরদের সাহায্য করে থাকতে পারে। আদিম মানুষ যে সময় ক্ৰমশঃ চাষভিত্তিক জীবনযাত্রার দিকে এগোচ্ছে, সেই সময় তাদের এঁটোকাটার মধ্যে শর্করার ভাগ বাড়ছে, এবং হাড়গোড় বা মাংসের সঙ্গে মিশে থাকছে গম, ধান, জব জাতীয় খাবার। যে প্রাণী এই সমস্ত হজম করতে সক্ষম, সে অনেক বেশি পুষ্টি পেতে পারে মানুষের উচ্ছিষ্ট থেকে। সুতরাং, নেকড়েদের তুলনায় কুকুর এক্ষেত্রে অনেকটাই সুবিধে পেয়ে থাকতে পারে, এই নতুন তিনটে জিন থাকার জন্য।

২০১৮-র জুন মাসে BMC Biology জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে একটি নতুন কাজ, যেখানে একসঙ্গে কাজ করেছেন বোয়কো, ভীরামাহ ও আরো কয়েকজন। পৃথিবীর নানা জায়গার থেকে পাওয়া ৪৩টি নেড়ি কুকুর এবং ১০টি নেকড়ের জিনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে এঁরা এমন ৪২৯টি জিন খুঁজে বের করেছেন, যেগুলি হয়ত বা কুকুরের পোষ মানার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। এই কাজের মূল উপসংহারটি বেশ আকর্ষণীয় – এক গুচ্ছ জিন, যেগুলি ভ্রূণের ক্রমবিকাশের প্রাথমিক পর্যায় কাজ করে, এবং এগুলির জন্য কুকুরসুলভ বেশ কিছু phenotype প্রকাশ পায়, যেমন ঝোলা কান, ছোট মাপের চোয়াল, নম্র স্বভাব, মাথার আকার ছোটো হওয়া, ইত্যাদি। কুকুর এবং নেকড়েদের মধ্যে এগুলি মূল প্রভেদ হিসেবে সহজেই চেনা যায়, এবং এই আকৃতি ও প্রকৃতিগত ভেদগুলিকে একসঙ্গে বলা হয় domestication syndorme। সুতরাং, এই পেপারটির মূল যুক্তি হল যে মানুষ আদিম কুকুরদের পোষ মানিয়েছিল কিছু প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য বেছে নিয়ে, এবং যেহেতু এই জিনগুলি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত, একই সঙ্গে নির্বাচিত হয়েছিল কিছু আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। 

নেড়ি কুকুরের ভূমিকা

কুকুরের বিবর্তন নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখানেই – কুকুর নিজের ইচ্ছেতে পোষ মানা নেকড়ে, নাকি মানুষ চেষ্টা করে তাদের  পোষ মানিয়েছে, যেমন পোষ মানিয়েছে আরো অনেক পশুকে, উদ্ভিদকে? একদল বিজ্ঞানী মনে করেন যে মানুষ শিকারের সুবিধের জন্য নেকড়েদের পোষ মানাতে চেষ্টা করেছে, এবং সেই থেকেই কুকুরের জন্ম। মানব সভ্যতার ইতিহাসে নেকড়েই  একমাত্র বড়মাপের মাংসাশী প্রাণী যাকে পোষ মানানো হয়েছে। নেকড়ে থেকে কুকুরে পরিবর্তিত হওয়ার সময় হয়ত এদের মানুষের কাছে সবথেকে বড় প্রয়োজন ছিল শিকারে সহায়ক হিসেবে। সেই শিকারী কুকুর থেকেই  ক্ৰমশঃ জন্ম নিয়েছে ল্যাব্রাডর থেকে শুরু করে চিওয়াওয়া, সব জাতের সারমেয়। প্রশ্ন হল, এই কয়েক হাজার বছরের বিবর্তনের গল্পে আমাদের নেড়িদের জায়গা কোথায়?

পৃথিবীর সমস্ত কুকুরের জনসংখ্যার ৭০-৮০% নেড়ি, যারা ছড়িয়ে রয়েছে মূলতঃ অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। যতই বিশ্বায়ন হোক, বৈজ্ঞানিক গবেষণার মূলস্রোত এখনও চালিত হয় পাশ্চাত্যের হাতে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলিতে রাস্তায় কুকুর থাকে না, সুতরাং নেড়িদের নিয়ে কুকুর-গবেষকেরা বিশেষ মাথা ঘামাননি এতকাল। পোষা কুকুরদের দেহতত্ত্ব (physiology), শরীর-বিদ্যা (anatomy) নিয়ে গবেষণা পশু চিকিৎসায় বহু প্রচলিত, কারণ মানুষ তার পোষা প্রাণীটিকে সুস্থ রাখতে চায়। কুকুরের আচার আচরণ (behaviour), জ্ঞানীয় দক্ষতা (cognitive skills), মনস্তত্ত্ব (psychology) নিয়ে গত দু-তিন দশকে প্রভূত পরিমাণে গবেষণা করা হচ্ছে পাশ্চাত্যে। মানুষের হাবভাব ও ভাষা বুঝতে পারে কুকুর, এ কথা যে কোনো কুকুরপ্রেমী তো বলবেনই, এমনকি যাঁরা কুকুর পছন্দ করেন না, এ কথা তাঁরাও অস্বীকার করেন না। মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলা, মানুষের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করার এই ক্ষমতার জন্যই তো কুকুর আমাদের এত প্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছে!

কিন্তু এই ক্ষমতা কি কুকুরের সহজাত? কুকুরের বিবর্তনের কোন পর্যায় তারা এই ক্ষমতা অর্জন করেছে? নেকড়ে থেকে কুকুরে বিবর্তনের পথে আগে কি নেকড়ে পোষ মেনে তারপর মানুষকে বুঝতে শিখেছে, নাকি মানুষকে বোঝার, মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা অর্জন করেছে বলেই তারা পোষ মেনে কুকুর হয়ে উঠেছে? এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ইওরোপ ও আমেরিকায় বেশ কিছু বিজ্ঞানী নানা জাতের পোষা কুকুরের ওপরে নানান পরীক্ষা করে চলেছেন। এবং প্রশ্ন যেহেতু বিবর্তন নিয়ে, তুলনামূলক গবেষণার জন্য তাঁরা একই পরীক্ষা চালাচ্ছেন নেকড়েদের ওপর।  তবে এই নেকড়েরা ঠিক বন্য নেকড়ে নয়, এদের রাখা হয় কোনো সংরক্ষিত এলাকায়, যথেষ্ট যত্নে, এবং এদের জন্ম থেকেই হাতে করে বড় করে তোলেন ট্রেনাররা। সুতরাং এই নেকড়েরা ঠিক পোষা না হলেও, যত্নে রক্ষিত বন্দী।

একদিকে প্রায় পোষা নেকড়ে, অন্যদিকে পুরোপুরি পোষা কুকুর – জন্ম থেকে এরা মানুষের হাতেই গড়ে ওঠে, মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করে, মানুষের দেওয়া খাবার খেতে শেখে, মানুষের আচার আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।  সুতরাং, এদের মধ্যে দিয়ে কোনোভাবেই এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, যে মানুষকে বোঝার ক্ষমতা কুকুরের কতটা সহজাত, আর কতটা মানুষের সঙ্গে থাকার ফলে শেখা।

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনেকটাই সাহায্য করতে পারে নেড়িরা, কারণ তারা মানুষের আশেপাশে থাকে, মানুষের ওপর নির্ভর করে খাবারের জন্য, আশ্রয় খোঁজে মানুষের বসতির মধ্যে, তাদের রোজনামচায় মানুষ অনেকটা অংশ জুড়ে থাকে। একদিকে মানুষ এদের শত্রূ, তাড়া করে, আহত করে, এমনকি মেরেও ফেলে; আবার অন্যদিকে মানুষই এদের বন্ধু, খেতে দেয়, আশ্রয় দেয়, আদর করে। সুতরাং মানুষের হাবভাব বুঝে চলা এদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরী। ঠিক কতটা এই ক্ষমতা রয়েছে নেড়িদের? ওরা কি পারে মানুষের ভাষা বুঝতে, অথবা মানুষের শরীরের ভাষা (body language) বুঝতে? কিছু মানুষকে কুকুর পছন্দ করে কেন? কি করে একজন অচেনা মানুষের বন্ধু হয়ে যায় কোনো কুকুর? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে গবেষণা প্রয়োজন নেড়িদের ওপর, ভালো জাতের পোষা কুকুর এই ধাঁধার উত্তরে পৌঁছে দেবে না আমাদের। এই সহজ কথাটা আজ মেনে নিয়েছেন পাশ্চাত্যের অনেক বিজ্ঞানী, এবং দৃষ্টি পড়েছে গরীব দেশের নেড়িদের ওপরে। উত্তর এখনো মেলেনি বটে, তবে একটা বড় jigsaw puzzle -এর কিছু ছোট ছোট অংশ মিলেছে যেন, একটু একটু করে ফুটে উঠছে একটা ছবি। 

হয়তো ইতিহাসটা এরকম ছিল

একটু চোখ বন্ধ করে ভাবা যাক, আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগে, কোনো এক জঙ্গলের প্রান্তে, আগুনের ধারে গোল হয়ে বসে রয়েছে একদল মানুষ, খেতে ব্যাস্ত তারা। আজ একটা বড় শিকার হয়েছে, সবার পেট ভরছে। বাচ্চাগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে মায়েদের কোলের কাছে। খেতে খেতে কথা বলছে বড়রা, হাড়গুলো ছুঁড়ে ফেলছে আশেপাশে। আলোর বৃত্তের বাইরে কয়েক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছে। ঘাপটি মেরে বসে আছে কয়েকটা নেকড়ে। মানুষদের ছুঁড়ে ফেলা হাড়গুলো নিঃশব্দে তুলে নিচ্ছে তারা, গুটি গুটি এগিয়ে আসছে আর একটু কাছে। বেশি কাছে যাবে না তারা, দেখতে পেলেই তাড়া করবে দুপেয়েরা, এমনকি মেরেও ফেলতে পারে তাদের। যখন দলের সঙ্গে থাকে এই নেকড়েরা, তখন দুপেয়েদের ভয় পায় না, কিন্তু একা একা খাবারের খোঁজে বের হলে সাবধানে থাকতে হয়, আড়ালে থেকে টুক করে তুলে নিতে হয় খাবারের টুকরো, ভুলেও শিকার করার চেষ্টা করতে নেই।  এদিকে দলের সঙ্গে যখন শিকার করে, বড় শিকার না পেলে প্রায় কিছুই জোটে না কপালে, পালের মধ্যেকার শ্রেণীবিভাগে তাদের জায়গা যে একদম তলার দিকে!

খিদের চোটে খাবার খুঁজতে বের হয় নেকড়ের পালের “হেরোরা” (subordinates), আর মানুষের দলের আশেপাশে ঘুরে বেড়ালে সহজেই পেয়ে যায় উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়, চামড়া, ইত্যাদি। এই সজলভ্য খাবারের লোভে হয়ত কোনো কোনো নেকড়ে দলছুট হয়ে বেরিয়ে পড়ে নতুন পথে, মানুষের পেছন পেছন চলে যায় এশিয়া থেকে ইওরোপ। এই চলার পথে কেউ মারা পড়ে মানুষের হাতে, কারো সঙ্গে ভাব হয়ে যায় কোনো মানুষের। গুহার ভেতরে দুপেয়েরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, বাইরে বসে থাকা নেকড়েরা অজান্তেই হয়ে ওঠে পাহারাদার। কোনো বুদ্ধিমান দুপেয়ে হয়ত টের পায় এই চারপেয়েদের সঙ্গে রাখার সুবিধে, এক আধ টুকরো খাবার ছুঁড়ে দেয় তাদের দিকে খেয়াল করে, শুরু হয় পোষ মানা। এই পোষ মানা হয়ত এক তরফা নয়, দুই পক্ষই পোষ মানিয়েছে একে অপরকে, যার ফলে কয়েক হাজার বছরে কুকুর ও মানুষের মধ্যে ঘটেছে সহ-বিবর্তন (co -evolution)।

এই অদ্ভুত পোষ মানা-মানির ফলে কুকুর ও মানুষের যে সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, তার দ্বিতীয় কোনো নিদর্শন নেই। এই সম্পর্ক বুঝতে জানতে হবে নেড়িদের, বুঝতে হবে তাদের দৈনন্দিন জীবন, মানুষের সঙ্গে তাদের মেলামেশা, ভাব-ভালোবাসা। বিজ্ঞানের মূল ধারা পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণে চললেও, এই বিষয়ে দিশারী হতে পারে ভারতের মত অনুন্নত দেশ, যেখানে নেড়িদের মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান অতি স্বাভাবিক, এবং এভাবেই চলে এসেছে সেই সরমার সময় থেকে। অতএব, বিজ্ঞানের চোখে দেখলে, ভারতীয় উপমহাদেশের সারমেয়কূল অতি প্রাচীনকাল থেকে হয়ত একটি continuous population, অর্থাৎ বহু প্রজন্ম ধরে এরা একইভাবে বাস করে চলেছে। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে মানুষের পারিপার্শিক, জীবনযাত্রা, বদলেছে জীবনদর্শন, আচার ব্যবহার, এবং এই সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে এই নেড়িরা।        

টিকা:

পোষা কুকুরের বিবর্তনের পিছনে মানুষের হাত কতটা?

এখনকার দিনে বাজারে hybrid শব্দটা খুবই প্রচলিত, এবং অপ্রিয়। অথচ মানুষ কয়েক হাজার বছর ধরে হাইব্রিড বা দো-আঁশলা পশু ও উদ্ভিদ সৃষ্টি করে এসেছে, কখনো প্রয়োজনে, কখনো দৈবাৎ, আবার কখনো খেলাচ্ছলে।  আমাদের বেশীর ভাগ খাদ্যশস্য, সবজি, ফল, এমনকি শৌখিন সব ফুল আসলে হয়  হাইব্রিড, আর নাহলে  নির্বাচনী প্রজননের ফল।  দুটি আলাদা প্ৰজাতির প্রাণীর মিলন ঘটিয়ে যে প্রাণী তৈরী করা হয়, তাকে বলা হয় বর্ণশঙ্কর বা হাইব্রিড। মানুষের হাতে তৈরী এমনই এক প্রাণী হল খচ্চর, যার মা ঘোড়া আর বাবা গাধা। সমস্যা হল, প্রকৃতিকে নিয়ে মানুষ খেললেও প্রকৃতি শেষে টেক্কা দিয়ে দেয় নানাভাবে। বর্ণশঙ্কর প্রাণীরা সাধারনতঃ প্রজনন অক্ষম হয়, সুতরাং মানুষ ঘোড়া আর গাধাকে মিলিয়ে খচ্চর তৈরী করলেও, সেই খচ্চর সন্তানের জন্ম দিতে পারে না।  আর্টিফিশিয়াল সিলেকশনে ব্যবহৃত হয় একই প্রজাতির প্রাণী, যাদের কিছু বৈশিষ্ট আলাদা; এই পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য একটাই, নানা বৈশিষ্ট মিলিয়ে আমরা ঠিক যেমন চাই, তেমন একটি জীব তৈরী করা। এই পদ্ধতিতে তৈরী প্রাণীরা অনেক সময় উদ্ভট হতে পারে, কিন্তু সাধারনতঃ প্ৰজননক্ষম হয়।  জার্সি গরু, আরবি ঘোড়া, নানান ব্রীডের কুকুরের  এভাবেই জন্ম হয়েছে মানুষের হাতে । প্রকৃতি সাধারণত বৈচিত্রময়, আর আর্টিফিশিয়াল সিলেকশনের উদ্দেশ্য সেই বৈচিত্র কমান। সুতরাং কয়েক হাজার বছরের আর্টিফিশিয়াল সিলেকশনের ফল যেসব কুকুরের ব্রীড, তাদের জিনগত  বৈচিত্র কম না হলেই আশ্চর্য্য হতে হত। 

তথ্যসূত্র:

  1. [১] Degerbøl, M. (1961). On a find of a Preboreal domestic dog (Canis familiaris L.) from Star Carr, Yorkshire, with remarks on other Mesolithic dogs. Proceedings of the Prehistoric Society, 27, 35-55.
  2. [২] Davis, Simon & R. VALLA, (1978). Evidence for domestication of the dog 12,000 years ago in the Natufian of Israel. Nature. 276. 608-610.
  3. [৩] Carles Vilà, Peter Savolainen, Jesús E. Maldonado, Isabel R. Amorim, John E. Rice, Rodney L. Honeycutt, Keith A. Crandall, Joakim Lundeberg, Robert K. Wayne. (1997) Multiple and ancient origins of the domestic dog. Science. 276 (5319). 1687-1689.
  4. [৪] Savolainen P1, Zhang YP, Luo J, Lundeberg J, Leitner T. (2002) Genetic evidence for an East Asian origin of domestic dogs. Science. 298 (5598). 1610-1613.
  5. [৫] Pang, J., Klütsch, C.F., Zou, X., Zhang, A., Luo, L., Angleby, H., Ardalan, A., Ekström, C., Sköllermo, A., Lundeberg, J., Matsumura, S., Leitner, T., Zhang, Y., & Savolainen, P. (2009). mtDNA Data Indicate a Single Origin for Dogs South of Yangtze River, Less Than 16,300 Years Ago, from Numerous Wolves. Molecular biology and evolution. 26 (12). 2849-2864.
  6. [৬] Adam R. Boyko, Ryan H. Boyko, Corin M. Boyko, Heidi G. Parker, MartaCastelhano, Liz Corey, Jeremiah D. Degenhardt, Adam Auton, MariusHedimbi, Robert Kityo, Elaine A. Ostrander, Jeffrey Schoenebeck, Rory J.Todhunter, Paul Jones, Carlos D. Bustamante. (2009). Complex population structure in African village dogs and its implications for inferring dog domestication history. Proceedings of the National Academy of Sciences. 106 (33). 13903-13908.
  7. [৭] Robert Wayne et al. Complete Mitochondrial Genomes of Anicent Canids Suggest a European Origin of Domestic Dogs. (2013). Science. 342 (6160). 871-874.
  8. [৮] Greger Larsen et al. Rethinking dog domestication by integrating genetics, archeology and biogeography. (2012). Proceedings of the National Academy of Sciences. 109 (23). 8878-8883.
  9. [৯] Nikolai D. Ovodov, Susan J. Crockford, Yaroslav V. Kuzmin, Thomas F. G. Higham, Gregory W. L. Hodgins, Johannes van der Plicht. (2011). A 33,000-Year-Old Incipient Dog from the Altai Mountains of Siberia: Evidence of the Earliest Domestication Disrupted by the Last Glacial Maximum. PLOS ONE. https://doi.org/10.1371/journal.pone.0022821
  10. [১০] Anna S. Druzhkova, Olaf Thalmann, Vladimir A. Trifonov, Jennifer A. Leonard, Nadezhda V. Vorobieva, Nikolai D. Ovodov, Alexander S. Graphodatsky, Robert K. Wayne. (2013). Ancient DNA Analysis Affirms the Canid from Altai as a Primitive Dog. PLOS ONE. https://doi.org/10.1371/journal.pone.0057754
  11. [১১] Adam Boyko et al, (2015). Genetic structure in village dogs reveals a Central Asian domestication origin.Proceedings of the National Academy of Sciences. 112 (44). 13639-13644.
  12. [১২] Laurent A.F. Franz et al (2016). Genomic and archaeological evidence suggest a dual origin of domestic dogs. Science. 352 (6920). 1228-1231.
  13. [১৩] Krishna Veeramah et al (2017). Ancient European dog genomes reveal continuity since the Early Neolithic. Nature Communications. 8 (16082).
  14. [১৪] Erik Axelsson, Abhirami Ratnakumar, Maja-Louise Arendt, Khurram Maqbool,  Matthew T. Webster, Michele Perloski, Olof Liberg, Jon M. Arnemo, Åke Hedhammar & Kerstin Lindblad-Toh. (2013).The genomic signature of dog domestication reveals adaptation to a starch-rich diet. Nature. 495. 360–364. [১৫] Amanda L. Pendleton, Feichen Shen, Angela M. Taravella, Sarah Emery, Krishna R. Veeramah, Adam R. Boyko and Jeffrey M. Kidd. (2018). Comparison of village dog and wolf genomes highlights the role of the neural crest in dog domestication. BMC Biology. 16 (64)

The post কুকুর কাহিনী appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).


নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর অঙ্ক কেমন দেখতে

$
0
0

মানুষের মস্তিষ্ককে অনুকরণ করার একটা ক্ষীণ প্রয়াস নিউরাল নেটওয়ার্ক। সেই নিউরাল নেটওয়ার্ক আসলে কেমন দেখতে? কি করা যায় তার মাধ্যমে?


কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়ের কাছে আমাদের বাঙালিদের ঋণের শেষ নেই। শুধু কালজয়ী চলচ্চিত্রেই সেই ঋণের ঝুলি শেষ হয়না। বইয়ে ঠাসা বাঙালি গৃহস্থালীতে  বড় হতে হতে আমাদের ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিচয় ঘটে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই। কেন, প্রফেসর শঙ্কু-র গল্পের রোবু বা বিধুশেখর যখন প্রায় মানুষের মতো আচরণ করে, সেটাও একরকম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বৈকি!

একদিক দিয়ে দেখলে, প্রফেসর শঙ্কুর মিষ্টি রোবোটগুলোর সাথে আমাদের প্রথম আলাপ হয়ে ভালোই হয়েছে। নইলে আইজ্যাক অ্যাসিমভ-এর রোবোটিক্স-এর তিন তত্ত্বের সামনে পড়লে রোবটের দুনিয়াদখলের সম্ভাবনায় ভীত হয়ে থাকতে হতো [১]। তবে, এই ২০১৯-এও মিষ্টি-স্বৈরাচারী কোনো রোবট-ই কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে আসেনি। কিন্তু গত পাঁচ-ছ বছরে এক নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তনের কথাই আমরা এই লেখায় বোঝার চেষ্টা করবো।

প্রথমেই একটা স্বীকারোক্তি। হালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছে, সেই নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানারকমের মত রয়েছে। সবাই একইরকম আশাবাদী নয়। এবং আমি যা বলতে চলেছি, সেটাও একেবারে নিরপেক্ষ হবেনা। তাতে আমার নিজের গবেষণার কিছুটা ছায়া হয়তো পড়বে।

নিউরাল নেটওয়ার্কএর প্রভাব সর্বত্র

পাঠকের অনেকেই হয়তো শুনেছেন, সম্প্রতি AlphaZero-র মতো তথাকথিত যন্ত্র দাবার মতো খেলায় সবরকম রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। এমন সব ছকের সন্ধান পাওয়া গেছে যা দাবার ইতিহাসে আজ অব্দি কেউ দেখেনি। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, এই ধরণের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একেবারেই প্রফেসর শঙ্কুর রোবটের মতো নয়। একসাথে বিভিন্ন রকমের মেধা এরা দেখতে পারেনা।

তবে মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে কোনো একটা সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে বিচার করলে যন্ত্রের সাথে তফাৎ করা দায় হয়ে ওঠে। দাবা কিংবা পোকার-এর মতো খেলায় হাজার হিসেবনিকেশ করে চাল দিতে হবে? যন্ত্রও পারে। ভ্যান গো-র স্টাইল অনুকরণ করে ছবি আঁকতে হবে? এটাও যন্ত্র পারে। পটাপট একটা ভাষা থেকে আরেকটাতে অনুবাদ করতে হবে? এখানেও যন্ত্র জাঁকিয়ে বসেছে। গত কয়েক বছরে সবই অটোমেশন-এর আওতায় চলে এসেছে। যাকে বলে ‘ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক’ বা ‘DNN’ বা ‘নিউরাল নেটওয়ার্ক’ বা ‘নিউরাল নেটস’ বা মাঝেমাঝে শুধুই ‘নেটস’ (nets), এর গণনাশক্তিকে হাতের মুঠোয় এনে তবেই এই চমৎকার সম্ভব হয়েছে। যেভাবে একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক-কে “ট্রেন” করে একদম মানুষের মতো কাজ করানো যায়, তাকেই বলে “ডিপ লার্নিং” (deep learning)।

নিউরাল নেটওয়ার্ক নিয়ে নিজে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাইলে

নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর এইসব চোখধাঁধানো কেরামতি দেখতে TensorFlow কিংবা PyTorch-এর মতো সফটওয়্যার বিনামূল্যে নিজের কম্পিউটার-এই বসানো যায়। এইসব সফটওয়্যার-এর স্রষ্টারা ক্রমশ চেষ্টা করছেন যাতে আরো বেশী লোকে চটপট হাত পাকিয়ে এইসব প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে পারেন। এর ফলে Google Colab-এর মতো প্ল্যাটফর্ম তৈরী হয়েছে যেখানে সরাসরি কোড লিখে ছোটোখাটো নিউরাল নেটওয়ার্ক চালানো যায়। একটা গোটা জবরজং সফটওয়্যার নিজের কম্পিউটার-এ বসাতে হয়না।

আপাতত ডিপ লার্নিং নিয়ে উৎসাহ আনতে চাইলে এই ওয়েবসাইট-টাতে ঘুরে আসতে পারেন: https://thispersondoesnotexist.com/। পাতাটা যতবার রিফ্রেশ করা হবে, একটা আপাত মানুষের ছবি দেখতে পাবেন, হয়তো মাঝেমধ্যে একটু খুঁত সমেত। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবেন না, কৃত্রিমভাবে নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর মাধ্যমে প্রত্যেকটা ছবির জন্ম হয়েছে! অন্যভাবে বললে, এই মানুষগুলো সম্পূর্ণরূপে ওই নেটওয়ার্ক-এর কল্পনার রাজ্যের বাসিন্দা, বাস্তবে এদের কোনো অস্তিত্বই নেই!

নিউরাল নেটএর ম্যাজিকএর আড়ালে কি হচ্ছে

কিভাবে একটা নেটওয়ার্ক এরকম জলজ্যান্ত মানুষের ছবি এঁকে ফেললো? কিভাবে, সেটা আমরা খুব ভালো বুঝিনা। যতটা অংশ বোধগম্য, তার নাগাল পেতেই গণিতের একটা উচ্চতর শাখার আশ্রয় নিতে হয়, তার নাম ‘অপটিমাল ট্রান্সপোর্ট’ (optimal transport)। এই শাখাতেই গবেষণা করে ২০১০-এ সেড্রিক ভিলানি ফিল্ডস মেডেল পেয়েছিলেন (অঙ্কের জগতে নোবেল-এর সামিল)। নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর জগৎটাকে এই অজানা-অচেনা গণিতের প্রয়োগশালা হিসেবে ভাবা যেতে পারে। কিন্তু আমরা সবে এই গণিতে বুড়িছোঁয়া ছুঁয়েছি মাত্র।

আশা করছি কোনো একদিন এই জটিল শাখাটির ওপরও আলোকপাত করতে পারবো। কিন্তু এই লেখায় শুধু নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর একদম গোড়ার গাণিতিক কাঠামোটা নিয়েই আলোচনা করবো।

কাজ যে করছে সেটা বুঝবো কিকরে

নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর যে উন্নতিগুলোর কথা আগে বললাম, সেগুলো প্রয়োগের দিক থেকে একদম তাজা তাজা কালকের গবেষণা। কিন্তু নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর কোনো তত্ত্ব যাচাই করতে এগুলো ব্যবহার করা হয়না। কোনো তত্ত্বের সাফল্য মাপতে আমরা কয়েক দশক পুরোনো কিছু স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা করে থাকি। বাজারে কোনো নতুন তত্ত্ব এলেও এই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যায়।

এক ধরণের পরীক্ষাতে একগোছা ছবি নিয়ে কোনো একটা অর্থবহ বিভাগে ভাগ করা হয়। এখানে ছবি বলতে ভিতরে ভিতরে একটা বহুমাত্রিক ভেক্টরের কথা বলা হচ্ছে (ছবির কোথায় কি রং, সেটা সংখ্যায় প্রকাশ করলে, যে সংখ্যার ম্যাট্রিক্স পাওয়া যায়, তার কথাই বলা হচ্ছে এখানে)। নিউরাল নেটওয়ার্ক (বা যে যন্ত্রকে নিউরাল নেটওয়ার্ক হিসেবে ভাবা হচ্ছে) সেইসব ভেক্টরে সমৃদ্ধ হয়ে ছবিগুলোর একটা বিভাগ স্থির করবে। এরপর নতুন কোনো ছবি এলে কোন ভাগে পড়বে সেটাও বলে দেবে এই নেটওয়ার্ক।

তুলনা করুন একটা ন’মাসের শিশুর সাথে যে অবলীলায় কোনো রোজকার সামগ্রীকে তার ছবির সাথে মেলাতে পারে। এই ন’মাসের শিশুর কাছে নিউরাল নেটওয়ার্ক হেরে ভূত! শিশু একটিবার একখান ফল দেখেই পরের বার ফলটা চিনতে প্রস্তুত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক-কে অনেক অনেক ছবি দেখিয়ে তবেই সেই পর্যায়ের প্রস্তুতি দেওয়া যায়। কেন এই আকাশপাতাল তফাৎ? সেটাও রহস্য, গবেষণা সবেমাত্র চালু হয়েছে এবিষয়ে।

দুটো ছবির ভান্ডার বিশেষ করে এই পরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এরা হলো:

[১] CIFAR ডেটাবেস। CIFAR-এর পুরো কথাটা Canadian Institute For Advanced Research [২]।

[২] MNIST ডেটাবেস। MNIST-এর পুরো কথাটা Modified National Institute of Standards and Technology [৩]।

প্রথমটাতে অর্থাৎ CIFAR ডেটাবেস-এ লক্ষ লক্ষ অল্প রিসোলিউশন-এর ছবি রয়েছে, হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত। যেমন, পাখি, এরোপ্লেন, গাড়ি, ইত্যাদি। এই ছবির ভান্ডার থেকে যে কোনো একটা ছবি দেওয়া হলে তাকে সঠিক ভাগে ফেলতে হবে। সেটাই নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর সাফল্যের মাপকাঠি। নিচের ছবিতে MNIST সংগ্রহের একটা অংশ দেওয়া হলো। এটা আর কিছুই না, ০ থেকে ৯ অব্দি হাতে লেখা সংখ্যার সংগ্রহ। নিউরাল নেটওয়ার্ক-কে একবার প্রস্তুত করা হলে ওই সংগ্রহের মধ্যে থেকে যে কোনো একটা সংখ্যা দিলে তাকে চিনতে পারার কথা। আজও আমরা এই MNIST-কেই নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর ন্যূনতম পরীক্ষা হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। আর কিছু পরীক্ষা পারুক না পারুক, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এখানে বলে রাখি, MNIST-এর বাংলা সংস্করণ-ও পাওয়া যায় কিন্তু!

MNIST ডেটাবেস-এর একটি অংশ

একটা লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, CIFAR-ভিত্তিক পরীক্ষাটা অর্থাৎ ছবির বিভাগ নির্ণয় কিন্তু MNIST-ভিত্তিক পরীক্ষা অর্থাৎ হাতে লেখা সংখ্যা চেনার থেকে অনেক বেশি শক্ত। কিন্তু অঙ্কের দিক থেকে কেন একটা আরেকটার থেকে বেশি শক্ত হবে, সেটা এখনো অজানা। একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর কাছে কখন যে কাজটা সরল আর কখন শক্ত, এই সারল্যের তারতম্যটাও গবেষকদের কাছে রহস্য। এবিষয়ে সবেমাত্র গবেষণা চালু হয়েছে। একটা আশাব্যঞ্জক গবেষণার দিশা হলো, “t-SNE” (“t-distributed Stochastic Neighbor Embedding”) বলে একটা পদ্ধতির গাণিতিক সুতোর জট ছাড়ানোর। তবে এই নিয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না। উৎসাহী পাঠক এবিষয়ে আরো ঘেঁটে দেখতে পারেন।

আপাতত নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর প্রয়োগ আর পরীক্ষা পেরিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর আরো গভীরে যাওয়া যাক: ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক বা DNN।

নিউরাল নেটওয়ার্কএর খুব সংক্ষিপ্ত একটা ইতিহাস

সেই ১৯৫৮-এ কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মনস্তত্ত্ববিদ ফ্র্যাঙ্ক রোজেনব্ল্যাট একটা গবেষণাপত্রে DNN-এর ধারণাটা দিয়েছিলেন, তবে থেকে ধারণাটা কোনো না কোনো আকারে টিকে গেছে। উনি নাম দিয়েছিলেন ‘পারসেপট্রন’ (perceptron)। তবে অনেকে বলবেন, নিউরাল নেটওয়ার্ক সম্বন্ধে আধুনিক চিন্তাধারা এসেছে ১৯৮৬-এর একটা গবেষণাপত্র থেকে, নাম তার “Learning representations by back-propagating errors” [৪]। এর লেখকদের মধ্যে Geoffrey Hinton-কে ডিপ লার্নিং-এর পথিকৃৎ হিসেবে ভাবা হয় এবং মজার বিষয় হলো, এনার আন্ডারগ্রাজুয়েট পড়াশোনাও মনস্তত্ত্ববিদ্যা নিয়ে!

কিন্তু নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর ধারণা থাকলে কি হবে, বাস্তবে যা করা যেত, তা খুবই সীমিত। এই সময়টাকে বলা হতো AI winter বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শীতাবস্থা। এই দীর্ঘ শীতে পরিত্রাতা হয়ে এলো কম্পিউটার হার্ডওয়্যার। হঠাৎই অনেক অভাবনীয় গণনা হার্ডওয়্যার-এর অসম্ভব উন্নতির সৌজন্যে হাতের নাগালের মধ্যে চলে এলো। ২০১২-র একটি গবেষণাপত্র, যার নাম “ImageNet Classification with Deep Convolutional Neural Networks”, তাতে লেখকরা দেখালেন যে একটা ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর পক্ষে ছবি চেনা ও তার অর্থবহ বিভাজন সম্ভব [৫]। প্রায় মানুষের মতোই নিখুঁতভাবে! অনেকে বলেন এই গবেষণাপত্রটিই আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের সূচনা করেছিল।

নিউরাল নেটওয়ার্ক কেমন দেখতে

এবার বোঝার চেষ্টা করা যাক, গাণিতিকভাবে একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক কেমন দেখতে হয়। DNN-কে এক অর্থে গাণিতিক সার্কিট বলা যায়। এরা আদতে এক ধরণের ফাঙ্কশন (function) বা অপেক্ষক যাদের তড়িত্প্রবাহী সার্কিটের মতো সার্কিট দিয়ে আঁকা যায়। খালি এই সার্কিটগুলো তড়িতের পরিবর্তে অঙ্ক কষার নির্দেশ বহন করে। সার্কিটে যে সংখ্যাগুলো প্রবেশ করলো (input), তাদের উপর গুণ বা যোগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নির্দেশ। নিচের ছবিতে যেমন X_1, X_2, X_3  তিনটে সংখ্যা প্রবেশ করে বাহুগুলো দিয়ে গেলে W_1X_1 + W_2X_2 + W_3X_3 সংখ্যাটা দেয়।

একটা তড়িৎপ্রবাহী সার্কিটকে দিয়ে কাজের কাজ করাতে গেলে তাতে আরো জটিলতা আনতে হয়: রেজিস্টর, ইন্ডাক্টর কিম্বা ক্যাপাসিটর বসাতে হয়। সেইরকমই, এইসব গাণিতিক সার্কিটেও যোগ-গুণ  প্রক্রিয়ার পর সংখ্যাগুলো একপ্রকার গেট-এর মধ্যে দিয়ে যায়। গেট-টা সাধারণত একটা নন-লিনিয়ার অপেক্ষক হয় [৬]। উপরের ছবিতে একে f(W_1X_1 + W_2X_2 + W_3X_3) বা f(\displaystyle\sum_{i=1}^{n}W_iX_i) চিহ্নের সাহায্যে দেখানো হয়েছে। এই ছবিটা নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর একটা সরলতম উদাহরণ।

এই বিষয়ে যারা চর্চা করেন, তাদের কাছে এই :

f : {\Bbb R} \rightarrow {\Bbb R}

(অর্থাৎ একটা বাস্তব সংখ্যা দিলে আরেকটা আসে), এইটাকে বলে অ্যাকটিভেশন ফাঙ্কশন (activation function)। যেটা ইনপুট হিসেবে একটা ত্রিমাত্রিক ভেক্টর-এর লিনিয়ার কম্বিনেশন (অর্থাৎ তিনটে বাস্তব সংখ্যা-এর লিনিয়ার কম্বিনেশন) নেয় এবং আউটপুট হিসেবে f(W_1X_1 + W_2X_2 + W_3X_3) দেয়। যে তিনটে বাস্তব সংখ্যা W_1, W_2, W_3 দিয়ে ইনপুট সংখ্যাগুলোকে গুণ করা হলো, তাদের বলে ওজন বা ওয়েইট (weight)। এখানে গেট থেকে একটাই বহির্মুখ বাহু রয়েছে। সাধারণত অনেকগুলো থাকে এবং তার অর্থ হলো, সবকটা বাহুতেই একই সংখ্যা পাচার হচ্ছে, গন্তব্যস্থল আলাদা।

একটা সহজ উদাহরণ

এখন একাধারে সবাই মেনে নিয়েছেন যে অ্যাকটিভেশন ফাঙ্কশন হিসেবে ReLU বা Rectified Linear Unit অপেক্ষকটির তুলনা হয়না। অপেক্ষকটি এইরকম:

{\text{ReLU} : {\Bbb R} \rightarrow {\Bbb R}}\\{x \hspace{2mm} \rightarrow \hspace{2mm}  \max(0,x) }

অর্থাৎ, একটা সংখ্যা ধনাত্মক হলে সংখ্যাটাই পাওয়া যাবে আর ঋণাত্মক হলে শূন্য পাওয়া যাবে।

নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর সার্কিট-এ কি কি থাকে, সেগুলো দেখলাম। এবার দেখা যাক এই টুকরোগুলো জুড়ে একটা নিউরাল নেটওয়ার্ক কিভাবে বানানো যায়। নেটওয়ার্ক-টার শেষে খুব পরিচিত একটা অপেক্ষককেই পাবো। উদ্দেশ্য এইটা দেখানো, কিভাবে সেই পরিচিত অপেক্ষকটা নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর জালের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে।

উপরে যে ছবিটা দেখছি, সেটা একটা 1-DNN-এর উদাহরণ। শুরুর ইনপুট আর শেষের আউটপুট-এর মাঝে একটাই স্তর, তাই 1-DNN। এই নিউরাল নেটওয়ার্ক-টার “সাইজ” হলো চার, যেহেতু মাঝে চারটে গেট আছে। প্রত্যেকটা বাহুতে ওজনটাও ছবিতেই দেওয়া আছে। প্রত্যেকটা গেট-এই অ্যাকটিভেশন ফাঙ্কশন উপরে বর্ণিত \text{ReLU} অপেক্ষক। দাবি হলো এই যে নেটওয়ার্ক-এর মধ্যে দিয়ে গেলে ইনপুট সংখ্যা দুটোর মধ্যে বৃহত্তর সংখ্যাটা বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ,  \max(x_1, x_2)

বিশ্বাস হচ্ছে না? অঙ্কটা কষে দেখুন।  প্রথমে লক্ষ্য করুন, মাঝের স্তরে সবথেকে উপরের গেট-টাতে বাহুর ওজনগুলো ধরলে যে সংখ্যাটা যাচ্ছে, সেটা  x_1 + x_2। আর ওই গেট-টা থেকে গন্তব্যে যে সংখ্যাটা যাচ্ছে, সেটা (আবার বাহুর ওজন ধরলে)  \frac {1}{2} \max\{0, x_1 + x_2\}। গন্তব্যে সবকটা বাহু থেকে আসা সংখ্যা যোগ হয়। তাতেই সুরসুর করে বেরিয়ে আসে যে নেটওয়ার্ক-টা তার দুটো ইনপুটের বৃহত্তর সংখ্যাটা ফেরত দিচ্ছে।

দুটো বিশেষ সংখ্যা নিয়ে দেখতে পারেন। ধরুন,  x_1 = 2 আর x_2 = 5 । তাহলে নীল গেটগুলোতে উপর থেকে নিচে দেখলে প্রবেশ করছে 7, -7, 3 আর  -3 । গেটগুলো লাল গন্তব্যস্থলে পাঠাচ্ছে এই চারটে সংখ্যা:  \frac {7}{2} , - \frac {1}{2} \max\{0, -7\} = 0 ,  \frac {1}{2}\max\{0, 3\} = \frac {3}{2} আর \frac {1}{2} \max\{0, -3\} = 0 । এদের যোগফল 5 , যেটা সত্যিই দুটো ইনপুট-এর মধ্যে বৃহত্তর সংখ্যাটা।

আরেকটু জটিল নেটওয়ার্ক

এটা ছিল একটা স্তর সমৃদ্ধ নিউরাল নেটওয়ার্ক। এতে দুটো সংখ্যার বৃহত্তরটাকে পাওয়া গেল। এই বিষয়ে আরো দখল আনতে চাইলে চারটে সংখ্যার মধ্যে বৃহত্তম সংখ্যাটাকে খুঁজতে দুটো স্তর-ওয়ালা কিম্বা পাঁচটা সংখ্যার মধ্যে খুঁজতে তিনটে স্তর-ওয়ালা নিউরাল নেট বানানোর চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আরেক ধাপ এগিয়ে দেখানোর চেষ্টা করতে পারেন যে n -খানা সংখ্যার বৃহত্তরটাকে গণনা করতে চাইলে নিউরাল নেট-এ \log (n) -খানা স্তর থাকলেই যথেষ্ট।

আমরা যারা নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর তত্ত্ব বা থিওরি নিয়ে মাথা ঘামাই, তাদের কাছে আরেকটি অপেক্ষক খুব গুরুত্বপূর্ণ:

f(x) = \max\{0, \frac {1}{\omega} - \frac {1}{\omega^2}|x-a|\}, \omega > 0 , a > 0

সহজেই দেখতে পারেন, এর মান শুধু [a - \omega , a + \omega]-এর মধ্যে ছাড়া সর্বত্র শূন্য। ওই পরিসরটুকুর মধ্যে অপেক্ষকটার মান একটা ত্রিভুজের মতো আকার ধারণ করে। ত্রিভুজের ডগাটা x -এর মান a হলে আসে। এই অপেক্ষকটাকে একটা স্তর-সমৃদ্ধ নিউরাল নেটওয়ার্ক দিয়েও লেখা যায়। চেষ্টা করো দেখুন। আরেকটু চাপ নিতে চাইলে একাধিক ত্রিভুজ আকারের অপেক্ষক-কেও নিউরাল নেট দিয়ে লিখতে পারেন। (খেয়াল করুন, এখানে ইনপুট হিসেবে কিন্তু একটাই সংখ্যা যাচ্ছে। একের বেশি সংখ্যা ইনপুট হলে এই ত্রিভুজাকার অপেক্ষকের সমতুল্য অপেক্ষকটা কেমন দেখতে হবে, সেটা একেবারেই স্পষ্ট নয়!)

এই যে দু’ধরণের অপেক্ষকের কথা বললাম, ইনপুট সংখ্যাগুলোর বৃহত্তরটা আর একটা ইনপুট সংখ্যার ওপর ত্রিভুজাকার অপেক্ষক, এদের সাহায্যেই আরো এমন জটিল অপেক্ষক তৈরী হয় যাদের নিউরাল নেটওয়ার্ক দিয়ে গণনা করা যায়। কিন্তু কটা স্তর লাগবে সেই নিউরাল নেট-এ, সেটা বার করা মোটেই সোজা নয়। পাঁচটা সংখ্যার বৃহত্তমটাকে বার করতে তিনটে স্তর লাগবেই না দুটোতেও চলবে, আমরা এখনো সেটা জানি না। এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছু ক্ষেত্রে খুব জটিল অঙ্ক ব্যবহার করতে হয়, কিছু ক্ষেত্রে তো এখনো গবেষণা চলছে।

নিউরাল নেটওয়ার্ক সমাধান করা

আরো একধাপ এগোলে, ছবি (diagram) বা “আর্কিটেকচার”-এর (architecture) শরণাপন্ন হতে হয়। নিচে সেইরকম একটা ছবি রইলো।  (যারা গ্রাফ থিওরি জানো, তারা ছবিটাকে একটা ডিরেক্টেড অ্যাসাইক্লিক গ্রাফ হিসেবে ভাবতে পারো যেখানে সব বাহুগুলো ডানদিকে নির্দেশ করছে।)

আগের সার্কিটের মতো এখানে বাহুগুলোতে কোনো ওজন দেওয়া নেই। তাহলে, এক অর্থে ছবিটা যত \Bbb R^4 \rightarrow \Bbb R^3  অপেক্ষককে গণনা করা যায় এই নেট-এর মাধ্যমে, একাধারে সব্বাইকে বোঝাচ্ছে। খালি অ্যাকটিভেশন ফাঙ্কশনটাকে স্থির রাখা হয়েছে ওই নীল রঙের নোড-গুলোতে, কিন্তু বাহুগুলোর ওপর ওজন যা ইচ্ছে হতে পারে। হলুদ নোড-গুলোতে চতুর্মাত্রিক ইনপুটগুলো আসবে আর কমলা নোড দিয়ে ত্রিমাত্রিক আউটপুট বেরোবে। প্রত্যেকটা বাহুর ওপরও ওজন হিসেবে একটার জায়গায় দুটো বাস্তব সংখ্যা ব্যবহার করা যায়। তারা যদি a আর b হয়, তাহলে এইভাবে বলা যায় যে বাহুতে x ইনপুট এলে (ax + b) আউটপুট পাওয়া যাবে।

অতএব এই নিউরাল নেট দিয়ে কোনো একটা অপেক্ষককে বোঝাতে হলে, যতগুলো বাহু আছে, তার দ্বিগুন ওজনকে নির্ণয় করতে হবে। আজকের দিনে কিছু বিশালকায় নেট-এ (যাদের “AmoebaNet-D” বলে), ছ’হাজার লক্ষ মতো এরম প্যারামিটার নির্ণয় করা যায়। তবে সেটা যে খুব বড়ো একটা সংখ্যা, এরকম ভেবে বসবেন না। মানবমস্তিষ্কে ছ’হাজার কোটি নিউরন রয়েছে এবং একেকটার দশ হাজার মতো সাইন্যাপ্টিক যোগাযোগ আছে অন্যান্য নিউরনের সাথে। আমরা সবচেয়ে শক্তিশালী যে নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের অনুকরণ করার চেষ্টা করছি, আসল মস্তিষ্কের দক্ষযজ্ঞের সামনে তাকে প্রায় শিশু বলা চলে!

এবার মোটামুটি নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর নকশাটা কিছুটা স্পষ্ট হলো। (একটা গূঢ় প্রশ্ন হলো: যেসব অপেক্ষককে এইরকম নিউরাল নেট-এর মাধ্যমে লেখা যায়, তাদের মধ্যে কতগুলো দ্রুত ওঠানামা করছে। অর্থাৎ, ওই ত্রিভুজাকার অপেক্ষকের মতোই, কিন্তু অনেক, অনেক ত্রিভুজ।)

পরের পরিচ্ছদের প্রিভিউ

এটা যাকে বলে হিমশৈলের মাথাটুকু। এরপর কি রয়েছে, তার একটা আভাস দেওয়া যাক। ডিপ লার্নিং এ যে কোন একটি সমস্যায় (ধরা যাক মেশিনকে দাবা খেলাতে ট্রেন করার প্রক্রিয়ায়)  “লস ফাংশান” খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ডিপ লার্নিং-এর সমস্যাটি সমাধান করা আখেরে কিছু বাস্তব অপেক্ষককে ক্রমাগত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করায় গিয়ে ঠেকে। এই বাস্তব অপেক্ষকটিই এখানে “লস ফাংশান”। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা গেছে যে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে যথেষ্ট দক্ষতা থাকলে লস ফাংশান সরাসরি লিখে ফেলা  সম্ভব। এই লস ফাংশান যে কোন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমস্যাকে একটি অপেক্ষক হিসেবে কল্পনা করে যা নিউরাল নেটস এর আউটপুটকে ধনাত্মক সংখ্যাতে রূপদানের চেষ্টা করে। আমাদের কাজ হল নিউরাল নেট-এর ওজন এবং অসংখ্য প্যারামিটার-কে বাড়িয়ে কমিয়ে এই লস ফাংশানকে ক্রমশ ছোট করে নিয়ে অভীষ্ট আসল লক্ষ্যে পৌঁছনো।  অর্থাৎ এক্ষেত্রে অনেক অনেক নিউরাল নেট গঠন পদ্ধতির মধ্যে যথাযথ গঠনটিকে বেছে নেওয়া ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু বেছে নেওয়াই নয়, কোন নিউরাল নেট গঠনের জন্য কোন লস ফাংশান জরুরি তা নির্ধারণ করাও সমান ভাবে গবেষণার দাবি রাখে। বর্তমানে এটি শিল্পের পর্যায় পৌঁছেছে এবং এ বিষয়ে গবেষণা সবেমাত্র শুরু হয়েছে।

মজার ব্যাপার হল,  নিউরাল নেট গঠনের সময়ে প্রকৃত লস ফাংশান নিয়ে সম্পূর্ণ ধারণা থাকেনা। এই ধরণের সমস্যা সাধারণত খুব জটিল হয়। কি খোঁজা হচ্ছে, সেই সবন্ধে একটা আধাখ্যাঁচড়া ধারণা নিয়ে শুরু করে তামাম অপেক্ষকদের মধ্যে প্রকৃত অপেক্ষকটাকে খুঁজে বার করতে হবে। এখান থেকেই এক নতুন গবেষণা শাখার জন্ম, যাকে বলা হয় “ স্টকাসটিক অপ্টিমাইজেশান” (stochastic optimization)। অন্য এক দিন নিউরাল নেট এ এই বিষয়টার প্রয়োগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। প্রত্যেকদিন বিভিন্ন গবেষণাপত্র নতুন করে এই বিষয়টার ওপর আলোকপাত করছে!

(প্রচ্ছদের ছবি: সূর্যকান্ত শাসমল)

(লেখাটি মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় ও শৌর্য সেনগুপ্ত।)

উৎসাহী পাঠকদের জন্য

[১] আইজ্যাক অ্যাসিমভ-এর রোবোটিক্স-এর তিনটে তত্ত্ব বা আইন হলো:

এক, একটা রোবট যেচে বা স্রেফ অনীহায় মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না।

দুই, একটা রোবট মানুষের বাধ্য হয়ে থাকবে, যদি না তাতে প্রথম তত্ত্বের সাথে ঠোকাঠুকি লাগে।

তিন, একটা রোবট নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সম্পূর্ণ চেষ্টা করবে যদি না তাতে প্রথম বা দ্বিতীয় তত্ত্বের লঙ্ঘন হয়।

এরকম তিনটে তত্ত্ব শুনলে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। মনে হতেই পারে, গল্পে দেওয়া এই তিনটে তত্ত্ব   বাস্তবে রোবট মানবে কেন!

[২] CIFAR ডেটাবেস-টা ২০০৯-এ তৈরী করেছিলেন Alex Krizhevsky, Vinod Nair এবং Geoffrey Hinton।

[৩] MNIST ডেটাবেস-টা ১৯৯৮-এর একটা যুগান্তকারী গবেষণপত্রে পেশ করেছিলেন এই বিষয়ের কিছু বাঘা বাঘা গবেষক: Y. LeCun, L. Bottou, Y. Bengio এবং P. Haffner। গবেষণাপত্রটির নাম “Gradient-Based Learning Applied to Document Recognition”।

[৪] ১৯৮৬-র “Learning representations by back-propagatin errors” গবেষণাপত্রটির লেখক David RumelHart, Ronald Williams এবং Geoffrey Hinton।

[৫] ২০১২-র “ImageNet Classification with Deep Convolutional Neural Networks” গবেষণাপত্রটির লেখক Alex Krizhevsky, Ilya Sutskever এবং Geoffrey Hinton।

[৬] একটা অপেক্ষক x  নন-লিনিয়ার হবে যদি এইটা সত্যি হয়: f(x_1 + x_2) \neq f(x_1) + f(x_2)

[৭] এই বিষয়ে একটা অত্যন্ত মুল্যবান বই হলো এইটা:  https://www.deeplearningbook.org/ । বইটা বিনামূল্যে সংগ্রহযোগ্য। এই বইটা পড়লে বিষয়ের একেবারে শিকড়ের কাছাকাছি পৌছনো যাবে। এর একজন লেখক হলেন ইয়ান গুডফেলো, যিনি নিউরাল নেট এবং আরটিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স এর একজন পথিকৃৎও বটে।

The post নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর অঙ্ক কেমন দেখতে appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

ব্যাকটেরিয়া বনাম অ্যান্টিবায়োটিক্স: এ লড়াইয়ের শেষ কোথায়?

$
0
0

ব্যাকটেরিয়া বনাম অ্যান্টিবায়োটিক্স, এই লড়াইয়ে এখন কে এগিয়ে? প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক্স-এর কার্যকারিতা হারালে ব্যাকটেরিয়াদের কিভাবে মোকাবিলা করা যায়?


প্যাসাডেনা, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে অবস্থিত পাহাড় ঘেরা সুন্দর সুসজ্জিত একটা ছোট্ট শহর। শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু নামকরা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। যেমন নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরি, কাভলি ন্যানোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। আর রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা সংক্ষেপে ক্যালটেক। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই পোস্ট ডক্টরাল গবেষক দেবনাথ ঘোষালের সঙ্গে প্যাসাডেনা শহরে আড্ডায় বসেছিল “বিজ্ঞান” এর পক্ষ থেকে ডঃ রাজীবুল ইসলাম।  সেই আড্ডাতেই উঠে এল ব্যাকটেরিয়া ও অ্যান্টিবায়োটিক্স উপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, গবেষনার দিক। সেই আড্ডার উপর ভিত্তি করে লেখাটি সাজিয়েছে দেবব্রত মাজী।

আমাদের চারদিকে রয়েছে লক্ষ  লক্ষ কোটি ব্যাকটেরিয়া। পৃথিবীতে এই এককোষী, আণুবীক্ষণিক অণুজীবের আবির্ভাব ঘটেছিলো মানুষ সৃষ্টিরও প্রায় কয়েকশ কোটি বছর আগে । কোথায় থাকে এরা?? হিমশীতল পর্বতের চূড়া থেকে শুরু করে সমুদ্রের গভীরতম বিন্দু ; সর্বত্রই  চলে এদের অবাধ বিচরণ। এমনকি আমার আপনার শরীরের ভেতরেও রয়েছে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া। সে সংখ্যাটা নেহাতই মন্দ নয় কিন্তু। ঠিক যতগুলো দেহকোষ রয়েছে আমাদের দেহে, তার থেকেও বেশি ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের দেহে। না না ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ব্যাকটেরিয়া মানেই যে অপকারী তা কিন্তু নয়। বরং এরা আমাদের শরীরে থেকে উপকারই করে। এরা একদিকে যেমন আমাদের দেহে খাদ্য হজমে সাহায্য করে, আবার অনাক্রমতা বা immunity গড়ে তুলে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাও করে। এছাড়াও এরা আমাদের শরীরে থেকে আমাদের স্বাভাবিক শরীর বৃত্তীয় প্রক্রিয়া বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।  কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের শরীরে কিছু অপকারী ব্যাকটেরিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটে। তারাই জ্বর থেকে শুরু করে প্লেগ, যক্ষা, কলেরা বা গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের মতো ভয়ঙ্কর সব রোগ ঘটায়। আমাদের লড়াইটা তাদের বিরুদ্ধেই । তাদের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক্স তৈরির লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ল্যাবরেটরিতে অসংখ্য বিজ্ঞানী নিরলস গবেষণা করে চলেছেন। আজকের আড্ডাতে আমরা সেই গবেষণার গল্পই শুনবো।

যাইহোক আড্ডার এর প্রসঙ্গে আসা যাক। ‘বিজ্ঞান’ টিম-এর ডঃ রাজীবুল ইসলাম প্রশ্ন করলেন গবেষক ডঃ দেবনাথ ঘোষালের উদ্যেশ্যে।

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : আমরা যখন ডাক্তারের কাছে যাই, তখন প্রায়শই দেখা যায়, ডাক্তারবাবুরা আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক্স খেতে বলেন। তো এই অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলো ঠিক কি করে?

দেবনাথ: আসলে বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক্স হয়। সব অ্যান্টিবায়োটিক্স একইরকম ভাবে কাজ করে না। তবে সবথেকে বেশি যে ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক্স আমরা ব্যবহার করি তা হলো পেনিসিলিন গোত্রের বিটা ল্যাক্টাম অ্যান্টিবায়োটিক্স। এর মূল কাজ হচ্ছে, ব্যাকটেরিয়াদের প্রতিরক্ষাবলয় তথা কোষ প্রাচীর গঠনে বাধা দিয়ে তা নষ্ট করে দেওয়া। ফলে তখন ব্যাকটেরিয়া কোষটি অভিস্রবনজনিত চাপ সহ্য করতে না পেরে মারা যায়।

তবে গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াদের ক্ষেত্রে কোষ প্রাচীরের বাইরেও কোষ পর্দার একটা আস্তরণ থাকায়,  ওদের কোষ প্রাচীরকে আক্রমণ করা বেশ কঠিন। আর যদিও বা অ্যান্টিবায়োটিক্স ওদের কোষ প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছেও যায়, তাকে ওরা এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন কমপ্লেক্সের মাধ্যমে নিজেদের কোষ থেকে বের করে দেয় (ইফ্ল্যাক্স পাম্প)। তাই গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াদের জন্য  রাইবোজম ইনহিবিটরস, ফোলেট সিন্থেসিস ইনহিবিটরস,  ট্রান্সক্রিপশন ইনহিবিটরস এই সব বিকল্প অ্যান্টিবায়োটিক্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে [৪]। এই অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলো ব্যাকটেরিয়া কোষের রাইবোজম থেকে প্রয়োজনীয় সব প্রোটিন উৎপাদনে বাধা দিয়ে ব্যাকটেরিয়া কোষের মৃত্যু ঘটায়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই রাইবোজম-এর গঠন ও  ইনহিবিটরস নিয়ে অসামান্য গবেষণার জন্যই কিন্তু 2009 সালে ভারতীয় বংশদ্ভূত বিজ্ঞানী ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণণ এবং আরও দুজন বিজ্ঞানী তথা থমাস স্টেইজ ও এডা ইওনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

রাইবোজম-এর গঠন ও  ইনহিবিটরস নিয়ে অসামান্য গবেষণার জন্যই কিন্তু 2009 সালে ভারতীয় বংশদ্ভূত বিজ্ঞানী ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণণ এবং আরও দুজন বিজ্ঞানী তথা থমাস স্টেইজ ও এডা ইওনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : বাহ! তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। এই সমস্ত অ্যান্টিবায়োটিক্স দিয়েই তো তাহলে সব ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলা যাবে। শরীর হবে রোগমুক্ত।

দেবনাথ: কিন্তু মুস্কিলটা অন্য জায়গায়। ধরো আমি ব্যাকটেরিয়াদের রাইবোজমটাকে আক্রমণ করে ব্যাকটেরিয়াগুলোকে নিকেষ করতে চাইছি। কিন্তু রাইবোজম তো শুধু ব্যাকটেরিয়াদের নেই। মানুষের দেহকোষেও রয়েছে রাইবোজম। সেক্ষেত্রে মানব দেহকোষেরও অল্পবিস্তর ক্ষতির সম্ভাবনা থেকেই যায়। আবার ব্যাকটেরিয়া নিজেরাও দিনের পর দিন আমাদের তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধেও দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। তাই আমাদের প্রতিনিয়ত আরও শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক্স বানিয়ে যেতেই হবে, সেই সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন মানুষের দেহের বিশেষ কোনো ক্ষতি না করে বসে। সুতরাং আমাদের এমন কিছুর ওপর আক্রমণ হানতে হবে, যা মূলতঃ ব্যাকটেরিয়াদের দেহকোষেই আছে। তাই মূলত টার্গেট করা হয়, ব্যাকটেরিয়াদের কোষ প্রাচীরকেই। কেননা আমাদের দেহকোষে কিন্তু কোষ প্রাচীর নেই। তবে এক্ষেত্রেও একটা সমস্যা রয়েছে। আমাদের দেহে উপস্থিত সমস্ত ব্যাকটেরিয়া তো আর অপকারী নয়। অসংখ্য উপকারী ব্যাকটেরিয়াও রয়েছে দেহে। কোষ প্রাচীরের উপর আক্রমণ করলে তারাও যে মারা যাবে! তবে একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখতে পাবে, আজকাল কিন্তু ডাক্তারবাবুরা অ্যান্টিবায়োটিক্স খাওয়ার পরে দই, প্রোবায়োটিক এইসব খেতে বলেন। এতে কি হয়, অন্ততঃ কয়েকটা শ্রেণীর উপকারী ব্যাকটেরিয়া পুনরায় আমাদের শরীরে সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়!। কিন্তু হলেও সেটা খুবই সামান্য।

ব্যাকটেরিয়া নিজেরাও দিনের পর দিন আমাদের তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধেও দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।  তাই আমাদের প্রতিনিয়ত আরও শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক্স বানিয়ে যেতেই হবে, সেই সঙ্গে এটাও  খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন মানুষের দেহের বিশেষ কোনো ক্ষতি না করে বসে।

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : তাহলে তোমার মতে এই সমস্যাগুলোর সমাধান কিভাবে করা যেতে পারে?

দেবনাথ: সবথেকে ভালো হয় যদি শুধুমাত্র অপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর জন্য পৃথক পৃথক ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক্স বানানো যায়। তবে তার জন্য পৃথকভাবে ওদের গঠন এবং রোগ বিস্তারের পদ্ধতিটা জানা খুব জরুরি। এ প্রসঙ্গে এইসব ব্যাকটেরিয়াতে উপস্থিত বিভিন্ন মলিকুলার মেশিনের কথাটা উল্লেখ করতেই হয়। অনেক বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন অপকারী ব্যাকটেরিয়া-র দল আমাদের শরীরের কোষগুলোকে আক্রমণ করার জন্য বেশ কয়েক রকমের ইনজেকশন মেশিন (বা সিক্রেশন সিস্টেম) তৈরী করে ফেলেছে। এইগুলোর মাধ্যমেই তারা আমাদের শরীরে নানারকমের ক্ষতিকারক টক্সিন ছড়িয়ে রোগব্যাধির জন্ম দেয়। শুধু তাই না, যদি কোনো ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক্স-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলে, তাহলে এইসব মেশিনের মাধ্যমে তারা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া-র মধ্যেও তা সঞ্চালন করতে পারে। ফলে একসময় যে সব অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলো খুব কার্যকরী ছিল তাদের কার্যক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে আর ব্যাকটেরিয়াগুলো মহানন্দে রোগ বিস্তার করতে শুরু করে।

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : তাই নাকি? ব্যাপারটা তো খুব রোমহর্ষক ঠেকছে।

দেবনাথ: হুম। সত্যিই তাই। অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধের ঘটনা প্রথম সামনে এসেছিলো সত্তরের দশক নাগাদ। দেখা গেল পাপুয়া নিউগিনির একটি গ্রামে এক রোগীর স্টেপটোকক্কাস নামের এক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ সারাতে গিয়ে প্রচলিত পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক্স আর কোনো কাজই করছে না। নব্বইয়ের দশকে এই প্রতিরোধের ঘটনা আরও অনেকগুলো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ক্ষেত্রে দেখা যেতে লাগলো। বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। কারণ খুঁজতে গিয়ে একদল বিজ্ঞানী দেখলেন, ওই ব্যাকটেরিয়াগুলো আসলে এতোদিনে পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক্সদের রুখতে বিশেষ ধরনের অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে যার নাম বিটা ল্যাক্টামেজ উৎসেচক। এই উৎসেচক হইড্রোলিসিস বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক্সদের প্রধান গঠনগত একক বিটা ল্যাক্টাম রিং-টাকেই ভেঙে দেয়। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলো পঙ্গু হয়ে যায়। আর কাজ করতে পারে না। আর যেসব ব্যাকটেরিয়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক্স-এর বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, তাদের বলা হয় “সুপার বাগ”।

আর এই পরিস্থিতে মলিকুলার মেশিন বা সিক্রেশন সিস্টেম-গুলোর ভূমিকা আরো ভয়ঙ্কর। ব্যাকটেরিয়া-রা এদের ব্যবহার করে একে ওপরের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের অ্যান্টিবায়োটিক্স প্রতিরোধ ক্ষমতাগুলোকে অন্য ব্যাকটেরিয়াদের দেহে সঞ্চালন করে দেয় । ফলে সুপার বাগ-এর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং সেই অ্যান্টিবায়োটিক্স-এর ব্যবহারযোগ্যতা ক্রমশই কমতে থাকে। এতোজনের বিরুদ্ধে ঐ  আর কতক্ষণই বা টিকে থাকতে পারে??

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : তাহলে উপায়??

দেবনাথ: উপায় হচ্ছে, এই সমস্ত সুপার বাগ-দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা। এই লড়াইয়ের অন্যতম একটা স্ট্র্যাটেজি হলো – ব্যাকটেরিয়া কোষের অন্তর্গত মলিকুলার মেশিন বা সিক্রেশন সিস্টেম -গুলোর গঠন ও কার্যপ্রণালী জেনে নিয়ে ওদের বিরুদ্ধে ড্রাগ নির্মাণ করা। তো এই মলিকুলার মেশিন বিশ্লেষণের আরেকটা মস্ত সুবিধা হচ্ছে এই মলিকুলার মেশিনের গঠন কিংবা কার্যপ্রণালী কিন্তু ব্যাকটেরিয়া ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। ফলে সহজেই ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াগুলোকে চিহ্নিত করাও যাবে আবার তাদের বিরুদ্ধে প্রতিষেধকও প্রস্তুত করা যাবে।

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : তো এখন এই মলিকুলার মেশিনের গঠন ও কার্যর্প্রণালী  কিভাবে বোঝা সম্ভব?

দেবনাথ: এই কাজটা দুটো উপায়ে করা যেতে পারে। প্রথমত একটা উপায় হচ্ছে – ব্যাকটেরিয়া কোষের অন্তর্গত মলিকুলার মেশিন বা সিক্রিশন সিস্টেমের উপাদানগুলোকে আলাদাভাবে কোষের বাইরে পরীক্ষানিরীক্ষা করে তাদের গঠন ও কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করা। কিন্তু সেক্ষেত্রে আবার তারা মিলেমিশে ঠিক কিভাবে কাজ করে সেটা জানা যায়না। তাই সবথেকে ভালো হয়, যদি তুমি ব্যাকটেরিয়া কোষ থেকে ঐ মেশিনটাকেই পুরোপুরি বের করে নিয়ে এসে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি বা ইলেকট্রন ক্রায়ো মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে তার সামগ্রিক গঠন বিশ্লেষণ করতে পারো। তবে কাজটা বেশ দুরূহ।

এছাড়াও একটা উপায় রয়েছে যা ইলেকট্রন – ক্রায়োটোমোগ্রাফী নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে “ভিট্রিফিকেশন”  পদ্ধতিতে ব্যাকটেরিয়া কোষের অন্তর্গত সমস্ত উপাদানকে গতিহীন করে দিয়ে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে কোষের মধ্যে থাকা  ব্যাকটেরিয়ার সিক্রিশন সিস্টেমের  সামগ্রিক  গঠন বিশ্লেষণ করা হয়। এই পদ্ধতিটাকে ইনসিটু স্ট্রাকচারাল বায়োলজি বলে। আমার গবেষণায় আমি মূলত এই কাজটাই করার চেষ্টা করছি।  প্রসঙ্গত বলে রাখি, কোষীয় উপাদানকে “গতিহীন” করে দেওয়ার ধারণাটা  কিন্তু বেশ মজার। আমরা যদি “ভিট্রিফিকেশন” পদ্ধতিতে কোনও ভাবে একজন মানুষের কোষীয় উপাদানগুলোকে খুব দ্রুত এভাবে “গতিহীন” করে দিই, তারপর দীর্ঘদিন পরে এমনকি কয়েক হাজার বছর পরেও  যদি ঐ “গতিহীন” অবস্থাটা তুলে নিই, তাহলে দেখতে পাবো, মানুষটা আবার ঠিক আগের অবস্থায় জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে, দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারছে। তবে হ্যাঁ, এটা তখনই সম্ভব যখন আমরা আমাদের সমস্ত কোষের মধ্যেকার জলের অণুকে ভিট্রিফিকেশন করতে পারবো অর্থাৎ জলের অণুগুলো নিশ্চল হয়ে যাবে কিন্তু বরফের মতো ত্রিমাত্রিক সজ্জায় সজ্জিত হবে না।

আমরা যদি “ভিট্রিফিকেশন” পদ্ধতিতে কোনও ভাবে একজন মানুষের কোষীয় উপাদানগুলোকে খুব দ্রুত এভাবে “গতিহীন” করে দিই, তারপর দীর্ঘদিন পরে এমনকি কয়েক হাজার বছর পরেও  যদি ঐ “গতিহীন” অবস্থাটা তুলে নিই, তাহলে দেখতে পাবো, মানুষটা আবার ঠিক আগের অবস্থায় জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে, দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারছে।

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : বাহ, এ তো কল্পবিজ্ঞান দেখছি। তো এই মলিকুলার মেশিনের গঠন ও কার্যকলাপ  নিয়ে  ঠিক কি ধরনের গবেষণা হচ্ছে বা এ ব্যাপারে এখনও কতদূর অগ্রগতি ঘটেছে?

দেবনাথ: আসলে হয় কি, ব্যাকটেরিয়াগুলো বিভিন্ন সিক্রেশন সিস্টেমের  মাধ্যমেই ভয়ঙ্কর সব রোগ ঘটায়। ইতিমধ্যে প্রায় নয় রকমের  সিক্রেশন সিস্টেম  আবিস্কার হয়েছে। সেই সিক্রেশন সিস্টেমগুলোকে কি করে রুখে দেওয়া যায়  তার  ওপর ভিত্তি করেই মূলতঃ কাজগুলো হচ্ছে।  বিশেষ করে টাইপ II ও টাইপ III সিক্রিশন পদ্ধতি নিয়ে এখন অসংখ্য বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। এমনকি দুটো সিক্রিশন সিস্টেমের বিরুদ্ধে ড্রাগ তৈরির কাজও অনেকদূর এগিয়েছে।  এছাড়াও কোনো কোনো গবেষণাগারে একইসাথে দুটো মলিকুলার মেশিন-কে টার্গেট করে একটা  বানানোর চেষ্টাও করা হচ্ছে।

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : তাহলে এতক্ষণ বিভিন্ন টক্সিন সঞ্চালনার পদ্ধতির ভিত্তিতে  বানানোর গবেষণা সম্পর্কে জানলাম। এগুলো ছাড়াও কি আর কোনো ভাবে দুস্টু ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলার আয়োজন চলছে?

দেবনাথ: নিশ্চই। অনেকেই চেষ্টা করছেন ওই ব্যাকটেরিয়াগুলো যে পদ্ধতিতে বিভাজিত হয়ে বংশবিস্তার করে, কোনো ব্লকার তৈরি করে সেটাকেই বন্ধ করে দিতে। বা ওদের কোষ পর্দাকেই বিপর্যস্ত করার চিন্তা ভাবনা করছেন কোনো কোনো বিজ্ঞানী। আরও একটা নতুন পদ্ধতি হচ্ছে-কিছু কিছু ভাইরাস যেগুলো কেবল ব্যাকটেরিয়া মারে, এই সব  ব্যাক্টেরিওফেজ ভাইরাস  ব্যবহার করে  ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে ধংস করার পদ্ধতি নিয়েও অনেক কাজ হচ্ছে|।

তবে একটা ভালো খবর বলি — ব্যাকটেরিয়াগুলোও কিন্তু নিজেদের মধ্যে প্রচন্ড মারামারি করে । আমাদের শরীরে এমন অনেক ভালো ব্যাকটেরিয়া আছে, যারা বাইরে থেকে আসা ঐ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াদের একদম সহ্য করতে পারে না। দেখতে পেলেই মেরে ফেলে।

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : বাহ, অনেককিছুই জানলাম। তোমার গবেষণার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যেকোনো একটা রিসার্চ ফিল্ড-এ সাধারণত যে ধরণের সরঞ্জাম বা উপাদান ব্যবহৃত হয়, তার জন্য তো একটা পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। তো তুমি এখন যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করতে চলেছ তার জন্য কেমিস্ট্রি নাকি বায়োলজি;  কোন বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ?

দেবনাথ: দেখো এটা নির্ভর করে ল্যাবরেটরিতে এসে তুমি আসলে কি ধরণের কাজ করতে চাইছো তার ওপর। তুমি যদি ব্যাকটেরিয়া কোষের অন্তর্গত মলিকুলার মেশিনের গঠন ও কার্যপ্রণালী নিয়ে কাজ করতে চাও তাহলে তোমার স্ট্রাকচারাল বায়োলজির জ্ঞান থাকলে সুবিধা হবে, আবার যদি তুমি ওই মেশিনের গঠন ও কার্যকারিতা জেনে নেওয়ার পর ওকে ধ্বংস করার জন্য  কোনো ড্রাগ বানাতে  চাও, তাহলে তোমার কেমিস্ট্রি নিয়ে গভীর জ্ঞান থাকলে সুবিধা হবে। এখন দেখো, এই দুটো আলাদা বিষয় নিয়ে একজনের পক্ষে কাজ করা তো বেশ কঠিন, তাই না? সেক্ষেত্রে দুজনে মিলে বা দলবদ্ধ হয়ে কাজ করলে বেশ সুবিধা হয়।

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : এতো অভাবনীয় সমস্ত গবেষণার পরিধি তৈরি হচ্ছে ক্ষতিকারক অণুজীবদের মেরে দূরারোগ্য সব রোগ সারিয়ে তোলার! কোনো ছাত্রছাত্রী যদি ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে চায়, সে কোন পথে এগোবে বা কি নিয়ে পড়াশুনা করলে সুবিধা হবে ?

দেবনাথ: অনেকভাবেই এধরণের ফিল্ডে আসা যায়। তাহলে আমার নিজের উদাহরণটাই দিই। আসলে আমার খুব ইচ্ছে ছিল বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা করার। কিন্তু তখন পশ্চিমবঙ্গে স্নাতক স্তরে বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়টাই ছিল না। তাই তখন আমি স্নাতক স্তরে কেমিস্ট্রি নিয়েই ভর্তি হলাম। তারপর স্নাতকোত্তর স্তরে যখন TIFR গেলাম। ওখানে গিয়ে বায়োলজিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়াশুনো করলাম। এবং সবশেষে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে পিএইচডি করলাম স্ট্রাকচারাল বায়োলজি আর মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে। তাই এরকম কোন মানে নেই যে মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে গবেষণা করতে হলে মাইক্রোবায়োলজি নিয়েই পড়তে হবে। আমার মনে হয় ইন্টারেস্ট থাকাটাই সবথেকে বেশি জরুরি। সেই ইন্টারেস্ট থেকেই বোধহয় পড়াশুনার শুরুটা আমি কেমিস্ট্রি নিয়ে করলেও ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-তে আজ আমি এসে পৌঁছেছি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেকার মলিকুলার মেশিন নিয়ে পোষ্ট ডক্টরেট করতে।

এরকম কোন মানে নেই যে মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে গবেষণা করতে হলে মাইক্রোবায়োলজি নিয়েই পড়তে হবে।

বিজ্ঞান. অর্গ. ইন : একটা কথা জানতে চাইবো। ফিজিসিস্টরা এধরনের কাজে আসেন?

দেবনাথ: হা হা.. আমার বস কিন্তু একজন ফিজিসিস্ট-ই। আমার পিএইচডি সুপারভাইজার যিনি ছিলেন উনি কেমিস্ট্রি-র মানুষ। আসলে এধরনের গবেষণাতে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথেম্যটিকস, বায়োলজি ওতপ্ৰতভাবে একে অপরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। এই গবেষণাতে ব্যবহৃত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র ক্রায়ো-ইলেক্ট্রন  মাইক্রোস্কোপের ব্যবহার ও তথ্য সংগ্রহ, রিয়াল স্পেস ও ফুরিয়ার স্পেসের মধ্যে আনাগোনা ইত্যাদি করার জন্য যেমন  ফিজিক্সের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, আবার ঐ তথ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করতে ম্যাথেম্যটিকসের জ্ঞান থাকাও সমান জরুরি।

আসলে আমার মনে হয়েছে  উচ্চশিক্ষা, গবেষণার ক্ষেত্রগুলোতে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর মধ্যে কোনো দ্বন্দ নেই। বরং ওরা মিলেমিশে ,পারস্পরিক সহযোগিতায় একটাই লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে -কিভাবে একটা সুন্দর, আরামদায়ক, স্বাস্থ্যময়  ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যায়। সেখানেই বিজ্ঞানের সার্থকতা, সেখানেই বিজ্ঞানের জয়জয়কার।

পুনশ্চঃ  প্রায় 360 কোটি বছর ধরে হাজার হাজার বাধা প্রতিকূলতা কাটিয়ে এই পৃথিবীতে  যে ব্যাকটেরিয়ারা টিকে থাকতে পারে , তাদের নিকেষ করা সত্যিই ভীষণ দুরূহ  একটা কাজ । আমরা যেমন বছরের পর বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটার পর একটা  বানিয়ে  চলেছি, ওরাও তেমনি ওদের চরিত্র, গঠন পরিবর্তন করে সেই দের বিরুদ্ধেই  প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলে ক্রমশ আরও মহা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। জানিনা এ লড়াইয়ের শেষ কোথায়।

তবে ভরসা থাকুক বিবর্তনবাদের ওপর, বিশ্বাস থাকুক যোগ্যতমের উদবর্তনের ওপর।  কারণ, “অস্তিস্তের জন্য সংগ্রামের” লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত কিন্তু সেই বেঁচে থাকে…. যে লড়াই করতে জানে, যে বুদ্ধিমান, যে প্রকৃত বেঁচে থাকার যোগ্য।

(ড: রাজীবুল ইসলাম ও ড: দেবনাথ ঘোষাল-এর আড্ডার ভিত্তিতে লেখাটি সাজিয়েছেন দেবব্রত মাজী। )

(প্রচ্ছদের ছবির সূত্র, কৃতজ্ঞতা: Lightspring/Shutterstock.com)

উৎসাহী পাঠকদের জন্য

[১] ব্যাকটেরিয়া-র ভিতরের সজ্জা নিয়ে বিশদে জানতে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত ড: দেবনাথ ঘোষাল-এর এই ধারাবাহিক লেখাটি পড়ুন।

[২] ব্যাকটেরিয়া-র ভিতর জিনগত তথ্যের আদানপ্রদান কিভাবে হয়, সেই নিয়ে জানতে এই লেখাটি পড়ুন।

[৩] ভিট্রিফিকেশন:- এটি জলের এক ভিন্ন ধরনের “বরফ শীতল ( কিন্তু বরফ নয়) ”  অবস্থা যেখানে জলের অণুগুলো মাইনাস 196 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শীতল হয় , কিন্তু বরফের মতো ত্রিমাত্রিক সজ্জায় সজ্জিত হয় না ।

[৪] বিকল্প অ্যান্টিবায়োটিক্স নিয়ে জানতে এই লেখাটি পড়ুন।

The post ব্যাকটেরিয়া বনাম অ্যান্টিবায়োটিক্স: এ লড়াইয়ের শেষ কোথায়? appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা

$
0
0

আকাশবাণীতে যোগ দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই অনুষ্ঠান তৈরির প্রথম দায়িত্ব পেলাম। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জাতীয় সম্মেলন। নিমন্ত্রণপত্র হাতে নিয়ে, গাড়ির ব্যবস্থা করে যখন পৌঁছলাম কলেজ প্রাঙ্গণে তখন সামান্য দেরি হয়ে গিয়েছে। হুড়মুড় করে বেকার হলে ঢুকে সংবাদমাধ্যমের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় বসলাম। মঞ্চে তখন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো এক বক্তা। ছোটখাটো, শীর্ণ শরীর তাঁর কিন্তু বক্তব্যের তেজ চোখ-কান টেনে রাখার মত। ঠিক কি কী বলেছিলেন তিনি তা এখন আর স্পষ্ট মনে নেই তবে এটুকু মনে আছে যে প্রেসিডেন্সি কলেজে নিজের লেখাপড়া করার সময়টা কেমন উত্তাল ছিল, নকশাল আমলের অশান্ত পরিস্থিতি কতটা প্রভাব ফেলত পড়াশোনায় তা আলোচনা করেছিলেন তিনি। এছাড়া সভার উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তো ছিলই। বক্তব্য শেষে যখন হাততালিতে ফেটে পড়ছে সভাঘর তখন পাশে বসা সাংবাদিকের কাছে জানতে চাইলাম, কী নাম বক্তার? কথা না বলে তিনি নিমন্ত্রণপত্রের একটা নামের উপর তর্জনী রাখলেন। এন সি রানা। নারায়ণচন্দ্র রানার সঙ্গে সেই প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ পরিচয় আমার। বাকিটা জেনেছি বই পড়ে আর তাঁর ঘনিষ্ঠ মানুষজনের কাছ থেকে।

সাউড়ি থেকে শহর কলকাতা

রাজেন্দ্রনাথ রানা আর নাকফুড়ি দেবীর জ্যেষ্ঠ সন্তান নারায়ণচন্দ্র রানার জন্ম ১৯৫৪ সালের ১০ই অক্টোবর। তাঁর গ্রামের নাম সাউড়ি, আজকের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। পেতল সহ নানা ধাতুর শিল্পকর্ম করতেন রাজেন্দ্রনাথ। একইসঙ্গে নিজের বাড়িতে চালাতেন একটা পাঠশালা। রানার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি সেখানেই। পঞ্চম শ্রেণীতে সে এসে ভর্তি হল সাউড়ির ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে। ঝকঝকে হাতের লেখা আর অঙ্ক কষায় তার সহজ দক্ষতা নজর কাড়ল সবার। এই স্কুলে দুটো বছর কাটতে না কাটতেই সঙ্কট দেখা দিল পরিবারে। নিউমোনিয়ায় ভুগে বাবা মারা গেলেন, শুরু হল অর্থের টানাটানি। রানার লেখাপড়া অবশ্য এতে থেমে যায় নি। শত কষ্টের মধ্যেও ভালো ফল করতে থাকল সে। অষ্টম শ্রেণীতে রানা আর তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু গৌরকিশোর রাউত মিলে এক দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করল। নাম দেওয়া হল ‘কিশোর’। এব্যাপারে সবরকম সাহায্য করতেন মাস্টারমশাই মহীতোষ দাস।  নিজের লেখাপড়ার বাইরে সহপাঠীদের সাহায্য করতে হত রানাকে। নীচু ক্লাসের ছাত্ররাও তাঁর কাছে আসত পড়া বুঝতে। এমনকি কখনও-কখনও তাঁকে দু’ একটা ক্লাস নিতেও বলা হত। কিছুদিন পরে এখানে এসে যোগ দিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ি। ন্যূনতম আসবাবপত্র নিয়ে তাঁর ঘর, সেখানে ছিল ছাত্রদের অবাধ যাতায়াত। মণিবাবু রাতের আকাশ খুঁটিয়ে দেখতে শেখাতেন ছাত্রদের। তবে এ ব্যাপারে অন্য সবার থেকে এগিয়ে থাকত রানা, সে ছিল তাঁর প্রিয় ছাত্র। সহপাঠীদের কখনও মনে হত যেন রানা আর মণিবাবু দুই বন্ধু। কারও মনে হত রানা তাঁর মানসপুত্র। সে যাই হোক না কেন, রানার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পেছনে সবথেকে বেশি অবদান যে মণিবাবুর তা এক বাক্যে স্বীকার করেন সবাই।

রানার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পেছনে সবথেকে বেশি অবদান যে মণিবাবুর তা এক বাক্যে স্বীকার করেন সবাই।

১৯৬৯ সালের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় রানা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। গৌরকিশোর রাউত পেয়েছিল পঁচিশতম স্থান। অর্থের অভাবে এরপর হয়ত লেখাপড়া এগোত না যদি না স্কুলের কয়েকজন মাস্টারমশাই দায়িত্ব নিয়ে বেলঘরিয়ার রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যার্থী আশ্রমে নিয়ে যেতেন এই দুই কৃতী ছাত্রকে। বিনা খরচে থাকা, খাওয়া আর পাঠাগার ব্যবহারের সুযোগ পেল দু’জন। শহরের পরিবেশে বড় হতে থাকল তারা।  প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে ভর্তি করে দেওয়া হল দু’জনকে। সেখানেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর  রেখে রানা ভর্তি হল প্রেসিডেন্সি কলেজে, পদার্থবিজ্ঞানে সাম্মানিক সহ। পড়াশোনার অভিমুখ পাল্টে রাউত গেল নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে এম বি বি এস পড়তে। প্রেসিডেন্সিতে অন্যান্য অনেক মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে রানা পেল কসমোলজির পথিকৃৎ অমল কুমার রায়চৌধুরীকে। প্রত্যাশিতভাবেই তাঁর অত্যন্ত প্রিয় একজন ছাত্র হয়ে উঠল রানা। পরবর্তী জীবনে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার তালিমটা সেরা মানের হল এভাবেই। প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতক হওয়ার পর রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজ থেকে এম এস সি করলেন রানা। তবে কলেজে থাকতেই শ্বাসকষ্টে ভোগা শুরু হল। অল্প হাঁটাহাঁটিতে হাঁপিয়ে পড়া, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে বারবার থেমে পড়া তাঁর আগামী জীবনের দুর্বিষহ কষ্টের ঈঙ্গিত দিচ্ছিল।

রানার গবেষণা

১৯৭৭ সালে Tata Institute of Fundamental Research (টি আইএফ আর)এ ঢোকার জন্য আবেদন করেন তিনি। গৌরকিশোর রাউত জানিয়েছেন যে তাঁর পরীক্ষা নিয়েছিলেন জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার। ২৫৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন রানা। নারলিকারের অধীনেই গবেষণার সুযোগ হল। বিষয় – Cosmic Microwave Radiation। এ প্রসঙ্গে একটু পরেই আলোচনায় ঢোকা যাবে। এই সময় থেকেই অবশ্য রানার শারীরিক অসুস্থতা বাড়তে থাকে। মিশনের মহারাজদের চেষ্টায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আর এন চ্যাটার্জির কাছে চিকিৎসা শুরু হয় রানার। ১৯৭৮ সালের ২২শে অক্টোবর তাঁর বুকে পেসমেকার বসানো হয়। চিকিৎসার খরচ বাড়ছিল হু হু করে কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় টি আই এফ আর কর্তৃপক্ষ। ১৯৮১ সালে রানা লাভ করেন পি এইচ ডি। এর দু’ বছরের মধ্যে তিনি ভূষিত হন Indian National Science Academyর দেওয়া Young Scientist Medalএ। এই বছরেই তিনি পোস্ট ডক্টরাল কাজের জন্য চলে গেলেন বিলেতের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে প্রখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী Arnold Wolfdaleএর তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করলেন তিনি। ওখানেও তিনি নিজের মেধার পরিচয় দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। দু’টো আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পান। ডারহ্যামে একজন মেধাবী ছাত্র D A Wilkinson রানার অধীনে গবেষণা শুরু করেন। গুরু-শিষ্য মিলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র লিখেছেন। ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে রানা বম্বেতে ফিরে আসার পরে উইলকিনসন এদেশে এসে নিজের থীসিস শেষ করেন। ১৯৮৬ সালে পুনায় IUCAA প্রতিষ্ঠিত হলে নারলিকারের সঙ্গে এসে যোগ দেন রানা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন সেখানেই।

এবারে রানার গবেষণার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করা যাক। রানার পাঠ ও গবেষণার ক্ষেত্র জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান। বিংশ শতকে নব নব আবিষ্কারের ফলে এই ক্ষেত্রের মধ্যে আরও ছোট ছোট ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। রাণা এর অনেকগুলোতেই নিজের অবদান রেখেছেন। গত শতকের মাঝামাঝি, ঠিক করে বলতে গেলে ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ খৃষ্টাব্দে মহাবিশ্বের উদ্ভব আর তার বিবর্তন নিয়ে দুটো তত্ত্ব এল বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। এর মধ্যে পরের তত্ত্বটার পরিচিতি বেশি। জর্জ গ্যামোর দেওয়া এই তত্ত্ব বিগ ব্যাং নামে চেনেন সবাই। তিনি বলেন যে এই বিশ্ব অনাদি নয়, এর একটা সৃষ্টিবিন্দু আছে। অর্থাৎ কোনো একটা সময় থেকে শুরু করে বিবর্তনের পথ ধরে আজ মহাবিশ্ব পৌঁছেছে এই জায়গায়। অন্য যে তত্ত্বটা একইভাবে আলোড়ন ফেলেছিল বিজ্ঞানীদের চিন্তাজগতে তা হল এডুইন হাবলের দেওয়া মহাবিশ্বের প্রসারণ তত্ত্ব। সংগৃহীত তথ্য থেকে হাব্‌ল ধারণা করেছিলেন যে মহাবিশ্বের বস্তুপুঞ্জ একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই অপসরণের হার দুটো বস্তুপুঞ্জের মধ্যেকার দূরত্বের সমানুপাতিক। গ্যামো বললেন, একদিকে মহাবিশ্ব সমদৈশিক (isotropic) আর সমসত্ত্ব (homogeneous), অন্যদিকে তা প্রসারিত হচ্ছে। তার মানে প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্বের ঘনত্ব কমছে। তাহলে অতীতে নিশ্চয়ই এই ঘনত্ব বেশি ছিল। আরও পিছিয়ে গেলে বলা যেতে পারে যে এক সময় সব বস্তু ঠাসা ছিল একটা বিন্দুতে এবং তার ঘনত্ব ছিল কল্পনার অতীত। সেই বিন্দু থেকে এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে মহাবিশ্ব, ঘটছে তার প্রসারণ। গ্যামো হিসাব করে বললেন যে এই প্রসারণ শুরু হয়েছে এক হাজার থেকে দু’ হাজার কোটি বছরের মধ্যে কোনো একটা সময়। এই শুরুর মুহুর্ত পরিচিত বিগ ব্যাং নামে।

গ্যামোর ভাবনা লোকসমক্ষে আসার বছরখানেক আগে ফ্রেড হয়েল, হারমান বন্ডি এবং টমাস গোল্ড মহাবিশ্ব সৃষ্টির যে তত্ত্ব দেন তাতে সৃষ্টিবিন্দুর কোনো ধারণা ছিল না। তাঁরাও মহাবিশ্বের সমদৈশিক ও সমসত্ত্ব ধর্মকে কাজে লাগান। Steady State Theory নামে পরিচিত তাঁদের তত্ত্বের বক্তব্য ছিল, মহাবিশ্ব মোটামুটি অপরিবর্তিতই আছে এবং ছোটখাটো পরিবর্তন বাদ দিলে এমনই থাকবে। দুটো তত্ত্বই কিছু পরিমাণে সফল হল মহাবিশ্বের অবস্থা এবং বিবর্তন সম্পর্কিত নানা প্রশ্নের জবাব দিতে। সমানে-সমানে যখন প্রতিযোগিতা চলছে তখনই ১৯৬৫ সালে হঠাৎ করে হওয়া একটা আবিষ্কার পাল্লা ভারী করে দিল গ্যামোর তত্ত্বের পক্ষে। আর্নো অ্যালান পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন রেডিও অ্যান্টেনা নিয়ে কাজ করার সময় দেখলেন যে মহাবিশ্বের সব দিক থেকে একটা বিকিরণ আসছে। রেডিও অ্যান্টেনা যেদিকেই ঘোরানো যাক না কেন, বিকিরণ থাকছে একইরকম। পরম শূন্য তাপমাত্রার ডিগ্রী তিনেক উপরে কোনো বস্তুর তাপমাত্রা রাখলে সেটার থেকে যে বিকিরণ হয় তেমনই বিকিরণ আসছে চারদিক থেকে। পৃথিবীর আবহমন্ডলের গড় তাপমাত্রা অনেক বেশি হওয়ায় চট করে ধরা যায় না এই বিকিরণ। পেনজিয়াস ও উইলসনের আবিষ্কার বিগ ব্যাং-কে যেন একটা দৃঢ় ভিত্তি দিল। এই মতের অনুসারীরা বললেন যে মহাবিশ্বের আদিতম তল থেকে আসছে এই অবশিষ্ট বিকিরণ (relict radiation)। পশ্চাৎপটের এই বিকিরণ পরিচিত হল Cosmic Microwave Background হিসাবে। মনে করা হল, হয়েল-বন্ডি-গোল্ডের তত্ত্ব এবার অবান্তর হয়ে গেল।

কিন্তু এত সহজে একটা তত্ত্বকে বিসর্জন দেন না প্রবক্তারা। এখানে খেয়াল রাখতে হবে, টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে নারায়ণ চন্দ্র রানা গবেষণা শুরু করেন জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের অধীনে এবং গবেষণার বিষয় ছিল Cosmic Microwave Radiation। অর্থাৎ সেই একই পশ্চাৎপট বিকিরণ যা নিয়ে আলোচনা করছি আমরা। একইসঙ্গে আরও একটা কথা মনে না রাখলেই নয়। সেটা হল, নারলিকার ছিলেন ফ্রেড হয়েলের ছাত্র এবং হয়েলের প্রবর্তিত বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে তাঁর গবেষণা তথা অবদানও ছিল উল্লেখযোগ্য। ফলে সামগ্রিকভাবে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র এবং গবেষক হলেও রানা কাজ শুরু করলেন Steady State Theoryর শিবির থেকে।

টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে নারায়ণ চন্দ্র রানা গবেষণা শুরু করেন জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের অধীনে এবং গবেষণার বিষয় ছিল Cosmic Microwave Radiation।

পশ্চাৎপট বিকিরণের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন হয়েল ও নারলিকার। শুধু তাই নয়, তাঁরা নিজেদের তত্ত্বের কিছু পরিবর্তন করে নাম দেন Quasi Steady State Theory। পরিবর্তনের বিস্তারিত আলোচনা এই প্রবন্ধের পরিসরে সম্ভব নয়। আমরা যেটা করতে পারি তা হল পশ্চাৎপট বিকিরণের যে ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছিলেন এই বিজ্ঞানীরা তার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা। রানা নিজে উৎসাহী ছিলেন বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে। বহু পথিকৃৎ বাঙালি বিজ্ঞানীর মত তিনি নিজেও চেষ্টা করতেন সহজ ভাষায় মানুষের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিতে। ১৯৮৩ সালে লেখা তাঁর এক প্রবন্ধের নাম ‘মহাবিশ্বের উৎস সন্ধানেঃ সাম্প্রতিক বিতর্ক’। সেখানে এক জায়গায় তিনি লিখছেন,

‘… স্থিরাবস্থা মডেলের প্রবক্তারা অবশ্য তাঁদের মডেলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মহাজাগতিক ক্ষুদ্রতরঙ্গের ব্যাকগ্রাউন্ডের উৎস সম্পর্কে বিকল্প ব্যাখ্যা দেওয়ার জোরদার চেষ্টা চালালেন। তাঁরা দেখালেন যে, ছায়াপথের নক্ষত্রের আলোর যা জোর রয়েছে তা দিয়ে নক্ষত্রের মধ্যে হাইড্রোজেন, হিলিয়ামে রূপান্তরিত হতে পারে। শুধু তাই নয়, নির্গত নক্ষত্রালোক ছায়াপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কার্বন বা লৌহকণিকার দৌলতে অপেক্ষাকৃত কমজোরি হয়ে সম্ভবত ঐ ক্ষুদ্রতরঙ্গের ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরির ক্ষমতা রাখে।’ গবেষক রানা নিজেও পশ্চাৎপট তৈরির ব্যাখ্যা হিসাবে কার্বন ও লৌহকণিকার আলো শোষণ এবং পুনরায় বেতার তরঙ্গ হিসাবে বিকিরণের কথা বলেন। ১৯৮০ সালে লেখা এর পরের দুটো গবেষণাপত্রে বিষয়টার খুঁটিনাটি আলোচনা করেন তিনি। সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে স্থিরাবস্থা মডেলের পক্ষ নিয়ে উপস্থিত করা এই সব ব্যাখ্যা তেমন গৃহীত হয় নি জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে। কিন্তু রানার উপস্থাপনার মুন্সিয়ানা স্বীকৃত হয়েছে।

স্থিরাবস্থা মডেলের পক্ষ নিয়ে উপস্থিত করা এই সব ব্যাখ্যা তেমন গৃহীত হয় নি জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে। কিন্তু রানার উপস্থাপনার মুন্সিয়ানা স্বীকৃত হয়েছে।

নক্ষত্রের অভ্যন্তরে নতুন নতুন মৌলিক পদার্থ সৃষ্টি সম্পর্কে রানার গবেষণাও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৬ সাল নাগাদ হয়েল দেখাতে সক্ষম হন যে ভারী, বিশালাকার নক্ষত্রের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা এবং ঘনত্ব, দুটোই এত উচ্চ মানে পৌঁছয় যে সেখানে ভারী মৌল যেমন লোহাও সৃষ্টি হতে পারে। সুপারনোভা জাতীয় বিস্ফোরণের সঙ্গে এই সব মৌল ছড়িয়ে পড়ে মহাশূন্যে। এর আগে মৌলিক পদার্থের সৃষ্টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না বিজ্ঞানীদের কাছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে নক্ষত্রের মধ্যে মৌলের সৃষ্টি ব্যাপারটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁরা বরং জর্জ গ্যামোর তত্ত্বে আস্থা রেখেছিলেন যে মহাবিশ্ব সৃষ্টির পরে এক লহমায় তৈরি হয়েছিল নানা মৌল। বস্তুতপক্ষে অনেকের বক্তব্য হল যে গ্যামো বিগ ব্যাং মডেলের জন্ম দিয়েছিলেন মৌলের সৃষ্টি এবং মহাশূন্যে তা ছড়িয়ে পড়া ব্যাখ্যা করতে। পি এইচ ডি পর্ব থেকেই নারলিকার প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁর গাইড ফ্রেড হয়েলের এই সব ভাবনায়। সেই প্রভাব রানার মধ্যেও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু যথার্থ বিজ্ঞানী কোনো প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে গবেষণার পথ ধরেন না। গ্যামো এবং হয়েল, দু’জনের তত্ত্বেরই আংশিক সাফল্য এবং আংশিক ব্যর্থতা ব্যাখ‍্যা করেছিলেন রানা। পাশাপাশি নিজে মহাবিশ্বে মৌলের বন্টন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিশ্লেষণ করেন। গ্যালাক্সির রাসায়নিক গঠন তথা বিবর্তন নিয়েও তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।

প্রেসিডেন্সির সেই সভা

খালি চোখে রাতের আকাশে চাঁদ, গ্রহ, নক্ষত্র,  ধূমকেতু ইত্যাদি দেখে অগাধ আনন্দ পেতে পারেন একজন মানুষ। নিজের চর্চাকে আর একটু নিবিড় করতে পারলে তিনি ঢুকে পড়তে পারেন শখের জ্যোতির্বিদদের দলে। এমন শখের বা অপেশাদার জ্যোতির্বিদদের দেওয়া তথ্যে বহুবার সমৃদ্ধ হয়েছে পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জ্ঞানভান্ডার। আজও সেই ধারা বহমান। এই অপেশাদার চর্চাকে বৈজ্ঞানিক করে তুলতে অনেক সময়ই সহযোগীর প্রয়োজন অনুভব করেন একজন জ্যোতির্বিদ। সেই তাগিদ থেকেই বিশ্বের নানা জায়গায় তৈরি হয়েছে অপেশাদার জ্যোতির্বিদদের সংগঠন। তাতে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরাও থেকেছেন। ভারতে এমন সংগঠন প্রথম তৈরি হয় কলকাতায় ১৯১০ সালে, হ্যালির ধূমকেতু পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে। এর পরেও বিচ্ছিন্নভাবে দেশের নানা প্রান্তে গড়ে উঠেছে এমন সংগঠন।

সরকারি অর্থানুকূল্যে ১৯৯০ সালে পুনায় Inter University Centre for Astronomy and Astrophysics (IUCAA) নামে এক স্বশাসিত সংস্থা গড়ে ওঠে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের তত্ত্বাবধানে। পরের বছর এই সংস্থাই আয়োজন করে প্রথম সারা ভারত জ্যোতির্বিদ্যা সম্মেলনের। এর পরের দুটো বছরে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ওয়ার্ধা এবং নাগপুরে। চতুর্থ বছরে এই সম্মেলন হয় কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। দায়িত্ব নিয়েছিল যে ট্রাস্ট তা গঠন করেছিলেন রানা নিজেই, তাঁর শিক্ষক মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ির স্মৃতিতে। পরমপ্রিয় শিক্ষক যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন তখন তিনি IUCAAর সহযোগী অধ্যাপক। কিন্তু গুরুর অসুস্থতার কথা শুনে সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছিলেন। হুগলির গুড়াপে সাতদিন ধরে মণিবাবুর পাশে থাকলেন। ১৯৯১ সালের ৫ই জানুয়ারি মণিবাবুর মৃত্যুর দু’ মাসের মধ্যে সাউড়িতে স্থাপিত হল ‘মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ি স্মৃতি বিজ্ঞান মন্দির’। এরই পরের ধাপে ১৯৯৩ সালে কলকাতায় তৈরি হয় মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ি অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ট্রাস্ট।

অপেশাদার জ্যোতির্বিদদের এক ছাতার নীচে নিয়ে আসার উদ্যোগের সঙ্গে রানা জড়িত ছিলেন প্রথম থেকেই। IUCAAতেও তিনি ছিলেন বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের দায়িত্বে।

সেই ট্রাস্টের উদ্যোগেই ১৯৯৪ সালের ২১ ও ২২শে জানুয়ারি কলকাতায় অনুষ্ঠিত হল 4th All India Amateur Astronomers’ Meet। প্রেসিডেন্সি কলেজে আসা ছাত্রছাত্রীদের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত যাবতীয় কৌতূহল মেটালেন রানা। অন্যেরা তাকিয়ে দেখলেন মুগ্ধ হয়ে। তৈরি হল Confederation of Indian Amateur Astronomers। নিজে রইলেন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে। আসলে অপেশাদার জ্যোতির্বিদদের এক ছাতার নীচে নিয়ে আসার উদ্যোগের সঙ্গে রানা জড়িত ছিলেন প্রথম থেকেই। IUCAAতেও তিনি ছিলেন বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের দায়িত্বে। অপেশাদারদের সংগঠনের যাতে একটা দৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রচিত হয় তার জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় সম্মেলনে সারা ভারতের অপেশাদার জ্যোতির্বিদদের গুণগত মান নির্ধারণের জন্য একটা উদ্ভাবনী সমীক্ষা করেন। এটা পরবর্তী সময়ে বেশ কাজে এসেছে বলে অনেকের অভিমত।

সূর্যগ্রহণ ও রানা

রানার আরও একটা উদ্যোগকে সামনে আনা দরকার যেখানে তিনি মিশেছিলেন বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠানের চার দেওয়ালের বাইরে থাকা মানুষের সঙ্গে। স্থান দিল্লি-জয়পুর হাইওয়ে এবং সময় ১৯৯৫ সালের ২৪শে অক্টোবর। সেবারের সূর্যগ্রহণকে ব্যবহার করে ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন। ছাপা হয়েছিল পুস্তিকা, বিতরণ করা হয়েছিল নিরাপদে সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য উপযুক্ত চশমা। রানা নিজেও বাংলায় একটা প্রবন্ধ লেখেন যার শিরোনাম ছিল সাদামাটা – পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। প্রবন্ধ শুরু হচ্ছে এইভাবে,

‘আগামী ২৪ অক্টোবর ১৯৯৫ সকালে ভারতের রাজস্থান থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় উপত্যকার উপর দিয়ে যাওয়া চাঁদের প্রচ্ছায়াপথের অন্তর্গত কোন স্থানে যদি থাকা যায়, তবে এমন একটি দৃশ্য দেখা যাবে যাকে নিঃসন্দেহে প্রকৃতির সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ দৃশ্য বলা যায়। …’

সূর্যগ্রহণ ঘিরে নানা কুসংস্কার যা এমনকি বিজ্ঞানীদেরও প্রভাবিত করে তার আলোচনা করেছেন রানা … কিন্তু মানুষকে বোঝানোর কাজে  সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি এমন একটা উদ্যোগ নেন যা সম্ভবতঃ এদেশে অভূতপূর্ব।

এই সূর্যগ্রহণ ঘিরে নানা কুসংস্কার যা এমনকি বিজ্ঞানীদেরও প্রভাবিত করে তার আলোচনা করেছেন রানা। একইসঙ্গে সূর্যগ্রহণের খুঁটিনাটি এবং নিরাপদে তা দেখার পদ্ধতি জানিয়েছেন। কিন্তু মানুষকে বোঝানোর কাজে  সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি এমন একটা উদ্যোগ নেন যা সম্ভবতঃ এদেশে অভূতপূর্ব। বিংশ শতকের শেষ দুটো দশকে কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণায় বলা হয় যে বিগত কয়েক শতকে আপাতভাবে সূর্যের ব্যাসের একটা পরিবর্তন হয়েছে। এ নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও সূর্যের ব্যাস সরাসরি মাপার উপর জোর দেন সবাই। সূর্যগ্রহণ এই পরিমাপের জন্য একটা দারুণ সুযোগ তৈরি করে। পদ্ধতিটা এইরকম – প্রচ্ছায়া (umbra) অঞ্চলের সীমানায় দাঁড়াতে হবে পর্যবেক্ষকদের। এবার Baily’s Beads এর প্রত্যেকটা ‘পুঁতি’ তৈরি হওয়ার এবং অদৃশ্য হওয়ার নির্দিষ্ট সময়গুলো মাপতে হবে। এই দৃশ্য এবং অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা যেন একটা বিন্দুর এগিয়ে যাওয়াকে নির্দেশ করে। এভাবে পাওয়া পরিমাপকে ব্যবহার করে সূর্যের আপাত ব্যাস পাওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে এই পদ্ধতি ত্রুটিমুক্ত কিন্তু সমস্যা এখানেই যে এক-একটা পরিমাপের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয় যেহেতু দুটো পূর্ণ সূর্যগ্রহণের মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকে অনেকটাই।

রানা নিজে এই ‘মুক্তোমালা’ সম্পর্কে জনপ্রিয় ভাষায় কী লিখেছেন দেখি,

‘চাঁদের দেহের আড়ালে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যাওয়ার সময় চাঁদের পূর্বপ্রান্ত ঘিরে একটি সরু আলোর রেখা আর মাঝে মাঝে আলোকবিন্দু দেখা যায়। একে বলে Baily’s Beads, বাংলায় বলা যেতে পারে মুক্তামালা। ১৮৩৬ সালের গ্রহণকালে জনৈক ইংরেজ বিজ্ঞানী বেইলি (Baily) প্রথম এর বর্ণনা দেন। দ্বিতীয় স্পর্শকালে পাহাড় পর্বত ঘেরা চাঁদের দেহ সূর্যের সর্বশেষ অংশ আবৃত করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পাহাড়ের উপত্যকা অংশের ফাঁকা স্থান দিয়ে সূর্যের আলোর ঝলক বাইরে আসে। … … তৃতীয় স্পর্শকালে অপর পাশ দিয়ে সূর্যদেহ উন্মুক্ত হতে শুরু হওয়ার ঠিক প্রাক্কালে অনুরূপ কারণে আবার মুক্তামালা দেখা যায়।’

১৯৯৫ সালের ২৪শে অক্টোবর তিনি এই মুক্তোমালা ব্যবহার করার জন্য ঢালাও ব্যবস্থা করলেন। দিল্লী-জয়পুর হাইওয়ের দু’পাশে শখের জ্যোতির্বিদ এবং ছাত্রছাত্রীরা যোগ দেয় এই পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের কাজে। এ যেন ছিল বিজ্ঞানের এক উৎসব! কিন্তু একটা সূর্যগ্রহণের তথ্য দিয়ে তো আর কাজ হবে না। ফলে লক্ষ্য রইল পরের সূর্যগ্রহণ।

অকালে চলে গেলেন রানা

১৯৯৯ সালে সেই সূর্যগ্রহণ অবধি অবশ্য বেঁচে থাকতে পারলেন না রানা। কথাটা এভাবে বলতে হচ্ছে তার কারণ রানা চেয়েছিলেন অনেকদিন বাঁচতে এবং আরও অনেক কাজ করতে। কিন্তু যে দুরারোগ্য হৃদযন্ত্রের অসুখ তাঁর জন্মগত, যার জন্য কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ থেকে শুরু করে বিলেতের ডারহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি তাঁর শেষ কর্মস্থল IUCAAতে তাঁর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হয়েছিল সেই ব্যাধি ছিনিয়ে নিল তাঁকে। রোগের ডাক্তারি পরিভাষা হল Idiopathic Hypertrophic Subaortic Stenosis with complete left Bundle Branch Block। যে রোগের জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তাঁকে অতি সন্তর্পণে সিঁড়ির একটি-একটি ধাপ ভেঙে ক্লাসে পৌঁছতে হত, সেই শারীরিক সমস্যাই তাঁর মৃত্যু ডেকে আনল ১৯৯৬ সালের ২২শে অগাস্ট। মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে বিদায় নিলেন রানা। কিন্তু এমন বিজ্ঞানীর কি সত্যিই মৃত্যু হয়? তাঁর কাজেই তো বেঁচে আছেন তিনি!

রানার সমাজভাবনা

বিজ্ঞানের গবেষণা তাঁর মূল পরিচিতি হলেও শুধুমাত্র সেখানেই সীমাবদ্ধ নন নারায়ণচন্দ্র রানা। বিজ্ঞানের সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের যে যোগাযোগ, স্থানভেদে ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন রানা। এর পর বাস্তব পরিস্থিতি যখন তুলে ধরেছেন তখন তিনি কঠোর সত্যবাদী। বাঙালি তথা পূর্ব ভারতের মানুষদের এবং বিজ্ঞান পড়ুয়াদের সম্পর্কে রানার মনোভাবের উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁরই কয়েকটা লেখায়। ‘বিজ্ঞান মনীষা’ পত্রিকার জুলাই ১৯৮৩ সংখ্যায় তিনি লিখছেন,

‘যে কারণেই হোক, জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণায় ভারতের পূর্বাঞ্চল বরাবরই পিছিয়ে থেকেছে। এখনও পর্যন্ত দু-একটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জায়গায় দু একজনের চেষ্টা ছাড়া বিশেষ উন্নতির লক্ষণ মেলে নি। …’

ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি বা সেখানকার গবেষকদের সঙ্গে তুলনা করে তির্যক মন্তব্য করছেন বাঙালির আয়েসী মনোভাবের প্রতি। এখানে যেন তাঁকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উত্তরসূরী মনে হয়!

আবার ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি বা সেখানকার গবেষকদের সঙ্গে তুলনা করে তির্যক মন্তব্য করছেন বাঙালির আয়েসী মনোভাবের প্রতি। এখানে যেন তাঁকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উত্তরসূরী মনে হয়! আবার এখানেই বোঝা যায়, একজন নিবেদিত গবেষক হওয়ার পাশাপাশি তিনি সমাজের গতিবিধি সম্পর্কে ভাবনার জন্য সময় ব্যয় করতে চাইতেন। রানার বিজ্ঞান বলা বা জনপ্রিয় ভাষায় লেখার যে ধারাবাহিকতা সেটাও এই সমাজ-ভাবনারই ফসল। সমাজে বৈজ্ঞানিক মানসিকতার প্রসার চাইতেন তিনি। ঠিক এই শিরোনামে অর্থাৎ ‘বৈজ্ঞানিক মানসিকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি পথের বাধাগুলো যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা অত্যন্ত মনোগ্রাহী এবং বাস্তবসম্মত। প্রবন্ধের শেষে দেশের আশানুরূপ উন্নতির অভাব তিনি বর্ণনা করেছেন এইভাবে,

‘…যে শিক্ষিত সমাজের উপর একটা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, সেই সমাজ নিজেদের সমালোচনা কিংবা নিজেদের উপযুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেও ভুলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত শিক্ষকের ভূমিকা কে নিতে পারেন? সার্থক রূপকারের অভাবে ভারতবর্ষের কটা পরিকল্পনাই বা আজ পর্যন্ত ঠিক রূপান্তরিত হয়েছে?’

এই বিশ্লেষণের সঙ্গে সম্ভবতঃ কেউ দ্বিমত হবেন না।

প্রচ্ছদের ছবি: Philosophy of Science Portal

সূত্রঃ

১। দীপককুমার দাঁ সংকলিত ও সম্পাদিত এবং মণীন্দ্র-নারায়ণ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ট্রাস্ট প্রকাশিত ‘জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা’, ডিসেম্বর ২০১৭

২। Utpal Mukhopadhyay, Saibal Ray, N C Rana: Life and His Contributions in Astrophysical Science, Indian Journal of History of Science, 51.3 (2016) 531-547

৩। Cirkovic, M. M., & Perovic, S. Alternative explanations of the cosmic microwave background: A historical and an epistemological perspective, Studies in History and Philosophy of Modern Physics (2017) ৪। Alan D Fiala, David W Dunham, Sabatino Sofia, Variation of the solar diameter from solar eclipse observations, 1715-1991, Solar Physics, June 1994

The post বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

কার্টুনের মাধ্যমে বিজ্ঞানশিক্ষা

$
0
0

বাহুবলীকে কতটা জোর লাগাতে হচ্ছে পিয়ানোটা ঠেলতে? পিয়ানোর ওজনের সমান নাকি অন্য কিছু? এরকম কিছু প্রশ্ন নিচে দেওয়া হলো। ভেবে বার করো দেখি।


বিজ্ঞানে যুক্তি প্রাধান্য পায় বেশি; আবেগ বা শিল্পের বহিঃপ্রকাশ সেখানে সচরাচর কম। তাই বিজ্ঞান শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই নবীন মনের কাছে শুকনো মনে হয়। শুধুই যুক্তির কচকচিতে মন সাড়া দিতে চায় না এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে মাস্টারমশাই যখন ক্লাসে বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ত্বগুলো বুঝিয়ে চলেছেন, অনেক ছাত্র-ছাত্রীই তখন নিজেদের মজাদার জগতে মশগুল।

বিজ্ঞান পত্রিকার সদস্য  ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড ইস্টার্ন শোর-এর পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ডঃ কৌশিক দাস বিশ্বাস করেন আমরা বিজ্ঞানকে নবীন মনের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারলে এই বাধা অতিক্রম করে ওঠা যায়।  যে হাসি, মজা, আড্ডা নিয়ে আমরা মেতে থাকতে চাই তা যদি বিজ্ঞানের ক্লাসের মধ্যে, পড়ানোর মধ্যে আমরা আনতে পারি, তাহলে পড়াটা, শেখাটা আর শুকনো থাকে না। স্বাভাবিক ভাবেই বিষয় বস্তু আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এই চিন্তারই ফসল কৌশিক দাস আর বিশ্ববিখ্যাত কার্টুনিস্ট ল্যারি গনিকের যৌথ উদ্যোগে তৈরী পদার্থবিদ্যার কার্টুন প্রশ্ন। এই মজাদার প্রশ্নগুলোর উদ্দেশ্য ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান যাচাই করা নয়, বরঞ্চ ক্লাসে এমন এক পরিবেশ তৈরী করা যাতে সকলে বিজ্ঞান নিয়ে হাসি-মজা আর আড্ডা বা তর্কে মেতে প্রশ্নগুলোর গভীরে যেতে পারে  আর নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সেগুলোর সঠিক উত্তর খুঁজে পেতে পারে। শিক্ষকের দায়িত্ব এক্ষেত্রে প্রশ্ন গুলো দিয়ে তার উত্তর বলে দেওয়া নয়, বরঞ্চ ছাত্রছাত্রীদের আলোচনার সূত্র ধরে সঠিক দিকের দিশা দেওয়া যাতে তারা নিজেরাই যুক্তিযুক্ত সঠিক সমাধানে পৌঁছতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশন এই প্রজেক্টের পৃষ্ঠপোষক।  বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদক ডঃ কাজী বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদক ডঃ কাজী  রাজীবুল ইসলামের অপিরিসীম উৎসাহ এবং অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায় ও ‘বিজ্ঞান’-এর অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকের বঙ্গানুবাদে আমরা ক্রমান্বয়ে এই মজাদার প্রশ্নগুলো নিয়ে পাঠকের দরবারে আসবো। আজ আমাদের প্রথম পর্ব।

[১]  সঞ্জয় উপর দিকে একটা ডিম ছুঁড়লো।

ডিমটা যখন শূন্যে, তখন বায়ু ছাড়া আর কোন কোন বল ডিমটার ওপর ক্রিয়াশীল ?

  1. নিম্নাভিমুখী অভিকর্ষ বল এবং ক্রমাগত বাড়তে থাকা একটা ঊর্ধ্বাভিমুখী বল।
  2. ঊর্ধ্বাভিমুখী গতিপথে সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছনো পর্যন্ত সমানে কমতে থাকা ঊর্ধ্বাভিমুখী বল এবং পতনের সময় ক্রমশ বাড়তে থাকা নিম্নাভিমুখী বল।
  3. প্রায় ধ্রুবক (constant) নিম্নাভিমুখী অভিকর্ষ বল এবং সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছানোকালীন কমতে থাকা ঊর্ধ্বাভিমুখী বল। পতনের সময় শুধুমাত্র ধ্রুবক অভিকর্ষ বল।
  4. প্রায় ধ্রুবক নিম্নাভিমুখী অভিকর্ষ বল।
  5. কোনো বলই নেই। ডিমটা নিচে পড়ছে কারণ ভূপৃষ্ঠে পড়ে স্থির হয়ে যাওয়াই তার প্রবণতা।

[২] সঞ্জয় বঁড়শিতে একটা মাছ ধরেছে যা সমবেগে সে ওপরে তুলছে।

ছিপের সুতো দ্বারা মাছটার ওপর প্রযুক্ত ঊর্ধ্বমুখী বলের ক্ষেত্রে কোনটা সত্যি? আপাতত ঘর্ষণ বলকে উপেক্ষা করা যাক।

  1. এই বলটা নিম্নমুখী অভিকর্ষ বলের চেয়ে বেশি।
  2. এই বলটা নিম্নমুখী অভিকর্ষ বলের সমান।
  3. এই বলটা নিম্নমুখী অভিকর্ষ বলের চেয়ে কম।
  4. এই বলটা নিম্নমুখী অভিকর্ষ বল এবং বায়ুজনিত নিম্নমুখী বলের সমষ্টির চেয়ে বেশি।
  5. কোনো ঊর্ধ্বমুখী বলের অস্তিত্বই নেই। মাছটা ঊর্ধ্বাভিমুখে উঠছে, কারণ ছিপের ঝুলে থাকা সুতোটার দৈর্ঘ্য ছোট হচ্ছে।

[৩] ঊষা O বিন্দু থেকে ঝুলন্ত একটা বট গাছের ঝুড়ি ধরে দুলছে।

A বিন্দুটা দিয়ে যাওয়ার সময় ঊষার উপর এই চারটে বল কাজ করতে পারে:

  1. নিম্নমুখী অভিকর্ষ বল।
  2. উষা যেদিকে এগোচ্ছে, সেই দিকে একটা বল।
  3. ঝুড়ি বরাবর A থেকে O বিন্দুর দিকে একটা বল।
  4. ঝুড়ি বরাবর O থেকে A বিন্দুর দিকে একটা বল।

এর মধ্যে কোনটা (বা কোনগুলো) প্রকৃতই ঊষার উপর কাজ করছে?

  1. শুধু ১।
  2. ১ আর ২।
  3. ১ আর ৩।
  4. ১, ২ আর ৩।
  5. ১, ২ আর ৪।

৪] কিংবদন্তি বলবান বাহুবলী সমতল মেঝের উপর রাখা একটা ভারী বস্তুকে ক্রমাগত একই বলে ঠেলতে থাকেন। এর ফলে বস্তুটা স্থির v দ্রুতি সহকারে এগিয়ে যায়।

সুতরাং, বাহুবলীর প্রয়োগ করা বল:

  1. বস্তুটার ওজনের সমান হবে।
  2. বস্তুটার ওজনের থেকে বেশি হবে।
  3. বস্তুটার গতির বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ বল কাজ করছে, তার সমান হবে।
  4. বস্তুটার গতির বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ বল কাজ করছে, তার থেকে বেশি হবে।

বস্তুটার ওজন অথবা বস্তুটার গতির বিরুদ্ধে কার্যকর বলের থেকে বেশি হবে।


[৫] এবার বাহুবলী বস্তুটার ওপর পূর্বের তুলনায় প্রযুক্ত বল-এর মান দ্বিগুণ করে দিলেন।

দ্বিগুণ বলপ্রয়োগের পূর্বে বস্তু যদি v সমবেগে গতিশীল হয়, তাহলে দ্বিগুণ বলপ্রয়োগের পর তার দ্রুতি কত হবে?

  1. বস্তুটা ২v (2v) সমবেগে (অর্থাৎ পূর্বের দ্বিগুণ বেগে) গতিশীল হবে।
  2. বস্তুটার দ্রুতি v-এর থেকে বেশি হবে কিন্তু দ্বিগুণ-এর থেকে কম।
  3. কিছু সময়ের জন্য বস্তুটা v-এর চেয়ে বেশি কিন্তু সমবেগে গতিশীল হবে এবং তার পর তার দ্রুতি বাড়বে।
  4. প্রথমে বস্তুটার দ্রুতি বাড়তে থাকবে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরে সমবেগে গতিশীল হবে।
  5. বস্তুটার দ্রুতি ক্রমাগত বাড়বে।

[৬] বাহুবলী হঠাৎ বস্তুটার ওপর বলপ্রয়োগ বন্ধ করে দিলেন।

ফলে বস্তুটা:

  1. সঙ্গে সঙ্গে থেমে যাবে।
  2. কিছুক্ষণ সমবেগে চলবে এবং তারপর ধীরে ধীরে দ্রুতি কমে অবশেষে থামবে।
  3.  সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতি  কমতে থাকবে এবং অবশেষে থামবে।
  4. সমবেগে চলতে থাকবে।
  5. কিছুক্ষণ গতিবেগ বাড়বে এবং তারপর ধীরে ধীরে দ্রুতি কমে অবশেষে থামবে।

(এই কার্টুনগুলি ‘বিজ্ঞান’ প্রিন্ট পত্রিকার প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল।)

The post কার্টুনের মাধ্যমে বিজ্ঞানশিক্ষা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

ভালো অঙ্ক খারাপ অঙ্ক

$
0
0

টিফিনের পর পরাণমাস্টার অঙ্কের ক্লাসে ঢুকে ছাত্রদের বললেন, “বুঝলি, ভাবছি এবারের ফাইনাল পরীক্ষায় একটা মজা করব। দশ নম্বরের প্রশ্নের সঠিক উত্তর লিখলে শুধু সাত পাবি। বাকি তিনটে নম্বর পাওয়ার জন্যে উত্তরটাকে সুন্দরও হতে হবে।”

টিফিনের পর সবারই বেশ ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো। এমনকি ক্লাসের ফার্স্টবয় গোপালও জেগে থাকার জন্যে নিজেকে চিমটি কাটছিলো মাঝে মাঝে। এসবের মধ্যে পরাণমাস্টারের এই পিলে চমকানো কথা শুনে সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। যদিও পরাণ এরম কথা মাঝে মাঝেই বলে থাকে। লোকটার আজগুবি কথা বলা আর বাড়িয়ে বলা এই দুটো বদঅভ্যেসই আছে। মাথায় একটু ছিট থাকলে যেরম হয় । তাই এসব শুনে ছেলেরা অতটাও ভয় পায় না আজকাল। পরাণ সাসপেন্স ক্রিয়েট করার জন্য একটু থামলেন। কিন্তু কেউ বিশেষ পাত্তা দিলো না দেখে একটু ক্ষুণ্ণ হয়েই আবার শুরু করলেন, “ধর একটা ত্রিভুজ আছে।” বলে ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকলেন:

“আমরা শিখেছি যে এর তিনটে কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রী।” 

\angle A + \angle B +\angle C =  180^{\circ}

“এটা কেন হয় তোদের দেখিয়েছিলাম। মনে আছে?”

যথারীতি গোপালের মনে ছিল। সে ব্ল্যাকবোর্ডে গিয়ে প্রমাণটা দেখালো।

A ” বিন্দুর মধ্যে দিয়ে  \overline{BC} -র সমান্তরাল একটা রেখা (  \overline{AD} ) আঁকলাম। সমান্তরাল রেখার ধর্ম থেকে আসে:

 \angle B = \angle  ১ ,  \angle C = \angle  ২ ,

আবার এক সরলরেখার ওপর অবস্থিত বলে:

\angle   + \angle  + \angle A = 180^{\circ}

এই দুটো সিদ্ধান্ত একত্র করলে ত্রিভুজের আলোচ্যমান ধর্মটা আসে।”

“বেড়ে বলেছিস!” পরাণ আবার শুরু করলেন, “এবার বলতো এই বহুভুজটার সবকটা কোণের যোগফল কত?” বলে ব্ল্যাকবোর্ডে এটা আঁকলেন:

এবার যে কজন মন দিয়ে শুনছিলো তারা সবাই ভ্যাবাচ্যাকা। খালি গোপাল চাপ নিয়ে খাতায় অনেক আঁকিবুকি কাটলো:

কিন্তু কোন শীর্ষবিন্দু দিয়ে যে সমান্তরাল রেখা টানবে আর কোন বাহুর সাথেই বা সেটা সমান্তরাল হবে তার মাথামুন্ডু খুঁজে পেলো না। 

পরাণ মুচকি মুচকি হাসছেন এমন সময় পেছন থেকে দুর্গার মিনমিনে গলা শোনা গেলো, “আচ্ছা বহুভুজটাকে অনেকগুলো ত্রিভুজে ভেঙে ফেললে হয় না ?”

দুর্গার মিনমিনে গলা শোনা গেলো, “আচ্ছা বহুভুজটাকে অনেকগুলো ত্রিভুজে ভেঙে ফেললে হয় না ?”

পরাণ একটু অবাক হলেন। মন্দ বলেনি মেয়েটা!

“দেখা কিভাবে ভাঙবি।” পরাণের ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ডে সবার অবাধ গতিবিধি ছিল। দুর্গা বোর্ডে এসে এই  লাইনগুলো আঁকলো

তারপর বললো, “বহুভুজের কোণগুলোর যোগফল ওই ছ’ টা ত্রিভুজের কোণগুলোর যোগফলের সমান। একেকটা ত্রিভুজ থেকে আসে ১৮০ ডিগ্রী, সুতরাং মোট কোণের পরিমাণ হলো  ১৮০^{\circ} x ৬ = ১০৮০ ডিগ্রী।”

“একদম সঠিক!”

দুর্গা বেঞ্চে ফেরত গেলে পরাণ আবার শুরু করলেন, “এটা খুবই ভালো সমাধান, কিন্তু আরও ভালো হতো যদি আমাদের শুরুর যুক্তিটা, যেটা দিয়ে ত্রিভুজের ধর্মটা প্রমাণ করেছিলাম সেটা যেকোনো বহুভুজের ক্ষেত্রেই লাগানো যেত, তাই না?”

এই বলে ত্রিভুজের ছবিটায় ফেরত গিয়ে গোপাল যে লেজুড় গুলো জুড়েছিলো সেগুলো মুছে ফেললেন।

“ধর আমি ত্রিভুজের বাহু বরাবর হাঁটতে থাকলাম: প্রথমে B থেকে C , তারপর বাঁক নিয়ে C থেকে A , আবার বাঁক নিয়ে A থেকে B , শেষ বাঁক নিয়ে আবার \overline{BC} রাস্তায় ফেরত।”

“অর্থাৎ আমি শুরুতে যেমুখো যাচ্ছিলাম, এক চক্কর মেরে আবার সেইদিকেই যেতে শুরু করলাম। সুতরাং আমার তিনটে বাঁকের (   \angle ১,   \angle ২, আর    \angle ৩) সমষ্টি হলো একটি পূর্ণকোণ বা ৩৬০ ^\circ ।”

  \angle ১ +   \angle ২ +   \angle ৩ = ৩৬০^\circ

“ত্রিভুজের কোণগুলির সাথে এই বাঁকের কোণগুলির (যাদেরকে ত্রিভুজের বহির্মুখী কোণ বলতে পারি) একটা সোজাসুজি সম্পর্ক আছে:”

  \angle A = 180 - \angle

  \angle B = 180 - \angle

  \angle C = 180 - \angle

“এই দুটো তথ্য থেকে আসে:”

\angle A + \angle B +\angle C =  180 ^{\circ}

“কেমন লাগলো যুক্তিটা?”

কেউ কিছু না বললেও কয়েকজনের মাথা নাড়া থেকে বোঝা গেলো তাদের ভালো লেগেছে।”

“দুটো প্রমাণই সঠিক”, পরাণমাস্টার বলে চললেন, “কিন্তু নতুন প্রমাণটা বেশ সুন্দর লাগলো না? লাগলো কি?” 

অনেকেই আবার উপরনিচে মাথা নাড়লো। 

“কেন লাগলো বলতে পারবি?”

পেছনের বেঞ্চ থেকে দুর্গা মাথা চুলকে বললো, “বইয়ের প্রমাণটায় কথা নেই বার্তা নেই কিরম দুম করে একটা সমান্তরাল রেখা টানতে বললো। এটা মূখস্থ করে রাখতে হবে — নইলে মনে থাকবে না। সেই তুলনায় ত্রিভুজের রাস্তা ধরে হাঁটলে যে পুরো একপাক ঘোরা হয় এটা বেশ মজার জিনিস। নতুন প্রমাণটায় একটা সুন্দর গল্প আছে।”

বইয়ের প্রমাণটায় কথা নেই বার্তা নেই কিরম দুম করে একটা সমান্তরাল রেখা টানতে বললো। এটা মূখস্থ করে রাখতে হবে — নইলে মনে থাকবে না। … নতুন প্রমাণটায় একটা সুন্দর গল্প আছে।

“ভালো বলেছিস!” পরাণ খুশি হলেন, “ওটাই নতুন প্রমাণটার আইডিয়া। আর শুধু ত্রিভুজ নয়, সমতলে যেকোনো সহজ বদ্ধ বক্ররেখার (simple closed curve) জন্যেই এ কথাটা খাটে। অর্থাৎ বক্ররেখাটাকে শেষে এসে নিজের সাথে মিলিত হতে হবে (বদ্ধ), আর মাঝে নিজেকে কোথাও ছেদ করা চলবে না (সহজ)। রেখাটা পুরোটাই বাঁকানো হওয়ার প্রয়োজন নেই — টুকরো টুকরো সরলরেখা জুড়ে বানালেও চলবে। এই হিসেবে আমাদের ত্রিভুজও একটা সরল বদ্ধ বক্ররেখা।   অর্থাৎ এই রেখাগুলোর জন্য আমাদের যুক্তিটা খাটবে:

কিন্তু এইগুলোর জন্য খাটবে না:

খালি দুটো কথা মনে রাখতে হবে:

  1. রেখাটা বহুভুজ না হলে বাঁকগুলো দুম দুম করে ৩-৪ টে জায়গা হয়না – ক্রমাগত একটু একটু করে হতে থাকে।  এক্ষেত্রে মোট বাঁকের হিসেব করাটা একটু কঠিন – তার জন্যে ক্যালকুলাস বা কলনবিদ্যার প্রয়োগ করতে হয়। কিন্ত আমাদের মূল আইডিয়া টা তখনো ঠিক – মোট বাঁকের পরিমাণ এক পূর্ণকোণ বা ৩৬০ ডিগ্রী।
  2. একটা বাঁক কোনদিকে হচ্ছে – ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে সেইদিকে (দক্ষিণাবর্ত/clockwise) না তার উল্টোদিকে (বামাবর্ত/anticlockwise) তার খেয়াল রাখা প্রয়োজন। আমাদের ত্রিভুজের উদাহরণে তিনটে বাঁক-ই বামাবর্ত ছিল।  কিন্তু এই বহুভুজটায় একটা বাঁক দক্ষিণাবর্ত। যোগ করার সময় বামাবর্ত বাঁক-কে ধণাত্মক ধরলে দক্ষিণাবর্ত বাঁক-কে ঋনাত্বক ধরতে হবে।”

“এই ফাঁকে তোদের একটু জ্ঞান দিয়ে দি। সাধারণতঃ আমরা গণিতজ্ঞরা একটা বিষয়ে মোটামুটি একমত: যে কোনো একটা যুক্তি যত সরল, সেটা তত বেশি সুন্দর। প্রচুর কায়দা আর মারপ্যাঁচ ওয়ালা যুক্তি আমরা ততটা পছন্দ করি না। সেই অর্থে আমাদের নতুন প্রমাণটা আগেরটার থেকে বেশি সুন্দর, যদিও দুটোই একদম সঠিক।”

গণিতজ্ঞরা একটা বিষয়ে মোটামুটি একমত: যে কোনো একটা যুক্তি যত সরল, সেটা তত বেশি সুন্দর।

“সরল প্রমাণ ভালো লাগার একটা কারণ হলো অনেক সময়েই তার থেকে আমরা বিষয়টা সম্বন্ধে বেশ গভীর কিছু অন্তর্দৃষ্টি পাই। যেমন এখানে শুরুতে আমরা মাথা ঘামাচ্ছিলাম ত্রিভুজের ভেতরের কোণগুলো নিয়ে, কিন্তু শেষে দেখলাম যে ত্রিভুজের বাইরের কোণগুলোর যোগফল আরও মৌলিক একটা ধর্ম। কারণ সেটা শুধু যেকোনো ত্রিভুজ নয়, যেকোনো সরল বদ্ধ বক্ররেখার ক্ষেত্রেই সবসময় এক পূর্ণকোণ হয়। আর তার কারণ ঐরকম একটা রেখা মোট একপাক ঘুরে আবার নিজেতে ফিরে আসে!” 

“এছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে: সেটা হলো প্রতিসাম্য। এখানে আমরা বার করতে চাইছি . আমাদের প্রশ্নটাতে \angle A , \angle B আর \angle C তিনটে শীর্ষবিন্দুই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রথম প্রমাণটায় A বিন্দুটাকে আলাদাভাবে দেখা হচ্ছে B আর C -এর থেকে। সেটা করা মোটেই ভুল কিছু না, কিন্তু এরকম একটা যুক্তি গণিতজ্ঞদের সৌন্দর্যবোধে একটু খোঁচা দেয়। যেন তিনটে বিন্দুকে সমানভাবে ব্যবহার করে একটা যুক্তি খাড়া করতে পারলে আরেকটু ভালো হতো। আমাদের দ্বিতীয় প্রমাণটা আশাটা পূর্ণ করে।”[1]

“এর থেকে বহুভুজের প্রশ্নটার সমাধান করা তো জলভাত। এটা তোদের হোমওয়ার্ক।” বলে পরাণ গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। ক্লাস শেষের ঘন্টাও বাজলো। 

উৎসাহী পাঠকদের জন্য

[১] Measurement, Paul Lockhart, Harvard University Press (2012)

[২] Proofs from THE BOOK, Martin Aigner, Gunter M Zeigler, Karl H Hoffman, Springer (2013)

~প্রচ্ছদের ছবির উৎস : https://pixabay.com/


[1] বিখ্যাত গণিতজ্ঞ পল এরদিশ মাঝে মাঝে (খানিকটা মজা করেই) বলতেন যে ঈশ্বরের কাছে একটা বই আছে যাতে যাবতীয় গাণিতিক উপপাদ্যের সবচেয়ে সুন্দর ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন প্রমাণগুলো লেখা আছে। একটা যুক্তি বা প্রমাণ তাঁর খুব ভালো লাগলে তিনি বলতেন: “এটা সেই বইটা থেকে নেওয়া!” (“This one’s from the book!”).

গণিতের নানা শাখার বেশ কিছু এরকম সেই বই থেকে নেওয়া প্রমাণ  একত্র করে গণিতজ্ঞ মার্টিন আইগনার আর গুন্টার জিগলার লিখেছেন Proofs from THE BOOK নামে একটি আকর্ষণীয় বই। এই বইটির অনেক প্রমাণই এরদিশের আবিষ্কৃত, বাকিগুলি অন্যদের।  এরকমই একটি প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ‘বিজ্ঞান’-এর এই লেখাটিতে।

The post ভালো অঙ্ক খারাপ অঙ্ক appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

মিউজিয়াম পরিক্রমা –হার্ভার্ডের কাচের ফুল

$
0
0

হার্ভার্ড মিউজিয়াম অফ ন্যাচরাল হিস্ট্রি-তে রয়েছে লিওপোল্ড আর রুডলফ ব্লাশকার তৈরি হাজারো কাচের ফুল! এরা “ঝরে না, মরে না, পোকা ধরে না”, অথচ কি আশ্চর্য জীবন্ত!


শহরের নাম কেমব্রিজ, রাস্তার নাম অক্সফোর্ড স্ট্রীট! নামে ইংল্যান্ডের কোন জায়গা মনে হলেও চার্লস নদীর ধারে গড়ে ওঠা কেমব্রিজ আসলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন শহরের প্রতিবেশী। আর এই অক্সফোর্ড স্ট্রীটের ধারেই একটা পুরনো বিশাল বাড়িতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়াম অফ ন্যাচরাল হিস্ট্রি। ন্যাচরাল হিস্ট্রি অর্থাৎ প্রাকৃতিক ইতিহাস। যেমন, এই মিউজিয়ামে খুঁজে পাওয়া যাবে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা খনিজ ও রত্ন – ম্যালাকাইট, অ্যাজুরাইট, রকমারি জিওড পাথর ইত্যাদি। রকমারি রত্নসম্ভারের পাশের ঘরেই অবশ্য আছে এক হাজারের মত অন্য রকম ‘রত্ন’, যা বিশ্বের খুব বেশী মিউজিয়ামে নেই। পাঠকদের সাথে হার্ভার্ডের কাচের ফুলের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই লেখা!

চিত্র ১ – লিওপোল্ড আর রুডলফ ব্লাশকার তৈরি কাচের রডোডেন্ড্রন ফুল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়াম অফ ন্যাচরাল হিস্ট্রি-তে সংরক্ষিত। ছবিটি হার্ভার্ড মিউজিয়াম অফ ন্যাচরাল হিস্ট্রি-র সৌজন্যে পাওয়া ও কপিরাইট সংরক্ষিত।

চিত্র ১ -এ রডোডেনড্রন ফুলগুলোকে দেখলে বোঝাই মুশকিল যে এগুলো কাচ দিয়ে তৈরি! চার হাজারের বেশি ফুল, ফল, বোটানির বিভিন্ন নমুনা বা স্যাম্পেল ছড়িয়ে রয়েছে মিউজিয়ামে (চিত্র ২), একশো বছরের বেশী সময় ধরে। জার্মানীর বাবা-ছেলে জুটি লিওপোল্ড ব্লাশকা (১৮২২-১৮৯৫) আর রুডলফ ব্লাশকার (১৮৫৭ – ১৯৩৯) তৈরি এই কাচের ফুলগুলো ‘অমর’ হয়ে আজও বিস্ময় তৈরি করছে দর্শকদের মনে। লিওপোল্ড ব্লাশকা কাচের কাজ শিখেছিলেন তার পারিবারিক ব্যবসা থেকে। শোনা যায় একবার ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকায় জাহাজে করে যাওয়ার সময় যান্ত্রিক গোলযোগে জাহাজ আটকে পড়ে মাঝ সমুদ্রে। আটলান্তিকের জলে লিওপোল্ড দেখলেন বহু জলজ অমেরুদন্ডী প্রাণী। তাদের দেহের স্বচ্ছতা দেখে তাঁর মনে কাচের মডেল তৈরি করার সংকল্প জাগল। ইউরোপে ফিরে তৈরি করতে থাকলেন সামুদ্রিক অমেরুদন্ডী প্রাণীদের, যেমন অক্টোপাসের, অসাধারণ সব মডেল। ছেলে রুডলফের সাথে লিওপোল্ড ব্লাশকার তৈরি কাচের বিভিন্ন নমুনা স্থান পেতে থাকল জার্মানীর মিউজিয়ামে। ইউরোপ ছাড়িয়ে তাঁদের সুনাম পৌঁছলো উত্তর আমেরিকায়।

চিত্র ২ – হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়াম অফ ন্যাচরাল হিস্ট্রি-তে সংরক্ষিত রয়েছে লিওপোল্ড আর রুডলফ ব্লাজকার তৈরি বহু কাচের ফুল, যেগুলি প্রায় একশো বছরের পুরনো! ছবিটি হার্ভার্ড মিউজিয়াম অফ ন্যাচরাল হিস্ট্রি-র সৌজন্যে পাওয়া ও কপিরাইট সংরক্ষিত।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ গুডেল এই সময় হার্ভার্ডে বোটানী বা উদ্ভিদবিদ্যা পড়ানোর জন্য ল্যাবরেটরী তৈরি করছিলেন। বোটানী পড়াতে গেলে লাগে বিভিন্ন ফুল, ফল, ও তাদের নানা অংশের নমুনা। কিন্তু, সেই সব নমুনাকে ঠিকভাবে প্রদর্শন করা বেশ সমস্যার। সাধারণত কিছুদিন বাদেই নমুনার রঙ ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে আসে। তাই প্রয়োজন এমন ভাবে সংরক্ষণের, যা হীরক রাজার দেশের বৈজ্ঞানিকের ভাষায়, “ঝরে না, মরে না, পোকা ধরে না।… রঙ হাতে আঁকা।” সেই সাথে বোটানীর নমুনা যেভাবে সংগ্রহ করা হয়, তাতে তাদের ত্রিমাত্রিক গঠন দর্শকের সামনে তুলে ধরাও মুশকিল। ব্লাশকাদের তৈরি কাচের নমুনা তাই মন কাড়ল অধ্যাপক গুডেলের। আসল গাছপালার বদলে কাচের মডেল তৈরি করতে পারলে প্রায় সব সমস্যারই সমাধান হয়। তা সংরক্ষিত থাকবে বছরের পর বছর। রঙ ফ্যাকাসে হবে না। ত্রিমাত্রিক গঠন ভালভাবে দেখানো যাবে। প্রয়োজনমত বিভিন্ন অংশের গঠন বিবর্ধিত আকারেও দেখানো যাবে। অধ্যাপক গুডেল ব্লাশকাদের তাঁর বোটানী ক্লাশরুম প্রোজেক্টে উৎসাহিত করার আশা নিয়ে জার্মানীতে গেলেন। রাজী করালেন ব্লাশকাদের।

প্রথমে কিছু বোটানীর নমুনা তৈরি করে হার্ভার্ডে পাঠালেন ব্লাশকারা। ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকার লম্বা সফরের ধাক্কায় ভেঙে গেল কাচের নমুনা। কিন্তু, তা সত্ত্বেও সেই নমুনাগুলোর উচ্চমান নজর কাড়ল গুডেল ও তাঁর সহকর্মীদের। বোস্টনের সভ্রান্ত ওয়্যার বংশের দুই ভদ্রমহিলার অর্থসাহায্যে ব্লাশকারা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেন বোটানীর মিউজিয়ামের নমুনার উপর কাজ করতে। একে একে তৈরি হতে থাকল অসাধরণ সব কাচের ফুল। কয়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হল। চিত্র ৩ -এ ঝিঙে ফুলের সূক্ষ্ম কাজ, রঙ ইত্যাদি দেখে ব্লাশকাদের হাতের যাদুর ঝলক পাওয়া যায়। বিভিন্ন রঙের কাচ ছাড়াও গঠনগত কাঠামো বজায় রাখার জন্য ব্লাশকারা তারের ব্যবহার করেছিলেন। এই লেখার সাথে তুলে ধরা ছবিগুলি হার্ভার্ড ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের সৌজন্যে পাওয়া। ছবিগুলো কপিরাইট সংরক্ষিত, অর্থাৎ হার্ভার্ড ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ করা যাবে না।

চিত্র ৩ – কাচের লুফফা (ঝিঙ্গে ফুল)। ছবিটি হার্ভার্ড মিউজিয়াম অফ ন্যাচরাল হিস্ট্রি-র সৌজন্যে পাওয়া ও কপিরাইট সংরক্ষিত।
চিত্র ৪ – কাচের জ্যাকারান্ডা ফুল। ছবিটি হার্ভার্ড মিউজিয়াম অফ ন্যাচরাল হিস্ট্রি-র সৌজন্যে পাওয়া ও কপিরাইট সংরক্ষিত।
চিত্র ৫ – কাচের Symphyotrichum ফুল। ছবিটি হার্ভার্ড মিউজিয়াম অফ ন্যাচরাল হিস্ট্রি-র সৌজন্যে পাওয়া ও কপিরাইট সংরক্ষিত।

পরিশিষ্ট – ব্লাশকা ও কলকাতা যাদুঘর!

ব্লাশকারা বিশ্বের বহু মিউজিয়ামের জন্য কাচের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের নমুনা তৈরি করেছিলেন। তাঁদের তৈরি ক্যাটালগে ক্রেতাদের একটা তালিকা পাওয়া যায়। সেই তালিকার মধ্যে রয়েছে কলকাতা যাদুঘরও (চিত্র ৬)। অবশ্য, কলকাতা যাদুঘর কি কিনেছিল ব্লাশকাদের কাছ থেকে, আর সেই কাচের নমুনার হাল বর্তমানে কী, তা অজানা। পাঠকের মধ্যে থেকে কেউ কি কলকাতা যাদুঘরের ব্লাশকার কাচের কাজের খবর দিতে পারবে(ন)?

চিত্র ৬ – ব্লাশকাদের কাছ থেকে কাচের তৈরি প্রাণী বা উদ্ভিদের নমুনা কিনেছিল কলকাতা যাদুঘর। বর্তমানে সেই নমুনার হাল কী তা অজানা। ছবিটি লেখক নিউ ইয়র্ক রাজ্যের কর্নিং গ্লাস মিউজিয়ামের প্রদর্শনী থেকে তুলেছে।

তথ্যসূত্র ও অতিরিক্তঃ

  1. The Glass Flowers at Harvard, Richard Evans Schultes and William A. Davis (Harvard Museum of Natural History)
  2. The Story of Rudolf and Leopold Blaschka, Corning Museum of Glass (Youtube video)
  3. https://hmnh.harvard.edu/glass-flowers

The post মিউজিয়াম পরিক্রমা – হার্ভার্ডের কাচের ফুল appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

ধাঁধকি টাঁড়

$
0
0

‘টাঁড়’ শব্দের অর্থ মাঠ। ‘ধাধকি’ পুরুলিয়ার জেলার একটি গ্রামের নাম। শব্দ দুটোকে জুড়ে, একটা চন্দ্রবিন্দু সাঁটিয়ে, যদি ‘ধাঁধার মাঠ’ কল্পনা করতে চান, ক্ষতি নেই।


১।

দুনিয়ার কোনোখানে এক পায়ে দাঁড়িয়ে
দক্ষিণে এক ক্রোশ গেলে তুমি মাড়িয়ে।
তারপর পুবে গেলে এক ক্রোশ হন হন
শেষমেশ উত্তরে এক ক্রোশ হন্টন।
এইবারে তুমি ঠিক হলে হতভম্ব,
যেইখানে শুরু ছিল সেখানেই সাঙ্গ!
শুরুটা কোথায় ছিল প্রশ্নও সেইটাই ,
মস্কো না হনলুলু, নাকি ছিলে সাংহাই?

(সূত্রঃ দুনিয়াটা গোল!)

২।

যদি দাও এক যোগ ডিগবাজি খাবে সে,
এমনি ভেলকি আছে কার সুখ পরশে?

(সূত্রঃ ৫ ডিগবাজি খেলে হয়ে যায় ১/৫)

৩।

১ থেকে লিখে ফেলো ২০১৮,
মুছে ফেলো দু’জনাকে, ছুটি চাই তাদেরও।
যাদেরকে মুছে দিলে তাদের বিয়োগ দাও,
তারপর লিস্টিতে সেইটুকু লিখে নাও।
(তারপর ফের দুটো সংখ্যা কে মোছা যাক,
তাদের ফারাকটাও লিস্টিতে লেখা থাক।)

এই ভাবে লেখো মোছো লেখো মোছো বার বার,
শেষতক টিঁকবে যে শুধু তাকে দরকার।
যেই জন টিঁকে গেলো ভাগ দাও দিয়ে দুই,
কি পাবে তা বলো দেখি, ফেলে রেখে টইটই।

(সূত্রঃ যদি মোছো ৩ আর ৩৩, লিস্টিতে লেখা হোক |৩৩ – ৩| = ৩০)

১। পৃথিবীর বুকে দক্ষিণে হাঁটছ? তবে তুমি কোনো দ্রাঘিমারেখা ধরে হাঁটছ নির্ঘাৎ।

দক্ষিণে এক ক্রোশ গেলে তুমি মাড়িয়ে

তারপর পুব দিকে যেতে চাও ? তার মানে কোনো এক অক্ষরেখা ধরে চলেছ।

তারপর পুবে গেলে এক ক্রোশ হন হন

শেষধাপে উত্তরে যাবে? তবে আবারও কোনো দ্রাঘিমারেখা ধরেই চলেছ তুমি।

শেষমেশ উত্তরে এক ক্রোশ হন্টন।

তুমি ফিরতে চাও শুরুর বিন্দুতে। অর্থাৎ D এবং A বিন্দুকে মিলতে হবে।

তাহলে মোদ্দা ব্যাপার হল, দুটো দ্রাঘিমারেখাকে উত্তরের দিকে এক বিন্দুতে জুড়ে যেতে হবে। তবে তুমি ফিরতে পারবে শুরুর স্থানে।

(উত্তর দিকে? পশ্চিম থেকে পুবে যে অক্ষরেখা ধরে গিয়েছিলে, তার উত্তরে)​

সোজা উত্তর: উত্তর মেরু (দক্ষিণ মেরু নয় কেন?)  নট সো সোজা উত্তর:   তুমি দক্ষিণ মেরুর কাছে একটা অক্ষরেখাকে বেছে নিলে যার পরিসীমা এক ক্রোশ। নাম দিলাম সুন্দররেখা।

সুন্দররেখা … পরিসীমা ১ ক্রোশ… দক্ষিণ মেরুর কাছে

(এমন একটা অক্ষরেখা পাবোই পাবো? Intermidate Value Theorem.. কি যে বলে…)

এবার সুন্দররেখা থেকে এক ক্রোশ উত্তরের অক্ষরেখার থেকে যে কোনো বিন্দু থেকে তুমি শুরু করতে পারো।

মেফিস্টোফিলিস উত্তর:

এমন আরো অনেক (অনেক অনেক) বিন্দু আছে। তারা কারা?

২।

কার সুখ পরশে?  ধরা যাক, সেই অজানা হল X।

যদি দাও এক যোগ”, অর্থাৎ X+

ডিগবাজি খাবে সেঅর্থাৎ /X

বাকিটুকু জলবৎতরল,

\frac{1}{x}= x+1

x^2 - x - 1 = 0

 X  \cong 0.618  অথবা  X  \cong  -1.618

মেফিস্টোফিলিস উত্তর:

-1 + \frac{1}{x} নিয়ে আমাদের কারবার

 f(x) = -1 + (\frac{1}{x})

আমরা এই অপেক্ষকটির একটি ধার্য বিন্দু (Fixed Point: অর্থাৎ   f(x) = x ) খুঁজছি।

আপাতদৃষ্টিতে আর পাঁচটা অপেক্ষকের মতই লাগলেও উপরের অপেক্ষকটি একটু ঘোরালো ধরনের।

নীচের অবিরত ভগ্নাংশটির (ছোট্টবেলার সিঁড়িভাঙা অঙ্ক) দিকে তাকানো যাক

 -1 + \frac{1}{-1 + \frac{1}{-1 + \frac{1}{-1 + }}}

অবিরত ভগ্নাংশটির (Continued Fraction) মধ্যে আমাদের -1 + \frac{1}{x} লুকিয়ে আছে। কেমন করে? অবিরত ভগ্নাংশটির মান কত​? ধরা যাক এর মান হল X।

এবার লক্ষ্য কর, গোল্লা করা অংশটিও তো আসলে X, তাহলে ব্যাপারটা গিয়ে হলো -1 + \frac{1}{x}

এমনি ভাবে অগণ্যবার (Infinite Times) করলে, আমরা কোন  সংখ্যায় গিয়ে পৌঁছব? মজার ব্যাপার হল, ওই ফাঁকা জায়গাতে যেকোনো সংখ্যা বসিয়ে যদি “পরীক্ষা” করো দেখবে সংখ্যাগুলো -১.৬১৮ এর ধার ঘেঁষে চলেছে।

বি: দ্র: পরীক্ষাতে  x  = 0.618  নেওয়া চলবে না। অর্থাৎ ০.৬১৮ কে বাদ দিয়ে বাকি যেকোনো সংখ্যা নেওয়া যাবে।

এমন কেন হচ্ছে?

৩।

১ থেকে ২০১৮ অবধি সংখ্যা গুলোকে যোগ করলে হয় ১০০৯*২০১৯ (কেন বলত?)

অর্থাৎ যোগফলটা বিজোড়।

এবার মনে করো তুমি a, b কে মুছে দিলে প্রথম ধাপে। ধরা যাক a > b  (দুটোর মধ্যে কোনো একটা বড় হবে আরেকটার চেয়ে, সেটাকেই নাম দাও a)।

তাদের ফারাক হচ্ছে a-b।

এবার দেখা যাক এই মোছা লেখার ফলে যোগফলটার কি হাল হল।

আগে ছিল বিজোড় (২০১৯*১০০৯)। মুছে দিলে a, b এবং লিখে দিলে a-b

অতএব যোগফল দাঁড়ালোঃ বিজোড় সংখ্যা  - (a+b) + (a-b) = - 2b বিজোড়

2b তো একটা জোড় সংখ্যা। তাকে বিজোড় থেকে বাদ দিলে যা পড়ে থাকে তাও নিশ্চয় বিজোড়।

ব্যাস খেল খতম।  প্রতি ধাপে যোগফলটা বিজোড়ই থাকছে। শেষ ধাপে, যখন একটা সংখ্যা পড়ে থাকবে, তখন যোগফল হবে সেই সংখ্যাটাই। সেটাও নির্ঘাৎ বিজোড় হবে। তাকে দুই দিয়ে ভাগ দিলে পড়ে থাকবে ১।

ঋণঃ  শুভদীপ ঘোষ ভাষা পরিমার্জনে সাহায্য করেছেন।

ছবি -https://stock.adobe.com

The post ধাঁধকি টাঁড় appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).


কমপ্লেক্সিটি থিওরির মজার জগৎ

$
0
0

কম্পিউটার কি কি কাজ পারে, আর কি কি কাজ পারে না, সে এক গভীর প্রশ্ন। তার উত্তর খুঁজতে পাড়ি দিতে হবে অঙ্ক ও যুক্তির এক মজার জগতে।


শুরু করা যাক ছোটবেলায় শেখা অঙ্ক দিয়ে।

আমরা গুণ করতে সকলেই শিখেছি। ধরো তোমাকে ৩১ আর ৮৯ — এই দুই সংখ্যার গুণফল নির্ণয় করতে বললাম। কাগজ কলম নিয়ে বসলে গুণটা করতে পাঁচ মিনিটও লাগবে না।  ক্যালকুলেটরে করলে তো কথাই নেই, বোতাম টিপলেই উত্তর।

শুধু এই দুটি সংখ্যা কেন? যেকোনো দুটি সংখ্যা গুণ করাই খুব সোজা।  এক হয় হাতে হাতে করা — ইশকুলে শেখানো পদ্ধতিতে।  তবে খুব বড় সংখ্যা হলে কিন্তু সমস্যা! কেসি নাগের বইয়ের বিভিন্ন অঙ্কের লেজুড় সেই ইয়া বড় গুণগুলো মনে আছে? মাধ্যমিকের আগে পরীক্ষার হলে ক্যালকুলেটর ব্যাবহার করা যেত না৷ ওগুলো হাতে করতে কোনও না কোনও সময় হিমসিম খেতেই হয়েছে! কিন্তু এগারো ক্লাস থেকে এলো ক্যালকুলেটর। অত্যধিক বড় সংখ্যা না হলে ক্যালকুলেটরে টিপতে সাথে সাথেই উত্তর। তখন ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অঙ্কের মোটা মোটা বই, শক্ত শক্ত কন্সেপ্ট।  হাতে ধরে এত গুণ করার সময় কই? এদিকে প্রায় সব অঙ্কেই কত সংখ্যা যে গুণ করতে হবে তার ইয়ত্তা নেই! সেসব সংখ্যা আবার দেখতে ভয়াল — ডেসিমালের পর পাঁচ ছয় ঘর ধরে চলতেই থাকে। দত্ত-পালের ফিজিক্‌সের বইয়ের বা মাইতি-তিওারির ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির বই — সবই ওরকম ভজঘট ভ্যালু দেওয়া অঙ্কে ঠাসা। সবেতেই ভরসা ক্যালকুলেটর বাবাজি।

প্রসঙ্গে ফিরি। গুণ তো হল।  কিন্তু যদি একটু ঘুরিয়ে দি প্ৰশ্নটা? তুমি ধর দিব্বি ভাল মুডে আছ একদিন, হটাৎ আমি বললাম ২৭৫৯ দুটি মৌলিক সংখ্যার গুণফল — সেই সংখ্যা দুটি বের করে দেখাও দেখি। অমনি তুমি জব্দ — মেজাজ ঘেঁটে একশা। আর সহজে  কাগজে কলমে করার উপায় নেই। দিনরাত এক করে খাতা-পেন্সিল নিয়ে বসে ১ থােক ২৭৫৯ অবধি  সবকটা সংখ্যা লিখে কোনটা ২৭৫৯ দিয়ে ভাগ যাচ্ছে টেস্ট করতে না চাইলে একটাই উপায়। কম্পিউটার খুলে C বা Java তে প্রোগ্রাম লেখা। যেকোনো algorithm ক্লাসে শেখানো হয় এরকম একটি প্রোগ্রাম – ১ থেকে শুরু করে ২৭৫৯ এর বর্গমূল অবধি  সংখ্যাগুলির কোনও একটি দিয়ে ২৭৫৯ ভাগ যাচ্ছে কিনা ক্রমাগত পরীক্ষা করা। 

সংখ্যার এই যে নানান মজার বৈশিষ্ট্য, অঙ্কশাস্ত্রে এগুলি বের করা ও চর্চার যে পদ্ধতি, তাকে নাম্বার থিওরি বলে। তা দিয়ে দেখানো যায় যে যদি কোনও সংখ্যা নিজে মৌলিক না হয়, তার বর্গমূলের চেয়ে ছোট কোনও একটি মৌলিক সংখ্যা দিয়ে সে ভাগ যাবেই। যেহেতু ২৭৫৯ দুটি মৌলিক সংখ্যার গুণফল, একটি বেরলে অন্যটি বের করতে শুধু ২৭৫৯ কে সেই মৌলিক সংখ্যাটি দিয়ে ভাগ করলেই হবে৷ তবে এত খেটেখুটে program লিখে যা পাব তা কিন্তু বেশ আশ্চর্যের। ২৭৫৯ যাদের গুণফল সেই সংখ্যাদুটি ৩১ আর ৮৯!

এ কীরকম হল? সংখ্যাটা অপরিবর্তিত, তার মৌলিক উৎপাদক দুটিও অপরিবর্তিত। কিন্তু গুণ করা যতটা সোজা, উৎপাদকে বিশ্লেষণ করা ততটাই শক্ত! তুমি বলবে “শক্ত” কই? খেটে program লিখতে হল বটে, কিন্তু কম্পিউটার যে দিব্বি করে দিল! উত্তর হল ২৭৫৯ বলে পেরেছে, কারণ সংখ্যাটি আজকালকার কম্পিউটারের ক্ষমতার সাপেক্ষে বেশ ছোট। কিন্তু যদি সংখ্যাটি ক্রমেই বাড়াতে থাকি?

একটু খোলসা করা যাক।

আমরা জানি ডিজিটাল কম্পিউটার চলে বাইনারি সিস্টেমে — যা ইনপুট দি, তাকে  প্রসেসরে পাঠানোর আগে ০ আর ১ দিয়ে প্রকাশ করতে হয় । ভেতরের সার্কিট দিয়ে বাইনারিতে রূপান্তরিত করাটা স্বয়ংক্রিয় ভাবেই হয়।  এই যেমন ২৭৫৯ — বাইনারিতে ১০১০১১০০০১১১, ১২ টা বাইনারি ডিজিট দিয়ে লেখা। ধর এরম ১০০০ টা ডিজিট আছে; এমন নাম্বার লেখা আজকের যুগের সুপারফাস্ট কম্পিউটারদের কাছে জলভাত।

কিন্তু দেখানো যায় যে আমাদের আগের algorithm দিয়ে এরকম সংখ্যার মৌলিক উৎপাদক বের করতে যা সময় লাগবে তা মহাবিশ্বের বিগ ব্যাং থেকে আজ অবধি যা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে তার থেকেও বেশি! তুমি তাও বলবে ধুস, এ তো algorithm এর দোষ। কোনও ভাল প্রোগ্রামার কোনও না কোনও ভাবে ঠিকঠাক algorithm লিখে আরামসে উত্তর বের করে দেবে, তা সে ১২ টা ডিজিট হোক বা ১০০০।

কিন্তু না, তাবড় বিজ্ঞানীরাও উৎপাদক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে হোঁচট খান — এরকম কোনও  algorithm আজ অবধি কারও জানা নেই যে! বুদ্ধি খাটিয়ে কম্পিউটার বাবাজী কে একটু তাড়াতাড়ি কাজ করানো যায় বটে — কিন্তু তাতে লাভ হয় যৎসামান্যই। মুশকিল তাহলে আরো গভীরে কোথাও!

আধুনিক কম্পিউটারের জনক Alan Turing কে প্রশ্নটি বেশ ভাবিয়েছিল। আমরাও প্রশ্নটি ভাবব, তবে তার আগে কিছু জিনিস ঠিকমত বোঝা খুব জরুরি।

প্রথমে বুঝতে হবে শক্ত কাহারে কয়।  যা ক্যালকুলেটরের জন্য খুব শক্ত, এই যেমন ২৭৫৯ কে উৎপাদকে ভাঙা, তা কিন্তু ভাঙাচোরা আদ্দিকালের কোনও কম্পিউটারও সহজেই করে দেবে।

কম্পিউটার শব্দটাও বেশ গোলমেলে। কম্পিউটার মানে অনেকের কাছেই যে ছবিটা ফুটে ওঠে তা টেবিলে রাখা একটা মনিটর — সাথে মাউস, কীবোর্ড, সিপিউ। কিন্তু এটাই যে একমাত্র মডেল হতে পারে, তা কে বলে দিল?

কম্পিউটারের মূল কাজ কোনও কিছু গণনা করা — তা করা হয় সিপিউর  খোলের ভেতরের microprocessor বলে যন্ত্রটি দিয়ে। কিন্তু ওরম microprocessor ফ্রিজ, টিভি, মাইক্রোওয়েভ ওভেন — সবেতেই আছে; যন্ত্রের উপর নির্ভর করে আলাদা আলাদা কাজে ব্যবহৃত হয়।

ঠিকঠাক কিছু থিওরি খাড়া করার আগে তাই সব গরুকে এক ঘাটে জল খাওযাতে হবে৷ অতঃপর Turing একটা কাল্পনিক যন্ত্র ডিফাইন করলেন। নাম Turing machine। খুব সহজ সরল যন্ত্র। একটা  অসীম লম্বা টেপ থাকবে – তাতে চৌকো চৌকো খোপ, কয়েকটা খোপে আগে থাকতে কিছু ইনপুট চিহ্ন আঁকা, যেমন ধরো ০ কিংবা ১। একটা “টেপ হেড” থাকবে, কোনও একটি খোপে নির্দেশ করে। টেপ হেডটা জোড়া একটা কট্রোল ডিডাইসের সাথে — সেই ডিভাইসের বেশ কয়েকটা অভ্যন্তরীণ অবস্থা বা স্টেট থাকতে পারে। বর্তমান অবস্থা (স্টেট) আর চিহ্নের ওপর নির্ভর করে মেশিনটি টেপে নতুন কোনও চিহ্ন আঁকতে পারে; আঁকার পরে টেপের ডানদিকে বা বাঁদিকে সরে যেতে পারে; আবার এর কিছুই না করে অভ্যন্তরীণ স্টেটটাই পরিবর্তন করতে পারে। বিশদে জানতে Turing এর আসল পেপারটা পড়ে দেখতে পারো। [১]

টুরিং মেশিনের ছবি

Turing machine এর একটা ছবি [3] জুড়ে দিলাম। এখানে মেশিনটির বর্তমান স্টেট বা অবস্থা “স্টেট রেজিস্টারে” দেখা যাচ্ছে। একটা টেপ হেড আছে, যেটা টেপের কোনও একটা জায়গাকে নির্দেশ করছে। টেপটিতে বিভিন্ন ইনপুট চিহ্ন আঁকা।

কি কি চিহ্ন থাকবে, কি কি স্টেট থাকবে, কখন কিভাবে টেপ হেড সরবে — এ সবই ডিজাইন প্যারামিটার, আগে থেকে ঠিক করা। স্টেট, টেপের চৌকে কি লেখা আছে, আর টেপ হেড কি করতে চায় — এই তিনটে নির্ধারণ করে মেশিনের এর বর্তমান কনফিগারেশন। এরম প্রচুর unique কনফিগারেশন হতে পারে!

শুনতে খুব সহজ লাগছে? এর ক্ষমতা কিন্তু অপরিসীম।  একটু ভাবলেই দেখা যাবে,

মেশিনের বর্ণনা যতই সহজ হোক, এই মেশিন যে কোনও ডিজিটাল কম্পিউটারকে বর্ণনা করার ক্ষমতা রাখে! টেপের চিহ্নগুলি রাইনারি অ্যালফাবেটের ০ আর ১ এ সীমিত রেখে ডিজাইন প্যারামিটারগুলি ঠিকমত সেট করলেই হল।

বিজ্ঞানী Church আর Turing একধাপ ওপরে গেলেন।  তাদের মতে শুধু কম্পিউটার কেন, মহাবিশ্বের যে কোনও computing device কেই simulate করার ক্ষমতা রাখে এই Turing machine! simulate বলতে সোজা কথায় অনুকরণ করা – একটা ক্যালকুলেটরের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুকরণ যেমন একটা কম্পিউটার দিয়ে করা সম্ভব।

সময় কম বেশি লাগতে পারে, মেমরিও কম বেশি লাগতে পারে (সে প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি) — কিন্তু শেষমেশ simulate করতে পারবেই। এই কথাটির কিন্তু কোনও প্রমাণ নেই — গোদা ভাষায় একে বলে hypothesis।  তবে এও সত্যি যে আজ অবধি এরকম কোনও যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি যা hypothesis কে  ভুল প্রমাণিত করে। যদ্দিন না হচ্ছে, Turing machine কেই কম্পিউটেশনের থিওরেটিক্যাল মডেল হিসেবে ধরে বিজ্ঞানীরা যাবতীয় কাজকর্ম করেন।

অনেকে আরও এক কাঠি ওপরে উঠে আরও একটু কড়া ডোজের hypothesis করেন। তাঁদের মতে মহাবিশ্বে যা efficiently computable (মানে সহজভাবে গণনা করা যায়), সবই Turing machine দিয়েও efficiently computable। কিন্তু efficiency মাপা হবে কিভাবে?

উত্তর মেমোরি আর সময় দিয়ে ।

মেমরির একক চৌকো খোপগুলি — কিছু compute করার সময় যতগুলো একক খোপে টেপ হেড সরছে, ততটাই মেশিনের মেমরির ব্যবহার।

সময়ের একক কনফিগারেশন — একটা unique কনফিগারেশন থেকে অন্য একটি একক কনফিগারেশনে যেতে যা সময় অতিক্রান্ত, তা এক ইউনিট সময়।

ডেফিনেশানে আসি। ইনপুট এনকোড করতে ধরলাম n টা বাইনারি অঙ্ক (digit) লাগছে। মেশিন efficient তখনই যখন computation শেষ করতে মেমরি আর সময় যা লাগছে তা  n এর কোনও polynomial বা বহুপদ দিয়ে মাপা যায়।  যত বড় polynomialই হোক না কেন — n^{2} ba n^{1000} — যাহা বাহান্ন তাহা তিপান্ন! আমরা polynomial হলেই খুশি। আরো একটু বিশদে জানার জন্য নিচে একটি লিঙ্ক দিলাম [২]। 

Efficiency যেই মাপা গেল, দু ধরনের `সমস্যার’ (বা complexity class) সাথে চেনা হয়ে যাক।  এদের অন্য রূপে আমরা আগে দেখেছি।  প্রথম ধরনের সমস্যা এরকম polynomial সময়ে সমাধান করা যায়। এদের দ্বারা তৈরি ক্লাসটিকে বলা হয় PTIME বা P।  এই যেমন দুটি সংখ্যার গুণফল — সে ছোট হোক বা বড়!

অন্য ধরণের প্ৰব্লেম এখনো অবধি  polynomial সময়ে সমাধান করা যায় না — এই যেমন উৎপাদকে বিশ্লেষণ।  কিন্তু প্রব্লেমগুলির একটা বিশেষত্ব আছে।  এরম কোনও প্রব্লেমের সমাধান কেউ করে দিলে তুমি সমাধানটা ঠিক না ভুল polynomial সময়ে যাচাই করে দেখে নিতে পারবে।  এদের ক্লাসকে বলা হয় NP। গালভরা নাম Non—Deterministic polynomial time — কেন সেসবে পরে একদিন আসা যাবে।

উদাহরণ দি।  এই যেমন ধর কেউ ২৭৫৯ সংখ্যাটি দিয়ে বলল এর মৌলিক উৎপাদক ৩১ এর ৮৯।  তুমি দিব্বি  গুণ করে দেখে নিলে ৩১ এর ৮৯ এর গুণফল আদপে ২৭৫৯ কিনা । প্রশ্ন আসবে ৩১ বা ৮৯ মৌলিক সংখ্যা কে বলে দিল? তাও polynomial সময়েই যাচাই করে নেওয়া যায়, কিভাবে সেই আলোচনা পরে একদিন হবে।  ছোট্ট গল্প — কোনও সংখ্যা মৌলিক কিনা তা বের করতে যে বিশ্বখ্যাত AKS algorithm ব্যবহৃত হয়, তা আবিষ্কার করেছিলেন তিনজন ভারতীয়।

একটু ভাবলেই দেখবে সব P প্রব্লেমই আসলে NP।

ধর তোমাকে ৩১ এর ৮৯ গুণ করতে দিলাম, সমাধানও দিলাম ২৭৫৯। আমার সমাধান ঠিক না ভুল যাচাই করতে কি করবে? গুণটা নিজে করে দেখবে! যেহেতু গুণ করতে polynomial সময় লাগে, সমাধানটা যাচাই করতেও polynomial সময়ই লাগবে।

উলটোদিকটাও কি সত্যি? যার সমাধান দেওয়া থাকলে polynomial সময়ে দিব্বি যাচাই করতে পার, তাকে কি polynomial সময়ে সমাধান করতে পার না? খুব সরল প্রশ্ন!

কিন্তু মজার ব্যাপার, এর উত্তর কেউ জানে না ! এটি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অমীমাংসিত সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম । কেউ উত্তর দিতে পারলে সে পাবে Clay Mathematics Institute থেকে এক মিলিয়ন ডলার।

আচ্ছা,পাতালঘরের মতো কল্পবিজ্ঞানের সিনেমা তো তোমরা অনেকেই দেখেছ। কত হরেক রকম যন্ত্র ছিল সেখানে, সবই বিজ্ঞানের উপহার। আর এখন তো artificial intelligence এরই যুগ। অনেক AI skeptic ভয় পান যে একদিন যন্ত্র বা মেশিন সর্বেসর্বা হয়ে মানুষের ওপর ছড়ি ঘোরাবে।

এরম কি কখনো হতে পারে? এই যে আমরা মানুষ, আমরা মেশিনের থেকে ঠিক কিভাবে আলাদা? মেশিন কি কোনদিন মানুষ হতে পারে? মানুষ হওয়া মানেই বা কি? মানুষের জ্ঞানের স্বরূপই বা কি? আমরা এই যে কবিতা লিখি, ভাল ছবি দেখলে বা ভাল গান শুনলে খুশি হই, এরকম মেশিন পারবে? এরম প্রচুর প্রশ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে biology, philosophy, economics ও আরও কত বিষয়ে! ভাবলে অবাক হবে এ সবের গোড়াতে P vs NP। কীভাবে? পরবর্তী প্রবন্ধগুলিতে ক্রমশ প্রকাশ্য!

আর একটি মজার ব্যাপার। এই যে  Church—Turing hypothesis এর কড়া ভার্সন, যাকে বলে Extended Church—Turing hypothesis, এটি কিন্তু মোটেই  সত্যি না। বিজ্ঞানী পিটার শর ১৯৯8 সালে দেখান যে (কোয়ান্টাম কম্পিউটার নামক এক আজব কম্পিউটারে কিছু স্পেশাল NP prob1em দিব্বি efficiently polynomial সময়ে সমাধান করা যায় — Turing machine দিয়ে যা কখনওই সম্ভব না।

কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য নতুন এক complexity class তৈরি করে অনেক কিছু কেঁচে গণ্ডূষ করতে হয় ।  সেসব  নিয়েও আলোচনা হবে। তবে হ্যাঁ, Turing machine যা একেবারেই পারে না — efficiently হোক বা না হোক — তা কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারের দ্বারাও পারা সম্ভব না।  তাই মূল Church—Turing hypothesis এখনো অক্ষত।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার সুদূর ভবিষ্যতে তাও তৈরি করা সম্ভব বলে মানা হয় — অনেকে তৈরি করার প্রচুর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।  দুর্জনে কিন্তু আরও এলাহি সব কম্পিউটারের কথা বলে — যা তৈরি করা

দূর অস্ত, ভারতেও বেকুব হতে হয় । অনেকেই Time machine এর গল্প পড়েছ নিশ্চয়ই।।  যদি ওরম এক Time Machine থাকত? সাথে থাকত কোয়ান্টাম কম্পিউটারও৷ ভাবছ যা ইচ্ছে তাই করা যেত? গুলি মারি Church-Turing কে! না কিন্তু।  অঙ্ক কষে দেখানো যায় যে তখনো Church Turing hypothesis এর থেকে বেরোনোর কোনও উপায় নেই। এরকম অতিবাস্তব জগতে বাস্তবের অপেক্ষা খুব কিছু বেশি যে করা যাবে, এমনটাও না! সেসবের কথা পরে হবে। কিন্তু এরকম শুনে ভীষণ অবাক ইচ্ছ নিশ্চয়ই? ওয়েলকাম টু দ্যা ওয়ার্ল্ড অফ complexity theory!

References:

  1. Alan Turing. “On Computable Numbers, with an Application to the Entscheidungsproblem”, Proceedings of the London Mathematical Society, Volume s2-42, Issue 1, 1937, Pages 230–265
  2. Alan Cobham. “The intrinsic computational difficulty of functions.” Logic, methodology and philosophy of science, Proceedings of the 1964 International Congress, edited by Yehoshua Bar-Hillel, Studies in logic and the foundations of mathematics, North-Holland Publishing Company, Amsterdam1965, pp. 24–30.
  3. https://gyires.inf.unideb.hu/GyBITT/26/ch04.html

(প্রচ্ছদের ছবির সূত্র, কৃতজ্ঞতা: http://tosya.magdalene-project.org/turing-machine/)

The post কমপ্লেক্সিটি থিওরির মজার জগৎ appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

বিজ্ঞান পত্রিকা (প্রিন্ট), দ্বিতীয় সংখ্যা

$
0
0

বিজ্ঞান পত্রিকা-র দ্বিতীয় মুদ্রণ সংখ্যা প্রকাশিত হলো! দৈনিক কাগজের থেকে গভীরে কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের থেকে মনোগ্রাহী প্রাঞ্জল ভাষায় বিজ্ঞান জানতে চাইলে এই সংখ্যাটি সংগ্রহ করুন। নিচে পত্রিকার সম্পাদকীয় অংশটি তুলে ধরা হলো। সবশেষে, বইটা কোথায় কেনা যেতে পারে, তার ঠিকানা দেওয়া হলো।


আমরা একবিংশ শতাব্দীর বাসিন্দারা বিগত কয়েকশো বছরের বিজ্ঞান উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। বড় হয়েছি বিজ্ঞানের ছত্রছায়ায়। কিন্তু সেই বিজ্ঞান আমাদের জীবনের প্রতিটি অংশে মিশে থাকা সত্ত্বেও যেন বহুদূরে চলে গেছে। বিজ্ঞানের একদম প্রথম সারিতে কোন লড়াইটা চলছে, সেটা আমরা সাধারণরা যে বুঝতে পারবো, সেই আশা করাও ধৃষ্টতা মনে হয়। সমাজে ধনসম্পদের বৈষম্যের মতো জ্ঞানের জগতেও একটা বৈষম্য দেখা দিয়েছে বলা যায়। ইন্টারনেট-এর কল্যাণে তথ্যমূলক জ্ঞান হাতের নাগালে এসে গেলেও অনেক তথ্যের মর্মোদ্ধার করতে যে ফুটনোটগুলো চাই, সেগুলো যেন হারিয়ে গেছে।

এই বৈষম্যকে দূর করতে এবং বিজ্ঞানকে আবার মানুষের ধরাছোঁয়ার নাগালে নিয়ে আসতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এক বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ তৈরি করার লক্ষ্যে সকলকে সামিল করাই তাদের উদ্দেশ্য। বাংলাতে ‘বিজ্ঞানএমনই একটা প্রয়াস। কথ্য ভাষায়, মাতৃ ভাষায় বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের খবরগুলি ত্রুটিহীন ভাবে প্রচার ও প্রসার করার উদ্দেশ্য নিয়েই “বিজ্ঞান” মাঠে নেমেছে। কয়েক বছর ইন্টারনেট-এ বাসা করার পর ২০১৮-র শেষে পত্রিকাটির প্রথম মুদ্রণ সংখ্যা বার হয়েছিল bigyan.org.in ও কন্টাই সায়েন্স অ্যাকাডেমীর যৌথ উদ্যোগে। সেই সংখ্যার সাফল্যের পর সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে প্রকাশিত হতে চলেছে দ্বিতীয় সংখ্যা। গত কয়েক মাসে সমস্ত স্তরের পাঠক/পাঠিকাদের কাছ থেকে যে উৎসাহ আমরা পেয়েছি সেটাই এই দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের মূলধন। স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই সংখ্যা পরিভ্রমণ করেছে কলেজ, গবেষণা কেন্দ্র এবং বিজ্ঞানমেলা প্রাঙ্গণ সহ আরও বিভিন্ন জায়গায়।

গত সংখ্যার মতো “বিজ্ঞান” পত্রিকার এই সংখ্যাতেও পাতায় পাতায় আছে নতুন আবিষ্কারের গল্প, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা নিত্য নতুন গবেষণার হাল হকিকত।  তবে আমরা “বিজ্ঞান”-এর সদস্যরা এটাও বুঝি যে সবাই একভাবে শেখে না। তাই শুধু লেখা পড়ে নয়, আছে বিভিন্নভাবে বিজ্ঞান শেখার সুযোগ – কার্টুন-এর সাহায্যে প্রশ্নোত্তর, মজার ধাঁধা এবং হাতেকলমে নিজে বাড়িতে বসে করতে পারবে এমন কিছু সহজ পদ্ধতি।  আর এসবই সহজ বাংলায় লিখছেন সেইসকল বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানপ্রেমী যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এইসব গবেষণার সাথে যুক্ত। অর্থাৎ, একদম বিজ্ঞানের আজকের গবেষণা সরাসরি গবেষকদের কাছ থেকে পৌঁছে যাচ্ছে তোমাদের কাছে।

কিরকম গবেষণা? ধরো, খবরের কাগজে পড়লে “মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কার হয়েছে”।  কিন্তু সে যে কি জিনিস এবং কেনই বা এত গুরুত্বপূর্ণ সেটা ভালো করে বোঝানো আছে, এমন লেখা খুব বেশি নেই।  বিজ্ঞানীরা বলছেন এই তরঙ্গ বের করা এত কঠিন কাজ যেন খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা।  কারণ এই তরঙ্গ নাকি ভীষণ ক্ষীণ। এখন প্রশ্ন হলো, হাজার হাজার তরঙ্গের মাঝে বিজ্ঞানীরা এই ক্ষীণ তরঙ্গ খুঁজে পেলেন কিভাবে? সেটা জানতে মন চাইবে বইকি। সেই জানার ইচ্ছে মেটাতে গবেষণার সাথে সরাসরি জড়িত এক বৈজ্ঞানিক লিখছেন সেই বিশাল কর্মকাণ্ড নিয়ে।

যদি তোমাকে কেউ প্রশ্ন করে, এই মহাবিশ্বে প্রথম আলো এসেছিল কি ভাবে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, প্রথম আলো? তুমি ভাবছ সূর্যের কথা, সে তো এই সে দিনের নক্ষত্র।  তারও অনেক লক্ষ বছর আগে কেমন ছিল?  খুব বেশী ভাবার প্রয়োজন নেই, সেই গল্পটাই তোমাদের শোনাবেন প্রফেসর নিধিরাম পাটকেল-এর ছদ্মবেশে এক কসমোলজিস্ট। 

তারপরে ধরো, আমরা প্রায়ই শুনে থাকি বৈদিক গণিতের কথা। বেদের যুগে নাকি আধুনিক গণিতের অনেক ধারণাই ছিল। কিন্তু সেটা কি সত্যি নাকি অতিরঞ্জন? আর, এই ‘বৈদিক গণিত’ বলে যা প্রচলিত তা কি সত্যিই বেদের যুগেরই আবিষ্কার? অনেকসময় এইসব না ভেবেই আমরা পূর্বপুরুষদের জন্য গর্ববোধে মেতে থাকি। পত্রিকার এই সংখ্যাতে আমরা জেনে নিতে পারবো ঠিক কবে এবং কতটা অগ্রগতি হয়েছিল আমাদের প্রাচীন গণিত বিদ্যার।  তাহলে হয়ত ভবিষ্যতে আমরা মিথ্যেটাকে এড়িয়ে যথার্থ কারণে গর্ববোধ করতে পারবো।

শুধু গ্রহনক্ষত্র নয়, বিজ্ঞানের প্রশ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও চারিদিকের পরিবেশে। আচ্ছা বলতে পারবে, সাবান কি করে ময়লা পরিষ্কার করে? জানি তো, অনেক অনেক ফেনা হয়।  কিন্তু কেন সাবান ঘষলে আমাদের জামা কাপড়ের তেলচিটে দাগ উঠে যায় সেটা কি ভেবে দেখেছ কখনও? কিম্বা জানো কি, শুধু মানুষ নয়, পিঁপড়েরাও চাষ করে? চমকে গেলে তো!  ভাবছো, পিঁপড়েরা আবার চাষি হ’ল কবে থেকে? কি চাষ করে? কাদের জন্য করে? এইসব প্রশ্নের উত্তরগুলো এই সংখ্যাতেই পাবে।

বা হয়তো তোমার ঘরে একটা কম্পিউটার পড়ে আছে, ই-মেল আর ইন্টারনেট ঘাঁটার বাইরে কিছু করা হয়না। প্রোগ্রামিং শিখতে চাও, কিন্তু কেউ একটু ধরিয়ে দিলে ভালো হতো।  তাই যদি ভাবো তাহলে ভয় পাবার কোন কারণ নেই, এই সংখ্যাতে তারও একটা সমাধান পাবে। 

এইরকমই নানান পাঁচমেশালি বিষয়ে লেখা আছে এই সংখ্যায়। এবং এতো রকমের বিজ্ঞান নিয়ে বলা ও ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকার কথা বহু মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এর পিছনে বহু বিজ্ঞানপ্রেমীর ভূমিকা আছে। তাদের মধ্যে বিশেষ করে ধন্যবাদ জানাতে চাই জনপ্রিয় রেডিও ব্যক্তিত্ব মীরকে, যিনি সম্পূর্ণ অব্যবসায়িক উদ্যোগে ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকার কথা পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর বহু শ্রোতার কাছে। ধন্যবাদ জানাই বসু বিজ্ঞান মন্দিরকে, বিশেষত অধ্যাপক গৌতম বসুকে, যাঁর অসামান্য উৎসাহ আমাদের অনুপ্রাণিত করে বারবার। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলাতে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের স্টলে ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকা স্থান পেয়েছে প্রবাদপ্রতিম সব বিজ্ঞানসাহিত্যের সাথে এক টেবিলে। এছাড়াও ‘বিজ্ঞান’-এর প্রসারের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই আকাশবাণী কলকাতার ডঃ মানস প্রতিম দাসকে, যিনি আজ প্রায় দু’দশক ধরে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানপ্রসারের দুরূহ কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন, ও তাঁর লেখনীতে ‘বিজ্ঞান’-কে সমৃদ্ধ করেছেন।

তাহলে আর কি, শুরু হোক পাতা ওল্টানো। বিজ্ঞান ভালোবাসো কিম্বা ভয় পাও, যেই হও না কেন, ‘বিজ্ঞান’ পত্রিকা তোমারই জন্য।

জনপ্রিয় রেডিও মির্চি হোস্ট মীর-এর সাথে আলোচনায় বিজ্ঞান টীম-এর রাজীবুল ও স্বাগতা। বিজ্ঞান পত্রিকা ছাড়াও আলোচনায় উঠে এলো নানারকম প্রশ্ন: স্কুলের বই-এর বাইরে আমরা বিজ্ঞান নিয়ে কেন ভাববো, মানুষের কাছে বিজ্ঞানের খবরের  উৎসগুলো কি আর সঠিক ও ভুয়ো খবরের যাচাই করার পদ্ধতি কি হওয়া উচিৎ।

বইটার মূল্য: ৩০ টাকা

যেখানে যেখানে বইটা পাওয়া যাবে:

কলকাতা

দে বুক স্টোর (দীপু),১৩ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট,কলকাতা ৭০০০৭৩মোবাইল: ৯১৪৩৫৪৯৯৭০

পশ্চিম মেদিনীপুর

ভূর্জপত্র বই দোকান, তাঁতিগেড়িয়া লেবেল ক্রসিং, মেদিনীপুর

পূর্ব মেদিনীপুর

রয়েল আই.টি.আই., প্রফেসর কলোনী, কন্টাই, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ-৭২১৪০৪

ই-মেল: baruncontai@gmail.com

এছাড়াও, আপনি যদি আপনার স্কুল-এর জন্য কিংবা ক্লাব-এর জন্য একসাথে অনেকগুলি বই কিনতে চান, তাহলে আমাদের ইমেল করুন bigyan.org.in@gmail.com এই ঠিকানায়।

The post বিজ্ঞান পত্রিকা (প্রিন্ট), দ্বিতীয় সংখ্যা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

পাঠকের দরবারে: মানুষের বিভিন্ন আবেগ কি জন্মগত না অর্জিত

$
0
0

মানুষের আবেগ এবং ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশে কার প্রভাব বেশি? জিন নাকি পরিবেশ? পাঠক সোহম দে-র প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন ড: অরুণিমা রায় এবং ড: তনয় মাইতি।


ড: অরুণিমা রায়

প্রথমেই একটি প্রকারভেদ করা যাক।

আবেগ শব্দের অর্থ আলাদা করে বলছি না, তা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু কিছু আবেগ ঠিক আবেগের পর্যায়ে থাকে না – তা আমাদের চরিত্রের অংশ হয়ে ওঠে।

যেমন ধরো রাগ আমরা কোনও না কোনও সময়ে সকলেই করে থাকি। কিন্তু পাড়ার বদমেজাজি কাকু – সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইলেও চোটপাট করবেন, ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বাড়ির বাগানে বল ঢুকে গেলে তা নিয়েও পাড়া মাথায় করবেন।  

তেমনি আবার ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে বসা মুখচোরা ছেলেটি।

আমরা অনেক জায়গাতেই একটু একাকীত্ব পছন্দ করি, হয়ত যখন কোনও জটিল থিওরেম ভাবছি, বা যখন অফিসের ধকল সামলে বাড়িতে এসে নেটফ্লিক্সে প্রিয় অনুষ্ঠান দেখছি। কিন্তু অন্তর্মুখী বা বহির্মুখী হওয়া – তা কিন্তু এরম বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, তা চরিত্রের গোড়ার ব্যাপার।

এবার প্রশ্ন হলো, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য (personality traits) আর আবেগ (emotional traits), কোনটার কতটা জন্মগত, কতটাই বা অর্জিত। এই বিষয়টা নিয়ে গবেষণা চলছে। আমরা খুব স্পষ্টভাবে জানি না।

কিছু জিনিস অবশ্য জানা গেছে।

প্রথম হল, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলার মালমসলার শতকরা ৪০-৬০ শতাংশ জন্ম থেকে পাওয়া। আবেগের ক্ষেত্রে তা একটু কম, শতকরা ২০-৫০ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে শতাংশের হিসেবটা খুবই কাঁচা, জানার চেয়ে অজানার পরিধিটাই এখানে অনেক বেশি।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলার মালমসলার শতকরা ৪০-৬০ শতাংশ জন্ম থেকে পাওয়া।

এখানে প্রাসঙ্গিক, আবেগ চরিত্রের মজ্জাগত ব্যাপার নয় বটে, কিন্তু আবেগ আর  চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ফারাকটা খুবই সূক্ষ্ম – ডিপ্রেশন, anxiety এইসবের প্রভাব চরিত্রের ওপর পড়তে পারলেও ব্যাপারগুলিকে emotional trait বা আবেগ হিসেবেই ধরা হয়। এদের treatment আছে; anxiety বা clinical depression অনেক সময়েই সেরে যায়। কিন্তু অন্তর্মুখী হওয়া কোনও রোগ না। আগেও যেমন বলা হয়েছে, অন্তর্মুখীতা আমাদের চরিত্রের প্রতিফলন।       

অনেকটা সেইকারণেই অনেক বিজ্ঞানী অনুমান করেন যে আবেগের ক্ষেত্রে অর্জিত উপকরণ বেশি।

চরিত্র একটা খুবই লম্বা সময় ধরে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অপরিবর্তিত থাকে। খুব আকস্মিক বা তীব্র পরিবর্তন না এলে চরিত্র পালটায় না। যে ছেলে ভারতে মুখচোরা, সে বাইরের দেশে Ph.D. করতে এসে হটাৎ ভীষণ মিশুকে আর প্রগলভ হয়ে যাবে, এরম ঠিক হয় না।

আবেগ কিন্তু সেই তুলনায় সদা পরিবর্তনশীল। কোনোদিন মুড ভালো, যেমন ধরো অফিসে প্রমোশন হবার পর। কোনোদিন একদমই মুড অফ। বসের সাথে প্রচুর ঝামেলা হবার পর বা ইন্ডিয়া বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল হেরে যাওয়ার পর। তাই যদিও অখন্ডনীয় প্রমাণ পাওয়া যায় নি, আবেগের উপর পরিস্থিতির চাপ স্পষ্ট।

অর্জিত ও জন্মগত উপকরণ সময়ের সাথে সাথে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যতে কতটা প্রভাব ফেলে তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেকের মতে জন্মগত উপকরণের প্রভাব সময়ের সাথে প্রায় অপরিবর্তনীয় [১]। অন্যদিকে, অর্জিত উপকরণের প্রভাব গোড়ার দিকে শূন্য। তা বয়সের সাথে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ৩০ বছর বয়সের পর চরিত্রে যা পরিবর্তন, তার প্রায় সবটুকুই অর্জিত – পারিপার্শ্বিক অবস্থার দরুন।

কিন্তু ৩০ বছরের আগে কীরকম? অনেক বাবা-মাই ভাবেন বয়ঃসন্ধিকাল চরিত্র গঠনের মূল সময়। ছেলেমেয়ে বখে যায় বয়ঃসন্ধিতেই। তা কতটা সত্যি?

৩০ বছর বয়সের পর চরিত্রে যা পরিবর্তন, তার প্রায় সবটুকুই অর্জিত – পারিপার্শ্বিক অবস্থার দরুন।

কিছুটা সত্যি তো বটেই। পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছিল বেশ কয়েকজন যমজ বোনের বয়ঃসন্ধি থেকে যৌবনে বেড়ে ওঠার কালে। মনোবিজ্ঞানীরা এরম `twin study’ প্রায়ই করে থাকেন। বিজ্ঞানীরা তাদের চরিত্রের নানা দিক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন [২]।

বেড়ে ওঠার সময়কালকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে [২] – বয়ঃসন্ধির অবসানকাল (১৭ – ২৪ বছর), আসন্ন যৌবনকাল (২৪ – ২৯ বছর), ও যৌবনকাল (২৯ বছর)। দেখা গেছে চরিত্রগঠনে প্রথম পর্যায়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। পরের পর্যায়গুলি মোটামুটি স্থিতিশীল।

আরও একটা মজার জিনিস লক্ষ করেছিলেন এঁরা। এই যে  রাগ, কান্না, হাসি, লজ্জা, ঘেন্না – এই সব কিছুর অবদান নিয়ে একটা variable ডিফাইন করা হয়ে থাকে – নাম negative affectivity। কম negative affectivity মানে সে খুব শান্তশিষ্ট, ধীর, স্থির – সহজে রেগে যায় না। বেশি মানে সেই পাড়ার বদমেজাজি, খিটখিটে কাকু। তা বয়সের সাথে সাথে নাকি negative affectivity কমতে থাকে। মানে যে ছেলেটি বয়ঃসন্ধিকালে চালচুলোহীন, বদমেজাজি – যে কিনা  রকে আড্ডা, বাড়িতে লুকিয়ে সিল্ক কাট খাওয়া, কলেজ বাঙ্ক করে সিনেমা দেখা, কিছুই বাকি রাখেনি – সেই কিন্তু তিরিশ পেরলে দায়িত্ববান সংসারী ও চাকুরীজীবী।

এই যে বারবার জন্মগত শব্দটা ব্যবহার করছি, ঠিক কোন জিনগুলি এঁর জন্য দায়ী? তা নিয়েও অনেক গবেষণা আছে [৩]। এই যে বিভিন্ন আবেগের সমাহার, প্রত্যেকটির জন্য একটি করে জিন আছে। অনেকগুলি আবেগ আবার গভীরভাবে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। বহির্মুখীরা নাকি বেশ সহানুভূতিশীল হয় – ওই জিন-এর জন্যই। কয়েকটি আবেগ – এই যেমন খামখেয়ালী (neurotic) হওয়া – নাকি পুরোটাই জিনগত, পরিপার্শ্বের খুব একটা প্রভাব নেই সেগুলিতে।

শেষ করি দুটি মজার থিওরি দিয়ে। আগেই বলেছি প্রচুর গবেষণা এখনো হয়ে চলেছে প্রশ্নটি নিয়ে, যা শতকরা হিসেব দেওয়া হয়েছে, তা খুবই কাঁচা। তা একদল বিজ্ঞানী মনে করেন চরিত্রের ক্ষেত্রে জন্মগত প্রভাবেরই আধিপত্য – তাঁদের hypothesis এর নাম intrinsic maturation hypothesis। আরেকদল মনে করেন প্রভাবগুলি অর্জিত – যা কিনা life-course hypothesis।

জিন না পরিবেশ? এই মূল তর্কটি আসলে অনেক পুরনো, শুধু মনস্তত্ব নয়, দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান – অনেক কিছুতে এর প্রভাব। ছোট্ট একটি নামও দেন অনেকে – nature versus nurture।  তুমি কোন দলে? দুই দলের যুক্তিগুলি বিশদে পড়ে দেখতে পারো।

Bibliography:

[১]  “Genetic and Environmental Continuity in Personality Development: A Meta-Analysis”, Briley et al.

[২] “Genetic and environmental influences on personality trait stability and growth during the transition to adulthood: A three wave longitudinal study”, Hopwood et al.

[৩] “Genome-wide analyses for personality traits identify six genomic loci and show correlations with psychiatric disorders”, Lo et al.

ড: তনয় মাইতি

জন্মগত না অর্জিত – কোনটা বড়? বিজ্ঞানীরা আজ বলেন দুটোই বড়। প্রমাণ তাই বলছে। বিজ্ঞান বহুমুখী, তাই একই ঘটনার বিভিন্ন প্রকারের ব্যাখ্যা সম্ভব।

আবেগ শরীর, মননক্ষমতা, ও আচার-আচরণের বহিঃপ্রকাশ। মনোবিজ্ঞানীরা আবেগ ছাড়াও আরও দুটি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট শব্দ ব্যাবহার করে থাকেন। একটি হল `temperament’ বা স্বভাব। স্বভাব দিয়ে মূলত খুব ছোট বাচ্চাদের মনস্তত্ত্ব বোঝা যায়। অন্যটি `personality’ বা ব্যক্তিত্ব। তা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।

স্বভাব মূলত জন্মগত, জেনেটিক থিওরি দিয়ে প্রায় পুরোটাই ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথম দিকে বাচ্চাটি কি খাচ্ছে, কার সাথে কিভাবে কখন কী কথা বলছে, কখন কাঁদছে, কখন কোথায় কতটা মনোযোগ দিচ্ছে – প্রায় সবই জিনের কারসাজি, বাবা-মার থেকে পাওয়া।

স্বভাবের থেকেই সময়ের সাথে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। কেউ তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে কিভাবে মিশছে, তা ব্যক্তিত্বের বিকাশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জিনের প্রভাবও কিন্তু আছে। ব্যক্তিত্বের জাতিগত প্রকারভেদের জন্য জিন ও পরিবেশ দুটোই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সেরোটোনিন ট্রান্সপোর্টার জিন, অক্সিটোসিন রিসেপ্টর জিন ও ডোপামিন রিসেপ্টর জিন আচরণে ও মনস্তত্ত্ব বিকাশে সাহায্য করে। বিভিন্ন জাতির ক্ষেত্রে জিনগুলি বিভিন্ন রূপে ব্যাক্ত হয়, যাকে `genetic polymorphism’ বলে। স্বভাবের ক্ষেত্রেও এদের প্রভাব আছে। শুধু এই দুই জায়গাতেই না, অক্সিটোসিন রিসেপ্টর জিনের প্রভাব আরও অনেক বিচিত্র জায়গায় দেখা গেছে – যেমন বাচ্চাদের কাঁদার ক্ষেত্রে, আত্মমর্যাদার বিকাশের ক্ষেত্রে, কারো বহির্মুখী বা অন্তর্মুখী হওয়ার ক্ষেত্রে, কোনও কিছু নিয়ে আশাবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে, কোনও পরিবেশে একাকীত্ব অনুভব করার ক্ষেত্রে।

এক কথায় বলতে গেলে আমাদের চরিত্রের বিকাশ দুই সমান্তরাল প্রক্রিয়ার পরিণাম – প্রথমটি জিনের অভিব্যাক্তি, দ্বিতীয়টি পরিবেশের চাপ। অভিভাবক বা বংশের পূর্বপুরুষরা তাই কিছুটা দায়ী – জন্মগত উপাদানগুলি সবই তাঁদের থেকেই। তবে বাকিটা কিন্তু পরিবেশ।

ছবির ঋণ স্বীকার : https://www.shutterstock.com/

The post পাঠকের দরবারে: মানুষের বিভিন্ন আবেগ কি জন্মগত না অর্জিত appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

সাইজ-এর মাহাত্ম্য

$
0
0

দৈত্যাকার মানুষ কি সত্যিই হতে পারে? জলহস্তীর সাইজের খরগোশ কিম্বা পুঁটিমাছের সাইজের তিমি হতেই বা অসুবিধে কোথায়?


পশুজগতে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে সেটা হলো সাইজের বৈচিত্র্য। কিন্তু কোনো কারণে প্রাণিবিশারদরা সেই নিয়ে প্রায় মাথা ঘামাননি। আমার সামনে জু’লজি-র একটা ইয়াব্বড় পাঠ্যপুস্তক রয়েছে। তাতে কোথাও ইঙ্গিত পাইনা যে ঈগল চড়াইয়ের থেকে বড় কিংবা জলহস্তী খরগোশের থেকে। খালি ইঁদুর আর তিমির কথা বলতে গিয়ে যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের সাইজের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সহজেই দেখানো যায় যে জলহস্তীর সাইজের খরগোশ হতে পারতো না কি হেরিং-এর (অনুবাদক: পুঁটিমাছও ভাবা যায়) মতো পুচকে তিমি পাওয়া সম্ভব ছিল না। যে কোনো প্রজাতিরই একটা সবথেকে সুবিধের সাইজ রয়েছে, সেই সাইজ-এ বড় মাপের হেরফের হলে প্রজাতিটার গঠন-ও এক থাকবে না।

কি-হতে-পারতো-র রাজ্যে সবথেকে চেনা কেসটাকেই ধরা যাক। ষাট ফুট উচ্চতার দৈত্যাকার মানুষ — আমার ছোটবেলায় পড়া Pilgrim’s Progress বইটাতে Giant Pope কিম্বা Giant Pagan-এর মতো (অনুবাদক: এখানে ভারতীয়রা মহাভারতের ‘ঘটোৎকচ’ কিংবা চাচা চৌধুরী-র বইয়ের ‘সাবু’-কে ভাবতে পারেন)। এই দৈত্যাকৃতি মানুষেরা সাধারণ মানুষের থেকে দশ গুণ লম্বাই নয়, সামনে-পিছনে কিংবা আড়াআড়িও সেইরকমই। সবসুদ্ধ এদের ওজন তাহলে হাজারগুণ অর্থাৎ আশি নব্বই টন হবে [১]। কিন্তু ওদের হাড়ের প্রস্থচ্ছেদ একই হিসেবে সাধারণের থেকে মাত্র একশোগুণ বেশি। সব মিলিয়ে দাঁড়ায় যে ওদের হাড়ের  প্রত্যেক স্কোয়ার ইঞ্চিকে সাধারণ মানুষের হাড়ের এক স্কোয়ার ইঞ্চি-র দশগুণ বেশি ভার বহন করতে হবে। মানুষের উরুর হাড়ে দশগুণ বেশি চাপ পড়লে সেটা ভেঙ্গে যায়, অৰ্থাৎ Pope বা Pagan (আমাদের ঘটোৎকচ বা সাবু) সত্যিই থেকে থাকলে প্রত্যেক পদক্ষেপে একবার করে তার হাড় ভাঙ্গতো। তাই বোধহয় বেশিরভাগ ছবিতেই ওদের বসে থাকতে দেখি। কিন্তু এইভাবে ভাবলে Christian বা Jack the Giant Killer-এর প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায় (অর্থাৎ ছোট সাইজের কেউ এদের পরাস্ত করলে আশ্চর্যের কিছু নেই)।

পশুবিদ্যায় ফেরা যাক। গ্যাজেল (gazelle) এক জাতীয় খুদে হরিণ, লম্বা সরু পায়ে ভর দিয়ে ছুটে বেড়ায়। হঠাৎ যদি সে আজ সাইজে বেড়ে যেত, তারও হাড়গোড় ভাঙ্গা দশা হতো, যদি না একই সাথে তার আরো একটা পরিবর্তন ঘটতো। হয় তার পা’গুলো গণ্ডারের মতো বেঁটে আর গাবদা হয়ে যেতে পারতো যাতে বেড়ে যাওয়া ওজনের অনুপাতেই হাড়ের প্রস্থচ্ছেদও বাড়ে। নয়তো দেহটাকে সংকুচিত করে ওজন কমিয়ে পা’দুটোকে তেরছা করে দাঁড়িয়ে সেই ওজন সামলাতে পারতো, খানিকটা জিরাফের মতো। এই দুটো প্রাণীর কথা বলছি কারণ একদিক দিয়ে গ্যাজেলের সমগোত্রীয় এরা। এরা সকলেই চলাফেরায় সফল, প্রয়োজনে ছুটতে পারে দ্রুতগতিতে।

দৈত্যাকার মানুষ সত্যিই থেকে থাকলে প্রত্যেক পদক্ষেপে একবার করে তার হাড় ভাঙ্গতো।

মাধ্যাকর্ষণ মানুষের কাছে শুধুমাত্র একটা বিরক্তিকর অসুবিধে মাত্র কিন্তু দৈত্যের কাছে সেটা একটা আতঙ্ক। এদিকে নেংটি ইঁদুর কিংবা তার থেকেও ছোট কোনো প্রাণীর প্রকৃতপক্ষে মাধ্যাকর্ষণকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। হাজার গজ নিচু খনিগর্ভে একটা নেংটি ইঁদুরকে ফেলে দিতে পারো। সে মাটিতে পড়ে একটু ঘাবড়ে যাবে বটে কিন্তু কিছুক্ষণেই চলতে শুরু করবে, অবশ্যই নিচের জমিটা খুব শক্ত না হলে। একটা ধেড়ে ইঁদুর একই অবস্থায় মরে যাবে, মানুষ ভেঙ্গে যাবে আর ঘোড়া থেঁতলে যাবে। কারণ পড়ার মুখে বাতাসের প্রতিরোধ পড়ন্ত প্রাণীর প্রস্থচ্ছেদের সাথে সমানুপাতিক। প্রাণীটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা প্রত্যেকটাকেই দশ দিয়ে ভাগ করো, তার ওজন হাজার ভাগের একভাগ হয়ে যাবে কিন্তু পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল হবে একশো ভাগের এক ভাগ। তাই প্রাণীটি ছোট হয়ে গেলে তার ওপর বাতাসের প্রতিরোধ কমবে একশো ভাগ কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের টান কমবে হাজার ভাগ [২]। সুতরাং ক্ষুদ্র জীবের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বাতাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা মাধ্যাকর্ষণের তুলনায় দশ গুণ বেশি।

তাই, একটা পোকার মাধ্যাকর্ষণের থেকে কোনো শঙ্কা নেই। সে নির্ভয়ে ভূমিসাৎ হতে পারে আবার সিলিং-এ সেঁটেও থাকতে পারে অনায়াসে। সেঁটে থাকার জন্য মাকড়শার পায়ের মতো নিপুণ কারুশিল্পেরও আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু আরেকটা বল আছে যেটার কাছে তারা ধরাশায়ী হয়। সেটা হলো পৃষ্ঠটান (surface tension)। স্নান সেরে বেরোনোর সময় মানুষের দেহের উপর এক ইঞ্চির পঞ্চাশভাগ পুরু একটা জলের স্তর থাকে। পুরো স্তরটার ওজন করলে এক পাউন্ডও হবে না। একটা জলসিক্ত ইঁদুরকে তার ওজনের সমান জল বইতে হয়। একটা মাছির ক্ষেত্রে সেই ওজনটাই হয়ে যায় নিজ ওজনের বহুগুণ [৩]। জানোই তো, একটা মাছিকে একবার জলে কিংবা অন্য কোনো তরলে ফেলে দিলে সে মহা বেকায়দায় পড়ে যায়। একটা পতঙ্গের জল খেতে যাওয়া আর একজন মানুষের খাদের কিনারায় ঝুঁকে খাবারের খোঁজ করা একইরকম বিপজ্জনক। পতঙ্গ একবার জলের পৃষ্টটানের কবলে পড়লে, অর্থাৎ একবার ভিজলে, সেই জলেই আটকা পড়বে যতক্ষণ না সে ডুবে যাচ্ছে। কিছু পোকা আছে যাদের ভেজানো যায়না, যেমন ওয়াটার-বীটল (water-beetle)। কিন্তু অধিকাংশই চেষ্টা করে জলের থেকে বহুদূরে থেকে শুঁড়ের মাধ্যমে পিপাসা মেটাতে।

একটা পোকার মাধ্যাকর্ষণের থেকে কোনো শঙ্কা নেই কারণ তার ক্ষেত্রে বাতাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি।

লম্বা হওয়ার আবার অন্য হ্যাপা রয়েছে। লম্বা স্থলচর প্রাণীদের দেহে রক্ত চলাচল বজায় রাখতে মানুষের থেকে বেশি উচ্চতায় রক্ত পাম্প করতে হয়। তাই রক্তচাপও বেশি, রক্তনালীগুলোকেও সেই চাপ সহ্য করার ক্ষমতা রাখতে হয়। বেশ কিছু মানুষের ধমনী ফেটে মারা যাওয়ার কথা আমরা শুনেছি, কিন্তু জিরাফ বা হাতির ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা আরো বেশি। তবে আয়তন নির্বিশেষে সব পশুকেই একটা সমস্যার সমাধান করতে হয়। ধরো একটা ক্রিমি বা rotifer-জাতীয় কীট। তার চামড়া হয় মসৃণ যাতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন শুষে নিতে পারে, তার খাদ্যনালী হয় একটি সিধা গহ্বর যার গায়ে খাদ্য শোষণের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকে, আবর্জনা ত্যাগ করার জন্য থাকে একটিমাত্র কিডনি। এই কীটেরই মাপ সবদিকে দশগুণ বাড়িয়ে দাও। ওর ওজন বেড়ে যাবে হাজারগুণ, ফলে মাংসপেশীগুলোকে একইরকম কার্যকর হতে গেলে হাজারগুণ খাদ্য ও অক্সিজেন শোষণ করতে হবে, ত্যাগও করতে হবে সেই পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ।

এবার সেই কীটের গঠন যদি একইরকম থাকে, তার উপরিতল বাড়বে মাত্র একশোগুণ। অর্থাৎ বৃহদকায় কীটটির চাহিদা মেটাতে দেহের প্রত্যেক স্কোয়ার মিলিমিটার-এ দশগুণ বেশি অক্সিজেন প্রবেশ করতে হবে। একইভাবে অন্ত্রের প্রত্যেক স্কোয়ার মিলিমিটার-এ দশগুণ খাদ্য শোষণের প্রয়োজন হবে। শোষণক্ষমতা সীমায় এসে ঠেকলে তখন অন্য উপায়ে এদের শোষণতলটাকে বাড়ানোর ফন্দি করতে হবে। চামড়ার একটা অংশ ঝুড়ি ঝুড়ি চুলের মতো বেরিয়ে আসতে পারে, যেমন মাছের কানকোতে থাকে, কিংবা ভিতরে সেঁদিয়ে যেতে পারে, যেমন মানুষের শ্বাসযন্ত্রে হয়। মানুষের শ্বাসযন্ত্রে প্রায় একশো স্কোয়ার গজ শোষণতল আছে। একইভাবে, খাদ্যনালী সিধা না হয়ে পাকিয়ে যায়, উপরিতলটা মসৃণের পরিবর্তে হয়ে যায় মখমলের মতো। অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গেও জটিলতা দেখা যায়। প্রাণীজগতের উপরের দিকের বাসিন্দারা আয়তনে বড় এই কারণে নয় যে তারা বেশি জটিল। তারা বেশি জটিল এই কারণে যে তাদের আয়তন বড়। একই যুক্তি উদ্ভিদদের ক্ষেত্রেও খাটে। সরলতম উদ্ভিদগুলো, যেমন ডোবার স্থির জলে বা গাছের ছালে জমা শ্যাওলা (algae), শুধু গোলাকার কোষ মাত্র। এর থেকে উপরের শ্রেণীর উদ্ভিদরা চেষ্টা করে পাতা কিংবা শিকড় মেলে নিজেদের শোষণতল বাড়াতে।

শেষপর্যন্ত গঠনবিষয়ক তুলনামূলক আলোচনা উপরিতল বনাম আয়তনের লড়াইয়ে এসে ঠেকে [৪]। উপরিতল বাড়ানোর কিছু পদ্ধতি খানিকদূর পর আর কাজ করে না। মেরুদণ্ডী প্রাণীরা রক্তের মাধ্যমে ফুসফুস থেকে দেহের সর্বত্র অক্সিজেন চালান করে। কীটপতঙ্গের দেহে কিন্তু অক্সিজেন পরিবহন সরাসরি কিছু নলের মাধ্যমে হয়, যাদের বলে tracheae। এই নলগুলো দেহের বিভিন্ন জায়গায় হাঁ করে বাইরে থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে। শ্বাস নেওয়ার সময় অক্সিজেন সরাসরি গৃহীত হলেও সেই অক্সিজেনকে নলের সূক্ষ্মতর শাখাগুলোতে diffusion বা আশ্লেষের মাধ্যমে ছড়াতে হয়। যে কোনো গ্যাস অল্প দূরত্বে সহজেই ছড়াতে পারে। তবে এই দূরত্বটা খুব বেশি নয়, গ্যাসীয় অণুর সংঘর্ষের মাঝে যাত্রাপথের যে গড় দূরত্ব, তার কয়েকগুণ মাত্র। কিন্তু একটা অণুকে যদি এক ইঞ্চির চতুর্থাংশের মতো মহাযাত্রায় বেরোতে হয়, তখন এই পরিবহনপদ্ধতি অত্যন্ত ঢিমে চালায় এগোয়। ফলে একটা পোকার দেহের যেসব অংশ খোলসের থেকে এক চতুর্থাংশ ইঞ্চির বেশি ভিতরে থাকবে, তারা সবসময়ই অক্সিজেনের খরায় ভুগবে [৫]। অতএব ওই সাইজের থেকে পুরুষ্ঠু পোকা দেখা যায়না। কাঁকড়ার মতো পুরুষ্ঠু প্রাণীও হয় যাদের দেহের মানচিত্রটা কিছুটা পোকা গোত্রেই। কিন্তু কাঁকড়াও রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন চালান করে তবেই সাধারণ কীটপতঙ্গের থেকে অনেক বড় আয়তনে পৌঁছতে পেরেছে। কীটপতঙ্গরাও যদি তাদের কলা-র (tissue) মধ্যে দিয়ে বাতাসটাকে নিজ মর্জিতে চলতে না দিয়ে জোর খাটিয়ে পরিচালনা করতে পারতো তাহলে অন্তত তাদের গলদা চিংড়ির সাইজে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যদিও অন্য নানাবিধ কারণে তখনও হয়তো তারা মানুষের সাইজে পৌঁছতে পারতো না।

বাতাস শোষণক্ষমতা সীমায় এসে ঠেকলে তখন অন্য উপায়ে শোষণতল বাড়াতে হয়, যেমন মাছের কানকো কিম্বা মানুষের শ্বাসযন্ত্র।

একই সমস্যা ওড়ার ক্ষেত্রেও। বিমানচালনাবিদ্যার একটা গোড়ার সূত্র হলো এইটে: একটা বিমানের আকৃতি একই রাখলে, তাকে ভাসমান থাকতে ন্যূনতম যে গতি বজায় রাখতে হবে সেটা তার দৈর্ঘ্যের বর্গমূলের সমানুপাতিক। অর্থাৎ বিমান চারগুণ লম্বা হলে তাকে ভাসমান থাকতে দ্বিগুণ গতিতে চলতে হবে। এর থেকে দাঁড়ায় যে একটা বিমানকে ভাসমান রাখতে যে ক্ষমতার (power) প্রয়োজন সেটা বিমানের আয়তন বাড়ালে ওজনের থেকে দ্রুতগতিতে বাড়ে। একটা জাম্বো বিমান, যেটা একটা ছোট বিমানের থেকে চৌষট্টিগুণ ভারী (সবদিকেই চারগুণ বাড়ালে) ভাসমান থাকতে দুশো ছাপ্পান্নগুণ ক্ষমতা দাবী করবে [৬]। একই তত্ত্ব পাখিদের ওপর প্রয়োগ করলে খুব শীঘ্রই তাদের আয়তন সম্ভবের সীমা ছাড়িয়ে যাবে। যদি পরীরা বাস্তবে থাকতো আর ঈগল বা পায়রার মতোই ওজনের সাথে সাথে তাদের ক্ষমতার খাঁই বাড়তো, তাহলে তাদের চার ফুট গভীর বুকের পেশী লাগতো ডানা ঝাপ্টে ভাসমান থাকতে। একই সাথে ওজনের ভার কমাতে পা’গুলো হয়তো প্যাঁকাটির মতো হয়ে যেত। যদি খেয়াল করো, ঈগল বা চিলের মতো বড় পাখী কিন্তু ডানা ঝাপটে ভেসে থাকে না। বেশিরভাগ সময় তারা স্রেফ ডানা মেলে একটা উর্ধ্বগামী বাতাসের থামের উপর নিজেদের ব্যালান্স করে। তবে সেটাও আয়তন বাড়ার সাথে সাথে অসম্ভবের দিকে পাড়ি দেয়। তা না হলে বাঘের সাইজের ঈগল উড়ে বেড়াতো আর শত্রু বিমানের মতোই মানুষকে নাকাল করে ছাড়তো।

এতক্ষণ সাইজের অসুবিধে নিয়ে কথা হচ্ছিলো, এবার সুবিধেগুলো বলি। সবথেকে প্রকট যে সুবিধেটা সেটা হলো দেহের উষ্ণতা বজায় রাখা। সব উষ্ণ রক্তের জীবই স্থির অবস্থায় দেহের এক একক ক্ষেত্র থেকে একই পরিমাণ তাপ হারায়। এই হারানো শক্তি পূরণ করতে তাদের যে খাদ্যভাণ্ডারের প্রয়োজন হয় সেটা তাদের উপরিতলের সাথে সমানুপাতিক, গোটা ওজনের সাথে নয়। পাঁচ হাজার নেংটি ইঁদুর মিলে তবে একটা মানুষের ওজনের সমান হয়। কিন্তু তাদের সম্মিলিত উপরিতল এবং ফলে খাদ্য বা অক্সিজেনের প্রয়োজন মানুষের সতেরোগুণ। একটা নেংটি ইঁদুর রোজ তার ওজনের এক চতুর্থাংশ ভক্ষণ করে, যার বেশিরভাগটাই তার দেহের উষ্ণতা বজায় রাখার পিছনে চলে যায়। একই কারণে শীতপ্রধান দেশগুলোতে ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী বিরল। স্পিৎজবার্গেন শহরে সবথেকে ছোট জন্তু হলো শেয়াল। শীতকালে ছোট পাখীরা পরিযায়ী হয়ে পালিয়ে যায় এবং কীটপতঙ্গ মরে যায়, যদিও তাদের ডিমগুলো ছ’মাস বা তার বেশি তুষার সহ্য করতে পারে। এইরকম পরিবেশে সবথেকে সফল প্রাণী ভল্লুক, সীল ও সিন্ধুঘোটক।

আয়তনের তুলনায় ক্ষেত্রফল কম হওয়ার সুবিধেও আছে: হারানো শক্তি পূরণ করতে খেতে হয় কম।

একইভাবে, চোখ ইন্দ্রিয় হিসেবে বেশ অকেজো যতক্ষণ না তার সাইজ একটা মাত্রা ছাড়াচ্ছে। চোখের পিছনদিকের পর্দা, যেখানে বহির্জগতের ছবি ধরা পড়ে, একটা ক্যামেরা-র ফিল্মের মতো। এই পর্দা আদতে ‘রড আর কোন’ কোষের এক মোজাইক, যেখানে একেকটা কোষের ব্যাস আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে কিঞ্চিৎ বেশি। একটা চোখে এরকম পাঁচ লক্ষ মতো কোষ রয়েছে। দুটো বস্তুকে আলাদা করতে হলে তাদের প্রতিবিম্বগুলোকে আলাদা রড কিংবা কোন-এর মধ্যে তৈরি হতে হবে। অর্থাৎ, আমাদের চোখের রড এবং কোন কোষ সংখ্যায় কম কিন্তু সাইজে বড় হলে আমাদের দৃষ্টিশক্তি আরো আবছা হয়ে যেত। তারা দ্বিগুণ বড় হলে দুটো বস্তুকে দ্বিগুণ দূরে থাকতে হতো আলাদা করে সনাক্ত করার জন্য। কিন্তু উল্টোটা সত্যি নয়। তাদের সাইজ আরো ছোট করে সংখ্যায় বাড়িয়ে দিলে কোনো লাভই হতো না। কারণ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে কম ফারাক নির্ণয় করা অসম্ভব। তাই একটা নেংটি ইঁদুরের চোখ কিন্তু মানুষের চোখের সংকুচিত মডেল নয়। অর্থাৎ তাদের রড আর কোন-গুলো সাইজে আমাদের থেকে ছোট নয়, ফলে জায়গায় কুলোতে তাদের সংখ্যা অনেক কম। একটা ইঁদুর ছ’ফুট দূরে দুটো মানুষকে আলাদা করে চিনতে পারেনা। চোখদুটো আদৌ কোনো কাজে আসতে গেলে যে সাইজের হওয়া প্রয়োজন, সেটা একটা ছোটখাটো প্রাণীর দেহের তুলনায় বেশ বড়। অন্যদিকে বড় জন্তুদের তুলনামূলকভাবে ছোট চোখেই কাজ চলে যায়। হাতি কিংবা তিমির চোখ আমাদের চোখের তুলনায় সামান্যই বড়। একই সূত্র মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যদিও তার ব্যাখ্যাটা আরেকটু জটিল। যদি বিড়াল, চিতা, বাঘ, এরকম একই জাতির প্রাণীদের মস্তিষ্কের ওজনের তুলনা করি তাহলে দেখবো যে দেহের ওজন চারগুণ করে দিলে মস্তিষ্কের ওজন দ্বিগুণ বাড়ে। বড় জন্তু, তার সেইরকম বড় দেহের কাঠামো, কিন্তু চোখ, মস্তিষ্ক এবং কিছু বিশেষ অঙ্গে তারা কার্পণ্য করে থাকে।

এইরকমই কিছু ভাবনাচিন্তা থেকে দেখা যায় যে প্রাণীমাত্রেই একটা যুৎসই সাইজ আছে। যদিও গ্যালিলিও তিনশো বছর আগে বিপরীতটাই প্রমাণ করেছিলেন, অনেকের এখনো এই ধারণা আছে যে একটা মানুষের সাইজের মাছি হাজার ফুট উঁচু লাফ দিতে পারবে। একটা প্রাণী কত উঁচুতে লাফ দিতে পারবে তাকে সাইজের সমানুপাতিক বলার থেকে সাইজের ওপর নির্ভরশীল নয় বললেই বেশি সঠিক হবে। একটা মাছি দু’ফুট অব্দি যেতে পারে, মানুষ পাঁচ। বাতাসের প্রতিরোধ বাদ দিলে একটা বিশেষ উচ্চতা অব্দি লাফাতে শক্তি খরচ লম্ফমান ব্যক্তির ওজনের সমানুপাতিক। কিন্তু যদি প্রাণিনির্বিশেষে দেহের ওজনের একই ভগ্নাংশের মাংসপেশী লাফ দেওয়ার পেছনে কাজে লাগে, তাহলে প্রত্যেক আউন্স পেশীতে যে শক্তি খরচ হয়, সেটা প্রাণীর সাইজের ওপর নির্ভর করে না [৭]। অবশ্যই খরচ করতে হলে চটজলদি অতটা শক্তি সৃষ্টি করতে হবে। সেটা সবসময় সত্যি হয়না। একটা পতঙ্গের পেশী, যদিও আমাদের থেকে দ্রুততর সংকোচনে সক্ষম, আমাদের তুলনায় শক্তি রূপান্তরে ঢের বেশি অপচয়প্রবণ। নইলে একটা মাছি বা ফড়িংও লাফিয়ে ছ’ফুট অব্দি উঠতে পারতো।

একটা প্রাণী কত উঁচুতে লাফ দিতে পারবে, সেটা তার সাইজের উপর ঠিক নির্ভর করে না।

সব প্রাণীর যেমন একটা উপযুক্ত সাইজ রয়েছে, সব প্রতিষ্ঠানেরও তাই। গ্রিক ধারার গণতন্ত্রে, নাগরিকরা একরাশ বক্তৃতা শুনে বিভিন্ন আইনের প্রশ্নে সরাসরি ভোট দিতে পারতো। তাই তাদের দার্শনিকদের মতে, একটা ছোট শহরের থেকে সাইজে বড় গণতন্ত্র হতেই পারেনা। ইংরেজদের সৃষ্ট নির্বাচনী রাজনীতির ফলে একটা গোটা দেশকে গণতন্ত্রের আওতায় আনার কথা ভাবা গেল, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমে ও পরবর্তীকালে অন্যত্র তাকে বাস্তবে রূপায়িত করা গেল। তারপর রেডিও সম্প্রচারের ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আবার জনগণের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হলো, এবং কে জানে ভবিষ্যতে আবার হয়তো গ্রিক ধাঁচের গণতন্ত্রে ফেরত যাওয়া যাবে।  এমনকি, রেফারেন্ডাম বা গণভোটের ধারাটাও ভাবা গেছে শুধুমাত্র দৈনিক সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে।

এক জীববিজ্ঞানীর কাছে সমাজতন্ত্র বা সোশ্যালিজম-এর সমস্যাটা বেশিরভাগটাই বেমানান সাইজের সমস্যা। কট্টর সাম্যবাদীরা সব দেশকেই একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো পরিচালনা করতে চান। আমার মনে হয়না হেনরি ফোর্ড-এর অ্যানডোরা কিংবা লুক্সেমবুর্গ-এর মতো ছোট দেশ চালাতে কোনো অসুবিধে হতো। এখনই ওনার কর্মচারীর তালিকা এই দেশগুলোর জনসংখ্যার থেকে বেশি। এটাও ভাবা যেতে পারে যে একদল ফোর্ড-এর মতো নেতা পাওয়া গেলে তারা হয়তো বেলজিয়াম লিমিটেড কিংবা ডেনমার্ক কর্পোরেশন-এর সংস্থাকে সামলাতে পারতো। কিন্তু একেবারে বড় দেশগুলোতে যদিও কিছু শিল্পের রাষ্ট্রীয়করণ স্বাভাবিক, গোটা দেশটাকেই সেই নীতিতে চালানোর কথা ভাবতে পারিনা। আমার কাছে একটা সম্পূর্ণরূপে সমাজতান্ত্রিক ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কল্পনা করা একটা ডিগবাজি খাওয়া হাতি কিংবা বেড়া টপকানো জলহস্তী কল্পনা করার থেকে কোনোভাবে সহজ নয়।

(লেখাটি মূল ইংরাজি রচনা On Being the Right Size থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর  অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়। কলকাতা-র পাঠক সন্দীপ রায়-কে ধন্যবাদ জানাই এই অনবদ্য লেখাটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য।)

(প্রচ্ছদের ছবি: সূর্যকান্ত শাসমল)

(অন্যান্য ছবি: Freepik, সহযোগিতায়: অনির্বাণ ঘোষ)

টীকা:

  1. ধরো, একটা কিউব বা ঘনক্ষেত্র, যার প্রতিটি ধারের মাপ L, সুতরাং কিউবটার আয়তন L। এবার যদি প্রতিটা ধারকে ১০ গুণ বড় করে দাও, তার আয়তন বেড়ে হবে (১০L) = ১০০০L, অর্থাৎ আগের মাপের ১০০০ গুণ। এবার দেখা যাক কিউব-টার প্রস্থচ্ছেদে বা পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফলে কি ধরণের পরিবর্তন হয়। একটি কিউবে থাকে ছ’টা তল, আর প্রত্যেকটার ক্ষেত্রফল L, অতএব সমগ্র পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল ৬L । কিন্তু যখন প্রতিটা ধারের দৈর্ঘ্য ১০গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হলো, তখন তার সমগ্র পৃষ্ঠতলের সমষ্টি হলো ৬ X (১০L) = ৬০০L , অর্থাৎ আগের ক্ষেত্রফলের ১০০ গুণ। প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
  2. পড়ন্ত বস্তুর ওপর বাতাসের প্রতিরোধ বস্তুটির ক্ষেত্রফলের সমানুপাতিক আর মাধ্যাকর্ষণ টান আয়তনের (বা ভরের) সমানুপাতিক।
  3. গায়ে কতটা জল জমলো, সেটা একটা প্রাণীর উন্মুক্ত দেহের ক্ষেত্রফলের উপর নির্ভর করে। প্রাণী যত ছোট হতে থাকে, তার ওজন আর সেই ক্ষেত্রফলটা একই হারে কমেনা। ক্ষেত্রফল আর ওজনের অনুপাত যেহেতু ১/L, যেখানে L হলো প্রাণীটির একদিকের মাপ, প্রাণীটা যত ছোট হবে তার পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল আর ওজনের অনুপাত বাড়তে থাকবে। তাই মানুষের কাছে যেখানে জলের স্তরের ওজন নিজের ওজনের তুলনায় প্রায় নামমাত্র, মাছির কাছে সেটাই ওজনের বহুগুণ হয়ে যায়।
  4. আমরা দেখেছি যে আয়তন এক রেখে যদি আমরা কোনো বস্তুকে ছোট ছোট টুকরো করি, তাহলে সম্মিলিত পৃষ্ঠতল বাড়তে থাকে। একটা খেলা খেলা যাক। ধরা যাক, আমাদের কাছে একটা চিনির কিউব আছে যার প্রত্যেকটি ধারের দৈর্ঘ্য ১ cm = ১০-২ m।  সুতরাং চিনির কিউব-এর পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল ৬ X ১০-৪ m । এখন ধরো, আমরা এই চিনির কিউবটাকে গুঁড়ো গুঁড়ো করলাম (একটুও না খেয়ে, বিজ্ঞানের দিব্যি) এবং প্রতিটি চিনির দানা হলো ১০০ মাইক্রন = ১০-৪ m ধারের একটা কিউব। তখন সব চিনির দানাগুলোর সম্মিলিত পৃষ্ঠতল দাঁড়াবে শুরুর গোটা চিনির কিউব-এর পৃষ্ঠতলের ১০০ গুণ (খেয়াল রেখো যে এক একটা দানার ক্ষেত্রফল কম হলেও, যতগুলো দানা তৈরী হয়েছে, সেই সংখ্যাটা দিয়ে একেকটা দানার ক্ষেত্রফলকে গুণ করে তবেই সম্মিলিত পৃষ্ঠতলটা পাবে)। একইভাবে আমরা যদি ১০-৯ বা ১ ন্যানোমিটার ধারের চিনির দানাতে ভাঙ্গতাম, তাহলে ১০গুণ পৃষ্ঠতল পেতাম। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ভর এক রেখে যখন বস্তুকে ভেঙ্গে ছোট ছোট করা হয়, সবকটা বস্তুর পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল যোগ করলে যেটা হয়, সেটা বস্তুর বিশিষ্ট দৈর্ঘ্যের ব্যাস্তানুপাতিকে (inversely proportional to the characteristic length) বাড়তে থাকে। এই লেখাটাতে কিছু নমুনা দেওয়া হলো যেখানে প্রকৃতি এই বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে। কিন্তু শুধু প্রকৃতি নয়, আধুনিক বিজ্ঞানও এই ধর্মের ব্যবহার করে ন্যানোটেকনোলজিতে। আমরা যদি এক টুকরো কার্বন নিই, তার যা পৃষ্ঠতল আছে, সেটাকে ভেঙ্গে যদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ন্যানো পার্টিকল  করে ফেলি, বুঝতেই পারছো সেই তুলনায় অনেক বেশি পৃষ্ঠতল তৈরী করতে পারি। আর যে সমস্ত ক্ষেত্রে পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল গুরুত্বপূর্ণ, যেমন সুপার ক্যাপাসিটরে  চার্জ সংরক্ষণ (যেখানে বেশি পৃষ্ঠতল মানেই বেশি ইলেক্ট্রনের বসার জায়গা) বা তাপ পরিবহন ইত্যাদি, সেখানেও এই ধর্ম কাজে লাগানো যায়।  বুঝতেই পারছো, বিবর্তন থেকে ন্যানোটেকনোলজি, সর্বত্রই সাইজ বা লেংথ স্কেল কতটা গুরত্বপূর্ণ।
  5. হিসেবটা যাকে বলে অ্যাপ্রক্সিমেট (মোটামুটি হিসেব)। অর্থাৎ, এখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে খোলসের ভিতর অক্সিজেন প্রবেশ করা মাত্রই তাকে ডিফিউশন বা আশ্লেষের মাধ্যমে বাকিটা যেতে হয়। সেই যাত্রাপথটা খুব বেশি হতে পারে না, তাই পোকারাও খুব বেশি পুরুষ্ঠু হতে পারেনা।
  6. মূল লেখাতে ‘একশো আঠাশ গুণ’ বলা আছে। তবে, হিসেবটা যদি এইভাবে করা হয় যে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা যদি চার গুণ বাড়ে, তাহলে ওজন বাড়ে চৌষট্টিগুণ, নূন্যতম গতিবেগ (যেটা লেখা অনুযায়ী দৈর্ঘ্যের বর্গমূলের সাথে সমানুপাতিক) বাড়ে দ্বিগুণ, এবং সবশেষে প্রয়োজনীয় গতিশক্তি (কাইনেটিক এনার্জি) বাড়ে ৬৪ ⁢⨉  ৪ = ২৫৬ গুণ। [৭] যে শক্তি প্রয়োজন একটা উচ্চতা অব্দি লাফাতে, সেটা ওজনের সমানুপাতিক। আমরা জানি,  স্থিতিশক্তি বা পোটেনশিয়াল এনার্জি ওজন (W) এবং উচ্চতার (h) গুণফল, অর্থাৎ W  ⁢⨉ h। তাহলে প্রত্যেক একক ওজনে যতটা শক্তি খরচ হয়, সেটা আর ওজনের ওপর নির্ভর করেনা, অর্থাৎ সব প্রাণীর ক্ষেত্রেই সমান। এবার পুরো শরীরের পেশী তো এই লাফ দেওয়ার পেছনে লাগে না। ধরে নেওয়া যাক, ওজনের একটা বিশেষ ভগ্নাংশ (f) লাফ দেওয়ার পেছনে শক্তি যোগান দেয় এবং এই ভগ্নাংশটা সব প্রাণীর ক্ষেত্রেই সমান। তাহলে একই উচ্চতা লাফাতে সব প্রাণীরই প্রত্যেক একক ওজনের পেশীতে একই পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ, সব প্রাণীই একই উচ্চতা লাফাতে পারতো যদি সেই শক্তি তারা তৈরী করতে পারতো।

The post সাইজ-এর মাহাত্ম্য appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

স্টেম কোষ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুনর্গঠনের সম্ভাবনা

$
0
0

বয়স্ক অবস্থায় স্টেম কোষের ঘাঁটিগুলো কোথায়? সেখান থেকে কিম্বা অন্য কোনো প্রকারে সাপ্লাই নিয়ে পুনরায় দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরী করা সম্ভব কি?


কখনও ভেবে দেখেছো, দেহের যন্ত্রপাতি বানানোর একখান কারখানা থাকলে কেমন হতো? কোনো অ্যাকসিডেন্টে বা রোগের কারণে দেহের কোন অঙ্গ খারাপ হলে তখনই পাল্টে ফেলতে পারতাম। সেই রবিন কুকের কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মতো শোনাচ্ছে, তাই না?  কিন্তু স্টেম কোষ আর 3D প্রিন্টিং প্রযুক্তির দৌলতে এসব এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে।

সেই দিন আর দূর নয় যখন এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ল্যাবরেটরিতে বানানো কর্নিয়ার সাহায্যে দৃষ্টিহীন মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারবো। আর এই যে অরগ্যান ডোনারের সমস্যা আমাদের আছে , তারও একটা সুরাহা হবে। গত এক দশক ধরে গবেষণা চলছে কিভাবে দেহের এইসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুনরায় বানানো যায়, চেষ্টা চলছে সেইসব কোষ খুঁজে বের করার যারা এই প্রক্রিয়াতে অংশগ্রহণ করে। 

গত এক দশক ধরে গবেষণা চলছে কিভাবে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুনরায় বানানো যায়।

এসবই সম্ভব হচ্ছে আমাদের দেহের অল্পসংখ্যক কোষের জন্য, তাদের আমরা স্টেম কোষ নামে চিনি। বাইরে থেকে দেখতে অন্য সব কোষের মতনই কিন্তু এদের বিভিন্ন ধরনের কোষ উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে। এদের অবিশেষীকৃত বা আনডিফারেনশিয়েটেড (undifferentiated) কোষও বলা হয় কারণ এরা তখনও অব্দি কলা বা টিস্যুর (tissue) অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিশেষ কাজে নিয়োজিত হয়ে যায়নি। আমাদের দেহে দুই প্রকার স্টেম কোষ আছে, যথা এম্ব্র্যাওনিক বা ভ্রূণ অবস্থার স্টেম কোষ আর অ্যাডাল্ট বা প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম কোষ। ভ্রূণ অবস্থার স্টেম কোষগুলো খুবই নমনীয় হয় এবং এরা বিভিন্ন ধরনের কোষ উৎপাদন করতে পারে, এদের তাই প্লূরিপোটেন্ট কোষও বলা হয়। অন্য দিকে প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম কোষগুলো নির্দিষ্ট কিছু কোষ উৎপাদন করে, তাই এদের ইউনিপোটেন্ট আখ্যা দেওয়া হয়।

ভ্রূণ অবস্থার স্টেম কোষগুলো আদায় করতে হলে একটা বাড়ন্ত ভ্রূণর মধ্যে খুঁজতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই, এই ধরণের স্টেম কোষ নিয়ে গবেষণার কিছু  প্রতিবন্ধকতা আছে, যেমন গর্ভাশয়ে থাকা ভ্রূণ থেকে ইএসসি (এম্ব্র্যাওনিক স্টেম সেল) আলাদা করার অসুবিধে কিংবা সেই সংক্রান্ত নৈতিক প্রশ্ন। তাই, গবেষণার জন্য বাতিল হয়ে যাওয়া আই ভি এফ ভ্রূণ থেকে ইএসসি সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও নাড়ি  বা আম্বিলিকাল কর্ড ইএসসি-তে সমৃদ্ধ একটি অঙ্গ। উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এই নাড়ি থেকে ইএসসি আলাদা করা হয় এবং রাখা হয় আলট্রা-লো তাপমাত্রায় যাতে কোষগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগানো যেতে পারে। শুনতে বেশ সহজ ব্যাপার লাগলেও বাস্তবে অতো সোজা নয়। এই জমিয়ে রাখার ফলে কোষগুলো তাদের নমনীয়তা হারিয়ে ফেলে আর তাদের যে ভিন্ন ধরনের কোষ উৎপাদনের বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে সেটাও কমতে থাকে। 

বাইরে থেকে দেখতে অন্য সব কোষের মতনই কিন্তু স্টেম কোষের বিভিন্ন ধরনের কোষ উৎপাদন করার ক্ষমতা রয়েছে।

দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে যে এক ধরনের স্টেম কোষ আছে যাদের কিছু নির্দিষ্ট অঙ্গেই দেখতে পাওয়া যায়, এরাই আমাদের অ্যাডাল্ট বা প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম কোষ। এই প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম কোষগুলো দেহের অঙ্গের ভিতর পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া কোষদের সাথে সহাবস্থান করে। অঙ্গের ভিতর একটা কোণে এরা ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে, এই অংশটাকে স্টেম সেল ‘নিস’-ও (stem-cell niche) বলা হয়। যতদিন না কোনও অঙ্গ বা কলার পুনর্গঠনের প্রয়োজন ততদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকে এরা। যখন দরকার পড়ে, তখন জেগে উঠে ক্ষতিগ্রস্ত কলা মেরামতের কাজে লেগে পড়ে, তৈরী করে নতুন পরিপক্ক বা ম্যাচিওর (mature) কোষ।  আবার একই সাথে তারা নিজেদের সংখ্যাও বজায় রাখে যাতে কম না পড়ে যায়।

এই প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম কোষগুলোর মধ্যেও ইউনিপোটেন্ট আর মাল্টিপোটেন্ট দু’ধরণের কোষই হয়।  যেমন ধরো রক্তের স্টেম কোষ বা হেমাটোপোয়েটিক স্টেম কোষ (HSC), এরা মাল্টিপোটেন্ট, সব রকমের রক্ত কণিকা বানাতে পারে। অন্যদিকে পেশীর যে স্টেম কোষ, যারা স্যাটেলাইট কোষ নামেও পরিচিত, এরা শুধু কঙ্কাল পেশীর কোষ বানায়, তাই এরা ইউনিপোটেন্ট।  কিন্তু যত ধরণের কোষই তৈরী করুক না কেন, রূপান্তরের সময় প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম কোষ নিজের টিস্যু বা কলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অর্থাৎ চামড়ার স্টেম কোষ কখনও পেশীর কোষে রূপান্তরিত হবে না বা রক্তের স্টেম কোষ কখনও হৃদযন্ত্রের কোষে রূপান্তরিত হবে না। এই প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম কোষগুলো দেহের বিভিন্ন অংশে দেখতে পাওয়া গেছে, যেমন মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, পেশী, মজ্জা, পেরিফেরাল ব্লাড, রক্তনালী, চামড়া, কঙ্কাল পেশী, দাঁত, অন্ত্র, যকৃৎ, ডিম্বাশয় , শুক্রাশয়। অস্থি মজ্জার মধ্যে যে রক্তসৃষ্টিকারী স্টেম কোষদের পাওয়া যায়, যাদের হেমাটোপোয়েটিক স্টেম কোষও বলা হয়,এরা সব রকম রক্তের কোষ বানাতে পারে: যেমন লোহিত রক্ত কণিকা , বি লিম্ফসাইট , টি লিম্ফসাইট, রোগ প্রতিরোধকারী শ্বেত রক্তকণিকা, নিউট্রোফিল, বেসোফিল, ইওসিনোফিল, মনোসাইট ও ম্যাক্রোফেজ।

রূপান্তরের সময় প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম কোষ নিজের কলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, অর্থাৎ চামড়ার স্টেম কোষ কখনও পেশীর কোষে রূপান্তরিত হবে না।

রূপান্তরের পর স্টেম কোষগুলো কলা বা অঙ্গের বিশেষ কাজে লেগে পড়ে কিন্তু সাথে সাথে তারা বিভাজনের ক্ষমতা কিংবা অন্য ধরণের কোষে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই স্টেম কোষের রূপান্তর অনেকটা রান্না করার মত। রান্না করার সময় আমরা প্রয়োজনমতো উপাদান যোগ করি, উপাদানগুলো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে হতে একটা সুস্বাদু পদ তৈরী হয়। যেমনভাবে শেষের পদটা থেকে আর উপাদানগুলোকে আলাদা করে উদ্ধার করা যায়না, তেমনই স্টেম কোষও তার রূপান্তরের সময় এমন কিছু ধর্ম আয়ত্ত্ব করে যে আর ফিরে যাবার উপায় থাকেনা। প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম কোষগুলোর পরিবর্তনের সময় এক এক করে ডিগ্রী অফ ফ্রিডম বা স্বাধীনতার মাত্রায় বেড়ি পড়তে থাকে এবং ক্রমশ তারা ঝুঁকে পড়ে বিশেষ কোনো এক প্রকার কোষ সৃষ্টির দিকে। অর্থাৎ হার্ট, কিডনি কিংবা পেশী, যেদিকেই যাক না কেন, স্টেম কোষ একবার সেইদিকে পা বাড়ালে ভবিষ্যৎ অনিবার্য, সেই দিকেই আরো নির্দেশিত হতে থাকে। এই ব্যাপারটাকে লিনিয়েজ রেস্ট্রিকশন (lineage restriction) বলা হয়ে থাকে। সাদা বাংলায়, বংশবৈচিত্র্য সীমাবদ্ধ করা।

আচ্ছা বলোতো, পরিবর্তিত আর অপরিবর্তিত স্টেম কোষের মধ্যে তফাৎ করে কিকরে? কিংবা ভ্রূণ অবস্থার স্টেম কোষ আর প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থার মধ্যে? আমাদের দেহের মধ্যে প্রত্যেক ধরণের কোষ একেবারে এক উপাদান দিয়ে তৈরী নয়, কিছু তফাৎ আছে। যেমন একটা গাড়ির ক্ষেত্রে তার রং, আকার, মাইলেজ দেখে আলাদা করা যায় কোষের ক্ষেত্রেও তাই। প্রত্যেক কোষের উপরিতলে একধরনের বিশেষ প্রোটিন আর কার্বোহাইড্রেট থাকে যাদের “মার্কার” বলা হয়, এই মার্কার দেখে এক কোষের থেকে অন্য কোষকে আলাদা করা যায়। মার্কার-এর তফাৎ থেকে যে কোনো জোড়া-র মধ্যে তফাৎ করা যায়: পরিবর্তিত আর অপরিবর্তিত স্টেম কোষ, প্লুরিপোটেন্ট আর ইউনিপোটেন্ট স্টেম কোষ, মায় রক্ত আর পেশীর স্টেম কোষ পর্যন্ত।

 স্টেম কোষকে অধ্যয়ন করার জন্য, প্রাণীদেহের কোনো এক কলা, এই ধরো চামড়ার কোষসমূহ, থেকে কোষ সংগ্রহ করা হয়, তারপর ল্যাবে তাদের কালচার করা হয়। ধরো যেগুলো অপরিবর্তিত স্টেম কোষ, তাদের ওপর “X” মার্কার আছে, আর যারা পরিবর্তিত কোষ, তাদের মধ্যে নেই। এরপর এই মার্কারগুলোকে ফ্লুরোসেন্ট রং-এ দাগ দেওয়া হয় যাতে  “X” মার্কার-সমৃদ্ধ কোষ মাইক্রোস্কোপের নিচে জ্বলজ্বল করবে। এই দাগ দেওয়া কোষগুলোকে বাকিদের থেকে আলাদা করা হয় আর তাদের যে নতুন কোষ কিংবা বিশেষীকৃত কোষ তৈরির ক্ষমতা আছে, সেটা পরীক্ষা করা হয়। পেট্রিডিসে রেখে বা কোনো প্রাণীর দেহে এই কোষগুলোকে অনুপ্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করা হয় এই কোষগুলো স্ব-পুনর্নবীকরণের যোগ্য কি না। এই পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন কলাতে এই সব স্টেম কোষের সংখ্যা, আকার, স্ব-পুনর্নবীকরণ, পরিবর্তনের ক্ষমতা, এইসব নির্ধারণ করেন ।

মার্কার-এর তফাৎ থেকে যে কোনো জোড়া-র মধ্যে তফাৎ করা যায়: পরিবর্তিত আর অপরিবর্তিত স্টেম কোষ, প্লুরিপোটেন্ট আর ইউনিপোটেন্ট স্টেম কোষ, মায় রক্ত আর পেশীর স্টেম কোষ পর্যন্ত।

ক্যান্সার বা অন্য কোনো ব্যাধির কারণে যেসব রোগীর দেহে স্টেম কোষের ঘাটতি দেখা দিত, বেশ কিছু বছর হলো তাদের দেহে হেমাটোপোয়েটিক স্টেম কোষের সাপ্লাই দেওয়ার চিকিৎসাপদ্ধতি চলে আসছে। পেশীতেও স্টেম কোষ হয়, এদের বলে স্যাটেলাইট কোষ। এরা পেশীতে চোট লাগলে নতুন  কোষের সৃষ্টি করে। যেসব রোগীর দেহে এই ধরণের স্টেম কোষের অভাব দেখা যায়, তাদের ডুসিন মাসকুলার ডিস্ট্রফি-র (Ducene muscular dystrophy) মতো পেশীর রোগ দেখা দেয়। আমাদের পাচন নালি ও অন্ত্রের গভীরে যে এপিথেলিয়াল কলার স্তর আছে সেখানেও স্টেম কোষ আছে, তারা অনবরত মেরামত আর নতুন কোষ উৎপন্ন করে চলেছে।  দেহের সবথেকে বড় কলা চামড়াতে স্টেম কোষ রয়েছে কাটাছেঁড়া মেরামত ও পুনর্গঠনের জন্য। এপিডার্মিস স্তরের নীচের স্তরে ও লোমের গোড়ায় হেয়ার ফলিকল-এ (hair follicle) এদের পাওয়া যায়। এপিডার্মিস-এর স্টেম কোষ কেরাটিনোসাইট-দের জন্ম দেয়, এরা চামড়ার উপরিতলে যাত্রা করে সেখানে একটা সুরক্ষার আস্তরণ তৈরী করে। লোমের গোড়ার স্টেম কোষগুলো হেয়ার ফলিকল ও এপিডার্মিস, দু’জায়গাতেই যোগদান করতে পারে। মস্তিষ্কে স্নায়বিক স্টেম কোষ সংখ্যায় কম হলেও মস্তিষ্কে মুখ্যরূপে যে ধরণের কোষ থাকে, সবকটারই জন্ম দিতে পারে: স্নায়বিক কোষ ও দু’ধরণের অ-স্নায়বিক কোষ: অ্যাস্ট্রোসাইট ও অলিগোডেন্ড্রোসাইট।

স্টেম কোষগুলো দেহের বাইরে বিশেষীকরণে কতটা সফল, সেটা অনেকটাই নির্ধারণ করে সেগুলো চিকিৎসায় কাজে লাগবে কিনা। দেহের ভিতরে ইশারা পাওয়ামাত্র স্টেম কোষগুলো তাদের কাজ শুরু করে দেয়, নির্দিষ্ট কলা নির্মাণের কাজ। কিন্তু ভেবে দেখেছো কি, ভ্রূণ অবস্থায় স্টেম কোষ তো বিভিন্ন ধরণের কোষের জন্ম দিতে সক্ষম, তারা বোঝে কিকরে কি ধরণের কোষে রূপান্তরিত হতে হবে? আর প্রাপ্তবয়স্কদের স্টেম কোষে অতটা নমনীয়তা না থাকলেও কিছুটা তো রয়েছে — যেমন, রক্তের হেমাটোপোয়েটিক স্টেম কোষ জানে তাকে রক্তের বিভিন্ন কোষে পরিণত হতে হবে, পেশীর কোষে নয়। এর আড়ালে নেওয়া হয় নানারকম সিদ্ধান্ত। অনেকরকম বাইরের ঘটনা এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে সুইচের কাজ করে, সঠিক দিকে কোষের বিশেষীকরণটাকে নির্দেশ করে।

যে সকল রোগীদের বেঁচে থাকার জন্য কলা বা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন, স্টেম কোষ গবেষণা তাদের আশার পথ দেখিয়েছে। সমস্যাটা হলো, দেহের ভিতর কলার মধ্যে স্টেম কোষের সংখ্যায় প্রচুর তারতম্য রয়েছে। তাই, চিকিৎসা কিংবা গবেষণাতে সংগৃহীত স্টেম কোষের ওপর নির্ভর করে থাকা মুশকিল। পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন ল্যাব-এর পরিবেশে ব্যাপক হারে স্টেম কোষ তৈরী করতে। তৈরী হয়েছে নতুন এক পদ্ধতি, যার দ্বারা প্রাপ্তবয়স্কদের বিশেষীকৃত কোষকে স্টেম কোষে ফিরিয়ে আনা যায়। এরকমভাবে পাওয়া স্টেম কোষকে বলে ইন্ডিউসড প্লুরিপোটেন্ট স্টেম কোষ বা IPSC। অর্থাৎ যেসব কোষ তাদের প্লাস্টিসিটি হারিয়েছে, তাদের মধ্যে আবার সেইটা জাগিয়ে তোলা যায়। যে বিশেষীকরণ পদ্ধতি একদিকে যেত, ফিরে আসার উপায় ছিল না, তাকে উল্টোদিকে চালনা করার এই পদ্ধতি বহু পদক পেয়েছে, এমনকি নোবেল প্রাইজ-ও।

স্টেম কোষের কার্যক্ষমতা নিয়ে গবেষণা, তাদের সংখ্যাবৃদ্ধির প্রচেষ্টা, তাদের সঠিক বিশেষীকরণের দিকে পরিচালনা করা, সব মিলিয়ে অনেকগুলো দিক খুলে গেছে দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে পুনরুজ্জীবিত করার চিকিৎসায়।

(লেখাটি মূল ইংরাজি থেকে অনুবাদ করেছেন অভিরূপ ব্যানার্জী ও অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়।)

The post স্টেম কোষ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুনর্গঠনের সম্ভাবনা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

রক্তকণিকা সৃষ্টিতে ফুসফুসের কার্যকরী ভূমিকা

$
0
0

শুধু অস্থিমজ্জা বা বোন ম্যারো (bone marrow) নয়, রক্তকণিকার একাংশ ফুসফুসেও সৃষ্টি হতে পারে। সাম্প্রতিক চমকপ্রদ গবেষণা।


মানবদেহে সংবহনতন্ত্রের প্রধান ভিত্তি রক্ত আসলে  প্লাসমা ও রক্তকণিকার সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লাসমায় থাকে নানা প্রকার প্রোটিন যারা শারীরিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে।  আর রক্তকণিকা মূলত সৃষ্টি হয় অস্থিমজ্জা (bone marrow) থেকে। অস্থিমজ্জায় অবস্থিত বিশেষ রক্তজনিতৃকোষ নতুন রক্তকণিকা সৃষ্টিতে প্রধানত অংশ নেয়l লোহিতরক্তকণিকা, শ্বেতরক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা এই তিন প্রকার রক্তকণিকার মধ্যে, রক্ত জমাট বাঁধতে, অণুচক্রিকা (platelets) বিশেষ ভূমিকা নেয়। তাই অণুচক্রিকার সংখ্যা খুব কমে গেলে শরীরে মারাত্মক রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই অণুচক্রিকাই আজকের গল্পের প্রধান চরিত্র।

ডেঙ্গু, মাম্পস,  রুবেলা, চিকেনপক্স, হেপাটাইটিস-সি, এইডস ভাইরাস, এদের সংক্রমণে অস্থিমজ্জা (bone marrow) থেকে রক্তে অণুচক্রিকা (platelets) সৃষ্টি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে। এছাড়া, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া বা প্যানসাইটোপেনিয়া রোগে, লিউকেমিয়া এবং লিম্ফোমা জাতীয় ক্যান্সারে এমনকি ভিটামিন বি-12 ও ফোলিক অ্যাসিড-এর স্বল্পতায় অস্থিমজ্জা থেকে খুব কম পরিমাণে অণুচক্রিকা তৈরী হয়। কিন্তু অণুচক্রিকা যে শুধু অস্থিমজ্জাতেই তৈরী হয়না, সম্প্রতি তার পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া গেছে একটি গবেষণায়। এই গবেষণার হাত ধরে পরবর্তীকালে হয়ত এইসব রোগীদের দেহে অণুচক্রিকার সংখ্যা (platelet count) বৃদ্ধি করার উপায় বেরোতে পারে।

অণুচক্রিকা আমাদের শরীরে কেন জরুরি? ইটালিয়ান বৈজ্ঞানিক জুলিও বিসসেরও প্রথম রক্তে অণুচক্রিকার উপস্থিতি ও তার কাজের বিবরণ দেন [১]। অণুচক্রিকা থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ থ্রম্বোপ্লাস্টিন, রক্তে অবস্থিত ফাইব্রিনোজেন ও প্রোথ্রোম্বিন, এই দুই প্রোটিন-এর উপস্থিতিতে রক্ততঞ্চন বা রক্তকে জমাট বাঁধানোর কাজে বিশেষ ভূমিকা নেয়। মানবদেহে অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে গেলে থ্রম্বোসাইটোপিনিয়া নামে রোগ সৃষ্টি হয় এবং কেবলমাত্র রক্তপরিসঞ্চালনের মাধ্যমে বাইরে থেকে শরীরে প্রয়োজনীয় অণুচক্রিকার যোগান দিলে তবেই এই রোগের উপশম সম্ভব।

গবেষণায় দেখা গেছে, অণুচক্রিকা অস্থিমজ্জায় অবস্থিত বৃহৎ আকৃতির মেগাক্যারিওসাইট কোষ থেকে তৈরী হয়। অস্থিমজ্জা ছাড়াও শরীরের অন্যান্য অঙ্গস্থান থেকে অণুচক্রিকা সৃষ্টিপদ্ধতি এবং সৃষ্টিস্থান নির্ধারণের কাজে বৈজ্ঞানিকরা বহুদিন ধরে গবেষণা করে চলেছেন। যেমন ফুসফুস। মানবদেহে নিশ্বাস-প্রশ্বাস ও শ্বসনকার্যের জন্যে ফুসফুস অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। দেখা গেছে, সংবহনের  সময় যে রক্ত ফুসফুসে প্রবেশ করে তাতে উপস্থিত অণুচক্রিকার সংখ্যার তুলনায়, ফুসফুস থেকে বেরনোর সময়ের রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা অনেক বেশী। সেই কারণে, বিজ্ঞানীরা ফুসফুসে অণুচক্রিকা সৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।

এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী এল. আস্কফ-এর নাম উল্লেখ্য। বিজ্ঞানী আস্কফ বহুদিন আগেই ফুসফুসে মেগাক্যারিওসাইট এর উপস্থিতি সম্পর্কে জানিয়ে গেছেন [২]। পরবর্তীকালের বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করে বার করেন যে সমস্ত শারীরিক অসুস্থতায়  রক্তকণিকার উপর প্রভাব পড়ে (যেমন ভাইরাল ইনফেকশন,  অ্যানিমিয়া, ক্যান্সার), সেই অসুস্থতার সময়ে অস্থিমজ্জা থেকে মেগাক্যারিওসাইট ফুসফুসীয় কলা ও রক্তজালিকায় সংবহন পথে চলে আসে। বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাকে “স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ঘটনা” বলে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ, এর জন্য আলাদা কোনো স্টিমুলাস-এর প্রয়োজন হয়না। কিন্তু কিভাবে যথেষ্ট পরিমাণে অণুচক্রিকা ফুসফুস থেকে উৎপন্ন হয়, সেই ধারণা যথোপযুক্ত গবেষণালব্ধ প্রমাণের অভাবে অসম্পূর্ণ ছিল।

সাম্প্রতিককালে, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডক্টর মার্ক. আর. লুনির  তত্ত্বাবধানে গবেষকরা ইঁদুরের উপর দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে আবিষ্কার করেছেন যে, ফুসফুস থেকে সরাসরি যথেষ্ট পরিমাণে অণুচক্রিকার সৃষ্টি হতে পারে। তারা “ইন্ট্রাভাইটাল মাইক্রোস্কোপিক ইমেজিং”-এর  সাহায্যে ইঁদুরের ফুসফুসের কোষীয় গমনপদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করেনl গবেষকরা অণুচক্রিকা ও রক্তজনিতৃকোষগুলিকে তাদের কোষীয় মার্কার অনুযায়ী, “ফ্লুওরোসেন্স লেবেলিং” এর সাহায্যে চিহ্নিত করেন যাতে রক্তপরিবহন পথে কোষগুলির উপস্থিতি এবং তাদের নির্দিষ্ট গতিপথের ভিডিও রেকর্ডিং করে সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। ফুসফুসীয় রক্তসঞ্চালনের ভিডিও রেকডিং থেকে বৈজ্ঞানিকরা এই সিদ্ধান্তে আসেন যে,  অস্থিমজ্জার মেগাক্যারিওসাইট সরাসরি ফুসফুসীয় সংবহন পথে চলে আসে এবং সেখানে যথেষ্ট অণুচক্রিকার সৃষ্টি করে। ফুসফুসে সৃষ্ট নতুন অণুচক্রিকা ফুসফুসীয় সংবহন থেকে বার হয়ে মূল রক্তসংবহন পথে চলে আসে। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে, সম্পূর্ণ অণুচক্রিকার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ ফুসফুস থেকে তৈরী হয়! গবেষকদের এই অভিনব পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা বিশ্ববিখ্যাত “নেচার” ও “ব্লাড” গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে [৩,৪]l

এছাড়া, গবেষকরা প্রমাণ করেছেন যে, উপরে উল্লিখিত নানান কারণে যখন  রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণ বিশেষ ভাবে কমে যায়, তখন পরিণত ও অপরিণত যে মেগাক্যারিওসাইট কোষগুলো ফুসফুসের কলার বাইরের খাঁজেখোঁজে (extravascular space) থাকে, তারা সংবহন পথে পৌঁছে যায় অস্থিমজ্জাস্থানে এবং রক্তে পুনরায় অণুচক্রিকার সংখ্যা সার্বিক ভাবে বৃদ্ধি করে রোগপ্রশমনে সাহায্য করে l নিঃসন্দেহে এই আবিষ্কার বিজ্ঞান গবেষণায় রক্তজনিতৃকোষ ও অণুচক্রিকা সম্বন্ধীয় নানা রোগের শারীরবৃত্তিয় কার্য-কারণ ও সার্বিক নিরাময়ের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।

বৈজ্ঞানিক তথ্য উৎস:

[১] Ribatti D, Crivellato E. Giulio Bizzozero and the discovery of platelets. Leuk Res. 2007 Oct;31(10):1339-41. Epub 2007 Mar 26. PubMed PMID: 17383722

[২] Aschoff L: Über capillare Embolie von riesenkemhaltigen Zellen. Arch Pathol Anat Phys 1893, 134:11-14

[৩] https://www.nature.com/articles/nature21706

[৪] https://www.sciencedirect.com/science/article/abs/pii/S0008874918304404?via%3Dihub

The post রক্তকণিকা সৃষ্টিতে ফুসফুসের কার্যকরী ভূমিকা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

এ আই এর প্রকৃতি ও প্রয়োগ: গোড়ার কথা

$
0
0

মানুষের বুদ্ধির সাথে যান্ত্রিক বুদ্ধির তফাতটা আদতে কোথায়? ছবি চেনার মতো সহজ কাজ করতে একটা যন্ত্রের দম বেরিয়ে যায় কেন?


আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (artificial intelligence), যাকে সংক্ষেপে আমরা ‘এ আই’ (AI) বলে জানি, তার আক্ষরিক অনুবাদ হোলো ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’। প্রকৃতিতে প্রতিটি প্রাণীর আচরণে কম বেশি যে বুদ্ধির প্রকাশ দেখা যায়, মানুষের তৈরি কোনও যন্ত্রে যদি তারই কোন অংশ ফুটে ওঠে, তাকে আমরা এ আই বলে মানতে পারি। এই যন্ত্র একটি রোবট হতে পারে, একটি কারখানার স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হতে পারে, বা মোবাইলের একটি আ্যপও হতে পারে।

আজকাল যে অনেক বেশি এ আই-এর কথা শোনা যায় তার প্রধান কারণ হল মোবাইলের অনেক আ্যপে এর ব্যবহার। ছবির মধ্যে কারও মুখ চেনা, ম্যাপে দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর রাস্তা দেখানো, টাইপ করার সময় ঠিক কোন শব্দটি খুঁজছি তা বলে দেওয়া, টাইপের পরিবর্তে মুখের কথা শুনে নেওয়া, ই-মেইলের সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত উত্তর বানিয়ে দেওয়া, এ সবই এ আই-এর মহিমা এবং প্রকাশ। এ আই এর প্রয়োগ ক্ষেত্র অবশ্য এর চেয়ে অনেক বিস্তীর্ণ – চিকিৎসাবিদ্যায় রোগনির্ণয় থেকে শুরু করে ওষুধ তৈরির কলাকৌশল, রোবটের গতি নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে স্বয়ংচালিত গাড়ি, এমনকি শেয়ার বাজারের দামের ওঠানামার ভবিষদ্বাণী থেকে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের বৃহদায়তন তথ্য বিশ্লেষণ, এই সবের জন্যই এই প্রযুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

বুদ্ধির প্রকৃতি

বুদ্ধির প্রকৃতি নিয়ে আমাদের মনে নানান ধারণা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হোলো ধাঁধা বা অঙ্কের সমাধান করার ক্ষমতা। আমাদের কাছে যা কঠিন, তাতেই বুদ্ধির প্রয়োজন, এমন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কম্পিউটারের সামর্থ্য অন্যরকম। সে মুহূর্তের মধ্যে অনেক হিসাব কষে ফেলতে পারে, লক্ষ লক্ষ তথ্যের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যটি খুঁজে নিতে পারে। এই কাজ আমাদের করতে গেলে দিন কেটে যাবে, ভুল হবে। আবার আমরা খুব সহজে চোখে দেখে আশপাশের জিনিসগুলো চিনে নিই, এবং তাদের আকৃতি ও অবস্থান সম্বন্ধেও অনেকটা ধারণা করতে পারি। আমরা কথা বলে এবং শুনে নিজেদের মধ্যে নির্ভুলভাবে যোগাযোগ করতে পারি। এর সবকটিই কম্পিউটারের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। কম্পিউটারকে দিয়ে এই আপাত সহজ কাজগুলো নির্ভরযোগ্য ভাবে করানো এ আই-এর অন্যতম লক্ষ্য।

মানুষের চিরকালের স্বপ্ন নিজের মত একটি দক্ষ ও বুদ্ধিমান রোবট বানানোর। সেই রোবটের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চালনা করার নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আবার সেই কম্পিউটারের হাতেই। আমরা যদিও অনায়াসেই হাঁটতে, লাফাতে ও দৌড়তে পারি, একটি রোবটকে দিয়ে এইগুলো করানো কিন্তু মোটেও সহজ নয়। অনেক জটিল গতিবিদ্যার তত্ত্ব কষেও কম্পিউটার এখনো রোবটকে স্বচ্ছন্দে যে কোনও ভূখণ্ডে হাঁটাতে পারে না। মানুষ যেমন ছোট থেকে বড় হওয়ার পথে এই ক্ষমতাগুলো নিজেই আয়ত্ত করে ফেলে, সেরকম কম্পিউটারও কি পারে না? এটাও এ আই এর জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ।

কম্পিউটারকে দিয়ে মানুষের কাছে আপাত সহজ কাজগুলো নির্ভরযোগ্য ভাবে করানো এ আই-এর অন্যতম লক্ষ্য।

সন্ধানের ভিত্তিতে সমাধান

কম্পিউটারকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সব নির্দেশ না দিলে সে সঠিক কাজ করতে পারে না। এইভাবে অনেক লম্বা এবং জটিল হিসাব নির্ভুল ভাবে এবং মুহূর্তের মধ্যে করা সম্ভব, কিন্তু ধাঁধা বা অঙ্কের সমাধান কি কম্পিউটার করতে পারবে? কিভাবে? গত শতাব্দীর ষাটের দশকে নিউয়েল, শ ও সায়মন দেখালেন কি ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম একটি জ্যামিতির উপপাদ্য প্রমাণ করতে পারে [১]। এর প্রধান উপাদান ছিল সমস্যা নির্ভর কয়েকটি সরল চাল ও তাদের প্রয়োগ পদ্ধতি। ওঁরা এমন একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের কাঠামো বানালেন যাতে সমস্যার শুরুর অবস্থার উপর পর্যায়ক্রমে এই সরল চালগুলি প্রয়োগ করে দেখা যায় গন্তব্য পরিস্থিতিতে পৌঁছানো গেল কিনা। কার্যকরী না হলে আবার পূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরে অন্য চালের কথাও ভাবা যায়। এইভাবে কয়েকটি সরল চাল দিয়ে বেশ জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব। মোটামুটি এইভাবেই আমরাও ধাঁধা বা অঙ্কের সমাধান করি, তবে এত গুছিয়ে করি না, তাই কখনো তাড়াতাড়ি, আবার কখনো বেশ দেরি হয়, বা সমাধান মেলে না।


হারবার্ট সায়মন ও অ্যালেন নিউয়েল দাবা খেলার প্রোগ্রাম লেখার চেষ্টা করছিলেন পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে (ছবির সূত্র)

সমস্যা নির্ভর কয়েকটি সরল চাল দিয়ে সমাধানে পৌঁছনোর এই কাঠামোটির ব্যবহার করে প্রথমে চাইনিস চেকার, তারপর দাবা খেলায় কম্পিউটারের নৈপুণ্য প্রদর্শিত হোলো। দাবা খেলায় চালের সংখ্যা প্রচুর, তাই এই ক্ষেত্রে সমস্যা সম্পর্কিত জ্ঞানের ব্যবহার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দাবার বোর্ডে ঘুঁটির অবস্থান অনুযায়ী খেলার পরিস্থিতির প্রকৃত মূল্যায়ন করার চেষ্টাই এই জ্ঞানের মুখ্য কৌশল বলা যেতে পারে। তার সাথে যোগ হোলো আধুনিক কম্পিউটারের তীব্র গতি ও বিপুল স্মৃতির ভান্ডার। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৭ সনে গ্যারি কাস্পারভকে হারালো আইবিএমের ডীপ ব্লু কম্পিউটারে অধিষ্ঠিত দাবার প্রোগ্রাম। এ আই এর জন্য এটি ছিল একটি বিশেষ সাফল্যের মুহূর্ত। তবে এই সাফল্য অনেকটাই কম্পিউটারের গণনা ও অন্বেষণের পাশবিক শক্তির ফল। গ্র্যান্ড মাস্টার যে বিচার ও সুচতুর অনুমান থেকে চাল দেন তা কিন্তু এখনও কম্পিউটারের বোধের বাইরে।

এতো ছিল নিতান্তই খেলা। এছাড়াও অনেক বাস্তব সমস্যার সমাধানে মোটামুটি এই কাঠামোটি প্রয়োগ করা যেতে পারে – যেমন ক্যালকুলাসে ইন্টিগ্রেশন, এবং সাধারণ ভাবে যে কোনো সরলীকরণ প্রক্রিয়ায়, রাসায়নিক শিল্পে পাইপের বিন্যাস, ইন্টিগ্রেটেড সারকিটের নকশা, রোবটের নির্বাধ গতিপথ নির্ধারণ, ধাতব পাত বা প্লাইউড বোর্ড সবচেয়ে কার্যকারী ভাবে কাটা, ইত্যাদি। এখনকার যে কোনো কম্পিউটার সহায়তায় পরিকল্পনা (Computer-aided Design বা CAD) প্যাকেজের এগুলি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সমাধানে জ্ঞানের ভূমিকা

নিউয়েল, শ ও সায়মন প্রনোদিত এই কাঠামোকে তাঁরা নাম দিলেন ‘জেনারাল প্রব্লেম সল্ভার’ (General Problem Solver), অর্থাৎ যে কোনো সমস্যা সমাধানের উপায়। কার্যত দেখা গেলো বেশিরভাগ বাস্তব সমস্যার সমাধানের জন্য সেই বিষয়ের অনেক জ্ঞানের প্রয়োজন। সেই জ্ঞানকে ঠিক কিভাবে নিবেদন করলে সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে উঠবে তাই নিয়ে অনেক চর্চা হোলো। এই নতুন বিষয়টির নাম হোলো ‘নলেজ রিপ্রেসেন্টেশন’ (knowledge representation) বা জ্ঞান উপস্থাপনার পদ্ধতি। একটি বিশেষ বিষয়ের জ্ঞানকে উপযুক্ত ভাবে উপস্থাপনা করে তার থেকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পরামর্শ নেওয়ার জন্য তৈরি হল ‘এক্সপার্ট সিস্টেম’ (expert systems) বা বিশেষজ্ঞ প্যাকেজ।

অনেক ক্ষেত্রেই  বিষয়ের জ্ঞানকে কতগুলি নিয়মের মধ্যে ধরা হোতো। এই নিয়মের গঠন হোলো ‘যদি X সত্য হয়, তবে Y সত্য বা Y করা যেতে পারে’।  অনেকটা আগের মতন কাঠামোতেই সরল চালের জায়গায় সমস্যা সমাধানের নিয়ম প্রয়োগ করা যায়। একটি বিশেষ প্রয়োগ ক্ষেত্রে, যেমন চিকিৎসাবিদ্যায় রোগনির্ণয় বা চিকিৎসাদানের জন্য, এমন বেশ কিছু নিয়ম বানানো যায়, এবং রোগীর উপসর্গ থেকে শুরু করে উপযুক্ত নিয়মের প্রয়োগের মাধ্যমে কার্যকরী চিকিৎসায় পৌঁছনো যেতে পারে। সত্তরের দশকে রক্তের সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য মাইসিন নামে একটি বিশেষজ্ঞ প্যাকেজ বেশ সাফল্য অর্জন করে [২]। তবে এর ব্যবহার তেমন হয়নি, কারণ ভুল হলে তার দায়িত্ব নেবে কে?

লিখিত ভাষার মর্মোদ্ধার

এ আই এর আরেকটি দিক হল কোনো লিখিত বর্ণনা পড়ে, তার মানে বুঝে, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। কম্পিউটার যদিও অনায়াসে প্রোগ্রামের ভাষা বুঝে নেয়, লিখিত ভাষা বোঝা একেবারে অন্যরকম ব্যাপার। প্রোগ্রামের ভাষার একটি খণ্ডের অর্থ একই, তা প্রোগ্রামের যেখানেই আসুক না কেন। লিখিত ভাষায় অনেক ক্ষেত্রেই একটি শব্দের বা বাক্য খণ্ডের অর্থ কি প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, অর্থাৎ আগে কি বলা হয়েছে, তার উপর নির্ভর করে। তাই লিখিত ভাষার মানে বোঝা কম্পিউটারের পক্ষে বিশেষ কঠিন।

এর জন্য প্রথমে বাক্যের শব্দ এবং যতিচিহ্নগুলি আলাদা করে ব্যাকরণ অনুযায়ী তার গঠনটি বুঝে নিতে হয়। বাক্যের উদ্দেশ্য-বিধেয়, বিশেষ্য-বিশেষণ-ক্রিয়াপদ ইত্যাদি বুঝে একটি উপযুক্ত অভ্যন্তরীণ বর্ণনা তৈরি করা হয়। এই বর্ণনায় প্রত্যেকটি শব্দের অর্থ ও তাদের মধ্যে সম্পর্ককে ধরা আছে। বলাই বাহুল্য, অনেক সময়ই একাধিক অর্থের সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হয় যতক্ষণ না নতুন তথ্যের আলোয় বোঝা যায় এদের মধ্যে কোনটি ঠিক। আরও একটি কঠিন ব্যাপার হলো একটি বাক্যের সাথে তার পরের বাক্যের সম্পর্ক বুঝে জ্ঞানের অভ্যন্তরীণ বর্ণনায় উপযুক্ত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আরও প্রয়োজন হল অভ্যন্তরীণ এই জ্ঞানের বর্ণনা থেকে শুদ্ধ বাক্য রচনা করার ক্ষমতা। এই পর্যায়ে অন্য একটি ভাষাতেও বাক্য রচনা করা যেতে পারে। সেটা হবে যন্ত্রের অনুবাদ। লিখিত ভাষা বুঝে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার এই পদ্ধতি নিয়েও অনেক বছর ধরে অনেক গবেষণা হয়েছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে সাফল্যও এসেছে, তবু এই পদ্ধতি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। এর উপরে যখন উচ্চারিত কথা শুনে ও সেটা বুঝে কম্পিউটারকে তার উত্তর দিতে হয়, ভুলের সম্ভাবনা যায় আরও অনেক গুন বেড়ে।

লিখিত ভাষা বোঝা কম্পিউটারের পক্ষে বিশেষ কঠিন কারণ একটি শব্দের বা বাক্য খণ্ডের অর্থ তার প্রসঙ্গের উপর নির্ভর করে।

ছবি চেনা

এ আই-এর আরেকটি লক্ষ্য হলো ক্যামেরার ছবি বা ভিডিওর থেকে আশপাশের জিনিসগুলোকে চেনা ও তাদের পারস্পরিক অবস্থান সম্বন্ধে ধারণা করা। একটি রোবটের এই ক্ষমতার বিশেষ প্রয়োজন, কারণ তবেই সে কিভাবে কাজ করবে তার পরিকল্পনা করতে পারে। এই বিষয়টি গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ষাটের দশক থেকে, এবং এ বিষয়ে কাজও হয়েছে প্রচুর। তবে এই সমস্যাটি এতই কঠিন যে সব পরিস্থিতিতে কার্যকরী হবে এমন সমাধান পাওয়া মুশকিল।

ক্যামেরার থেকে যে ছবি পাওয়া যায়, তার প্রতিটি বিন্দুতে রঙ ও ঔজ্জ্বল্য কত সেই তথ্য কম্পিউটারকে দেওয়া হয়। এই তথ্য থেকেই বিভিন্ন পদ্ধতিতে কম্পিউটার বোঝার চেষ্টা করে ছবিতে কি দেখা যাচ্ছে। এর জন্য প্রথমে ছবির বিভিন্ন অংশকে আলাদা করা হয় – যেমন একটি ছবিতে দেয়াল, টেবিল, ও টেবিলের ওপরে রাখা একটি বইকে আলাদা করা যেতে পারে। একটি অংশের মধ্যে রঙ ও ঔজ্জ্বল্যের মাত্রা প্রায় একই থাকে অথবা খুব ধীরে পরিবর্তন হয়; প্রাথমিক ভাবে এই নীতি প্রয়োগ করেই অংশগুলিকে আলাদা করা হয়।

এরপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হোলো প্রতিটি অংশের মধ্যে প্রচ্ছন্ন জিনিসটির সীমাসূচক রেখাগুলিকে আবিষ্কার করা।  ছবির মধ্যে যে বিন্দুগুলিতে ঔজ্জ্বল্যের পরিবর্তনের হার সবচেয়ে বেশি তাদের নিয়েই এই রেখাগুলি তৈরি। এই রেখাগুলির প্রত্যেকের দিক ও কিভাবে তারা এক একটি বিন্দুতে এসে মিলেছে, তার মধ্যে জিনিসটির আকৃতির একটি ছাপ থাকে, যা দিয়ে তাকে চেনা যায়।  জিনিসের আকৃতি ও ভঙ্গি অনুযায়ী এই রেখার বিন্যাস ভিন্ন হয়। পরিচিত জিনিসের সম্ভাব্য রেখার বিন্যাসের তথ্য কম্পিউটারের কাছে তালিকাভুক্ত থাকে। তার সাথে মিলিয়ে সে বুঝে নেয় ছবিতে কোন জিনিসটি দেখা যাচ্ছে এবং তার ভঙ্গি কি। অবশ্যই ব্যাপারটা অত সহজ নয়, এবং কম্পিউটার প্রায়ই বুঝে উঠতে পারে না, বা ভুল বোঝে। এর প্রধান কারণ প্রতিকূল আলোয় কোনো রেখার মাঝপথে হারিয়ে যাওয়া, জিনিসের আংশিক ভাবে ক্যামেরার দৃষ্টির আড়ালে পড়ে যাওয়া, এবং সর্বোপরি জিনিসের আকৃতির ভীষণ বৈচিত্র্য যা জ্যামিতিক বর্ণনায় ধরা কঠিন। এরপর অবশ্য এই প্রাথমিক পদ্ধতিটির সঙ্গে আরো অনেক আনুষঙ্গিক পদ্ধতির যোগ হয়, যেমন আলো ছায়ার থেকে বিভিন্ন পৃষ্ঠতল কোন দিকে মুখ করে আছে তা অনুমান করা। পৃষ্ঠতল কতটা উজ্জ্বল বা নিষ্প্রভ অথবা কতটা দানাদার তার থেকেও জিনিস চিনতে সুবিধা হয়। কিন্তু এ সত্বেও দৈনন্দিন ব্যবহারের অনেক জিনিসই কম্পিউটারের পক্ষে নির্ভুল ভাবে চেনা সহজ ছিল না। সম্প্রতি নতুন প্রযুক্তিতে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে।

এ পর্যন্ত এআই এর যে অতি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেওয়া হোলো, তাকে সনাতন এ আই বলা যেতে পারে। এর ভিত্তি ছিল যুক্তিবাদ, অর্থাৎ প্রতিটি বুদ্ধির কাজকে বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে কিভাবে কম্পিউটারকে এই ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। তাতে সব ক্ষেত্রেই কিছু সরল সমস্যার সমাধান হলেও, বাস্তবের অনেক সমস্যাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। অথচ একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, আমাদের ক্রিয়াকলাপ প্রায়ই আমাদের অজান্তে অবচেতন থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। আশপাশটা দেখে বুঝে বা চিনে নেওয়া, কথা বলা এবং শোনা, এসবের জন্য আমরা কখনও ভাবতে বসিনা। কিভাবে আমাদের অবচতেনকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে এনে দিলো নিউরাল নেটওয়ার্ক, সেটা আমরা দেখবো পরের পর্বে।

প্রচ্ছদের ছবি: গ্যারি কাস্পারভ আই বি এমের ডীপ ব্লু এর কাছে পরাজিত হলেন ১৯৯৭ এ (ছবির সূত্র)

কিছু রেফারেন্স:

[১] Newell, A., Shaw, J. C., & Simon, H. A. (1958). Elements of a theory of human problem solving. Psychological Review, 65(3), 151–166. https://doi.org/10.1037/h0048495

[২] https://en.wikipedia.org/wiki/Mycin

The post এ আই এর প্রকৃতি ও প্রয়োগ: গোড়ার কথা appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).


এ আই এর প্রকৃতি ও প্রয়োগ: নিউরাল নেটওয়ার্ক

$
0
0

নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর ভিতর কি থাকে যাতে একটা যন্ত্র মানুষের মতো নিজে নিজেই শিখতে পারে?


লেখাটির প্রথম পর্বে আমরা দেখেছিলাম মানুষের জন্য আপাত সহজ কিছু কাজ করতে একটা যন্ত্রকে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়। একটা ছবি চেনা কিংবা লিখিত শব্দের মর্মোদ্ধার করা, যেগুলো মানুষ অবলীলায় করতে পারে, সেগুলোই একটা যন্ত্রকে ধরে ধরে শেখানো প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পরে। এই পর্বে আমরা এই সমস্যার একটি সমাধান দেখবো।

সনাতন আইএর সীমাবদ্ধতা

সনাতন এ আই-এর ভিত্তি ছিল যুক্তিবাদ, অর্থাৎ প্রতিটি বুদ্ধির কাজকে বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে কিভাবে কম্পিউটারকে এই ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। তাতে সব ক্ষেত্রেই কিছু সরল সমস্যার সমাধান হলেও, বাস্তবের অনেক সমস্যাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। অথচ একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, আমাদের ক্রিয়াকলাপ প্রায়ই আমাদের অজান্তে অবচেতন থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। আশপাশটা দেখে বুঝে বা চিনে নেওয়া, কথা বলা এবং শোনা, এসবের জন্য আমরা কখনও ভাবতে বসিনা। সনাতন এ আই-তে ধরা হোতো যন্ত্রের কার্যকলাপে বুদ্ধির প্রকাশের জন্য প্রয়োজন অনুভব – বোধ – কর্ম এমন একটি চক্রাকার নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা। অনুভব হলো কাজের উপযোগী একাধিক সেন্সর থেকে যে তথ্যের ধারা আসতে থাকে, তাদের সঞ্চয় করা। বোধ হোলো এই তথ্যের বিশ্লেষণ করে পরিবেশের সম্বন্ধে একটি ধারণা করা, বা পরিবেশের একটি মডেল তৈরি করা। এই মডেলের ভিত্তিতে, লক্ষ্য অনুযায়ী, যুক্তি, তর্ক ও অন্বেষণের মাধ্যমে স্থির করা হয় যন্ত্রের কি করা উচিত।

অবিরাম কম্পিউটার এই নিয়ন্ত্রণ চক্র মেনে চলতে থাকে, যাতে পরিবেশে হঠাৎ কোনও পরিবর্তন হলেও যন্ত্র তা মানিয়ে নিতে পারে। এই নিয়ন্ত্রণ চক্রটি আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে বেশ যুক্তিগ্রাহী মনে হলেও, এতে প্রছন্ন আছে ‘বুদ্ধির ভিত্তি যুক্তি’ এমন একটি ধারণা। এর বিকল্প যে বুদ্ধির গঠন হতে পারে তা হোলো সরাসরি অনুভব থেকে কর্ম এমন একটি নিয়ন্ত্রণ চক্র। এতে যুক্তি তর্কের কোনও বালাই নেই। অনেকটা অবচেতন থেকে শুধু অনুভবের ভিত্তিতে কাজ স্থির করা। এই উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত হোলো মস্তিষ্কের স্নায়বিক জালের অনুকরণে আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক (artificial neural network), অর্থাৎ কৃত্রিম স্নায়বিক জাল, সংক্ষেপে এ এন এন।

সনাতন এ আই-তে ধরা হোতো যন্ত্রে বুদ্ধির প্রকাশের জন্য প্রয়োজন অনুভব – বোধ – কর্ম,  এমন এক চক্রাকার নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা।

নিউরাল নেটওয়ার্কএর জন্ম

এর ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছিল চল্লিশের দশক থেকেই, যখন কম্পিউটারের গঠন কেমন হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এর প্রধান অঙ্গ ছিল উদাহরণ থেকে কাজ শেখার ক্ষমতা।  এই সময় যে ধরনের নিউরনের কথা ভাবা হয়েছিল, তার ইনপুট আর আউটপুটের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল সরলরৈখিক, তাই এর ক্ষমতা ছিল সীমিত। সত্তরের দশকে মারভিন মিন্সকি ‘পারসেপ্ট্রন’ নামে একটি বইয়ে [১] এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে নিউরাল নেটওয়ার্ক কখনওই কোনো কঠিন কাজ শিখতে পারবে না। এর ফলস্বরূপ বেশ কিছু বছর এই বিষয়ে গবেষণা প্রায় বন্ধ থাকে। এরপর আশির দশকের শেষার্ধে রুমেলহার্ট ও আরও অনেকে অরৈখিক (নন লিনিয়ার) নিউরনের নেটওয়ার্ক বানিয়ে তাকে কিভাবে কাজ শেখানো যায় তা দেখালেন [২]। তার সফল প্রয়োগ হলো অনেক ক্ষেত্রে। এরপর আবার এ এন এন নিয়ে নতুন করে আগ্রহ জন্মালো সবার মনে। কৃত্রিম নিউরন একটি অতি সরল গণকযন্ত্র যে তার ইনপুট থেকে কেবল একটি নির্দিষ্ট সূত্র অনুযায়ী আউটপুট গণনা করে। নিচের ছবিতে এই ধরণের নিউরন দিয়ে গঠিত একটা স্নায়ুতন্ত্রের ছবি দেওয়া হলো।


স্তরপূর্ণ নিউরাল নেট – বাঁয়ে ইনপুট স্তর, মাঝে দুটি গুপ্ত স্তর, ডাইনে আউটপুট স্তর। প্রতিটি স্তর তার পরের স্তরের সাথে সম্পূর্ণ ভাবে সংযুক্ত (ছবির সূত্র)

যে সূত্রের মাধ্যমে আউটপুট গণনা হয়, সেটা নানারকম হতে পারে। কিন্তু তা অবশ্যই সরলরৈখিক নয়, অর্থাৎ ইনপুট কিছুটা পরিবর্তন হলে আউটপুট সেই অনুপাতেই পরিবর্তিত হবে এমন নয়। উপরের ছবিটির মতো একটি নিউরন অন্য অনেক নিউরনের থেকে একত্রে ইনপুট নিতে পারে, আবার তার আউটপুট অন্য অনেক নিউরনের ইনপুটে পৌঁছে দিতে পারে। একটি নিউরনের আউটপুট থেকে আরেকটি নিউরনের ইনপুটে বার্তা যাওয়ার পথে আছে নিয়ন্ত্রণকারী একটি ভার (ওয়েট) যেটি ঠিক করে দেয় দ্বিতীয় নিউরনের সক্রিয়তায় প্রথম নিউরনের অবদান কতটা থাকবে। নিউরনগুলি নিজেদের মধ্যে নানারকমভাবে সংযুক্ত থাকতে পারে। একটি সংযোগের ভার ঠিক করে দেয় তার সক্রিয়তা কেমন হবে। একটি নিউরাল নেটকে শেখানো মানে হচ্ছে তাদের সংযোগের ভারগুলির মান ঠিক করে দেওয়া, যাতে তারা শেখানো আচরণটি অনুসরণ করতে পারে।

ইনপুট, আউটপুট গুপ্ত স্তর

পারস্পরিক সংযোগের ধরণের উপর নির্ভর করে নানারকম নিউরাল নেট বানানো যায়। এখানে বিশেষ ভাবে যে নিউরাল নেটের কথা আলোচিত হবে তার নিউরনগুলি ইনপুট থেকে আউটপুট অবধি স্তরে স্তরে সাজানো। ইনপুট স্তরের নিউরনগুলি সমস্যার বিবরণ গ্রহণ করে। আউটপুট স্তরের নিউরনগুলির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। যেমন, হাতে লেখা সংখ্যা চেনা যদি এর উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ইনপুট স্তরের নিউরনগুলিতে ইনপুট হবে একটি হাতে লেখা সংখ্যার চিত্রের প্রতিটি বিন্দুর ঔজ্জ্বল্য। তেমনি আউটপুট স্তরের এক একটি নিউরন এক একটি সংখ্যার প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য হতে পারে। অর্থাৎ, যে আউটপুট নিউরনের সক্রিয়তা সবচেয়ে বেশি, সে সংখ্যার চিত্রই ইনপুট করা হয়েছে বলে মানা হবে। ইনপুট এবং আউটপুট স্তরে কতগুলি করে নিউরন থাকা উচিত, তা নির্ভর করে সমস্যার প্রকৃতির উপর। সংখ্যার চিত্র যদি বর্গাকার ১০ x ১০ বিন্দুতে ঔজ্জ্বল্য দিয়ে বর্ণিত হয়, তাহলে ইনপুট স্তরে ১০০ টি নিউরনের প্রয়োজন। আউটপুট যেহেতু ০ থেকে ৯ এই দশটি সংখ্যাই শুধু হতে পারে, আউটপুট স্তরে প্রয়োজন মাত্র ১০ টি নিউরনের।

এতো হলো ইনপুট এবং আউটপুট স্তরের কাহিনী। এদের মাঝে থাকে এক বা একাধিক গুপ্ত নিউরনের স্তর বা হিডেন লেয়ার (hidden layer)। প্রথম গুপ্ত স্তরের প্রতিটি নিউরনের ইনপুট আসে ইনপুট স্তরের প্রতিটি নিউরনের আউটপুট থেকে, তাদের সংযোগের ভার অনুযায়ী। তেমনি গুপ্ত স্তরের প্রতিটি নিউরনের আউটপুট প্রেরিত হয় তার পরের গুপ্ত স্তরের প্রতিটি নিউরনের ইনপুটে (কিংবা যদি একটিই গুপ্ত স্তর থাকে, তাহলে তার আউটপুট প্রেরিত হয় আউটপুট স্তরের প্রতিটি নিউরনের ইনপুটে)। প্রত্যেকটি স্তরের প্রতিটি নিউরন তার ইনপুটে প্রাপ্ত সমস্ত বার্তাকে মিলিয়ে তার উপর গণনা করে আউটপুট বার্তা তৈরি করে [২]। এইভাবে অবশেষে আউটপুট স্তরে প্রকাশিত হয় সমাধান।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই সমাধান নির্ভর করে নিউরনগুলির পারস্পরিক সংযোগের ভারের বর্তমান মানের উপর। সমাধানকে কার্যকরী করার জন্য সমস্ত ভারের উপযুক্ত মান হওয়া দরকার। রুমেলহার্ট ও তার সহকর্মীরা ব্যাকপ্রপাগেশন আ্যলগরিদম (backpropagation algorithm) তৈরি করলেন অনেক উদাহরণ থেকে এই ভারগুলির মান স্থির করার জন্য। এটি অবশ্য এক দফায় হয় না। অনেক উদাহরণকে বারবার দেখিয়ে ধীরে ধীরে নেটওয়ার্ক তার সমস্ত সংযোগের ভারের মান বেঁধে নেয়। প্রতিটি উদাহরণে সমাধানে যে পরিমাণ ভুল হোলো, তার উপর ভিত্তি করে পেছনের প্রতিটি স্তরের সংযোগের ভার উপর নিচ করে ভুল কমানোই এই আ্যলগরিদমের উদ্দেশ্য। সহজ সরল হলেও এই আ্যলগরিদম খুবই কার্যকরী প্রতিপন্ন হয়েছে। এর ব্যবহার এখনও অব্যাহত, যদিও ক্ষেত্র অনেক বদলে গেছে।

নিউরাল নেটওয়ার্ক কদ্দুর যেতে পারে

নব্বইয়ের দশকে এ এন এন-এর অনেক প্রয়োগ হয়েছিল তথ্যের শ্রেনীবিভাগ বা তার মধ্যে কোনও বিশেষ জিনিস বা প্যাটার্নকে চেনার জন্য। এগুলি অন্য অনেক পদ্ধতিতেও করা সম্ভব ছিল, কিন্তু এ এন এন-এর এই প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করাটা জরুরি ছিল। এ এন এন এর ক্ষেত্রে নতুন ছিল ইনপুট এবং আউটপুট কিরকম হবে, কোন স্তরে কটি নিউরন হলে ঠিক হয়, এই সবের বিচার। তাছাড়া প্রয়োজন ছিল অনেক উদাহরণের, যার থেকে এর সম্যক শিক্ষা সম্ভব হতে পারে। এ এন এন ঠিক কিভাবে কাজ করে তা নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা হয়েছে এই সময়। বোঝা গেলো এর প্রতিটি স্তর তার নিচের স্তরের তথ্যের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য আছে তাকে প্রকাশ করার চেষ্টা করে। এইভাবে অনেক স্তরের মধ্যে দিয়ে প্রায় যে কোনো সমস্যার সমাধান শিখে নেওয়া যেতে পারে।

কিন্তু দেখা গেলো স্তরের সংখ্যা বাড়ালে শিক্ষার সময় নিচের স্তরের সংযোগের ভারে প্রায় কোনো পরিবর্তনের ঢেউ এসে পৌঁছচ্ছে না। তাই বিশেষ কঠিন সমস্যার সমাধান এ এন এন এর এক্তিয়ারের বাইরেই রয়ে গেলো। এছাড়া অন্য সমস্যাও ছিল। অনেক সমস্যা সমাধানেই, যেমন ক্যামেরার ছবির বিশ্লেষণে, ইনপুট স্তরে বহুসংখ্যক নিউরনের প্রয়োজন হয়। এতে অনেক বেশি সংযোগ ভারের আমদানি হয়, আর তাদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় অসংখ্য উদাহরণ, যা সংগ্রহ করে ভার শিক্ষায় ব্যবহার করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এর ফলে ধীরে ধীরে এ এন এন এর প্রতি গবেষকদের আগ্রহ কমে যাচ্ছিল। এর পর ২০০৬ এ বহুস্তরীয় এ এন এন এর শিক্ষার বিষয়ে একটি নতুন ধারণা এলো ক্যানাডার কয়েকজন বৈজ্ঞানিকের কাছ থেকে। শুরু হোলো ডীপ লার্নিং (deep learning) বা গভীর শিক্ষার অভিযান।

আরো একবার সম্ভাব্য ব্যর্থতার মুখে দাঁড়িয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। কথা বলে নিজের বক্তব্য পেশ করা, অন্যের কথা শুনে বোঝা, আশপাশের অজস্র জিনিসকে চিনে নেওয়া, এগুলো আমরা ঠিক কিভাবে করি তা কয়েকটি স্পষ্ট নিয়ম দিয়ে বাঁধা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল সনাতন যুক্তিভিত্তিক এ আই তে। আশা ছিল এ এন এন এই জটিল সমস্যার সমাধান শিখে নেবে প্রচুর উদাহরণ থেকে। তার জন্য প্রয়োজন বহুস্তরীয় এ এন এন। কিন্তু শুধু ব্যাক প্রপাগেশন অ্যালগরিদম দিয়ে এমন বহুস্তরীয় নেটের সন্তোষজনক শিক্ষা হচ্ছিল না।

কিছু রেফারেন্স:

[১] Perceptrons: an introduction to computational geometry, by Marvin Minsky and Seymour Papert

[২] নিউরাল নেটওয়ার্ক-এ কিভাবে ননলিনিয়ার গণিত ব্যবহৃত হয়, তার কয়েকটি সহজ উদাহরণ এখানে দেখুন।

[৩] Krizhevsky, Alex & Sutskever, Ilya & Hinton, Geoffrey. (2012). ImageNet Classification with Deep Convolutional Neural Networks. Neural Information Processing Systems. 25. 10.1145/3065386. [৪] Geoffrey E. Hinton, Simon Osindero, and Yee-Whye Teh. 2006. A fast learning algorithm for deep belief nets. Neural Comput. 18, 7 (July 2006), 1527–1554. DOI:https://doi.org/10.1162/neco.2006.18.7.1527

The post এ আই এর প্রকৃতি ও প্রয়োগ: নিউরাল নেটওয়ার্ক appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

তথ্যের আলোকে নভেল করোনা ভাইরাস ও COVID-১৯

$
0
0

করোনা ভাইরাস নিয়ে আপনার মনে অনেক ধন্দ রয়েছে? দেখুন তো, এখানে তার কিছু সুরাহা হয় কিনা।


করোনা ভাইরাস কি?

গঠনগতভাবে করোনা ভাইরাস একটা বিশাল আরএনএ (RNA) ভাইরাসের পরিবার। “করোনা” শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হলো মুকুট। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের তলায় এই পরিবারের ভাইরাসকে অনেকটা রাজার মাথার মুকুটের মতন দেখায়, সেই থেকে এই নামকরণ (ছবি ১ দেখুন)। অন্যসকল ভাইরাসের মতো এরাও জীবনধারণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য কোন না কোন একটা প্রাণী বা উদ্ভিদ কোষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।

এই ভাইরাসের সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের স্পাইক বা কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়। দ্বিতীয় উপাদানটা হলো রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)। জীবন্ত কোষের ভিতরে প্রবেশ করে ভাইরাসটা  আরএনএ-র প্রতিলিপি তৈরি করে বংশ বিস্তার করে। আর তৃতীয় উপাদানটা হ’ল একটা লিপিড স্তর, এটা ভাইরাসের অন্যান্য অংশকে ধরে রাখে। করোনাভাইরাস-এর মারাত্মক প্রকোপ এবং এবং তাকে কিকরে ঠেকিয়ে রাখা যায়, সেটা বুঝতে হলে এই তিনটে অংশের কথাই আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

ছবি ১ –  করোনা ভাইরাস-এর গঠন (ছবির সূত্র)

যদিও করোনাভাইরাসের অনেক প্রজাতি আছে, তার মধ্যে মাত্র সাতটা প্রজাতি মানুষের দেহে রোগ সংক্রমণ করতে পারে [১]।  এদের মধ্যে চারটে সারা বছর ধরে অত্যন্ত সাধারণ হাঁচি-কাশি সর্দির উপসর্গ সৃষ্টি করে। এরা হল, 229E (আলফা করোনাভাইরাস), NL63 (আলফা করোনাভাইরাস), OC43 (বিটা করোনাভাইরাস), HKU1 (বিটা করোনাভাইরাস)

এছাড়া, মার্স কভ (MERS-CoV) – এটা একটা বিটা করোনাভাইরাস যা থেকে ২০১২ সালে মিড্ল্ ইস্ট রেস্পিরেটারি সিন্ড্রোম বা মার্স (Middle East Respiratory Syndrome, or MERS) ছড়িয়েছিল। সার্স কভ (SARS-CoV)– এটা একটা বিটা করোনাভাইরাস যা অতি তীব্র শ্বাস রোগ  বা সার্স (severe acute respiratory syndrome, or SARS) ছড়িয়েছিল। প্রথম ২০০২ সালে চীন দেশে এই রোগ দেখা গিয়েছিল।  মৃত্যুর হার প্রায় ১০০ রোগীপিছু ১০, তবুও এই রোগকে দ্রুত বাগে আনা গেছিলো কারণ মানুষ থেকে মানুষে তার সংক্রমণের হার ছিল কম। সব মিলিয়ে মোট ৮,০০০-এর কাছাকাছি রোগী এই রোগে আক্রান্ত হয় ও প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়। গবেষণায় প্রমাণ হয় যে একধরনের গন্ধগোকুল প্রজাতির প্রাণীর থেকে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছিল।  তৃতীয় আরেকটা টাইপ, সার্স কভ-২ (SARS-CoV-2) (severe acute respiratory syndrome coronavirus 2)-কেই নভেল করোনা ভাইরাস বলা হয়। এই সার্স কভ-২ মানুষের শরীরে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস ডিসিজ সংক্রামিত করে। এই ভাইরাসকে নভেল বা নতুন বলা হচ্ছে কারণ এই সংক্রামক ভাইরাসটা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাসটার আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি (2019-NCOV)। মানুষ থেকে মানুষে এর সংক্রমণের হার প্রচণ্ড বেশি। সারা পৃথিবীর প্রায় ১৬৬টা দেশ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO-র ১৮ই মার্চের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, – সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত ১,৯১,১২৭ জন (নতুন রোগী ১১,৫২৬), মৃত্যু হয়েছে ৭,৮০৭ জনের, সেরে উঠেছেন ৬৭,০০৩ জন [২]। ভারতে এখন (১৮ই মার্চ,২০২০) আক্রান্তের সংখ্যা ১৮০। মৃত্যু হয়েছে চারজনের। সেরে উঠেছেন উনিশজন [৩]।

ছবি ২ –  বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকারক করোনা ভাইরাস (ছবির সূত্র)

কোভিড-১৯ (COVID-19) কি?

নতুন আবিষ্কৃত বা নভেল করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে মানুষের দেহে যে ছোঁয়াচে রোগ সৃষ্টি হয়, সেই রোগের নাম কোভিড-১৯ (COVID-19) বা করোনা ভাইরাস ডিসিজ (coronavirus disease)। ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে চীনদেশের ইউহান প্রদেশে সর্বপ্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। ভাইরাস সংক্রমণ সব বয়েসের মানুষের মধ্যে হলেও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যারা বয়স্ক, তাদের এই রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি [৪]।

করোনাভাইরাস  কি তার গঠন বদলাতে পারে অর্থাৎ এর কি মিউটেশান (Mutation) হতে  পারে?

এই প্রশ্নটা জরুরি কারণ ভাইরাস-কে একটা অপরিবর্তনশীল বস্তু বলে ভাবলে চলবে না। যেকোনো আর.এন.এ (RNA) ভাইরাসের মতো সার্স কভ-২-ও খুব সহজেই তার গঠন বদলাতে পারে। অর্থাৎ, ভাইরাস যখন বংশ বিস্তার করে তখন যেমন খুশি নিজেদের জিনের সজ্জা বদলে ফেলতে পারে। এই জিনের পরিবর্তিত সজ্জা নিয়েই ভাইরাস এক মানব দেহ থেকে অন্য মানব দেহে সংক্রামিত হয়।

এখনও পর্যন্ত, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও প্রায় ১০০বার মিউটেশান লক্ষ্য করা গেছে। বার বার মিউটেশানের ফলে ভাইরাস খুব সহজেই নতুন নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কিন্তু এই মিউটেশানের প্রভাবে কোভিড-১৯ যুক্ত রোগীর উপসর্গে কি পরিবর্তন হচ্ছে তা এখনি বলা সম্ভব নয়। তাঁর জন্য প্রচুর নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাসের জিনোম সিকয়েন্সিং করে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে হবে [৫]। 

কোভিড-১৯(COVID-19)-এর উপসর্গগুলি কি?

রোগের উপসর্গ মূলতঃ জ্বর, শুকনো কাশি, ক্লান্তি। এছাড়া সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যাথা, ডায়েরিয়া-ও হতে পারে।

সাধারণ ফ্লু বা সর্দিজ্বরের সঙ্গে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। আক্রান্ত হবার পর প্রথম দিকে উপসর্গ খুবই কম থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কখনও কখনও এর পরিণামে নিউমোনিয়া ও শেষে মাল্টি অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে (১৪%)। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির কোন উপসর্গই থাকে না বা তারা অসুস্থ বোধ করেন না।  প্রায় ৮০% আক্রান্ত মানুষই সেরকম কোন চিকিৎসা  ছাড়াই সেরে ওঠেন।

জ্বর হলে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তিনি বিষয়টা  খতিয়ে দেখে প্রয়োজন বুঝলে পরীক্ষা করাতে বলবেন। প্রতি ছ’জন আক্রান্তের মধ্যে, একজনের শ্বাসকষ্টজনিত গুরুতর অবস্থা হতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এবং যারা বয়স্ক ( বিশেষত যাদের উচ্চ-রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা বা ডায়াবেটিস রয়েছে) তাদের এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে [৬]।

COVID-19 আটকানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের বহু দেশ দৈনন্দিন জীবনযাপন ও চলাফেরার উপর আমূল নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। কারণ হিসাবে কতগুলো কথা উঠে আসছে মিডিয়াতে, যেমন ‘এক্সপোনেন্সিয়াল’, ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’, ‘স্যোশাল আইসোলেশান’ – এত সাবধানতার কী প্রয়োজন আছে? এই শব্দগুলোরই বা মানে কী?

কোভিড-১৯(COVID-19) একটা ছোঁয়াচে রোগ। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু শরীরে ভাইরাস ঢোকা মানেই এমন নয় যে COVID-19 রোগের উপসর্গ সঙ্গে সঙ্গে ফুটতে আরম্ভ করবে। কারোর ক্ষেত্রে দিন দুয়েকের মধ্যেই উপসর্গ দেখা দেয়, কারোর ক্ষেত্রে আবার সপ্তাহ দুয়েক! এই সময়কে বিজ্ঞানের ভাষায় ইনকিউবেশান পিরিয়ড (Incubation period) বলে। এখনো পর্যন্ত দেখা গেছে নভেল করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশান পিরিয়ড গড়ে পাঁচদিনের মত। অর্থাৎ, এই ইনকিউবেশান পিরয়ডের মধ্যে সংক্রামিত কেউ না জেনেই আরও অনেককে সংক্রামিত করতে পারে। এক মাসের মধ্যে একজন কত জনকে সংক্রামিত করতে পারে? একটা সহজ অঙ্ক কষা যাক।

ধরা যাক, সমীরণ মাসের এক তারিখে করোনা ভাইরাসে সংক্রামিত হল। এর পরের পাঁচদিন অব্দি তার শরীরে COVID-19 এর কোন লক্ষণ ধরা পড়ে নি, কিন্তু সে অনেকের সাথে একসাথে আড্ডা দিয়েছে, একসাথে রেস্টুরান্টে খেতে গিয়েছে। আর এই মেলামেশার ফলে তার অজান্তেই দু-তিনজন সুস্থ মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। মাসের ছ’তারিখ নাগাদ যখন তার COVID-19-এর লক্ষণ ধরা পড়ল তখন থেকে সে অন্যদের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু ততক্ষণে কয়েকজনের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে ভাইরাস।

সমীরণ যে দু-তিনজনের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছে তারাও অন্যদের সাথে মেলামেশা করেছে! ধরা যাক তাদেরও COVID-19 এর উপসর্গ ধরা পড়তে দিন পাঁচেক সময় লেগেছে। তাহলে এই দুই-তিনজনের প্রত্যেকে আরও দু-তিনজন করে মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছে! এবার যারা আক্রান্ত হল তাদের প্রত্যেকে আরো কিছু সুস্থ মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়াবে। এমন করে মোট আক্রান্তের সংখ্যাটা খুব তাড়াতাড়ি বাড়তে থাকবে। একজন আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাসের ইনকিউবেশান পিরিয়ডের মধ্যে ধরা যাক গড়ে R0 (‘আর-নট’ বা ‘আর-জিরো’, reproduction number of the virus বোঝাতে) সংখ্যক লোককে সংক্রামিত করে। নভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা হল প্রায় আড়াই জন (মানে গড়ে আড়াই জন, এমন নয় যে তৃতীয় ব্যক্তির শরীরের অর্ধেক সংক্রামিত হয়েছে !)। ইনকিউবেশান পিরিয়ড পাঁচদিন ধরে নিলে প্রথম পাঁচদিনের শেষে, মানে মাসের ছ’তারিখ নাগাদ গড়ে R0 জন সংক্রামিত হল। এর পরের পাঁচ দিনে এই R0-এর প্রত্যেকে আরও R0 জনকে সংক্রামিত করল। অর্থাৎ, মাসের এগারো তারিখ নাগাদ মোট ভাইরাস আক্রান্ত লোকের সংখ্যা হল R0 নভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা হল গড়ে

২.৫= ২.৫x২.৫ = ৬.২৫,

অর্থাৎ গড়ে প্রায় ছ’জন। মাসের ষোল তারিখ নাগাদ

 ২.৫ = ২.৫x২.৫x২.৫ = ১৫.৬২৫

অর্থাৎ, প্রায় ষোল জন। এইভাবে মাসের শেষে সংক্রামিত লোকের সংখ্যা হবে

 ২.৫  = ২.৫x২.৫x২.৫x২.৫x২.৫x২.৫ = ২৪৪

অর্থাৎ প্রায় আড়াইশোর কাছাকাছি।  

পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশের করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা সময়ের সাথে এইভাবে হু হু করে বাড়ছে। এই ধরণের বৃদ্ধিকে এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধি (exponential growth) বলে। উদাহরণস্বরূপ,  ছবি ৩-এ  সময়ের সাপেক্ষে কিছু দেশের করোনা সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগই এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধি।

উপরের অঙ্কটা বুঝলে এটাও বোঝা যাবে কেন COVID-19 আমরা সাধারণ যে ফ্লু তে আক্রান্ত হই তার থেকে অনেক বিপজ্জনক। ফ্লু এর ক্ষেত্রে R0 হল ১ এর কাছাকছি, অর্থাৎ একজন সংক্রামিত ব্যক্তি গড়ে একজনকে সংক্রামিত করে। COVID-19 ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ২.৫, তাই অনেক তাড়াতাড়ি সংক্রমণ বাড়ছে।

এই এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধির কার্ভটাকে একটু চ্যাপ্টা করা (‘flatten the curve’), অর্থাৎ বৃদ্ধির হারটা কমিয়ে দেওয়াই এখন সব দেশের উদ্দেশ্য। না হলে এত আক্রান্ত লোকের চিকিৎসা করার মত সামর্থ্য প্রায় কোন দেশেরই নেই। COVID-19-এর কোন প্রতিষেধক টীকা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাহলে, উপায়? এখানেই স্যোশাল আইসোলেশান, অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়ার  অপরিসীম গুরুত্ব।

ছবি ৩ – বিশ্বের কয়েকটি দেশের করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যার এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধি (১৮ মার্চ পর্যন্ত)। চীনের ক্ষেত্রে exponential curve এর flattening  লক্ষণীয়। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে চীনের জনগণের চলাফেরার উপর কঠোর নিষেধ জারী হয়েছিল। ছবির সূত্র – The Globe and Mail (Canada),  Johns Hopkins University

একজন ভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তির থেকে কতজন সংক্রামিত হবে তা নির্ভর করবে সেই ব্যক্তি (আমাদের উদাহরণে সমীরণ) ইনকিউবেশান পিরিয়ডের মধ্যে কতজনের সাথে মেলামেশা করেছে। সমীরণ ও তার থেকে ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিরা যদি যতটা সম্ভব নিজেদের অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতো, তাহলে ভাইরাসের সংক্রমণের হার কম হতো – অর্থাৎ R0 সংখ্যাটা কমে যেত। ধরা যাক, সরকারের নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির ফলে বেশীরভাগ রেস্টুরান্ট, অফিস-কাছারী বন্ধ, তাই এখন আর গড়ে ২.৫ নয়, বরং তার অর্ধেক লোক, গড়ে ১.২৫ জন একজনের থেকে সংক্রামিত হচ্ছে। অর্থাৎ, এক মাসে মোট সংক্রমণের সংখ্যা হবে

১.২৫ = ১.২৫x১.২৫x১.২৫x১.২৫x১.২৫x১.২৫ =  ৩.৮১৫

জনের মত! আগে এই সংখ্যাটাই ছিল ২৪৪, সেখান থেকে নেমে মাত্র চারজনে এসে ঠেকেছে।

এই ধরণের ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে তাই আমাদের সামাজিক কর্তব্য হলো নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়া, যাতে ভাইরাস একজনের থেকে অনায়াসে অন্যজনের কাছে না পৌঁছতে পারে। এই দূরত্ব ততদিন বজায় রাখতে হবে, যতদিন না অবধি পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে, টীকার বা চিকিৎসার সাহায্যে, বা অন্যান্য কোন প্রাকৃতিক কারণে ভাইরাসের কার্যক্ষমতা কমে গেলে।

আপাতত করোনা ভাইরাসের মহামারীকে ঠেকানোর একমাত্র উপায় হ’ল, এর ছড়িয়ে পড়ার গতি কমিয়ে দেওয়া ও শেষ পর্যন্ত থামিয়ে দেওয়া।

শরীর খারাপ হলেই কি  করোনা ভাইরাসের-এর জন্য পরীক্ষা করা জরুরি ?     

আগেই বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গ মূলতঃ জ্বর, শুকনো কাশি, ক্লান্তি। এছাড়া সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যাথা, ডায়েরিয়া-ও হতে পারে। সাধারণ ফ্লু বা সর্দিজ্বরের সঙ্গে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। তাই এই উপসর্গগুলো থাকলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিশ্চিত হওয়া উচিৎ যে রোগীর করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা  করা প্রয়োজন কিনা। তবে পরীক্ষাগারের সংখ্যা যেহেতু সীমিত, এইসকল উপসর্গযুক্ত যেকোনো রোগীর-ই অযথা পরীক্ষার সংখ্যা কমানো উচিৎ। আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যদিও এই রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই (এই প্রতিবেদনটা  লেখার দিন পর্যন্ত), তার মানে এই নয় যে পরীক্ষা করা অর্থহীন। পরীক্ষায় রোগ আছে  প্রমাণিত হ’লে রোগীকে আলাদা করে রাখা যায় যাতে তার থেকে ভাইরাস অন্য সুস্থ মানুষের দেহে সংক্রামিত না হয়। এছাড়াও পরীক্ষা হলে তবে কোন দেশে  কত আক্রান্তের সংখ্যা তার একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া সম্ভব। আর তবেই ভাইরাসের প্রকৃতি ও ছড়িয়ে পড়ার গতি নির্ণয় করা যায়। বর্তমানে ভারতে ৫২টি ল্যাবরেটারীতে এই পরীক্ষা করা হচ্ছে [৭]।

করোনা ভাইরাস-এর পরীক্ষা কিভাবে করা হয় ? 

বস্তুত যেকোনো জায়গাতেই এই পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব। সাধারণতঃ রোগীর গলার ভিতরে একটি তুলোর ডেলা (cotton swab) প্রবেশ করিয়ে, সেটার সাহায্যে লালা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া র‍্যাপিড টেস্টে আন্টিবডির উপস্থিতি লক্ষ্য করার জন্য রক্ত পরীক্ষাও করা যেতে পারে। তবে সম্ভবতঃ শুধুমাত্র চীনেই সেই পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়াটা সহজ হলেও ল্যাবরেটারীতে তা পরীক্ষা করার পদ্ধতিটা বেশ জটিল। নমুনাটা দিয়ে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ পলিমারেজ চেন রিয়েকশান (Reverse Transcriptase Polymerase Chain Reaction) করা হয়। যেকোনো পলিমারেজ চেন রিয়েকশান (PCR)  কোষের ডিএনএ-তে (DNA) ঘটে।  কিন্তু, যেহেতু করোনা ভাইরাস একটা আরএনএ (RNA) ভাইরাস, তাই পরীক্ষাটার প্রথম ধাপে রোগীর দেহ থেকে প্রাপ্ত নমুনায় ভাইরাস থাকলে তার আরএনএ প্রথমে DNA-তে রূপান্তরিত হয়। তারপর PCR পদ্ধতিতে DNA-র  অগুন্তিবার রেপ্লিকেশান ঘটে যে প্রতিলিপি তৈরি হয়, তা থেকে নমুনাতে ভাইরাসের উপস্থিতি সহজেই বোঝা যায়। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে  করোনা  পসিটিভ বলা হয়। আর ভাইরাস না থাকলে কোন প্রতিলিপিই তৈরি হয় না। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে  করোনা  নেগেটিভ বলা হয়। ২৪ ঘন্টা লাগে টেস্টের রেসাল্ট আসতে। তবে প্রচুর নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে, সব ধাপগুলো একবারে করার সুযোগ না থাকায় অনেকসময়  ৪৮-৭২ ঘন্টাও লাগতে পারে [৮]।  

কোভিড-১৯(COVID-19) ঠেকাতে বা করোনা ভাইরাসকে রুখতে কি কি সাবধানতা  নেওয়া   উচিৎ? 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation) নভেল করোনা ভাইরাসের প্রকোপে উদ্ভব  হওয়া পরিস্থিতিকে প্যান্ডেমিক বা অতিমারী হিসেবে ঘোষণা করেছে। ভারতেও  ধীরে ধীরে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এই প্রতিবেদনটা লেখার দিন পর্যন্ত ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৮০। কর্ণাটক, দিল্লি, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করার কথা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু শুধুমাত্র প্রশাসন নয়, প্রত্যেক মানুষকে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবেই এই ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতি রোধ করা সম্ভব।

  • হাত সর্বদা পরিচ্ছন্ন  রাখার চেষ্টা করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পরপর  সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুতে হবে। হাতের তালু, আঙ্গুল ও কব্জি পর্যন্ত  ভাল করে সাবান দিয়ে ঘষে ধুতে হবে (অন্তত কুড়ি সেকেন্ড ধরে)।  হাতে ময়লা দেখা না গেলেও বারবার হাত ধুতে হবে। বিশেষ করে হাত ধুতে হবে অসুস্থ ব্যক্তির পরিচর্যার পর, হাঁচি বা কাশির পর, খাবার রান্না করার আগে,  খাবার পরিবেশন করার আগে, বাথরুম ব্যবহারের পর এবং পশুপাখির পরিচর্যার পর।
  • হাত পরিষ্কার করার জন্য যে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে, তাতে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৭০% থেকে ৯৫% হওয়া প্রয়োজন।
  • হাঁচি-কাশি হলে, নাক দিয়ে সর্দি জল পড়লে মুখে মাস্ক পরতে হবে।
  • সারাদিন যথাসম্ভব নাকে মুখে হাত দেওয়া এড়িয়ে চলতে হবে। হাত দিয়েই আমরা প্রধানত সব কাজ করি বলে সারাদিন অনেক কিছু স্পর্শ করি যার থেকে ভাইরাস হাতে লেগে যেতে পারে। তাই অপরিষ্কার হাত দিয়ে কখনো নাক–মুখ–চোখ স্পর্শ করা উচিৎনয়।
  • সর্দি-কাশি বা জ্বর হয়েছে এমন লোকজনের থেকে অন্তত এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারণ আর সব ফ্লুর মতোই এই রোগও সর্দি-কাশির ড্রপলেট বা কণার মাধ্যমে অন্যকে সংক্রমিত করে। এছাড়া ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ-ও  এড়িয়ে চলতে হবে। অসুস্থ পশুপাখির থেকে দূরে থাকতে হবে।
  • রুমাল বা টিস্যু পেপার হাতে না থাকলে,  মুখে হাত চাপা দিয়ে হাঁচা বা  কাশা উচিৎ নয় কারণ সেই হাতে অন্য কিছু স্পর্শ করার সম্ভাবনা থাকে। পরিবর্তে কনুই-এর কাছে বা কাঁধের কাছে মুখ গুঁজে হাঁচলে বা কাশলে সেই সম্ভাবনা কম।
  • হাঁচি বা কাশির সময়, টিস্যু পেপার ব্যবহার করার পর ওই টিস্যু পেপার যেখানে সেখানে না ফেলে, কোনও নির্দিষ্ট ঢাকনা দেওয়া ডাস্টবিনে ফেলতে হবে।
  • খাবার রান্নার  সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে তা সুসিদ্ধ হয়।
  • ভিড় থেকে দূরে থাকতে হবে।  যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে লোকজমায়েত বন্ধ রাখতে হবেসম্ভব হলে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করতে হবে।একেই সামাজিক দূরত্ব  বজায় রাখা বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বলে।
  • নিজেকে অসুস্থ মনে হলে ঘরে থাকতে হবে। বাইরে যাওয়া অত্যাবশ্যক হলে নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। তবে বেশী অসুস্থ বোধ করলে, জ্বর হলে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তিনি বিষয়টি  খতিয়ে দেখে প্রয়োজন বুঝলে পরীক্ষা করাতে বলবেন। অর্থাৎ নিজের উপসর্গ সম্পর্কে নিজে সচেতন হয়ে, প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেকে ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত রাখতেহবে ও বাড়িতেও অন্য সদস্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে (সেল্ফ আইসোলেশান) বা ডাক্তারের কাছে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে (সেল্ফ রিপোর্টিং)
  • জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে হবে।  অত্যাবশ্যকীয় ভ্রমণের ক্ষেত্রে জরুরি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
  • কেউ কোন কারণে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এসেছে জানতে পারলে, তার কোন উপসর্গ না থাকলেও তাকে ১৪ দিনের জন্য অন্যদের থেকে আলাদা থাকতে হবে। একেই বলে সেল্ফ কোয়ারান্টিন।
  • কারোকে অভ্যর্থনা করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।কারও সঙ্গে হাত মেলানো (হ্যান্ড শেক) বা কোলাকুলি না করে নমস্কার করে অভিবাদন জানাতে হবে।

সার্স কভ-২  কোনো পৃষ্ঠতলে (surface) বা কোনো জিনিসের উপর কতক্ষণ বাঁচতে পারে?

কোভিড-১৯ (COVID-19) একটা সংক্রামক রোগ। এটি মানুষ থেকে মানুষে ড্রপলেট ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে ছড়ায়। অর্থাৎ, কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সময় যে অতি সূক্ষ্ জলের ফোঁটা বা এরোসল তৈরী হয় তার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। সেইজন্য এই  নভেল করোনা ভাইরাস কোনো জিনিসের পৃষ্ঠতলে ঠিক কতক্ষণ বাঁচতে পারে সেইটা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ-এর একদল বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, এই ভাইরাসটা এরোসলে অর্থাৎ বাতাসে সূক্ষ্ম ড্রপলেট অবস্থায় প্রায় ৩ ঘন্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কার্ডবোর্ড-এর উপর ভাইরাসটা প্রায় ২৪ ঘন্টা এবং প্লাষ্টিক বা স্টেইনলেস স্টিল এর উপর প্রায় তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সক্ষম [৯]।

কেন সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া জরুরি?

আগেই বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের গঠন লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে প্রধানত তিনটে উপাদানে গঠিত এই  নভেল করোনাভাইরাস। সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়। দ্বিতীয় উপাদানটা হ’ল রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)। যখন কোনও জীবন্ত কোষের ভিতরে  ভাইরাসটি ঢোকে, তখন সে বংশ বিস্তার করে আরএনএ-র  প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যম। আর তৃতীয় উপাদানটা হ’ল একটা লিপিড স্তর, এটা  ভাইরাসের অন্যান্য অংশ-কে ধরে রাখে। এই লিপিড স্তরটাকে  ভাঙ্গতে পারলে ভাইরাসটাকে মারা সম্ভব।

ছবি ৫ – সাবানের অণুর একটা মাথা, একটা লেজ (ছবির সূত্র)

সাবানের আণবিক গঠন দেখলে বোঝা যায় যে, এদের একটা মাথা এবং একটা লেজ আছে।

সাধারণত মাথাটা হাইড্রোফিলিক (hydrophilic), অর্থাৎ মাথাটার জলের অণুগুলোর প্রতি আকর্ষণ প্রবল। লেজটা আবার হাইড্রোফোবিক (hydrophobic), অর্থাৎ লেজটা জলকে একেবারেই পছন্দ করে না। এবার সাবান আর জল দিয়ে হাত ধুলে ভাইরাসের  লিপিড স্তরের প্রতি জলে গোলা সাবানের অণুর লেজের আকর্ষণ প্রবল হয়। অন্য দিকে  জলের অণু আবার সাবানের অণুর মাথাকে আকর্ষণ করে। এই টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে ভাইরাসের লিপিড স্তরটা ভেঙে যায়, ফলে ভাইরাসটা  নিষ্ক্রিয় হয়ে মারা যায়।

কেন হ্যান্ড সানিটাইজারের থেকে সাবান বেশি কার্যকরী?

স্যানিটাইজারের মূল উপাদান হল অ্যালকোহল। অ্যালকোহল-ও করোনভাইরাস-এর লিপিড স্তরটা ভেঙে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু সাবানের মতো ভাইরাসের লিপিড স্তরের সঙ্গে অ্যালকোহলের দ্রুত বন্ধন গঠন হয় না, যার ফলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হতে সময় লাগে।  তাই  হ্যান্ড স্যানিটাইজারের থেকে সাবান ভাইরাস নষ্ট করতে বেশি কার্যকরী। সাবান ও জল  ব্যবহারের সুযোগ না থাকলে তখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিকল্প হতে পারে।

ছবি ৭ – অযথা স্যানিটাইজার ধাওয়া করা উচিত না (ছবির সূত্রঃ ডিপার্টমেন্ট অফ সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি,গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া-র  ফেসবুক পেজ।

করোনা ভাইরাস কতরকমভাবে  ছড়িয়ে পড়তে পারে? 

কোন দেশে এই ভাইরাসটার সংক্রমণ ঘটার সময় প্রধানত চারটে পর্যায়ে ভাইরাসটা ছড়ায়।

পর্যায় .বিদেশ থেকে আগত রোগীর মাধ্যমে (Imported Cases)যে সমস্ত দেশে আগেই সংক্রমণ ঘটেছে সেই অঞ্চল থেকে কেউ সংক্রমণের শিকার হয়ে নিজের দেশে ফিরলে, তাকে প্রথম পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়। 

পর্যায় . আঞ্চলিক সংক্রমণ (Local Transmission) বিদেশ থেকে আগত রোগীর সান্নিধ্যে এসে কেউ নিজে সংক্রামিত হলে তাকে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, একজন আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে অন্য সুস্থ মানুষের সংক্রমণের সম্ভাবনা যথাসম্ভব কমিয়ে আনা, যাতে সংক্রমণের শৃঙ্খলটাকে (transmission chain) কেটে দেওয়া যায়। ভারতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এখন এই পর্যায়ে আছে এবং সকলে সামাজিক দূরত্ব (social distance) বজায় রাখলে তবেই সংক্রমণ  এই পর্যায়ে রোখা যাবে

 পর্যায় –  পারস্পরিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সংক্রমণ (Community Transmission)বিদেশ থেকে আগত রোগীর বা যেকোন করোনা আক্রান্ত রোগীর সান্নিধ্যে না এসেও কেউ যখন  সংক্রামিত হয় তখন তাকে তৃতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ  বলা হয়। এই পর্যায়ের সংক্রমণ অনেক দ্রুত, অনেক বড় এলাকা জুড়ে হয়।

পর্যায় মহামারী (Epidemic) –  এটা শেষ এবং সবথেকে খারাপ পর্যায় যখন সংক্রমণ অত্যন্ত দ্রুত মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই পর্যায়ের সংক্রমণ একবার হয়ে গেলে কবে, কিভাবে আটকানো যাবে, তা বলা অসম্ভব।

শিশুদেরও কি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে? 

শিশু তথা কিশোরদের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। CDC (Center for Disease Control and Prevention), China থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে  ০-৯ বছরের শিশু এবং ১০-১৯  বছর বয়েসীদের আক্রান্তের সংখ্যা  যথাক্রমে  ০.৯% এবং ১.২% মাত্র [১০]। আরেকটা সমীক্ষা অনুসারে, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে ০-১৪ বছরের বাচ্চাদের সংখ্যা ০.৯% যেখানে বড়দের (১৫-৪৯বছর)  সংখ্যা ৫৭.৮% [১১]। কিন্তু কেবলমাত্র কোভিড-১৯ আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে প্রকাশিত আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রের ফলাফল অনুসারে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ছোট (<৫ বছর), বিশেষত নবজাতকদের মধ্যে শারীরিক আবস্থার সংকটজনক অবনতি হবার প্রবণতা কিছুটা বেশী [১২]।  তাই শিশুদের ক্ষেত্রেও সমস্তরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত জরুরি।

তাপমাত্রা বাড়লে ভাইরাসের প্রকোপ কমবে বলে শোনা যাচ্ছে – এটা কতটা ভরসাযোগ্য?

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির  ডঃ মেরু শীল জানাচ্ছেন, এরকম কোনো পরিষ্কার সম্ভাবনা এখনো দেখা যায়নি যাতে করে এটা বলা যায় যে পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা বাড়লে করোনা ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত কমে। বিজ্ঞানীদের হাতে এখনও এব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বা WHO-এর মতেও এই ভাইরাস উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু যুক্ত অঞ্চলেও ছড়াতে পারে [১৩]।

ছবি ৮ –  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিজ্ঞপ্তি – করোনা ভাইরাস উষ্ণ জলবায়ু কিংবা উচ্চ আর্দ্রতার মধ্যেও ছড়াতে পারে (ছবির সূত্র)

প্রচ্ছদের ছবি: এই স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপি থেকে পাওয়া ছবিটাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা রোগীর থেকে পাওয়া কোষের ওপর ভাইরাসটাকে দেখা যাচ্ছে। কোষগুলো নীল গোলাপিতে আর ভাইরাস হলুদে। (ছবির সূত্র, কৃতজ্ঞতা স্বীকার: NIAID-RML)

লেখাটির জন্য তথ্য ও আলোচনার মাধ্যমে সহযোগিতা করেছেন সোমনাথ বক্সী (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়), সৌমেন মান্না (সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স), সায়ন্তন ব্যানার্জী (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা), আবীর দাস (আই.আই.টি. খড়গপুর) এবং কুণাল চক্রবর্ত্তী (এন.সি.বি.এস.)। ‘বিজ্ঞান’ সম্পাদকমন্ডলীর অন্য সদস্যদের সাহায্য নিয়ে লেখাটি সম্পাদনা করেছে স্বাগতা ঘোষ, বনানী মন্ডল, অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়  ও রাজীবুল ইসলাম।

তথ্যসূত্র:

[১] https://www.cdc.gov/coronavirus/types.html

[২] https://www.who.int/docs/default-source/coronaviruse/situation-reports/20200318-sitrep-58-covid-19.pdf?sfvrsn=20876712_2 , https://infographics.channelnewsasia.com/covid-19/map.html

[৩]  https://covidindia.org/ , https://www.mohfw.gov.in/  

[৪] https://www.who.int/emergencies/diseases/novel-coronavirus-2019/technical-guidance/naming-the-coronavirus-disease-(covid-2019)-and-the-virus-that-causes-it

[৫] https://www.abc.net.au/news/science/2020-03-17/how-viruses-work-explainer/12059904

[৬] https://www.who.int/news-room/q-a-detail/q-a-coronaviruses

[৭] https://icmr.nic.in/sites/default/files/upload_documents/Testing_sites_for_COVID19.pdf

[৮] Detection of 2019 novel coronavirus (2019-nCoV) by real-time RT-PCR.  10.2807/1560-7917.ES.2020.25.3.2000045

[৯] Aerosol and Surface Stability of SARS-CoV-2 as Compared with SARS-CoV-1, 0.1056/NEJMc2004973

[১০] https://wwwnc.cdc.gov/eid/article/26/6/20-0251_article

[১১] https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/NEJMoa2002032

[১২] https://pediatrics.aappublications.org/content/pediatrics/early/2020/03/16/peds.2020-0702.full.pdf

[১৩] https://www.theguardian.com/world/2020/mar/17/what-effect-will-winter-have-on-coronavirus-in-australia

The post তথ্যের আলোকে নভেল করোনা ভাইরাস ও COVID-১৯ appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

এ আই এর প্রকৃতি ও প্রয়োগ: ডীপ লার্নিং

$
0
0

ডীপ লার্নিং পদ্ধতি কিভাবে অপেক্ষাকৃত স্বল্প উদাহরণ থেকেই যন্ত্রকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে?


লেখাটির প্রথম পর্বে আমরা দেখেছিলাম মানুষের জন্য আপাত সহজ কিছু কাজ করতে একটা যন্ত্রকে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়। একটা ছবি চেনা কিংবা লিখিত শব্দের মর্মোদ্ধার করা, যেগুলো মানুষ অবলীলায় করতে পারে, সেগুলোই একটা যন্ত্রকে ধরে ধরে শেখানো প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পরে। দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখলাম নিউরাল নেটওয়ার্ক-এর মাধ্যমে কিভাবে একটা যন্ত্র নিজে নিজেই শিখতে পারে। তবে তাকে শেখাতে অনেক উদাহরণ লাগে। এই পর্বে আমরা দেখবো ডীপ লার্নিং-এর মতো প্রযুক্তি কিভাবে এই প্রতিবন্ধকতা পার হলো।

ডীপ লার্নিং

কথা বলে নিজের বক্তব্য পেশ করা, অন্যের কথা শুনে বোঝা, আশপাশের অজস্র জিনিসকে চিনে নেওয়া, এগুলো আমরা ঠিক কিভাবে করি তা কয়েকটি স্পষ্ট নিয়ম দিয়ে বাঁধা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল সনাতন যুক্তিভিত্তিক এ আই তে। আশা ছিল এ এন এন এই জটিল সমস্যার সমাধান শিখে নেবে প্রচুর উদাহরণ থেকে। তার জন্য প্রয়োজন বহুস্তরীয় এ এন এন। কিন্তু শুধু ব্যাক প্রপাগেশন অ্যালগরিদম দিয়ে এমন বহুস্তরীয় নেটের সন্তোষজনক শিক্ষা হচ্ছিল না।

এসময় বেশ কিছু বছরের প্রচেষ্টার পর বহুস্তরীয় এ এন এন-কে কিভাবে শেখানো যেতে পারে তা বোঝা গেলো। শুরু হোলো ডীপ লার্নিং (deep learning) বা গভীর শিক্ষার অভিযান। নতুন পদ্ধতিতে ইনপুট আর আউটপুট-এর মাঝে প্রতিটি গুপ্ত স্তরকে আলাদা করে শেখানোর ব্যাবস্থা হল। আশা এই যে একেকটি গুপ্ত স্তর শিক্ষালাভের পর তার নিচের স্তরের তথ্যের বৈশিষ্ট্য বুঝে উপরের স্তরে সেই বার্তা পৌঁছে দিতে পারবে। এই শিক্ষা পদ্ধতি চলে সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধান ছাড়াই। যেহেতু গোড়ার ইনপুট তথ্য কি তা বলে দেওয়ার কোনও তাড়না নেই, তাই যথেচ্ছ পরিমাণে তথ্য দিয়ে অনেক সময় ধরে এই শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। তারপর এই বৈশিষ্ট নিষ্কর্ষক স্তরগুলি একের পর এক সঠিক ক্রমে সাজিয়ে ও আউটপুট স্তর যোগ করে গোটা নিউরাল নেটটি বানানো হয়। এবার এই সম্পূর্ণ নেটটি উদাহরণের সাহায্যে নিজেদের সংযোগ ভারগুলি আরেকটু বেঁধে নেয় পূর্বোক্ত ব্যাকপ্রপাগেশন অ্যালগরিদম দিয়েই।

এই নতুন পদ্ধতির সাফল্য বেশ চমকপ্রদ। প্রথমে হাতে লেখা সংখ্যা চেনা, তারপর উচ্চারিত শব্দের থেকে কথা বুঝে নেওয়ার ব্যাপারে অনেক কম উদাহরণ থেকেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাওয়া গেল। এমন এর আগে কখনও সম্ভব হয়নি। ২০১২-র মধ্যে উচ্চারিত শব্দের থেকে কথা বোঝার এই প্রযুক্তি এতই নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠলো যে মোবাইল ফোনে প্রায় প্রতিটি অ্যাপ এর ব্যবহার শুরু করলো টাইপিং-এর বিকল্প হিসাবে।

ডীপ লার্নিং পদ্ধতিতে একেকটি গুপ্ত স্তরকে আলাদা করে শিখিয়ে তারপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্তরগুলোকে জুড়ে নেটওয়র্ক তৈরী হয়।

পৃথকভাবে শেখানো স্তর সমৃদ্ধ নিউরাল নেট বিশেষ কার্যকরী হয় যখন উদাহরণের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকে। পরে একটি নতুন ধরনের অতি সরল নিউরনের প্রচলন হয়, যেটি ডায়োডের মতন শুধু ধনাত্বক ইনপুটকে সরাসরি আউটপুট করে, বাকি আটকে দেয়। এই সরল নিউরনের বহুস্তরীয় নেটও বেশ তাড়াতাড়ি উদাহরণ থেকে শিখে ফেলে, আলাদা করে স্তরগুলিকে শিখিয়ে নিতে হয় না।

সি এন এন

কনভলিউশনাল নিউরাল নেটওয়র্কের নির্মাণকৌশল – পর্যায়ক্রমে কনভলিউশন (convolution) ও পুলিং (pooling) স্তর এবং শেষে সম্পূর্ণভাবে সংযুক্ত গুপ্ত ও আউটপুট স্তর (ছবির সূত্র)।

নব্বইয়ের দশক থেকে আরেক ধরণের নিউরাল নেট নিয়ে গবেষণা হচ্ছিল, তার নাম হল কনভলিউশনাল নিউরাল নেটওয়র্ক (convolutional neural network), বা সংক্ষেপে সি এন এন। এর প্রয়োগক্ষেত্র হল উচ্চারিত কথা, ছবি, ভিডিও, বা সাধারণভাবে কোনও সেন্সর থেকে আসা তথ্যের ধারার বিশ্লেষণ। এই ধরণের তথ্যের বিশেষত্ব হল এই যে এদের কাছাকাছি দুটি তথ্য স্থান বা সময়ে নিকটবর্তী এবং সেইজন্য তারা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। যেমন, একটি উচ্চারিত কথার পাশাপাশি শব্দখন্ড মিলিয়ে একটি অর্থপূর্ণ শব্দের সৃষ্টি হয়, বা একটি ছবির নিকটবর্তী কয়েকটি চিত্রবিন্দু মিলিয়ে একটি জিনিসকে চেনা যায়। সনাতন স্তরপূর্ণ নিউরাল নেটে একটি স্তরের প্রতিটি নিউরন তার উপরের স্তরের প্রতিটি নিউরনের সাথে উপযুক্ত ভার দিয়ে সংযুক্ত। সি এন এন-এ কিন্তু এমন নয়। এর একটি স্তরের নিকটবর্তী কিছু নিউরন  তার পরের স্তরের একটি নিউরনের সাথে সংযুক্ত। এই ধরণটির পুনরাবৃত্তি হয় এই দুই স্তরের সমস্ত সংযোগের মধ্যে।

শুধু তাই নয়, এই সংযোগের ভার-সমষ্টি দুটি স্তরের মধ্যে সমস্ত সংযোগের জন্য একই রাখা হয়। এইরকম ব্যাবস্থার কারণ হল কোনও প্যাটার্ন – সে একটি বিশেষ শব্দ হোক বা ছবি হোক – সময় বা স্থানে একটু এদিক ওদিক হলে কিছু যায় আসে না।  এটি যেমন কোনও প্যাটার্ন চেনার জন্য বিশেষ কার্যকরী, তেমনই এতে খুব অল্প সংখ্যক সংযোগ ভারের মান স্থির করতে হয়। তাই এর শিক্ষা পূর্ণভাবে সংযুক্ত দুটি স্তরের থেকে অনেক সহজে সম্পন্ন হয়। একে বলে কনভলিউশন (convolution) স্তর।

একটা কনভলিউশনাল নিউরাল নেটওয়ার্ক-এ কনভলিউশন স্তরের পরে থাকে পুলিং (pooling) স্তর। কনভলিউশন স্তরের নিকটবর্তী বেশ কটি নিউরনের মধ্যে যার সক্রিয়তা সব চেয়ে বেশি, তার আউটপুট সরাসরি চলে আসে পুলিং স্তরের একটি নিউরনে। স্বাভাবিক ভাবেই পুলিং স্তরে নিউরনের সংখ্যা অনেক কম। এই কম সংখ্যক নিউরনের মধ্যে একটি বিস্তারিত ছবির বা তথ্যপ্রবাহের বৈশিষ্ট্য বা নির্যাস ধরা পরে।

পর পর এইরকম বেশ কিছু কনভলিউশন ও পুলিং স্তর দিয়ে ছবি বা তথ্য প্রবাহের একটি সংক্ষিপ্ত বিমূর্ত বিবরণ পাওয়া যায়। একদম শেষে কয়েকটি পূর্ণভাবে সংযুক্ত স্তর যোগ করে এই সম্পূর্ণ নেটওয়ার্কটিকে  ব্যাক প্রপাগেশন অ্যালগরিদম দিয়ে অনেক উদাহরণের সাহায্যে শিক্ষা দেওয়া হয়। এইভাবে সি এন এন-এর বিশেষ গঠন ও বহুস্তরীয় নেটের জটিল সম্পর্ক শেখার ক্ষমতার সমন্বয়ে যে নেটটি তৈরি হল, তার কার্যকারিতার পরিচয় পাওয়া গেল ২০১২ র ইমেজনেট প্রতিযোগিতায়। এই প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যালগরিদমগুলির চেয়ে সি এন এন যে স্পষ্টভাবে শ্রেয় তা প্রমাণিত হয় [১]। এরপর থেকে ছবি চেনা ও বোঝার ক্ষেত্রে সি এন এন হয়ে উঠলো অপরিহার্য। এছাড়াও উচ্চারিত বা লিখিত কথা বোঝার ব্যাপারেও এর সাফল্য অসামান্য।

আর এন এন

ডীপ লার্নিং-এর অভিযান শুরু হওয়ার অনেক আগেই আরেক ধরনের নিউরাল নেটওয়ার্ক নিয়েও কাজ হচ্ছিল। তার নাম হলো রিকারেন্ট নিউরাল নেটওয়ার্ক (recurrent neural network), বা সংক্ষেপে আর এন এন। যে সব তথ্যের মধ্যে সময় অনুযায়ী একটি ক্রমবিন্যাস আছে – যেমন উচ্চারিত শব্দখন্ডের বা লিখিত শব্দের শ্রেণী – বিশেষভাবে তাদের বিশ্লেষণের জন্যই এই নেটওয়ার্ক-এর সৃষ্টি।

আর এন এন-এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা খানিকটা এইরকম। ধরা যাক, সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল একটি তথ্য শ্রেণীর কথা বলা হচ্ছে। সেই তথ্য শ্রেণীর মধ্যে একেকটি সময়ের ধাপে (time step) যে তথ্য রয়েছে সেটি এই নেটওয়ার্ক-এ ইনপুট হয় এবং তার ফলস্বরূপ একটি আউটপুট ঘোষিত হয়। এছাড়াও শেষ গুপ্ত স্তরের আউটপুটের একটি অংশ পরবর্তী সময়ের ধাপের নেটের প্রথম গুপ্ত স্তরে ইনপুট হয় (নিচের ছবিটি দেখো)। এইরকম আয়োজনের উদ্দেশ্য হল শ্রেণীর কোনও তথ্যকে বিচ্ছিন্ন ভাবে না দেখে তার পূর্ববর্তী তথ্যশ্রেণীর প্রেক্ষাপটে বিচার করা। উচ্চারিত কথা বা লিখিত বাক্যের মানে বোঝার জন্য এর খুবই প্রয়োজন।

রিকারেন্ট নিউরাল নেটওয়ার্কের নির্মাণকৌশল – শেষ গুপ্ত স্তর থেকে আউটপুটের একটি অংশ প্রথম গুপ্ত স্তরে ইনপুট করা হয় পরবর্তী ইনপুটের সঙ্গে (ছবির সূত্র)

এর আরেকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল এই যে তথ্য শ্রেণীর একটি অর্থপূর্ণ অংশ – যেমন একটি বাক্য – ইনপুট হওয়ার পরে, শেষ গুপ্ত স্তরে এই অংশের একটি সম্মিলিত ছাপ ধরা থাকে। সেই ছাপ ব্যবহার করে একটি অন্য ভাষায় – যার বাক্যগঠনের রীতি অন্যরকম – একই কথা বলা যায়, অর্থাৎ অনুবাদ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন আরেকটি আর এন এন যার প্রথম ইনপুট হবে পূর্বোক্ত গুপ্ত স্তরের ছাপ, তারপর প্রত্যেকটি সময়ের ধাপে দ্বিতীয় ভাষায় একটি করে শব্দ আউটপুট করবে যতক্ষণ না বাক্য সম্পূর্ণ হয়। এই দুটি আর এন এন-কেই অবশ্য পৃথকভাবে অনেক উদাহরণ দিয়ে শেখাতে হবে, অনেক অনেক পূর্বে অনূদিত নথিপত্রর সাহায্য নিতে হবে।

একটি আর এন এন-কে পরের শব্দটি কি হতে পারে সে বিষয়েও শেখানো যেতে পারে অনেক অনেক নথিপত্র পড়িয়ে। কম্পিউটারে বা মোবাইলে আমরা যখন টাইপ করি, তখন সম্ভাব্য শব্দগুলি আমাদের সামনে এসে যায় এমনই একটি আর এন এন-এর সাহায্যে। এক্ষেত্রে আর এন এন আমাদের নিজস্ব লেখার ধরণ থেকে ক্রমাগত নিজেকে মানিয়ে নেয়, যাতে আরো নিখুঁতভাবে পরের শব্দটি ধরতে পারে।

এতো হল শুধুই বাক্য গঠন। একটি সি এন এন দিয়ে ছবির বিশ্লেষণ করে তার গুপ্ত স্তরের তথ্যকে একটি আর এন এন এ ইনপুট করে ছবিটির একটি ভাষায় বর্ণনা পাওয়া যেতে পারে। এর জন্য অবশ্য আর এন এন-কে উদাহরণের সাহায্যে শেখাতে হবে কি করে সি এন এন-এর গুপ্ত স্তরের তথ্য থেকে ছবিটিকে  ভাষায় বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সব মিলিয়ে এর ফলটি বেশ চমকপ্রদ।

ডিপ লার্নিং এর প্রভাব

নিউরাল নেটওয়ার্ক সম্বন্ধে এত বিস্তারিত আলোচনার কারণ হলো এই যে সম্প্রতি এ আই-এর যত সাফল্য এসেছে তার প্রধান স্তম্ভ ডীপ লার্নিং প্রযুক্তি। নেটওয়ার্ক গভীর ও প্রয়োজনমত বিস্তারিত হলে যে ইনপুট এবং আউটপুটের মধ্যে প্রায় যে কোনও বাস্তব সম্পর্ক শিখে ফেলা যায়, এটিই হল এই প্রযুক্তির প্রধান বক্তব্য। তীব্র গতিসম্পন্ন গ্রাফিক্স প্রসেসর ইউনিটের ব্যবহার এই শেখার পর্বটি সময়ের দিক থেকে সহনীয় করে তোলে। বলা যায়, ডীপ লার্নিং-ই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এ আই-এর ছোঁয়া এনেছে – বিশেষ করে মোবাইলের বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে।

তবে সব সময় যে শুধু ডীপ লার্নিং দিয়েই সমস্যার সমাধান হয় তা নয়, চিরাচরিত এ আই-এর যুক্তি, তর্ক ও অনুসন্ধানের উপরও প্রায়ই ভরসা করতে হয়। এখন কনভারসেশনাল এ আই, অর্থাৎ কম্পিউটারের সাথে কথোপকথনের প্রযুক্তি নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। নিউরাল নেটওয়ার্ক অনেকটা যান্ত্রিক ভাবে উচ্চারিত বা লিখিত ভাষাকে ব্যবহার করে। তাতে আমরা উচ্চারিত কথার থেকে লিখিত শব্দমালা, বা লিখিত শব্দমালা থেকে উচ্চারিত কথা পেতে পারি, এমনকি এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদও পেতে পারি। কিন্তু ঐ শব্দমালার মধ্যে অন্তর্নিহিত ভাব কম্পিউটার সহজে ধরতে পারেনা। তার জন্য বাক্যের গঠন, শব্দের অর্থ, ইত্যাদি নিয়ে যুক্তি ও অনুসন্ধানের প্রয়োজন হয়। তাই কম্পিউটারের পক্ষে মানুষের সাথে টানা কথোপকথন করা বেশ কঠিন। গুগল হোম বা অ্যামাজনের ইকো অথবা বিভিন্ন ওয়েবসাইটের চ্যাটবট প্রায়ই কথার প্রসঙ্গ ধরতে না পারলে হতভম্ব হয়ে যায়।   

রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং

মানুষের বুদ্ধির প্রকাশ শুধু চোখে দেখা আর কথা শোনার মধ্যেই নয়, হাত ও পায়ের চালনা করে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ করা, যেমন হাঁটা, দৌড়ানো, খেলাধুলা ইত্যাদির মধ্যেও হয়। এসবের আড়ালে প্রছন্ন আছে এক ধরণের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, যা কিছুটা সহজাত আর কিছুটা শেখা। এও একধরণের বুদ্ধি, যেটি যুক্তিগ্রাহ্য নয়, অনেকটা অবচেতন স্তর থেকে কাজ করে।

এইরকম ক্ষমতা যন্ত্রকে প্রদান করা কিন্তু মোটেও সহজ নয়। রোবটের প্রতিটি অঙ্গের জাড্যের অনুমান করে, গতিবিদ্যা এবং নিয়ন্ত্রণ শাস্ত্রের সূত্র মেনে তার প্রতিটি মোটরে কি পরিমাণে বিদ্যুৎ প্রবাহ হওয়া উচিত তার অনেক হিসাব কষেও একটি রোবটকে দিয়ে সুস্থির ও নিশ্চিতভাবে চলাফেরা করানো একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে সূত্রের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করে ক্রমাগত শিক্ষার মাধ্যমে রোবট এই দক্ষতা অর্জন করতে পারে। এই ব্যাপারে নিউরাল নেটওয়র্ক ও ডীপ লার্নিং খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু তার সঙ্গে আরেকটি ধারণাও মনে আসে – তা হল রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং (reinforcement learning) [২]।

এটি এমন একটি শিক্ষা পদ্ধতি যাতে রোবট কিছুটা তার পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং কিছুটা এলোমেলো ভাবে তার কর্ম নির্ধারণ করে। কোন কর্মের কেমন ফললাভ হচ্ছে সেই অনুযায়ী তার অভিজ্ঞতার সংশোধন হতে থাকে এবং ভবিষ্যতে কর্ম নির্ধারণের ধরণটিও পালটে যায়। এইভাবে ক্রমেই রোবট আরও আরও দক্ষ হয়ে ওঠে। এটি শিক্ষার খুবই কার্যকরী একটি পদ্ধতি, এবং আমরা এই ভাবেই অধিকাংশ দক্ষতা অর্জন করি। শুধু এতে শিক্ষার সময় লাগে প্রচুর। তাই সাধারণত প্রাথমিক কিছুটা শিক্ষা দেওয়া হয় সিমিউলেশন-এ (simulation), অর্থাৎ কমপিউটারে একটি মডেল বানিয়ে। তারপর বাস্তব জগতে রোবট সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কাজে নেমে পড়ে এবং ক্রমশ কাজের মধ্যে ভুল ভ্রান্তির থেকে শিখে দক্ষ হয়ে ওঠে। এই শিক্ষা কোনরকম তত্ত্বাবধান ছাড়াই চলতে থাকে। ভুল থেকে রোবটের যাতে কোনও ক্ষতি না হয় সেজন্য কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

আই এর ভবিষ্যৎ

আমাদের পরিবেশে এ আই-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হবে ড্রাইভার-বিহীন গাড়ি। ক্যামেরা ও রেঞ্জ সেন্সর দিয়ে আশপাশটা বুঝে নিয়ে এই গাড়ি নিজেই নিজের পথ দেখে এগিয়ে চলে। শুধু গন্তব্যস্থানটি বলে দিতে হয়। এর প্রযুক্তি প্রায় প্রস্তুত। একটু সীমিত ভাবে চালিয়েছেও এমন গাড়ি Google আর Uber। আরো কিছুটা সময় লাগবে একে আরও নির্ভরযোগ্য করে তোলার জন্য। এতে একটি বিশেষ সুবিধা হল এই যে প্রত্যেকটি যন্ত্রচালিত গাড়ি ট্র্যাফিকের নিয়ম মেনে সার্বিক নিরাপত্তার কথা ভেবে চলে, তাই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা যায় অনেক কমে।

এর পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় শিল্প রোবট, যা তার কর্মক্ষেত্রের মধ্যে সব কিছু দেখে শুনে বুঝে ঠিক করে কিভাবে আদিষ্ট কাজটি সুসম্পন্ন করবে। অনেক সময় মানুষের সাথে হাত মিলিয়ে তাকে কাজ করতে হয়। সেক্ষেত্রে মানুষ সহকর্মীর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিতে হয় রোবটকেই। এমন নমনীয় রোবট তৈরি হচ্ছে যা কাজের প্রয়োজনে যথেষ্ট বলপ্রয়োগ করতে পারে, কিন্তু মানুষ সহকর্মীর সাথে অপ্রত্যাশিত কোনও সংঘর্ষ হওয়ার পূর্বমুহূর্তে নিজেকে নরম করে ফেলে। এ আই-এর গোরার চিন্তাধারাগুলির উদ্ভব হয়েছে কম্পিউটার আবিষ্কারের কয়েক দশকের মধ্যেই। পরে তারা অনেক পরিমার্জিত ও পরিশোধিত হলেও এ আই-এর সাম্প্রতিক সাফল্যের মূলে আছে প্রধানত উন্নতমানের সেন্সর, কম্পিউটারের সামান্য আয়তন, গণনার তীব্র গতি, ও স্মৃতি ধারণের অসীম ক্ষমতা। মোবাইলের মাধ্যমে এ আই আজ আমাদের সবার জীবনকে বিভিন্ন মাত্রায় সমৃদ্ধ করেছে। কম্পিউটার যেমন ক্রমাগত ছোট ও দ্রুততর হয়ে চলেছে, তাতে আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের অনেক জিনিসের মধ্যেই তার অনুপ্রবেশ অবশ্যাম্ভাবি। পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেটে এর ব্যাবস্থাও আছে। এর পরিণতি কেমন হবে তা কল্পনা করা বেশ কঠিন। সব কার্যকলাপের মধ্যে অজস্র কম্পিউটার চিপ্স ও সেন্সর আমাদের ঘিরে থাকবে, সাহায্য করবে কাজ সুসম্পন্ন করতে। এতে কি আমাদের শ্বাসরোধ হয়ে আসবে? এখন এমন মনে হলেও, সময়ে হয়ত আমরা তার সাথে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষমতা ও উৎসাহ পাবো।

বস্টন ডাইনামিক্সের হিউম্যানয়েড ও ডগ রোবটের চলাফেরার দক্ষতা উল্লেখযোগ্য  (ছবির সূত্র)

শেষ পর্যন্ত এ আই এর থেকে আমরা কি চাইতে পারি? হিউম্যানয়েড রোবট, অর্থাৎ মানুষের মত চেহারার রোবট, যে আমার সঙ্গী হয়ে বিভিন্ন ব্যাপারে তথ্য বা পরামর্শ দিতে পারে, মুষড়ে পড়লে উৎসাহ দিতে পারে, অথবা কাজ করে সাহায্য করতে পারে। এর প্রথমটি অনেকটাই আয়ত্তের মধ্যে এসে গেছে। গুগল অ্যাসিস্টেন্ট, অ্যামাজনের অ্যালেক্সা, অ্যাপলের সিরি, বা মাইক্রোসফ্টের কোর্টানা এর পূর্বসূরি, যদিও এরা কম্পিউটারের আড়ালে থেকে কথা বলে। মানুষের মতন চেহারায় গুছিয়ে কথা বলে এমন রোবটও হয়েছে – যেমন অ্যামেরিকার সোফিয়া, জাপানের এরিকা ইত্যাদি। এদের ক্ষেত্রে কথার বিচক্ষণতার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল কথা বলার মানুষসুলভ ভঙ্গিমাটি আয়ত্ত করা। আই বি এমের প্রোজেক্ট ডিবেটারকে যদিও পরাজিত করলেন নামী তার্কিক হরিশ নটরাজন, কম্পিউটার যে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে কত প্রাসঙ্গিক তথ্য পরিবেশন করতে পারে তা দেখে সবাই মুগ্ধ [৩]।

এতো হল কম্পিউটারের যুক্তি, তর্ক আর গল্প করার ক্ষমতা। মানুষের মতন চলে ফিরে কাজকর্ম করার ক্ষমতা এখনও রোবটের হয়নি। বেশিরভাগ পরীক্ষামূলক রোবট নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কাজ করতে পারে। বস্টন ডাইনামিক্স অবশ্য বেশ কিছু রোবট বানিয়েছে যাদের চলাফেরার দক্ষতা লক্ষণীয়। তবে আমাদের সাথে সহবাস করার মতন রোবট এখনও তৈরি হয়নি। একসময় নিশ্চয়ই তৈরি হবে। তখন কি গল্পের মতন এই অসীম শক্তিশালী রোবটের দল মানুষের উপর আধিপত্য করতে পারে? এ বিষয়ে অনেক জল্পনা করা যেতে পারে। তবে রোবটকে যতই মানুষের মতন বা তার চেয়েও শক্তিশালী ও দক্ষ বানাই না কেন, সে শুধু আমাদের আদেশ মেনে চলবে। এখনও মানুষের চেতনা ঠিক কি, তা আমরা বুঝি না। এই চেতনার আলোতেই আমাদের ভাললাগা, ভালবাসা, ইচ্ছা, উচ্চাশা, আবেগ, সৃজনশীলতা, এমনকি দুঃখ, হিংসা, ঘৃণাও। যতদিন রোবটের চেতনা না হচ্ছে, রোবট আমাদের দাস হয়ে থাকবে। আমরা নিরাপদ। কিন্তু একই কারণে রোবটের ব্যক্তিত্বে সেই সমৃদ্ধি আসবে না যাতে সে আমাদের প্রকৃত সখ্যের আনন্দ দিতে পারে, আস্থা অর্জন করতে পারে।

প্রচ্ছদের ছবি: এ আই এর উপর জাতিসঙ্ঘের এক আলোচনাচক্রে অংশগ্রহণকারী হিউম্যানয়েড রোবট সোফিয়া (ছবির সূত্র)

কিছু রেফারেন্স:

[১] Krizhevsky, Alex & Sutskever, Ilya & Hinton, Geoffrey. (2012). ImageNet Classification with Deep Convolutional Neural Networks. Neural Information Processing Systems. 25. 10.1145/3065386.

[২] ‘Reinforcement learning: an introduction’ by Richard S. Sutton and Andrew G. Barto, MIT Press, 1992, 2018 (2nd Ed). [

৩] মানুষের সাথে যন্ত্রের তর্কের আশ্চর্য নমুনা দেখুন:

The post এ আই এর প্রকৃতি ও প্রয়োগ: ডীপ লার্নিং appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

পৃথিবীর জন্য অশনি সংকেত-মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত ?

$
0
0

পৃথিবীর দিকে ছুটে আসা বিভিন্ন ঘাতক গ্রহাণুগুলির উৎপত্তি কি? কীভাবেই বা তাদের মোকাবিলা করা যাবে? শ্রী কুমার কান্তি দত্তের কলমে ধরা পড়ল বিজ্ঞানীদের তা জানার ও পৃথিবীকে সুরক্ষিত রাখার প্রচেষ্টা।


হিংস্র মহাবিশ্ব

স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, “মহাবিশ্ব একটি হিংস্র জায়গা। নক্ষত্রগুলো গ্রহসমূহকে গ্রাস করে,মহাকাশ জুড়ে অতিকায় নবজ্যোতিষ্কগুলো প্রাণঘাতী রশ্মি ত্যাগ করে, কৃষ্ণগহ্বরগুলো একে অন্যের সাথে ধাক্কা খায়  এবং গ্রহাণুগুলো প্রতি সেকেন্ডে শত শত মাইল বেগে চারদিকে ধাবিত হয়।

অবশ্যই, মহাবিশ্বের এইসব ঘটনাবলি আমাদের আরও সতর্ক করে। পৃথিবীতে মানুষের বিলুপ্তি ঠেকাতে পুরোপুরি প্রযুক্তি সক্ষমতার সন্ধান করতে হবে। বিশেষ করে অন্য গ্রহে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি ও কারিগরি ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে হবে।

একটি গ্রহাণুর সংঘর্ষের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো প্রতিরক্ষা নেই।

সর্বশেষ এইরকম বড় সংঘর্ষ হয়েছিলো প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে এবং মনে করা হয় যে সেটি ডাইনোসরকে মেরে ফেলেছিলো এবং এটি আবার ঘটবে। এটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়, এটি পদার্থবিজ্ঞান এবং সম্ভাবনার সূত্রাবলি দ্বারা নিশ্চিত।

উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীমহল

গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার আশঙ্কার মগ্ন বিজ্ঞানীমহল। শঙ্কা যে আগে ছিল না তা নয়। প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে এখন প্রতিদিন চারটে গ্রহাণু আবিষ্কার হয়। এখনো পর্যন্ত প্রায় ১৯,০০০ মহাজাগতিক বস্তু চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলি খাতায়-কলমে পৃথিবীর জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে ৷ সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।

মহাকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এলন মাস্ক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন-বিশাল এক গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হেনে মানব সভ্যতা নিশ্চিহ্ন করে দেবে।

আমাদের হাতে তা ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। যদিও তাঁর এই উক্তিকে অনেক মহাকাশ বিজ্ঞানী স্বীকার করেন না। ইতিহাসের সাক্ষী আছে এমন অনেক ঘটনা। ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এক উল্কাপিণ্ডের আঘাতে বিলুপ্ত হয়ে যায় ডাইনোসর প্রজাতি।  ১৯০৮ সালের ৩০ জুন রাশিয়ার সাইবেরিয়ার গহীন জঙ্গলে বিশাল এক গ্রহানু আঘাত করেছিল, যার ফলে ৭৭০ বর্গকিলোমিটার বন পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরকম আরেকটি বড় গ্রহাণু রাশিয়ার চেলিয়াবিংক্সির আকাশের বায়ুমন্ডলে ঢুকে পড়েছিল।  তবে এটি পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু, বায়ুমন্ডলে প্রবেশের ফলেই এটি সূর্যের চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, আর তারই উত্তাপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় ৭ হাজার ইমারত, আহত হয়েছিল সহস্রাধিক মানুষ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে একটি বড় গ্রহাণু আমাদের পৃথিবীকে আঘাত করলে কী পরিমাণ ধ্বংসলীলীলা করবে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বলছেন গ্রহাণুর আঘাতে সৃষ্ট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্র্যাটার তারা খুঁজে পেয়েছেন মধ্য অস্ট্রেলিয়াতে।  তারা জানান ৩০০ মিলিয়ন বছর আগে ওয়ারবারটন জোড়া-গ্রহাণুর আঘাতে এরকম বিশাল গর্তের জন্ম হয়েছে। নতুন আবিষ্কৃত এই ক্র্যাটারের ব্যাস প্রায় ৪০০ কিলোমিটার।  দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্রেদফোর্ট ক্র্যাটারের চেয়ে ১০০ কিলোমিটার বড় এটি। গ্লিক্সন এবং তার দল এখনও জায়গাটা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। খুব শীঘ্রই তারা আরও নতুন তথ্য দিতে পারবেন বলে আশা করছেন। সুতরাং এলন মাস্কের ভবিষ্যদ্বাণী খুব অযৌক্তিক নয়।

ধাবমান ঘাতক

প্রতিদিনই পৃথিবীর দিকে অসংখ্য গ্রহাণু ধেয়ে আসে। তার বেশির ভাগই বায়ুমন্ডলের ঘর্ষণে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু, এমন কিছু বৃহৎ গ্রহাণু আছে, যা বায়ুমন্ডলের ঘর্ষণে জ্বলে শেষ হতে পারে না, ফলে তা পৃথিবীতে ভূপাতিত হয়, আর তার তীব্র গতিশীল পতনের ফলে ভূপৃষ্ঠে বিশাল গহবরও তৈরি হয়ে যায়।  আরো বড় গ্রহাণু হলে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পও হতে পারে। এই জন্য বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে বেশি সচেতন এইসব বিশাল গ্রহাণুর প্রতি। প্রতি মুহূর্তেই নজর রাখতে হয় কোনো গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে কি-না। এর জন্য নাসা দ্বিগুণ সচেতনতা অবলম্বন করছে। নাসা এখন এ ব্যাপারে অনেক সচেতন। আর তাই বলা হয়, নাসা যদি তাদের কার্যক্রম যথাযথভাবে অব্যাহত রাখে তাহলে মহাপ্রলয় হয়তো এতো ভয়ঙ্কর হবে না।

বিজ্ঞানীদের মতে বর্তমানে  ২ হাজার ‘পোটেনশিয়ালি হ্যাজারডাস অ্যাস্টরয়েডস’ (পিএইচএএস) রয়েছে। মিসরীয় বিশৃঙ্খলার দেবতা অ্যাপোপহিসের নামে নামকরণ করা একটি গ্রহাণু বিপজ্জনকভাবে পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করবে। ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১৯ হাজার মাইল দূর দিয়ে যাবে এ গ্রহাণুটি। ২০২৯ সালের ১৩ এপ্রিল আকাশজুড়ে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠবে। এখন ধীরে ধীরে তা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। এটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দেখা যাবে। এক হাজার ১০০ ফুট প্রশস্ত গ্রহাণুটির কারণে পৃথিবীতে ক্ষতির আশঙ্কা যদিও কম।  যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির গবেষক মেরিনা ব্রজোভিক বলেন, ২০২৯ সালে পৃথিবীর সন্নিকটে গ্রহাণু চলে আসার ঘটনা বিজ্ঞানের জন্য দারুণ একটি সুযোগ। অপটিক্যাল ও রাডার টেলিস্কোপ দিয়ে এটি পর্যালোচনা করা হবে। পৃথিবীর কাছ দিয়ে এত বড় আকারের গ্রহাণু অতিক্রম করার ঘটনা দুর্লভ। বিজ্ঞানীদের অভিমত, অ্যাপোপহিসের পৃথিবীতে প্রভাব ফেলার আশঙ্কা সামান্য।

২১৩৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রহাণু ‘বেনু’ পৃথিবীতে আঘাত হানবে।

কোনোভাবেই একে থামানো যাচ্ছে না। এমনটিই জানিয়েছে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। এটি পৃথিবীতে আঘাত হানলে ‘ভয়াবহ’ ক্ষতির আশঙ্কাও করা হচ্ছে।বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘বেনু’ ক্রমাগত পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। এর আকার যুক্তরাষ্ট্রের ‘এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং’-এর চেয়েও বড়। এর কার্যক্ষমতা এক হাজার ২০০ মেগাটন। ‘বেনু’ হিরোশিমা বোমের চেয়ে ৮০ হাজার গুণ বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম। নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রহাণু ‘বেনু’কে প্রতিরোধে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিও ব্যর্থ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিস্ফোরণ সর্বোত্কৃষ্ট উপায় হতে পারে। ‘বেনু’ ছাড়াও সম্ভাব্য পৃথিবী অভিমুখী গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তনের উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। এ জন্য ‘হ্যামার’ নামে মহাকাশযান তৈরি করা হচ্ছে। এই যানটি এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যাতে পৃথিবীমুখী গ্রহাণুকে অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে পারে। তবে এটি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পদার্থবিজ্ঞানী ডেভিড ডিয়ারবোন, ‘যদি কোনো গ্রহাণু ছোট হয় এবং যথাসময়ে জানা যায় তবে মহাকাশযান ব্যবহার করে একে প্রতিরোধ সম্ভব। তবে যথেষ্ট সময় হাতে না থাকলে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ছাড়া আর পথ থাকবে না।

পৃথিবীর প্রতিরোধ

পৃথিবীতে ধেয়ে আসা গ্রহাণুপুঞ্জ নাসা কীভাবে প্রতিরোধ করে এই নিয়ে একটি বিস্তৃত প্রতিরক্ষা কৌশল পকিল্পনা প্রকাশ করলো এই আন্তজার্তিক মহাকাশ সংস্থা নাসা। এই পকিল্পনাকে নাসা একটি বাস্তব রুপ দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এন ই ও (নিয়ার আর্থ অবজেক্টস)বা গ্রহাণুগুলোর আঘাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে অনেক পকিল্পনা তৈরি করেছেন। নাসার গবেষকেরা বলেন, নিয়ার আর্থ অবজেক্টগুলো সাধারণত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। ১৯৯৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫৫৬টি ঘটনা নাসা পর্যবেক্ষণ করেছেন। গবেষকেরা প্ল্যানেটারি ডিফেন্স কো-অর্ডিনেশন অফিস (পিডিসিও) নামের একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, যাঁর মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলো পৃথিবীর আশপাশে থাকা নিয়ার আর্থ অবজেক্টসের(এনইওস)ওপর নজরদারি করবে।যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই প্রকল্পের নাম দিয়েছেন  ” ন্যাশনাল নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট প্রিপারেডনেস স্ট্রাটেজি এন্ড অ্যাকশন প্ল্যান।”  নাসা এবং ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সী (ফেমা) এই প্রকল্পটির উপর আগামী ১০ বছর ধরে কাজ করবে।কিন্তু কোনো বিপজ্জনক গ্রহাণু প্রতিরোধ করতে মানুষ কতটা প্রস্তুত ? ইউরোপ ও অ্যামেরিকা সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছেন ৷ বিজ্ঞানীরা মূলত বিশেষ পাঁচটি উদ্দেশ্যে কাজ করছেন। 

প্রথম উদ্দেশ্যে পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহাণু সনাক্তকরণ, ট্র্যাকিং এবং চরিত্র বিশ্লেষণ করা, যুগ্মভাবে নুতন প্রচেষ্টাকে বাহবা দেয়া, বর্তমানের অনিশ্চয়তাকে কম করা।

নাসা গ্রহাণুগুলিকে আকাশে বিশ্লেষণ করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অনেক অবজারভেটরি তৈরি করেছে।

যেমন, টি ক্যাটালিনা স্কাই সার্ভে – টুসান (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা), টি পান-স্টারর্স ১ টেলিস্কোপ – মায়ায়, টি নেযেইসে স্পেস টেলিস্কোপ ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক বিভিন্ন দেশে। বেশ কয়েকটি মহাকাশ মিশনও গ্রহাণু দ্বারা পর্যবেক্ষণ করেছে। নয়ার শূমেকার মহাকাশযানটি ২০০১ সালে পৃথিবীর নিকটবর্তী একটি গ্রহাণু ইরোসে অবতরণ করে। তারপরে, মহাকাশযানটি ২০১১ সালে গ্রহাণু বেল্টে ভ্রমণ করেছিল এবং সেখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম বস্তু, ভেষ্টার কক্ষপথ এবং অধ্যয়ন করেছিল।  ভেস্তা এত বড় যে এটি একটি ছোট গ্রহের মতো। ২০১২ সালে ভেস্তা ছেড়ে দিয়ে গ্রহাণু বেল্টের সবচেয়ে বড় বস্তু, বামন গ্রহ সেরেসের চারপাশে কক্ষপথে চলে যায়।

২০১৬ সালে নাসা বেনু নামে পৃথিবীর নিকটবর্তী একটি গ্রহাণু অধ্যয়ন করতে এবং গ্রহাণুর নমুনা আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার জন্য ও এস আই আর আই এস – রেক্স মহাকাশযান চালু করেছিল। ২০১৮ সালে ও এস আই আর আই এস – আর এক্স বেন্নুর চারপাশে কক্ষপথে যায়। বেন্নু হ’ল মহাকাশযান দ্বারা প্রদক্ষিণ করা সর্বকালের সবচেয়ে ছোট পৃথিবী। ও সি আই আর আই এস -রেক্স বেন্নুর পৃষ্ঠতল অধ্যয়ন করে দু’বছর ব্যয় করবে, একটি নমুনা নেওয়ার জন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা খুঁজছেন।

দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটিতে, নিয়ার আর্থ অবজেক্টস বিশ্লেষণ, ভবিষ্যদ্বাণী এবং তথ্য একত্রিকরণ। এই সম্পর্কীয় সমস্থ তথ্য পৃথিবীর সমস্ত সংস্থা কে পূর্বাভাস দেবে-কোন গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানবে এবং কখন ও কোথায় আগত গ্রহাণুটি আঘাত হানতে পারে। ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট টিমস  “ ফেমা ” তৎক্ষণাৎ এই তথ্যের ভিত্তিতে কি করা যায় স্থির করবে।বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ও সরকারকে নিয়ে জরুরি মুহূর্তে বিশেষ ব্যবস্থা নেবে এবং পৃথিবীর ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে জানাবে। গ্রহাণুর আকার ও পৃথিবীতে এর প্রভাব বিবেচনা করে পৃথিবীকে সুরক্ষিত করার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্রহাণুর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মতো প্রকল্প।

নাসার গবেষকেরা জানিয়েছেন, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সঙ্গে মিলে তাঁরা গ্রহাণুর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তির ধারণা নিয়ে কাজ করছেন।

এই মিশন পরিচালনার জন্য অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার চেষ্টা করছে নাসা।  নাসার গবেষকেরা জানান, পৃথিবীতে যদি কোনো গ্রহাণুর আঘাত হানার মতো জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়, তবে ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি (ফেমা ), মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়ে কাজ করবে  পি ডি সি ও।

তৃতীয় উদ্দেশ্যটিতে, পৃথিবীর দিকে কোনো বড় আকারের মহাজাগতিক বস্তু এগিয়ে এলে, তাকে অন্য পথে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নাসাকে নতুন উপায় নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। রেপিড-রেসপন্স নিও ( নিয়ার-এঅর্থ অবজেক্ট ) রেকোননাইসেন্স মিশনস এর উদ্দেশ্যে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা। এই উদ্দেশ্যে  “ডবল অ্যাস্টেরয়েড রেডিরেক্শন টেস্ট ( ডার্ট ) মিশন তৈরি হয়েছে। জরুরি অবস্থা দেখা দিলে বিজ্ঞানীরা সংঘাত এড়াতে গ্রহাণুর গতিপথ পরিবর্তন করতে চান ৷ কয়েক টন ওজনের মহাকাশযান সেই কঠিন কাজ করতে পারবে, এমনটাই তাঁদের লক্ষ্য ৷ এমন যানের ভর তুলনামূলক ভাবে সামান্য হলেও সেটি গ্রহাণুর সঙ্গে অভিকর্ষের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে ৷ ফলে গ্রহাণুর গতিপথ কিছুটা হলেও বদলে যেতে পারে ৷ জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের অ্যালেন হ্যারিস বলেন, ‘‘এটি অত্যন্ত নিখুঁত এক পদ্ধতি ৷ গ্রহাণুর সঠিক অবস্থান জানা থাকে৷ কিন্তু গ্রহাণু ও মহাকাশযানের মধ্যে অভিকর্ষের টান খুব দুর্বল হওয়ায় সেটির গতিপথের সামান্য বিচ্যুতি সম্ভব ৷ ফলে গতিপথে বড় পরিবর্তনের জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন ৷”

দক্ষিণ জাপানের ওসুমি দ্বীপের তানেগাশিমা মহাকাশ কেন্দ্র থেকে ‘এইচ টু এ’ উৎক্ষেপণ ব্যবস্থায় ২০১৪ সালের ৩ ডিসেম্বর ‘হায়াবুসা ২’ উৎক্ষেপণ করা হয়। ২০১৮ সালের ২৭ জুন এসে পৌঁছায় গ্রহাণু রুগুর কাছে। শুরু হয় গবেষণার কাজ। ‘হায়াবুসা ২’-এর রয়েছে গোটা চারেক রোভার। ঠিক হয়েছে এরাই গ্রহাণুর চার জায়গায় নেমে নমুনা সংগ্রহ করবে, ছবি তুলবে। গ্রহাণুর উপর সফলভাবে আনম্যান্ড বা যন্ত্রচালিত রোভার নামাল জাপান।  হায়াবুসা-২ মহাকাশযান থেকে পৃথক হওয়ার পর সফলভাবে অবতরণ করেছে মহাকাশ অভিযানকারী রোবট বা রোভার দুটি।

মিনার্ভা-টু ১ নামের সেই দুটি রোভারই এখনও পর্যন্ত বিশ্বের প্রথম রোভার যা কোনও গ্রহাণুর উপর নামল।

সেই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, দুটি রোভারই ভালো অবস্থায় আছে এবং অবতরণের কিছু সময় পর থেকেই সেগুলি পৃথিবীতে ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন তথ্য এবং ছবি পাঠিয়েছে। একটি হীরক খণ্ডের মতো দেখতে রিয়ুগু গ্রহাণুতে প্রচুর খনিজ পদার্থ রয়েছে, যা কয়েক কোটি বছর আগে তৈরি হওয়া আমাদের সৌরমণ্ডলের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারবে। সেই তথ্য এবং ছবি নিয়ে ইতিমধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং গবেষণাও শুরু করে দিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। জাপানি ভাষায় ‘হায়াবুসা’ মানে বাজপাখি আর ‘রুগু’ হল জলের তলায় ড্রাগন রাজপ্রাসাদ। জাপানি উপকথায় জেলে উরাশিমা তারো সেই প্রাসাদ থেকে জাদুবাক্স নিয়ে আসে। ‘হায়াবুসা ২’ সাফল্য থেকে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে গ্রহণের উপর আঘাত আনতে পারবে অথবা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গতিপথ পরিবর্তন করতে পারবে।

মারণাত্মক মহাকাশযানের সাহায্যে গ্রহাণুর উপর আঘাত হানতে হবে এই উদ্দেশ্যে ২০২০ সালে নাসা এক পরীক্ষামূলক মহড়ার পরিকল্পনা করেছে৷ এটি চতুর্থ উদ্দেশ্য

ইউরোপীয় ও মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ‘ডিডিমস’ ও ‘ডিডিমুন’ নামের যমজ দুই গ্রহাণুর উপর হামলা চালাতে চলেছে৷

এই অভিযানের লক্ষ্য একটি মহাকাশযান গোটা প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে এবং গ্রহাণুর নমুনা সংগ্রহ করবে ৷ ৩৩০ কিলোগ্রাম ওজনের দ্বিতীয় একটি যান ‘ডিডিমুন’ গ্রহাণুর উপর হামলা চালাবে ৷ এ যেন মহাশূন্যে বিলিয়ার্ড খেলা ! এর ফলে দুই গ্রহাণুর গতিপথে কতটা পরিবর্তন ঘটবে? জার্মানির ফ্রাইবুর্গ শহরে অ্যার্নস্ট-মাখ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা এক হাই-স্পিড কামানের সাহায্যে মহাকাশে গোলা নিক্ষেপের পদ্ধতির সিমুলেশন বা নকল করছেন ৷ এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেলেপাথরের উপর কামান দাগা হচ্ছে ৷ মহাকাশের মতো এ ক্ষেত্রেও সেকেন্ডে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানা হচ্ছে ৷ বিস্ফোরিত পাথরের ধাক্কায় মারাত্মক সেই পালটা আঘাতের মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠছে ৷ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী ফ্রাংক শেফার বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে স্যাটেলাইটের আঘাতে স্পষ্টভাবে মোমেন্টাম ট্রান্সফার দেখা যাচ্ছে ৷ অন্যদিকে গ্রহাণুর নিজস্ব উপাদানের কারণে বাড়তি মোমেন্টাম ট্রান্সফার ঘটছে ৷ বিস্ফোরণের ফলে টুকরোগুলি আঘাতকারীর দিকে ধেয়ে যাচ্ছে ৷ এটা অনেকটা জেট ইঞ্জিনের মতো পেছনে ভর বার করে সামনে গতি বাড়ানোর মতো দৃষ্টান্ত ৷ তবে এই প্রক্রিয়ায় শুধু অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের শক্ত বস্তুকে কক্ষচ্যুত করা সম্ভব ৷ কিন্তু কোনো গ্রহাণুর মধ্যে অসংখ্য ছিদ্র থাকলে বা সেটির আকার বিশাল বড় হলে আঘাতের ইমপ্যাক্ট বা প্রভাব দুর্বল হয়ে যাবে ৷ গতিপথ পরিবর্তনের জন্য সবসময়ে হাতে বেশি সময় থাকবে না ৷ জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের অ্যালেন হ্যারিস মনে করেন, ‘‘ পৃথিবীর দিকে কোনো বড় আকারের মহাজাগতিক বস্তু এগিয়ে এলে এবং খুব দেরিতে তা টের পেলে আমাদের সর্বশেষ হাতিয়ার সম্বল করতে হবে৷ অর্থাৎ পারমাণবিক বোমা প্রয়োগ করতে হবে ৷ তবে ভাগ্য খুব খারাপ হলে ‘শটগান এফেক্ট’ দেখা যেতে পারে ৷ তখন বিস্ফোরণের ফলে গ্রহাণুটি ভেঙে চৌচির হবে এবং তার অসংখ্য টুকরো পৃথিবীর দিকে ধেয়ে যাবে ৷ তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে ৷”  আমরা কি এমন আঘাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে পারি ? অ্যালেন হ্যারিস ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘নিওশিল্ড’ নামের প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৷ এই মুহূর্তে এমন ‘গ্লোবাল কিলার’-এর হুমকি না থাকলেও তাঁর নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী প্রতিরক্ষার কৌশল সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত৷

পঞ্চম এবং শেষ উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে- এমন একটি পরিকল্পনা নিয়ে আসতে যা কার্যকর হবে যদি একটি বড় গ্রহাণু পৃথিবীর কে আঘাত হানে-বা যদি কোনও সতর্কীকরণ ছাড়াই পৃথিবী বিধ্বস্ত হয়।

এই রকম গ্রহাণু জরুরী পরিস্থিতিতে ফেমার ভূমিকা হবে প্রত্যেককে সর্তকতা জারি করা।

বিবর্ণ নীল বিন্দু

আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা মহাকাশে শক্তিশালী টেলিস্কোপ সংযুক্ত মহাকাশযান ভয়েজার:১ প্রেরণ করেছিল সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রের নিখুঁত ছবি পাওয়ার জন্য। ছয়শ কোটি কি. মি. দূর থেকে পৃথিবী গ্রহের একটি দুর্লভ ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই বিশাল মহাবিশ্বে পৃথিবীর অবস্থান যে কত ক্ষুদ্র তা প্রমাণিত হয়েছে।

সেই ছবিতে পৃথিবীকে মনে হচ্ছে একটি বিবর্ণ নীল বিন্দুর মতো।

মহাবিশ্বে বিন্দুসম এই গ্রহটি বর্তমানে ভয়াবহ রকমের অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।প্রচ্ছদের ছবি: NASA-DART Mission. NASA website. Artists’ imagination for future defence system.

The post পৃথিবীর জন্য অশনি সংকেত-মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত ? appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

মোবাইল অ্যাপে মেশিন লার্নিং

$
0
0

মেশিন লার্নিং, বর্তমানের এই বহুল চর্চিত বিষয় টিকে ব্যবহার করে কিভাবে আমরা আমাদের মোবাইল ফোনে বানিয়ে ফেলতে পারি দরকারি অ্যাপ্লিকেশন?


মেশিন লার্নিং এর আবির্ভাব 

স্বাভাবিকভাবেই পাঠক হয়ত ভাবছেন মোবাইল অ্যাপে মেশিন লার্নিং, হ্যাঁ, ঠিকই ভাবছেন, এখন আর কোন কিছুই অসম্ভব নয়। তথ্য প্রযুক্তির এই সময়ে আমাদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলেজেন্স। আর এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলেজেন্সের অন্যতম শাখা মেশিন লার্নিং। যারা ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে  পড়াশোনা করেছেন বা করছেন সবাই কম বেশি এই শব্দটির সাথে পরিচিত। সহজ কথায় বলতে গেলে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মেশিনকে শিখানো।

বর্তমান সময়ে সবথেকে বহুল ব্যবহৃত শব্দ মেশিন লার্নিং। হাতের স্মার্ট ওয়াচ হতে শুরু করে ঘরের স্মার্ট টিভি, সবকিছুতেই পাওয়া যায় মেশিন লার্নিং এর নিত্য নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া। প্রযুক্তি নির্ভর এই পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কারে ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলেজেন্স। বিগত কয়েক বছর ধরে সারা বিশ্বে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলেজেন্স এর অন্যতম শাখা মেশিন লার্নিং তার ডাল পালা ছড়িয়েছে বিস্ময়করভাবে। সবাই যেখানে প্রতিনিয়ত মেশিন লার্নিং এর সুফল ভোগ করছে, সেইখানে মেশিন লার্নিং এর এলগরিদমগুলোকে কিভাবে আরও সহজ করে, সর্বত্র ব্যাবহারকারির উপযোগী করে তৈরি করা যায় তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বের নামী দামী টেক জায়েন্টরা (গুগল, অ্যামাজন, অ্যাপল, স্যামসাঙ, হুয়াওয়ি এবং আর অনেকে)। মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে আপনি সহজেই অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশনের (OCR) এর মাধ্যমে সহজেই ছবি থেকে অক্ষর, এবং অক্ষর থেকে শব্দ চিহ্নিত করতে পারবনে। এতে করে কিন্তু মোবাইলেই মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে অফলাইনেই বিদেশি ছবির বাংলা অর্থ বের করা ফেলা সম্ভব। শুধু তাই না, অফলাইন ট্রান্সলেশন, টেক্সট ক্লাসিফিকেশন থেকে শুরু করে ভয়েস সিনথেসিসসহ প্রয়োজনীয় আরও অনেক কিছুই  এই মেশিন লার্নিং এর দ্বারা করা সম্ভব। চিত্র ১ এ মানুষের মস্তিস্ক এবং মেশিনের শেখাকে একত্রে করে দেখানো হয়েছে।

ছবি ১: মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিনের শেখা (সূত্র)

বইয়ের পাতায় বা ইন্টারনেটে সবাই হয়তো কম বেশি মেশিন লার্নিং সম্পর্কে জেনেছেন বা পড়েছেন, কেউ কেউ হয়তো নিজের গবেষণার জন্য ব্যবহারও করেছেন। কিন্তু কেউ কি কখনো, বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য নিজের মোবাইলে মেশিন লার্নিং এলগরিদম প্রয়োগ করেছেন বা চেষ্টা করেছেন কিভাবে আমরা মোবাইলে অ্যাপ্লিকেশান এ মেশিন লার্নিং এলগরিদম নিয়ে কাজ করতে পারি। না করলেও কোন সমস্যা নেই, আমার এই লেখাটি তাদের জন্যই বেশি প্রয়োজন, যারা মেশিন লার্নিং এর তাত্ত্বিক বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন কিন্তু সঠিক নির্দেশনার অভাবে কখনো এই  তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর বাস্তব প্রয়োগ করতে পারেননি।

এজন্য, মেশিন লার্নিং কে শুধুমাত্র বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, বাস্তবে এর ব্যবহার সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আমার এই ছোট প্রয়াস আমি যার নাম দিয়েছি “মোবাইলে অ্যাপে মেশিন লার্নিং”। জেনে রাখা ভালো, মেশিন লার্নিং এলগরিদমগুলো কিন্তু অনেক জটিল গাণিতিক সমীকরণের সমন্বয়য়ে তৈরি। তবে হ্যাঁ, আমি কিন্তু কোন জটিল সমীকরণের সূত্র আজ লিখব না। যেহেতু, এটি সকল পাঠকদের জন্য লেখা, তাই আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি যতটুকু সম্ভব আমার সহজ সরল লেখনীর মাধ্যমে আপনাদের বোধগম্য করে তোলা। তাহলে, শুরু করা যাক।

বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং মেশিন লার্নিং

ভালো হয় যদি একটা গল্প দিয়ে শুরু করি, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি কনফারেন্সে রিসার্চ পেপার উপস্থাপনার জন্য পর্তুগাল গিয়েছিলাম, সেখানে বেশ কিছু জায়গাতে আমাকে তাদের ভাষা বুঝতে হোঁচট খেতে হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই রেস্তোরা, ট্যাক্সি, রাস্তার লেন, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিখ্যাত জায়গাগুলোর বিবরণ, আমাকে গুগলের সাহায্য নিয়ে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে হয়েছিল। কিন্তু, এর জন্য আমাকে প্রতিটা মুহূর্তের ছবি প্রসেস করার জন্য গুগলের  সার্ভারে পাঠাতে হয়েছে, যেটা ছিল বেশ সময় সাপেক্ষ এবং ব্যয় বহুল।


ছবি ২: মোবাইলে মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করার জন্য ফায়ারবেস এমএল কিট  (সূত্র)

স্বাভাবিকভাবেই চিন্তা করলাম প্রতিবারে সম্পূর্ণ ছবিটাকে প্রসেস না করে যদি ছবির শব্দটাকে সার্ভারে পাঠানো যেত বা যদি আমার মোবাইলে পর্তুগিজ শব্দগুলোর বাংলা অর্থের ডাটাবেস থাকতো যেটি আমার লোকাল মেশিনে ইনট্রিগ্রেট করা থাকতো , তাহলে একই সাথে মোবাইল ডেটা এবং প্রসেসিং টাইম দুটোরই প্রয়োজনীতা কমে আসতো। যেই ভাবনা সেই খোজা, খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম সম্প্রতি মেশিন লার্নিং ডেভেলপারদের জন্য গুগল উন্মুক্ত করেছে অতি কাঙ্ক্ষিত ML Kit for Firebase []। যেখানে গুগল মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপারদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, যাতে করে তারা তাদের অ্যাপ্লিকেশানে মেশিন লার্নিং Mobile SDK (Software Development Kit) [] ব্যবহার করে বাস্তব সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে। এতে করে কিন্তু সবচেয়ে বড় উপকার গুগলেরই হয়েছে। কারন, মানুষ যদি  মোবাইলেই মেশিন লার্নিং এর কাজটা করে ফেলতে পারে তাহলে কিন্তু গুগলের সার্ভারের উপর চাপ অনেকাংশে কমে আসবে। আর তাছাড়া, কিছু সংবেদনশীল তথ্য বা ছবি যা হয়ত আপনি কখনোই চাইবেন যে, আপনার মোবাইলের বাইরে কোথাও থেকে যাক। সেদিক থেকেও কিন্তু এটা বেশ কাজের।‌উপরোক্ত চিত্র ২ এ এমএল কিটের একটি ছবি দেখানো হলো মডেল হিসেবে।

সবথেকে মজার বিষয় হচ্ছে, মেশিন লার্নিং এ আপনার পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও, গুগলের এই প্যাকেজটি ব্যবহার করে, আপনি খুব সহজেই আপনার নিজের বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য মোবাইল আপ্লিকেশন তৈরি করতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশান তৈরি করাটা কিন্তু জানতে হবে।

যেভাবে কাজ করবে মেশিন লার্নিং?‌

Google Cloud Vision API (Application Programming Interface), TensorFlow Lite [৩], এবং Android Neural Networks API একত্রে একটি একক SDK হিসেবে কাজ করবে যেটি আপনার নিজস্ব অ্যাপ্লিকেশান এ মেশিন লার্নিং এর বিভিন্ন মেথড অ্যাপ্লাই করতে সাহায্য করবে। সুবিধা হিসেবে আপনি একই সাথে গুগলের ক্লাউড সার্ভিস, রিয়েল টাইমে মোবাইলে অপটিমাইজড অ্যাপ্লিকেশান ডেপলয়মেন্ট, এবং কাস্টম TensorFlow Lite Models ব্যবহার করার সুযোগ পাবেন। চিত্র ৩ এর সূত্র ধরে এগিয়ে গেলে খুব সহজেই বিস্তারিত জানতে পারবেন। কথাগুলো মনে হয় বেশ জটিল লাগছে, আচ্ছা সহজ করে বলছি। গুগলের তৈরি Machine Learning (ML) Kit [৪] কে মূলত ব্যবহার উপযোগী API হিসেবে তৈরি করার জন্য বেশ কিছু বহুল  নিত্য প্রয়োজনীয় ফিচার যেমনঃ টেক্সট রিকগনেশন, ফেস ডিটেকশন, বারকোড স্ক্যানিং, ইমেজ লেবেলিং, ল্যান্ডমার্ক রিকগনেশন, ল্যাঙ্গুয়েজ রিকগনেশন, স্মার্ট রিপ্লাই, এবং কাস্টম মডেল ইনফারেন্স অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে আশা রাখছি। চলুন উদাহরন দিয়ে প্রতিটা API সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করি।

ছবি ৩: বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্বলিত এমএল কিটের মডেল (সূত্র)

টেক্সট রিকগনিশন

ছবি ৪: জার্মান ভাষায় লিখিত একটি বাক্য (সূত্র)

‌একটু ভেবে দেখুন তো আপনাকে হয়তো প্রায়ই ক্রেডিট কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক রিসিপ্ট, বিসনেজ কার্ড বা জন্ম নিবন্ধন নাম্বার কোথাও না কোথাও ইনপুট দিতে হয়, কেমন হতো যদি শুধুমাত্র মোবাইল অ্যাপ্লিকেশান এর মাধ্যমে এই বিরক্তিকর কাজটি করা যেত। আপনার এই সমস্যার সমধানের জন্যই গুগল তার মেশিন লার্নিং কিটটি ডিজাইন করেছে। Text Recognition API এর মাধ্যমে আপনি যেকোন ল্যাটিন বেইসড ল্যাঙ্গুয়েজ এর টেক্সটকে রিকগনাইজ করতে পারবেন। পাশাপশি, এর ক্লাউড বেইজ API এর মাধ্যমে ছবি থেকেও টেক্সট রিকগনাইজ করতে পারবেন। মজার বিষয় হলো, রিয়েল ওয়ার্ল্ড অবজেক্ট যেমন ধরুন, ট্রেনের গায়ে লিখিত নম্বরও আপনি এই API টি ব্যবহার করে বের করতে পারবেন। একটু একটু বোঝা যাচ্ছে মনে হচ্ছে। নিচের চিত্র ৪ এ জার্মান ভাষার এই উদাহরণটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

ফেইস ডিটেকশন

ছবি ৫: ফেস ডিটেকশন প্রক্রিয়া মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে  (সূত্র)

আমরা যারা প্রচুর সেলফি এবং পোটরেট ছবি তুলতে পছন্দ করি তাদের জন্য গুগল নিয়ে এলো মোবাইল অ্যাপ্লিকেশান ভিত্তিক ফেস ডিটেকশন API। এর মাধ্যমে খুব সহজেই আপনি ছবি থেকে আপনার কাঙ্ক্ষিত ফেইসটি খুঁজে বের করতে পারবেন ,সাথে সাথে আপনি সেই ফেইসটির ফিচার এবং তার মুখমণ্ডলের পারিপার্শ্বিক গঠনও পেয়ে যাবেন। আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, গুগল তার ফেইস ডিটেকশন কিটটিকে এমনভাবে তৈরি করেছে যা খুব সহজেই রিয়েল টাইমে ভিডিও চ্যাট বা গেমস খেলার সময় ব্যবহারকারীর অভিব্যক্তি বা এক্সপ্রেশন ধারণ/ ডিটেক্ট করতে সক্ষম। আশা রাখছি পুরো বিষয়টি চিত্র ৫ দেখলে আপনার কাছে বেশ পরিষ্কার হয়ে যাবে।

বারকোড স্ক্যানিং

ছবি ৬: একটি কিউ আর কোডের ছবি (সূত্র)

আপনি হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, প্রায়শই আপনাকে হয়তো দোকানগুলোতে কিছু ক্রয়ের পরে বিকাশ, আই-পে, রকেট বা অন্য যেকোন বিল পে সার্ভিস গুলোর সাহায্য নিয়ে আপনাকে বিল পে করতে হয়। আর এই বিল পে করতে গিয়ে আপনি তাদের QR (Quick Response) কোড স্ক্যান করে থাকেন, চিত্র ৬ এ যেভাবে দেখানো হয়েছে, ঠিক সেইভাবে। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওয়াই-ফাই এক্সেস করতে গেলেও আপানকে বারকোড (Bar Code) বা QR কোড স্ক্যান করার প্রয়োজন হয়।খুব স্বাভাবিকভাবেই ,মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ছবি তুলে সার্ভারে পাঠিয়ে প্রসেস করা বেশ সময়সাপেক্ষ, তার থেকেও বড় সমস্যা আপনাকে সর্বদা ইন্টারনেট এর সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে, সেটা সবসময় সম্ভব নাও হতে পারে। তাই, এই সমস্যা সমাধানের জন্য QR কোডের মতো 2D ফর্ম্যাট এবং বার কোড স্ক্যান করার জন্য গুগলের বার কোড স্ক্যানিং API  হতে পারে গ্রহণযোগ্য সমাধান, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই ডেটা সনাক্ত এবং পার্স করতে পারে, পাশাপাশি,  ব্যবহারকারী যখন বারকোড স্ক্যান করবে তখন বুদ্ধিমত্তার সহিত সাড়া দিতে পারে।

ইমেজ লেবেলিং

ছবি ৭: ইমেজ লেবেলিং এর বাস্তব উদাহরণ (সূত্র)

ইমেজ লেবেলিং API খুবই মজার এক আবিষ্কার গুগলের। একই সাথে মোবাইল ডিভাইস এবং ক্লাউড ,দুই ধরনের API এর সুবিধা রয়েছে এই ইমেজ লেবেলিং API টিতে। ব্যবহারকারী খুব সহজেই একটি ছবি থেকে আলাদা আলাদা ভাবে মানুষ, জায়গা, বস্তু, বিভিন্ন ধরণের এক্টিভিটি, এবং আরও অনেক কিছু খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে। উল্লেখ্য, লেবেলিং করার সাথে সাথে মোবাইল অ্যাপ প্রতিটি লেবেলে আপনাকে একটি স্কোর দেখাবে যেটি নির্দেশ করবে মেশিন লার্নিং মডেলটি কতটা সফলতার সাথে লেবেল ডিটেক্ট করতে সক্ষম হয়েছে। ইন ডিভাইস APIটি যেখানে ৪০০ এর বেশি লেবেল সাপোর্ট করে সেখানে ক্লাউড API টি ১০, ০০০ এর বেশি লেবেল চিনতে সক্ষম। চলুন, একটি উদাহরন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। পাশের ছবিটিকে আমরা লেবেলিং করার চেষ্টা করেছিলাম, একি সাথে ইন ডিভাইস এবং ক্লাউড এর মাধ্যমে API এর মাধ্যমে। ফলাফল আপনারাই দেখুন চিত্র ৭ এর মাধ্যমে।

ল্যান্ডমার্ক রিকগনেশন

ছবি ৮: ল্যান্ডমার্ক রিকগনেশন প্রক্রিয়া (সূত্র)

আমাদের দেশের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন হলো লালবাগ কেল্লা। স্বাভাবিকভাবেই দেশের ভিতর এবং বাহির হতে বহু পর্যটক প্রতিনিয়ত এই অপরূপ নিদর্শন প্রত্যক্ষ করতে আসেন। পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন, লালবাগ কেল্লার সাথে ল্যান্ডমার্ক রিকগনেশনের কি সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে বলেই তো লিখছি, গুগল তার ল্যান্ডমার্ক রিকগনেশন API টির মাধ্যমে একটি ইমেজ থেকে বহুল পরিচিত স্থাপত্য বা নিদর্শন সমূহকে ল্যান্ডমার্ক বা ঐ নির্দিষ্ট জায়গার বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করে, যেমনটা চিত্র ৮ এ বোঝানো হয়েছে। পাশাপাশি ঐ জায়গা সমূহ থেকে ল্যান্ডমার্কটির ভৌগোলিক স্থানাক (Geographic Coordinate) এবং কোন এরিয়াতে এবং কোন দেশে ল্যান্ডমার্কটি রয়েছে সেটিও ব্যবহারকারীকে নিমিষেই জানিয়ে দেয়। এখনো পর্যন্ত ক্লাউড API হিসেবে এটি কাজ করছে, খুব শীঘ্রই মোবাইল API হিসেবেও এটি কাজ শুরু করবে বলে জানিয়েছে গুগল।

ল্যাঙ্গুয়েজ আইডেনটিফিকেশন

‌১০০র বেশি ভাষা সাপোর্ট নিয়ে গুগলের আরেকটি চমৎকার API হলো ল্যাঙ্গুয়েজ আইডেনটিফিকেশন। এর মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই টেক্সট থেকে ভাষাকে আলাদা করতে পারবেন। রোমানাইজ টেক্সট যেমন এরাবিক, বুল্গেরিয়ান, গ্রীক, জাপানীস, রাশিয়ান, এবং চাইনিজ টেক্সট থেকে ন্যাটিভ, পাশাপশি, রোমানাইজ স্ক্রিপটেও টেক্সট সনাক্ত করতে সক্ষম। আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাতেও কিন্তু আমরা টেক্সট থেকে ভাষা সনাক্ত করার সুযোগ পাচ্ছি। এই জন্য গুগল কিন্তু একটা ধন্যবাদ পেতেই পারে।

স্মার্ট রিপ্লাই

‌মেশিন লার্নিংকে ব্যবহারকারীর কতটা কাছে নিয়ে আসা যায় তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে স্মার্ট রিপ্লাই। আপনি  কি  কখনো খেয়াল করছেন জিমেইল কিভাবে তার ইউজারকে স্মার্ট রিপ্লাই সার্ভিস ব্যবহার করাচ্ছে। আপনি নিজেও হয়তো ব্যবহার করেছেন মনের অজান্তেই। আবার কেউ কেউ হয়তো জেনে শুনেই ব্যবহার করেছেন। এবার গুগল সেই সার্ভিসকেই ব্যবহারকারীর আরোও কাছাকছি নিয়ে আসার জন্য মোবাইল অ্যাপ্লিকেশান এর মধ্যে নিয়ে আসলো স্মার্ট রিপ্লাই। ML Kit’s Smart Reply API এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনি আপনার জন্য আসা মেসেজের প্রাসঙ্গিক উত্তর প্রদান করতে পারবেন। এতে করে আপনার সময় বাঁচবে, পাশাপাশি কোন মেসেজের উত্তর কেমন হওয়া উচিত সেটা সম্পর্কেও ধারনা পেতে পারবেন। সমস্যা হিসেবে থাকছে, মেসেজের রিপ্লাই সাজেশন, অডিয়েন্স  অনুযায়ী বেশ ভিন্নতা দেখতে পাবেন। বর্তমানে এটি শুধুমাত্র ইংরেজী ভাষাতেই রিপ্লাই প্রদান করতে সক্ষম।‌

কাস্টম মডেল

‌টেক জায়ান্ট গুগল যে কত কিছু রেখেছে আপনার জন্য, আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। আপনি যদি মনে করেন মেশিন লার্নিং এর পূর্ব নির্ধারিত মডেল নিয়ে কাজ করবেন না, তাহলে আপনি TensorFlow Lite মডেল নিয়েও কাজ করতে পারেন। হয়তো আপনি এটাই ভাবছেন, TensorFlow Lite মডেলটা আবার কি বিষয়? আগেই বলেছি, একের পর এক চমক রেখেছে গুগল আপনার জন্য। তো চলুন জেনে আসি, যারা ডিপ লার্নিং নিয়ে কাজ করেন তারা হয়তো জেনে থাকবেন টেনসর ফ্লো হল একটি ওপেন সোর্স ডীপ লার্নিং বেইস ফ্রেমওয়ার্ক । স্বাভাবিকভাবেই ডীপ লার্নিং এ কাজের জন্য প্রচুর গাণিতিক হিসাব এর প্রয়োজন হয়, পাশাপাশি দ্রুত প্রসেসিং ক্ষমতা এবং GPU/CPU (Graphics/Central Processing Unit) এর সাপোর্ট প্রয়োজন। এই সমস্ত সুবিধা একত্রে প্রদান করার জন্য গুগল তৈরি করলো তাদের নিজস্ব ডিপ লার্নিং ফ্রেমওয়ার্ক টেনসর ফ্লো। কিন্তু তাহলে মোবাইলের জন্য কি হবে, মোবাইলে তো এতো মেমরি বা প্রসেসিং ক্ষমতা নেই, যে ভাবা সেই কাজ, সাথে সাথে গুগল তৈরি করলো TensorFlowমোবাইল ভার্সন যার নাম দিলো TensorFlow Lite । যার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইব্রেরীর সাইজটিকে অনেক ছোট করে আনা, যাতে অ্যাপগুলোতে সহজেই ব্যবহার করা যায়। আর লাইট দিয়ে কোন অ্যাপ বানালে অ্যাপ এর সাইজ যেমন কমে আসবে, তেমনি অ্যাপ দ্রুতগতিরও হবে। পাঠক এখনো কিন্তু শেষ হয়নি, আপনাদের যদি না দেখাতে পারি কিভাবে TensorFlow Lite  দিয়ে কাস্টম মডেল কাজ করে তাহলে এই লেখাটি কিন্তু বৃথা হয়ে যাবে।‌

TensorFlow Lite এর মাধ্যমে ইমেজ ক্লাসিফিকেশন ‌কেমন হতো যদি আপনি আপনার মোবাইল এর ক্যামেরার মাধ্যমে রিয়েল টাইমে অসংখ্য ইমেজকে ক্লাসিফাই করতে পারতেন? যেখানে লাগতো না কোন সার্ভার এর সাহায্য বা ইন্টারনেট কানেকশন। আপনি আপনার মোবাইলের অ্যাপ্লিকেশান এর মাধ্যমেই সনাক্ত করতে পারতেন সব ধরনের ইমেজ । নিশ্চয়ই ভাবছেন এও কি সম্ভব, আগে না দেখা কোন বস্তু কিভাবে আপনার মোবাইল অ্যাপ সঠিকভাবে সনাক্ত করতে পারে? নিম্নের চিত্র ৯ এর ছবিটি কিন্তু আমার নিজের মোবাইল থেকে তোলা , অবাক হচ্ছেন, মাউসটি কিন্তু আমার নিজেরই। আপনাদের দেখানোর জন্যই নিজেই TensorFlow Lite এর মাধ্যমে একটা অ্যাপ এর কাস্টম মডেল তৈরি করে ফেললাম [৫]। এভাবে, আপনার নিজের ডিভাইসের ব্যাক ক্যামেরা ব্যবহার করে আপনি নিজেও ক্লাসিফাই করতে পারবেন এরকম অসংখ্য ছবিকে আর TensorFlow Lite আপনাকে সাহায্য করবে এমন সব মোবাইল আপ্লিকেশন তৈরি করতে। আপনাদের ‌সুবিধের জন্য একটি ভিডিও লিঙ্ক [৬] সংযুক্ত করে দিলাম,যাতে করে খুব সহজেই আপনি বুঝতে পারেন.।

সঙ্গত কারনেই লিখাটি সাধারণ পাঠকের পাঠ্য উপযোগী করে লেখা হয়েছে, যাতে করে তারা উৎসাহ পায়  এবং পরবর্তীতে কিভাবে মেশিন লার্নিং টুলকিট ব্যবহার করে মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপ করতে হবে তার সম্মুখ ধারনা লাভ করতে পারে। পাঠকের জন্য আলোচ্য বিষয়বস্তু গুলোকে বাস্তব রূপে তুলে ধরার প্রয়াসে রেফারেন্স অংশে একটি ভিডিও লিঙ্ক দেয়া রইলো [৭]।

ছবি ৯: TensorFlow Lite এর মাধ্যমে ইমেজ ক্লাসিফিকেশন এর মোবাইল অ্যাপ

পরিশেষে বলবো, আমি মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ নই, আপনাদের মতো আমিও প্রতিদিন নতুন নতুন বিষয় শিখছি। বাংলা ভাষায় মেশিন লার্নিং এর বিষয়গুলো উদাহরণ দিয়ে আপনাদের সামনে তুলে ধরার একটাই কারন, আপনারা যেন পরবর্তী সময়ে এই বিষয়গুলো বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারেন এবং মেশিন লার্নিং এর সুফল সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস তখনি সার্থক হবে যখন সাধারন পাঠক এবং মেশিন লার্নিং এ আগ্রহী সকলে নিজেরদের প্রজেক্টে আমার লেখনীর বিষয়গুলো নিয়ে বাস্তব সমস্যার সমাধানে কাজ করবে। ভবিষ্যতে আবারো আপনাদের সামনে আসার প্রত্যয় নিয়ে আজ এ পর্যন্তই।

প্রচ্ছদের ছবি: সম্রাট কুমার দে

টীকা :

[১] https://firebase.google.com/docs/ml-kit

[২] https://developer.android.com/studio/releases/sdk-tools

[৩] https://www.tensorflow.org/lite

[৪] https://developer.android.com/ml

[৫] https://github.com/samratkumardey/TensorFlow_lite_ObjectDetection_android

[৬] https://www.youtube.com/watch?v=QwHD36bhXZA (ML Kit: Machine Learning for Mobile with Firebase )

[৭] https://www.youtube.com/watch?v=bTSWzddyL7E (ML Kit: Machine learning for mobile developers)

The post মোবাইল অ্যাপে মেশিন লার্নিং appeared first on বিজ্ঞান - বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের এক বৈদ্যুতিন মাধ্যম (An online Bengali Popular Science magazine).

Viewing all 311 articles
Browse latest View live


<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>